বেশ কয়েকদিন আত্মীয় বন্ধুদের নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে নবীনকুমার এক সময় আবার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। তার আর বিপদাশঙ্কা রইলো না বটে, কিন্তু শরীর একেবারে বিছানার সঙ্গে লীন। জন্মের পর থেকে নবীনকুমারের কখনো কোনো গুরুতর পীড়া হয়নি। এই এক অসুখেই সে একেবারে কাহিল।
কয়েকদিন প্রবল জরে সে পুরোপুরি চৈতন্যহীন হয়ে ছিল, জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে কানে ঠিক মতন শুনতে পায় না। যারা কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের কণ্ঠস্বরও যেন ভেসে আসে বহু দূর থেকে। নবীনকুমার ভাবে, সে কি তবে বধির হয়ে যাচ্ছে? তার হাত পা সরু কাঠি কাঠি, উঠে বসার শক্তি নেই, সে কি অথর্ব হয়ে থাকবে বাকি জীবন! তার চক্ষে জল আসে। সারাদিন ধরে বারবার ওষুধ পথ্য সেবনে তার মুখ বিস্বাদ, কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
এই রকম ভাবে আরও সপ্তাহাধিক কাল কাটার পর সে কিছুটা শারীরিক শক্তি ফিরে পেল। কিন্তু তার শ্রবণক্ষমতা সেই রকম দুর্বল হয়েই রইল। সারাদিন নানা জন তাকে দেখতে আসে, অনেক রকম প্রশ্ন করে, কিন্তু নবীনকুমার তার কিছুই প্রায় বুঝতে পারে না। বারবার অ্যাঁ? অ্যাঁ? করতে করতে সে নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং শয্যার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সে গম্ভীর হয়ে থাকে।
এই ব্যাধিতে তার একটি মাত্র লাভ হলো, সে তার দ্বিতীয়া পত্নী সরোজিনীর সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হলো। সরোজিনী সর্বক্ষণ ছায়ার মতন থাকে তার শিয়রের কাছে। এই বালিকাটির প্রতি নবীনকুমার এতদিন বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। এখন সে দেখলো, সরোজিনী আর বালিকাটি নেই, কবে যেন হঠাৎ সে কিশোরী হয়ে গেছে। তার শরীরে এসেছে লজ্জা, তার বক্ষে উঠেছে ঢেউ। নবীনকুমারের সঙ্গে চোখাচে্যুখি হলেই সরোজিনী নিজের চক্ষু নত করে। অথচ অন্য সময় নবীনকুমার অনুভব করতে পারে যে, সরোজিনী নির্নিমেষে তার দিকেই চেয়ে আছে।
সরোজিনীর কথা একেবারেই শুনতে পায় না। নবীনকুমার। সরোজিনী এমনিতে বেশী কথা বলেও না, যা বলে তাও অতি মৃদুস্বরে। একদিন সকালে পিঠে বালিশের ভর দিয়ে আধো-বসা হয়ে নবীনকুমার একটি গ্রন্থ পাঠ করার চেষ্টা করছে, সরোজিনী তাকে কী যেন বললো। নবীনকুমার কিছুই বুঝতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, তোমরা এমন নিচু গলায় কতা কও কেন? আমি এক বর্ণ বুঝতে পারি না। একটু জোরে বলো!
সরোজিনী বললো, মা কালীঘাটে চলে গ্যাচেন, আপনি তখন ঘুমুচ্চিলেন, তাই আপনার সঙ্গে দ্যাকা করে যেতে পারেননি কো।
নবীনকুমার সরোজিনীর ওষ্ঠ নাড়া দেখলো, কিন্তু কোনো কথাই তার কর্ণে প্রবিষ্ট হলো না। সে বললো, আরও কাচে এসো, আরও জোরে বলো! আমি কিচু শুনতে পাচ্চিনি যে!
সরোজিনী কাছে এগিয়ে কথাগুলি পুনবার উচ্চারণ করলো। নবীনকুমার এবার কিছু শব্দ শুনতে পেল মাত্র, কিন্তু সে সব শব্দের কোনো মর্ম তার বোধগম্য হলো না।
সে বললো, আরও কাচে এসো। আমার কানে মুক লাগিয়ে বলে!
সরোজিনী চকিতে একবার পিছনের দিকে তাকালো। ঘরে অন্য কেউ নেই, ঘরের বাইরে একজন ভৃত্য বসে আছে, কিন্তু সে শিয়রের এ দিকটা দেখতে পাবে না।
সরোজিনী তার স্বামীর এক কানে ওষ্ঠ স্থাপন করে বেশ জোরে বললো কথাগুলো। এবার নবীনকুমার শুনতে পেল স্পষ্ট। সে খুশী ও বিস্মিত হলো।
সে জিজ্ঞেস করলো, কালীঘাটে, কেন, মা হঠাৎ কালীঘাটে গ্যালেন কেন?
সরোজিনী বললো, বাঃ, কাল রাতে মা আপনাকে সব বললেন না? আপনার অসুকের সময় মা আপনার নামে কালীঘাটে জোড়া পাটা মানোত করেচিলেন।
সরোজিনী একটু সরে গিয়েছিল, নবীনকুমার বললো, আবার দূর থেকে বলচো! কানে কানে না। বললে আমি শুনতে পাই না। কানে কানে বলে!
কাল রাতে মায়ের সঙ্গে কি কথাবার্তা হয়েছিল তা নবীনকুমার একটুও বুঝতে পারেনি। সে অবশ্য কালীঘাটে পুজো দেবার ব্যাপার নিয়ে আর কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলো না। সে বললো, আজ আমায় ভাত খেতে দেবে তো? বড্ড খিদে পেয়েচে! গরম গরম ভাত, এক পলা গাওয়া ঘি, নুন, আর আলু সেদ্ধ খাবো। আর মাগুর মাছের ঝোল খাবো!
সরোজিনী বললো, আপনাকে ভাত দেওয়া হবে পরশুদিনকে! সেদিন ভালো তিথি আচে। আজ আপনি ওবেলা কালীঘাটের প্রসাদ খাবেন।
নবনীকুমার তার দুর্বল দক্ষিণ হস্ত দিয়ে সরোজিনীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে বললো, বারবার দূরে সরে যাচ্চো কেন? সব কতা আমার কানে কানে বলে।
ভাত দেওয়া হবে না। শুনে সে রেগে গিয়ে বললো, দুত্তুরি ছাই তিথির নিকুচি করেচে! আমি ভালো হয়ে গ্যাচি, আমার খিদে পেয়েচে, আমি আজই ভাত খাবো।
সরোজিনী মিনতি করে বললো, লক্ষ্মীটি, অমন কত্তে নেই, কোবরেজ মশাই বলেচেন, পর্শুদিনকে সকালেই আপনাকে ভাত দেওয়া হবে।
—না, আমি আজই ভাত খাবো!
—আজ মায়ের প্রসাদ খাবেন। আপনার নামে মানোত। আজ তো এমনিতেই ভাত খেতে নেই।
—না, আমি ভাত খাবো, আমি ভাত খাবো, আমি গরম ভাত খাবো!
সরোজিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে বললো, আপনি কাঁদবেন না, আপনার শরীর খারাপ হবে।
—আমি ভাত খাবো, কোনো কতা শুনতে চাই না, আমায় ভাত এনে দাও!
—কোবরেজ মশাইকে ডাকি?
—আঁমি ভাঁত খাঁবো! আঁমি ভাঁত খাঁবো!
সাহেব চিকিৎসকরা তো নিয়মিত দেখছেনই, তাছাড়াও মেডিক্যাল কলেজের একজন ছাত্র এবং বিশিষ্ট কবিরাজকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য স্থায়ীভাবে এ বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সংকট উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রটি দুদিন আগে চলে গেছেন, কবিরাজমশাই এখনো রয়েছেন। লোক পাঠিয়ে সরোজিনী কবিরাজ মশাইকে ডেকে আনলো।
কবিরাজমশাই মধ্যবয়স্ক, রীতিমত বলবান চেহারার সুপুরুষ। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। দেখলে বেশ সমীহ হয়। তিনি নবীনকুমারের নাড়ি দেখে বললেন, অতি সুলক্ষণ, ভাত খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে, অতি সুলক্ষণ! নাড়ির গতিও স্বাভাবিক প্রায়! তবে কিনা। কালিকার দিনটিতে অমাবস্যা, আর অমাবস্যায় শরীর এমনিই রাসস্থ হয়, কালিকার দিনটি বাদ দিয়ে পরশ্ব ভাত দেওয়া যাউক।
নবীনকুমার বললো, আঁমি ভাঁত খাঁবো! আঁমি ভাঁত খাঁবো!
কবিরাজ সস্নেহে বললেন, আর তো দুটি মাত্র দিন! আজি সিদ্ধ সাবু, কাগজি লেবুর রস দুই ফোঁটা, লবণ একেবারে বাদ।
নবীনকুমার বললো, আঁমি ভাঁত খাঁবো! আঁমি ভাঁত খাঁবো!
কবিরাজের একপাশে দিবাকর, আর শয্যার শিয়রের কাছে মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। সরোজিনী। দিবাকর বললো, কবরেজ মশাই, আজ অন্তত চাট্টিখানি ভাত দেওয়া যায় না? ছোটবাবু অ্যাত্তি করে চাইচেন।
কবিরাজ তাকে ধমক দিয়ে বললেন, বাপু, আবার জ্বরজারি এলে তুমি দায়িক হবে?
তারপর নবীনকুমারের দিকে ফিরে কোমল গলায় বললেন, আর তো মোটে দুটি মাত্র দিন। আজ সিদ্ধ সাবু, কালিকার দিনটি ফলমূল।
নবীনকুমার একঘেয়ে গলায় বলে যেতে লাগলো, আঁমি ভাঁত খাঁবো! আঁমি ভাঁত খাঁবো!
সরোজিনী মৃদুস্বরে বললো, উনি কানে শুনতে পাচ্চেন না!
কবিরাজ বললেন, তা তো হবেই, এ ব্যাধিতে পঞ্চেন্দ্ৰিয় দুর্বল হয়-স্বৰ্ণ মকরধ্বজ ঠিক মতো সেবন করলে, মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
নবীনকুমার প্রাণপণ শক্তিতে চেঁচিয়ে বললো, আঁমায় ভাঁত দাঁও! আঁমি ভাঁত খাঁবো! আঁমি ভাঁত খাঁবো!
কেউ আর ভ্রূক্ষেপ করলো না তার আবেদনে। কবিরাজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও নিষ্ক্রান্ত হলো সে কক্ষ থেকে।
মহাধনী পরিবারের পরম আদরের দুলাল, ষোড়শ বৎসর বয়স্ক নবীনকুমার সামান্য ভাতের জন্য সানুনাসিক সুরে আর্তনাদ করতে লাগলো, কেউ তাকে ভাত এনে দিল না।
দুর্বল শরীরে কান্না বেশীক্ষণ সহ্য হয় না। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। দ্বিপ্রহরে দুজন দাসীকে সঙ্গে নিয়ে সরোজিনী যখন এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে সাবু খাওয়াতে গেল, সাবু সমেত শ্বেতপাথরের বাটিটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল নবীনকুমার। কিছুতেই সে সাবু খাবে না। একটু পরে তুলসীপাতা ও মধু দিয়ে মাড়াই করা মকরধ্বজ খাওয়াতে এলেও সে ওষুধের খলটি ছুঁড়ে ভেঙে ফেললো। বাল্যকাল থেকেই সে দেখে এসেছে যে, তার মুখের কথাটি খসা মাত্র প্রতিপালিত হয়, দাস-দাসীরা তার প্রত্যেক হুকুম তামিল করার জন্য সদা উন্মুখ, অথচ আজ সে ভাত খেতে চাইলেও কেউ তাকে দেয় না। অন্যের কথা সে শুনতে পায় না, তার নিজের কণ্ঠের জোর নেই, সে অসহায়। ক্ষোভে, বেদনায়, অভিমানে তার হৃদয় উদ্বেল হয়ে রইলো।
বিম্ববতী কালীঘাটের মন্দিরে পূজা দিয়ে ফিরলেন প্রায় সন্ধ্যার সময়।
ফিরেই যেই তিনি শুনলেন যে তাঁর পুত্র সারাদিনে কিছুই আহার করেনি, তিনি অমনি ছুটে এলেন ব্যাকুল ভাবে।
কিন্তু নবীনকুমার তার জননীর সঙ্গেও একটিও বাক্য বিনিময় করলে না। সে সর্বক্ষণ শুয়ে রইলো উপুড় হয়ে, মাকে সে দেখবেও না। সরোজিনী তার কানের কাছে মুখনিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো, একটিবার পাশ ফেরার জন্য, কোনো সাড়া মিললো না তাতে। বিম্ববতী পুত্রের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাজারভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ছেলে তাঁর বড় জেদী তিনি জানেন। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় এমন জেদ যে অতি মারাত্মক! কিছুতেই কালীঘাটের প্রসাদও খাওয়ানো গেল না নবীনকুমারকে। তার মুখে জোর করে গুঁজে দিলেও সে থু থু করে ফেলে দেয়। মা কালীর প্রসাদের এমন অবমাননায় বিম্ববতীর বুক কাঁপতে থাকে অমঙ্গল আশঙ্কায়।
কবিরাজের আবার ডাক পড়ে। কবিরাজও নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। কুপথ্য খাওয়াবার চেয়ে বিনা পথ্যে রাখাও অনেক ভালো। ভাত দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
বিম্ববতী সারাদিন উপবাস করে ছিলেন, রাত্রেও তিনি কিছুই মুখে দিলেন না। নিজ শয্যায় শুয়ে তিনিও চক্ষের জল ফেলতে লাগলেন অনবরত। নবীনকুমারকে জোর করে ধমক দিয়ে খাওয়াতে পারতেন বোধহয় শুধু একজন। বিধুশেখর। কিন্তু বিধুশেখরের নিজেরই শরীরের এমন অবস্থা যে তাঁকে যখন তখন ডেকে আনানো আর যায় না। কিংবা, কে জানে, নবীনকুমারের জেদ যে-রকম বাড়ছে, তাতে সে আজ বিধুশেখরের কথাও শুনতো কিনা! বিম্ববতীর ভয় হয়, কোনোদিন য়দি নবীনকুমার মুখের ওপর বিধুশেখরের কোনো আদেশ অগ্রাহ্য করে? বিধুশেখর কি তা সহ্য করতে পারবেন? সহ্য না করতে পারলে কী রকম হবে তাঁর প্রতিক্রিয়া!
মধ্যরাতে জেগে উঠলো নবীনকুমার। ঘর একেবারে অন্ধকার নয়, এক কোণে একটি সেজবাতি মিটমিট করে জ্বলছে। প্রথমে তার মনে হলো, সে যেন গভীর সমুদ্রে এক ভেলার ওপর ভাসমান। সে চলেছে। নিরুদেশ যাত্রায়। দুনিয়ায় তার কেউ নেই। তারপর তার চোখ পড়লো। কক্ষের চেনা আসবাবগুলির প্রতি। সে আশ্বস্ত হলো।
ঘরের মেঝেতে পালঙ্কের খুব কাছে শয্যা পেতে শুয়ে আছে সরোজিনী। ঘুমের মধ্যে তার কোমল মুখখানি বড় করুণ দেখায়। নবীনকুমার তার নিশ্বাস-প্ৰশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল না। বস্তুত পৃথিবীর কোনো শব্দই তার কানে আসে না। এই নিস্তব্ধতা তার কাছে দারুণ একটা বোঝার মতন মনে হয়।
নবীনকুমার ডাকলো, সরোজ! সরোজ!
সেই ডাকেই সরোজিনী ধড়মড় করে উঠে বসে বললো, কী হয়েচে? আপনার কষ্ট হচ্চে? মাকে ডাকবো?
নবীনকুমার বললো, সরোজ-আমি যে ক্ষিদের জ্বালায় মরে যাচ্চি। আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুমুচৌ?
সরোজিনী চক্ষু মুছতে মুছতে বললো, ওমা, আপনাকে খাওয়াবার জন্য অত সাধাসাধি, মা আপনাকে কত করে বললেন।
—সরোজ, তুমি ভাত রাঁধতে জানো না?
—ওমা, এত রাত্তিরে? এখুন বুঝি কেউ ভাত রাঁধে?
—কী বলচো, শুনতে পাচ্চিনি। কাচে এসে কানে কানে বলে। সরোজ, এখুন তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েচে, কেউ টের পাবে নাকে। তুমি চুপি চুপি আমার জন্য চাটি ভাত ফুটিয়ে এনে দেবে? ভাত আর আলু সেদ্ধ, আর কিচু চাই না।
সরোজিনী স্বামীর কানের কাছে মুখ এনে কাতর গলায় বললো, আপনার পায়ে পড়ি, আজ নয়। আর তো মোটে মাঝে কালকের দিনটা। তারপর আমি নিজে আপনাকে ভাত বেঁধে দেবো।
—সরোজ, সবাই নিষেধ কচ্চে বলে তুমিও আমার কতা শুনবে না? ভাত খাওয়ার জন্য যে আমার মনটা আকুলি বিকুলি কচ্চে। দুটি ভাত দাও না আমায়।
–মা গো মা, অমন করে কেউ ভাত চায়? এত রাতে আমি ভাত কোতায় পাবো?
—যাও, রেঁধে নিয়ে এসো। যাও। নইলে আর কোনোদিন আমি তোমার সঙ্গে কতা কবো না।
সরোজিনী সেজবাতিটা তুল নিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে i দ্বারের বাইরে ঘুমিয়ে
আছে একজন দাসী, তাকে ডিঙ্গিয়ে গেল সাবধানে। স্বামীর আদেশ সব সময় পালন কবতে হয়। কিন্তু সে যে এক্ষেত্রে একেবারে অসহায়। এ বাড়ির সব রান্না হয়। পিছন মহলে নিচের তলায়, সেখানে সরোজিনী গেছে মাত্র দু-তিনবার। সেখানকার ব্যবস্থাপত্র সে কিছুই জানে না। দ্বিতলে ঠাকুরের ভোগ রান্নার জন্য একটি ছোট রান্নাঘর আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ দিনই সেটা তালাবন্ধ থাকে। তা ছাড়া, কোথায় ভাঁড়ার ঘর, কোথায় চাল-ডাল পাওয়া যায়, উনুন কীভাবে ধরাতে হয়, সেসব সম্পর্কেও তার কোনো জ্ঞান নেই।
খানিকবাদে সে ম্লান মুখে ফিরে এলো।
নবীনকুমার ব্যগ্ৰভাবে জিজ্ঞেস করলো, চাপিয়েচো! ভাত চাপিয়েচো?
সরোজিনী কাছে এসে বললো, ভোগ রাঁধার ঘরে তালাবন্ধ। নিচ তলায় একলা যেতে আমার ভয় করে।
–সরোজ, তুমি আমায় না খাইয়ে মারতে চাও?
—আপনি সন্দেশ খাবেন?
–নাঃ।
—তা হলোঁ-তা হলে আপনি খিচুড়ি খাবেন?
এবার নবীনকুমার চমকে উঠে বললো, খিচুড়ি? কোতায়? হ্যাঁ, খিচুড়ি খাবো। কোতায় খিচুড়ি পাবে?
—সে আচে। আমি খিচুড়ি আনচি। কেউ যেন জানতে না পারে।
সরোজিনী দেখেছিল জাল দিয়ে ঢাকা আলমারিতে কালীঘাটের প্রসাদ খিচুড়ি আর সন্দেশ আর ফলমূল রাখা আছে। খিচুড়ি আনা হয়েছিল বাড়ির অন্য লোকজনদের জন্য। অনেকেই খায়নি। মায়ের প্রসাদ যেখানে সেখানে ফেলে দিতে নেই বলে রেখে দেওয়া হয়েছে, কাল গঙ্গায় দিয়ে আসা হবে। বাসি হয়ে গেছে, এই খিচুড়ি এখন আর খাওয়া উচিত। কিনা সে বিষয়ে আর চিন্তা করলো না সরোজিনী। তার জেদী পতি দেবতাটি এরকম কিছু না পেলে কিছুতেই শান্ত হবে না যে!
অতি সাবধানে জালের আলমারি খুলে সে এক বাটি খিচুড়ি বার করলো, তারপর আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে চলে এলো।
নবীনকুমার বিছানার ওপর বসে আছে। সরোজিনী ফিরে আসতেই সে ব্যস্ত ভাবে হাত বাড়িয়ে বললো, দাও। তারপর অতিশয় লোভীর মতন, পথের ক্ষুধার্ত কঙালীদের মতন সে সেই খিচুড়ি খেতে লাগলো।
সরোজিনী একবার ভাবলো, বিছানার ওপর বসে বসে এই সকড়ি জিনিস খেলে পাপ হবে না তো? তারপরই সে ভাবলো, মায়ের প্রসাদ কক্ষনো এঁটো হয় না। আর মায়ের প্রসাদ খেলে কখনো শরীরের ক্ষতি হতে পারে না।
তৃপ্তির সঙ্গে সবটুকু খিচুড়ি আহার করে নবীনকুমার বললো, আঃ, তুমি আমায় বাঁচালে সরোজ। এবার বলো তো, এর বিনিময়ে তোমাকে আমি কী দিতে পারি?
সরোজিনী বললো, কিচু না। এবার আপনি ঘুমোন, আমি আপনার মাতায় হাত বুইল্যে দিই।
রাত্রির এই ঘটনাটি বাড়ির অন্যান্যদের কাছে গোপন রয়ে গেল এবং পরদিন নবীনুকমার ফল ও মিষ্টি দ্রব্যাদি খেয়ে থাকতে রাজি হওয়ায় বিম্ববতী আবার দ্বিগুণ বিস্মিত হলেন। সত্যিই এ ছেলের মতিগতি বোঝা ভার।
অমাবস্যার পরদিন নবীনকুমার অন্ন গ্রহণ করবে, কঠিন রোগের পর প্রায় দেড় মাস বাদে সে আবার ভাত মুখে দিচ্ছে। সেই উপলক্ষে কয়েক শত কাঙালী ভোজনেরও আয়োজন করা হলো। বিম্ববতী কাঙালীদের একটি করে মুদ্রাও দান করলেন।
নবীনকুমারের জন্য ভাত রন্ধন করা হলো দ্বিতলের ঠাকুরের ভোগ রান্নার ঘরে। সরোজিনী নিজে উপস্থিত রইলো সেখানে এবং শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে নিজে সে ভাতের হাঁড়ি নামালো। তারপর নিজের হাতে রূপের থালায় ভাত বেড়ে এনে দিল নবীনকুমারকে। সেই সঙ্গে গব্য ঘৃত, সিদ্ধ আলু আর মাগুর মাছের ঝোল।
অত ভাত খাবার সাধ নবীনকুমারের, কিন্তু দু-তিন গরাসের পর আর ভাত মুখে রুচিলো না। বাড়ির অনেক লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। যেন একটা উৎসব। কিন্তু একটুখানি খাওয়ার পর সে থালা ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। বিম্ববতী হা হা করে উঠলেন। কবিরাজমশাই বললেন, থাক থাক, যথেষ্ট হয়েচে, প্রথম দিন আর বেশী না খাওয়াই ভালো। তবে দেখবেন, আজ যেন দ্বিপ্রহরে নিদ্রা না যায়। জ্বরের পর ভাত-ঘুম অতি ক্ষতিকারক।
এর দু-তিন দিনের মধ্যে নবীনকুমার অনেক সুস্থ হয়ে উঠলো, আহারেও রুচি এলো। তবু তার মুখখানি সব সময় বিরস হয়ে থাকে। সে নিজেই হাঁটা চলা করতে পারে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক দুর্বল, শ্রবণশক্তি অতি ক্ষীণ। এই পৃথিবীর সঙ্গে যেন তার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। শুধু খাওয়া, শুয়ে থাকা বা মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে বসা, এ ছাড়া যেন তার জীবনের কোন উদ্দেশ্য বা কর্ম নেই।
সরোজিনী সর্বক্ষণ তার কাছাকাছি থাকে এবং যাবতীয় খবরাখবর সরোজিনী মারফৎই নবীনকুমার পায়। আর কেউ তার কানের কাছে চেঁচিয়ে কথা বললে তার ভালো লাগে না। বাবার আমলের বৃদ্ধ খাজাঞ্চি সেনমশাই বদ্ধ কালা, তাঁকে কিছু বলতে গেলে ঐ রকম ভাবে চাঁচাতে হয়। ষোড়শ বর্ষীয় নবীনকুমার নিজেকে ঐ বৃদ্ধের মতন ভাবতে পারে না।
সে সরোজিনীকে একদিন ছাদে বসে বললো, তুমি সব সময় কাজের কতা বলো কেন? অন্য কোনো কতা বলতে পারো না?
সরোজিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, অন্য কতা? কী কতা?
নবীনকুমার বললো, অন্য কিচু ভালো কতা? তুমি গান জানো না?
সরোজিনী লজ্জায় মুখ নিচু করে। দুদিকে মস্তক আন্দোলিত করে বলে, না।
নবীনকুমার বললো, আমি তোমায় গান শিকিয়ে দিচ্চি। তুমি আমার কানে কানে গান শোনাবে। আমি কোনো কিচুই শুনতে পাই না, গানও শুনতে পাই না, এর চে আমার মরণ ভালো। তারপর সে গুন গুন করে গান ধরে।
সুধাই তোমায় সুধামুখী, ভুলেছ কি আছে মনে
মনে ভেবে দেখ দেখি কী কথা ছিল দুজনে
আমায় মন দিবে বলে আগে আমার মন নিলে
অবশেষে এই করিলে, তুই জানিস আর তোর ধর্ম জানে।
সরোজিনী খুব মন দিয়ে শোনে। তারপর হঠাৎ সে স্বামীর কানে ওষ্ঠ চেপে ধরে গান গাইতে শুরু করে। এই গান নয়, অন্য গান, ভালোবাসিব বলে ভালোবাসিনে…।
অনেক দিন পর নবীনকুমারের মুখে হাস্য ফুটে ওঠে। সরোজিনীর সান্নিধ্যের তাপ, তার উষ্ণ ওষ্ঠ তাকে এক ধরনের অনাস্বাদিতপূর্ব মাদকতা এনে দেয়। সে সরোজিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, সরোজ, তুমি এত ভালো গান জানো? তুমি এত সুন্দর?