ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ২৬শে সেপ্টম্বর
দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ রাখাল প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরের সম্মুখে চাতালের উপর উপবিষ্ট। জগন্মাতাকে কালী-প্রতিমামধ্যে দর্শন করিতেছেন। কাছে মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। আজ ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; ভাদ্র কৃষ্ণা দশমী; বৈকালবেলা।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ঠাকুর বলিতেছেন, “ঈশ্বরের সম্বন্ধে কিছু হিসাব করবার জো নাই! তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য! মানুষ মুখে কি বলবে। একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ের কাছে গিয়ে, একদানা চিনি খেলে। তার পেট ভরে গেল; তখন সে ভাবছে, এইবার এসে সব পাহাড়টা গর্তের ভিতর নিয়ে যাব।
“তাঁকে কি বোঝা যায়। তাই আমার বিড়ালের ছানার ভাব, মা যেখানে রেখে দেয়। আমি কিছু জানি না। ছোট ছেলে মার কত ঐশ্বর্য তা জানে না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺কালীমন্দিরের চাতালে বসিয়া স্তব করিতেছেন, “ওমা! ওমা! ওঁকার-রূপিণী! মা! এরা কত কি বলে মা — কিছু বুঝিতে পারি না! কিছু জানি না মা! — শরণাগত! শরণাগত! কেবল এই করো যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় মা! আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ করো না, মা! শরণাগত! শরণাগত!”
ঠাকুরবাড়ির আরতি হইয়া গেল, শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। মহেন্দ্র মেঝেতে বসিয়া আছেন।
মহেন্দ্র পূর্বে পূর্বে শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ব্রাহ্মসমাজে সর্বদা যাইতেন। ঠাকুরকে দর্শনাবধি আর তিনি সেখানে যান না। শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদা জগন্মাতার সহিত কথা কন; তাহা দেখিয়া তিনি অবাক্ হইয়াছেন। আর তাঁহার সর্বধর্ম-সমন্বয় কথা শুনিয়া ও ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা দেখিয়া তিনি মুগ্ধ হইয়াছেন।
মহেন্দ্র ঠাকুরের কাছে প্রায় দুই বৎসর যাতায়াত করিতেছেন ও তাঁহার দর্শন ও কৃপালাভ করিতেছেন। ঠাকুর তাঁহাকে ও অন্যান্য ভক্তদের সর্বদাই বলেন, ঈশ্বর নিরাকার আবার সাকার; ভক্তের জন্য রূপধারণ করেন। যারা নিরাকারবাদী তাদের তিনি বলেন, তোমাদের যা বিশ্বাস তাই রাখবে, কিন্তু এটি জানবে যে, তাঁর সবই সম্ভব; সাকার নিরাকার; আর কত কি তিনি হতে পারেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহেন্দ্র — সাকার-নিরাকার — ডিউটি —
কর্তব্যবোধ — ভক্তের পক্ষে অবিদ্যার সংসার মৃত্যুযন্ত্রণা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি) — তুমি একটা তো ধরেছ — নিরাকার?
মহেন্দ্র –আজ্ঞে হাঁ, তবে আপনি যেমন বলেন, সবই সম্ভব; সাকারও সম্ভব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বেশ; আর জেনো তিনি চৈতন্যরূপর চরাচর বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
মহেন্দ্র — আমি ভাবি, তিনি চেতনেরও চেতয়িতা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখন ওইভাবেই থাক; টেনে-টুনে ভাব বদলে দরকার নাই। ক্রমে জানতে পারবে যে, ওই চৈতন্য তাঁরই চৈতন্য। তিনি চৈতন্যস্বরূপ।
“আচ্ছা, তোমার টাকা ঐশ্বর্য এতে টান আছে?”
মহেন্দ্র — না, তবে নিশ্চিন্ত হবার জন্য — নিশ্চিন্ত হয়ে ভগবানচিন্তা করবার জন্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হবে বইকি।
মহেন্দ্র — লোভ, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তা বটে, তাহলে তোমার ছেলেদের কে দেখবে?
“তোমার যদি অকর্তা জ্ঞান হয়, তাহলে ছেলেদের উপায় কি হবে?”
মহেন্দ্র — শুনেছি, কর্তব্য থাকতে জ্ঞান হয় না। কর্তব্য মার্তণ্ড।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখন ওইভাবে থাক; তারপর যখন আপনি সেই কর্তব্যবোধ যাবে তখন আলাদা কথা।
সকলেই কিয়ৎকাল চুপ করিয়া রহিলেন।
মহেন্দ্র — কতক জ্ঞানের পর সংসার! সে সজ্ঞানে মৃত্যু — ওলাউঠা!
শ্রীরামকৃষ্ণ — রাম! রাম!
মৃত্যু সময় জ্ঞান থাকলে খুব যন্ত্রণাবোধ হয়; যেমন কলেরাতে হয়। এই কথা বুঝি মহেন্দ্র বলছেন। অবিদ্যার সংসার দাবানল তুল্য — তাই বুঝি ঠাকুর “রাম! রাম!” বলিতেছেন।
মহেন্দ্র — অন্যলোক তবু বিকারের রোগী, অজ্ঞান হয়ে যায়; মৃত্যুযন্ত্রণা বোধ থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ না, টাকা থাকলেই বা কি হবে! জয়গোপাল সেন, অত টাকা আছে কিন্তু দুঃখ করে, ছেলেরা তেমন মানে না।
মহেন্দ্র — সংসারে কি শুধু দারিদ্রই দুঃখ? এদিকে ছয় রিপু, তারপর রোগ-শোক।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আবার মান-সম্ভ্রম। লোকমান্য হবার ইচ্ছা।
“আচ্ছা, আমার কি ভাব?”
মহেন্দ্র — ঘুম ভাঙলে মানুষের যা, যা — হবার তাই। ঈশ্বরের সঙ্গে সদা যোগ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি আমায় স্বপ্নে দেখ?
মহেন্দ্র — হাঁ, — অনেকবার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিরূপ? কিছু উপদেশ দিতে দেখ?
মহেন্দ্র চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — যদি দেখ আমাকে শিক্ষা দিতে, তবে জানবে সে সচ্চিদানন্দ।
মহেন্দ্র অতঃপর স্বপ্নে যাহা যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা সমস্ত বর্ণনা করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মনোযোগ দিয়া সমস্ত শুনিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি) — এ খুব ভাল! তুমি আর বিচার এনো না। তোমরা শাক্ত।