১৭। মৃতের সঙ্গে দেখা

১৭। মৃতের সঙ্গে দেখা

অতিথিশালার ঘরে ইরতেনসে ফিরে আসার পর দেখল উপল বসে আছে। তার সামনে রাখা আছে অনেকটা চওড়া একটি আয়তকার পাত্র। পাত্রের মধ্যে বালি ভরা। তার উপরে একটি সরু এবং লম্বা শণের কাঠি দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে উপল। এই দেশে লেখালিখির জন্য প্যাপিরাস থাকলেও তার যোগান খুব বেশি নয়। তাই কোন প্রয়োজনীয় নথি তৈরি ব্যতীত এর ব্যবহার হয় না।

ছোটখাটো লেখালিখি বা হিসাবনিকেশ যা স্থায়ী হবে না তার জন্য ব্যবহার করা হয় এই বালি ভর্তি আয়তকার পাত্রটিকে। মিশরীয়রা একে বলে সালো। শণের কাঠি দিয়ে আঁকাজোকা করে নিয়ে আবার মসৃণ কাঠের টুকরো দিয়ে সালোর বালির উপরিভাগকে সমতল করে নেওয়া যায়, তারপর আবার তার উপরে আঁক কাটা হয়। এ দেশে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও এই সালোর উপরে হস্তলিপি এবং অঙ্কের অনুশীলন করে। ইরতেনসেনু উপলের পাশে এসে দাঁড়াল, বলল, ‘আপনার কাজ কতদূর নাবিক মহাশয়?

উপল তার দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে হাসল, ‘প্রায় সম্পূর্ণ। তবে তোমাদের বায়ুযানে ওঠার আগে অবধি তো বুঝতে পারছি না আমার গণনা কার্যকরী হবে কি না।’

যতদিন ধরে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু বায়ুযান তৈরিতে ব্যস্ত ছিল ততদিন উপলও মন দিয়েছিল নিজ অংশের দায়িত্ব পালনে। বায়ুযান একবার শূন্যে ভাসমান হলে বাতাসের বলে ধাবিত হবে। বাতাস এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়, কিন্তু পাহাড়ের গাত্রে ধাক্কা লেগে সেই বাতাস ডাইনে বা বাঁয়ে দিক বদল করতে পারে। আবার নীলনদের গতিপথও সোজা নয়, সর্পিল। তাই নদীপথ ধরে এগোতে হলে বায়ুযানের অভিমুখ প্রায়শই বদল করতে হবে। সেই কাজ কীভাবে সম্পন্ন হবে তার ভার উপলের উপরে।

এই কয়েক দিনে সে একবার নীলনদের দক্ষিণে গমন করেছে, যতটা পথ যাওয়া যায় ততটাই আর কী, সেশেনুর অরণ্যের প্রান্তদেশ অবধি। নদীর গতিপথের একটি নকশা সে এঁকে নিয়েছে, তার সঙ্গে খেয়াল করেছে নদীর বিভিন্ন বাঁকে বায়ুর অভিমুখ। সেশেনুর অরণ্যের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি পর্বত। উপলের বিশ্বাস এই পর্বতের মাঝে একটি গিরিপথ থাকবেই, তবে সেই অংশে বায়ুর গতিপথও অনেক বেশি হবে। সেখানে বায়ুযানের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে তা নিয়ে উপল এখনও চিন্তিত। সেই অঙ্ক কষার সময়ই ইরতেনসেনুর আবির্ভাব হল।

উপল তার হাতে ধরা শণের কাঠিটিকে নামিয়ে রাখল। অনেক হয়েছে, এখন আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, নিজের মনকে শান্ত রাখতে হবে। ইরতেনসেনু উপলের পাশে এসে বসল। উপল নিজের মুখে হাসি রেখে বলল, ‘অনেক হয়েছে। আগামীকাল কী হতে চলেছে তা নিয়ে ভেবে আজকের দিনটা আর নষ্ট করব কেন? এই কয়েক দিনে যথেষ্ট শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম হয়েছে। এখন মনকে একটু আনন্দ দেওয়ার প্রয়োজন। চলো কিছু সুখাদ্যে উদরপূর্তি করা যাক। আমার বন্ধুটি কোথায়? সে কি এখনও তার যন্ত্রের কলসিগুলির মধ্যে কাঠের গুঁড়ো ভরে চলেছে?’

ইরতেনসেনু সংক্ষেপে উপলকে বলল হাতসেপসুতের সঙ্গে হওয়া কথোপকথনের কথা। উপল ভাবলেশহীন মুখে শুনল, তারপর বলল, ‘অগস্ত্যকে আমি চিনি। বিজ্ঞান তাকে অনুসন্ধিৎসার অভ্যাস দিয়েছে। কিন্তু সেনেনমুতের মৃত্যু নিয়ে সে কেন এতটা ভাবছে বুঝতে পারছি না। যাই হোক, চলো, এই বদ্ধ ঘরে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না।’

এই বলে একপ্রকার জোর করেই ইরতেনসেনুকে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে এল উপল। তাদের গন্তব্য একটি সরাইখানা। সরাইখানাটি প্রাসাদ থেকে হাঁটা পথে কিছুটা দূরে। সন্ধ্যের সময় সেখানে খুব বেশি ভিড় ছিল না। ইরতেনসেনুদের দেখেই তাদেরকে সাদর আমন্ত্রণে সরাইখানার ভিতরে একটি সুদৃশ্য আসনে বসানো হল। শহরের সবাই এখন উপলকেও চেনে। আগামীকালের অদ্ভুত জাদুকে চাক্ষুস দেখার জন্য শহরবাসী মুখিয়ে আছে। সরাইখানার কর্তাটি পরম আগ্রহে একের পর এক সুস্বাদু খাবার উপল আর ইরতেনসেনুর সামনে পরিবেশন করছিল। তার মধ্যে ছিল আঙুর পাতায় মোড়া সিদ্ধ মাংস, আগুনে পোড়ানো শূকরের নরম মাংস, সদ্য উনুন থেকে নামানো যবের রুটি, ভুট্টা ভাজা, আরও কত কী।

ঘরটির এক পাশে ঢোলকের মতো দেখতে একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল এক মধ্যবয়সি পুরুষ, সেই বাজনার তালে নাচ্ছিল একজোড়া নর্তক-নর্তকী। কিছুক্ষণের জন্য সব চিন্তা, ক্লেশ ভুলে গিয়েছিল ইরতেনসেনু। সে খাওয়া থামিয়ে বাজনার তালে তালে দু’হাতে তালি বাজিয়ে নাচিয়েদের উৎসাহিত করছিল। এই সুর, এই নাচ, এই সুগন্ধী খাদ্যের স্বাদ, এও তো জীবন। এর মধ্যে ডুবে থাকতে ভালো লাগছিল তার। একসময় কাঁধে হালকা টোকা পড়তে সে পিছন ফিরে তাকাল, দেখল অগস্ত্য দাঁড়িয়ে।

উপল শশব্যস্ত হয়ে অগস্ত্যর হাত ধরে টেনে তাকেও ভোজনের আসনে বসিয়ে দিল। অগস্ত্যর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এখন এই খাদ্যদ্রব্যের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কোনও রকমে কিছুটা খেয়েই সে বলল, ‘চলো এবারে ওঠা যাক, একটি ছোট কার্য এখনও বাকি আছে।’

কার্যটি যে কী তা অগস্ত্য বলল না, তার থমথমে মুখ দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও হল না ইরতেনসেনুর। তার পিছু পিছু এসে তিনজনে একটা ঘোড়ায় টানা শকটে উঠল। সহিসের হাতে দুটি তামার মুদ্রা দিয়ে অগস্ত্য বলল, ‘গোকের কর্মশালায় যাব।’

অগস্ত্যর মুখের কথা শুনে ইরতেনসেনু চমকে উঠল।

গোকের নাম এই শহরে শোনেনি এমন মানুষ নেই। তার বয়স নব্বই এর আশেপাশে। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় সে কেবল ষাটটি বসন্তেরই সাক্ষী থেকেছে। গোকের কর্মশালাটি শহরের বাইরে। বাকুর পাহাড়ের পাদদেশে। নদী থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়ায় এই অঞ্চলের বাতাসে আর্দ্রতা অনেকটাই কম। এমন কর্মশালার জন্য শুষ্ক আবহাওয়ার ভীষণ প্রয়োজন। কারণ এই আবহাওয়াতে চামড়া, মাংস শুকাতে সুবিধা হয়, জীবানুর আক্রমণে তা নষ্ট হয়ে যায় না। গোকের কর্মশালায় মমি তৈরি হয়।

মমি তৈরির কর্মশালায় অগস্ত্যর কী প্রয়োজন তা জিজ্ঞাসা করাতে সে শুধু বলেছিল, চলো দেখতে পাবে। এইটুকু বলেই চুপ করে গিয়েছিল। পথে উপল কেবল আরেকটি প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি জানলে কী করে যে আমরা ওই সরাইখানাতেই আছি?’

‘অতিথিশালায় পৌঁছে খবর পেলাম তোমরা সান্ধ্যভোজন সেখানে করনি। কয়েকদিন আগে ওই সরাইখানায় শূলপক্ক শুকরের মাংস খেয়ে এমন গুণগান গাইছিলে যে মনে হল যাত্রার আগে নিশ্চয়ই ওখানেই আরও একবার খেতে যাবে। তোমাকে আমি চিনি ভালো করেই।’

উত্তরে বলেছিল অগস্ত্য। তারপর আবার সবাই চুপচাপ।

মমি তৈরির কর্মশালাটি একতলীয়। বাইরের দরজা দিয়ে তার ভিতরে প্রবেশ করার পর অগস্ত্যরা একটি বেশ চওড়া উঠোনে এসে পড়ল। উঠোনের এক পাশে কয়েকটি চৌবাচ্চা রয়েছে, সেগুলির মুখ কাঠের চওড়া পাটাতন দ্বারা বন্ধ করা, এক ভারি ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে রয়েছে উঠোন। গন্ধটি প্রথমবার নাকে এসে লাগার পর মিষ্ট মনে হলেও তারপর সেই গন্ধের মধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অগস্ত্য কাজ করতে থাকা একটি শ্রমিককে কাছে ডেকে এনে বলল, ‘গোকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাদের রাজ চিকিৎসক বেবতি পাঠিয়েছেন।’

এই বলে তার হস্তে একটি ছোট সম্পুট দিল। লোকটি একটি ঘরের মধ্যে অন্তর্হিত হল। অগস্ত্যরা অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘদেহী এক প্রৌঢ় বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে অগস্ত্যর সম্পুটটি। তিনি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমিই গোক, বলুন কী ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।’ এটি বলার সময় গোকের চোখ পড়ল ইরতেনসেনুর উপরে। তিনি ইরতেনসেনুকে চিনতে পেরে মাথা নীচু করে সম্ভাসন জানালেন। ইরতেনসেনুও প্রতি নমস্কার জানাল তাঁকে। অগস্ত্য এবারে বলল, ‘একটি প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছিলাম।’

‘হ্যাঁ বলুন।’

‘মহামন্ত্রী সেনেনমুতের মমিটি আপনি প্রস্তুত করছেন। সেটি যদি একবার দেখা যেত তাহলে ভালো হতো। তিনি ছিলেন ইরতেনসেনুর পালক পিতা, সে তাকে শেষবারের জন্য দেখতে চায়।’

ইরতেনসেনু চমকে উঠল! এই কারণে অগস্ত্য তাকে এই স্থানে নিয়ে এসেছে! তাহলে যাত্রাপথে এই কথা সে জানাল না কেন? কোন গর্ভে ইরতেনসেনুর জন্ম তা সে জানে না, সেনেনমুতই তার পিতা এবং মাতা, দুই-ই ছিলেন। তাঁর মৃতদেহ সে দেখতে পারবে? প্রাণহীন পালক পিতার শরীরটির দিকে তাকাতে পারবে সে? ইরতেনসেনুর গলার কাছে একটি কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠল, নিজের চোখের জল ঢাকতে সে মাথা নামিয়ে নিল।

অগস্ত্যর এই আকস্মিক কাজে সে আহত হয়েছে, কোথাও গিয়ে যেন তাদের মধ্যের বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়েছে। উপলও এতে যারপরনাই বিরক্ত তা বোঝা যায় তার মুখমণ্ডলের ভাব দেখে। সে জানে তার বন্ধুটির সংবেদনশীলতা কম, বিজ্ঞানের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে তার হৃদয়ের এই আপাত শুষ্কতার পরিচয় সে আগেও পেয়েছে। কিন্তু ইরতেনসেনুর সঙ্গে তার এমন ব্যবহারের কী সত্যই কোনও প্রয়োজন ছিল? উপল গম্ভীর গলায় বলল, ‘ইরতেনসেনু তার পিতার মৃত্যুতে গত কয়েকদিন ধরেই মূহ্যমান হয়ে রয়েছেন। এই অবস্থায় তাকে সেনেনমুতের মৃতদেহের সামনে নিয়ে আসার কি খুব প্রয়োজন ছিল?’

অগস্ত্য এবারে অস্বস্তিতে পড়ল। গোক তার দিকে এক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু অগস্ত্য কিছু বলার আগেই ইরতেনসেনু বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই অগস্ত্যকে বলেছিলাম যদি একটি বারের জন্য পিতাকে দর্শন করতে পারি। তাকে আমার শেষ প্রণাম জানাবার সুযোগ পাব তাহলে।’

এবারে যেন গোক সামান্য আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। কিছুক্ষণ সময় দিন আমাকে। ভিতরে মহান সেনেনমুতের দেহটিকে নিয়ে কর্মরত ছিল আমার কারিগরেরা। তারা ব্যবস্থাটা একটু গুছিয়ে নিক, তারপর আমি দর্শনের সুযোগ করে দেব।’

এই বলে গোক ঘরের ভিতরে আবার প্রবেশ করলেন। ইরতেনসেনুর কথায় অগস্ত্য এবং উপল দুজনেই চমকে গিয়েছিল। অগস্ত্য ইরতেনসেনুর দিকে চেয়ে দেখল সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল অগস্ত্য। উপলের মুখে তখনও বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনজনের মধ্যে একটিও বাক্য বিনিময় হল না। খানিকক্ষণ পর গোক বাইরে এলেন, বললেন, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, তারপরই আমরা সেনেনমুতের দর্শন করতে পারব। আপনারা আগ্রহী হলে ততক্ষণ এই কর্মশালাটি ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।’

অগস্ত্য বলল, ‘অবশ্যই।’

এই অস্বস্তিকর পরিবেশে দাঁড়িয়ে থাকার তুলনায় কর্মশালার মধ্যে হাঁটা বেশি শোভনীয়। গোকের পিছন পিছন তারা তিনজন চলতে লাগল। অগস্ত্য গোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিশরের মমি তৈরির প্রক্রিয়ার কথা আমি আগে শুনে থাকলেও তা কখনো চাক্ষুস দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বিজ্ঞানকে সম্বল করে আপনারা যে অসাধ্য সাধন করেছেন তা সমগ্র পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর। আচ্ছা গোক, এই প্রক্রিয়ায় আপনারা মৃত মানুষের শরীরকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এতে তার চেহারার কোনও পরিবর্তন হয়?

‘না, বাইরে থেকে দেখলে কোন রকমের পরিবর্তন বুঝতে পারবেন না আপনারা। এই প্রক্রিয়াকে আয়ত্তে আনতে কয়েক সহস্র বছর ধরে গবেষণা করতে হয়েছে আমার পূর্বজদের। আমি শুধু তার সুবিধা লাভ করছি।’

‘তাহলে মৃতের চর্মও একই রকম থাকবে?’

‘হ্যাঁ, প্রায় একরকম থাকবে। একশত বছরের পুরোনো মমিকে যখন সমাধি থেকে তুলে এনে অন্য সমাধিতে স্থানান্তরিত করা হয় তখনও আমি লক্ষ করেছি, মৃতের দেহ প্রায় একইরকম অবিকৃত থেকে যায়। তবে এই পদ্ধতিটি বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। এই দেখুন।

এই বলে গোক একটি চৌবাচ্চার কাছে এনে দাঁড় করালেন অগস্ত্যদের। চৌবাচ্চার উপরিভাগ কাঠের একটি পাটাতন দ্বারা ঢেকে রাখা আছে। ইরতেনসেনুর পা দুটি যেন ভারী হয়ে গেছে, চলতে তার ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তার মন যেন কোথাও বলছে অগস্ত্যর এ হেন আচরণের কোন এক যথার্থ কারণ আছেই। গোক কাঠের পাটাতনটি কিছুটা সরিয়ে দিলেন, তারপর চৌবাচ্চার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন, ‘দেখুন।’

অগস্ত্যরা সামান্য একটু ঝুঁকে চৌবাচ্চার ভিতরে তাকাল। চৌবাচ্চাটির ভিতরে লবণ ভর্তি করে রাখা আছে। তার মধ্যে শোয়ানো আছে এক বৃদ্ধকে। তার বয়স আনুমানিক ষাট হবে। বৃদ্ধের পেটের উপরে একটি কাটা দাগ, সেটিকে সুতার দ্বারা সেলাই করা। গোক বললেন, ‘তিনি থীবসের একজন বিত্তশালী পুরুষ। তাঁর মৃত্যু কতদিন আগে হয়েছে বলে আপনাদের মনে হয়?’

মৃতদেহটিকে আরও একবার ভালো করে দেখল অগস্ত্যরা। বৃদ্ধের দেহের চামড়া সজীব, দুই হাতের উপরে শিরা উপশিরার উপস্থিতি স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন বৃদ্ধ ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন, সামান্য টোকা দিলেই উঠে বসবেন। বেশ কিছুক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বুকটি বোধ হয় শ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে। গোকের প্রশ্নের উত্তরে উপল বলল, ‘দেখে মনে হচ্ছে আজ সকালেই হয়তো ইনি গত হয়েছেন।’

গোক তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘তিনি পরলোকের অনন্ত যাত্রায় গমন করেছেন আজ সকালে না, একটি মাস আগের অন্য এক সকালবেলায়।’

গোকের কথায় উপলেরা যারপরনাই অবাক হল। একটি মাস আগে এই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে! তাহলে এখনও এর ত্বক এত সজীব, এত প্রাণবন্ত থাকে কী করে! এ কেমন জাদু!

এমন সময় একটি ভৃত্য এসে জানাল যে সেনেনমুতের দেহ ইরতেনসেনুর দর্শনের জন্য প্রস্তুত। গোকের পিছনে হেঁটে এবারে অন্য একটি ঘরে এল অগস্ত্যরা। ঘরটিতে প্রবেশের আগে তাদের তিনজনের হাতে তিনটি মুখোশ তুলে দিলেন গোক, বললেন, ‘এই ঘরে প্রবেশের আগে এগুলিকে পরে নিন।’

অগস্ত্য দেখল তার হাতের মুখোশটি একটি শিয়ালের। গাঢ় বাদামী বর্ণের মুখোশটির চোখের কাছে গোল গর্ত করা, নাকের অংশটি সামনের দিকে এগোন। অগস্ত্য এতে বেশ অবাক হল। উপল জিজ্ঞাসা করল, ‘শুনেছি মিশরের পুরাণের মতে দেবতা আনুবিসই প্রথম মমি তৈরি করেন। সেই মমি ছিল দেবতা ওসাইরিসের। এমন লোককথার জন্যই কি এই মুখোশ?’

‘না, এর একটি বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। যে ঘরে আমরা এখন প্রবেশ করতে চলেছি তাতে মমি তৈরির শেষ ধাপটি সম্পন্ন হয়। এখানে মৃতের দেহে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করি আমরা। এই বস্তুগুলি থেকে যে বায়ু উদগত হয় তা শ্বাসের পক্ষে ক্ষতিকারক। সেই কারণেই মূলত এই মুখোশের ব্যবহার। খেয়াল করে দেখুন এর নাকের অংশটি অনেকটাই সামনের দিকে এগিয়ে আছে। এই অংশের মধ্যে থাকে একটি সিক্ত কাপড়ের টুকরো, এর ভিতরে থাকে কাঠ কয়লা। ঘরের বাতাস এই কাপড়ের টুকরোর মধ্য দিয়ে গমন করার সময় শোধিত হয়, তাই নাকে যে বাতাস এসে পৌঁছয় তাতে কোন শারীরিক ক্ষতি হয় না।’

মুখোশটি পরিধানের পর তারা একে একে সেই ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটি অন্যান্য ঘরগুলির থেকে অনেকটা আলাদা। প্রথমত এটি আকারে বড়, দ্বিতীয়ত এই ঘরে কোনও রকমের জানালা নেই। দেওয়ালে লাগানো মশালের আলোয় ঘরটি আলোকিত হয়ে রয়েছে। ঘরের মেঝের উপরে শোয়ানো রয়েছে চারটি বেশ প্রশস্ত প্রস্তরখণ্ড। তাদের তিনটি ফাঁকা হলেও অন্যটিতে এক ব্যক্তিকে যে শোয়ানো আছে তা বোঝা যায়। তার সামনে আনুবিসের সেই মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনজন কারিগর। সেইদিকে এগিয়ে গেল অগস্ত্যরা।

প্রস্তরখণ্ডটির উপরিভাগ সমতল। তার উপরে শোয়ানো আছে মহামন্ত্রী সেনেনমুতের নিথর দেহ। একটি বস্ত্রখণ্ড দিয়ে তার কটিদেশ ঢাকা, বাকি উন্মুক্ত। কয়েক পক্ষকাল আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, অথচ তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি এখনও জীবন্ত! ঘুমিয়ে রয়েছেন কেবল। ইরতেনসেনু একদৃষ্টে সেনেনমুতের দিকে চেয়ে রইল। যে পিতাকে ত্যাগ করে পাঁচ বছর আগে সে ভিনদেশে যাত্রা করেছিল তাঁকে এভাবে কখনও দেখতে হবে এমন সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি।

সেনেনমুতের মুখ যেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট। তাঁর সবল শরীর যেন শুকিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর আগেই। শরীরে একটি গাঢ় বাদামী-হলুদ রঙের আভা। ইরতেনসেনু আর তাকিয়ে থাকতে পারল না, চোখের জল ঝাপসা করে দিল তার দৃষ্টি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। অগস্ত্য তার কাঁধে হাত রাখল। গতবারে যখন সে এই দেশে এসেছিল তখন সেনেনমুতের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল তার। কিন্তু সেই সাক্ষাৎই যে শেষ দেখা হবে তা কেই বা জানত!

অগস্ত্য এবারে সেনেনমুতের দেহের কাছে এগিয়ে এল, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখল, তারপর গোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মহামন্ত্রীর দেহে কালো বর্ণের গোলাকার কিছু চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। বুক এবং উদরের উপরে সেই চিহ্নের সংখ্যা বেশি। একমাত্র খুব কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে এদের উপস্থিতি। এগুলি কি মমি তৈরির প্রক্রিয়ার কারণে হয়েছে?’

‘না, সেনেনমুতের দেহ যখন এই কর্মশালায় আসে তখনই আমি খেয়াল করেছিলাম যে তাঁর সর্বাঙ্গে যেন অজস্র ক্ষত। এই অংশগুলিতে চামড়া ভীষণই পাতলা হয়ে ফুলে উঠেছিল, পরে যখন লবণের চৌবাচ্চায় দেহটিকে প্রবেশ করানো হয় তখন দেখলাম ক্ষতগুলি ফেটে গিয়ে জলের মতো কিছু একটা বেরিয়ে এল, তারপর চর্মের ক্ষতগুলি ধীরে ধীরে এমন কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে।’

অগস্ত্য এবারে আবার ইরতেনসেনুর পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমরা আসছি।’

ইরতেনসেনু কোন কথা না বলে ঘর থেকে প্রস্থান করার পর অগস্ত্য গোকের দিকে আবার ফিরে তাকাল, বলল, ‘আশ্চর্য বিজ্ঞানের আশীর্বাদের অধিকারী আপনি গোক। মৃতের শরীরে প্রাণ না থাকলেও যেন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার দৃষ্টিতে আপনিও একজন বৈজ্ঞানিক। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নেবেন। একটি শেষ অনুরোধ আছে আপনার কাছে, সেটি জানাতে পারি?’

প্রীত স্বরে গোক বললেন, ‘হ্যাঁ বলুন।’

‘আমি শুনেছিলাম যে মমি প্রস্তুত করার সময় মৃতের যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলী এবং নাড়িকে বার করে নিয়ে চারটি পাথরের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। সেগুলিকে দেখা যেতে পারে?’

গোক এবারে তাদের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে এলেন। আনুবিসের মুখোশটি ততক্ষণে তারা খুলে রেখেছে। এই ঘরটি অনেকটাই ছোট। এখানে কাঠের পাটাতনের উপরে সারি দিয়ে রাখা আছে পাথরের তৈরি কিছু পাত্র। পাত্রগুলি আকৃতিতে খুব ছোট কলসের মতো। তাদের মাথার ঢাকনাগুলি এক-একটি পশু বা পাখির মুখের আদলে বানানো। গোক একটি নির্দিষ্ট পাটাতনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সামনে রাখা পাত্রগুলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইগুলিতে সেনেনমুতের অঙ্গগুলি রাখা আছে। এই বাঁদরের মুখওয়ালা পাত্রে রাখা আছে ফুসফুস। শিয়ালের মুখ যে পাত্রে আছে তাতে আছে পাকস্থলী, মানুষের মুখের পাত্রে আছে যকৃত এবং বাজপাখির মুখের আদলে তৈরি পাত্রে আছে নাড়ি। আমরা বিশ্বাস করি এই প্রতিটি পাত্রকে রক্ষা করেন এক একজন দেবদেবী। যেমন এই মানুষের মুখের আকৃতির পাত্রটিকে রক্ষা করেন দেবী আইসিস।

অগস্ত্য বলল, ‘এই পাত্রেই যকৃতটি রাখা আছে, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি কি একবার দেখতে পারি যকৃতটিকে? কীভাবে একটি অঙ্গকে সংরক্ষণ করেছেন আপনারা তা দেখার প্রবল আগ্রহ আমার।’

গোক এবারে সেই পাত্রটিকে খুললেন। হাতে ধরা একটি মাঝারী আকারের ধাতব চিমটার সাহায্যে সেনেনমুতের যকৃতটিকে বার করে এনে অন্য একটি পাত্রের উপরে রাখলেন। অগস্ত্য একটু এগিয়ে এসে যকৃতটিকে পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর বলল, ‘ধন্য আপনাদের প্রজ্ঞাকে। যকৃতটির আকার একেবারেই অবিকৃত রয়েছে! আচ্ছা এটিকে যখন শরীর থেকে বার করেন তখন কোন গন্ধ পান আপনারা?

‘না, এখন যে তিব্র মিষ্ট গন্ধটি আপনি পাচ্ছেন তা সংরক্ষণের কার্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের জন্য। মৃতের শরীরের ভিতরের অঙ্গে যে গন্ধ লেগে থাকে তা রক্তের। সেই গন্ধের বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। তবে শরীরের কোন অংশে চোট লেগে রক্তপাতের পরে এমন গন্ধ আমরা প্রায় সবাই পেয়ে থাকি। কিন্তু সেনেনমুতের যকৃতে এক অন্য প্রকারের গন্ধ আমি পেয়েছিলাম। এখন আবার মনে পড়ল।’

‘সেটি কেমন গন্ধ ছিল?’

অগস্ত্য যেন খুবই অগোছালো ভাবে প্রশ্নটি করল। গোক বললেন, ‘গন্ধটি বড়ই অদ্ভুত ছিল, হাঁসের ডিমের মধ্যে পচন ধরলে এমন গন্ধ পাওয়া যায়।’

কর্মশালা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার পর অগস্ত্য দেখল ইরতেনসেনু অশ্ব শকটের ভিতরে বসে আছে। অগস্ত্য এবং উপল শকটের উপরে উঠে বসল। অগস্ত্য বসল ইরতেনসেনুর পাশে। উপলের ইশারায় শকটটি চলতে লাগল অতিথিশালার অভিমুখে। অগস্ত্য ইরতেনসেনুর ডান হাতটি নিজের বাম হাতের মধ্যে নিল। খেয়াল করল ইরতেনসেনু হাত তার হাতের তালুকে জড়িয়ে ধরল না, আলগা ভাবে নিজের তালুটিকে রেখে দিল। অগস্ত্য মাথা নীচু করে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো। অতিথিশালায় ফিরে গিয়ে সবটা জানাব তোমাদের।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *