১৬-২০. এসো, একটু চা খেয়ে যাও

১৬.

এসো, একটু চা খেয়ে যাও। বাড়ির সীমানায় পা রেখে ওদের ডাকল সেকান্দর। চা খাওয়াটা ওর অনুপানের মতো। বাড়িতে চায়ের পাট নেই। কেবল ঘোর কোনো বর্ষার দিনে অথবা সর্দি জমে মাথাটা যখন টনটন করে তখন আদা তেজপাতার সাথে এক চিমটে চা পাতা সেদ্ধ করে তার সাথে কিছু চিনি লবণ মিশিয়ে চুমুক চুমুক টানে। শরীরটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মাথা ধরাটা ছেড়ে যায়। আসলে চা খাওয়াটা বাহানা, ওদের সঙ্গটা বুঝি ছাড়তে চায় না সেকান্দর। নির্ঝঞ্ঝাট সবল জীবনটা ওর কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। স্থির বাসনা-স্কুল-ক্ষেত-বাড়ি। নির্ধারিত বৃত্তের মাঝে সীমিত জীবন। হঠাৎ সেই বৃত্তের আড়ালটা যেন অপসারিত হয়ে গেছে। ওর অজানতেই কখন বিস্তৃত হয়ে গেছে জীবন আর চিন্তার পরিধিটা। গৎ ধরে চলা আর বাঁধাধরা ভাবনা, সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাকুলিয়ার সকলের সাথে সব কিছুর সাথেই কখন সে জড়িয়ে পড়েছে। কারো বিশ্বাস, কারো অবিশ্বাস, কারো বা ঘৃণা–সব কিছু মিলিয়ে এ জীবনটা কেমন? ইচ্ছে করলেও যেন এর মায়া কাটানো যায় না।

দু হাতের চেটোর মাঝে ধরা গরম এনামেলের বাটিটা একটু বুঝি নড়ে উঠল। নিজের ভেতরেই চমকে ওঠে সেকান্দর। গত রাত অর্থাৎ মাত্র ঘণ্টা পাঁচ ছয় আগে সৈয়দ বাড়ি থেকে ফেরার পথে ঠিক এ কথাগুলোই কী ভাবছিল না সেকান্দর? হয়ত একটু অন্য ভাবে ভাবছিল, অন্য কোনো ঘটনার সাথে মিলিয়ে। তালতলির শ্যামচরণ দত্ত হাইস্কুলের জুনিয়ার মাস্টার আবুল বশর মোহাম্মদ সেকান্দরের কী হল? ও কী ভাবতো কখনো? ভাবলেও কোনোদিন কী বেচাইন হত ও?

চায়ের বাটিটা এক পাশে ফেলে রেখে বেড়ার গায়ে ঢলে পড়েছে মালুর ঘুম ঘুম দেহটা। সেদিকে চোখ পড়ে হঠাৎ চটে গেল সেকন্দর : এই মালু। লেখা পড়া নেই, খালি ডাং ডাং। ঘর বাড়ি ছেড়ে রাত বিরেতে যার তার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? এখনি বখে যেতে শুরু করেছিস, না? দাঁড়া আজ স্কুলের বেতটা নিয়ে আসব, তোর পিঠেই ভাঙতে হবে ওটা। মালুর দিকেই উঠে যাচ্ছিল সেকান্দর। হঠাৎ হুরমতির চোখে চোখ পড়ে পা-টা যেন তুলত পারে না ও। অসাবধানে এমন একটা রূঢ় কথা বলে ফেলল ও? হুরমতির চোখের পাতাগুলো কেমন লাল নীল আর ভারি ভারি। ও কী কেঁদেছে এতক্ষণ? কেমন যেন লজ্জা পেয়ে নিজেই চোখ নামিয়ে নিল সেকান্দর। না, আজ হুরমতিকে এতটা অশ্রদ্ধা করত পারল না ও।

মালুকে শুইয়ে দাও আমার চৌকিটায়, সারারাত ঘুমোয়নি, কতক্ষণ আর ঘুমটাকে ঠেকিয়ে রাখবে। হুরমতিকে উদ্দেশ্য করেই বলল সেকান্দর। স্বাভাবিকের চেয়েও বুঝি নরম ওর স্বরটা।

না গিয়ে কী করবে? দ্যাশে গেরামে কী ভাত মিলে, না কাম মিলে? চা শেষ করে খোরাটা দাওয়ায় রেখে বলল ফজর আলি। এতক্ষণ ধরে এসব কথাই বুঝি তোলপাড় খাচ্ছিল ওর মনে।

আরো যাবে, দেখবেন মাস্টার সাব। ওই মিঞা আর বাবুরা মিলেই খেদাবে। সেকান্দরের দিকে তাকিয়ে লেকু মুখ খুলল এতক্ষণে।

অকস্মাৎ ক্ষেপে গেল সেকান্দর। তর্জনীটা উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল : খবরদার লেকু, খবরদার ফজর আলি। যাবার টাবার কথা বলেছ কী এখুনি বের হও আমার বাড়ি থেকে। গেরামটাকে কী তোমরা গোরস্থান বানাবে?

কাঁচু মাচু করে মুখ আর বুক এক করে ওরা। ওরা হয়রান মানে, আজ কী হয়েছে সেকান্দর মাস্টারের?

সেদিন আমার মাথাটা ঠিক ছিল না মাস্টার সাব। আপনি মাফ করে দিন। সেকান্দরের আকস্মিক রাগটাকে গলিয়ে দেবার জন্যই বুঝি পেছনের কোনো কথা পাড়ল লেকু। কুণ্ঠিত নীচুস্বর লেকুর। এমন স্বরে লেকুকে কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি কেউ।

ওর কথা আর ওর স্বর, দুটোই যেন রাগ তাড়িয়ে বিস্ময় ফোঁটায় সেকান্দরের মুখে। অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারে না সেকান্দর, মাফ চাইবার মতো এমন কী করেছে লেকু। হঠাৎ মনে পড়ে হেসে দিল ও, বলল, কী যে বল। একটু থেমে বলল আবার, গেরামটা ছাড়বে না তো?

মাস্টারের স্বরটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল। ওদের বুকে গিয়ে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল।

না। অদ্ভুত এক জোর লেকুর গলায়।

জাহাজের ভাড়াটা আলাদা করে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল লেকু। খোঁড়া জায়গাটাকে ঢাকতে গিয়ে সারা ঘরটাই লেপতে হয়েছে আম্বরিকে।

পাহাড় থেকে ফিরে এসেই রওনা দিবে রঙ্গম, এবার একলা নয়, আম্বরিকে সাথে করে। এই তো ঠিক ছিল। কিন্তু, এই একটি মুহূর্তে ওর সব ঠিক বেঠিক হয়ে গেল!

আচ্ছা উঠি। সেলাম দিয়ে উঠে গেল ওরা।

একটু গড়িয়ে নেবার জন্য নিজের চৌকিটায় গা রাখল সেকান্দর। ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমুতে পারল না। মায়ের চেঁচামেচি আর হাতের টান খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। ঘরের ছায়াটা দাওয়া ছেড়ে উঠোনে নাবতে শুরু করেছে, এত্তেলা দিচ্ছে মা।

হাঁ, স্কুলের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বই কী! তাড়াতাড়ি মালুকে একটা ধাক্কা দিয়ে উঠে গেল সেকান্দর। পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এল, নাকে-মুখে দুটো হুঁজে নিল।

খুন হলরে। খুন হলরে। খুন–হঠাৎ চিৎকার ভেসে এল। কান খাড়া করল সেকান্দর। গলাটা চেনা চেনাই মনে হচ্ছে। উত্তর দিক থেকেই ভেসে আসছে চিৎকারটা।

মুখে একটা পান পুরে ছাতাটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেকান্দর। কত টুকুই বা এগিয়েছে। পেছন থেকে কে যেন গলা ফাটিয়ে ডাকছে–মাস্টার সাব মাস্টার শীগগীর আসেন। পেছন ফিরে দেখল সেকান্দর। ঊর্ধ্ব শ্বাসে দৌড়াচ্ছে ফজর আলী, চিৎকারের সাথে সাথে হাতের ইশারায় থামতে বলছে ওকে।

খুন খারাবিটা কালে ভদ্রে হলেও কাইজা ফ্যাসাদ তো বাকুলিয়ায় নিত্য ব্যাপার। কিন্তু সে সব ঝগড়া বিবাদে সেকান্দর মাস্টারের আবার ডাক পড়েছে কবে! গায়ের জোরে যে যা পারল, বাকিটুকুর জন্য তো রয়েছে মাতব্বর আর পঞ্চায়েত। খিঁচানো মেজাজটা আরো যেন খিঁচিয়ে যায় সেকান্দরের। ওরা বুঝি একটুও রেহাই দেবে না ওকে, স্কুলে যাবার মুখেও না। হাজারো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট চাপিয়ে দেবে ওর মাথায়।

মারামারি করেছে তো আমি করব কী? পঞ্চায়েত ফেলে আমার কাছে কেন? ফজর আলীর কথাটা না শুনেই খেঁকিয়ে ওঠে সেকান্দর।

মারামারি কী বলছেন, এ যে খুন!

খুন!

হ্যাঁ, খুনই তো। জানটা তো যায় যায়। কতক্ষণ টিকবে কে জানে! যেন সম্বিৎ পেয়ে পড়ি মরি ছুট দেয় সেকান্দর মাস্টার। গাঁও মুল্লুকে যেমন আরো দশটি বিবাদ সামান্য শুরু থেকে মারাত্মক আকার নেয় তেমনি মামুলি ঘটনাটা রক্তারক্তি পর্যায়ে পৌঁছেছে। শেষ হয়নি, শেষের জেরটা কোথায় এবং কতদিন চলবে কে জানে।

লেকুর ঘরের পেছনের চালটা চুইয়া পানি পড়েছে গেল বর্ষায়। সেই তখন থেকেই নতুন চাল তুলবার কথাটা ভেবে আসছে ও। মুফতে নয়, নগদ দিয়ে কসিরের চাল দুটো তাই কিনে রেখেছে ও। সেকান্দরের বাড়ি থেকে ওরা আর ঘরে ফেরেনি। এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে দু একজনকে ডেকে ওরা দুজনে কসিরের পরিত্যক্ত ঘরের চালগুলো নামাতে লেগে যায়। মাত্র একটা চাল নামিয়েছে এমন সময় রমজান এসে হুংকার ছাড়ে–খবরদার, ও চাল ধরবে না, নেমে এস শীগগীর। খাজনা বাকি রেখে পালিয়ে গেছে কসির। অতএব ওই ঘর মিঞার প্রাপ্য। স্পষ্ট কথাটা জানিয়ে দিয়ে রমজান বুঝি কালু পেয়াদাকে নিয়ে নাবানো চালটা দখল করতে যায়। তখুনি তর্ক। আর তর্ক থেকে হাতাহাতি বেধে গেল লেকুর সাথে। ফজর আলী ছিল চালের উপর, বাকি চালটার বেতের বাঁধনগুলো কেটে কেটে আলগা করছিল। লেকু ছিল নিচে তাই অত লক্ষ করেনি ফজর আলি। হঠাৎ চিৎকার শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল ফজর আলী, উন্মাদের মতো দা চালাচ্ছে রমজান, একটার পর একটা কোপ বসিয়ে চলেছে লেকুর গায়ে। জলদি চাল থেকে নেমে আসে ফজর আলী, পেছন থেকে পা-টা পটকান দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় রমজানকে। নইলে তো টুকরো টুকরো হয়ে যেত লেকু।

ঘটনার জায়গায় এসে দেখল সেকান্দর এতটুকু অতিরঞ্জন নেই ফজর আলির বর্ণনায়। দার কোপে কোপে জর্জর লেকুর পেশীবহুল শরীরটা। উরুর উপরকার ক্ষতটাই সবচেয়ে বড়। এক দলা গোশত ঝুলে পড়ে ক্ষতটা একটি বীভৎস রূপ নিয়েছে, সাদা হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এখনো রক্ত পড়ছে গল গল করে। ঘাড়ে কাঁধে পিঠে বাহুতে শুধু দার কোপ, এতটুকু জায়গা যেন খালি রাখেনি রমজান। ঘা-গুলোর মুখে রক্ত এখন দলা পাকিয়ে জমে আছে চিটে গুড়ের মতো। অবচেতন লেকু যেন ডুবে আছে রক্তে, মাটিটাও রক্তে জবজব।

একবারের বেশি তাকাতে পারল না সেকান্দর। মানুষকে মানুষ এমন করে আহত করতে পারে, দলা দলা মাংস এমন করে কেটে কেটে তুলে নিতে পারে আর একটি মানুষের দেহ থেকে? এ কী বর্বর প্রতিশোধ নিল রমজান! ওর গরুটাকে যেমন করে কাঁটা ফুঁড়ে কুঁড়ে জর্জর করে ছিল লেকু, এ তো তার চেয়েও নৃশংস, তার চেয়ে বীভৎস। সারা গায়ে দায়ের কোপে কোপে কী বন্যক্রূরতা আর বর্বরতার ভাষা রেখে গেছে রমজান।

সবাই বে-দিশা, সবাই লেকুকে ঘিরে, কিন্তু ওর ধুক ধুক হৃদয়ের স্পন্দনটা যে কোনো সময় থেমে যেতে পারে সেদিকে যেন কারও খেয়াল নেই।

এই যাও। রহমত মৃধার গাড়িটা নিয়ে আস। জলদি কর। ফজর আলির দিকে তাকিয়ে আদেশ করল সেকান্দর। মাস্টারের এ মূর্তি অন্য মূর্তি, এ মূর্তিকে আমল না দিয়ে চলে না। ফজর আলি ছুটে যায় বাড়ির দিকে।

এই মালু তুই, দৌড় তো। গগন ডাক্তারকে নিয়ে আয়। এই ছেপ ফেললাম এটা শুকোতে না শুকোতেই চলে আসা চাই কিন্তু। মালু ছোটে তালতলির পথে।

ক্রোধে গোটা শরীরটা কাঁপছে সেকান্দরের : এ কী মগের মুল্লুক নাকি? ইংরেজের আইন কানুন কী নেই দেশে? থানা পুলিশ উঠে গেছে দেশ থেকে? চিৎকার শুনে যে যার কাজ ফেলে ছুটে এসেছে, বড় রকমের ভিড় জমে গেছে। সেই ভিড়টার উদ্দেশ্যেই যেন চেঁচিয়ে চলে সেকান্দর মাস্টার। কয়টা হার্মাদ মাতিয়েছে দেশের মধ্যে। আজ এর ছাগল চুরি, কাল ওর ক্ষেতের ফসল চুরি, মারামারি অশান্তি লাগিয়েই রেখেছে। এই হার্মাদ শয়তানগুলোকে শায়েস্তা করতে হবে, ওদের হাত-পা ভেঙে দিতে হবে। অনর্গল চেঁচিয়ে চলেছে সেকান্দর।

এতক্ষণে বুঝি খবরটা আম্বরির কানে গেছে। আলুথালু বেশে দৌড়ে আসছে ও। পেছনে হুরমতি, কিছুতেই সামলে রাখতে পারছে না আম্বরিকে, রক্তমাখা জ্ঞানহীন মানুষটাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে ও। নিথর দেহটার উপর আছড়ে পড়ে।

আহু হুরমতি, থামাতো ওকে, নিয়ে যা এখান থেকে। বলল সেকান্দর। কিন্তু বললে কী হবে, আম্বরির গায়ে এখন দুনিয়ার জোর। এই হট হট। ছুবিনা ওকে এখন। খবরদার। নিজেই তেড়ে আসে সেকান্দর। ওর ধমকে এই শোকের মাঝেও বুঝি হকচকিয়ে যায় আম্বরি। পলকের জন্য কান্নাটা ওর থেমে যায়। হুরমতি টেনে নিয়ে যায় ওকে।

বেশিদূর নিতে পারে না। ওর হাতের বাঁধন থেকে ছিটকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায় আম্বরি। মাথা আছড়ায় মাটিতে। টেনে টেনে বিলাপ করে, ওরে আল্লারে, আমার কপালটা পুড়ল রে। এরি মাঝে আবার বিলাপ ছেড়ে খনখনিয়ে উঠছে ওর অভিসম্পাতের জিহ্বা, কোনো হার্মাদ, কোনো কুত্তার বাচ্চা, কোন্ শুয়োরের জন্ম শুয়র আমার সর্বনাশ করল রে। আল্লার কহর পড়ুক, নির্বংশ হোক সেই বেজন্মা।

কহর থামিয়ে আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে আম্বরি। মাথার চুল ছেড়ে, কাপড়ের আঁচল টেনে টেনে ছেঁড়ে। হুরমতি কোলে নিতে চেষ্টা করে ওকে। কামড়ে দেয় হুরমতির হাত! আবার গড়াগড়ি খায় মাটিতে। তারপর অভিশাপের সম্ভাব্য পরিণতিগুলোও সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বয়ান করে চলে আম্বরি : হাত ভাঙবে, পা ভাঙবে, হাঁটু ভাঙবে। লুলো হবে, অন্ধ হবে, খোদার আকাশ থেকে ঠাডা পড়বে মাথায়, সারা গোষ্ঠী জাহান্নামে যাবে।

এই চুপ। খালি কাঁদবি নাকি তুই? কান্না ছাড়া আর কী পারিস? আম্বরির সামনে এসে খেঁকিয়ে ওঠে সেকান্দর। তারপর হুরমতির দিকে তাকিয়ে বলল ও, এই হুরমতি নিয়ে যা ওকে বাড়িতে। ওর ধমকের চোটে ভিড়টাও বুঝি পিছু হটে যায় দুপা। ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ সেকান্দর মাস্টার। নিজেকেই যেন ও আর সামলে রাখতে পারছে না। মিনিমুখো মুচকি শয়তান, আড়ালে বলত রমজান। ভালো মানুষ শান্ত সরল মাস্টার সাব, বলত বাকুলিয়ার মানুষ। সেই শান্ত মানুষটির এই অগ্নিমূর্তির দিকে বিস্ময় মেলে চেয়ে থাকে বাকুলিয়ার মানুষ।

গ্রামের কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা মারপিট, এক কথায় ভয়ংকর কিছু ঘটলেই মিঞা বাড়ির কর্তারা আসেন অকুস্থলে। ওটা ওদের প্রজা হিতৈষণার ঐতিহ্য। ফেলু মিঞাও এল। শুনলো দেখল। বলল : বড় আফসোস, এমন নাহক কাণ্ড ঘটে গেল। যাক, ডাক্তার ডাক। টাকা পয়সা যা লাগে নিও আমার কাছ থেকে। আর রমজানটা বাড়াবাড়ি রকমের গোঁয়ার বই কী? ওকে শাসন করে দেব আমি। তোমরাও রাতে এস আমার কাচারিতে।

রহমত গাড়িওলাকে নিয়ে ফিরে এসেছে ফজর আলি। ফেলু মিঞার শেষের কথাগুলো ওর কানে যায়। ফস করে বলে ও, বিচারের জন্য ফৌজদারিই আছে, সেখানেই দেখব আমরা।

গ্রামের মেল আছে, জমাত আছে। ও সব ছেড়ে ফৌজদারি কেন? শান্ত ভাবেই বলল ফেলু মিঞা।

হয়েছে হয়েছে। জমাত পঞ্চায়েৎ যে কী বিচার করে সে আমাদের দেখা আছে। সেকান্দরের কর্কশ রুক্ষ স্বরে ফেলু মিঞাও বুঝি চমকে ওঠে। তবু মাথাটা ঠাণ্ডা রাখে ফেলু মিঞা, বলে তা হাজার দোষ আছে জমাতের তা বলে কী গ্রামের কাইজা লয়ে পুলিশ ডাকবে, কোর্টে যাবে?

যাবোই তো ফেলু মিঞার চোখে চোখ রেখেই বলে সেকান্দর। ফেলু মিঞার নীল রক্তটা অকস্মাৎ সমুদ্র ঘূর্ণির মতো কয়েকটা পাক খেয়ে গেল। গর্জে উঠল মিঞার ব্যাটা : মেলের বিচার, মজলিসের বিচার, বিচার নয়? যাও তবে ফৌজদারিতে, দেখি কী বিচার পাও! এ হুমকিরও জবাব আছে। জবাব দিতে যাচ্ছিল সেকান্দর, কিন্তু থেমে যেতে হয়। গগন ডাক্তার এসে গেছে। পর পর দুটো সুঁই ফুটিয়ে দিল গগন ডাক্তার। ওষুধ দিয়ে পিঠ আর উরুর বড় দুটো ঘা ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। বলল, মারাত্মক জখম, নিয়ে যাও শহরের হাসপাতালে।

ওরা ধরাধরি করে লেকুকে তুলে নিল গরুর গাড়িতে। ফজর আলিকে গাড়ির সাথে রওনা করে দিয়ে সেকান্দর চলে এল বাড়িতে। বাক্স খুলে তুলে নিল কিছু টাকা। দ্রুত পা চালিয়ে মন্থর গরুর গাড়ির নাগাল ধরল। ফেলু মিঞার চোখের সুমুখ দিয়েই, ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটা। এত বড় স্পর্ধা? যাকে কখনো দেখেনি সেই দাদুর জামানার কথাটা মনে পড়ল ফেলু মিঞার। শুধু বাকুলিয়া কেন, দশ-বিশ গ্রামে মিঞার চোখে চোখ রেখেছে কেউ কোনোদিন? মিঞার সুমুখে কথা বলত তারা মুখ নীচু করে, হুকুম তামিল করত নিঃশব্দে।

ফেলু মিঞার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল আগুনের ফুলকি। বিচারের আশ্বাস দিল, তবু এই উদ্ধত অবাধ্যতা? কেন, হক বিচার কী করত না ফেলু মিঞা? নাঃ ছোট লোককে মোটেও আসকারা দিতে নেই। বাপদাদার অভিজ্ঞতার সেই শোনা কথাটাই দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল ফেলু মিঞা।

হঠাৎ কী যেন মনে পড়ল ফেলু মিঞার। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিটা এদিক ওদিক বুলিয়ে আনল একবার। তারপর দ্রুত পা চালাল তার কাচারির দিকে। আর ওর পিছে পিছে ভেসে চলে আম্বরির অভিসম্পাতগুলো : এত হার্মাদি সইবে না খোদা। খোদা জ্যান্ত কবরে নিবে তোকে। খোদার ঠাডা পড়বে, পুত মরবে ঝি মরবে, সর্বস্বান্ত হবি। নিজের বিষ্ঠা নিজে খাবি। অভিসম্পাতগুলো যে রমজানের উদ্দেশে সেটা বুঝি বলার প্রয়োজন করে না। নিরক্ষর কিষাণীর অশ্লীল মুখরতায় এত উত্তেজনার মাঝেও না হেসে পারে না ফেলু মিঞা। এমনিই ওদের স্বভাব, যেন মুখটা খারাপ করলেই সব শোধ নিয়ে নেওয়া হল। কিন্তু মুহূর্তও স্থায়ী থাকে না তার মুখের হাসিটা। কেন যেন মনে হল ফেলু মিঞার, আম্বরির ওই অভিসম্পাতগুলো তারই উদ্দেশে ব্যথিত মনের বদ দোয়া, ফলে যায় সেই বদ দোয়া। এতে যে কোনো সন্দেহ নেই ফেলু মিঞার! বৌ হালিমার সেই অভিসম্পাতটাও মনে পড়ল। কুষ্ঠ হবে, কুষ্ঠ হবে ওই হাতে। খোদার কহর পড়বে। কী এক ভয়ে গায়ের লোমকূপগুলো তার দাঁড়িয়ে যায় আর সেই ভয়টাকে এড়াবার জন্যই আরো জোরে পা চালায় ফেলু মিঞা।

কাচারিতে উঠে বুঝি বেকুব বনে যায় ফেলু মিঞা। কোত্থেকে ছুটে এসে ধড়াস করে তার পায়ের উপর পড়ে যায় রমজান। দু হাতে জড়িয়ে থাকে মুনিবের পা জোড়া। সেই অবস্থাতেই বলে চলে : আপনি মিঞা। আপনি মুনিব। আপনি রিজিকের মালিক। চাবুক মারতে হয় আপনার হাতেই মারবেন এই অধমের পিঠ। কিন্তু, হুজুর ওই ছোট লোক কুত্তার বাচ্চাগুলোর সুমুখে নাজেহাল করবেন না। দোহাই আপনার।

কোনো রকমে পা জোড়া ছাড়িয়ে নেয় ফেলু মিঞা, বলে, ব্যাটা চাষা, তোরে কী খুনাখুনি করতে বলেছিলাম? এতটুকু হয়ে যায় রমজান ফেলু মিঞার ধমকে। ফেলু মিঞার যদি ন্যায়বিচারের রোখ চেপে বসে তবে সর্বনাশের কিছু কী বাকি থাকবে?

চাষার পুত চাষা, শোন। ওকে শুনতে বলে নিজের জায়গাটিতে এসে বসে ফেলু মিঞা। রমজান কাছে এসে হাতজোড় দাঁড়িয়ে থাকে। জামার খুটটা ধরে হ্যাঁচকা টানে পাশে বসিয়ে দেয় ফেলু মিঞা, বলে, শীগগীর যা শহরে। গত মাসের পয়লা কী দোসরা তারিখ দিয়ে মামলা দায়ের করবি কসিরের বিরুদ্ধে। টাকা নিয়ে যা। যা লাগে তাই খরচ করবি। আর…হুঁ, আর একটা মামলা ঠুকে দিবি চুরির। ট্রেসপাস বুঝিস? অন্যের জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করেছে লেকু… হা শোন। এদিক ওদিক তাকায় ফেলু মিঞা। নিশ্চিত হয়ে নেয় কেউ নেই ধারে কাছে। তার পর মুখটা রমজানের কানের কাছে এনে ফিস ফিস করে বাতলিয়ে দেয় বুদ্ধিটা।

মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায় রমজানের মুখের দুশ্চিন্তার কালি। খুশির চোটে বুঝি লাফিয়ে উঠবে ও। কুতকুতে চোখের মণিগুলো সাপের জিবের মতো লিকলিকিয়ে বুঝি বেরিয়ে আসতে চায় কোটর ছেড়ে। ঠোঁটের কোণে কৃতজ্ঞতা স্বস্তি আর নেমকহালালির একটা বিচিত্র হাসি অনেকক্ষণ ধরে রাখে রমজান।

সাধে কী আর সে রমজান–মালিও না, সারংও না, একেবারে চাষার পুত চাষা; আর ফেলু মিঞা, যাকে বলে মিঞার ব্যাটা মিঞা, তার বুদ্ধির সাথে আঁটবে এমন মাথা এই পরগনায় আছে কয়টা?

টাকা নিয়ে রমজান দৌড় মারে মেঠো পথে। কোনাকুনি আলের পথে সেকান্দর মাস্টারের আগেই সে পৌঁছে যাবে শহরে, আগেই যে ওর পৌঁছানো দরকার।

১৭.

বাকুলিয়ার ছোট্ট ছেলে মালু। তালতলির মেলাটা কত কী দিয়ে গেল ওকে! গান সুর আর কথা দিয়ে যেন ভরে দিয়ে গেল ওর ছোট্ট বুকটা। কিষ্কিন্ধ্যার সেই বীর পুরুষটি যে চমক লাগিয়েছিল ওর মনে, সেটা প্রথম দুটো রাতের বেশি স্থায়ী হয় না। পরের চমকটা দিয়ে যায় গণি বয়াতি। সে চমক কাটে না, কাটবার নয়। দিনে দিনে সে চমকের ঘোরে মালু যেন কত কিছু খুঁজে পাচ্ছে, যা ওর ছোট্ট মাথার বুদ্ধি দিয়েও ধরতে পারে না, ছোট্ট মনটা দিয়ে বুঝতেও পারে না।

কত কিসসা কত গান গণি বয়াতির। আর ঢং কী শুধু একটি? কত ঢংয়ে কত সুরে কত রকমের নাচে ভাবে বলা কথা আর গাওয়া গান। শুধু কী গণি বয়াতি? সুলতানপুরের মধু গায়েন, উদবাজপুরের গফুর কবিয়াল, চাটখিলের রতন বড়ুয়া। ওরা যেন এ দুনিয়ার মানুষ নয়, জিনপরীর দেশের মানুষ। ফেরেশতাদের সাথেও নিশ্চয় ভাব আছে ওদের। সেই ফেরেশতাদের কাছেই বুঝি জাদু শিখেছে ওরা।

জাদু না জানলে অমন করে মাতিয়ে যেতে পারত তালতলির মেলাটা? আর মালুকে তো সে জাদু একেবারেই বশ করেছে। সেই নেচে নেচে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গাওয়া, সেই স্বর, সেই সুর, সেই মুখ; সব সময় ওরা যেন ভাসছে মালুর চোখের সুমুখে। আর ওদের সুরটা বেজে চলেছে মনের ভেতর। ঘুমের মাঝেও ওদেরই দেখছে মালু। এই তো, এটাকেই তো বলে জাদু করা। ওদের ভেতর জাদু আছে, কথাটা প্রথমে শুনেছিল ভটাচায্যিদের ছেলে মাখনের কাছে। তারপর নিজের চোখেই তো দেখেছে মালু, একটা নয় দুটো নয়, রীতিমতো গোছা গোছা তাবিজ ওদের বাজুতে বাঁধা। কী যে সাধ জাগে মালুর, এমন একটা তাবিজ কী সংগ্রহ করতে পারে না ও?

গানের মতো করে গাওয়া সেই আরবী ফার্সি বয়াতগুলোকে রোজ সকালেই আম্মার মুখে শুনে আসছে মালু। তা ছাড়া রাখালের গান, বিয়ের সময় নেকো সুরে গাওয়া মেয়েদের গান, এ সব তো হামেশাই শুনছে। কিন্তু তালতলির মেলার বয়াতিদের গানের সাথে তার যেন কোনো তুলনাই হয় না। তার জাত, তার শব্দ, তার টান সবই যে আলাদা।

ওদের ঢংটা নকল করে মালু। ওদের গানগুলো গায়, যখন লোক থাকে ধারে পাশে তখন মনে মনে। যখন থাকে না কেউ তখন দিব্যি গলা ছেড়ে। আর সে কী ফুর্তি, সে কী মজা ওর! সকালের ওই মক্তব, রাবুর ফরমাশ সব ফেলে দিয়ে শুধু ওর গান গাইতে ইচ্ছে করে। আর ইচ্ছে করে ওদের মতো নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে অনেক লোকের সুমুখে গাইবে সে। আহা, ওদের মতো করে কবে গাইতে পারবে মালু?

এমন সব মানুষ আছে দুনিয়াতে যারা দিনভর শুধু গান করে? শুধু গান আর গান? সে গান গেয়ে খুশির বান ডেকে দেয় মানুষের মনে? হাসির সুড়সুড়ি জাগিয়ে পাগল করে তোলে হাজার হাজার মানুষকে? কাঁদায়? হ্যাঁ সে তো নিজেই দেখল, রতন বড়ুয়ার গান শুনে অতগুলো মানুষ ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদল। এই মানুষগুলোর খবর এতদিন জানত না মালু। ভাবতেও মনটা খারাপ হয়ে যায় মালুর।

কত দূর-দূরান্তর থেকে এসেছিল ওরা। তারও দূরে, তার চেয়েও অনেক দূরে নিশ্চয় দুনিয়া রয়েছে, মানুষ রয়েছে। সেই দুনিয়ার মানুষগুলো কেমন কে জানে? সেই অজানা দুনিয়ার অচেনা মানুষগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মালু যেন অনেক দূর চলে যায়।

হঠাৎ মনে হল মালুর, তালতলি আর তালতলির ওপারে তামাম দুনিয়াটাই গানে ভরা। গান নেই শুধু বাকুলিয়ায়। আব্বার দরুদ, মিঞা মসজিদের আজান? ধ্যৎ, সে কী গান? তালতলির স্কুলের ছেলেরাও গান করে। মেয়েরাও। রানুদি তো কী একটা যন্ত্র বাজায় প্যাঁপু করে। সেই যন্ত্রটার সাথে গানের যে কী সম্পর্ক এতদিনেও বুঝতে পারল না মালু। নইলে নিশ্চিয়ই তার অন্ধিসন্ধিগুলো জেনে নিত রানুদির কাছ থেকে।

রানুদির প্রসঙ্গে বড় আপা আর রাবু আপার কথা মনে পড়ল মালুর। গান করে না কেন ওরা? এত লোক গেল মেলায়, তালতলিটা তো ভেঙেই পড়ল, অথচ আপারা গেল না। একদিন বলেই ফেলেছিল মালু। বলে কী ধমকটাই না খেয়েছিল বড় আপার কাছে। কিন্তু রাবু আপা বড় ভালো। খুব ভালো। এতোগুলো রাত যে তালতলির মেলায় কাটাল মালু, সে তো রাবু আপার বরাতেই।

গুন্ গুন্ করে মালু গণি বয়াতির মুখে শোনা গানের কলি। গলা ছেড়ে গাইবার উপায় নেই। শুনবে সবাই। আর শুনলে রক্ষে আছে? সেদিন তো অল্পের উপর দিয়েই বেঁচে গেছে মালু। দুপুর বেলায় কোরান পড়তে লাগিয়ে দিয়েছিলেন আব্বাজান। সম্প্রতি শুরু হয়েছে উৎপাতটা। মুনশীজীর উদ্দেশ্য ছেলেকে কেরাত শেখাবেন। কেরাত শেখাতে শেখাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মুন্‌শীজী। মালুও গলাটাকে খাট করতে করতে এক সময় চুপ মেরে যায়। ওর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সুরগুলো গুটি গুটি বেরিয়ে আসে। মালুকে ঘিরে সুরগুলো যেন নাচতে থাকে। মনে মনে গাইতে থাকে মালু। মনে মনে গাওয়া গানটা কখন যে জিবের ডগায় এসে ধ্বনি তুলল টের পায়নি ও, শুধু বুঝলো একটি উর্দু কিতাব ওর কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে চলে গেল। ছিটকে পড়ল অদূরে। মুন্‌শীজীর হাতখানা ওর কান অবধি পৌঁছবার আগেই তিন লাফে অনেক দূরে চলে এসেছিল মালু।  

দেখেছিস বড় আপা, মালু আমাদের কেমন সেয়ানা হয়ে উঠেছে। বাইরে তার কত কাজ আজকাল। মুচকি মুচকি হাসে আর বলে রাবু।

লজ্জায় এতটুকু হয়ে আসে মালু। গানের সাথে সাথে কোত্থেকে লজ্জা এসেও যেন ভর করছে ওর উপর। এই প্রথম লজ্জার সাথে পরিচয় হল মালুর।

রাবুর কথাটা অনেকক্ষণ ঘুর ঘুর করে ওর মনের ভেতর। কেমন যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে মালুর। মধুর চেয়েও মিষ্টি রাবু আপার কথা, রাবু আপার শাসনটাও। আদরটাও। আর কী সুন্দর চাপা ফুলের গন্ধঘেরা রানুদি। সেই রাবু, সেই রানু, ওদের চেয়েও মিষ্টি মনে হয় গণি বয়াতির গান। স্পষ্ট বুঝতে পারছে মালু, ওদের কথা শুনে, ওদের ফরমাশ খেটে আগের মতো মনটা ওর খুশিতে নেচে উঠে না।

কী বিপাকেই না পড়ল মালু। মধু গায়েনের বধুয়ার সুরটি মনে মনে ভাজতে গিয়েও মুখটা ওর লাল হয়ে ওঠে। কান যেন গরম হয়ে আসে। ও ছুটে যায় সৈয়দদের সেই মজা দীঘির পাড়ে। সেখানে চারিদিকে শুধু ধান ক্ষেত। লোকজন থাকে না ধারে কাছে। গলা ছেড়ে গান ধরে মালু। ঘরে ফিরেও লজ্জাটা ওর থেকে যায়। ওর মনে হয় কেমন যেন অন্যায় করছে ও, ধরা পড়লে কী যে শাস্তি হবে কে জানে! আপাদের কাজের ছুঁতো বের করে মক্তব ফাঁকি দেওয়া, একটা বাহানা খুঁজে সন্ধ্যায় মাস্টার সাহেবের পড়াটা ফাঁকি দেওয়া, এ যেন তেমনি কোনো অন্যায়, শাস্তি যার ভীষণ। তাই রাবুর সুমুখেও কেমন এক লজ্জায় এতটুকু হয়ে থাকে মালু।

ইস শরমে যে মরে যাস। শুধু বলেই কী ক্ষ্যান্ত হয় রাবু? মালুর থুতনিটা টিপে দেয়। তারপর যেন আকাশ থেকে পড়েছে তেমন করে আবার বলে : ও মা। এ যে ডেং ডেংয়িয়ে বেড়ে উঠেছিস রে! আমাকেও তো ধরে ফেললি!

রাবু আপাটা যে কী! দেখছে লজ্জায় মরে যাচ্ছে মালু, তবু ওকে কাছে টেনে ওর মাথার সাথে নিজের মাথাটা মিলিয়ে রীতিমতো মাপ-জোখ করতে লেগে যায়। না, এখনো আমি আধা ইঞ্চি লম্বা তোর থেকে। ছাড়া পেয়ে যেন বাঁচল মালু।

কিন্তু, রাবু আপার হাত থেকে কী বাঁচার উপায় আছে মালুর? সেদিন তো একটা কাণ্ডই করে বসল রাবু। বলা নেই কওয়া নেই দুটো নতুন লুঙ্গি ওর হাতে দিয়ে বলল : সেয়ানা হয়েছিস, হাফপ্যান্ট পরতে লজ্জা করে না তোর? নে পর এগুলো। কথা শেষ করেও হাসি থামায় না রাবু। মুখ টিপে টিপে হেসেই চলে। কেন যে এত হাসে রাবু আপা! ছুটে পালাতে চেয়েছিল মালু। রাবুর সুমুখে সে সাহসটাও খুঁজে পায়নি ও। সত্যিই তো, কেমন লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে ও। হাফপ্যান্টগুলো কেবলই ছোট হয়ে যাচ্ছে। গানের লজ্জা, বড় হওয়ার লজ্জা, দুয়ে মিলে কেমন যেন লাগে মালুর। ঠিক ঠিক ধরতে পারে না ও, আঁচও করতে পারে না ব্যাপারটা। শুধু মনে হয় আশেপাশের মানুষ, এই গোটা বাকুলিয়া আর সৈয়দ বাড়ির আপারা, ওদের কাছ থেকে কেমন আলাদা হয়ে যাচ্ছে ও।

বড় হওয়াটা যে এত মুশকিলের, এত লজ্জার মালু সেটা জানত না। অথচ মেজো ভাই যখন আসত শহর থেকে, মেজো ভাইকে দেখে ওর বড় হওয়ার সাধটা কী তীব্র ভাবেই না জাগত। কিন্তু এখন যেন আফসোস হয় ওর, যেন পারলে বড় হওয়াটা এখানেই বন্ধ করে দিত ও।

মায়ের অভিসম্পাতেও এই বড় হওয়া বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কথায় কথায় শুধু বড় হওয়ার গঞ্জনা। দামড়ার মতো বেড়ে উঠছে মালু। দামড়ার মতোই নাকি গুঁতগুঁতিয়ে চলে ও। দেখতে দেখতে কেমন শাল্টি গাবুর হয়ে চলেছে অথচ লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা। মায়ের কথা সেই লাল-কালো পিঁপড়েগুলোর মতোই এসে কামড়ে ধরে মালুকে। তবু যেন সহ্য হয়, রাবু আপার মতো লজ্জা দেয় না মায়ের এই গঞ্জনা। কিন্তু ভেঙে গেল মালুর লজ্জা, ভেঙে দিল রাসু আর মেজো ভাই।

রাসুদের বাড়ির পেছনের সেই ডোবা মতো পুকুরটা। বড় নির্জন। রাসুদের ঘর থেকেও বেশ দূরে। একেবারে পশ্চিমের পাড়টায় বসে গুন গুন করে মালু। একটু বাদেই রাসু এসে পড়বে, ও জানে।

.

ও তুই বুঝি বয়াতি হয়েছিস? একেবারে কানের কাছেই রাসুর স্বরটা শুনতে পায় মালু। কেমন একটা নাকসিঁটকানো ভাব রাসুর। অদম্য একটা ইচ্ছে জাগে মালুর একমণি একটা ঘুষি বসিয়ে দিক ওর থুতনিতে। নাক সিঁটকালে কী হবে, রঙ্গমিবুয়ার গান শুনে কেঁদে দেয় রাসু। কে না শুনেছে রঙ্গমিবুয়ার গান! রাসুও শুনেছে বই কী। তবু মালুর কণ্ঠে এ গান কলজেটাকে পানি করে চোখের ধারায় বইয়ে দেয়।

রঙ্গমিবুয়ার কাছে বাংলার বধূর সকরুণ মিনতি : বিবাগি খসমটাকে যেন পাঠিয়ে দেয়। হিসালামতে। রঙ্গমিবুয়ার তো ঘর আছে, বেটা আছে, বেটি আছে। তার দিলে কী রহম হবে না? পথ চেয়ে চেয়ে যে বধূর চোখে ছানি পড়ে গেল। গাছের ফল ঝরে গেল, আমের বোল থেকে আম এল। তবু তো কসম তার ফিরে আসে না। রঙ্গমিবুয়া জাদুর বাহুটা এক দিনের জন্যও কী মুক্ত করতে পারে না?…

মালুর কণ্ঠে সুর তো নয়, এ যে সেই প্রতীক্ষারতা বধূর বিলাপ, বুক ভাঙা কান্না। আর সেই সাথে রঙ্গম রঙ্গিলাকে কত ধিক্কার।

রঙ্গম রঙ্গিলারে…
রঙ্গম রঙ্গিলার সনে
রঙ্গে দিছ মন,
সেইমত দেওয়ানা হইয়া
রইল কতজনরে…

চুপচাপ বয়ে যায় সময়। বিরহিণীর দীর্ঘশ্বাসটা বুঝি ওদের ঘিরে থাকে। সেই কল্পিত হতভাগিনীর দুঃখের সায়রে ওরাও ডুবে যায়। মন যখন কচি, বুদ্ধিটা যখন স্বার্থবোধে অপরিণত, হাত জোড়া নরম–বিপন্নের সাহায্য তো দূরের কথা, নিজের জন্যও বুঝি বিশেষ কাজে আসে না সে হাত; অথচ বুকে আকুলতা জাগে অন্যের দুঃখে, ঠিক সেই বয়স ওদের। রঙ্গমিবুয়ার ফাঁদে-পড়া খসমের শোকে অসহায় আবাগী বধূর ব্যথাভরা বিলাপে ওদের ছোট্ট দুখানি বুক ভার হয়ে আসে।

হঠাৎ আঁচলটা মাথায় টেনে বাড়ির দিকে ছুট দেয় রাসু। রান্না ঘর থেকে বুঝি ওর মায়ের আওয়াজটা ভেসে আসছে। নির্নিমিষ চেয়ে থাকে মালু ওর ছুটে যাওয়া ছায়াটির দিকে। কেবলি দূরে সরে যাচ্ছে রাসু।

সেদিন যে সারা সকাল বেলাটা ওদের ঘরে ঘুমিয়ে কাটাল, কই রাসু তো একবার এসে দেখল না ওকে! আর আজকাল তো ওকে চুপিসারে ডেকে-ডুকে আনতে হয়।

কিন্তু গানের শরমটা একেবারেই ভেঙে দিয়েছে রাসু। এখন আর ঠাট্টাও করে না ও বরং নিজ থেকেই সেধে শুনতে চায়। আর কেমন মিষ্টি করে বলে : মালু বয়াতি। মালু বয়াতি, গান শোনাও না! ওর মুখের বয়াতি ডাকটি ভালো লাগে মালুর।

মেজো ভাই এসেছে, মেজো ভাই এসেছে। যেন মহাধুম পড়ে গেল সৈয়দ বাড়িতে। ইস প্রায় বছরটা কাবার করে এল মেজো ভাই! মালু তো রীতিমতো ছটফটিয়ে মরছে সেই থেকে, কবে আসবে মেজো ভাই।

কী মজারই না কাটল রাত্তিরটা। মালুর জন্য সুন্দর একটা সার্ট এনেছে মেজো ভাই, আর বিস্কুট। সার্টটা তক্ষুণি পরে ফেলল মালু। তারপর রাত ভর চলল কত কিস্সা কত গল্প। রাবু-আরিফারও তো দেবার খবর কম নেই। সারা বছরের খবর সবই যেন এক নিশ্বাসেই শোনাতে হবে মেজো ভাইকে।

কিন্তু এমন মজার রাতটা শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল মেজো ভাইর উৎপাত। সকালে উঠেই, শুধু মালুর নয়, রাবু-আরিফা, সকলের হাতের লেখা আর পড়া পরীক্ষা করতে লেগে গেল মেজো ভাই। ওইতো একটা দোষ মেজো ভাইর, যে দোষ কোনোদিন শোধরাবে বলে মনে হয় না মালুর।

কিন্তু পড়া পরীক্ষার পর যে কথাটা বলল মেজো ভাই সে ঠিক মেজো ভাইর মতোই। বলল–চল তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসি। কী রকম ধারি হয়ে গেছিস খেয়াল আছে? মেজো ভাইর কথাতেও সেই বড় হওয়ার ধিক্কার। কিন্তু মেজো ভাইর ধিক্কার তো? গায়ে লাগে না মালুর। নেচে ওঠে মালু। এত আনন্দ কোথায় ধরে রাখবে ও? ওই স্কুলটার সুমুখ দিয়ে যেতে যেতে কতদিন কত কথা ভেবেছে মালু। ওই স্কুলকে ঘিরে ওর ছোট্ট বুকখানিতে কত ভয়-বিস্ময়, কত স্বপ্ন জেগে উঠেছে, আবার মরে গেছে। সে স্কুলটিতেই প্রবেশ করবার অধিকার পাবে ও?

মেজো ভাইর যেই কথা, সেই কাজ। সেইদিনই তালতলির শ্যামাচরণ দত্ত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেল মালু।

১৮.

মানুষ আর আজরাইলে টানাটানি চলল গোটা একটি মাস। শেষ পর্যন্ত আজরাইলকে পিঠটান দিতে হল। সেরে উঠল লেকু। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সেকান্দর।

উৎকণ্ঠা মুক্ত হয়ে মামলার তদ্বিরে মন দিল সেকান্দর! কিন্তু কোর্ট আদালতের কারবার, সে এক অথৈ ব্যাপার। সেকান্দর মাস্টারের দুটা পাস সেখানে একেবারেই অকেজো।

মামলা ওরা যথাসময়েই রুজু করল। কিন্তু দু দিন বাদেই টের পেল সেকান্দর, বুদ্ধির খেলায় রমজানের মুনিব ফেলু মিঞার কাছে ও নিতান্তই শিশু। কেননা ওদের মামলাটা রুজু হওয়ার আগেই আর একটা মামলা রুজু হয়ে গেছে ওদের বিরুদ্ধে। বাদী রমজান। আসামী সেকান্দর মাস্টার এবং লেকু। অভিযোগ অনধিকার প্রবেশ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। কোন্ কেরামতিতে এটা সম্ভব হল সেকান্দরের লেখাপড়া শেখা মাথায় সেটা কিছুতেই বোধগম্য হল না। নেহাৎ খাতির করেই অথবা অন্য কোনো ইঙ্গিতে দারোগা আসছে না ওকে চালান দিতে। গ্রেফতারী পরোয়ানাটা ঝুলিয়ে রেখেছে। যে কোনোদিন ধরে চালান দেবে কোটে। তাছাড়া আইনেরই যে ফাঁক আছে, এ কথাটা সেকান্দর মাস্টারের স্কুল-কলেজে পড়া বিদ্যায় জানা ছিল না মোটেই। মেলা ফাঁক আইনের। ফাঁক সাক্ষী-সাবুদের। যা ঘটে তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। যা ঘটে না তাই প্রমাণিত হয়ে পড়ে পেনাল কোডের ধুরন্ধরদের কেরামতিতে। থানা আর মিঞা বাড়ির যতটা নৈকট্য সেকান্দর আর থানার মাঝে বুঝি ঠিক ততটাই দূরত্ব। সে দূরত্বে সেতুবন্ধের সামর্থ্য কোথায় সেকান্দরের? অল্প দিনের মাঝেই এই রূঢ় সত্যটা আবিষ্কার করল সেকান্দর মাস্টার।

সৈয়দদের সমস্ত সম্পত্তির দেখভালের ভার নিচ্ছে সেকান্দর। রমজানের মুখে খবরটা শুনে প্রথমে স্তম্ভিত হয় পরে বিষম ক্রোধে ফেটে পড়েছে ফেলু মিঞা। ভগ্নিপতিরা গ্রামের পাট গুটিয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে–এ তথ্যটার উপর ভিত্তি করে অনেক হিসেব করে রেখেছে ফেলু মিঞা। সে হিসেব বানচাল করে দেবে দু কলম পড়ালেখা জাননেওয়ালা গোলামের বাচ্চাটা? ও, তাই শালার পিঠে এত তেল হয়েছে, দল পাকিয়েছে লেকুকে নিয়ে। তা আর বলতে স্যার : আগুনে বাতাস দেয় রমজান।

শম্বুক গতিতে চলে মামলা। কিছুদূর গড়াতেই দেখা গেল যারা ছিল মুখ্য অর্থাৎ লেকু-রমজান, ওরা এখন গৌণ। অনেক পেছনে সরে গেছে ওরা। আর যারা ছিল পেছনে তারাই এসে গেল সুমুখে। লড়াইটা শুরু হল সামনাসামনি, একদিকে তালতলি স্কুলের তিরিশ টাকা মাইনের জুনিয়ার মাস্টার সেকান্দর অন্য দিকে মিঞার বেটা ফেলু মিঞা।

চোখে অন্ধকার দেখেও হাল ছাড়ল না সেকান্দর। আইন তার পক্ষে, ঘটনা দিবালোকের প্রকাশ্য জনসমক্ষে। কাজেই রমজানকে নিদেনপক্ষে দশ বছর ঠুকে দেয়া যাবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত সেকান্দর।

কিন্তু টাকা? টাকার দিকটা কেমন করে সামলাবে সেকান্দর? লেকুকে সারিয়ে তুলতে, মামলার প্রাথমিক দৌড়াদৌড়ির কাজে ওর স্বল্প সঞ্চয়টা যে ফুরিয়ে গেল। এখন? অথচ খরচ তো সবে শুরু। ওদিকে লেকু বেঁচে উঠলেও হাঁটা-চলার মতো সুস্থ হতে আরো সময় নিবে। সে সময়টা ওষুধ খেতে হবে। ভালো পথ্য দিতে হবে ওকে। সে খরচটাই বা আসবে কোত্থেকে। লেকু তো জমিজমা রেহান দিয়ে ফতুর হয়ে বসে রয়েছে। উপায়?

ফেলু মিঞার হাত ধরে কেঁদে দেয় সেকান্দরের বুড়ি মা : আপনি মিঞার বেটা মিঞা। গ্রামের মাথা। ছেলেকে ডেকে শাসিয়ে দিন, শাসন করুন। দু ঘা দিতে হয় আপনিই দেবেন, সে হক কী নেই আপনার? কিন্তু দোহাই আপনার পুলিশে হাজতে বেইজ্জত করবেন না ছেলেটাকে। ছেলের বিপদে ছুটে এসেছে মা।

হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ফেলু মিঞা। আতরমাখা রুমালটা একবার নাকের কাছে ধরে আবার পাট করে রেখে দেয় বুক পকেটে। কাচারির দিকে পা বাড়িয়ে বলে, আচ্ছা দেখি।

শুধু ওইটুকু কথায় বুঝি নিশ্চিন্ত হতে পারে না উদ্বিপ্ন মা। ফেলু মিঞার পিছু পিছু চলে আসে কাচারি তক। বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে কান্না-জড়ান গলায় কত কথা বলে যায় : পোলার কথা শুনবেন না। ওর তো মাথাই খারাপ হয়েছে, নইলে আপনার মুখে মুখে কথা বলে? আপনি ওকে মাফ করে দিন।

কাচারি ঘরটায় গিস গিস করছে লোক। খোদ বড়বাবু এসেছে তদন্তে। প্রাথমিক রিপোর্ট তো কবেই শেষ। সাক্ষী সাবুদও হয়েছে। তবু বড়-বাবু আর একবার এসেছেন দেখতে। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে কসিরের বাড়ি বলে কথিত ঘরগুলো মিঞাদের খাস দখলি জায়গায় মিঞাদেরই ঘর। এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে অমুক তারিখে সে জায়গায় বলপূর্বক প্রবেশ করেছে সেকান্দর মাস্টার এবং লেকু। লুঠতরাজ ও দাঙ্গাহাঙ্গামার উদ্দেশেই যে তাদের এই অনধিকার প্রবেশ এতেও কোনো সন্দেহ নেই। কেননা প্রত্যেকটি অভিযোগের পক্ষেই প্রমাণ অকাট্য।

লেখাজোখার পর্ব শেষ করে কিঞ্চিৎ নাশতায় মন দিয়েছে বড়বাবু। হাবিলদার গেছে সেকান্দর মাস্টার এবং লেকুকে ধরে আনতে। ওদের আজই চালান দেওয়া হবে মহকুমা শহরে। বাকুলিয়ার পক্ষে মস্ত বড় ঘটনা। তাই গোটা গ্রামটাই ভেঙে পড়েছে মিঞা বাড়ির কাচারি ঘরে আর দহলিজে। ঘটনার অনিবার্য পরিণতিটা স্বচক্ষে দেখবার জন্য রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করছে লোকগুলো।

পাকা আশ্বাস না নিয়ে কিছুতেই বুঝি নড়বে না সেকান্দরের মা। ফেলু মিঞা শুনছে, কী শুনছে না, সে খেয়াল নেই তার, কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে বলেই চলেছে নিজের কথা : আপনি খাওয়ালে পর গরিব বাঁচে, না খাওয়ালে গরিব মরে। আপনি আছেন বলেই তো গ্রামটা টিকে আছে। আপনি থাকতে আমার ছেলে ফাটক খাটবে?

কথাগুলো মোটেই আস্তে বলছে না সেকান্দরের মা। কাচারি ঘরের অনেক লোকই শুনতে পাচ্ছে। ফেলু মিঞা তো একেবারে ধারেই বসে আছে।

আচ্ছা আমি কথা দিলাম। আপনি খোদাপরস্ত মুরুব্বীজন, আপনার কথা কেমন করে ঠেলি। তা ছাড়া প্রজার-কল্যাণ চিরকালই দেখে এসেছে মিঞারা। আপনি পাঠিয়ে দিন সেকান্দরকে। গোটা কাচারি ঘরটাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলল ফেলু মিঞা।

আমাকে অমন ছোট করলে মা? কথাটা গলা পর্যন্ত এনেও মুখ দিয়ে বের করতে পারল না সেকান্দর। এমন একটা রূঢ় কথা কেমন করে শোনাবে মাকে?

মা ততক্ষণে ওকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ জুড়ে দিয়েছে। দু দুটি ছেলেকে মাত্র দুটো দিনের জন্য দুনিয়াটা দেখিয়েই বেহেশতে টেনে নিয়ে নিলেন খোদা। তৃতীয় জন এসেছিল সেকান্দর। খোদার দরবারে কত মাথা কুটে প্রার্থনায় চোখের জলে কত বুক ভাসিয়ে তবে তো সেকান্দরকে ধরে রাখতে পেরেছে মা, বড় করে তুলেছে। সেই সেকান্দর শুনবে না মায়ের কথা? তা ছাড়া সে হল সংসারের খুঁটি। অমন গোয়াতুর্মি দেখিয়ে সে যদি হাজতেই যায় তবে সংসারের কী হবে, আর ওকে ছেড়ে বুড়ি মা-টাই বা বাঁচবে কেমন করে?

ফেলিস না, ফেলিস না মায়ের কথা। ফেললে আমার মাথা খাস্ তুই। যা, তুই শুধু কাচারিতে যাবি। ফেলু মিঞার সুমুখে একবার দাঁড়াবি। কিছু করতে হবে না, কিছু বলতে হবে না তোকে। সেকান্দরকে অরাজি দেখে মায়ের কান্নাটা দ্বিগুণ হয়। আহ্ মা, থাম তো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সেকান্দর। কিন্তু করবে কী ও? না হয় আমল দিল না মাকে, সদরে চালান গেল, তারপর যা থাকে কপালে। কিন্তু লেকু? মাত্র দুদিন হল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে। লেকু, ভালো করে বসতেও পারে না। সে কী ভাবে সইবে হাজতের ধকল?

আরো কত কী ভাববার আছে! হাজতে গিয়ে পড়ে থাকবে ওরা। কে করবে মামলার তদ্বির, কে করবে জামিনের ব্যবস্থা! না হয় সুলতানই কয়েকদিন লেখাপড়া ক্ষ্যান্ত দিয়ে পড়ে থাকল শহরে। কিন্তু টাকা? কোর্টের অবস্থাটা নিজের চোখেই তো দেখে এসেছে সেকান্দর। পায়ে পায়ে ট্যাকের কড়ি ফেলে চলতে হয় সেখানে, নইলে এক পা এগুবার জো নেই। সত্যি সত্যি যখন শুরু হয়ে যাবে দু দিকের দুটো মামলা তখন খরচের কী আর কোনো মা বাপ থাকবে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মিঞা বাড়ির দিকেই এগোয় সেকান্দর।

হ্যাঁ, স্কুল ফান্ডে কিছু টাকা জমিয়েছে ও। সে আর কত। পুরোদমে যখন চলবে মামলা উকিল মোক্তার পেশকারের হাজারো বায়ন্নাক্কা মিটোতে গিয়ে সে তো দু দিনেই উড়ে যাবে। তখন? তাছাড়া ও টাকায় হাত দেবার কোনো অধিকার নেই সেকান্দরের। বিরাট একটা স্বপ্নকে সুমুখে রেখে জমানো এ টাকা। আর কতকষ্টে, এদিকে টানে তো ওদিক ছেঁড়ে এমনি করে সংসার চালিয়ে, মাসে মাসে বছরে বছরে তিল তিল বঞ্চনায় গড়ে উঠেছে ওই সঞ্চয়।

হঠাৎ কী এক ধাক্কা খেয়ে যেন জেগে উঠল সেকান্দর। সমস্ত চিন্তা কখন সরে গিয়ে বুকের পর্দায় ভেসে উঠেছে বিলাপকাতর মায়ের মুখখানি। চারিদিকের কত টান এ সংসারে! কথাটা যেন আজই প্রথম মনে পড়ল সেকান্দরের।

ওকি? লেকুকে অমনভাবে বেঁধে নিয়ে আসছে? হাঁটতে পারছে না। পা দুটো হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে চলছে ও। না, হাবিলদারটার বিবেচনা আছে। দড়িটা লেবুর কোমরে বাঁধা ঠিকই, তবে হাতটা হাবিলদারের কাঁধে রেখে কিছুটা কষ্ট লাঘব হয়েছে ওর। ওর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সেকান্দর। অমন থলথলে স্বাস্থ্য জোয়ান মরদটার একী চেহারা। এক মাসেই যেন দশ বছর বুড়িয়ে গেছে ও।

চেনা হাবিলদার। সেকান্দরকে দেখে হেসে বলল, চলেন আপনারও এত্তেলা আছে।

লেকুর সুবিধের জন্য আস্তে আস্তে হাঁটে ওরা।

ওদিকে এক কাচারি লোক রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।

কী করতে বলেন? পেস্তাবাদামের কুচি ছড়ানো জাফরানী শরবতের এক ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে বড় দারোগা।

বুড়িটা অমন করে কেঁদে কেটে গেল। রেখেই যান আজ। পরে অবস্থা বুঝে খবর দেব আপনাকে, এক কাচারি মানুষকে বুঝি অবাক করে দেয় ফেলু মিঞা।

দুটোকেই?

হ্যাঁ, দুজনকেই।

সকলের দিকে একবার তাকাল ফেলু মিঞা। তারপর দারোগাকে উদ্দেশ্য করে বলল আবার, এই জন্যই তো প্রজা শাসন আমাকে দিয়ে হল না দারোগা বাবু। কেঁদে পড়ল পায়ের উপর অমনি সব রাগ আমার পানি। তা ছাড়া ভাবি বেয়াদবি বে-তমিজি যাই করুক মাফ চাইলে মাফ যে আমাকে করতেই হবে। বাপদাদা চৌদ্দ গুষ্টি আমাদেরই খেয়ে মানুষ, আমি যদি ফেরাই তবে ওরা যাবে কোথায়? একটু হাসল ফেলু মিঞা। চোখ জোড়া তার আর একবার কাচারি ঘরটা প্রদক্ষিণ করে এল।

সে আর বলতে?

মারহাবা মারহাবা।

এই তো মিঞার পুত মিঞার মতো কথা!

হাফেজ সাহেব খতিব সাহেব, কারি সাহেব, কত মানুষের কত তারিফ আর বাবার গুঞ্জন। ঘর ভর্তি মানুষগুলোও বুঝি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, মাস্টারকে তাহলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না।

শুধু কিছু বলে না রমজান। বরাবর দেখে আসছে, আজও দেখল মুনিবের বিচিত্র স্বভাব। নীল রক্তের রাগটাই বুঝি ওরকম। যখন চড়ে রাগটা ফেলু মিঞা তখন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য আত্মবিস্মৃত, যাই তখন গেলান যাবে তাই গিলবে। কিন্তু একটু তোষামোদ পেয়ে সে রাগটা যখন পড়ে যাবে তখন বুঝি দিল্লীর বাদশা ফেলু মিঞা, দিলটা তার দরিয়ার মতো দরাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাছে তুলে মইটা কী কেড়েই নেবে ফেলু মিঞা? কী এক আতঙ্কত্রাসে ঘরভর্তি লোকের মাঝেও যেন গায়ে তার কাঁটা দিয়ে যায়।

মিথ্যে মামলা লাগিয়ে আবার মেহেরবানী দেখান হচ্ছে? ঠোঁটের গোড়ায় এসেও কেমন করে যেন রুখে গেল কথাটা। লেকুর উপর চোখ পড়তেই নিজেকে সামলে নিল সেকান্দর। মাতবর মোসাহেব পরিবেষ্টিত ফেলু মিঞার দিকে একবার নজরটা বুলিয়ে দহলিজে নেমে এল ও।

ক্রিং ক্রিং সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে ওর পাশ ঘেঁষেই চলে গেল বড় দারোগা। ইচ্ছে হল সেকান্দরের দারোগাকে থামিয়ে শুধু একটি কথা শুধায়, আইনটা কী তার পকেটে? কিন্তু সে প্রশ্নটা উচ্চারণ করার আগেই কাঁধের উপর কার যেন স্পর্শ অনুভব করল। পেছন ফিরে দেখল সৈয়দ বাড়ির মেজো ছেলে জাহেদ।

কী হে দারোগার পিঠে কী বঙ্গদেশের মানচিত্র দেখছ নাকি? হাসছে জাহেদ।

ও, জাহেদ? তুমি এসেছ, খবর পেয়েছি। কিন্তু, বড় ঝামেলায় পড়েছি ভাই, যেতে পারিনি। কিছু মনে করনি তো?

আহা-হা, ভদ্দরলোকি বিনয়ে যে একেবারে ভেঙে পড়ছ। জীবন থাকলে ঝামেলা। আমি তো বেশ বড় রকমের একটা ঝামেলা নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। চল বসা যাক কোথাও।

মিয়া পুকুরের ঘাটলার পাশে লিচু গাছটার তলায় গিয়ে বসল ওরা। জাহেদের প্রত্যাশী চোখজোড়া স্থির হয়ে থাকে সেকান্দরের মুখের উপর, বুঝি ওর কাছে থেকে শুনতে চায় গ্রামের হালফিল অবস্থাটা।

সেকান্দরের মনে হল ওর মাথাটায় যেন ঝিঁঝি লেগেছে। সেই সকাল থেকে মা-টি কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে, ফেলু মিঞার হাত ধরে ছেলের মুক্তি কিনে এনেছে। ইস্ কেমন ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটল লেকুটা! ওকি আর কোনোদিন গতর খাটিয়ে রোজগার করতে পারবে? এসব ভাবনা কেমন দুমড়ে দিয়ে যায় সেকান্দরের মনটা। কিন্তু, এ সবের চেয়েও বুঝি অসহ্য ফেলু মিঞার উদারতার চাবুক। না, এ সময় জাহেদের সাথে দেখাটা না হলেই ভালো হত। নিজেকে নিয়ে একটু নিরিবিলি বসতে পারত ও।

সেকান্দরকে নীরব দেখে জাহেদই মুখ খুলল বলল, আমি সব শুনেছি। শুনেছ? ও, মালু-রাবু দুই গেজেট তো তোমার আছেই।

ফিক করে হেসে দেয় মালু। এতক্ষণ লক্ষ করেনি সেকান্দর, পেছনে নখ কেটে কেটে লিচু গাছটার গুঁড়িতে নাম লিখছিল মালু।

ও, শ্রীমান দেখি পিছে পিছেই। মালুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল সেকান্দর।

হ্যাঁ, সেই আসার পর থেকেই। জাহেদের মুখেও একটা প্রশ্রয়ের হাসি। আবহাওয়াটা বুঝি আলাপের উপযোগী হয়ে আসছে। সেকান্দর তাকায় জাহেদের দিকে, তার কাছ থেকেই তো শুনবে ও। তিন কুলে যার নেই কেউ সেই মেয়েটাকে ধরে অমন একটা বর্বর শাস্তি দিলে? বলিহারি তোমাদের বাহাদুরি। অথচ রমজানের গায়ে একটা আঁচড়ও বসাতে পারলে না। হঠাৎ বলল জাহেদ।

মিঞা-বাড়ির নায়েব-সরকার, তার আবার অপরাধ কী : ব্যঙ্গের স্বরে বলল সেকান্দর। থামল বুঝি গুছিয়ে নিল পরের কথাটা। বলল আবার অবিচার অনাচার যে কীভাবে বেড়ে চলেছে গ্রামে শুনলে আঁতকে উঠবে। লেখাপড়া শিখে তোমরা হলে দেশান্তরী, নইলে এমন হয় গায়ের অবস্থা? অভিযোগের স্বর সেকান্দরের।

একটু ভুল বললে মাস্টার। লেখাপড়া শিখে নয়, লেখাপড়া শেখবার জন্য গ্রাম ছেড়েছি। সে উদ্দেশে যদি গোটা বাকুলিয়াটা বিরানা হয়ে যায় আমি তাকে স্বাগতম জানাব।

বল কী? তা হলে ওই যে আমরা বলি গ্রাম বাংলা; জাতির প্রাণকেন্দ্র, সে সব কথার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?

এক পাইও না। গ্রামের মানুষগুলো যাতে শহরে বাবু সায়েবদের বিলাস দুর্গে হানা না দেয় তাই গাঁয়ে ফিরে যাও বলে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে তারা।

গ্রাম কী তা হলে বাঁচবে না? গ্রামের কোনো ভবিষ্যৎ নেই? কেমন কাতর শোনায় সেকান্দরের গলাটা।

না। যেভাবে আছে ওভাবে বাঁচবে না। তার জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়ে লাভ নেই। ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যৎ আছে বৈকি। তবে সে হবে অন্য গ্রাম।

কী রকম?

ওই যে দেখছ দখিনের ক্ষেত? অজস্র গুলগুলোর খোপের মতো, হাজার আলের কাটাকুটি, ও সব থাকবে না। গোটা দক্ষিণ ক্ষেতে থাকবে বড় জোর চার পাঁচটা সীমানা। চাষ চলবে কলের লাঙ্গলে। ফসল উঠবে যারা চাষ করবে তাদেরই ঘরে। জমিদার-তালুকদার-মহাজনের বখরাদারী চলবে না। ডায়নামো বসবে। বিজলী বাতি জ্বলবে গাঁয়ের ঘরে ঘরে। ক্লাব থাকবে, রেডিও থাকবে গাঁয়ে গাঁয়ে। স্কুল থাকবে প্রতি গ্রামে, কৃষকের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে বিনে মাইনেয়। বলতে বলতে অনাগত সেই স্বপ্নটা যেন ছায়া ফেলে যায় জাহেদের চোখের কোলে। তা কী সম্ভব? জাহেদের কল্পিত ছবিটি এত সুন্দর আর আকর্ষণীয় বলেই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না সেকান্দরের।

সম্ভব নয় মানে? সেকান্দরের অবিশ্বাসটা যেন মহাপাপ, চোখের দৃষ্টিটাকে অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ করে তাই বুঝিয়ে দিল জাহেদ।

শোননি কিছু? পত্রিকা পড় না? দেশ জুড়ে যে বেজে উঠেছে স্বাধীনতার ডঙ্কা। দিকে দিকে আজাদীর বুলন্দ আওয়াজ। দেশ আর কতদিন সহ্য করবে গোলামির জিঞ্জির? ইংরেজের যাবার দিন এসে গেছে হে, এসে গেছে। স্বাধীনতা না দিয়ে আর উপায় নেই ইংরেজের।

আর স্বাধীনতা মানে

মানে ওই নতুন গ্রাম

আলবত।

কী বিশ্বাস, কী দৃঢ়তা জাহেদের কথায়! মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে সেকান্দর। জাহেদের থেকে বয়সে ও বছর পাঁচেকের বড়। তবু সেই স্কুলে পড়বার সময় থেকেই দুজনের মাঝে গড়ে উঠেছে একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক। বয়স বাড়বার সাথে সাথে সেটা বন্ধুত্বে উন্নীত হয়েছে। বাকুলিয়ার গেরস্ত ঘরের একমাত্র শিক্ষিত ছেলে বলেই হয়ত সে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল আর তারই সূত্র ধরে সৈয়দবাড়ির অন্দর মহলেও যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছিল সেকান্দর। কিন্তু আজ মনে হল ওর, বন্ধুত্বের আর বয়সের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে জাহেদ। আজ শুধু বন্ধুত্বের দাবি নয় ওর দাবি শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যের।

কিন্তু, স্বাধীনতা মানে স্বরাজ নয়

স্বরাজ নয়? কেন? শুধাল সেকান্দর।

স্বরাজ মানে তো হিন্দুরাজ। এতে মুসলমানদের কী হবে? প্রায় দুশো বছর তো ইংরেজের গুঁতো খেয়ে খেয়ে কাটল। স্বরাজ এলে পর শুরু হবে বেনে মুৎসুদ্দির গুঁতো। এখন কী তার নমুনা দেখতে পাচ্ছ না?

অবাক না হয়ে পারে না সেকান্দর, ফেলু মিঞার কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি শুনবে জাহেদের মুখে, কখনো ভাবতে পারেনি ও। কী যেন বলতে চাইল ও, কিন্তু ততক্ষণে রীতিমতো বক্তৃতা শুরু করেছে জাহেদ।

জানো মাস্টার? আলিগড়ে আমি একটি বিরাট সত্যকে উপলব্ধি করেছি। বই বন্ধ করে জাগরণের বাণী নিয়ে ঘুরলাম গোটা উত্তর ভারত।

দেখলাম সারা দেশ জাগছে, হয়ত এগুচ্ছেও। কিন্তু মুসলিম জনতা? কেবলি যেন পিছিয়ে পড়ছে, কেবলি যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। শতাব্দীর উপর লড়ে লড়ে অত্যাচার সয়ে সয়ে ওরা যেন রণক্লান্ত, অশিক্ষা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে ক্ষণ-ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল যে জেহাদ, সেও যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। কেন, কেন এই অবস্থাটা জান?

কেন? ওর প্রশ্নটা ফিরে ওকেই শুধাল সেকান্দর।

কারণ আগত সেই স্বাধীন দেশে, স্বাধীন মর্যাদায় ওরা যে বাঁচতে পারবে সে নিশ্চয়তাটা খুঁজে পাচ্ছে না মনের ভেতর। গলাটা সাফ করে আবার শুরু করল জাহেদ : বাংলাদেশের ছবি তো আরো মর্মান্তিক। কয়েকটা জেলা ঘুরে এলাম। দেখলাম, সেই অন্নহীন বস্ত্রহীন শিক্ষাহীন মুসলিম প্রজাকুলের ব্যর্থ হাহাকার। কেউ কাঁদে না ওদের দুঃখে, কেউ শোনে না ওদের ফরিয়াদ। বুঝি ওই অভাগাজনদেরই দুঃখে ধরে আসে জাহেদের গলাটা। মিঞা পুকুরের টলটলে পানিটার দিকে তাকিয়ে কেমন উন্মনা হয়ে যায় ও। কিন্তু, মুহূর্তের মাঝেই কী এক আলোর ঝিলিক খেয়ে যায় ওর চোখে, উদ্ভাসিত মুখে বলে চলে ও : কিন্তু শহরে? লক্ষ্ণৌ, আলিগড় কানপুর, দিল্লী, কোলকাতায়? সে এক আশ্চর্য উন্মাদনা। জেহাদী প্রাণ যেন টগবগিয়ে উঠছে সেখানে। হাজার হাজার মুসলিম তরুণ আজ এক নতুন স্বপ্নে মেতে উঠেছে। নয়া জাগরণের বাণী ওদের মুখে মুখে। আজ বাকুলিয়ায় সে বাণী আর সে স্বপ্নের ডাক নিয়েই তো এসেছি আমি। সেকান্দর, আমি তোমার মদদ চাই। সে বাণী তোমাকেও যে শুনতে হবে, শোনাতে হবে লক্ষ হাজার মানুষকে। তুমি রাজি?

কী যেন এক শক্তি আছে জাহেদের কথায়। আর সে শক্তিটা ওর তরুণ বয়সের আবেগের সাথে মিশে ঝংকার তোলে বাতাসে। উত্তরের প্রত্যাশায় ও চেয়ে থাকে সেকান্দরের মুখের দিকে।

ইংরেজ, হিন্দু-মুসলমান জন্মভূমি, স্বাধীনতা এসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি বাকুলিয়ার সেকান্দর মাস্টার। তালতলির জোয়ান মাস্টাররা এ সব নিয়ে কত তর্কের তুফান তুলেছে, স্কুলের ময়দানে মিটিংও করেছে ওরা। কেউ কেউ জেল খেটে এসেছে, এখনো খাটছে। পত্রিকাগুলোও নিত্যদিন ছাপার অক্ষরে আগুন ঝরিয়ে চলেছে। দূর থেকে এসব দেখেছে সেকান্দর। শুনেছে আরো অনেক বেশি। কিন্তু নিজে কখনো উৎসাহ বোধ করেনি ও, হাঙ্গামা হুজ্জত বলে এড়িয়েই চলেছে। কেউ ওকে টানতেও আসেনি। তাই ও জগৎটা ওর কাছে এক রকম অজানা, যেমন অজানা ছিল নিজের গ্রাম এই বাকুলিয়াটা। ও তো সবে চিনতে শুরু করেছে বাকুলিয়াকে। তবু সেকান্দরের কথাটা পুরোপুরি জানবার ইচ্ছে হল, শুধাল তোমার স্বপ্নই বা কী বাণীই বা কী, আর একটু খোলাসা করে বলনা কেন?

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল জাহেদের : গোটা ভারতের মুসলমানকে আজ এক হতে হবে, এক জমাতে এক আওয়াজে এক নিশানে। গোটা বাংলায়, সারা ভারতে শুরু হয়ে গেছে সে কাজ। এ অঞ্চলে সে কাজের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে।

আমাকে? যেন আঁতকে উঠল সেকান্দর। না না ও সব রাজনীতি ফাজনীতির মধ্যে আমায় টেনো না জাহেদ, ওসব আমি বুঝি না।

বোঝ না? যেন ব্যাঙ্গের সুরেই বলল জাহেদ আর দৃষ্টিটাকে শলার মতো তীক্ষ্ণ করে গেঁথে রাখল ওর মুখের উপর।

নানুর কথা মনে আছে তোমার? সেকান্দরের মুখের উপর দৃষ্টিটাকে তেমনি গেঁথে রেখেই শুধাল জাহেদ।

হা মনে থাকবে না কেন?

নানুর সাথে যে তোমার আব্বাও কারাবরণ করেছিলেন সেই একুশ সালে জান সেটা?

বারে, জানব না কেন? আবছা আবছা মনেও রয়েছে আমার।

তবে? তবে কোন লজ্জায় তুমি আজ বল রাজনীতি বোঝ না?

তর্কে বুঝি কোণঠাসা হয় সেকান্দর। কিন্তু তর্কে হারা আর সত্যি সত্যি বুঝে নেয়া, দুটোতে অনেক তফাৎ। দেশ জাতি জন্মভূমি, জনসাধারণ একান্তভাবেই কতগুলো বাংলাশব্দ সেকান্দরের কাছে। তবু ওর পরিবেশ ওর দেখা এবং শোনা সে সব কী কখনও কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি ওর মনে? ছাপ যে ফেলেছে এবং মনে মনে ওর নিজস্ব একটা মতও যে গড়ে উঠেছে, সেটাই প্রকাশ পেল ওর দ্বিধা জড়ান কথায়! হিন্দু-মুসলমান আলাদা আলাদা জামাত গড়বে আলাদা রাজনীতি করবে, এটা কেমন ধারা কথা বলছ তুমি?

জাহেদের চোখ জোড়া নেচে যায়, যেন বলে, তবে যে বলছ রাজনীতি বোঝ না। বলল জাহেদ, সে কথাটাই তো এতক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছি তোমায়! দেশ জাগছে, স্বাধীনতা আসবেই। স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবে এদেশের মানুষ। কিন্তু সে স্বাধীনতার মন্ত্রে স্বাধিকার চেতনায় মুসলিম সমাজ এখুনি যদি সঙ্ঘবদ্ধ না হয়, তবে তারা যে শুধু পড়ে পড়ে মারই খাবে, অশিক্ষার দারিদ্র্যের অভিশাপ কোনো দিনই যে ঘুচবে না তাদের, এ সম্পর্কে কী সন্দেহ আছে তোমার?

ঠিক ঠিক। ভালো করে সমঝিয়ে দাও তো মাস্টারকে! হিন্দু স্কুলে চাকরি করে আর দিনরাত হিন্দুদের সঙ্গে উঠে বসে ওর মগজটাও হিন্দু ধাঁচের হয়ে গেছে।

ওরা চমকে ওঠে ফেলু মিঞার কণ্ঠস্বরে।

আসরের নামাজ সেরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছে ফেলু মিঞা। পরনে লাল সিল্কের উপর হলুদ ডোরা কাটা বর্মি লুঙ্গি। গায়ে সাদা মলমলের পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর বুক পকেটে সে আতর মাখা রুমাল। হাতে ছড়ি। নামাজ সেরে মাথার কিস্তি টুপিটা পাশের পকেটে রেখে দিয়েছে ফেলু মিঞা। একটু পরে ফেলু মিঞা চলে যাবে পুকুরের পূর্ব পাড়ে। সেখানে মিঞাদের পারিবারিক গোরস্থান। পূর্বপুরুষদের কবরগুলো জিয়ারত করে ফেলু মিঞা নেবে পড়বে দখিন ক্ষেতের রাস্তায়। ছড়িটা ঘুরোতে ঘুরোতে সোজা চলে যাবে বড় খাল অবধি। তারপর ফিরে আসবে। বিকেল বেলায় এই কবর জিয়ারত আর ভ্রমণের শৌখিনতাটা ফেলু মিঞার নিয়মিত অভ্যাসের অঙ্গ।

হঠাৎ কেন যে চুপ মেরে গেল ওরা বুঝতে না পেরে কাজের কথায় এল ফেলু মিঞা : শোন জাহেদ। পরশুদিন মিটিং দিয়েছে। তুমি তৈরি থেক কিন্তু।

পরশু? এত জলদির কী ছিল? আমি তো থাকব অনেকদিন।

না না এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইলেকশানের দিন আসছে ঘনিয়ে। ওদিকে কংগ্রেসীরা তো রীতিমতো বড়গোছের একটা মোল্লার দলকে কিনে নিয়েছে।

কিনে নিয়েছে? সমস্বরেই যেন চেঁচিয়ে উঠলে ওরা।

ওই কেনারই সামিল। বাইরে কী আর সে কথা বলে? তারপর কোত্থেকে পটিয়েছে এক মাওলানা, সে তো চষে বেড়াচ্ছে গোটা অঞ্চল। যা তা বলছে লীগের বিরুদ্ধে।

কিন্তু মামা মিটিংয়ের আগে আমি তো কিছু আলাপ সালাপ করে নিতে চেয়েছিলাম, মাঝে সময় যে রইল মোটে একটা দিন। ইতস্ততা জাহেদের কথায়।

চকচকিয়ে ওঠে ফেলু মিঞার চোখ জোড়া। এক কদম এগিয়ে এসে জাহেদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়, কী এক আগ্রহে ঝুঁকিয়ে আনে মুখটা। বলে : হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও ভাবছিলাম ঘরোয়া পরামর্শটা হয়ে যাওয়া দরকার। এইটুকু বলে কেমন লাজুক গোছের একটা হাসি ছাড়ল ফেলু মিঞা। ঢোক গিলল। বলল আবার, অবশ্য আমি যা ভেবেছি, সেটা তোমাকে এখুনি জানিয়ে দিতে পারি। আমি ভেবেছি, সেক্রেটারী হিসেবে মাস্টারই হবে উত্তম ব্যক্তি তুমি শুধু ওর মাথাটা টাইট করে দেবে। আর প্রেসিডেন্ট? সে দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম।

প্রেসিডেন্ট আপনি? ও, কাজের নেই দেখা, আর এখুনি গদি ভাগাভাগি? মামা, আপনার মতলবটা তো বড় খারাপ! বিদ্রূপ তীক্ষ্ণ জাহেদের কণ্ঠ।

ভাগনের অতর্কিত স্পষ্টবাদিতায় অপ্রস্তুত হয় ফেলু মিঞা। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি টেনে বলে : আরে যাহ, কী ফজুল বকছ তুমি।

শুনুন ফেলু মামা। দুশো বছরের ইংরেজ শোষণের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য লড়ছি আমরা। সে মুক্তির রূপ অতি স্পষ্ট : দেশের মাটি আমার, দেশের সম্পদ আমার, আমার মুক্তি কোটি কোটি মজলুমের পেটে দেবে অন্ন, গায়ে দেবে বস্ত্র আর মুখে ফোঁটাবে হাসির ছটা। আমাদের লড়াইয়ের ঘোড়ায় চড়ে আপনার মতো জমিদার তস্য জমিদাররা তখতে জেঁকে বসবেন সেটি হচ্ছে না কিন্তু। তীরের মতো কথাগুলো ছুঁড়ে মারল জাহেদ।

দেখেছ মাস্টার? আলিগড় থেকে কেমন চমৎকার বক্তৃতা শিখে এসেছে আমার ভাগ্নেটি! সাবাস, পরশুর মিটিংয়ে এমন তেজী জবান আর গরম সামুচার মতো বক্তৃতা চাই কিন্তু।

ফেলু মিঞা হেসেই উড়িয়ে দিল জাহেদের কথার তীর। কিন্তু এই কৃত্রিম হাসিটা বুঝি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না, তাই ছড়িটাকে এক চক্কর ঘুরিয়ে কবরস্থানের দিকে পা তুলল ফেলু মিঞা। যেতে যেতে বলল, তোমরা সবাই মিলে যা ঠিক করবে তাতেই আমার সায়।

দেখছ? কী রকম নিশ্চিত বিশ্বাস আমার মামুটির? যেন সে ছাড়া লীগের প্রেসিডেন্ট হবার মতো আর কেউ নেই এ তল্লাটে। ক্ষতি কী? হিন্দুদের সাথে লড়তে হলে তো ও রকম লোকই দরকার। ফস করে বলল সেকান্দর।

আহ্ চুপ কর তো। ফেলু মামা স্বপ্ন দেখছে কবে আবার মোগল বাদশাহীটা ফিরে আসবে হিন্দুস্তানে। তার হাতে পড়ে লীগের দশাটা কী হবে ভেবে দেখ তো? হঠাৎ জাহেদ হাত বাড়িয়ে সেকান্দরের হাত জোড়া ধরে নেয়, বলে, না না সেকান্দর। রাজি হয়ে যাও তুমি। সব দায়িত্ব তুলে নাও তোমার কাঁধে। তুমি, একমাত্র তুমিই পারবে ধনী নির্ধন সকল মুসলমানকে এক পতাকার নিচে শামিল করতে। তোমায় গরিবরা কত ভালোবাসে সে কী আমি জানি না? গভীর আবেগ নিঙড়ান স্বর জাহেদের। আর সে আবেগটা যেন ওর স্পর্শ বয়ে সেকান্দরের সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে কী এক বিদ্যুৎ সঞ্চারণে।

চট করে কোনো কথা জোগায় না সেকান্দরের মুখে।

ওরা উঠে পড়ে। আস্তে আস্তে হাঁটে।

পরিচিত পথ। চেনাজানা ঘরবাড়ি। তবে অনেকদিন পর এসেছে বলেই যেন নতুন মনে হয় জাহেদের। কিন্তু সেই নতুনত্বে নেই এতটুকু ভালো লাগার আকর্ষণ।

বেপারী বাড়ির ঘরের সুমুখের আম গাছটা এই বছরেই কত বেড়ে গেছে। চৌকিদার বাড়ির বুড়ো পাকুড় গাছটা ভেঙে পড়েছে। তবু একটা চিকন ডাল বুকে লয়ে মোটা গুঁড়িটা হেলে পড়েও ভাঙেনি এখনো, মাটির মায়া কাটাতে পারছে না বুঝি। চৌকিদার বাড়ি থেকে মৃধা বাড়ি অবধি রাস্তাটায় শুধু ভাংনা আর ভাংনা, যেন আস্ত একটা মানব শরীর থেকে খাবলা খাবলা মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে। কত বছর মাটি পড়েনি এ রাস্তায় কে জানে! গেল বর্ষায় যে পড়ে গেছিল হাসমত মৃধার ঘরখানা সেটা ডানা ভাঙা মোরগের মতো তেমনি মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। তবু তারই মাঝে বসত চলছে ওর এক বৌ তিন ছেলে মেয়ের।

ঘিনঘিন করে জাহেদের গাটা। গায়ের পাতলা চামড়াটায় যেন বালি পড়ে খস খস অস্বস্তি ছড়িয়ে যায়। দিনে দিনে নগ্ন হয়ে উঠছে বাকুলিয়ার দারিদ্র আর শ্রীহীনতা।

রাস্তাঘাটের মেরামতই বল আর পয়পরিষ্কারই বল, এ সব কারও মাথা ব্যথা নয়। কে বা একটু নজর দেয় গরিব দুঃখীর দিকে। তোমরাও সব রইলে বিদেশে। বুঝি জাহেদের চিন্তাটা অনুসরণ করেই বলল সেকান্দর। অভিযোগ-ম্লান ওর স্বর।

আড়চোখে একবার তাকায় জাহেদ। নীরবে পথ চলে।

অথচ তালতলিতে কিন্তু এমন হয় না কখনো–উদ্যোগী লোকের অভাব নেই সেখানে। নিজের কথাটাই চালু রাখল সেকান্দর।

শুধু উদ্যোগ কেন, অর্থ বিদ্যা সামর্থ্য দেশপ্রেম কোনটায় ওদের কমতি? তোমাদের সামর্থ্যও নেই তাই উদ্যোগও নেই। কেমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে জাহেদের গলাটা।

আবার পলিটিক্স টানছ তুমি? আমি বলি, বেশি নয়, তোমার মতো লেখাপড়া জাননেওয়ালা যদি চারটি ছেলে থাকে এই বাকুলিয়ায়, পারে না তারা এই গ্রামের চেহারাটা বদলে দিতে? নিশ্চয় পারে। অথচ সে দিকে না গিয়ে শুধু বুক চাপড়াও, যত ধন দৌলত শান-শওকত ওই হিন্দু জমিদার মহাজন বাবুমশায়দের, হায় হায় কী হবে আমাদের। কেন, অমন সংকীর্ণ ঈর্ষায় ছোট করি নিজেকে? তার চেয়ে জ্ঞানে গরিমায় সততায় ত্যাগে ওদেরকেও ছাড়িয়ে যাব, এমন একটা প্রতিজ্ঞা কী নিতে পারি না আমরা? আমি তো বলি এই সুস্থ প্রতিযোগিতা আর সহযোগিতার পথটাই একমাত্র সত্য পথ, ওতে উভয়েরই মঙ্গল।

হঠাৎ যেন কথার বাঁধ ভেঙে দিয়েছে সেকান্দর। আর জাহেদের কাছেও বুঝি ওর মনের কথাটা স্পষ্ট হয় এতক্ষণে।

ওহে মাস্টার, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতছ তুমি। অসমানে কখনো প্রতিযোগিতা চলে? গ্রামগুলোর যেমন দেখছ, গ্রাম হাটবাজার সব কিছুর মালিক ওরা, তেমনি অবস্থা শহরেও, চাকরি বল, ব্যবসা বল–সবই তো ওদের খপ্পরে। সাধ্য আছে সেখানে দাঁত ফুটাও তুমি? নতুন পথ করে নেবে তুমি, সে সুবিধেই বা তোমায় দিচ্ছে কে? আর যতদিন সেই সুবিধেটা আদায় না করতে পাচ্ছে নিজের জন্য তদ্দিন ওই হাসমত মৃধা অমনিই থাকবে, এই বাকুলিয়ায় এমনি দৈন্যের হাহাকার ছাড়বে।

অতএব ফেলু মিঞা রমজান সবাইকে নিয়ে জমাত কর? কেমন ভেংচিয়ে উঠে মাস্টার।

আহ, জমাত তো করতেই হবে। সবাইকে নিয়েই করতে হবে। কাউকে বাদ দিলে চলবে না। কিন্তু সে জমাত তো একটা নীতিহীন সুবিধাবাদীর জোট নয়। তার থাকবে সুস্পষ্ট নীতি। সে নীতি হল স্বাধীন দেশে আমাদের স্বাধীন বিকাশ আর উন্নতির নিশ্চয়তা বিধান, তার জন্য সংগ্রাম। আমি ভেবে পাই না এই সহজ কথাটা বুঝছ না কেন? এবার অসহিষ্ণু নয় জাহেদ, যুক্তি আর ন্যায়নীতির আবেদন দিয়ে বোঝাতে চায় সেকান্দরকে।

ঘুরতে ঘুরতে ওরা পৌঁছে যায় গ্রামের উল্টো সীমানা সৈয়দবাড়ির দরজায়। আসবে না? দাঁড়িয়ে পড়ে শুধাল জাহেদ।

না। সন্ধ্যার পরই তো আসছি। বাড়ির পথ নেয় সেকান্দর।

আমার কথাগুলো আরো ভালো করে ভেবে দেখ কিন্তু। পেছন থেকে ভেসে আসে জাহেদের গলা।

কোনোদিনই তো চিন্তা ভাবনার অনুকূল ছিল না সেকান্দরের স্বভাবটা। সেই মজলিসের দিন থেকেই বুঝি রাজ্যের যত জটিলতা এসে ছেঁকে ধরছে ওকে আর সেই পথে চিন্তা। কিন্তু চৈতি হাওয়ায় উড়িয়ে আনা রাশি রাশি পাতার মতো এই যে ভাবনাগুলো এনে দিল জাহেদ তার কোনো আগা মাথা যেন খুঁজে পায় না ও। প্রশ্ন তুলেছে মুখে মুখে তর্কও করেছে। কিন্তু মনে? মনের ভেতর যে দ্বন্দ্বের দোলা দিয়ে গেল জাহেদ তার মীমাংসা কী অত সহজ?

লেকুর বাড়ির পাশে এসে থমকে দাঁড়ায় সেকান্দর। চিঁ চিঁ করে কাঁদছে ওর মেয়েটা। আম্বরির খেঁকান গলাটা ভেসে আসছে–খালি খাই খাই। পেটে যেন দোজখের আগুন লেগেছে! কাল তো গিলেছিস এক খোরা ভাত। তবু চিল্লাস? সঙ্গে সঙ্গে ধুপ ধুপ করে বুঝি কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয় আম্বরি। হঠাৎ কিল খেয়ে একবার থ মেরে যায় মেয়েটি, চিঁ চিঁ কান্নাটা যায় থেমে। তার পরই তারস্বরে কান্না জুড়ে অবুঝ মেয়ে। ক্ষিধের উত্তর কিল, এতটা হয়ত সইতে পারে না ও।

যা না তোর বাপের ঠাউয়ের কাছে। বাপ তো চলেছে কবরে। ভুনির কান্নাকেও ছাড়িয়ে যায় আম্বরির গলা।

কথাটা হয়ত সেকান্দরকে উদ্দেশ্য করে নয়, তবু মাটির সাথে মিইয়ে যায় ও। খেজুর পাতার দরজাটা ঠেলে ও আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়, ডাক দেয়–ভুনি শুনে যা।

ঘোমটা তুলে বেরিয়ে আসে আম্বরি। আঁচল দিয়ে পরিষ্কার করে পিঁড়িটা পেতে দেয় দাওয়ায়। আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভুনিও বেরিয়ে আসে।

লেকু কোথায়?

ঘুমায়।

এই অবেলায় ঘুম? থাক থাক ডাকতে হবে না। চল ভুনি।

ভুনির হাতখানা ধরে বেরিয়ে আসে সেকান্দর। দরজার এ পারে এসে আম্বরিকে উদ্দেশ্য করেই বলল : ঘরে চাল নেই, খবর পাঠাতে হয় না? ভুনির হাতে সের দুই চাল পাঠাচ্ছি। কাল আসব আবার।

রাস্তায় পড়ে কেন যেন একটি প্রশ্নই জাগল ওর মনে। জাহেদ কী ভাবে ওদের কথা? যতটুকু বলে ও তার মাঝে সত্যই বা কতটুকু?

১৯.

ঝড় বইয়ে দিল জাহেদ।

মিটিং বক্তৃতার তুফান ছুটিয়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনায় মাতিয়ে তুলল মানুষগুলোক।

অন্ন নেই বস্ত্র নেই মর্যাদা নেই, এর নাম কী বাঁচা? কামালের তুর্কি জগলুলের মিসর বোখারা-সমরকন্দ, বোগদাদ-দামেস্ক সর্বত্র মানুষের বুকে নতুন বল নতুন জাগরণ। সারা মুসলিম জাহান জাগছে। স্বাধীনতার উত্তাল তরঙ্গে ফুঁসে উঠেছে নীল নদ, ফোরাত-তাইগ্রীসের তীরে তীরে জেহাদের ডাক। ভারতের দশ কোটি মুসলমান কী ঘুমিয়ে থাকবে? কাফের বিদেশি ইংরেজের হুকুমত আর কতদিন বরদাস্ত করবে ওরা?

কথা তো নয় যেন আগুনের ফুলকি আর মানুষের মুখে মুখে সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, ঘর থেকে ঘরে। আগুনের আঁচ পেয়ে সহসা বুঝি জেগে উঠে ঘুমন্ত মানুষ। ঝড়ের মতো গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ায় জাহেদ।

গাঁয়ের মানুষ মসজিদের সুমুখে বসে তর্কের অছিলায় একটু গরম হয় ওরা। সেও কালে ভদ্রে। সহজে যেমন বিশ্বাস করে না ওরা তেমনি সহজে রা বের হয় না ওদের মুখ দিয়ে। হুজুগ হাঙ্গামাকে বাপদাদার পরামর্শ মতো দূরে রেখেই চলে ওরা। কিন্তু মনের বাতাসটা যখন দোলা দিয়ে ওঠে, ওরা, তখন কালবৈশাখী, কোনো বাধা মানে না ওরা। এমনিতে ঠাণ্ডা রক্ত কিন্তু সে রক্ত যখন চনচনিয়ে গরম হয়ে ওঠে ওরা তখন বেদিশা।

সেই ঠাণ্ডা রক্তের মানুষগুলো মেতে উঠল কী এক উন্মাদনায়। মেতে উঠল ফজর আলি। মেতে উঠল মৃধা বাড়ির সেই রহমত বুড়োও। গরুর গাড়িটা নিয়ে জাহেদের সাথে সাথে সেও পাড়ি দেয় এ গাঁ সে গাঁ। দুর্বল লেকু সেও বসে থাকতে পারে না ঘরে। দূরে যেতে পারে না ও। কিন্তু মসজিদে আর জাহেদের বাড়ির বৈঠকে হাজিরা না দিয়ে থাকতে পারে না। উরুর জখমিটাই ওর সারছে না, পাটা সোজা করতে পারে না। তাই একটা লাঠি নিয়েছে ও। সেই লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে চলে আসে সৈয়দ বাড়ি। সেকান্দরও থাকতে পারল না এই উত্তেজনার বাইরে। দুর্বার এক স্রোতের টান ওকে যেন ভাসিয়ে নিল। জাহেদের সাথেই হাটে বাজারে ঘুরল, বক্তৃতা দিল, চাঁদা তুলল। আর এমনি করে বাকুলিয়ার বাইরে আরো কত সমস্যার সাথে জড়িয়ে পড়ল, মাকড়সা যেমন জড়িয়ে পড়ে আপনার তৈরি জালে। কিন্তু, এত উত্তেজনার মাঝেও নিজের সেই ছোট স্বপ্নটুকু স্তিমিত হতে দিল না ও, মানুষ করবে ছোট ভাইটিকে। তাই এ-গাঁ ঘুরে এসেও সুলতানের পড়া নেয়, বসে থাকে পাশে যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে পড়ে ছেলেটা।

থাক। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। তুমিও ভুলে যাও সব; রমজানকেও মাফ করে দাও। সেকান্দরের দিকে চেয়ে বলল ফেলু মিঞা।

হাত কচলিয়ে এগিয়ে আসে রমজান। সেও আপস চায়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ সেকান্দর। মিটিয়ে ফেল, এসব ঝগড়া বিবাদ এখন ভুলে যেতে হবে। ওদের কথায় সায় দেয় জাহেদ।

ঝগড়া কী বলছ? এ তো স্রেফ হার্মাদি, ডাকাতি, অন্যায়, জুলুম। এর বিচার হবে না? ঝাঁঝিয়ে ওঠে সেকান্দর।

অন্যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু ভাই, এসবের বিচার যে মুলতবি রাখতে হবে আমাদের। আজাদীর মনজিলে না পৌঁছে এ সবের কোনো মীমাংসা আছে বল? চটে যায় না জাহেদ। শান্তভাবেই বোঝাতে চায় ওকে।

তাই বলে একটা কী দুটো লোক যা খুশি তাই করে বেড়াবে? আর গোটা গ্রামকে সেটা সয়ে যেতে হবে? এ তোমার কী ধরনের কথা আমি বুঝি না। স্বরটা এবার উঁচুতে উঠে যায় সেকান্দরের।

ওহ্ তুমি এখনো বুঝছ না সেকান্দর। কার একটা ভিটি গেল, কার এক টুকরো জমি বেহাত হল সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন? তা ছাড়া একলা তুমি, কার কয়টা সমস্যার সমাধান করবে বল তো? সমস্যা কী একা লেকুর, একা ফজর আলির? সব সমস্যার যে মূল সে মূলেই তো হাত দিয়েছি আমরা। এবার বুঝি অসহিষ্ণুতায় জাহেদের গলাটাও উঁচুতে উঠে আসে।

বেশ, তুমি যা ভালো বোঝ কর। হাল ছেড়ে দেয় সেকান্দর।

আমি দারোগাকে খবর দিয়ে দিয়েছি। এসে পড়ল বলে। মামলাগুলো তুলে নেওয়া হবে। কী বল? মওকা বুঝে সার কথাটা ছেড়ে দেয় ফেলু মিঞা।

হ্যাঁ, তাই করুন। কথাটা বলে আর বসল না জাহেদ। সেকান্দরের হাত ধরে ফেলু মিঞার কাচারি ছেড়ে নেমে এল দহলিজে। চল, মেলা কাজ পড়ে রয়েছে। হুরমতির ছেলেটাকে কবর দিয়ে আবার যেতে হবে সুলতানপুর। হাঁটতে হাঁটতে বলল জাহেদুর।

নিরুত্তর সেকান্দর। ও ভাবছে, কী বলবে লেকুকে। সেদিন সেকান্দরকে না বলে, কারো সাথে কোনো পরামর্শ না করে লেকু জমি রেহান দিয়ে ফেলু মিঞার বকেয়া খাজনা শোধ দিয়েছিল বলে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেকান্দর। আর আজ? লেকুর কাছে কী অর্থ এই আপসের? থলথলে সেই স্বাস্থ্যটা কী ওকে ফিরিয়ে দিতে পারবে কেউ? নাকি মুছিয়ে দিতে পারবে ওর গা ভরা সেই দায়ের কোপগুলো?

যে যারবা শিশুটিকে নিয়ে এত দুর্ভোগ হুরমতির, তার জন্য এত কান্না? গতকাল সেই সাঁঝ রাতে মরে গেছে ওর বাচ্চাটা। সেই থেকে বাচ্চা ছেলেটিকে আগলে ধরে কাঁদছে হুরমতি। লাঠিটা পায়ের তলায় রেখে বেলগাছে হেলান দিয়ে আঙ্গিনায় বসে আছে লেকু। কী যে করবে সেও যেন ভেবে উঠতে পারছে না।

হুরমতির নাকি ইচ্ছে মোল্লা আসুক, কারি আসুক। কারি অথবা খতিব সাহেব নিজের হাতেই মুর্দাকে গোসল করিয়ে দিক। একটু দোয়া দুরুদ পড়ুক। তার জন্য যা পয়সা দেবার রেওয়াজ তার চেয়ে বেশিই খরচ করবে হুরমতি। কিন্তু কে আসবে ওর ডাকে? ও তো একঘরে। ওর পাপের সন্তানকে কোন্ মোল্লা গোসল করাবে? কেউ রাজি হয়নি। লেকু, আম্বরি কত বার গেছে ঘরের ভেতর। বলেছে, দাও গোসল টোসল করিয়ে রাখি, মাস্টার এলেই দাফন করতে নিয়ে যাবে। কিন্তু মুর্দাকে ছুঁতেও দেয় না হুরমতি। হটিয়ে দিয়েছে ওদের। রাবু এসেছিল সকাল বেলায়। ওর কথায়ও কান দেয়নি হুরমতি।

দে তো হুরমতি, ওকে আমার কোলে দে। জাহেদ ওর সম্মতির জন্য অপেক্ষা করে না। মরা ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আসে উঠোনে। কোলের উপর রেখেই ওকে গোসল করায় জাহেদ। সেকান্দর ঘড়া ধরে পানি ঢালে আস্তে আস্তে।

দেখেছ। কী নাদুস নুদুস বাচ্চাটা কেমন টকটকে গায়ের রং! পানি ঢালতে ঢালতে বলে সেকান্দর।

হ্যাঁ, ছোট বেলায় আমিও নাকি এ রকম ছিলাম, আম্মার মুখে শুনেছি। দেখ দেখ, নাক চোখ গোটা মুখের আদলটা যেন আমার সাথেই মিলে যায়। শুকনা গামছা দিয়ে মরা ছেলেটির গায়ের পানি মুছতে মুছতে বলে জাহেদ। কী ইঙ্গিত করছে জাহেদ সেটা বোঝে সেকান্দর। কিন্তু বুঝেও চুপ করে থাকে সেকান্দর, কেননা এ ধরনের রসিকতায় অভ্যস্ত নয় ও।

কবর খুঁড়ে অপেক্ষা করছিল ফজর আলি।

বাচ্চাটাকে কবরের শয্যায় শুইয়ে দিয়ে বলল জাহেদ : যাক একদিক দিয়ে রেহাই পেল হুরমতি।

ছোট্ট একটা হু বলে নীরবে মাটি ফেলে যায় সেকান্দর।

কার ছেলেকে কবর দিয়ে এলে মাস্টার? ফিরবার পথে হঠাৎ শুধাল জাহেদ।

কেন, রমজানের? হুরমতি নাকি তাই বলে।

ফেলু মামার নয় তো? কে জানে!

কিছু দূর এসে রাস্তাটা দুখান হয়ে যায়। জাহেদকে বিদায় দিয়ে বাঁ-মুখী হয় সেকান্দর। ওর পেছনে লেকু আর ফজর আলি।

ওরা আপস চায়। তাই আপসই করে ফেললাম। দুদিকের মামলাই তুলে নেয়া হবে। কী বল? হঠাৎ লেকুর দিকে ফিরে বলল সেকান্দর। কী বলবে লেকু! কোনো অর্থ হয় না ওকে জিজ্ঞেস করার। কেননা কথা তো দিয়েই দিয়েছে সেকান্দর। তবু যেন ওর মতামতের উপরই নির্ভর করছে সব কিছু তেমনি ভাবে লেকুর মুখের দিকে চেয়ে রইল সেকান্দর।

কিছুই বলল না লেকু। চোখ জোড়া ওর পথের উপর স্থির। যেন পথটাকেই শুধু দেখছে ও। আর লাঠিতে ভর দিয়ে ডান পাটাকে একটু টেনে টেনে চলেছে ও। আরও কাছে এসে সেকান্দর যেন তন্ন তন্ন করে জরিপ করল ওর মুখটা। আশ্চর্য হয় সেকান্দর। লেকুর মুখে কোনো ভাব নেই, ভাষা নেই। বাড়ির কাছটিতে এসে একবার চোখ তুলে ও দেখল সেকান্দর মাস্টারকে। সে চোখে রাগ নয়, ক্ষোভ নয়, কেমন যেন ভর্ৎসনা। তারপর খেজুর পাতার দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যায় লেকু। লাঠিটা চাঙের উপর ছুঁড়ে রেখে সটান শুয়ে পড়ে চৌকিতে।

এই চৌকিটার গায়ে বিচিত্র এক গন্ধ। মৃত পিতার সেই বার্ধক্যের আর ওর নিজের কৈশোরের গন্ধ যেন। সে গন্ধের সাথে লেপা মাটি, তেলচিটে বালিশ, আম্বরির সেলাই করা কাঁথা, আম্বরির গায়ের গন্ধ, সব মিলে এমন এক বাস যাকে কিছুতেই সুবাস বলা চলে না। তবু উপুড় হয়ে শুয়ে জাম কাঠের গায়ে এক আস্তর চিটচিটে ময়লা জড়ানো আর ভুনির কত পেচ্ছাব গড়িয়ে যাওয়া সেই প্রাচীন চৌকিটার সাথে মধুর এক আত্মীয়তা অনুভব করে লেকু। আর সব গন্ধ মিলিয়ে সেই যে এক বিচিত্র গন্ধ, নাক ভরে সে গন্ধ টানে লেকু।

শরীরে বল আছে, মনেও যেন জোর পাচ্ছে লেকু। আজ তো গোটা সকাল আর এই দুপুর অবধি একবারও শোবার কথা ভাবেনি ও। হ্যাঁ, ওর মনে পড়ছে, জাহেদ সাহেবের কথা–সুদিন আসছে, সুদিন আসবেই–সে কথাগুলো শোনার পর থেকেই একটু একটু করে যেন শক্তি পাচ্ছে ও।

সেই সুদিনের কথাটা যেদিন থেকে গেঁথে গেছে ওর মনে সেদিন থেকে উরুর ওই ব্যথাটাও যেন ভুলে গেছে ও। ভুলে গেছে অনেক কিছু। সেই রাগ, সেই আক্রোশ রমজানের বিরুদ্ধে, ফেলু মিঞার বিরুদ্ধে, তেমন করে যেন উন্মাদ করে না ওকে। ওর সেই সুদিনের স্বপ্নের কাছে ওরা যেন কিছুই না, ওদের গ্রাহ্য করে না লেকু।

ও ভাবে, থলথলে সেই শরীরখানি আর সেই তাকত, সে ফিরে পাবেই। আবার সে পাহাড়ে যাবে, বাঁশ কাটবে, ছন কাটবে। একটার পর একটা এমনি করে বারটা কী ষোলটা বাঁশ দিয়ে শক্ত করে বাঁশের ভেলা বাঁধবে। সে ভেলায় চাপিয়ে দেবে ছনের আঁটিগুলো, নিজেও চেপে বসবে। বাঁশের ভেলা ভাসিয়ে দেবে নদীর বানে। সেই বাঁশ আর ছনের সম্পদ এসে ভিড়বে তালতলির হাটে। নগদ পয়সা আসবে লেকুর হাতে। পয়লা কিস্তির টাকা দিয়েই একটা রাঙ্গা শাড়ি কিনবে আম্বরির জন্য। তারপর বর্ষা নামবার আগেই চলে যাবে দক্ষিণে ধান কাটতে, বদলা খাটতে। কার্তিকে যদি না গিয়ে পারে তবে যাবে না কোথাও, বাড়িতেই থাকবে। আর ওই জমিগুলো? সে তো ফিরে পাবেই। সুদিনে সে সব কী আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? ভালোই হল। রমজানের দার কোপ খেয়ে শরীরটা জখমী হয়েছিল বলেই তো বন্ধ হল বিদেশ যাওয়া।

আঃ। বোঁজা চোখে তার মাঝেও বুঝতে পারে লেকু, জোর আসছে ওর বুকে, ওর মনে। তাকত আসছে ফিরে, শক্তি আসছে ধমনীতে। আবার সেই জোয়ান মরদের থলথলে শরীরটা যখন চলবে–মাটি কাঁপবে, থর থর করে মাটি কাঁপবে।

লেকু ঘুমিয়ে পড়ে।

২০.

স্কুল। গান। নতুন নতুন বইখাতা। কত যে খুশি। বাকুলিয়ার মালু, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা মালু, এত খুশি কোথায় ধরে রাখবে ও?

এত খুশির খবর পেয়ে আপনাদের কথাও যেন খেয়াল থাকে না ওর। খেয়াল থাকে না রানুদি যে বলে দিয়েছে–রোজ টিফিনের ঘণ্টায় জলখাবার খেয়ে যাবি। আর সেই বড় হবার লজ্জা, গানের লজ্জা, সব লজ্জাই যেন চাপা পড়ে যায় এই খুশির তলায়।

কিন্তু এত খুশির মাঝেও কী যেন হয়ে গেল।

তালুর পেছন দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে মালু।

কী হলরে মালু? শুধায় মাস্টার সাহেব।

সহানুভূতির ছোঁয়া পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মালু।

আহা কী হয়েছে বল না। কাঁদছিস কেন? আবার শুধায় সেকান্দর মাস্টার।

ওই যতীন আমায় পয়লা বেঞ্চি থেকে তুলে দিয়েছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল মালু।

ভট্টচার্যি বাড়ির যতীন?

হা। বলে, ব্যাটা ম্লেচ্ছ ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিস কেন? ঠেলে দিল সেকেন্ড বেঞ্চে। উথলে উঠে মালুর কান্না। সার্টের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে শুধাল, ও মাস্টার সাহেব, ম্লেচ্ছ কাকে বলে? ম্লেচ্ছ শব্দটা এর আগে শোনেনি ও।

হো হো করে হেসে দেয় সেকান্দর মাস্টার। মানেই জানিস না। আর ফোঁপ ফোঁপ করে কাঁদছিস?

বা রে। আমাকে উঠিয়ে দিল যে! প্রথম বেঞ্চি থেকে উঠিয়ে দেয়ার মতো এত বড় অপমানটার মাঝে হাসির কী আছে বুঝতে পারে না মালু। আর একবার উথলে ওঠে মালুর কান্না।

আচ্ছা ঘণ্টাটা শেষ হলেই মাস্টারদের ঘরে আসবি তুই। আমি যতীনকে ডাকছি। সেখানেই ফয়সলা হবে। সেকান্দর মাস্টার চলে যায়।

কিন্তু, ঘণ্টার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না মালু। ওর ছোট্ট বুকটা যেন ভেঙে গেছে। ভয় বিস্ময় সম্ভ্রম মিলিয়ে ওর মনে যে স্কুলটির কল্পনা সে স্কুল যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে। এ স্কুলটি অন্য স্কুল যেখানে ওর কোনো আব্দার খাটে না।

শব্দটার অর্থ সে বোঝে না, কিন্তু যতীনের বলার ঢংয়ে আর ক্লাস শুদ্ধ ছেলেগুলোর বিদঘুঁটে হাসিতে বুঝে নিয়েছে মালু, ওটা একটা গালি ছাড়া আর কিছুই নয়। জায়গা থেকে জোর করে তুলে দিয়ে আবার একটা গালিও দিল ছেলেটা? অনেক দিন আগের সেই সুগ্রীবের কথাটা মনে পড়ল মালুর। নেড়ে না কী একটা শব্দ সেদিন বেরিয়েছিল সুগ্রীবের মুখ থেকে। কিন্তু সেদিন তো সেটা গালি বলে মনে হয়নি মালুর? মালুর সমস্ত রাগটা কেন যেন যতীনের পরিবর্তে স্কুলের উপরই এসে পড়ল। স্কুলটাই খারাপ। এই স্কুলে পড়বে না মালু।

আস্তে আস্তে বাকুলিয়ার দিকে পা বাড়ায় মালু।

রাসুদের বাড়ির কাছটিতে এসেই খুশি হয়ে ওঠে ও। কে যে কী বলেছে আর কখন যে কেঁদেছে ও সে যেন অনেক কাল আগেকার কথা।

সেই হাজামতো পুকুরটার পানি আরো কমে গেছে। পানির উপর থেকেই হাত দুয়েক নিচের পাঁক নজরে পড়ে। ঘাটের গুঁড়িতে পা ঠেকিয়ে এদিক ওদিক পলো ফেলছে রাসু। ঝপ ঝপ শব্দ তুলছে। আজও বুঝি মাছ ধরবার দরকার পড়েছে ওর।

শাড়িটা যেন রপতো হয়ে গেছে রাসুর। পরেছে গায়ের সাথে বেশ এটে সেঁটে। আঁচলটাকে প্যাঁচিয়ে এনে শক্ত করে কোমর বেঁধেছে। ওকে দেখে মালুর মনে পড়ে যায় তালতলির জেলে পাড়ার জালুনদের কথা। যখন মাছ ধরতে যায় তখন এমনি করে প্যাঁচিয়ে শাড়ি পরে ওরা। ছন্দ মিলিয়ে কথা বানায় মালু :

ও জালুনী
ঠেলা জালে যা ই বি?
বড় গাঙ্গে না ই বি?
সেই সাত পানির তলে
ঘাই মারে বোয়ালে,
জাল যে গেছে ঠেইক্যা
ডুব মারবি এইক্যা?

ও জালুনী
সাত নাইয়ের ঠাঁই
সেই গাঙ্গে যাই,
জাল টানমু হেঁইচকা
মাছ তুলমু ছেঁইক্যা
বিহান বাজার ধরমু
নুন মরিচ কিনমু,
ঘরে আবার ফিরমু।

সুর করে বলা কথাগুলো শেষ করতে পারে না মালু। পলো ছেড়ে রাসু কাদা তুলে নিয়েছে হাতে। সে কাদা ছুঁড়ে মেরেছে মালুর দিকে। জামাটা বুঝি নষ্টই হয়ে গেল মালুর।

চটেমটে থকথকে প্যাঁক ছুঁড়ে ওর জামাটা একসার করে দেবার মতো কী যে কারণ পেল রাসু বুঝতে পারে না মালু। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ও। জামাটার দশা দেখে রেগে উঠতে চায়। কিন্তু রাসুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঢিপ ঢিপ করে ওর বুকটা।

গোঁ গোঁ করে উঠে আসছে রাসু। ঘাটের গাছের গুঁড়িগুলোর উপর অযথা থপ থপ করে পা ফেলছে। রেগে বুঝি টং হয়েছে ও। গোসা করলি কেন রে? ওর পথ আগলে জিজ্ঞেস করল মালু।

জালুনী বললি কেন? যেন মহা অন্যায় করেছে মালু তেমনি রোষভরা চোখে তাকায় রাসু।

বা রে, জালুনী তো সুন্দর। ওই তোর মতো এঁটে শক্ত গিরো দিয়ে শাড়ি পরে ওরা। কত দেখি আমি বড় খালে। রাসুর ভুল ধারণাটা ভাঙাবার জন্য রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে ওঠে মালু।

বেয়াদব কোথাকার। ফের বলবি তো ঠুসিয়ে থুতনি ভেঙে দেব তোর। জালুনী না ছোটজাত?

মালু দেখল বলতে বলতে আরও লাল হয়ে উঠেছে রাসুর মুখখানা। অন্য দিনের মতো চিকন চাকন শরীরটাকে নাচিয়ে ছুট দিল না রাসু। পলোটাকে হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল বাড়ির দিকে।

ওর ব্যবহারে, ওর কথার ঢংয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় মালু। বোলে চলনে কেমন সেয়ানা ঢং। কেমন সেয়ানা রাগ।

মনটা আবার খারাপ হয়ে যায় মালুর। হঠাৎ স্কুলে যতীনের সাথে সেই ঝগড়ার কথাটাও মনে পড়ে গেল। পানিতে ভরে গেল মালুর দুটো চোখ। একটু আগেও কেঁদেছে ও। এখুনি আবার কান্না পেল। ছোট্ট বুকে কোথায় যে এত কান্নার বাসা আর একটুতেই কেন যে ঠেলে আসে সে কান্না, বুঝতে পারে না মালু।

জামাটা গা থেকে খুলে উল্টে নিল মালু। উল্টো দিকে মাটির দাগটা চোখে পড়ে না। জামাটা তা করে বইয়ের সাথে বগলে পুরে হাঁটা দিল।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবে মালু। ওদের মতো তো নয় মেজো ভাই? মালুর গান শোনার জন্য কত হাত বুলানো ওর পিঠে কত মিষ্টি কথার আদর মেজো ভাইয়ের। সেদিনের কথাটা মনে হতে আজও খুশিতে ফুলে ওঠে মালুর বুক।

ও যে গান করে, কথাটা কেমন করে যেন জেনে ফেলেছে জাহেদ। ওকে কাছে ডেকে বলল, তুই নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে গান করিস?

আমাদের একটা শোনা তো?

দুনিয়ার লজ্জা এসে ঘিরে ধরে মালুকে। ও বলে, না।

মিথ্যে কথা বলছিস? বলেছি না তোকে, মিথ্যে বলা অন্যায়?

তিরস্কার পেয়ে যেন এতটুকু হয়ে যায় মালু। কিন্তু, লজ্জাটা কেমন করে কাটাবে ও। রেলিঙে ঠেস দিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে রাবু আপা। বড় আপা তো যেন আকাশ থেকে পড়েছে। মালু বুঝতে পারে মুখটা তার লাল হয়ে উঠেছে, কান দুটো গরম হয়ে আসছে।

অত লজ্জা কিসের? গা। এবার নরম আদরমাখা স্বরে বলে জাহেদ। হাতের জোড়া তালু দিয়ে মুখটাকে বুঝি আড়াল করল মালু। চোখ বুজল। মরিবাঁচি করে গেয়ে ফেলল গণি বয়াতির মুখে শোনা একটি প্রেমের গান। চিরন্তন যে প্রেমের ধারায় সিঞ্চিত মানুষের মন, এ বুঝি তারই বন্দনা। জীবনের নিষ্ঠুর যাঁতাকলে পিষ্ট গাঁয়ের মানুষ যুগে যুগে যে প্রেমের স্বপ্ন দেখে, যে প্রেমের কল্পনা দিয়ে অভাব জর্জর জীবনের নগ্নতাকে ঢেকে দেয়, ভক্তির রসে সিক্ত হয়ে খুঁজে পেতে চায় বাঁচার কোনো অর্থ। স্মরণাতীত কাল থেকে বুঝি এই প্রেম-আকুলতাই সহনীয় করে রেখেছে ওদের দৈন্য ভরা নিরানন্দের দিনগুলোকে।

প্রথমে একটু আড়ষ্ট শোনায় মালুর স্বর। এক লাইন দু লাইন গেয়েই সহজ হয়, স্পষ্ট হয়। তার পর সুর ঝরে ওর কচি কণ্ঠে।

শোনরে আশেকগণ
প্রেমেরই বিধান
প্রেম বিনা বেহেশতো নসিব
না হয় মন।

প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
যে না জানে প্রেমের মরমো
তার সনে প্রেম কইরো না।
আহা প্রেমের মরা জলে ডুবে না।

চণ্ডীদাশ আর রজকিনী
তারা যে প্রেমের শিরোমণি-গো
আরো বারো বছর বাইলো বরশি
তবু আদার গিলে না
আহা এমন প্রেমিক কয়জনা
প্রেমের মরা জলে ডুবে না।

গণি বয়াতির গানটা অনেক লম্বা। লাইলি মজনু ইয়সুফ নবী আর জোলেখা বিবি আরো কত কিস্সার বয়ান আছে গণি বয়াতির গানে। কিন্তু মালু এটুকু গেয়েই থেমেছিল।

সাবাশ সাবাশ, মালুকে বুকের কাছে টেনে এনেছিল জাহেদ।

আর রাবু আপা ওর চিবুকটা তুলে ধরে বলেছিল, বাহ্ খাসা গলা তো তোর। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলি?

ইস্ রাসু যদি দেখত সে সব! রাসুর অকারণ গোসাটার কথা মনে পড়ে আবারও বড় খারাপ লাগে মালুর।

কিন্তু জাহেদকে সেদিন গান শুনিয়ে কী যে বিপদে পড়েছে মালু। তক্ষুণি তক্ষুণি ওকে নিয়ে বসে পড়ল জাহেদ। যেন স্কুলের সবক দিয়ে যথেষ্ট হচ্ছে না, গানেরও সবক দিতে হবে।

শোন্ মালু, ওসব গান বাদ দে তুই। আমি তোকে নতুন গান শেখাব।

বাহ্ মেজো ভাই গানও শেখাবে? মালু তো আহ্লাদে আটখানা। ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল ও।

কিন্তু আসল কাজে আসবার আগে কত যে বক্তৃতা ভনিতা মেজো ভাইয়ের। সে এক জ্বালা আর কী। এক বর্ণ না বুঝেও শুনে গিয়েছিলো মালু : নতুন গান তোর ওই প্রেমের গান নয়। নতুন গানে থাকবে তলোয়ারের মতো ধার, বিদ্যুতের মতো ঝিলিক আর বজ্রের মতো হুংকার। সে গানে ঘুম ভাঙবে মানুষের জড়তা কাটবে, জেগে উঠবে মানুষ। সে আবার কী? মালুর চক্ষু চড়কগাছ।

তারপর নিজেই গেয়ে গেছিল জাহেদ। চলরে চল–ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল… আর সেই “শিকল পূজার পাষাণ বেদী…কারার ওই লৌহ কপাট…” গানগুলো গেয়ে আবার এক ছোট বক্তৃতা দিয়েছিল জাহেদ।

নজরুলের গান। জেহাদের গান, জেহাদী সুর। সেই রক্ত টগবগান সুরে প্রলয় নাচন তুলবি মানুষের বুকে, মানুষের রক্ত কোষে, শিরায় শিরায়। মালুকে এই নতুন গানগুলো শিখিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি জাহেদ, মিটিংয়ে সভায় নিয়ে গেছে ওকে। হাজার হাজার মানুষের সুমুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছে–নে গলা ছেড়ে গা।

মালুর ছোট্ট মন অভিভূত হয়েছে এই নতুন সুরের দমকে। কোনো অগ্নিঝলকে ওর কচি শিরাগুলো গানের সাথে জ্বলে উঠে, সুরের সাথে তাল মিলিয়ে টন টন করে বেজে উঠে ওর ভেতরটা। ওর রক্তেও যেন প্রলয় ডাকে, জেহাদী সুরে কী এক নাচন জাগে ওর শিরায় শিরায়। বেসুমার লোক। ওর গান শুনে হাততালি আর বাহবায় ফেটে পড়ে মানুষগুলো। সাবাস জিতা রহো, ওর পিঠ চাপড়ায় জাহেদ। সেই থেকে মালু তো প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরে আসছে জাহেদের সাথে। আর তা নিয়ে সেকান্দর মাস্টার আর জাহেদের কথা কাটাকাটির অন্ত নেই।

এতে স্বভাব নষ্ট হবে, পড়া শোনারও ক্ষতি হচ্ছে ওর–বলে সেকান্দর।

 পড়ার একটু ক্ষতি হবে বৈ কী? তা পুষিয়ে নেবে মালু। তাই না রে? সেকান্দরের কথাটা গায়ে না মেখে যেন মালুরই সম্মতি চায় জাহেদ।

মেজো ভাইয়ের ডাকে মালু তো হরদম এক পা। ঘাড় নেড়ে সায় দেয় ও। মাস্টার সাহেব যেন কী! গান গাইলে স্বভাব নষ্ট হয়, এ কোন ধারা কথা? মাস্টার সাহেবের কথাগুলো একটুও পছন্দ হয় না মালুর। কত লোক। কাতারে কাতারে। সবগুলো চোখ চেয়ে থাকে মালুর দিকে। মালুর সুরে ওদের রক্তও বুঝি নেচে ওঠে। ইস্ একদিন যদি দেখত রাসু। তা হলে অমন করে নাক সিঁটকাতে পারত? বলতে পারত বেয়াদব? তাই সই। মালু যদি বেয়াদবই হয় তবে আর কোনো দিনই মালু যাবে না ওদের বাড়িতে। আর যদি বা যায়ই হাজার তোষামোদ করলেও রাসুর সাথে কখনও কথা বলবে না মালু। আর কথা দু একটা যদিই বা বলে গান আর শোনাচ্ছে না মালু। এটা মালুর কসম।

রাসুকে এমন কঠিন শাস্তি দিতে দিতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছে মালু, সেটা খেয়াল পড়েনি। খেয়াল হল জাহেদের ডাকে : জামা লুঙ্গি গামছা সব পরিষ্কার করে রাখ মালু। আসছে কাল বিকেলেই সাম্পান ধরব। এবার যেতে হবে অনেক দূরে।

কাদা ভরা জামা আর বইগুলো টেবিলের উপর রেখে ছুটে যায় মালু। অনেক দূর? কত দূর মেজো ভাই?

এ হাট থেকে সে হাট। এ বাজার থেকে সে বাজার। সাম্পান কুলে ভিড়ে। ওরা উঠে যায় পাড়ে। জাহেদ, সেকান্দর মাস্টার ফেলু মিঞা বক্তৃতা দেয়। মালু গান করে। আবার সাম্পান ছাড়ে। আর এক হাটে গিয়ে ভিড়ে। মাঝে মাঝে রমজানও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। কত কিছু দেখে মালু। নতুন নদী, নতুন নতুন গাঙ, খাল। নতুন জায়গা। দুনিয়াটা যে এত বড় কোনো দিন ভাবতে পেরেছিল মালু? সাম্পানে চড়ে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় মালুর, ওর ভেতরে ভেতরে কে যেন সাধারণ গান গেয়ে চলেছে। সে গানের বিরাম নেই, যতি নেই। ঘুমের মাঝেও সে গান যেন গুন গুন করে বাজে। মালু ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না সে গানের সুর।

সাম্পান তীরে বেঁধে কখনো বা ওদের হেঁটে যেতে হয় অনেক দূর। হাঁটতে হাঁটতেও নিজের ভেতর সেই নিঃশব্দ তান শুতে পায় মালু, বুকটা যেন ওর ভরে যায় কথায়, সুরে গানে। কত যে কথা। কত যে সুর। সবটার হদিস করতে গিয়ে মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায় মালুর। এইটুকু বয়সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ওর কৈশোরটা যেন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে জানা অজানা অনেক কিছুকে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু ছোট্ট সে হাতের বেড়ি, সামান্য তার শক্তি তাই সবটাকে ধরে রাখতে পারছে না ও।

এই তো খাসা খুলেছে তোর গলা। ইস্পাতের ধার, বজ্রের ডাক অগ্নিবীণার ঝংকার এই তো আসল সুর। প্রাণ মাতানো জীবন জাগানো সুর। মালুর পিঠ চাপড়ে উচ্ছ্বসিত হয় জাহেদ। ঠিক এই সময়টিতেই মালুর মনে পড়ে যায় রাসু আর রাবু আপার কথা। রানুদির কথাও।

কেমন যে দেমাক দেখায় রাসুটা। অথচ ঠিক তার উল্টো রাবু। মুচকি মুচকি হাসে রাবু আর বলে, তুই বুঝি শেষ পর্যন্ত গায়েন হবি রে? তার পরই হয়ত বলে বসল রাবু, শোনা তো একটা নতুন কিছু। সেই মুহূর্তেই হয়ত প্রস্তুত নয় মালু। না করে বসল ও। আর যায় কোথায়, অমনি রাবু বলবে বেশ আমিও বলে দিচ্ছি মুনশীজীকে।

মুন্‌শীজী অর্থাৎ মালুর আব্বাকে জানানোর অর্থ তো ভয়াবহ। প্রথমেই বেত্রাঘাত, অতঃপর যে কী, ভাবতেও গাটা বরফ হয়ে যায় মালুর। মালুকে যে মৌলভী বানাবেন এ আশা এখনো ছাড়েননি তিনি। তাই যে দু চারদিন জাহেদের সাথে বাইরে কাটায় সে কয়টা দিন বাদ দিয়ে সকাল বেলার আরবী ফারসী সবকের জ্বালাতনটা নিত্যদিন সয়ে যেতে হচ্ছে মালুকে। মুচকি মুচকি হেসে মজা দেখে রাবু। শেষ পর্যন্ত গান শুনিয়ে তবে রেহাই পায় মালু।

কেমন করে যেন রানুর কানেও পৌঁছে গেছে খবরটা। ভারি খুশি রানু। বলেছে, আসিস হারমোনিয়ামটা শিখিয়ে দেব তোকে। ভালো কথা। দু একদিন গিয়ে যন্ত্রটা যে টিপে টুপে দেখেনি মালু তা নয়। কিন্তু কেমন যেন ওটা ধাতে আসে না মালুর। তাছাড়া বসে বসে প্যাঁপু করার সময়ই বা কোথায় তার? দুদিনেই হারমোনিয়ামের উৎসাহে ভাটা পড়ে গেছিল মালুর।

কিন্তু সেদিন অমন গম্ভীর হয়ে গেছিল কেন রানু? অমন রূঢ় আর কর্কশ গলায় ধমকেই বা দিল কেন মালুকে?

জাহেদের সাথে সফরে বেরুবার দিন। টিফিনের ঘণ্টায় রানুদের বাড়ি গেছিল মালু। প্রথম কথায়ই শুধিয়েছিল মালু : আচ্ছা রানুদি ম্লেচ্ছটা কী গাল?

কে বলেছে? গম্ভীর হয়ে শুধিয়েছিল রানু।

ওই ভট্টচায্যিদের ছেলে যতীন। রানুর অকারণ গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়েই বলেছিল মালু।

ওসব পাজী ছেলেদের থেকে দূরে থাকলেই পারিস? ওদের সাথে গা ঢলাঢলি করলে কী চলে না তোর?

শোন রানুদির কথা। এক ক্লাসে পড়ে, পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসে আবার দূরে থাকা যায় কেমন করে?

আচ্ছা, মালু, না হয় দূরেই থাকলো। কিন্তু অমন করে খেঁকিয়ে উঠবার কী কারণ ঘটল রানুদির? সভা সমিতি বক্তৃতার এত হুল্লোড় আর ওর মনের ভেতর এত যে গানের উত্তেজনা, তার মাঝেও কথাটা মনে পড়ে মালুর। রানুদির সেই গম্ভীর মুখখানি যেন উড়ে উড়ে চলেছে ওর পাশে পাশে।

নদী ছেড়ে গাঙ্গ, এ গাঙ্গ সে গাঙ্গ ঘুরে আবার উল্টোমুখী হয় ওরা। চাটখিলে এসে নেমে পড়ে জাহেদ আর সেকান্দর মাস্টার।

এখানে তোর দরকার নেই। আমরা হেঁটে হেঁটে কয়েকটা বাড়ি ঘুরনী দিয়ে চলে আসছি। তুই যা।

জাহেদের কথা মতো সাম্পানে চড়ে একলাই ফিরে এল মালু। বড় খালে সামপানটাকে বিদায় দিয়ে কোনাকুনি দখিন ক্ষেতটা পেরিয়ে এল। মিঞাদের সুপরি বাগানটা আড়াআড়ি কেটে ভুঁইঞা বাড়ির পাটিপাতার বাগানটা দু ফাঁক করে একটু ডান ঘেঁষে রাসুদের বাড়ির পেছনের সেই না-ডোবা না-পুকুরটির পাড়ে উঠে আসে মালু। রাসুদের সীমানা পার হলেই পর পর সৈয়দদের কয়েকটা গড়। সে গড়গুলোর পর সৈয়দ বাড়ির অন্দর মহলের পাড়-উঁচু পুকুর। সেদিকেই পা বাড়ায় মালু। কিন্তু পা-টা একটু খানি উঠেই থমকে থাকে, মাটিতে পড়ে না। ওর কানে আসছে :

মালু বয়াতি! মালু বয়াতি!
যাও কই?
উধমপুর।
রান্ধ কী?
কইতরের ঠ্যাং।
খাও কী?
কচুর শাক!

রাসুর গলা। একটুও ভুল নেই তাতে। পশ্চিমের পাড়টা কচুর জঙ্গলে ভরে গেছে। সেখানে লতি তুলছে রাসু। মাথাটা একবার উঁচু করেই একটা বড় রকমের কচু গাছের আড়াল নিয়ে বসে পড়ে রাসু।

মুহূর্তে কয়েকদিন আগের কসমটি ভুলে গেল মালু। এক দৌড়ে রাসুকে ধরে ফেলল। হাতটি ধরে ঝটকা টানে নিয়ে এল কচু পাতার জঙ্গলের বাইরে। একটুও বাধা দিল না রাসু। পথের ধারে পড়ে থাকা ঝুমকো লতার মতোই মালুর হাতের সাথে প্যাঁচিয়ে চলে এল ও। একটু ফর্সা জায়গা দেখে বসে পড়ল ওরা। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মালু যেন বোকা বনে যায়। মিঞাদের বড় পুকুরটার অথৈ জলের মতো কেমন শান্ত আর গভীর রাসুর চোখ। এমন চোখ আগে কখনো দেখেনি মালু। এতদিন কোথায় ছিল রাসুর এই চোখ?

ছাড়, বলে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাসু। আর হাসে ও, যে হাসিটা সেই শাড়ি পরার দিন থেকেই জায়গা পেয়েছে রাসুর ঠোঁটের কোণে।

একি হল মালুর? কথা বানিয়ে সে সুর দেয়। কথা তার গান হয়ে বাতাসে ভাসে। সেই মালুর সব কথা গুলিয়ে যায়! এমনটি তো কোনোদিন হয়নি মালুর? অথচ কত কথাই তো শোনাবার রয়েছে রাসুকে। মালুকে সত্যি সত্যি বোকা বানিয়ে আরও একবার হাসল রাসু। দুষ্টুমির রেশ নেই, কেমন বাঁকা টানের আলাদা কিসিমের হাসি। অনেক বড় হয়ে গেছে রাসু। রাসু সবই বোঝে সবই জানে। ওই হাসিতে আর একটু রাংগা মুখের আদলে সে কথাই তো লেখা আছে। কিন্তু মালু রয়াতি, যতই গান জানুক সে, রাংগা মুখ আর চোখের ঠারে ফুটে ওঠে যে সব কথা, সে সব কথার যে কী জবাব, সে তো শেখা নেই তার।

মিঞা পুকুরের অথৈ জলের মতো শান্ত আর গভীর চোখ জোড়া রাসু সোজা তুলে ধরল মালুর দিকে। ওর মুখে সেই সেয়ানা হাসিটা যেন এখন ঠাঁই নিয়েছে ওর চোখের ক্ষেতে। হেসে খেলে যেন নেচে উঠল সেই শান্ত চোখ। ছড়ার মিলে বলল রাসু :

ইস মুরোদ নাই দুই আনা
বউ চাই সেয়ানা?

এতক্ষণ কথা আসেনি মুখে, এবার মাথাটাও বুঝি গুলিয়ে গেল মালুর। এর পর আর এক অবাক কাণ্ড করল রাসু। হঠাৎ মুখখানি গুঁজে দিল মালুর কোলে। নিথর পড়ে থাকল যেন ঘুমিয়ে গেছে।

কোলের উপর রাখা মালুর হাতখানি রাসুর বুকের তলার ত্রস্ত্র শালিকের ডানার মতো কেঁপে উঠল। সে কাঁপুনিটা যেন আচমকা ঝিলিক তুলে ছড়িয়ে পড়ল ওর গোটা শরীরে। অবাক! অবাক মানে মালু। এমন করে তো কোনোদিন কাঁপেনি ও? তারপর ওর মনে হল কোত্থেকে যেন এক দমক গরম হাওয়া ছুটে এল। সে হাওয়ার আঁচ লেগে যেন পুড়ে গেল ওর মুখ, গলা, হাত, ওর সমস্ত শরীর।

রাসুর খোঁপায় এক জোড়া কদম ফুল। কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো কেমন উদাসীন আলসেমিতে পড়ে থাকা খোঁপার দুধারে ঝুলে রয়েছে ফুলগুলো। আস্তে করে নাকটা ওর খোঁপার চুলে ডুবিয়ে দিল মালু। কদমের গন্ধ আর ওর চুলের খোসবু টানল বুক ভরে। যেন ফিসফিসিয়ে বলতে চাইল মালু : মুরোদ আমার আছে রে, মিছে ভয় পাচ্ছিস তুই। আচমকা উঠে দাঁড়ায় রাসু। মালুর হাত দুটো অকারণ জোরে ছুঁড়ে দেয়। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে, যেন দারুণ অপমানিত হয়েছে ও। মালু দেখল অথৈ পানির শান্ত গভীরতা হারিয়ে চোখ দুটো রাসুর জোনাকির মতো জ্বলে উঠেছে।

কী আমার মুরোদ রে!… ফোঁসফুসিয়েই বলল রাসু আর কী যে ঝাঁঝ ছড়াল। কোথা থেকে এত ঝাঁঝ এল রাসুর গলায়? ওর দিকে তাকিয়ে যেন দিশে হারায় মালু।

আর কিছু বলল না রাসু। মালুর দিকে চাইলও না একটিবার। লতির আঁটিটা হাতে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কচু পাতার জঙ্গলের ওপারে।

মালুর বুকটা কেন যেন ভারি হয়ে গেল। মনে হল ওর কী এক কান্না জমেছে সেখানে। কিন্তু চোখ দুটো ওর জ্যৈষ্ঠের ক্ষেতের মতোই শুকনো। এতদিন মালুর শরীরটাই বুঝি ফনফিনিয়ে বেড়ে উঠছিল। আজ হঠাৎ করে ওর মনটাও যেন বয়সের ছোঁয়া পেল, এক লাফে যেন বেড়ে গেল মালু অনেকখানি।

সূর্যটা লাল হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নাববে এক্ষুণি। গড়গুলো পেরিয়ে সৈয়দ বাড়ির অন্দর মহলের পুকুর পাড়ে উঠে এল মালু। হঠাৎ ঢোলের আওয়াজ শুনে কানটা ওর খাড়া হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ ধরেই ঢোলের আওয়াজ আসছিল, কিন্তু সে দিকে কান ছিল না মালুর। বাকুলিয়ায় ঢাক-ঢোলের রেওয়াজ নেই। বছরে শুধু একদিনই ঢোল বাজে এ গাঁয়ে, মিঞাদের পুইন্যার সময়। কয়েক পা এগিয়েই মালুর আর সন্দেহ রইল না, সৈয়দবাড়ি থেকেই ভেসে আসছে ঢোলের আওয়াজ। ঢোলকের তালের সাথে সাথে টুং টুং কী এক বাজনাও বাজছে যেন। সৈয়দবাড়িতে বাজনা? সূর্যের পশ্চিম দিকে ওঠার মতোই এ এক অসম্ভব অকল্পনীয় ব্যাপার। ঢাক-ঢোল বাজনা ওসব হল সেরেকি ব্যাপার, হিন্দুয়ানী কারবার। তাই সব রকমের বাজনাই নিষিদ্ধ এ বাড়িতে। পুইন্যার সময়ও কোনো ঢোল বাজতে পারে না সৈয়দবাড়িতে। পায়ের গতিটা বাড়িয়ে দেয় মালু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *