১৬-২০. বুলুর অবস্থা এতটা খারাপ

বুলুর অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছে সোবাহান বুঝতে পারেনি। সে অবাক হয়ে ডাকল, এই বুলু! এই!

বুলু ঘোলা চোখে তাকাল।

এ কী অবস্থা তোর?

অবস্থা কেরাসিন। হালুয়া টাইট।

হয়েছে কী?

জণ্ডিস।

জণ্ডিসে এরকম হয় নাকি?

অভাগাদের হয়।

বুলু চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। সোবাহান বেডের পাশে রাখা টুলে বসে রইল চুপচাপ। এখন ভিজিটিং আওয়ার নয়। তবু অনেক লোকজন চারদিকে ঘুরঘুর করছে। কোণার দিকে একটি রোগীকে ঘিরে আছে ছ’সাতজনের একটি দল। দু’টি অল্পবয়স্ক মেয়ে আছে। ওরা খিলখিল করে হেসে উঠছে বারবার। বুলুর সাড়াশব্দ নেই।

এই বুলু, এই।

কী?

জেগে ছিলি নাকি?

হুঁ। রেস্ট নিচ্ছিলাম। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না।

রেশমা এসেছিল?

হ্যাঁ। কাল সারা দিনই ছিল।

আজ আসবে না?

কী জানি। কেন?

এমনি জিজ্ঞেস করলাম। লাগছে কেমন তোর?

ভালোই। কাল রাতে তোর বড়ভাইকে স্বপ্নে দেখলাম।

সোবাহান বিস্মিত হলো। বুলু টেনে টেনে বলল, দেখলাম যেন তোর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। তোর ভাই গাছের নিচে বসে শান্তির কথা টথা বলছে। দাড়ি চুল সব মিলিয়ে তাকে রবীন্দ্রনাথের মতো লাগছে।

সোবাহান চুপ করে রইল। বুলু ফিসফিস করে বলল, শান্তি ব্যাপারটা কী তোর ভাইকে জিজ্ঞেস করিস তো?

তুই নিজেই জিজ্ঞেস করিস।

করব। আমি করব। ইন কেস আমি যদি না থাকি, যদি ফুটটুস হয়ে যাই তাহলে তুই জিজ্ঞেস করবি এবং বলবি, লম্বা লম্বা বাত নেহি ছারেগা। ইয়ে গম নেহি।

বুলু নেতিয়ে পড়ল। সোবাহান বলল, তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?

ঘাবড়ালাম কোথায়?

একজন অল্পবয়স্ক ইন্টার্নি ডাক্তার এসে গম্ভীর গলায় বলল, এখানে আপনি কী করছেন? এটা কি ভিজিট করার সময়? এখন যান, চারটার সময় আসবেন।

সোবাহান উঠে দাঁড়াল। সম্ভবত এ ডাক্তারটির কথা কেউ শোনে না। সে হয়তো ভেবেছিল সোবাহান উঠতে চাইবে না। তাকে বিনা তর্কে উঠে দাঁড়াতে দেখে তার হয়তো অস্বস্তি লাগল। সে নরম স্বরে বলল, রোগী আপনার কে?

আমার বন্ধু।

ঠিক আছে চার-পাঁচ মিনিট কথা বলে চলে যান। রোগীকে এখন বিরক্ত করা ঠিক। রেস্ট দরকার।

ওর এ অবস্থা হলো কেন?

খারাপ ধরনের জন্ডিস। লিভার ড্যামেজড হয়েছে। শরীরের সবচেয়ে বড় অর্গানটাই হচ্ছে লিভার। পাঁচ সের ওজন। সেটা ড্যামেজড হলে কী অবস্থা হয় বুঝতেই পারেন।

ডাক্তারটি কোনার দিকের বেডের দিকে চলে গেল। অল্পবয়েসী মেয়ে দুটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে।

বুলু।

উ।

কেমন লাগছে?

ভালো না।

বেশি খারাপ লাগছে?

হুঁ। তুই এখন যা।

কথা বলার দরকার নাই। তুই শুয়ে থাক চুপচাপ। আমি থাকি আরও কিছুক্ষণ।

শুধু শুধু বসে থেকে কী করবি?

যাবই বা কোথায়?

বুলু চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল। একটি নার্স এসে দুধ পাউরুটি দিয়ে গেল। বুলু ক্লান্তস্বরে বলল–সোবাহান, তুই যা। তোকে দেখে বিরক্ত লাগছে। বিকেলে আসিস। আমি ঘুমাব।

তোকে ঘুমাতে নিষেধ করছি?

যেতে বলছি যা। বাজে তর্ক ভালো লাগে না।

সোবাহান উঠে দাঁড়াল। বুলু থেমে থেমে বলল, বিকেলে আসার সময় এক কাজ করিস, তোর বায়োডাটা, টেস্টিমনিয়েল এইসব নিয়ে আসিস। নাম সই করে একটা ফুলস্কেপ সাদা কাগজ আনিস।

কেন?

আনতে বলছি নিয়ে আসবি। এত কথা কিসের?

বুলু চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একটি মাছি ভনভন করে তাকে বড় বিরক্ত করছে। সে চাঁদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।

.

গুলিস্তানের দিকে রিকশা-টিকশা কিছু যাচ্ছে না। একটা মিছিল বেরিয়েছে। কিসের মিছিল কেউ জানে না। জানার তেমন প্রয়োজনও অবশ্যি নেই। মিছিল হচ্ছে মিছিল। যা দেখামাত্র সেখানে সামিল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

সোবাহান নওয়াবপুর রোডের কাছে মিছিলের দেখা পেল। মাঝারি ধরনের মিছিল। প্রচুর লাল নিশান দেখে মনে হয় শ্রমিকদের কোনো ব্যাপার-ট্যাপার হবে। মিছিলের সঙ্গে হাঁটার একটা আলাদা আনন্দ আছে। সবসময় মনে হয় উদ্দেশ্য নিয়ে কোথাও যাওয়া হচ্ছে।

তাছাড়া চোখের সামনে মিছিলের চরিত্র বদলাতে থাকে, তাও দেখতে ভালো লাগে। যত সময় যায় ততই মিছিলের মানুষগুলি রেগে উঠতে থাকে। একটা সময় আসে যখন শুধু আগুনের কথা মনে হয়। চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এটাই সবচেয়ে চমৎকার সময়। তখন পাশের মানুষটিকেও মনে হয় কতদিনের বন্ধু।

কিন্তু আজকের মিছিল জমছে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। প্রধান কারণ সম্ভবত মিছিলের সঙ্গে পুলিশ-গাড়ি নেই। লাল রঙের পতাকাগুলি কড়া রোদে হলুদ হলুদ দেখাতে লাগল। এ মিছিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সোবাহান মিছিল ফেলে রেখে বাসায় চলে এল।

আজ দুপুরেও খাওয়া হয়নি। এ অভ্যাসটা সত্যি সত্যি করে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। খাওয়াদাওয়ার ঝামেলাটা তাহলে থাকে না।

সোবাহান বালতি হাতে গোসল সারতে গেল। কাছেই একটা টিউবওয়েল আছে। প্রচণ্ড গরমেও বরফের মতো ঠান্ডা পানি আসে সেখানে। ঝি-শ্রেণীর মেয়েরা এই সময়ে দল বেঁধে গোসল করে। দল বেঁধে ঝগড়া করে। দল বেঁধে হাসে। এ সময়টা ওদের। নিজস্ব।

গোসলের পর ক্ষিধে পেয়ে গেল। ভাতের ক্ষিধে। একটি পরিষ্কার থালায় জুই ফুলের মতো কিছু ভাত। চারপাশে ছোট ছোট বাটি। একটা বড় কাঁচের গ্লাসে বরফের মতো ঠান্ডা পানি। এরকম একটা ছবি ভাসতে লাগল চোখের সামনে। ক্ষিধে পেলেই এরকম একটা ছবি ভাসে। মিলিদের বাসার ছবি। ওদের ওখানে চলে গেলে কেমন হয়?

মিলির বর কি এসেছে বিলেত থেকে? কবে যেন আসার কথা? এ মাসেই তো আসার কথা।

একসময় বিলেত যেতে ইচ্ছা করত। কম বয়সে কত অদ্ভুত সব স্বপ্ন থাকে। পৃথিবী থাকে হাতের মুঠোর মধ্যে। তখন মনে হয় খালাশির চাকরি নিয়ে পৃথিবীর যে-কোনো। জায়গায় চলে যাওয়া যায়। মহানন্দে রবিনসন ক্রুশোর মতো নির্জন দ্বীপে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। বনের ভেতর সারা দিন ঘুরে বেড়ানো, সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্রতীরে বালির বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। চমৎকার সব জীবন।

সোবাহান ভেজা গায়ে ঘরে ফিরে দেখে, ভাবির আরেকটি চিঠি এসেছে। আগের চিঠিটির জবাব দেওয়া হয়নি। এখন কেন জানি চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে না। ভাবির এবারের চিঠিটি সংক্ষিপ্ত

কেন তুমি চিঠি লিখিতেছ না? তোমার ভাইয়ের চিঠির জবাব এখনো দাও নাই। তোমার ভাই খুব চিন্তিত। তিনি অবশ্যি এখন তাঁর নামাজঘর নিয়া আছেন। বেশির ভাগ রাত্রে সেইখানেই থাকেন। অনেক দূর দূরান্ত হইতে তাহার কাছে লোকজন আসে। আমার ভালো লাগে না। ভাই, তুমি একবার আসো। যূথির দুলাভাই তোমার ভাইয়ের কাছে একটি দীর্ঘ পত্র দিয়াছেন। সেই সঙ্গে যূথির একটি ছবি। মেয়েটির চেহারা খুব মায়াবতী। আমার পছন্দ হইয়াছে। তোমার নিজের মুখ হইতে এই মেয়েটির সম্পর্কে আরও কথা জানিতে ইচ্ছা করে। তুমি ভাই, চিঠি পাওয়া মাত্র একদিনের জন্যে হইলেও আসিবে।

.

১৭.

মনসুর সাহেব আজ দু’টি খবর পেয়েছেন। প্রথম খবর হচ্ছে তাকে বদলি করা হয়েছে কুষ্টিয়ায়। প্রমোশনের বদলি। এখন থেকে বাড়িতে টেলিফোন থাকবে। সরকারি গাড়ি পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় খবরটি এরচেয়ে ভালো। সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন তার অবদানের কথা মনে রেখে তাঁকে এই পরিত্যক্ত বাড়িতে বসবাসের অধিকার দিয়েছেন। সহজ শর্তে সরকারের কাছ থেকে বাড়িটি তিনি কিনে নিতে পারবেন। তবে বাড়ির জন্যে প্রয়োজন এমন কোনো সংস্কারের কাজ সরকার করতে পারবেন না। ইত্যাদি।

মনসুর সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি এলেন। বাড়ির ব্যাপারে বিশ রাকাত নফল নামাজ মানত ছিল। মানত পূরণ করা দরকার সবার আগে।

অনেক দিন পর আজ হাঁটতে তার কষ্ট হলো না। পায়ের ব্যথাটা হঠাৎ করে কমে গেছে। হাঁটতেও আজ বড় আনন্দ লাগছে। বাড়ির কাজে এখন ঠিকমতো হাত দিতে হবে। দোতলা কমপ্লিট করে ভাড়া দিতে হবে। সাবলেট দিয়ে দুজন ফালতু লোক রাখার। আর কোনো মানে হয় না। জলিল সাহেবকে আজই বলে দিতে হবে।

বদলি নাকচ করার চেষ্টাও শুরু করতে হবে আজ থেকে। এখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। বছর খানিক কোথাও নড়াচড়া করা যাবে না। ঢাকা শহরে গ্যাট হয়ে বসে থাকতে হবে। অনেক কাজ হাতে।

.

মনসুর সাহেবের বাড়ির সামনে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি সংক্রান্ত নতুন কোনো ঝামেলা না তো? অন্য কেউ কি এসে দখল নিয়ে নিয়েছে?

মনসুর সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। বমি বমি ভাব হলো। জলিল সাহেবকে দেখা গেল এগিয়ে আসছেন।

মনসুর সাহেব, ভাই একটা খারাপ সংবাদ।

খারাপ সংবাদ? কী খারাপ সংবাদ?

মনসুর সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল। লোকজনের কথাবার্তা অস্পষ্ট হয়ে গেল। তার পা কাঁপছে। জলিল সাহেব এগিয়ে এসে তার হাত ধরে ফেললেন।

আপনার স্ত্রী হঠাৎ করে…

মারা গেছে নাকি?

সবই আল্লাহর ইচ্ছা ভাই। মনটাকে শক্ত করেন।

জলিল সাহেব তাঁকে ধরে বারান্দায় রাখা একটি ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

মনসুর সাহেবের এখন হয়তো কাঁদা উচিত। কিন্তু কাঁদতে পারছেন না, নিশ্চিত বোধ করছেন। জীবন এখন নতুন করে শুরু করা যাবে। তবু মনসুর সাহেব কাঁদতে চেষ্টা করলেন। আশেপাশে প্রচুর লোকজন এসেছে, তারা শোকের প্রকাশ দেখতে চায়। শোকাহত একজন মানুষকে সান্ত্বনার কথা বলতে চায়। এরাই এখন ছুটাছুটি করবে। মৌলবি ডেকে আনবে। খাঁটিয়ায় কাঁধ দিয়ে সুর করে বলবে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু।’

মনসুর সাহেব বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। গভীর বেদনার সুরে ডাকলেন, কদম! ও কদম! জলিল সাহেব তাঁকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। প্রতিবেশীরা তাঁর পাশে জড়ো হতে শুরু করেছে। তাদের চোখ মমতায় আর্দ্র। মনসুর। সাহেব আবার ডাকলেন, কদম! কদম! তার শ্বশুর ফুলের নামে মেয়েদের নাম রেখেছিলেন–বেলি, কদম, যূই…।

একজন ভারিক্কি চেহারার ভদ্রলোক মনসুর সাহেবের হাত ধরে বললেন, মৃত মানুষের নাম ধরে ডাকতে নাই ভাই। আল্লাহকে ডাকেন। আল্লাহ শান্তি দেনেওয়ালা। এখন ভেঙে পড়ার সময় না। অনেক কাজ সামনে। কোথায় মাটি দিবেন ঠিক করেন, তারপর বাকি যা করবার আমরা করব।

কদমের মৃত্যুর সময়টা খারাপ হয়নি। ভালোই হয়েছে বলা চলে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ হলো। যোগাযোগের দরকার ছিল। এখন বাড়িসংক্রান্ত কোনো বিপদে এদের সাহায্য পাওয়া যাবে।

কবর দিতে হবে এখানেই। এতে একটা অধিকার আসে। মনসুর সাহেব মুখ বিকৃত করে আবার ডাকলেন, কদম! ও কদম! জলিল সাহেবের চোখ ভিজে উঠল।

মৌলবি চলে এসেছে। তার সঙ্গে মাদ্রাসার দুটি ছাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যে কোরান পাঠ শুরু হয়ে গেল। এ-বাসা ও-বাসা থেকে মহিলারা আসতে শুরু করেছে।

.

১৮.

বুলুর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বাথরুমে এখন আর যেতে পারে না। বেড প্যান ব্যবহার করতে হয়। নার্সারা বেড প্যান নিয়ে এলে বুলুর সত্যি সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করে। বড় লজ্জার ব্যাপার। তবে লজ্জাবোধটা তার দ্রুত কমে আসছে। এখন সে পড়ে থাকে আচ্ছন্নের মতো। বোধশক্তি দ্রুত কমে যাচ্ছে। মানুষের চেহারাও এখন মাঝে মাঝে অস্পষ্ট মনে হয়। সোবাহান যখন তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিসরে বুলু?

বুলু বিস্মিত হয়ে বলল, কে?

আমি। আমি সোবাহান। চিনিতে পারছিস না নাকি?

পারছি। বোস।

রেশমা এসেছিল?

এসেছিল। আবার আসবে।

কেমন লাগছে রে?

ভালো না।

সোবাহান বসে রইল চিন্তিত মুখে। বুলু থেমে থেমে বলল, তোর অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিয়েছি। রেশমা নিয়ে গেছে। হবে!

কিসের কথা বলছিস?

আমার যে চাকরির কথা ছিল সেইটা। সাত হাজার টাকা দেওয়া আছে। খেলার কথা না। আমি যখন নিতে পারছি না তোকে দিক।

তুই নিতে পারছিস না মানে?

হালুয়া টাইট রে ভাই। বাঁচব না।

কী ছাগলের মতো কথা বলছিস?

এইসব জিনিস বোঝা যায়। আমি বুঝতে পারছি।

বুলু চুপ করে গেল। মিনিট দশেক তার আর কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। সোবাহান বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারটে টেনে আবার ফিরে এল। বুলুর মামা এসেছেন। হাতে প্রকাণ্ড সাইজের একডজন কলা। বুলু বলল, কলাগুলি ঢেকে রাখেন মামা। দেখলেই বমি আসছে।

একটা খা। ছিলে দেই?

দেখেই বমি আসছে, খাব কী! ঢেকে রাখেন।

বুলু ক্লান্তস্বরে ডাকল, সোবাহান।

বল।

চাকরিটা নিস। ঝামেলা করিস না। আমার সাত হাজার টাকা লাগানো আছে।

হুদা সাহেব বললেন, কিসের সাত হাজার টাকা?

আছে আছে, আপনি বুঝবেন না।

বুলু চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল।

.

কদম নেই–এই কথাটি যতবার মনে হয় ততবারই মনসুর সাহেব মনে অন্যরকম একটা স্বস্তি বোধ করেন। মনসুর সাহেবের মেজাজও অনেক ভালো হয়েছে। গত তিনদিন যুঁথির সঙ্গে উঁচুগলায় কথা বলেননি। রাতেরবেলা খেতে বসে রান্নার প্রশংসাও করলেন।

তরকারিটা ভালো হয়েছে যূথি।

আরেকটু দেই?

দাও। কাঁচামরিচ আছে?

আছে।

দাও দেখি। কাঁচামরিচটা শরীরের জন্যে ভালো। প্রচুর ভিটামিন সি।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনি অনেকক্ষণ গল্প করলেন। দোতলাটা ভাড়া দেবেন? না দোতলায় উঠে গিয়ে নিচতলাটা ভাড়া দেবেন।

যূথি, কম্পাউন্ড ওয়ালটা আরও উঁচু করে দিতে হবে। লোহার একটা ভারী গেট দেব। কী বলো?

দেন।

নারকেল গাছের দু’টো চারা এনে লাগাব, বাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে। ঠিক না?

জি।

চা দাও তো এক কাপ। দুধ দিও না। লেবু দিয়ে দাও।

সেই রাতে মনসুর সাহেবের ঘুম এল না। রাত দু’টা পর্যন্ত জেগে রইলেন। তারপর ডেকে তুললেন যূথিকে। যূথি কাঁদতে শুরু করল। মনসুর সাহেব গাঢ়স্বরে বললেন, আহ্ কাঁদো কেন? তোমাকে আমিই বিয়ে করব বৃথি। ঘরসংসার তো করতেই হবে। হবে না?

মনসুর সাহেব দুপুররাতে গাঢ়স্বরে নানান রকম সুখের কথা বলতে লাগলেন।

.

সোবাহান বলল, জলিল সাহেব, মেয়েটা কাঁদছে। জলিল সাহেব নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েরা খুব মায়াবতী হয় রে ভাই। অল্প দুঃখেই কাঁদে। আর এর বোন মারা গেছে। সহজ দুঃখ তো না। কাঁদবেই তো। সারা রাত কাঁদবে।

সোবাহান কিছু বলল না। জলিল সাহেব মৃদুস্বরে ডাকলেন, সোবাহান সাহেব।

বলেন।

বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, শুনেছেন তো?

শুনেছি।

কোথায় যাবেন কিছু ঠিক করেছেন?

না।

কুমিল্লা বোর্ডিং-এ যাবেন নাকি?

আপনি কি ওইখানেই যাবেন?

হ্যাঁ। জলে ভাসা মানুষ আমি। হোস্টেল বোর্ডিং এইসব ছাড়া যাব কোথায় বলেন? ঘরসংসার করার শখ ছিল, অভাবের জন্যে পারলাম না।

সোবাহান উত্তর দিল না। জলিল সাহেব বললেন, ঘুমোবেন না?

ঘুম আসছে না।

রাস্তায় হাঁটবেন নাকি?

না। বারান্দায় বসে থাকব খানিকক্ষণ।

দু’জন এসে বারান্দায় বসল। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। মেয়েটা কাঁদছে। গভীর রাতে মেয়েদের কান্না শুনতে এত ভালো লাগে কেন কে জানে!

.

১৯.

১৯ অনেক লোকজন আসে ফরিদ আলির কাছে।

দুঃখী মানুষেরা শান্তির কথা শুনতে চায়। দূর দূর থেকে তারা আসে। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। ফরিদ আলি ভরাট গলায় কথা বলেন। গলার স্বর কখনো উঁচুতে ওঠে না, নিচুতেও নামে না। অবাক হয়ে সবাই তার কথা শোনে। তাদের বড় ভালো লা

আজ সবাই শুনছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছে। শান্তির কথা বলতে বলতে ফরিদ আলির চোখ ভিজে উঠল। তিনি বেশ খানিকক্ষণ কাঁদলেন। ভাঙা গলায় বললেন, আজ আর কিছু বলব না। আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড়বৃষ্টি হবে। ফরিদ আলি গভীর রাত পর্যন্ত একা বসে রইলেন বাংলাঘরে। একসময় পারুল এসে বলল, ভাত খাবেন না?

না।

নামাজঘরে যাবেন?

না, নামাজঘরেও যাব না।

তিনি পারুলের সঙ্গে ভেতরের বাড়িতে চলে এলেন। পারুল তাঁকে একটি জলচৌকি এনে বসতে দিল। তিনি উঠোনে বসে রইলেন।

আপনাকে এক কাপ চা এনে দেই?

দাও।

পারুল চা নিয়ে এল। ফরিদ আলি মৃদুস্বরে বললেন, আমার পাশে একটু বসো পারুল।

পারুল উঠানেই বসতে গেল।

জলচৌকিতেই বসো। দু’জনাতে বসা যাবে।

লোকজন আছে। কে না কে দেখবে।

দেখুক।

পারুল সংকুচিতভাবে বসল তার পাশে। অস্পষ্ট স্বরে বলল, সোবাহান কী লিখেছে?

ফরিদ আলি জবাব দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।

ওর চিঠিটা আমাকে পড়তে দেন।

ফরিদ আলি সে-কথারও জবাব দিলেন না। চিঠিটা পড়তে দেওয়ার তার কোনো। ইচ্ছা নেই। অর্থহীন কথাবার্তা লেখা সেখানে। রাতে নাকি তার ঘুম আসে না। লক্ষ লক্ষ মশা কানের কাছে পিন পিন করে। কোনো মানে হয়? চিঠির শেষে লেখা–ভাইজান, বড় কষ্ট।

ফরিদ আলি মৃদুস্বরে বললেন, ওকে দেশের বাড়িতে নিয়ে আসব। ওর বড় কষ্ট।

.

২০.

দুপুর থেকেই রেশমা ও সোবাহান বসে ছিল বুলুর পাশে। সোবাহান কয়েকবার ডাকল—বুলু! বুলু! বুলু তাকাল ঘোলা চোখে, জবাব দিল না। তিনটার দিকে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হলো। রেশমা একজন ইন্টার্নি ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল। সে মুখ কালো করে খবর দিতে গেল রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ানকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই এলেন। গম্ভীর মুখে বললেন, আপনারা কি রোগীর আত্মীয়?

রেশমা ভাঙা গলায় বলল, হ্যাঁ।

আমার মনে হয় পেসেন্ট কোমায় চলে যাচ্ছে। অবস্থা বেশ খারাপ।

রেশমা তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে চাইল, বলতে পারল না।

আমরা পেসেন্টকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যাচ্ছি।

সোবাহান বলল, এতটা খারাপ?

হ্যাঁ, বেশ খারাপ। পালস্ প্রায় পাওয়া যাচ্ছে না।

রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান দ্রুত চলে গেলেন। সোবাহান বলল, রেশমা, তুমি চেয়ারটায় বসো। তোমার পা কাঁপছে। পড়ে যাবে।

রেশমা বসল না, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

বুলু মারা গেল বিকাল চারটায়। নিঃশব্দ মৃত্যু। কোনো হৈচৈ হলো না। গলা ফাটিয়ে কেউ কাঁদতে বসল না। রেশমা ও সোবাহান হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে বুলুর মৃত্যুসংবাদ সহজভাবে গ্রহণ করল। রেশমা ধরাগলায় বলল, একটা রিকশা ঠিক করে দেন সোবাহান ভাই। বাসায় যাব।

খুব মেঘ করেছে আকাশে। বাতাস দিচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে আজও হয়তো ঝড় হবে। সোবাহান মৃদুস্বরে বলল, একা একা যেতে পারবে?

পারব।

আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি?

না। আপনি এখানে থাকেন। সোবাহান ভাই।

বলো।

বুলুর ওই চাকরিটা আপনার হবে। ওরা আমাকে কথা দিয়েছে। যদি হয় তাহলে আপনি দয়া করে চাকরিটা নেবেন।

সোবাহান কিছু বলল না। রেশমা চোখ মুছে মৃদুস্বরে বলল, বুলু শেষের দিকে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যাতে আপনি চাকরিটা পান। বুলুর বড় কষ্টের চাকরি সোবাহান ভাই।

ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাতাসের বেগ বাড়ছে। রেশমার রিকশা বাতাস কেটে এগুচ্ছে খুব ধীরে।

.

সোবাহান বাড়ি ফিরল অনেক রাতে। সমস্ত শহর অন্ধকারে ডুবে আছে। প্রচণ্ড কালবৈশাখীতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব। শহরটাকে লাগছে গহীন অরণ্যের মতো। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। কী অদ্ভুত লাগে জনশূন্য অন্ধকার রাজপথে হাঁটতে। হাওয়ায় সোবাহানের সার্ট পতপত করে ওড়ে। চোখেমুখে পড়ে বৃষ্টির মিহি কণা।

সোবাহান তার ঘরের বারান্দায় উঠে এল নিঃশব্দে। চারদিক অন্ধকার। রাত কত হয়েছে? সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সোবাহান মৃদুস্বরে ডাকল, যূথি! যূথি!

কেউ সাড়া দিল না। সোবাহান গলা উঁচিয়ে দ্বিতীয়বার ডাকল, যূথি! যূথি!

মনসুর সাহেব বেরিয়ে এলেন। জলিল সাহেব এলেন। যূথিও এল। তার হাতে একটা হারিকেন। সে তাকাল অবাক হয়ে। সোবাহান ভাঙা গলায় বলল, যূথি, আমার আজ বড় কষ্ট।

যূথি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর এগিয়ে এসে তার দুর্বল রোগা হাতটি রাখল সোবাহানের গায়ে। বাতাসের ঝাঁপটায় তার অন্য হাতের হারিকেনটি দুলছে। চমৎকার সব নকশা তৈরি হচ্ছে দেয়ালে।

যুঁথি নরম স্বরে বলল, কাঁদবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুই ঠিক হয় না। তবু মমতাময়ী নারীরা আশ্বাসের কথা বলে। আশ্বাসের কথা বলতে তারা বড় ভালোবাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *