১৭. অবাক করার কিছু নিয়ম

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
অবাক করার কিছু নিয়ম

মনে রাখবেন অপর ব্যক্তি হয়তো সম্পূর্ণ ভুল করতে পারে। তবে সে তা মনে করে না। এজন্য তাকে দোষ দেবেন না। যে কোন বোকাই এটা করতে পারে। তাকে শুধু বোঝার চেষ্টা করুন। একমাত্র বুদ্ধিমান, সহনশক্তিসম্পন্ন, আলাদা ধরনের মানুষই এটা চেষ্টা করে থাকেন।

অন্য ব্যক্তি যে–এরকমভাবে কাজ করে তার একটা কারণ আছে। সেই গোপন কারণটা খুঁজে বের করুন–তা হলেই তার এরকম ব্যবহারের কারণ বা হয়তো তার ব্যক্তিত্বের কথাটাই বুঝতে পারবেন।

দয়া করে সতোর মধ্য দিয়ে তার জায়গায় নিজেকে রাখুন।

আপনি যদি নিজেকে বলেন, ‘আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম তাহলে আমার অনুভূতি কেমন হতো বা কিভাবে চলতাম?’ এরকম করতে পারলে আপনি প্রচুর বিরক্তি আর সময় বাঁচাতে পারবেন। কারণ কারণটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আগ্রহী হওয়ায় তার ফলের জন্য আমরা ততটা বিরক্ত হব না। আর তাছাড়াও এতে আপনি মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা প্রচুর বাড়াতে পারবেন।

কেনেথ এম. গুড তার হাউ টু টান পিপল ইনটু গোল্ড’ বইতে লিখেছেন, ‘এক মিনিট অপেক্ষা করে দেখুন আপনার নিজের কাজে আপনার উৎসাহ কতটা আছে। তুলনা করে দেখুন অন্য কোন ব্যাপারে আপনার উৎসাহ কতটা কম। এবার বুঝে দেখুন পৃথিবীতে অন্য যে কোন লোকই ঠিক এইরকমভাবে। তারপর লিঙ্কন আর রুজভেল্টের সঙ্গে আপনি আয়ত্ত করতে পারবেন যে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার নির্ভর করে অপর লোকটির দৃষ্টিকোণ বুঝে নেবার আন্তরিকতার উপরেই।‘

বেশ কয়েক বছর ধরে আমি অবসর কাটাতে চেয়েছি আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা পার্কে বেড়িয়ে আর ঘোড়ায় চড়ে। আগেকার কালের সেই গলদের মতই আমি একটা ওক গাছকে দারুণ ভালোবাসতাম, বলা যায় পুজো করতাম। তাই প্রত্যেক বছরে অপ্রয়োজনীয় আগুন লেগে ছোট ছোট গাছ পুড়ে যেতে দেখে আমি খুব কষ্ট পেতাম। এই আগুন অবশ্যই অসাবধানী ধূমপানকারীদের জন্য লাগতো না। এটা লাগতো ছোট ছোট ছেলেরা গাছের তলায় আগুন লাগিয়ে ডিম ভেজে খাওয়ার জন্যে। মাঝে মাঝে এই আগুন বিরাট আকার ধারণ করতো যে ফায়ার ব্রিগেডকে ডাকতে হতো মোকাবিলা করতে।

পার্কের একটা কোণে বোর্ডে অবশ্য লেখা ছিল যে, কেউ কোন আগুন জ্বাললে জরিমানা বা কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু নোটিশটা পার্কের এমন জায়গায় টাঙানো ছিল যে ছেলেরা কেউই সেটা দেখতে পেত না। একজন ঘোড়সওয়ার পুলিশই পার্কে এসব তত্বাবধান করত। কিন্তু সে তার কর্তব্য তেমনভাবে গুরুত্ব সহকারে করত না আর আগুনও যথারীতি জ্বলতে থাকত প্রতি ঋতুতেই। একবার আমি আগুন লক্ষ্য করে পুলিশটির কাছে ছুটে গিয়ে তাকে আগুনের কতা বলে দমকলে খবর দেবার কথা বললাম। পুলিশটি অম্লানবদনে উত্তর দিল আগুন লাগলে খবর দেয়া তার কাজ নয়! আমি প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলাম আর এরপর যখন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতাম ছেলেদের আগুন জ্বালতে দেখলেই তাদের তাড়া করতাম। আমি লজ্জিত ও গোড়ায় ছেলেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা আমি দেখিনি। আমি স্বনিয়োজিত আইন রক্ষক হয়েই কাজ করতে চাইতাম। আগুন জ্বলতে দেখলে আমার মন এমনই খারাপ হয়ে উঠতো যে ঠিক করার বদলে ভুলই করে বসতাম। আমি কর্তৃত্ব ব্যঞ্জকস্বরে ছেলেদের সতর্ক করে বলতাম যে ঠিক করার বদলে ভুলই করে বসতাম। আমি কর্তৃত্ব ব্যঞ্জকস্বরে ছেলেদের সতর্ক করে বলতাম যে এজন্য তাদের জরিমানা আর জেলও হতে পারে। তাদের গ্রেপ্তারের ভয়ও দেখাতাম। আমি কেবল নিজের মনকেই হাল্কা করতে চাইতাম, তাদের মন বিচার করতাম না।

ফলাফল কি হলো? ছেলেরা কথা শুনতো–বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই মেনে নিত। আমি পাহাড়ে ঘোড়ায় চড়ে উঠে গেলে আমার ধারণা তারা আবার আগুন জ্বারাতো আর বোধহয় সারা পার্কটাই পুড়িয়ে ছাই করতে চাইতো।

সময় কেটে চললে আমি আশা করলাম মানবিক সম্পর্ক নিয়ে আমার নতুন কিছু জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছে। একটু কৌশলীও হই, আর অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত হলাম। এর ফলে হুকুম দেবার বদলে জ্বলন্ত আগুন দেখে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা এইভাবে শুরু করতাম :

কি ছেলেরা, সময় ভালো কাটছে? আর কি রান্না হচ্ছে?… আমার ছেলে বয়েসে আমরাও আগুন ধরাতাম–এখনও অবশ্য ভালোবাসি। কিন্তু তোমরা বোধহয় জানো না বাগানে আগুন জ্বালানো খুবই বিপজ্জনক। আমি অবশ্য জানি, তোমরা কোন অনিষ্ট করতে চাও না। তবে অন্য ছেলেরা সেরকম সাবধানী নয়। ওরা তোমাদের আগুন জ্বালাতে দেখে আগুন জ্বালায় অথচ খাওয়ার পর নিভিয়ে যেতে ভুলে যায় আর সেটা শুকনো পাতায় লেগে সব গাছ পুড়িয়ে ফেলে। তবে আমি কোন হুকুম করে তোমাদের আনন্দ মাটি করতে আসিনি। আমি চাই তোমরা আনন্দ করো। তবে দেখ, তোমরা শুকনো পাতাগুলো এখনই আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে নাও-আর যাওয়ার সময় ধুলোয় আগুনটা চাপা দিতে ভুল না। করবে তো এটা? এরপর যখন আনন্দ করতে চাইবে পাহাড়ের উপর যেখানে বালি আছে সেকানে ধরালে কেমন হয়? তাতে কোন ক্ষতিও হবে না …। এখানে আগুন জ্বালালে জেলও হতে পারে। তোমাদের ধন্যবাদ। আচ্ছা, এবার আসি। তোমরা স্ফুর্তি কর।

এ ধরনের কথায় কত তফাৎ ঘটে যায়। এর ফলে ছেলেরা সহযোগিতা করতে চায়। কোন বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতা তাদের মধ্যে থাকে না। তাদের হুকুম করে বন্ধ করতে হয় না। কারণ তারা তাদের মুখ রক্ষা করতে পেরেছে। এতে তাদের মন ভালো থাকে, আমিও সেরকম থাকি কারণ আমি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখতে চেয়ে অবস্থাটা সামাল দিয়েছি।

.

এর পরের বার কাউকে ওই আগুন নেভানোর কথা বলার বা অন্য কাজ করানোর আগে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা একটু চোখ বন্ধ করে দেখে নিন। এটা করলেই ভালো নয় কি? নিজেকে প্রশ্ন করুন : ‘লোকটি একাজ করতে চায় কেন?’ এটা সত্যি যে এতে সময় লাগবে। তবে তাতে নতুন বন্ধু পাবেন আর ঝগড়া রেষারেষির বদলে ভালো ফলও লাভ হবে। এতে জুতোর তলাও ক্ষয় হবে কম।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ডীন, ডনহ্যাস বলেছিলেন : কারও অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার আগে অফিসের সামনের রাস্তায় দুঘন্টা পায়চারী করতে চাই, কিন্তু কোনো পরিষ্কার ধারণা না নিয়ে ঢুকতে চাই না। যেমন আমি কি বলবো তারই বা উত্তর কি হবে। যার কাছে যাবো তার দৃষ্টিভঙ্গী জেনে রাখাই শ্রেয়।

কথাটা এতই দামী যে বারবার সেটা মনে রাখা দরকার।

এই বইটি পড়ার পর যদি সর্বদা সবকিছু অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অভ্যাস জন্মায় তাহলে এটা নিঃসন্দেহ যে আপনার জীবনে এটা হয়ে উঠবে একটা দি দর্শন আর সুন্দর কোন অভিজ্ঞতা।

তাই অন্যের বিরক্তি না জাগিয়ে মানুষকে যদি পরিবর্তন করতে চান তাহলে ৮ নম্বর নিয়ম হল : ‘আন্তরিকভাবে অপরের দৃষ্টিকোণ থেকেই সব কিছু দেখার চেষ্টা করুন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *