কিন্তু ওসব তো রঙ্গমঞ্চের ভূমিকার সংলাপ।
রাত্রে যখন অভিনয়ের রঙ মুছে নিজের কাছে নিজে ধরা দিই?
তখন কি ধরা দিই না একটি তীব্র রোমাঞ্চময় কল্পনার কাছে? দিই।
তখন ধ্যান করি এক রক্ত-মাংসের পুরুষের। ধারণা করতে চেষ্টা করি কী তীব্র সুখময় সেই বলিষ্ঠ বাহুর নিষ্পেষণ।
সেই ধ্যান-ধারণার দাহে কোনো কোনোদিন আমি যখন ঘরে টিকতে পারি না, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দাকে করি নৈশচারণার ক্ষেত্র, তখন সেই বারান্দার একাংশে অবস্থিত দাদা-বউদির পর্দাফেলা জানলাটার দিকে তাকিয়ে হিংসেয় সর্বাঙ্গ জ্বালা করে ওঠে আমার। আর কোনো কোনোদিন অদম্য হয়ে ওঠে একটা অন্যায় ইচ্ছার আকর্ষণ। আমার থেকে তেরো বছরের বড় দাদার ঘরের রাত্রির রহস্য যেন আমাকে তীব্রবেগে টানে অন্ধকারের আড়ালে গা ঢেকে ওই পর্দাকে ঈষৎ উন্মোচিত করে ভিতরে চোখ ফেলতে।
সেই ইচ্ছের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে শঙ্কর মহারাজের দীক্ষামন্ত্র নয়, নিতান্তই আমার চিরদিনের সভ্যতার সংস্কার, শিক্ষার সংস্কার, শালীনতার সংস্কার।
কিন্তু এসব কি বর্তমান? বুঝতে পারছি না।
অতীতে আর বর্তমানে মিশে গিয়ে যেন একটা কুয়াশার পর্দা দুলছে আমার মধ্যে। আমি বুঝতে পারি না আমার দিনের বেলার আমিটা আর রাত্রে বেলার আমিটা অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে, না একজন অপরজনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
যদি আত্মসমর্পণ করে থাকে তো স্নায়ুতে শিরাতে এত চাঞ্চল্য কেন? কেন ওর খবরের জন্যে এত ছটফটানি?
.
১৭.
আমার দিক থেকে খবর নেবার কোনো উপায় ছিল না কারণ, দুরন্তর ঠিকানার কোনো ঠিক নেই। কোথায় না কোথায় ক্যাম্প পড়ে ওদের, কখন না কখন চিঠি দেবার সময় পায়। তাও তো সে চিঠি আসে আমার এককালের সহপাঠিনী শিপ্রার শ্বশুরবাড়িতে তার স্বামীর নামে। এই ব্যবস্থা করে গিয়েছিল ও।
শিপ্রা কোনো গতিকে আমায় সে চিঠি পৌঁছে দিত। নিতান্তই দীর্ঘ ব্যবধান ছিল সেই চিঠি আসায়।
তার মধ্যে আবোল-তাবোল কথাই বেশি থাকত, তার মধ্যে প্রকাশ পেতে শুধু তার আকুলতা, প্রকাশ পেত বিশ্বাস আর আশ্বাসের ব্যাকুলতা। তবু ওরই মধ্যেই টের পেয়েছিলাম, কাজটা ওর বন কেটে নগর বসাবার। কুলি খাটাতে হয়, বন কাটাতে হয়, অরণ্যের দেবতার অভিশাপ কুড়িয়ে সেখানে আগুন জ্বালাতে হয় শুকনো পাতাকে ভস্ম করতে।
খুব স্পষ্ট করে কিছু লিখতে পারে না। মনে হয় স্পেন্সারের ব্যাপারটা কড়া, তাই লেখে ভালো আছি। আর মাঝে মাঝে লেখে দিন গুনছি।
আমি ওর খবর পাই, কিন্তু ও আমার কোনো খবর পায় না।
এক এক সময় ওর অবস্থা ভুলে নিতান্ত সহানুভূতিহীন নিমর্ম বিচার করে বসি আমি। বলি, দিব্যি তো নিশ্চিন্তে বসে দিন গুনছি, দিন গোনর সঙ্গে সঙ্গে যে দিন ফুরোয় তা খেয়াল আছে? তুমি কি জানতে পারছ আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি? জানতে পারছ কি, কিভাবে আমার দিন কাটছে?
আমি না হয় অদ্ভুত একটা হাতিয়ার হাতে পেয়ে গিয়ে আমার শত্রুপক্ষকে ঠেকিয়ে রেখেছি। তারা এই অভাবনীয় অস্ত্রটা দেখে ভয় পেয়ে গেছে, তারা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলছে, স্বপ্নেও ভাবিনি তুই এমন হয়ে যাবি।
কিন্তু তুমি? তুমি কি জানতে পারছ এসব?
আমার এই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ কোথায় তোমার? অথচ তুমি দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছ। কারণ তুমি আমায় প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছ, ঠিক থাকব আমি, বদলাব না।
এ পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা খোঁজ করতে একদিন রমেশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছেন যেন। ভারী যেন অসহায়। চুপচাপ বসে রইলেন।
কথা বললেন তার স্ত্রী।
বললেন, এই দেখ মানুষ, একটা পরের ছেলেকে পুষে এমন মায়ায় জড়ালেন নিজেকে যে, তার বিহনে একেবারে জবুথবু হয়ে গেলেন। অথচ তার ব্যবহার দেখ। চাকরি করতে বিদেশ যাচ্ছি বলে চলে গেল, না খবর না কিছু। নেমকহারাম যাকে বলে!
ভাবলাম, ইচ্ছে করলে কি ও টাকা পাঠাতে পারত না?
হয়তো পারত, হয়তো পারত না।
হয়তো ওই অবিশ্বাস্য মাইনেটা ফাঁদ মাত্র। হয়তে বিনিমাইনেয় খাঁটিয়ে নিচ্ছে ক্রীতদাসের মতো। কে জানে! প্রাণটা কেমন করে উঠল।
চলে এলাম। আর যাইনি। তাছাড়া যাবার সময়ই বা কোথায়?
.
১৮.
সময় নেই।
সময়টা আমার আঁটসাঁট একটা ছন্দের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে আছে যেন। একটা অক্ষরেরও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে গুরুর দেওয়া ইষ্ট-মূর্তির পট সামনে রেখে মঙ্গল-আরতি করি, ধূপ জ্বালি, ফুল বাছি, মালা গাঁথি, চন্দন ঘষি। তারপর চোখ বুজে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।
আমার সেই তপস্বিনী মূর্তি দেখে দেখে ক্রমশ বাড়ির লোকেরাও আমায় ভক্তি করতে শুরু করেছে। মা মালি দিয়ে নিত্য ফুলের যোগান করিয়ে দিয়েছেন, ফুল মিষ্টি দই ক্ষীর আনিয়ে রাখছেন ভোগের জন্য, সারা সকাল নিঃশব্দে সংসারের কাজ করেন, বাড়ির সকলকে সামলে রাখেন গোলমাল করা থেকে, পাছে পূজারিণীর পূজার ব্যাঘাত হয়। বউদি পর্যন্ত আজকাল আর মুখে-চোখে ব্যঙ্গহাসির ছুরি উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায় না, ঔদাসীন্যের ছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ভাবটা যেন এ সংসারের নৈবেদ্যের ভাগটা তো তুমিই লুঠে নিলে, আমার আর এখানে থাকাই বা কেন!
যাক, মনের কথা দেখতে নেই, মোটের মাথায় আছি ভালো। যে দাদা প্রথম-প্রথম কত রাগ দেখিয়েছে, কত তাচ্ছিল্য করেছে, সেই দাদাই দেখি কাজে বেরোবার কালে একবার আমার ঠাকুর ঘরের দরজায় এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাতটা জোড় করে কপালে ঠেকায়।
না, আলাদা কোনো ঠাকুরঘর নয়, আমার শোবার ঘরই আমার ঠাকুরঘর। সেই সরু একফালি ঘরেরই একপাশে চৌকি পেতে বসিয়েছি আমার গুরুর ফটো, আমার ইষ্টের পট। তার সঙ্গে অসুর নাশিনী দুর্গারও।
শঙ্কর মহারাজের কাছে সর্বধর্মসমন্বয়। তিনি বলেন, হলই বা বৈষ্ণবমন্ত্র, অসুরনাশিনী মূর্তিও সামনে রাখা দরকার। মনের মধ্যেকার পাপাসুরকে দমন করতে হবে যে। মা, মা হচ্ছেন আশ্রয় আর উনি? ওই নওলকিশোর? উনি হচ্ছেন সখা, বন্ধু, প্রিয়তম, প্রেমাস্পদ। উনি আধার, উনি প্রাণারাম।
চৌকির উপর অতএব তিন দেবতার ছবি সাজিয়ে রেখেছি ফুলে চন্দনে, ছোট্ট চেলির কাপড়ে, রুপোর বাঁশীতে। ধূপের সৌরভে ঘরের বাতাস পবিত্র হয়ে ওঠে, সকালের আলো এসে আমার মুখে চোখে চুলে ছড়িয়ে পড়ে এনে দেয় একটা দিব্যদৃতি, আমার মুদিত চোখের পল্লব কাঁপে না। এসব আমার সাধনা।
আমার সুন্দর সুন্দর সিল্কের শাড়িগুলো পরি আমি পুজো করবার সময় অযত্নে অবহেলায়। কারণ, আমি তো আর বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্নে যাই না, যাই না সিনেমা দেখতে, থিয়েটার দেখতে।
যাবার মধ্যে মঠে।
সেখানে সাদা শাড়ি।
দুধ-সাদা ধবধবে।
গুরু যাতে বলতে পারেন, বাইরের মতো মনটিও করতে হবে।
আমি যখন ধ্যান-ধারণা সেরে আবার নরলোকে ফিরে আসি, তখন দাদা অফিস চলে গেছে, দাদার ছেলেটা স্কুলে। বউদি রান্নাবান্না সেরে নিয়েছে। আগে আগে বউদি ওই রান্না-রান্না করে রাগারাগি করত, মস্তবড় একটা আইবুড়ো মেয়ে যে একদিন ভাত রাঁধতে পারে না, এর জন্যে অনুযোগ করত, কিন্তু এখন বউদির মুখে চাবি পড়ে গেছে। বউদির রান্নাঘরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? আমি তো আমার মায়ের রান্নাঘরে খাই, বিশুদ্ধ, আমিষ-বর্জিত।
পুজোর পর ঠাকুরের ফল-মিষ্টির প্রসাদ, আর পাথরের গ্লাসে চা খেয়ে পেড়ে বসি সেই জপের খাতা। হাজার জপ লিখতে হবে। এতে নাকি কাজ আরও বেশি হয়। অক্ষরের মধ্যেই নাকি ব্রহ্ম।
গল্পের বই বলে পাগল ছিলাম আগে, লাইব্রেরি বইতে শানাতো না, পাড়াপড়শীর দরজায় হাত পেতে পেতে তবে মিটত কুম্ভকর্ণের ক্ষুধা।
কিন্তু এখন ওসব বই নিষিদ্ধ খাদ্যের মতোই পরিত্যাগ করতে হয়েছে। গল্পের বই, নাটক-নভেল পড়ে সময়ের বৃথা অপব্যবহার করার মতো বোকামীতে মহারাজের বিশেষ ঘৃণা। আর যাতে তার ঘৃণা, তা করতে লজ্জা হবে না?
দুপুরবেলা হবিষ্যান্ন গ্রহণের পর্ব মিটলে দিবানিদ্রার বদলে পড়াশোনা করি, কিন্তু সে তো ধর্মগ্রন্থ। মঠের লাইব্রেরি থেকে আনা, মহারাজের টীকাভাষ্য সংবলিতও হয়তো।
তারপর যখন বেলা পড়ে আসে, তখন মঠ থেকে গাড়ি আসে আমার আর মা-র জন্যে, সন্ধ্যা-আরতি দেখতে যাবার কারণে। বিশেষ সমাদর, বিশেষ ব্যবস্থা।
গোড়ায় গোড়ায় বউদি বলত, লক্ষ্যটা তুমি, মা উপলক্ষ্য মাত্র।
এখন আর বলতে সাহস পায় না।
তা প্রথম প্রথম মা নিয়মিত যেতেন, হয়তো এতবড়ো মেয়েটাকে সন্ধ্যায় একা ছাড়তে সংস্কারে বাধত। কিন্তু ক্রমে সবই সয়। তাছাড়া, রোজ সন্ধ্যাবেলা কাজকর্ম ফেলে আরতি দেখতে যাবেন, এত ভক্তি-ঢলঢল মা-র মন নয়।
মা তার লক্ষ্মী-ষষ্ঠী-মনসা-ইতু বোঝেন, তার জন্যে উৎকণ্ঠিতও থাকেন, কিন্তু আরতি দেখতে রোজ মঠে যাবেন এত সময় বার করতে পারেন না। তাছাড়া, আরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে শুরু হয়ে যায় স্তব-স্তোত্র-কীর্তন। তার শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থাকা তো মা-র পক্ষে যম-যন্ত্রণার শামিল।
ক্রমশ তাই গাড়ির আরোহী হই একমাত্র আমি। বউদিকে জিগ্যেস করি, যাবে?
বউদি বলে, না, এখন কাজ রয়েছে।
শানু এক কীর্তি করার পর থেকে বউদি একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। বউদি আশঙ্কা করেনি শানুর মতো একটা ভীরু মেয়ে এমন বেপরোয়াভাবে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে।
লিখে রেখে গেছে নাকি, রেজিস্ট্রি বিয়ে করে স্বামী তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে তার কর্মস্থলে। কিন্তু সেকথা কে বিশ্বাস করেছে? তাছাড়া সেটাও যদি হয়েই থাকে সত্যি, দ্বিতীয়বারের স্বামীকে প্রকৃত স্বামীর মর্যাদাটা দিচ্ছে কে? ওটা যেন পরচুল দিয়ে খোঁপা বাঁধা, ঝুটো মুক্তোর মালা গলায় দিয়ে সাজা।
.
১৯.
মা বললেন, মেয়েটাকে ওই শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েই ভুল করলে তুমি বউমা! শাশুড়ি নেই, বুড়ো শ্বশুর, জায়েরা যে যার নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যস্ত। ওকে কে সামলেছে বল?
বউদি কপালে হাত রেখেছে।
বউদির মুখে জগতের দুঃখ বেদনা রাগ অপমান। বোনের দ্বারা যে তার মুখ পুড়ল, এটা যেন শুধু তার বোনেরই নয়, সেই দগ্ধ দৃশ্যের দর্শকদেরও অপরাধ।
একে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, আজকাল আর এসব না-হচ্ছে কোন্ সংসারে? কিন্তু অপরাধিনী বোনটাকে সামনে পেলে যে ধিক্কারে জীর্ণ করে ফেলত তাকে তাতে সন্দেহ নেই।
আশ্চর্য! বিধবা ছোটো বোনটার ওপর তো মমতার অবধি ছিল না তার, লুকিয়ে মাংসের চপ খাওয়াত। কিন্তু যেই সে নিজের জীবন গড়ে তুলতে গেল, অমনি সব মমতা কর্পূরের মতো উবে গেল? তার মানে মমতা ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি ভাগ্যহত! ভালোবাসা ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি নিজের সম্পর্কে অচেতন। সচেতন হয়েছ কি ভালোবাসাটি হারিয়েছ।
শানুর প্রতি আর ভালোবাসা নেই বউদির।
কিন্তু আমার?
আমারও শানুর ওপর ভালোবাসাটা উবে যেতে চাইল কেন? সে কী হিংসেয়? আমার এই দেবিত্বের আবরণ কি এতই ব্যর্থ? শানু যে সেইরকম জীবনটা পেয়ে গেল, যে-রকমটি নাকি একদার বেবি নামের মেয়েটার একান্ত কাম্য ছিল, সেটাই কি আমায় দগ্ধাল? নইলে শুনে এত জ্বালা ধরল কেন ভিতরে?
অথচ আমিই সাহস দিয়েছিলাম ওকে।
.
২০.
কিন্তু সকল জ্বালা প্রশমিত হয়ে যায় গাড়ি থেকে নেমে মঠের চৌহদ্দিতে পা দিতে দিতে। নিত্যসেবার সুবিধের জন্যে অনেকখানি জমি জুড়ে মালঞ্চ আর তুলসীবন। মালঞ্চে শৌখিন ফুল নেই, আছে দেশী ফুল। গোলাপ, চাঁপা, বেল, জুই, টগর, গন্ধরাজ, কাঠছাঁপা, গাঁদা, দোপাটি, কিন্তু কেয়ারির কী বাহার। গাছে গাছে আলোর সমারোহ।
জুড়িয়ে যায় চোখ জুড়িয়ে যায় মন।
তারপর উঠে যাই নাটমন্দিরে।
সুন্দর ডিজাইনের মোজেক টালি বসানো বিরাট চত্বর, আয়নার মতো নির্মল চকচকে। সেখানে নিঃশব্দ নিস্পন্দ ভক্তবৃন্দ বসে আছেন দুভাগে, মাঝখানে পথ রেখে। যে পথ শেষ হয়েছে গিয়ে বিগ্রহের পদপ্রান্তে। নাটমন্দিরের পরে অর্ধবৃত্তাকার অর্ধবেষ্টনী বারান্দা, সেখানেও ভক্তজনের শ্রেণীভাগ। একভাগে মহিলা, একভাগে পুরুষ, যেমন নাটমন্দিরে।
বারান্দার মধ্যে বসবার সৌভাগ্য যাঁদের হয়, তারা হচ্ছেন বিশেষ ভক্ত। বিগ্রহের পিছনে আলাদা কয়েকধাপ সিঁড়ি আছে তাদের ব্যবহারের জন্যে। যাঁরা অধিকারী তাঁরা এই নাটমন্দির না মাড়িয়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠেন, ভক্তপদরজঃ মাথায় ঠেকিয়ে। তারপর ঘেরা বারান্দা দিয়ে বিগ্রহের ঘর প্রদক্ষিণ করে আত্মস্থভাবে এসে বসেন নিজ নিজ স্থানে। নিত্য আসা-যাওয়ায় আপনা থেকেই স্থান একটা করে নির্বাচন হয়ে গেছে।
যেমন জানি, বৃন্দাদি বসবেন একেবারে ঠাকুরঘরের দরজা ঘেঁষে, সত্য ব্রহ্মচারী মোটা থামটার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে, বারান্দার গায়ে গায়ে ছেলেদের দিকে ব্রহ্মচারী অভয়, বীরেশ্বরভাই, নিত্যমহারাজ, অচ্যুতানন্দ, মেয়েদের দিকে সুধাদি, অমলাদি, নীলিমাদি, বুড়িমহামায়া মা, রাইকমল, ব্রজরাধা।
এঁদের দুজনেরও শঙ্করজীর দেওয়া নাম। এই বারান্দার এদিকের এঁরা সবাই এই আশ্রম বা মঠের অধিবাসী, এঁদের এখানে কিছু কিছু ভূমিকা থাকে।
যেমন আরতির পর কীর্তনের সময় ব্রহ্মচারী অভয় আর বীরেশ্বরভাই খোল বাজান, এঁরা সবাই দোহার দেন।
মূল গায়েন শঙ্করজী।
আরতিও তিনিই করেন।
সে এক অপূর্ব নৃত্যভঙ্গিমা! কত তার মুদ্রা, কত তার ছন্দ! প্রৌঢ় শরীরেও কী শক্তি? আরতির সময় এদিক থেকে শুধু পিঠটি দেখা যায়, আর আবিষ্ট আচ্ছন্ন হয়ে দেখতে হয় সেই স্বাস্থ্য-সংগঠিত সুগৌর পিঠ, পাঁজর, কাঁধ আর দুটি পা। গরদের ধুতি থাকে পরনে, গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায় সেই দুধে-গরদের ধুতি। কাঁধে থাকে একখানি পাট-করা উত্তরীয়, বার বার খসে খসে পড়ে, বার বার তাকে কাঁধে তোলেন, সেও এক মধুর ভঙ্গি।
তারপর যখন আরতি শেষ হয়, ঘুরে দাঁড়ান শঙ্করজী, তখন তাঁর শ্বেতচন্দনচর্চিত ললাট, কুঁদে কাটা মুখ, আজানুলম্বিত গোড়েমালা পরা বুক আর আশ্চর্য উদাস দুটি পদ্মপলাশ চক্ষু, দেখে সকলের মনেই একটি প্রশ্নের উদয় হয়, নদীয়ার গৌরাঙ্গ কি আবার অবতীর্ণ হয়েছেন এই কলির শেষপাদে?
প্রৌঢ় শরীরে এত লাবণ্য?
প্রৌঢ় মুখে এত দীপ্তি?
প্রৌঢ় চোখে এত আলো?
নিত্য দেখা চোখ, তবু প্রৌঢ়া বৃদ্ধা নির্বিশেষে মহিলাকুল বিহ্বল দৃষ্টি মেলে বলেন, কী চোখ দেখেছ? যেন কাজলপরা! হাত-পায়ের তেলোর রং দেখেছ? যেন আলতা-মাখা! মহাপুরুষের পরিচয়ই তো এইসব লক্ষণে।…আহা, নদের গৌরাঙ্গ না দেখার আক্ষেপ মেটালেন বাবা!
কেউ বলে বাবা, কেউ বলে মহারাজ, কেউ বলে ঠাকুর
আমি কিন্তু ওসব কিছু বলি না, বলি গুরুদেব। আমি ওটা শিক্ষক অর্থে বলি। এসেছিলাম তো সন্দেহ কৌতুক আর তাচ্ছিল্যের মনোভাব নিয়ে, তাই প্রচলিত সম্বোধনগুলো হাস্যকর ঠেকেছিল আমার কাছে।
কিন্তু সন্ধ্যারতির সময়কার ওই পঞ্চ-প্রদীপের শিখার কম্পনে, নিয়নের নীল আলোয়, ভারী ঘন্টার গম্ভীর ধ্বনির ছন্দময় ধাক্কায়, আর গোড়েমালা পরা এই দেবপ্রতিম মূর্তির লাবণ্যে ক্রমশ আমিও যেন আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি। একদা যে কৌতুক আর তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়েছি, সেকথা ভেবে লজ্জিত হচ্ছি, আর যখন বহু গুণীজ্ঞানী পণ্ডিত, বহু মানগণ্য বুদ্ধিজীবী, চিন্তাজীবী এসে এই পদপ্রান্তে মাথা লোটান, তখন মনে হয়, আচ্ছা, এঁরা কি সবাই অন্ধ অবোধ? যত বুদ্ধিমান আমি?
আবার যখন সরে আসি সেই আবেষ্টন থেকে, তখন ভাবি, আসেন তো (গুরুদেবের ভাষায়) তিতাগ জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু সে আশ্রয় কি মেলে এঁদের? প্রশ্ন তো সেইখানেই। এঁরা যে মন নিয়ে লটারির টিকিট কেনেন, সেই মন নিয়েই হয়তো ঠাকুরের কাছে আসেন। যার জীবনে যত ফাঁকি, যত ফাঁক, তার তত ব্যাকুলতা।