অপালা শান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে।
সোমাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছে অনেক আগে, কিন্তু এখনো তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। কত-কত জায়গায় সে গেল! একটি গলি ছাড়িয়ে অন্য একটি গলি, তারপর একটা বড় রাস্তা। আবার একটা গলি। একসময় সে একটা ফাঁকা মাঠের কাছে এসে পড়ল। চারদিক অন্ধকার হয়ে এলেও একদল ছেলেমেয়ে মাঠে খেলছে। কী সুন্দর লাগছে তাদের।
বিচিত্র ধরনের খেলা। একটা ছেলে ছুটতে থাকে সবাই তার পেছনে ছোটে। একসময় ছেলেটা বসে পড়ে ছড়ার মত কী একটা বলে, অমনি দলের সবাই উল্টো দিকে ছুটতে থাকে। অপালা গভীর আগ্রহে। ওদের খেলা দেখতে লাগল।
ফিরোজ বলল, তোমার নামটা গ্রাম্য ধরনের। এই যুগে লতিফা কারোর নাম হয়? নামটা আমি বদলে দেব।
কী নাম দেবেন?
আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে এখন থেকে তোমার নাম ফিরোজা। কী পছন্দ হয়েছে?
উল্টোটা করলে কেমন হয়? আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে আপনার নাম হোক লতিফ।
বলেই লতিফা খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ফিরোজ। মেয়েরাও যে রসিকতা করতে পারে, বিশেষ করে এই মেয়ে, যার জীবন এ-পর্যন্ত বোরকার আড়ালে কেটেছে তা ফিরোজ কল্পনাও করেনি।
আপনি রাগ করলেন না তো?
না, রাগ করিনি। আপনি-আপনি করছ, এই জন্যে রাগ লাগছে।
একদিনে কাউকে তুমি বলা যায়?
ইচ্ছা করলেই যায়।
তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?
হচ্ছে।
দাঁড়াও, একটা রিকশা নিয়ে নিই।
ফিরোজ রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। রিকশাওয়ালা পছন্দোবও একটা ব্যাপার আছে। এমন একজনকে নিতে হবে, যে তাদের দুজনের কথা কান পেতে শুনবে না। বুড়ো কোনো রিকশাওয়ালা। তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
অনেক ঝামেলা করে সে লতিফাকে বের কুরে এনেছে। হাজি সাহেব বাসায় থাকলে তা কিছুতেই সম্ভব হত না। হাজি সাহেবকে অনেক কায়দা করে খিলগায়ে পাঠানো হয়েছে। এই কাজটা করেছেন ফিরোজের শাশুড়ি। যদিও তিনি বার-বার বলেছেন বিয়ে তো এখনো পুরোপুরি হয়নি। এখন দুজনে একসঙ্গে বের হওয়া ঠিক না। কিন্তু এটা তার মুখের কথা, কারণ হাজি সাহেবকে খিলগায়ে পাঠানোর বুদ্ধিটা তারই।
লতিফা বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ফিরোজ হেসে বলল, আছে একটা জায়গা, এখন বলব না।
আমি জানি আপনি কোথায় যেতে চান।
তাই নাকি! বল, তো কোথায়?
অপালা বলে আপনার যে চেনা একজন আছেন, তার বাসায়।
বলতে-বলতেই লতিফা মুখ নিচু করে হাসল। ফিরোজ গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
এমনি হাসছি। মাঝে-মাঝে আমার খুব হাসি পায়।
কই, আমার তো পায় না।
সব মানুষ তো আর এক রকম হয় না। সবাই যদি এক রকম হত, তাহলে এখন আর আপনি ঐ বাড়িতে যেতে চাইতেন না; আমাকে সঙ্গে নিয়েই বেড়াতেন।
এটা আবার কী ধরনের কথা?
আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?
ফিরোজ সিগারেট ধরাল। সে সিত্য-সত্যি রেগে গিয়েছে। রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। ফিরোজের ধারণা ছিল, এই শাস্ত স্নিগ্ধ চেহারা মেয়েটি সাত চড়েও কথা বলবে না। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা তা নয়। মেয়েটা কথা বলতে পারে। কথা বলে খুব গুছিয়ে।
লতিফা, তোমার একটা ভুল আমি ভেঙে দিতে চাই। অপালাদের বাসায় যাবার জন্য আমি তোমাকে নিয়ে বের হইনি। তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি। একটু হাঁটব, কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসব। চট করে একটা ধারণা করা ঠিক না।
লতিফা চুপ করে রইল। ফিরোজের মনে হল মেয়েটি কান্না চাপার চেষ্টা করছে। এ-রকম কড়া গলায় কথা বলা উচিত হয়নি। এই মেয়ে খুব আদরে মানুষ হয়েছে, যে কারণে সে এত অভিমানী। কেঁদে ফেললেও অবাক হবার কিছু নেই, শুধু অবস্থাটা খুব অস্বস্তিকর হবে। রূপবতী একটা মেয়ে কাঁদছে, সে ভ্যাবলার মত পাশে দাঁড়িয়ে সন্দেহজনক চোখে সবাই তাকাবে।
লতিফা।
জি।
কেঁদে ফেলার চেষ্টা করছি নাকি?
যাতে কেঁদে না ফেলি, সেই চেষ্টা করছি।
ফিরোজ আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি কী সবসময় এ-রকম কথার পিঠে কথা বল, না। আমার সঙ্গেই বলছি?
আপনার সঙ্গেই বলছি। আমি কথা খুব কম বলি।
তুমি তো মনে হচ্ছে আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলবে।
না, তুলিব না। একসময় আমার কথা শুনে আপনার অভ্যাস হয়ে যাবে।
তারা একটা রিকশায় উঠল। ফিরোজ রিকশাওয়ালাকে অপালাদের বাড়ির দিকেই যেতে বলল। লতিফার গায়ে একটা চাদর। তার হাত চাদরের নিচে। ফিরোজ ভয়ে-ভয়ে লতিফার হাতে তার হাত রাখল। লতিফ ভীষণভাবে চমকে উঠে ও সামান্য হাসল।
লতিফা।
জি।
অপালাদের বাসায় আমরা কেন যাচ্ছি, বল তো?
ওনাকে আপনার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তাই যাচ্ছেন। তা ছাড়া হঠাৎ বিয়ে করে নিজেকে আপনার খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
চুপ কর তো, কী বক-বক শুরু করলে? আপরাধী মনে করার কী আছে। আমি চুরি করেছি, না ডাকাতি করেছি? এই মেয়ের সঙ্গে যেদিন আমার পরিচয়, সেদিনই আমি তাকে বলেছি যে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিকঠাক। যদি আমার কথা বিশ্বাস না-হয়, তাকেই জিজ্ঞেস করো।
আজ দারোয়ান তাকে গোটে আটকাল না। রূপবতী একটি মেয়ে পাশে থাকার অনেক রকম সুবিধা আছে। কাজের মেয়েটি যত্ন করে বসার ঘরে নিয়ে বসাল। তার কাছে জানা গেল, অপালা সারা দিন বাসায় ছিল না। এই কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে।
লতিফার চোখে বিস্ময়। এত বিশাল বাড়ি সে কল্পনাও করেনি। যা দেখছে তাতে মুগ্ধ হচ্ছে। এক সময় চাপা গলায় বলল, এদের বসার ঘরটা কত সুন্দর দেখেছেন?
সুন্দর লাগছে তোমার কাছে?
খুবই সুন্দর! ইস, আমাদের যদি এ রকম একটা বসার ঘর থাকত, তাহলে আমি আর কিচ্ছু চাইতাম না।
এই বসার ঘরটা আমার তৈরি করে দেয়া। ডিজাইন, ডেকোরেশন সব আমার।
সত্যি।
হ্যাঁ, সত্যি। তুমি চাইলে এর চেয়ে সুন্দর একটা ঘর আমি তোমার জন্যে বানিয়ে দেব।
আমি চাই। আমি একশ বার চাই। ঐ ছবিটাও তোমার আকা?
এই প্রথম লতিফা তুমি বলল। সে নিজেও তা বুঝতে পারল না। তার মুগ্ধ দৃষ্টি ছবিটির দিকে।
ছবিটা ভাল লাগছে?
হুঁ।
কেন ভাল লাগছে?
তা তো জানি না।
ফিরোজ মৃদু স্বরে বলল, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এইটা। অনেক সময় আমাদের অনেক কিছু ভাল লাগে, কিন্তু কেন ভাল লাগে তা আমরা বুঝতে পারি না। বুঝতে চেষ্টাও করি না।
সব কিছু বুঝে ফেলাও ভাল না।
ফিরোজ মনে-মনে হাসল। এই মেয়েটি দার্শনিক টাইপ নাকি? কত সহজে কঠিন কঠিন কথা বলেছে।
কাজের মেয়েটি ট্রেতে করে চা এবং নানান ধরনের খাবার-দাবার নিয়ে এসেছে। সে চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে মৃদু স্বরে বলল, আপার শরীরটা ভাল না। আপা আজকে একতলায় নামবে না। আপনেরা আরেক দিন আসেন। ফিরোজের মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেল। লতিফা বলল, আমি উপরে গিয়ে ওনাকে দেখে আসি?
কাজের মেয়েটি বলল, জি না। বাইরের মানুষের উপরে উঠা নিষেধ আছে। লতিফা চ্যায়ের কাঁপে চিনি ঢেলে হালকা গলায় বলল, মিষ্টি হয়েছে কী না দেখা। ফিরোজ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তে রেগেমেগে একটা কাণ্ড করবে। লতিফা মৃদু স্বরে বলল, চা না খেয়ে যাওয়াটা আরো খারাপ হবে। চা খাও, কিছুক্ষণ বস। কাপগুলো কী সুন্দর, দেখেছি? তুমি আমাকে এ রকম এক সেট কাপ কিনে দিও।
ফিরোজ চুপ করে আছে। লতিফা শাড়ির আঁচলে গা ভাল মত জড়াতে-জড়াতে বলল, আজি বেশ শীত পড়েছে। তোমার শীত লাগছে না?
এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব পাওয়া গেল না। ফিরোজ রিকশায় বসে আছে পাথরের মতো, তাকিয়ে আছে। শূন্যদৃষ্টিতে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। লতিফা চাপা গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা বলি? তুমি শুধু নিজের কথাটাই দেখছি। নিশ্চয়ই ওনার কোনো সমস্যা হয়েছে। কেউ কি আর ইচ্ছা করে কাউকে অপমান করে?
চুপ করে থাক। তুমি বেশি বক-বক কর।
সবার সঙ্গে করি না। কোনোদিন করবও না। শুধু তোমার সঙ্গে করব, রাগ কর আর যাই কর।
লতিফা তার হাত রাখল ফিরোজের হাতে। সেই হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফিরোজ বিস্মিত হয়ে বলল, কি হয়েছে লতিফা?
কিছু হয়নি।
কাঁদছ নাকি?
হ্যাঁ, কাঁদছি। তুমি এত লজ্জা পেয়েছ, তাই দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফিরোজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো বড় অদ্ভুত মেয়ে! সত্যি সত্যি কাঁদছে। ফিরোজ বিব্রত স্বরে বলল, কী শুরু করলে তুমি, কান্না থামাও তো!
লতিফা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, চেষ্টা করছি, পারছি না।