চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ২২শে সেপ্টম্বর
শ্রীযুক্ত অধরের বাড়ি — রাখাল, ঈশান প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
[বালকের বিশ্বাস, অস্পৃশ্য জাতি (The Untouchables) ও শঙ্করাচার্য, সাধুর হৃদয় ]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় অধরের বাড়ি শুভাগমন করিয়াছেন। ঠাকুর অধরের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। বৈকালবেলা। রাখাল, অধর, মাস্টার, ইশান১ প্রভৃতি ও অনেকগুলি পাড়ার লোক উপস্থিত।
শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভালবাসিতেন। তিনি Accountant General’s Office-এ একজন সুপারিনটেণ্ডেন্ট ছিলেন। পেনশন লইবার পরে তিনি দান-ধ্যান, ধর্মকর্ম লইয়া থাকিতেন ও ঠাকুরকে মাঝে মাঝে দর্শন করিতেন। মেছুয়াবাজার স্ট্রীটে তাঁহার বাড়িতে ঠাকুর একদিন আসিয়া নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে আহারাদি করিয়াছিলেন ও প্রায় সমস্ত দিন ছিলেন। সেই উপলক্ষে ঈশান অনেকগুলি লোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন।
শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের আসিবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসিতে পারেন নাই। ঈশান পেনশন লইবার পর ঠাকুরের নিকট দক্ষিণেশ্বরে প্রায় যাতায়াত করেন ও ভাটপাড়াতে গঙ্গাতীরে নির্জনে মাঝে মাঝে ঈশ্বরচিন্তা করেন। সম্প্রতি ভাটপাড়ায় গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করিবার ইচ্ছা ছিল।
আজ শনিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ (৬ই আশ্বিন, কৃষ্ণা ষষ্ঠী)।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি) — তোমার সেই গল্পটি বলতো; ছেলে চিঠি পাঠিয়েছিল।
ঈশান (সহাস্যে) — একটি ছেলে শুনলে যে ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই সে প্রার্থনা জানাবার জন্য ইশ্বরকে একখানি চিঠি লিকে ডাকবাক্সে ফেলে দিছিল। ঠিকান দিছিল, স্বর্গ। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — দেখলে! এই বালকের মতো বিশ্বাস২। তবে হয়, (ঈশানের প্রতি) — আর সেই কর্মত্যাগের কথা?
ঈশান — ভগবানলাভ হলে সন্ধ্যাদি কর্ম ত্যগ হয়ে যায়। গঙ্গাতীরে সকলে সন্ধ্যা করছে, একজন করছে না। তাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, আমার অশৌচ হয়েছে, সন্ধ্যা৩ করতে নাই। মরণাশৌচ, আর জন্মাশৌচ দুই-ই হয়েছে। অবিদ্যা মার মৃত্যু হয়েছে, আত্মারামের জন্ম হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর আত্মজ্ঞান হলে জাতিভেদ থাকে না, সেই কথাটি?
ঈশান — কাশীতে গঙ্গাস্নান করে শঙ্করাচার্য সিঁড়িতে উঠছেন — এমন সময় কুক্কুরপালক চণ্ডালকে সামনে দেখে বললেন, এই তুই আমায় ছুঁলি। চন্ডাল বললে, ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই — আমিও তোমায় ছুঁই নাই; আত্মা সকলেরই অন্তর্যামী আর নির্লিপ্ত। সুরাতে সূর্যের প্রতিবিম্ব আর গঙ্গাজলে সূর্যের প্রতিবিম্ব এ-দুয়ে কি ভেদ আছে?৪
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর সেই সমন্বয়ের কথা, সব মত দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়?৫
ঈশান (সহাস্য) — হরি-হরের এক ধাতু, কেবল প্রত্যয়ের ভেদ, যিনিই হরি তিনিই হর। বিশ্বাস থাকলেই হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর সেই কথাটি — সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়।
ঈশান (সহাস্যে) — সকলের চেয়ে বড় পৃথিবী, তার চেয়ে বড় সাগর, তার চেয়ে বড় আকাশ। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু এক পদে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, ত্রিভুবন অধিকার করেছিলেন। সেই বিষ্ণুপদ সাধুর হৃদয়ের মধ্যে! তাই সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়।
এই সকল কথা শুনিয়া ভক্তেরা আনন্দ করিতেছেন।
১ ঈশানের পুত্রগণ সকলেই কৃতবিদ্য। জ্যেষ্ঠ — গোপাল ডিস্ট্রিক্ট্ ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়াছিলেন। মধ্যম — শ্রীশচন্দ্র ডিসট্রিক্ট্ জজ হইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত সতীশ নরেন্দ্রের সহপাঠী সুন্দর পাখোয়াজ বাজাইতে পারিতেন। তিনি গাজীপুরে সরকারী কর্ম করিতেন, তাঁহারই বাসায় নরেন্দ্র প্রব্রজ্যা অবস্থায় কিছুদিন ছিলেন ও সেইখানে থাকিয়া পওহারী বাবাকে দর্শন করিয়াছিলেন। ভ্রাতাদের মধ্যে অন্যতম শ্রীযুক্ত গিরিশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্টান্ট রেজিষ্ট্রারের কার্য অনেকদিন করিয়াছিলেন।
ঈশান এত দান করিতেন যে, শেষে দেনাগ্রস্ত হইয়া অতি কষ্টে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর অনেক বৎসর পূর্বেই তাঁহার পত্নীবিয়োগ হইয়াছিল।
ঈশান ভাটপাড়ায় প্রায় মধ্যে মধ্যে গিয়া নির্জনে সাধন-ভজন করিতেন।
২ The kingdom of heaven is revealed unto babes but is hidden from the wise and the prudent — Bible.
৩ মৃতা মোহময়ী মাতা জাতো বোধময়ঃ সূতঃ।
সূতকদ্বয়সংপ্রাপ্তৌ কথং সন্ধ্যামুপাসমহে ৷৷
হৃদাকাশে চিদাদিত্যঃ সদা ভাসতি ভাসতি।
নাস্তমেতি ন চোদেতি কথং সন্ধ্যামুপাসমহে ৷৷ [মৈত্রেয়্যুপনিষদ্ ২য় অধ্যায়]
৪ সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ইক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ৷৷ [গীতা, ৬।২৯]
৫ যে তথা মাং প্রপদন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। [গীতা, ৪।১১]