আইয়ুব আমলের সাহিত্যপুরস্কার
আইয়ুব আমলের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ছিল ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’। ১৯৫৮ সালে জেনারেল মুহম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পরপরই তিনি এই পুরস্কার প্রবর্তন করেন ‘গৌরবজনক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই এই সম্মানজনক পুরস্কারটি ছিল বৈষম্যমূলক। পুরস্কারের নীতি হিসেবে বলা হয়েছিল কমপক্ষে পাঁচ হাজার এবং ঊর্ধ্বপক্ষে দশ হাজার টাকা ও তৎসহ প্রেসিডেন্টের পদক প্রদানের রীতি রয়েছে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। শুধু সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার দেওয়া হতো বিজ্ঞান, চিত্রকলা, খেলাধুলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গৌরবজনক অধ্যায় সৃষ্টির জন্যও। কৃতী ব্যক্তিদের এ ধরনের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ দেওয়া হতো বাংলা ও উর্দু সাহিত্যের কবি-সাহিত্যিকদের। সম্ভবত পাকিস্তানের অন্য কোনো ভাষায় কোনো কবি সাহিত্যিক এই পুরস্কার ষাটের দশকে পাননি। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধি ও পাঞ্জাবি ভাষার কবি-লেখকও ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পুরস্কার কমিটি গঠন করে দিত, সেই কমিটির সুপারিশমতো মনোনীত হতেন পুরস্কারপ্রাপ্তরা। প্রতিবছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হতো।
একই পুরস্কার কেউ পাবেন পাঁচ হাজার টাকা, কেউ পাবেন দশ হাজার টাকা, কেন এই বৈষম্য, তা সেকালে আমাদের বোধগম্য ছিল না। যারা বাংলা সাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁদের কাছেও ব্যাপারটি স্পষ্ট ছিল না। জিনিসটি নিয়ে যে আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা প্রশ্ন তুলবেন, সে সাহসও ছিল না কারও। কেউ কেউ, বিশেষ করে যারা পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছেন, মর্মবেদনায় ভুগতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না। অথচ প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল। গণতান্ত্রিক সমাজে অযৌক্তিক কাজের সমালোচনা এমন কি প্রতিবাদ হয়ে থাকে।
আমরা তখন তরুণ লেখক, সুতরাং ওই পদক-পুরস্কার নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। লক্ষ করেছি, যাঁর সাহিত্যকর্ম কম তিনি পেয়েছেন দশ হাজার টাকা এবং যার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রয়েছে তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। বাংলা সাহিত্যে প্রথম বছর (১৯৫৮) প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। নিঃসন্দেহে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনি পান দশ হাজার টাকা। তাঁর সঙ্গে একই বছর পুরস্কৃত হন কবি জসীমউদ্দীন। সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অপরিমেয়। তাঁকে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। জসীমউদ্দীনের মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।
১৯৫৯ সালেও ওই একই ব্যাপার ঘটে। আজাদ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী মুসলিম লীগের সাবেক নেতা মওলানা আকরম খাঁ পান দশ হাজার টাকা। ১৯৬০ সালে কবি গোলাম মোস্তফা পান পাঁচ হাজার টাকা।
১৯৬১ সালে কবি ফররুখ আহমদ পান পাঁচ হাজার টাকা এবং একই সঙ্গে মহিউদ্দীনও পান পাঁচ হাজার টাকা। ১৯৬২ সালে মহিউদ্দীন দ্বিতীয়বার একই পুরস্কার পান পাঁচ হাজার টাকা। বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের অবদান আর মহিউদ্দীনের অবদান কি সমান? তা ছাড়া একই পুরস্কার পরপর দুই বছর একই ব্যক্তির পাওয়ার যুক্তি কোথায়?
রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। সে গুরুত্ব শুধু অর্থনৈতিক নয়, মর্যাদারও। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই অনেক রকম সাহিত্য পুরস্কার প্রচলিত রয়েছে। ভারতে আছে জ্ঞানপাঠ, আকাদমি পুরস্কার প্রভৃতি। যে উদ্দেশ্যেই আইয়ুব সরকার ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রবর্তন করুক, কাজটি খারাপ ছিল না। মনোনয়ন ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতিত্বমূলক হওয়ায় পুরস্কারটির মর্যাদাহানি ঘটে এবং যারা পুরস্কৃত হন তাঁরাও গৌরব থেকে হন বঞ্চিত।
গণতন্ত্রহীন অনুন্নত দেশে সরকারি পুরস্কারের একটি নেতিবাচক দিক আছে, আর তা হলো তাতে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের শুধু নয়, পুরস্কারপ্রত্যাশী লেখকদের প্রতিবাদী চেতনা নষ্ট করে দেওয়া। সত্য উচ্চারণ থেকে তারা বিরত থাকেন। অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জোর দিয়ে করতে পারেন না। আইয়ুবের সামরিক একনায়কী শাসনামলেও সেটি লক্ষ করা গেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী নেতারা লড়াই করেছেন, নির্যাতিত-নিপীড়ন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, বিরল ব্যতিক্রম বাদে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অতুলনীয় সুবিধাবাদী।
১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান আবুল ফজল পাঁচ হাজার টাকা, পরের বছরও তিনি আবার পুরস্কার পান পাঁচ হাজার টাকা। মহিউদ্দীন ও আবুল ফজল পরপর দুবার পুরস্কার পান পাঁচ হাজার পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা। ১৯৬৬ সালে মুহাম্মদ এনামুল হক পেলেন পাঁচ হাজার টাকা, কিন্তু ‘৬৭ সালে বন্দে আলী মিয়া পেলেন দশ হাজার টাকা। সঙ্গীতে ওস্তাদ আয়েত আলী খান পেলেন দশ হাজার টাকা।
১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান শওকত ওসমান। তার পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর শুনে প্যারিস থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁকে ২৫ আগস্ট ‘৬৮ এক চিঠিতে লেখেন, “শুনলাম বড় পুরস্কার পেয়েছ তাই লিখছি। অবশ্য এটা একটা অজুহাত, কারণ তুমি একটা পুরস্কার পেয়েছ তা কী এমন বড় খবর। পুরস্কারে খুশি হওয়ার কথা, তোমার নয়, আমাদেরও নয়। অন্য একটা দিক আছে বৈকি কিন্তু ওটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ও বিষয়ে অন্যদের মন্তব্য করার অধিকার আছে বলে– মনে হয় না।’
(সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৮৩, পৃ. ২৩৪)
ওয়ালীউল্লাহ যে লিখেছিলেন পুরস্কারের অন্য একটা দিক, তা হলো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। যখন চালের মণ ছিল ৩০ টাকা এবং সোনার ভরি ১২০ টাকার কম, সেই সময় পাঁচ হাজার/দশ হাজার টাকা বিপুল টাকা। মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারটি যেহেতু ইসলামাবাদ থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিত, সুতরাং তার জন্য ঢাকা থেকে লেখকেরা কতভাবে কী পরিমাণ তদবির করতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথবা তারাই পুরস্কার পেতেন, যারা সরকারের আস্থাভাজন।
আদমজী পুরস্কার দেওয়া হতোকবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, জীবনী প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য বইয়ের জন্য। প্রতিটি পুরস্কারের মান ছিল পাঁচ হাজার টাকা। লেখক সংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের পরামর্শক্রমে স্থায়ী চেয়ারম্যান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পুরস্কারপ্রাপ্তদের মনোনীত করতেন। ১৯৬০ থেকে আদমজী পুরস্কার চালু হয়। প্রথম বছর পান আবদুস সাত্তার ও রওশন ইয়াজদানী, ১৯৬১তে রশীদ করীম ও আবদুর রাজ্জাক, ১৯৬২তে কাজী আবদুল মান্নান ও শওকত ওসমান, ‘৬৩তে শামসুর রাহমান ও শহীদুল্লাহ কায়সার, ‘৬৪তে আহসান হাবীব ও জহির রায়হান, ‘৬৫তে সুফি মোতাহার হোসেন ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং ‘৬৬তে আবুল ফজল ও ফররুখ আহমদ পুরস্কৃত হন। আদমজী পুরস্কারের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। যে বইটির জন্য পুরস্কার দেওয়া হতো, সেটি ভালো বিক্রি হতো। তাতে লেখক-প্রকাশক উভয়েই উপকৃত হতেন।
আরেকটি মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার ছিল দাউদ পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে ‘দাউদ ফাউন্ডেশন’ এই পুরস্কার প্রবর্তন করে। বাংলা ভাষার জন্য দশ হাজার এবং উর্দু ভাষার সাহিত্যকর্মের জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হতো গবেষণা, জীবনী ও ইতিহাস গ্রন্থের জন্য, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত বিষয়সমূহের ওপর গবেষণামূলক কার্যের জন্য। প্রতিটি পুরস্কারের মান ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ষাটের দশকে দাউদ পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ (১৯৬৩), জগলুল হায়দার আফরিক (১৯৬৩), আকবর উদ্দিন ও আশরাফ সিদ্দিকী (১৯৬৪), মুনীর চৌধুরী ও আনিসুজ্জামান (১৯৬৫), আবদুস সাত্তার ও মুন্সী রইসউদ্দীন (১৯৬৬) প্রমুখ।
পুরস্কার পাওয়ার কারণে কোনো কোনো বই ও তার লেখক জনপ্রিয়তা পেতেন। যেমন একজন লেখক জগলুল হায়দার আফরিক। তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ভ্রমণকাহিনি সিন্ধু নীলাভ দেশ নামক সুখপাঠ্য বইটির জন্য। ষাটের দশকে বইটি জনপ্রিয় ছিল। জগলুল হায়দার আফরিক চাকরি করতেন দৈনিক আজাদে। আজাদের হিসাব বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি এবং আকরম খাঁর বিশেষ আস্থাভাজন। তিনি অনেকগুলো ভাষা জানতেন। শুনেছি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দিসহ সাত আটটি ভাষা জানতেন। চল্লিশের দশকে তিনি অনেক দিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। তাঁর ইংরেজিতে একটি বই ছিল Call of the Red Sea. পঞ্চাশের দশকে তার একটি বই পরদা নশিন হওয়া পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। ষাটের দশকে তাঁর একটি উপন্যাস দেখেছি, নাম বিপ্লবী নায়িকা। স্বাধীনতার আগেই তিনি মারা যান। আমি তাঁকে দেখেছি। তিনি বিশেষ সজ্জন ছিলেন।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের জন্য আরও যারা দাউদ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশরাফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল হক, আবদুস সাত্তার, মাযহারুল ইসলাম প্রমুখ। যে বইয়ের জন্য লেখকেরা দাউদ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার সবই যে বিশেষ মূল্যবান বই, তা বলা যায় না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইটির চেয়ে বইয়ের লেখককেই পুরস্কৃত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেকালে ন্যূনতম মানসম্পন্ন না হলে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া কঠিন ছিল।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ১৯৬৪ থেকে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে। ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা মমতাজ হাসান ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের একজন সমঝদার। ষাটের দশকে আমাদের প্রধান চিত্রশিল্পী ও লেখকদের মুখে মমতাজ হাসানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি, তিনি ছিলেন তাঁদের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষক। পূর্ব পাকিস্তানে চিত্রকর্ম বিক্রি হতো না বললেই চলে। সে জন্য পঞ্চাশের দশকের চিত্রশিল্পীদের অনেকেই করাচি-লাহোরে যাতায়াত করতেন ছবি বিক্রির জন্য। তারা কেউই নিরাশ হননি। বিশেষ করে, কোনো রকমে মমতাজ হাসানের সঙ্গে গিয়ে পরিচিত হতে পারলে ভাগ্য খুলে যেত। তিনখানা বই লিখে একজন খ্যাতনামা লেখক যা রোজগার করতেন, দু-তিনটি ছবি ন্যাশনাল ব্যাংকে গছাতে পারলে তার কয়েক গুণ বেশি উপার্জন করতেন একজন শিল্পী। মমতাজ হাসান শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরই নন, সম্ভবত পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবও হয়েছিলেন।
দাউদ বা আদমজী পুরস্কারের চেয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের বিষয় ছিল কিছুটা ভিন্ন। প্রতিবছর ২৫ হাজার টাকা পুরস্কারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। বাংলা ভাষায় রচিত দুটি গ্রন্থের জন্য পাঁচ হাজার করে দশ হাজার, একইভাবে উর্দু দুটি গ্রন্থের জন্য দশ হাজার এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত একটি বইয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হতো। এই পুরস্কারটিতে বাঙালি লেখকেরা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর বাংলা ও উর্দুতে লেখা দুটি গবেষণাগ্রন্থের জন্য দুটো পুরস্কার দেওয়া হতো এবং পাকিস্তানের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যেতে পারে, এমন বিজ্ঞানবিষয়ক দুটি বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের লেখকদের পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর ইংরেজিতে রচিত একটি বইয়ের লেখককে ন্যাশনাল ব্যাংক পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিত।
সেকালে সমগ্র পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ মর্যাদা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেওয়া হতো খুবই সম্মান। মমতাজ হাসান, কুদরতুল্লাহ শাহাব প্রমুখের সুপারিশেন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর স্থায়ী চেয়ারম্যান করা হয় পদাধিকারবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে। লেখক বা প্রকাশককে বই জমা দিতে হতো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট একাডেমিশিয়ানরা ছিলেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য।
ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের প্রশ্নে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তিনি ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজা। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তার। তার চেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি আমাদের মতো তরুণদের বাম সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। তাঁর দীক্ষায় আমাদের বহু বন্ধু ষাটের দশকে বাম ধারার রাজনীতিতে এসেছেন। মস্কো-পিকিং দুই ধারার কমিউনিস্টদের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাংলা পরিভাষার কাজ তিনি করছিলেন। ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখ চাইতেন বাংলায় ডাক্তারি পড়বেন আমাদের ছাত্ররা মেডিকেল কলেজগুলোতে। তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার প্রথম বছরই পান মোহাম্মদ মোর্তুজা। যে বইটির জন্য তিনি পুরস্কার পান তার নাম ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ। তাঁর এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। প্রথম বছর আরেকটি ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল ড. এ কে এম আমিনুল হককে তাঁর চিল-ময়না-দোয়েল-কোয়েল বইটির জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং অধ্যক্ষ আবুল কাশেমকে তাঁর একটি রসায়নবিষয়ক বইয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকা। ১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকায় এসে ফুলার রোডে গিয়ে যখন শুনলাম আলবদর বাহিনী ডা. মোর্তজাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে, বেদনার সীমা ছিল না। অগণিত শহীদের তালিকায় যুক্ত হলো ফজলে রাব্বি, আলীম চৌধুরী, মোহাম্মদ মোর্তজাদের নাম।
১৯৬৫-তে ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আবদুল জাব্বার তাঁর খগোল পরিচয় এবং গোলাম আজম সিদ্দিকী তাঁর পাকিস্তানের অর্থনীতি বইয়ের জন্য। এই পুরস্কারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো এই জন্য যে তা আমাদের বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির দাবি বাস্তবায়নে সহায়ক ছিল। পুরস্কারের কারণে অনেকেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানবিষয়ক বই লেখায় প্রেরণা ও উৎসাহ পেতেন। ১৯৭০ সালে কবীর চৌধুরী একটি অনুবাদ বইয়ের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার পান।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মাধ্যমেই প্রতি দুই বছর পরপর ‘ইউনেসকো পুরস্কার দেওয়া হতো। সেটাও দেওয়া হতো বাংলা ও উর্দু বইয়ের লেখককে। প্রতিবছর তিনটি বাংলা বই এবং তিনটি উর্দু বইয়ের লেখকের প্রত্যেকের জন্য ৪০০ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ ছিল। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পরের বছরই এই পুরস্কার চালু হয়। সাধারণ বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সমঝোতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও নাটক-উপন্যাসের মতো সৃষ্টিশীল বইয়ের জন্যও ‘ইউনেসকো পুরস্কার দেওয়া হতো। ইউনেসকো পুরস্কারপ্রাপ্ত কয়েকজন কবি-লেখক হলেন জহুরুল হক (সাত সাঁতার), খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন (যুগস্রষ্টা নজরুল), রাজিয়া মাহবুব (খাপছাড়া), আহসান হাবীব (রত্নদ্বীপ), আলাউদ্দিন আল আজাদ (কর্ণফুলী), আবদুল গনি হাজারী (কতিপয় আমলার স্ত্রী), আবদুল গাফফার চৌধুরী (কৃষ্ণপক্ষ), শাহ ফজলুর রহমান (মহাশূন্যে অভিযান) প্রমুখ। ইউনেসকো পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলোর মধ্যে সাত সাঁতার, যুগস্রষ্টা নজরুল, কর্ণফুলী বাংলা সাহিত্যে টিকে গেছে।
আইয়ুব সরকার আরেকটি পুরস্কার চালু করেছিল। তার নাম ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার। এই পুরস্কারটিই ছিল বিতর্কিত। নাটক, শিশুসাহিত্য-বিষয়ক বইয়ের লেখকদের এই পুরস্কার দেওয়া হতো। বড়দের নাটকের জন্য দেওয়া হতো তিনটি পুরস্কার। প্রতিটির মান এক হাজার টাকা। সেকালে সেটাও কম টাকা নয়। প্রায় ১০ ভরি সোনার মূল্যের সমান। বড়দের নাটকের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, আশকার ইবনে শাইখ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর, প্রাবন্ধিক আবদুল হক প্রমুখ। মুনীর চৌধুরী নিহত হওয়ার কথা শুনে মমতাজ হাসান গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন বলে তাঁর ভাই শামসেদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি।
কিশোর উপযোগী দুজন জীবনীলেখককে ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার’ দেওয়া হতো। একটি পুরস্কারের মান ছিল ৭৫০ টাকা, আরেকটির মান ৫০০ টাকা। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পড়ার উপযোগী একটি কবিতার বইয়ের জন্য ছিল একটি এক হাজার টাকার পুরস্কার। ছোটদের জন্য লেখায় পুরস্কার পেয়েছিলেন আহসান হাবীব, ফয়েজ আহমদ, জহুরুল হক, মোহাম্মদ নাসির আলী, কবি আজিজুর রহমান, রাজিয়া মাহবুব প্রমুখ।
এ ছাড়া ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান (পরে যার নামকরণ হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র) বই প্রডাকশন পুরস্কার প্রবর্তন করেছিল। ১৯৬২ সালে এই পুরস্কার চালু করে। বইয়ের অঙ্গসজ্জার জন্য বড়দের বইয়ের দুটি (প্রথম ও দ্বিতীয়) এবং শিশু-কিশোরদের বইয়ের জন্য দুটি পুরস্কার ছিল। সেটা পেতেন প্রকাশকেরা। প্রথম পুরস্কার এক হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৫০০ টাকা। প্রচ্ছদশিল্পীদের ন্যাশনাল বুক সেন্টার দুটি পুরস্কার দিত। প্রতিটির মান ৫০০ টাকা।
পদক পুরস্কারে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা উপকৃত হয়েছেন সন্দেহ নেই; কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের বশে রাখা। এবং তাঁরা বশংবদ ছিলেনও, ব্যতিক্রম দু-একজন ছাড়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লেখকদের কলম থেকে কোনো শক্ত লেখা বের হতো না। যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলছে এবং বাংলার মানুষ চাইছে স্বায়ত্তশাসন, তখন তারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের সহায়তা করেননি। তবে হঠাৎ একদিন তাঁরাই পাকিস্তানি শাসকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর লেখকেরা আইয়ুব সরকারকে গালাগাল শুরু করলেন। শেখ মুজিবের যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অবধারিত, আইয়ুব-ইয়াহিয়া থেকে পাওয়ার আর কিছুই নেই, তখন ১৯৭১-এর ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান লেখক শিল্পী সমাজ’-এর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শুনেছি সংবর্ধনায় যেতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না, কবি লেখকদের পীড়াপীড়িতে যান।
বাংলাদেশের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বঙ্গবন্ধু খুব ভালো চিনতেন। মঞ্চে বসে পরিচিত কবি-সাহিত্যিকদের দিকে তাকিয়ে তাঁদের ভালো করে দেখে তিনি তার ভাষণে বলেন :
‘জনগণ যখন অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন একশ্রেণির শিল্পী, সাহিত্যিক-কবি…মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশস্তি গেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা কি আজ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন?’
স্পষ্টভাষী মুজিব সেদিন আরও একটু খোলাসা করে বলেছিলেন : ‘যে মৌলিক গণতন্ত্র ও ডিক্টেটরি শাসনের পতন ঘটানোর জন্য বাংলার বীর ছাত্র-জনতা-শ্রমিক বুকের রক্ত দিয়েছে, তাদের (আইয়ুবদের) গুণকীর্তন করে, প্রবন্ধ লিখে, বেতার কথিকা প্রচার করে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পয়সা রোজগার করেছেন। বিএনআরের অর্থানুকূল্যে বই প্রকাশ করেছেন।’
[দৈনিক পাকিস্তান]
তাঁর ওই বক্তব্যে অনেক কবি লেখকই মাথা নিচু করে থাকেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো তাঁরাই স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানকে গালাগালি করে আওয়ামী লীগ সরকার ও জিয়াউর রহমানের সরকার থেকে পদক পুরস্কার ও সুবিধা নিয়েছেন।