১৬-২০. ইউনুস জোয়ারদার খুন

ইউনুস জোয়ারদার খুন হয়ে আমার মধ্যে গোপন রাজনীতির প্রতি অনুরাগের বীজটি বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই বীজের রাজনীতির জল-হাওয়া লেগে অঙ্কুরিত হতে সময় লাগে নি। ইউনুস জোয়ারদারের অবর্তমানে তার পার্টিতে যোগ দেয়ার সাহস আমার হয়নি। কারণ খুন করা এবং খুন হওয়া দুটোর কোনোটার সাহস আমার ছিল না। আমি এমন একটা পার্টি বেছে নিলাম যেটা অর্ধেক গোপন এবং অর্ধেক প্রকাশ্য। তার মানে পার্টির গোপন সেল আছে এবং সেখান থেকে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়। আর প্রকাশ্য অংশের কাজ হলো সেগুলোকে চলতি রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তার অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করা। লেখক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষকদের ভেতর যোগাযোগ করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। আমার সঙ্গে প্রকাশ্য অংশের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না, মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করা ছাড়া। আমি সরাসরি পার্টির বস কমরেড এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। তিনি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জনসমক্ষে দেখা দিতেন না। এই রহস্যময় পুরুষ, যার কথায় বিপ্লব, হাসিতে কাশিতে বিপ্লব, এমন এক মহাপুরুষের সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক আছে মনে করলে আমি মনের মধ্যে একটা জোর অনুভব করতাম । ভাবতাম, আমি কখনো একা নই। এই রহস্যময় পুরুষ অদৃশ্যভাবে আমার সঙ্গে অবস্থান করছেন। কমরেড এনামুল হকের কাছে প্রতি পনের দিন অন্তর আমার কাজকর্মের রিপোর্ট দিতাম। শামায়োখের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তিনমাস কোথা দিয়ে কিভাবে পার হয়ে গেল, আমি বুঝতে পারি নি। একদিনও কমরেড এনামুল হকের কাছে যাওয়া হয়নি। অথচ তিনি তিন-চারবার দেখা করতে সংবাদ পাঠিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত আমি খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় কমরেড এনামুল হকের গোপন আস্তানায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমাকে সংবাদ জানানো হলো কমরেড অন্য কমরেডদের সঙ্গে জরুরি বিষয়ে আলাপ করছেন। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি বাইরের ঘরে হাতল ভাঙা চেয়ারের ওপর বসে পড়লাম। ঘণ্টাখানেক পর আমাকে ভেতরে ডাকা হলো। কমরেড এনামুল হকের ঘরে দেখলাম আধোয়া প্লেটের স্তূপ। মাংসের হাড়গোড় সরিয়ে নেয়া হয়নি। সারা ঘরে ছড়ানো স্টার সিগারেটের বটি। দেয়ালে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন এবং মাও সে তুংয়ের ছবি। আমরা যারা কমরেড এনামুল হকের চ্যালা, সঙ্গত কারণেই বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে যদি সর্বহারার সফল বিপ্লব হয়, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাসে তুং-এর পাশে কমরেড এনামুল হকও একটা স্থান দখল করে নেবেন। আমি তিনমাস আসি নি। এই সময়ের মধ্যে কমরেড এনামুল হকের দাড়ি-গোঁফ আরো লম্বা হয়েছে। তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির রহস্যময়তা আরো গাঢ় হয়েছে। যে হাতের বজ্রমুষ্টিতে তিনি সমাজের সমস্ত বন্ধন চূর্ণ করবেন বলে আমরা মনে করি, সেই হাত দিয়ে কমরেড এনামুল হক আমার হাত চেপে ধরলেন। পুরুষের হাত। এই হাতের স্পর্শ একবার যে পেয়েছে, কমরেড হকের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে নি। কমরেড হক তার তেজোব্যঞ্জক রহস্যময় দৃষ্টি এমনভাবে আমার ওপর প্রয়োগ করলেন, আমার মনে হলো, শরীরের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত দেখে ফেলতে পারেন। তার সেই দিব্য দৃষ্টি থেকে কোনো কিছুই আমরা লুকোতে পারি নে। এবার কমরেড হক কথা বললেন, আমরা মনে করলাম, কমরেড জাহিদ বিপ্লবী দায়িত্ব ভুলে গিয়েছেন এবং আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন। আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়লাম। আমতা-আমতা করে একটা কৈফিয়ত দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম, শরীর ভাল ছিল না, তাছাড়া গবেষণার কাজে মনোযোগ দিতে হয়েছিল। আমার খোঁড়া কৈফিয়ত শুনে বললেন, কমরেড জাহিদ, আপনাকে আর বানিয়ে বানিয়ে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। আমরা জানি একজন সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে আপনাকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল না, সেজন্য আপনাকে দোষারোপ করব না বরং আপনার তারিফ করব। মনে আছে কমরেড, প্লেটো বলেছিলেন, সুন্দরী মহিলারা সমাজের এজমালি সম্পত্তি। আপনার বান্ধবীকেও পার্টিতে নিয়ে আসুন। ভয় পাবেন না, বান্ধবী আপনার ঠিকই থাকবে, কিন্তু কাজ করবে পার্টির।

আমার মনে হলো, কমরেড এনামুল হকের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা ভাল। আমি বললাম, কমরেড, এই ভদ্রমহিলা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ চাইছেন। কমরেড এনামুল হক আবার ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, কমরেড, রাগ করবেন না, আপনার চিন্তা-চেতনা এখনো বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন। এই সুন্দরী মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করবে? আপনি কি চান ওই বস্তাপচা জিনিস পড়িয়ে মহিলা তার জীবন অপচয় করবেন? বিপ্লবের তাজা কাজে লাগিয়ে দিন। আমি বললাম, তার থাকার অসুবিধা আছে, চলার কোন সঙ্গতি নেই। কমরেড এনামুল হক বললেন, সেই দুশ্চিন্তা আপনার নয়। পার্টি সব ভার বহন করবে। তারপর তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে গোপন কিছু ফাঁস করছেন, এমনভাবে বললেন, কমরেড, জানেন, একজন সুশিক্ষিত সুন্দর মহিলা আমাদের পার্টিতে থাকলে আমাদের কত সুবিধে হয়। আমাদের শত্রুদের খবরাখবর সংগ্রহ করতে হয়, চাঁদা ওঠাতে হয়। ভয় পাবেন না কমরেড, আপনার বান্ধবী আপনারই থাকবে, লাগিয়ে দিন পার্টির কাজে। একটু অবসর সময়ে আসবেন, আমি লেনিনের রচনাবলি খুলে আপনাকে দেখাবো, মহামতি লেনিন পরিষ্কার বলেছেন, বিপ্লব সফল করতে হলে সৌন্দর্য, শক্তি, অর্থ, মেধা, কৌশল সবকিছু একযোগে কাজে লাগাতে হবে। নিয়ে আসুন আপনার বান্ধবীকে। আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, কমরেড, ওই মহিলার মাথার মধ্যে একটা দুটো নয়, অনেকগুলো ছিট আছে। এ ধরনের মহিলা বিপ্লবী কাজ-কর্মের মোটেই উপযুক্ত হবে না। কমরেড হক একটা চুরুট জ্বালালেন এবং টান দিয়ে বললেন, কমরেড জাহিদ, বললে আপনি অসন্তুষ্ট হবেন, বুর্জোয়া ধ্যান ধারণা আপনার মনে এমনভাবে শেকড় গেড়েছে যে, বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি আপনার মধ্যে এখন পর্যন্ত জন্মাতে পারে নি । মানুষের যত রকম ব্যাধি আছে তার অর্ধেক সামাজিক ব্যাধি। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হলো এ ধরনের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের মোক্ষম ওষুধ। পার্টিতে নিয়ে আসেন, দেখবেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার বান্ধবী সুস্থ হয়ে উঠবেন।

বুঝলাম, শামারোখের অবস্থা হয়েছে গোল আলুর মতো। গোল আলু যেমন মাছ, মাংস, সুটকি সব কিছুর জন্য প্রয়োজন, তেমনি শামায়োখকেও সবার প্রয়োজন। বিপ্লবের জন্য, কবিতার জন্য, রাজনীতির জন্য, এমনকি লুচ্চামি তাঁদরামোর জন্যও শামারোখের প্রয়োজন। দিনে দিনে নানা স্তরের মানুষের মধ্যে তার চাহিদা বাড়তে থাকবে। ভার বইবার দায়িত্বটুকু কেন একা আমার! যদি পারতাম কেঁদে মনের বোঝা হাল্কা করতাম।

.

১৭.

একদিন দুপুরবেলা শামারোখ এসে বলল, আপনি আজ আমাকে খাওয়াবেন। আমি বিব্রতকর একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। এই মহিলা দিনে দিনে আমার সমস্ত দীনতার কথা জেনে যাচ্ছে। আমি এই ভেবে শঙ্কিত হলাম যে, বজলুর মেসে যে খাবার খাই দেখলে ভদ্রমহিলা নিশ্চিতই তার নাক কুঁচকাবে। অথচ সে আজ নিজের থেকে কিছু খেতে চাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এটাকে আমার সৌভাগ্য বলে ধরে নিলাম। আমি জামা-কাপড় পরতে আরম্ভ করলাম। ভদ্রমহিলা আমার দিকে বড় বড় চোখ মেলে মন্তব্য করে বলল, আপনি এরকম উদ্ভট জামা-কাপড় পরেন কেন? শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু সামলে নিলাম। বললাম, জামা-কাপড় আমি নিজে কিনি নে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে যখন যেটা পাওয়া যায় পরে ফেলি। আমি আলনার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, এখানে যে শার্ট-প্যান্ট দেখছেন, তার কোনোটাই আমার কেনা নয়। সবগুলোই কারো না কারো কাছ থেকে পাওয়া। তাই আমার জামা-কাপড়ের কোনোটাই আমার গায়ের সঙ্গে খাপ খায় না। কোনোটা শরীরের মাপে ছোট, কোনোটা বড়। কিন্তু আমি দিব্যি পরে বেড়াচ্ছি। গায়ের মাপের চাইতে ছোটবড় জামা-কাপড় পরা যেন মস্ত একটা মজার ব্যাপার, এরকম একটা ভঙ্গি করে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলাম।

মহিলা কোনো কথা বলল না। শুধু আমার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকালো একবার। আমি বললাম, চলুন। শামারোখ জানতে চাইল, কোথায়? আমি বললাম, বাইরে। সে বলল, বাইরে থেকেই তো এলাম। আবার বাইরে যাব কেন? আমি বললাম, আপনি তো খেতে চাইলেন। তাই কোনো রেস্টুরেন্টে চলুন। শামারাৈখ বলল, আপনার হোস্টেলে খাবার পাওয়া যায় না? আমি বললাম, সে খাবার খেতে আপনার রুচি হবে না। শামারোখ বলল, আপনারা সবাই দু’বেলা ওই খাবার খেয়েই তো বেঁচে আছেন। আমি শামারোখের চোখে চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, আমাদের মেসের খাবার খেলে আমার প্রতি আপনার ঘৃণা জন্মাবে। সে কপট ক্রোধের ভান করে বলল, জাহিদ সাহেব, আপনি ইনকরিজিবল। চলুন, আপনাদের মেসে যাই।

আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। এখন মেসের অধিকাংশ বোর্ডার খেতে বসেছে। এই সময়ে যদি তাকে নিয়ে যাই একটা দৃশ্যের অবতারণা করা হবে। আমাদের মেসে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের খেতে আপত্তি নেই। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন রান্নার ঝামেলা এড়াবার জন্য দুই’বেলাই মেসে এসে খাওয়া-দাওয়া করে। কেউ কেউ তাদের বান্ধবী এবং আত্মীয়দের নিয়েও মেসে খেয়ে থাকে। কিন্তু শামারোখের ব্যাপারে যে ভয় আমি করছিলাম, তাকে যদি মেসে নিয়ে আসি, হঠাৎ কেউ কিছু বলে ফেলতে পারে। এমনিতেই শামারোখকে নিয়ে মানুষজন এতসব আজেবাজে কথা বলে যে, শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আজ শামারোখের উপস্থিতিতে কেউ যদি উল্টোসিধে কিছু বলে বসে, সে ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে উঠবে। মাঝখানে আমি বেচারি বিপদের মধ্যে পড়ে যাব ।

শামারোখকে বললাম, আপনি হাত-পা ধুতে থাকুন, আমি মেস থেকে খাবার নিয়ে আসি। সে বলল, আপনি না-হক কষ্ট করতে যাবেন কেন? চলুন মেসে গিয়েই খেয়ে আসি। অগত্যা তাকে নিয়ে আমাকে মেসে যেতে হলো। তখন বোর্ডাররা সবাই খেতে বসেছে। সবগুলো টেবিলই ভর্তি। তিন নম্বর টেবিলের কোণার দিকটা খালি। ওখানেই আমি শামারোখকে নিয়ে বসলাম। আমি তাকে মেসে নিয়ে যেতে পারি, এটা কেউ চিন্তাও করতে পারে নি। প্রায় সবগুলো দৃষ্টি শামায়োখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা তার দৃষ্টি এড়ায় নি। শামারোখ খেতে খেতে বলল, আচ্ছা, সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে কেন, আমি কি চিড়িয়াখানা থেকে এসেছি?

আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, সুন্দর মহিলাদের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকে, এটাতো খুব মামুলি ব্যাপার। কিন্তু চেপে গেলাম। আমার পাশে বসেছিল রিয়াজুল সাহেব। আচার-আচরণে তিনি পারফেক্ট জেন্টলম্যান। শামারোখকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাকে আগে কেউ দেখে নি, সে জন্যই তাকাচ্ছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। শামারোখ রিয়াজুল হক সাহেবের সঙ্গেই আলাপ জুড়ে দিলেন। আপনি কি ভাই টিচার? রিয়াজুল হক সাহেব জবাব দিলেন, তিনি ফিজিক্সের টিচার। কথাবার্তা আর বিশেষ এগুলো না । খাওয়ার পর যখন ঘরে এসেছি, শামারোখ বলল, আপনি এককাপ চা করে খাওয়ান। খাবারের গুণাগুণ নিয়ে কোনো কথা বলল না দেখে আমি মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি চা বানিয়ে দিলে খেতে খেতে সে বলল, আজ বেশিক্ষণ বসব না। আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আমি বললাম, আপনি কি সরাসরি বাড়ি থেকে আসছেন? শামারোখ বলল, নারে ভাই, অন্য জায়গা থেকে এসেছি। আমার নানা সমস্যা, যাকে বলে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল- আমারও সে অবস্থা। আমি জানতে চাইলাম কি রকম সমস্যা। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বলব একদিন। তারপর বলল আমি মাঝে মাঝে রান্না করে আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসব। আমি কথাটা শুনলাম, শুনে ভাল লাগল। কিন্তু হ্যাঁ বা না কিছু বলতে পারলাম না। একদিন সন্ধ্যে বেলা আমার এক আত্মীয়কে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে কমলাপুর যেতে হয়েছিল। ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি করল। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। আমি মেসে খাবার পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। বাইরের কোনো হোটেল থেকে খেয়ে নেব কিনা চিন্তা করেও কেন জানি খেতে পারলাম না। হোস্টেলে যখন ফিরলাম, রাত দশটা বেজে গেছে। গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই দারোয়ান আকর্ণ বিস্তৃত একখানা হাসি দিয়ে জানালো, ছাব আপনার কপাল বহুত ভালা আছে। সেই সোন্দর মেমছাব এই জিনিসগুলো আপনার লাইগ্যা রাইখ্যা গেছে। আমার ডিউটি শেষ, নয়টা বাজে। মগর আপনার লাইগ্যা বইসা আছি। হাফিজ আমার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার এবং আঙ্কারা স্টোর্স লেখা একটা শপিং ব্যাগও গছিয়ে দিল।

ঘরে এসে প্রথম শপিং ব্যাগটাই খুলোম। দেখি দুটো শার্ট এবং একটা পুরোহাতা সোয়েটার। আমার সেই গ্রামীণ রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমার জামা-কাপড় মানানসই নয় বলেই ভদ্রমহিলা আমাকে দোকান থেকে শার্ট সোয়েটার কিনে দিয়ে করুণা প্রদর্শন করেছে। ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু পারলাম না। সুন্দর জিনিসের আলাদা একটা মন হরণ করার ক্ষমতা আছে। পুরোহাতা শার্টটা নেড়েচেড়ে দেখে আমার মন ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। শার্টটা অপূর্ব! সিল্কের সাদা জমিনে লালের ছিটে। পরে দেখলাম আমার গায়ের সঙ্গে একেবারে মানিয়ে গেছে। সুতির হাফ শার্টটাও মনে ধরে গেল। পুরোহাতা সোয়েটারটা আমাকে সবচাইতে মুগ্ধ করল। নরম মোলায়েম উলের তৈরি আকাশী রঙে ছোপানো। শামারোখের রুচি আছে বলতে হবে! সে অন্যের জন্যও পছন্দ করে জামা-কাপড় কিনতে জানে। হঠাৎ আমার মনে একটা শিহরন খেলে গেল। তাহলে শামারোখ কি আমাকে ভালোবাসে? আমার হৃৎপিণ্ডটা আশ্চর্য সাংঘাতিক ধ্বনিতে বেজে উঠতে থাকল। শরীরের রক্ত সভায় একটা উচ্ছ্বাসের সাড়া জেগেছে। আমি নিজেকে নিজের মধ্যে আর ধরে রাখতে পারছি নে। কী সুখ, কী আনন্দ! এই অসহ্য আনন্দের ভার কী করে বহন করি? কোনোরকমে জুতো জোড়া পা থেকে গলিয়ে বিছানার ওপর সটান শুয়ে থাকার পর টের পেলাম, এখনো রাতের খাওয়া শেষ করিনি। চার থাকঅলা শামারোখের টিফিন ক্যারিয়ার খুলোম। প্রথম থাকে দেখি কয়েক টুকরো কাটা শশা। একটা কাঁচামরিচ এবং একটা আস্ত পাতাসুদ্ধ পেঁয়াজ। একপাশে সামান্য পরিমাণ আমের ঝাল আচার। এগুলো মহামূল্য পদার্থ নয়। কিন্তু টিফিন ক্যারিয়ারে যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, সেই সুন্দর যত্নটাই আমাকে অভিভূত করে ফেলল। দ্বিতীয় তাকে সরু চালের ভাত এবং ওপরে দুফালি বেগুন ভাজা। তৃতীয় তাকে আট-দশটা ভাজা চাপিলা মাছ এবং চতুর্থ তাকে ঘন মুগের ডাল । সহসা আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসতে চাইল । আহা, কতকাল ঘরের খাবার খাইনি!

প্রতিরাতে হোস্টেলে ফিরে দেখি, দরজার সামনে বজলু টিফিন ক্যারিয়ার থুয়ে গেছে। ঢাকনা খুললেই দেখি বাটির মধ্যে একটা মুরগির ঠ্যাং চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওই মুরগির ঠ্যাং দেখতে দেখতে, আর মুরগির ঠ্যাং খেতে খেতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে আমার মনে অনেক নালিশ জমা হয়ে গেছে। আল্লাহ খাওয়ার সময় নিছক আমার বিরক্তি উৎপাদন করার জন্য ওই দু ঠেঙে পাখিটাকে সৃষ্টি করেছেন। শামায়োখের রেখে যাওয়া ছিমছাম পরিপাটি খাবার খেতে খেতে যত্ন এবং মমতা দিয়ে ঢাকা একখানা ঘরের কথা মনে হতে লাগল । আমার কি ঘর হবে? সে রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমি ঘুমুতে পারি নি। এক সময় ঘরে থাকা অসহ্য হয়ে দাঁড়ালো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। দারোয়ানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গেট খোলালাম। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এই ঠাণ্ডার মধ্যেই একাকী লনে পায়চারি করতে লাগলাম। রাতের পৃথিবী চুপচাপ । গাড়ি ঘোড়ার শব্দও কানে আসছে না। আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম লাখ কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের দেয়ালি চলছে। আমার হৃদয়ে যে হৃৎস্পন্দন জাগছে তার সঙ্গে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের কাঁপা কাঁপা আলোর একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করলাম। এই তারা-ভরা আকাশের নিচে একা একা পায়চারি করতে করতে কেন জানি মনে হলো, গাছপালা, পশুপাখি, গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কিছুর থেকে আমি আলাদা নই, বিচ্ছিন্ন নই । নিসর্গের মধ্যে সব সময় একটা পরিপূর্ণতা বিরাজ করছে। আমার নিজেকেও ওই চরাচর পরিব্যাপ্ত পূর্ণতার অংশ মনে হলো। আমি অনুভব করলাম, আমার ভেতরে শূন্যতা কিংবা অপূর্ণতার লেশমাত্রও নেই। এই পরিপূর্ণতার বোধটি আমার মনে মৌমাছির চাকের মতো জমেছে। শরীরে-মনে একটা আশ্চর্য শান্তির দোলা লাগছে। এক সময় অনুভব করলাম ঘুমে চোখ দুটো ভারি হয়ে আসছে।

সপ্তাহখানেক পরে হবে। এক সন্ধ্যেবেলা শামারোখ এসে বলল, জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিন। আপনাকে আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, শামায়োখ খুব সূক্ষ্ম যত্নে সাজগোজ করে এসেছে। সূক্ষ্ম যত্ন শব্দ দুটো একারণে বললাম, সে যে সাজগোজ করেছে সেটা প্রথম দৃষ্টিতে ধরা পড়বে না। চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। একটা সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছে এবং শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে ব্লাউজ। তার পরনের স্যান্ডেলের স্ট্রাইপগুলো সাদা। হাতের ব্যাগটিও সাদা রঙের। ওই শুভ্রতাময়ীর দিকে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। তার শরীর থেকে একটা মৃদু মন্থর ঘ্রাণ বেরিয়ে এসে ঘরের বাতাস পর্যন্ত সুবাসিত করে তুলছে। শামারোখকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে, আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না। শামায়োখ বলল, অমন হাঁ করে কি দেখছেন? বললাম না, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে। আমি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। তারপর সেই পুরনো জামা-কাপড়গুলো আবার পরতে আরম্ভ করলে সে বলল, ওগুলো আবার পরছেন কেন? আপনার জন্য সেদিন শার্ট-সোয়েটার রেখে গেলাম না, সেগুলো কোথায়? আমি পলিথিনের ব্যাগটা শামারোখের হাতে দিয়ে বললাম, এর মধ্যে সব আছে। শামায়োখ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, এগুলো রেখে গিয়েছি পরার জন্য, ব্যাগের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য নয়। আমার কেমন বাধো-বাধো ঠেকছিল । শামায়োখের দেয়া কাপড়-চোপড় পরে পুরোদস্তুর ভদ্রলোক সেজে তার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম লজ্জার ব্যাপার আছে। সেটা আমি তাড়াতে পারছিলাম না। শামারোখের শার্ট পরব-কি-পরব না, এই ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। শামারোখ হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমার শরীর থেকে এক ঝটকায় পুরনো জামাটা খুলে ফেলল। আমি বাধা দিতে পারলাম না। তারপর সে সিল্কের পুরোহাতা শার্টটার বোতাম খুলে আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, শিগগির এটা পরে ফেলুন। বিনাবাক্যে শার্টটা পরে নিলাম। শামারোখ বোতামগুলো লাগিয়ে দিল। এ সময় তার ভোলা চুলগুলো এলোমেলো উড়ে আমার গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি তার স্পর্শ পাচ্ছিলাম। আমার ইচ্ছে করছিল, তার সুন্দর চিবুকখানা স্পর্শ করি, মুখমণ্ডলে একটা চুমু দিয়ে বসি। শামারোখ সোয়েটারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটাও পরুন। বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা। অগত্যা আমাকে পরতে হলো। সে আমার সামনে ঝুঁকে পড়া চুলের গোছাটি পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি কি পরিমাণ হ্যান্ডসাম, আয়নার সামনে গিয়ে দেখে আসুন। অথচ চেহারাখানা সবসময় এমন করে রাখেন, মনে হয়, সাতজন-পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে।

আমরা দুজন বাইরে এসে একটা রিকশা নিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? শামারোখ বলল, কলাবাগানের একটা বাড়িতে। ভিসিআর-এ আপনাকে একটা ছবি দেখাবো। এ ধরনের ছবি ঢাকায় দেখানো হয় না। ফরাসি বিপ্লবের নায়ক দাঁতোর ওপর ছবি। আমার এক বন্ধু বিদেশ থেকে ক্যাসেট নিয়ে এসেছে।

আমাদের কলাবাগান পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে যখন বাড়ির ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলাম, দেখি, একপাশে বসে চারজন ব্রিজ খেলছে। টেবিলে বিয়ারের গ্লাস। এই চারজনের একজন সোলেমান চৌধুরী। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। শামারোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার দেরি করার কারণটা বোঝা গেল। শামায়োখ জবাব দিল না। নাদুসনুদুস চেহারার ফ্রেঞ্চকাট দাড়িঅলা টাকমাথার ভদ্রলোকটি বিয়ার পান করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে? শামারোখ বলল, উনি আমার বন্ধু এবং একজন ভালো লেখক। সোলেমান চৌধুরী শ্লেষাত্মক স্বরে বললেন, আসল কথাটি এড়িয়ে যাচ্ছ। বলো না কেন তোমার কবিতা লেখার পার্টনার।

আজ প্রথম নয়, শামারোখ বারবার আমাকে এমন সব পরিবেশে নিয়ে আসে, আমি কিছুতেই তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি নে। আমার ইচ্ছে করছিল, পালিয়ে চলে আসি। সেটা আরো খারাপ দেখাবে বলে চলে আসতে পারছিলাম না। এই ভদ্রলোকেরা বাংলাভাষাতেই কথাবার্তা বলছিলেন, কিন্তু আমার মনে হলো, সে ভাষা আমি বুঝিনে। সোফার কোণার দিকে লম্বাপনা ভদ্রলোকটি আমার গায়ের জামার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন, শামারোখ, এখন বুঝতে পারলাম বায়তুল মোকাররমে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কেন আমাকে দিয়ে শার্ট এবং সোয়েটার কিনিয়েছিলে। কবি সাহেবকে জামা-কাপড় গিফ্ট করার জন্যই আমার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলে। ভদ্রলোক কাটাকাটা কথায় বললেন, শার্ট এবং সোয়েটার দুটো কবি সাহেবের গায়ে মানিয়েছে চমৎকার। কবি সাহেব ভাগ্যবান। আজ থেকে আমরাও সবাই কবিতা লিখতে লেগে যাব । ভদ্রলোক কেমন করে হাসলেন।

ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনে আমার সারা গায়ে যেন আগুন লেগে গেল । শামারোখ এই মানুষটার কাছ থেকে টাকা ধার করে আমার শার্ট এবং সোয়েটার কিনেছে। তারপর সেগুলো দেখাবার উদ্দেশ্যে সেই ভদ্রলোকের কাছেই আমাকে ধরে এনে হাজির করেছে। জামা-কাপড়গুলো শরীর থেকে খুলে ফেলে শামারোধের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তার তো আর উপায় নেই। সুতরাং বসে বসে অপমানটা হজম করছিলাম।

নাদুসনুদুস টাক মাথার ভদ্রলোক এবার সিগারেট টেবিলে ঠুককে ঠুকতে বললেন, শামারোখ হোয়াই শুড ঝু ইনডাজ ইন পোয়েমস? ত্যু আর মোর দ্যান এ পোয়েট্রি। তুমি কেন কবিতা লেখার মতো অকাজে সময় নষ্ট করবে। তোমাকে নিয়েই মানুষ কবিতা লিখবে। অ্যাণ্ড মাইন্ড ইট, একবার যদি লাই দাও দলে দলে কবিরা এসে মাছির মতো তোমার চারপাশে ভ্যান ভ্যান করবে। ঢাকা শহরে কবির সংখ্যা কাকের সংখ্যার চাইতে কম নয়। শামারোখ চটে গিয়ে বলল, আবেদ য়ু আর এ ফিলথি নইসেন্স। তুমি একটা হামবাগ এবং ফিলিস্টিন। মানুষের প্রতি মিনিমাম রেসপেক্টও তোমার নেই। আবেদ নামের ভদ্রলোকটি হাসতে হাসতে বললেন, মানুষের প্রতি সব রেসপেক্ট তো তুমিই দেখিয়ে যাচ্ছ। অন্যদের আর রেসপেক্ট করার অবকাশ কোথায়? পথেঘাটে যাকে যেখানেই পাচ্ছ ধরে ধরে স্ট্রিট আৰ্চিনদের হাজির করছ। তোমার টেস্টের তারিফ না করে পারি নে। শামারোখ বলল, তুমি একটা আস্ত ব্রুট। তারপর একটা বিয়ারের খালি টিন তুলে নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল এবং আমার হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল । গোটা ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে ছায়াবাজির মতো ঘটে গেল । গেটের কাছে যখন এসেছি, শামারোখ বলল, জাহিদ আপনি আস্ত একটা কাওয়ার্ড। এই আবেদ হারামজাদা আমাকে এবং আপনাকে এত অপমানজনক কথা বলল, আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু হজম করলেন? আপনি তার মুখে একটা ঘুষি পর্যন্ত বসিয়ে দিতে পারলেন না? আমি শামারোখের কথার কি উত্তর দেব ভেবে ঠিক করতে না পেরে তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

.

১৮.

শামারোখ আমার মনে একটা ঝংকার সৃষ্টি করে দিয়েছে। তাকে আমি মনের ভেতর থেকে তাড়াতে পারছি নে। শামারোখ শুধু সুন্দরী নয়, তার মনে দয়ামায়াও আছে। আমার প্রতি এই সময়ের মধ্যে তার একটা অনুরাগ জন্মানোও বিচিত্র নয়। শামায়োখ যখন হাসে, সাদা বেজির দাঁতের মতো তার ছোট ছোট দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সে যখন ফুঁসে ওঠে, তার মধ্যে একটা সুন্দর অগ্নিশিখা জ্বলে উঠতে দেখি। সে যখন গান করে অথবা কবিতা পাঠ করে, পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণা আমি মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। বড় বড় দুটি চোখ মেলে যখন দৃষ্টিপাত করে, তার অসহায়তার ভাবটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখন তাকে অনেক বেশি সুন্দরী দেখায়।

শামায়োখ আমার খাওয়া-দাওয়ার প্রতিও দৃষ্টি দিতে আরম্ভ করেছে। আমার দারিদ্র্য, আমার অক্ষমতা, আমার অস্তিত্বের দীনতা সবকিছু এমনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, তার কাছে আমি কোনো রকমের দ্বিধা এবং সংকোচ ছাড়াই নিজেকে মেলে ধরতে পারি।

আমার অনেক কিছু নেই, আমি জানি। কিন্তু শামায়োখের সঙ্গে যখন আলাপ করি, আমার নিজেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ মানুষ মনে হয়। মনে হয়, আমার মধ্যে কোনো অক্ষমতা, কোনো অপূর্ণতা নেই। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। এই মাস তিন-চার শামায়োখের সঙ্গে চলাফেরা করতে গিয়ে আমার ভেতরে একটা রূপান্তর ঘটে গেছে।

সেটা আমি এখন অনুভব করি। আমি ছিলাম নিতান্ত তুচ্ছ একজন আদনা মানুষ। এই রকম একজন সুন্দর মহিলা, সমাজে যার সম্পর্কে সত্য-মিথ্যে বিচিত্র ধরনের কাহিনী চালু আছে, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার কারণে আমি চারপাশের সবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি। আমি টের পেতে আরম্ভ করেছি, মানুষের কাছে একরকম ঈর্ষার পাত্র বনে গেছি। যদিও আমি বুঝতে পারি, তার মধ্যে কিছু পরিমাণে হলেও করুণা মিশে রয়েছে। যে মহিলা অঙ্গুলি হেলনে ঢাকা শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটিকে পেছনে ছুটিয়ে নিতে পারে, ক্ষমতাবান মানুষটিকে পাগল করে তুলতে পারে, আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন এই যে ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছে, এটা তার একটা খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। এ-কথা আমার হিতৈষী বন্ধু-বান্ধবেরা আমাকে বারবার বলেছে, আমি এক ঘড়েল মহিলার পাল্লায় পড়েছি এবং মহিলা আমাকে লেজে খেলাচ্ছে। এক সময় আমাকে এমন উলঙ্গ করে ছেড়ে দেবে যে, তখন মানুষের কাছে আমার মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। এগুলো আমি অস্বীকার করিনে। এ পর্যন্ত শামারোখ সম্বন্ধে যেটুকু ধারণা আমার হয়েছে, তাতে করে আমি ভালভাবে বুঝে গেছি, সে যে-কোনো সময় যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারে। এ রকম একটি মাদকতাময়ী সুন্দরীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো কি জিনিস, তার শরীরের স্পর্শ, তার কণ্ঠস্বরের উত্তাপ, চুলের সুঘ্রাণ এগুলোর সম্মিলিত নেশা রক্তে কেমন আগুন ধরিয়ে দিতে পারে, সেই অপূর্ব অভিজ্ঞতা বন্ধুদের কোনোদিন হয় নি। তাই তারা এমন অভাবনীয় ভয়াবহ পরিণতির কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। অনেক সময় মানুষ সত্য প্রকাশের ছলে, নিজের মনের প্রচ্ছন্ন ঈর্ষাটাই প্রকাশ করে থাকে।

যে যাই বলুক, আমার অবস্থা এমন, শামারোখ যদি আমাকে বলত, জাহিদ, তোমাকে আমার সঙ্গে দুনিয়ার অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে হবে, পাঁচতলা দালান থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ দিতে হবে, কিছুই করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ছোট্ট একটা কিন্তু সব কিছুতে বাদ সেধেছে। সেটা একটু খুলে বলি। এ পর্যন্ত শামারোখ আমাকে যে সমস্ত জায়গায় নিয়ে গিয়েছে সব জায়গাতেই আমি ভয়ংকরভাবে আহত বোধ করেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, গ্রিন রোড, কলাবাগান এই তিনটি জায়গায় নিয়ে গেছে। ওসব জায়গায় যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, আলাদা আলাদাভাবে তাদের চেহারাগুলো চিন্তা করলেও আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়। এইসব মানুষের সঙ্গে শামারোখের কি সম্পর্ক তাই নিয়ে আমাকে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে। শামায়োখের মনে কি আছে, তার অভিপ্রায় কি- একথা বার বার চিন্তা করেও আমি নিজের মধ্যে কোনো সদুত্তর পাই নি। আমি সবচেয়ে ব্যথিত বোধ করেছিলাম, যেদিন তার উপহার দেয়া জামা কাপড় পরিয়ে শামারোখ আমাকে কলাবাগানে তার বন্ধুদের আচ্ছায় সিনেমা দেখাবে বলে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে আমাকে জানতে হলো এই লোকদের একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে শামারোখ আমার জন্য শার্ট এবং সোয়েটার কিনেছে। সেদিন রাস্তার মাঝখানে ধরে তাকে পেটাতে ইচ্ছে করেছিল। হয়তো আক্ষরিক অর্থে পেটাতে না পারলেও কিছু কড়া কথা অবশ্য বলতাম এবং সম্ভব হলে শরীর থেকে সব জামা-কাপড় খুলে তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিতাম। আবেদের মুখের ওপর বিয়ারের টিন ছুঁড়ে মারার দৃশ্যটাই আমাকে একটা দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তারপর তো শামারোখ আমাকেই আসামি ধরে নিয়ে মস্ত বড় একখানা নালিশ ফেঁদে বসল। সে যখন বিয়ারের টিন ছুঁড়ে মারল, আমি আবেদের মুখের ওপর ঘুষি বসিয়ে দিলাম না কেন। এই মহিলাকে আমি কোনো । হিসেবের মধ্যে ফেলতে পারছি নে। মহিলা কি পাগল, নাকি অন্য কিছু?

শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গিয়ে আমাকে দেখতে হয়েছে বড় ভাইয়ের বউ তার বাহুতে কামড় দিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে। সেও নিশ্চয়ই বড় ভাইয়ের বউকে অক্ষত রাখে নি। এইরকম অব্যবস্থিত চিত্তের মহিলাকে নিয়ে আমি কি করব ভেবে ঠিক করতে পারলাম না। তাকে গ্রহণ করা অসম্ভব, আবার তাকে ছেড়ে দেয়া আরো অসম্ভব। গভীর রাতে আমি যখন নিজের মুখোমুখি হই, শামায়রাখের সমস্ত অবয়বটা আমার মানসদৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অন্তরের সমস্ত আবেগ দিয়ে ওই মহিলাকে জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা আমার মনে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। মনে হয়, তার জন্য প্রাণ-মন সবকিছু পণ করতে পারি। কিন্তু যখন তার অন্য কাণ্ডকীর্তির কথা স্মরণে আসে, মহিলার প্রতি আমার একটা অনীহাবোধ তীব্র হয়ে জেগে ওঠে। মনের একাংশ অসাড় হয়ে যায়। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, এই আধপাগলা বিক্ষিপ্ত মানসিকতার মহিলাটির সঙ্গে আমি লেগে রয়েছি কেন? প্রতি রাতেই পণ করি, এরপর যদি শামারোখ আসে, তার চোখে চোখে তাকিয়ে বলে দেব, তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আমার সব কিছু লাটে উঠতে বসেছে। অকারণে মানুষ আমার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। এরপর তার সঙ্গে আর মেলামেশা সম্ভব নয়।

কিন্তু পরদিন যখন শামারোখ আসে, তার চুলের রাশিতে কাঁপন ধরিয়ে আমার দিকে যখন বড় বড় চোখ দুটো মেলে তাকায়, আমার সমস্ত সংকল্প পরাজিত হয়, আমি সবকিছু ভুলে যেতে বাধ্য হই। মহিলা আমার ইচ্ছেশক্তি হরণ করে ফেলে। তারপর আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছে করিয়ে নেয়। শামারোখকে নিয়ে এমন সংকটে পড়ে গেছি যে, সে কথা কাউকে বুঝিয়ে বলারও উপায় নেই। দুঃসহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে দিন-রাত্রি অতিবাহিত করছি আমি। এই ডাকিনী মহিলা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

এরই মধ্যে একদিন দুপুরবেলা শামায়োখ আমার ঘরে এল। তার আলুথালু চেহারা। চোখের কোণে কালি। পরনের শাড়ির অবস্থাও করুণ। মনে হলো সে কয়েকদিন স্নান করেনি এবং ঘুমোয় নি। এই রকম বেশে শামারোখকে আমি কোনোদিন দেখি নি। নিশ্চয়ই কোনো একটা অঘটন ঘটে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা হু হু করে উঠল। শামায়োখ তার কাঁধের থলেটা টেবিলের ওপর রেখে খাটে বসল। তার বসার ভঙ্গি দেখে আমি অনুমান করলাম শরীরের ওপর শামারোখের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অবস্থায় কি জিজ্ঞেস করব, আমি ভেবে স্থির করতে পারলাম না। আমি কিছু বলার আগে অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে শামারোখ বলল, জাহিদ ভাই, এক গ্লাস পানি দেবেন? আমি পানি গড়িয়ে তার হাতে দিয়ে বললাম, আপনার কি হয়েছে, মনে হচ্ছে আপনার গোসল এবং খাওয়া কোনোটাই হয় নি। শামারোখ সমস্ত পানিটা গলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে বলল, দুদিন ধরে আমি খেতে এবং ঘুমোতে পারছি নে। আমি বললাম, এক কাজ করুন, বাথরুমে গিয়ে আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি ডাইনিং হল থেকে খাবার নিয়ে আসি। শামারোখ বলল, খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না, আপনার কষ্ট করে লাভ নেই। আমি আপনার বিছানায় শুয়ে পড়লে আপনি কি রাগ করবেন? আমি একটুখানি আতঙ্কিত বোধ করলাম। শামারোখকে আমার বিছানায় শোয়া দেখলে অন্য বোর্ডাররা কি মনে করবে! হয়তো সবাই মিলে আমাকে এমন একটা অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে সিট রক্ষা করাটাও দায় হয়ে পড়বে। আমার আশঙ্কার কথাটা আমি শামারেখকে বুঝতে দিলাম না। আজকে ভাগ্য ভাল, হোস্টেলের বেশিরভাগ বোর্ডার টিভি রুমে ইংল্যাণ্ড এবং পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখতে গেছে। শামারোখকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি শোবেন, তার আগে একটু চেয়ারটায় এসে বসুন, আমি নতুন চাদরটা পেতে দিই। শামারোখ মাথা নেড়ে জানালো, না, তার দরকার হবে না। বলেই সে সটান বিছানার ওপর শরীরটা ছুঁড়ে দিল। শামায়োখ বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিন। শামায়োখ না বললেও আমাকে বন্ধ করতে হতো।

সামনের দরজা বন্ধ করে আমি পেছনের দরজাটা খুলে দিলাম। ঠিক এই সময় আমার কি করা উচিত স্থির করতে না পেরে সিগারেট জ্বালালাম। একটা কি দুটো টান দিয়েছি, এরই মধ্যে দেখি শামারোখ ফুলে ফুলে কেঁদে উঠছে। কান্নার তোড়ে তার শরীরটা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সিগারেট টানা যায় না। আমি সিগারেটটা ছুঁড়ে দিলাম। চেয়ারটা বিছানার কাছে নিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে শামারোখ, কাঁদছেন কেন? কান্নার বেগ একটু কমে এলে সে বলল, জাহিদ ভাই আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। তারপরে আবার কাঁদতে আরম্ভ করল । আমি কিছুক্ষণ তার বিছানার পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। একজন মহিলা আমারই পাশে বিছানায় কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে, অথচ আমি করার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি নে। এক সময়ে বাথরুমে গিয়ে তোয়ালে এনে তার মুখ মুছিয়ে দিলাম। এই কাজটা করতে গিয়ে আমার হাত কেঁপে গেল, শরীর কেঁপে গেল, কথা বলতে গিয়ে দেখি আমার কণ্ঠস্বরও কাঁপল। আগে শামারোখের শরীরের কোনো অংশ আমি এমনভাবে স্পর্শ করি নি। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শামায়োখ, বলুন, আপনি কাঁদছেন কেন? আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়িটা এখানে-ওখানে টেনেটুনে ঠিক করে দিলাম।

শামারোখ আমাকে বলল, জাহিদ ভাই, আপনার চেয়ারটা টেনে একটু কাছে এসে বসুন। আমি চেয়ারটা খাটের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে তার হাতটা তুলে নিলাম, কোমল স্বরে বললাম, বলুন শামায়োখ আপনার কি হয়েছে? সে বলল, জাহিদ ভাই, আমার সর্বনাশ হয়েছে। আমি মরে গেলেই সবচাইতে ভাল হতো। তারপর আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমার ইচ্ছে হয়েছিল, তার মুখে চুমু দিয়ে বসি। কিন্তু পারলাম না। হয়তো আমার সাহস নেই । অথবা বিপদে-পড়া মহিলার ওপর কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে আমার মন সায় দেয় নি। শামায়োখের হাতটা ধরে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আর শামারোখ অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে। আমি যদি চিত্রকর হতাম এই রোরুদ্যমান রমণীর একটা ছবি আঁকতাম । ক্রন্দনরত অবস্থায় শামায়োখের শরীর থেকে এক বিশেষ ধরনের সৌন্দর্য ফুটে বেরিয়ে আসছিল। তার শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে। তার স্তন জোড়া ঈষৎ হেলে পড়েছে। চুলের মধ্যে অনেকগুলো রূপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছি। তারপরও শামায়োখ এখনো কী অপরূপ সুন্দরী। দুধে-আলতায় মেশালে যে রকম হয়, তার গায়ের রঙ অবিকল সেরকম। উরু দুটো সুডৌল। পা দুটো একেবারে ছোট। গোড়ালির ফর্সা অংশটাতে জানলার ফুটো দিয়ে একটা তেরছা আলোর রেখা এসে পড়েছে। বার বার তাকিয়েও আমি চোখ ফেরাতে পারছি নে। বাম হাতটা বাঁকা করে বিছানায় এলিয়ে রেখেছে। কান্নার তোড়ে ঈষৎ হেলে-পড়া স্তন দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে মনে আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম। অর্ধ আবৃত এমন সুন্দরী একটা নারীর শরীর এত কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি। বালিশের দুপাশে তার চুলগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের অতল থেকে দেবী ভেনাসের আবির্ভাবের যে ছবি শিল্পী এঁকেছেন, শামারোখকে কিছুটা সেরকম দেখাচ্ছে। তার নাক-মুখ-চিবুক সবকিছু যেন দেবী ভেনাসের শরীরের অংশ। আমি এই রকম শরীরের কোনো নারী জীবনে দেখি নি। শামারোখ যদি সুস্থ শরীরে সচেতনভাবে নারীর সমস্ত স্বাভাবিক লজ্জা নিয়ে শুয়ে থাকত, তার এরকম অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশমান হয়ে উঠত না। সে কেঁদে যাচ্ছে, কান্নার তোড়ে তোড়ে শরীর থেকে একরকম করুণ দুঃখ জাগানিয়া সৌন্দর্য ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তার ডান হাতটা হাতে নিয়ে আমি অনেকক্ষণ অভিভূতের মতো বসে রইলাম।

একসময় তার কান্না বন্ধ হলো। সে উঠে বসল। আমাকে বলল, আরো এক গ্লাস পানি দিন। আমি গ্লাসটা হাতে দিলে আস্তে আস্তে পানিটা খেয়ে নিল। তারপর তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে গেল। অনেকক্ষণ সে বাথরুমে কাটালো। যখন বেরিয়ে এল তাকে অনেকখানি সুস্থির দেখাচ্ছিল। ভাল করে হাত-মুখ ধুয়েছে। মাথায়ও পানি দিয়েছে। চুলের উস্কখুস্কু ভাবটি এখন নেই। আমাকে বলল, আপনার তোয়ালেটা মোটা। এ-দিয়ে চুলের পানি বের করা যায় না। গামছা থাকলে দিন। ভাগ্যিস আমার একটা গামছা ছিল। সেটা তাকে দিলাম। চুলের সঙ্গে গামছাটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাক দিয়ে দিয়ে সমস্ত পানি বের করে আনল। তারপর আমার ক্রিমের কৌটো নিয়ে আঙুলে একটুখানি ক্রিম বের করে আলতো করে মুখে লাগালো। এই সবকিছু করার পর সে আবার গিয়ে চেয়ারের ওপর বসল। এসব কিছুই যেন সে ঘোরের মধ্যে করে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই পীড়াদায়ক নীরবতা আমার স্নায়ু-শিরায় চাপ প্রয়োগ করছিল। আর চুপ করে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।

একটু আগে তার হাতখানা হাতে নিয়ে আদর করেছি। দুহাতে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছি। এই গম্ভীর রূপ দেখে আমি তার শরীর স্পর্শ করার সাহসও হারিয়ে ফেললাম। নরম জবানেই বললাম, আপনার দুঃখের কথাটা জানাতে যদি আপত্তি না থাকে আমাকে বলতে পারেন। আমি তো আপনার বন্ধু । আমাকে দিয়ে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। পারলে আপনার উপকারই করব। আমার কথা শুনে শামায়োখের চোখ জোড়া ঝিকিয়ে উঠল। আপাদমস্তক আমার শরীরে তার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর সহসা দাঁড়িয়ে গেল, আবার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। আঙুলে চুলের একটা গোছা জড়াতে জড়াতে বলল, আপনি আমার উপকার করতে চান? তার কণ্ঠস্বরটা একটু অস্বাভাবিক শোনালো। আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে, অবশ্যই আপনার উপকার করব। শামারোখ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করুন। এ কী বলছে শামায়োখ, তার কাছ থেকে এ কী শুনলাম! ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও আমি এতটা আশ্চর্যান্বিত হতাম না।

তার প্রস্তাবটা শুনে আমি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। আমি স্বপ্নেও ভাবি নি মহিলার মুখ দিয়ে এরকম একটা কথা বেরিয়ে আসবে। আমি যদি উল্লসিত হয়ে উঠতে পারতাম, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারতাম, সেটাই সবচেয়ে ভাল হতো। কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হওয়ার কথায়, একরাশ দ্বিধা আমাকে জড়িয়ে ধরল। শামারোখের মনে আঘাত দেয়ারও ইচ্ছে আমার ছিল না, বিশেষ করে ওই অবস্থায়। আমি বললাম, শামারোখ, আপনি যে কোনো পুরুষ মানুষকে বিয়ে করতে বললে নিজেকে তার ভাগ্যবান মনে করার কথা। আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের কাছে কথাটা বলেছেন, সেজন্য আমি নিজেকে খুবই ধন্য মনে করছি। আপনার মুখে এই অপূর্ব কথা শুনলাম, আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আপনার আর আমার মধ্যে যদি কিছু নাও ঘটে শুধু ওই কথাটি আমার সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমাকে খুব কাছের এবং নির্ভরযোগ্য মানুষ মনে করেন বলেই এমন কথাটি বলতে পারলেন। কিন্তু তার আগে আমি যদি বর্তমান দুঃখের কারণটা জানতে চাই, আপনাকে কি খুব আহত করব? শামারোখ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, আপনাকে জানাতে আমার আপত্তি নেই।

তার কাহিনীটা সংক্ষেপে এইরকম: সোলেমান চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বিলেতে। তারা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। দুবছর এক ছাদের তলায় থেকেছেও। কথা ছিল দেশে এসে দুজন বিয়ে করবে। আমার এখানে আসা নিয়ে সোলেমানের সঙ্গে তার কিছুদিন খুব খিটিমিটি চলছিল । আসলে এটা একটা উপলক্ষ মাত্র। সোলেমান আরেকটা কম বয়সের মেয়ের সঙ্গে তলায় তলায় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। শামারোখের বাড়ি যাওয়া-আসা করত। তাদের বাড়িতেই এই তরুণীর সঙ্গে সোলেমান চৌধুরীর পরিচয়। আমার সঙ্গে শামারোখের একটা বিশ্রী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এই অজুহাত তুলে আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্রীটিকে বিয়ে করে ফেলেছে সোলেমান। আমাকে শামারোখ গ্রিন রোডের যে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তার মালিক সোলেমান চৌধুরীর খালাতো ভাই। একজন বয়স্ক ঠিকাদার এবং বিবাহিত। এখন সেই আদিলই দাবি করছে, তুমি আমাকে বিয়ে কর, আমি আগের বউকে তালাক দেব। শামারোখ যদি তাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি না হয়, রাস্তাঘাট যেখানে থেকে পারে ধরে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে। বাড়িতে শামারোখের বুড়ো বাবা এবং ছোট বোনটি ছাড়া কেউ নেই। কাহিনী শেষ করে সে বলল, আমি আবার একটু ঘুমোব। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

শামারোখ সেদিন সন্ধ্যেঅবধি আমার ঘরে ঘুমিয়েছিল। আমার অন্য এক জায়গায় যাওয়ার তাড়া ছিল। কিন্তু শামারোখের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া আমার সম্ভব হয় নি। তাকে একা ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলে আমি বাইরে যাই কী করে! সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে আমাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হলো। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, কেউ যদি এসে পড়ে! ব্যাপারটা পাঁচ কান হয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে আমাকে ভীষণ বেকায়দার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। আমাকে অপছন্দ করার মানুষের অভাব নেই। তাদের কেউ যদি এই অবস্থায় শামারোখকে দেখে ফেলে, হোস্টেলে আমার সিটটা রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

সাতটা বেজে গেল, এখনো শামায়োখের ঘুম ভাঙছে না। খুন করা লাশের পাশে খুনিকে পাহারা দিয়ে জেগে থাকতে হলে যে অবস্থা দাঁড়ায়, আমার দশাও এখন অনেকটা সেইরকম।

অবশেষে শামারোখের ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙ্গল বুঝতে পারলাম, তার চোখ দুটো মেলেছে। শামারোখ অনেকক্ষণ ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলছে না। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। তার যা মনের অবস্থা, কোনো ধরনের অসুখ বিসুখ যদি ঘটে যায়, আমি কি করব! আমাদের এই পুরুষদের হোস্টেলে ভদ্রমহিলাদের থাকার নিয়ম নেই। যদি সত্যি সত্যি শামারোখ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমি কি করে তাকে চলে যেতে বলব! নানারকম চিন্তা আমার মনে আনাগোনা করছিল। মানুষ তো খারাপটাই চিন্তা করে আগে। এক সময় শামারোখ কথা বলল, তার গলার স্বরটা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং ফাসফেঁসে শোনালো। মনে হলো, সে যেন স্বপ্নের মধ্যেই কথা বলছে, হাফিজ ভাই, আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। আমি বললাম পানি খাবেন? সে বলল, আপনার যদি কষ্ট না হয়, আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়ান। আমি চায়ের কেতলি হিটারে বসিয়ে বললাম, আপনি মুখ-হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নিন। আমার কথায় সে উঠে বসল এবং বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল। আমি চায়ের পেয়ালাটা তার হাতে তুলে দিলাম। প্রথম চুমুক দিয়েই সে বলল, জাহিদ ভাই, আজ রাতটা আপনার ঘরেই কাটিয়ে দেব। তার কথা শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি হন্যে হয়ে উঠেছি আর এখন মহিলা বলে কিনা আজ রাতটা আপনার ঘরে থেকে যাব। আমাকে বলতেই হলো, আমাদের এটা পুরুষ হোস্টেল, ভদ্রমহিলাদের তো থাকার নিয়ম নেই। শামায়োখ বলল, অনেক মহিলা তো থাকেন দেখলাম। আমি বললাম, তারা বোর্ডারদের কারো-না-কারো স্ত্রী। শামারোখ বলল, তাতে কি হয়েছে! আমিও তো আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়া আর বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করে এক ছাদের তলায় থাকা এক জিনিস নয়। ব্যাপারটা আমি শামারোখকে বোঝাবো কেমন করে? শামারোখ চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, আমার প্রস্তাবটা আপনার পছন্দ হলো না, তাই না? তাহলে তো চলেই যেতে হয়। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে সে তক্ষুনি পা বাড়ালো । আমি হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, কথাটা এভাবে বলছেন কেন? আপনি প্রস্তাবটা করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তার আগে কতগুলো কথা তো চিন্তা করে দেখতে হবে। সে বলল, আপনি কি মনে করেন, আমি চিন্তা না করেই কথাটা আপনাকে বলেছি। আমি বললাম, সেটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। মানসিকভাবে আজ আপনি খুব অস্থির এবং বিপর্যস্ত। জ্বরের তাপ যখন বেশি থাকে, গরম পানি পান করতে নেই। আপনি এই অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে ভেবে-চিন্তে যদি আবার আমার কাছে বলেন, সবকিছু জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চান, আমি মনে করব, আমার হাতে স্বর্গ চলে এসেছে।

তারপর তাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তার বোনের বাড়িতে যেতে রাজি করাই । আমি তাকে বাবার বাড়িতে যেতেই বলেছিলাম। কিন্তু শামারোখ বলল, ময়না মানে তার বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে ঝগড়া চলছে। উপস্থিত মুহূর্তে সেই অগ্নিকুণ্ডে ফিরে যাওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই । বোনের বাড়িতে যেতেও রাজি করাতে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়েছে। শামায়োখ বলল, আপনিও মিষ্টি কথায় আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি ভেবেছিলাম আপনি লোকটা ভাল। এখন দেখছি, আপনিও অন্য দশটা পুরুষ মানুষের মতো। আমি আমার দুর্বলতার কথাটা প্রকাশ করে ফেলেছি, এখন আপনি আমাকে নোংরা আবর্জনার মতো দূরে ছুঁড়ে ফেলতে পারেন। আমি বললাম, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। ধরুন, আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। আজ যদি এই ঘরে আপনি রাত কাটান, আর সে কথাটা যদি ছড়িয়ে যায়, আপনার আমার দুজনের সামাজিক সম্মানের জন্য কাজটা মোটেও ভাল হবে না। শামায়োখ ফুঁসে উঠে বলল, সমাজ আমাকে খাওয়ায়

পরায়, যে আমি সমাজের ধার ধারব? আমি বললাম, আপনি যখন সমাজে বাস করবেন, আপনাকে সমাজের ধার ধারতেই হবে। সমাজ যখন আক্রমণ করে, সেটা অবহেলা করে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আঘাতটা গায়ে ঠিকই বাজবে। শামারোখ এবার নরম হয়ে এল। ঝোলা থেকে চিরুনি বের করে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিল। শাড়িটা ভাল করে পরল। দুজনে হেঁটে গিয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসলাম। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হলো না। নীলক্ষেত ছাড়িয়ে যাওয়ার পর শামারোখ আমার কাঁধের ওপর তার ক্লান্ত মাথাটা রাখল।

ধানমন্ডিতে তার বোনের বাড়িতে শামারোখকে রেখে আসার পর আমি সরাসরি ঘরে ফিরতে পারলাম না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কতবার যে এ-মাথা ও-মাথা করেছি, তার কোনো হিসেব নেই। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে । আমার গায়ে কোনো শীতের কাপড় নেই। তবু আমি খুব গরম অনুভব করছিলাম। ওই একটা দিনের মধ্যে আমার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। পরস্পর বিপরীতমুখী চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে আমার কাঁধ দুটো নুয়ে আসছিল। আমি কি করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

এই মহিলাটি আমাকে ভালোবাসে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। প্রাণ থেকে ভাল বাসলে এতখানি এগিয়ে এসে এরকম একটি প্রস্তাব করতে পারত না। এই অপরূপ সুন্দর মহিলার কি নেই, সবইতো আছে। তার গানের গলা চমৎকার। তার কবিতার মধ্যে মেধা ঝিলিমিলিয়ে জ্বলতে থাকে। মনে দয়ামায়া আছে। এরকম একজন সুলক্ষণা নারীর জন্য সেকালের রাজারা যুদ্ধ করতেও কুণ্ঠিত হতেন না । একটা মাত্র ইঙ্গিতে এই নগরীর ধনবান, রূপবান এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা কীভাবে ছুটে এসে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, সে দৃশ্য আমি অনেকবার দেখেছি।

আমার নিঃসঙ্গ জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, শামারোখ এক দুপুরবেলা আপনা থেকেই এসে আমার আধ-ময়লা বিছানায় দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল, তার জীবনের মর্মান্তিক পরাজয়গুলোর কথা আমার কাছে প্রকাশ করে অঝোরে কেঁদেছিল। তারপর নিজের মুখেই আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। আমার মৃত্যুর পূর্ব-মূহূর্ত পর্যন্তও এই ঘটনাটি দীপ্তিমান হীরক খণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবে। কী সৌভাগ্যবান আমি, মনে হচ্ছিল, আমি হাত বাড়িয়ে আকাশের তারাগুলো ছুঁয়ে ফেলতে পারি। শামারোখ আমার ভেতরে একটা অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

পাশাপাশি বিপরীত একটা চিন্তার ধারাও আমার মনে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই মহিলাকে রাজার ঘরে মানায়। যার দোতলা বাড়ি আছে, বাড়ির সামনে লন আছে, লনের একপাশে বাগান আছে, গ্যারেজে হাল মডেলের গাড়ি আছে, গেটের সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে, আসতে-যেতে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম ঠোকে, সেই রকম একটি বাড়িতে এই মহিলাকে চমৎকার মানায়। বিদেশী ফার্নিচার ভর্তি ড্রয়িং রুমের কার্পেটের ওপর লঘু চরণ ফেলে এই মহিলা চলাফেরা করবে, তার পায়ের ছোঁয়ায় কার্পেটের বাঘ জীবন পেয়ে আবার পায়ের কাছেই অনুগত সেবকের মতো লুটিয়ে পড়বে। এই মহিলা আমাকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমি কি করব? ধরে নিলাম, মহিলার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। মহিলা আমাকে নিয়ে একদিন-না একদিন তার পুরুষ বন্ধুদের সামনে হাজির করবে। আমার গ্রামীণ করুণ চেহারা নিয়ে তারা আমাকে ভ্যাঙচাবে। হতে পারে শামারোখ আমার অপমানকে তার নিজের অপমান বলবে, এই কুত্তার বাচ্চাদের সঙ্গে লড়াই করে প্রমাণ কর যে তুমি তাদের চাইতেও যোগ্য পুরুষ। আমি পুরুষ বটে, কিন্তু ও নিয়ে আমার বিশেষ গর্ববোধ নেই। আমি অত্যন্ত ভীতু মানুষ, ঝগড়া-ঝাটি করাও আমার ধাতে নেই। সুতরাং শামারোখের খাতিরেও কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া আমার পোষাবে না ।

শামারোখ ভালোবাসতে জানে, একথা অস্বীকার করি নে। তার সৌন্দর্য, তার রুচিবোধ, তার শিক্ষা কারো কাছে নগদ মূল্যে বিক্রি করার প্রবৃত্তি শামায়োখের হবে না, সে কথা আমি ভালভাবেই জানি। কিন্তু শামারোখের ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের আরো একটা দিক সম্পর্কে আমি জানি। শামারোখ ভালোবাসার কাছে যতই অসহায় বোধ করুক কিন্তু তার যে বিশেষ মূল্য আছে, সেটা সে মর্মে অনুভব করে। তার মনের একটা কামনা পুরুষ মানুষেরা তাকে নিয়ে পরস্পর শক্তি-পরীক্ষায় অবতীর্ণ হোক। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে সে ভীষণ আনন্দ পেয়ে থাকে। সব জেনে-শুনেও শামারোখের এই ইঁদুর-ধরা কলে আমি কী করে ঢুকে পড়ি।

শামায়োখের বাড়িতে আমি গিয়েছি এবং দেখেছি, আপন বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কীভাবে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে থানায় গিয়ে নালিশ করার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। আমার মনে হলো শামারোখের সঙ্গে একই ছাদের তলায় একমাসও যদি আমাকে থাকতে হয়, তাহলে সে আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলবে অথবা আমি তাকে খুন করে ফেলব। সমস্ত বিষয় চিন্তা করে আমার মনে হলো, আমি যেমন মাতৃগর্ভে আবার ফেরত যেতে পারি নে, তেমনি শামারোখকে বিয়ে করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। অসম্ভব এই কথাটি মনে হওয়ায় আমার দু’চোখের কোণায় পানি দেখা দিল। আমি নিজেকে ধিক্কার দিলাম। পুরুষ মানুষ হয়ে আমার জন্ম হয়েছিল কেন? একটি অসহায় নারী শেষ ভরসাস্থল মনে করে আমার কাছে ছুটে এসেছিল, আমি চূড়ান্ত অপমান করে তাকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। আমি কি এতই পাষণ্ড যে ঈশ্বরের দান করা এই সৌন্দর্য এবং মেধাকে আমি অপমান করতে পারি! আমি কাপুরুষ নই, পাষণ্ডও নই, একথা আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো। শামারোখ আমাকে বলুক তার পেছন পেছন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছুটে যেতে, কোনোরকম দ্বিধা-সংশয়ের বালাই না রেখে এক কাপড়ে আমি তার পেছন পেছন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছুটে যেতে পারি। শামারোখ আমাকে নির্দেশ করুক অন্য কোনো নারীর মুখের দিকে না তাকাতে, সমস্ত জীবন আমি শামারোষের মুখমণ্ডলের কথা চিন্তা করে কাটিয়ে দিতে পারব।

পারব শামারোখকে খুন করে কবর দিয়ে সেই কবরের পাশে মোমবাতি এবং ধূপধুনো জ্বালিয়ে সেবায়েত হিসেবে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে। ওপরে যা বললাম, শামায়োখের জন্য তার সবটা আমি করতে পারব। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারব না। আমার চাকরিবাকরি নেই। আগামী মাসে কোথায় যাব, কি করব জানিনে। আমার বাড়িঘরের দুর্দশার অন্ত নেই। যেদিকেই তাকাই দাঁড়াবার সামান্য জায়গাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। সুতরাং শামারোখকে নিয়ে এমন একটা জুয়াখেলায় মেতে উঠব কেমন করে! মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন রাজা হওয়ার প্রস্তাবও অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করতে হয়। একদিকে অসহায়তা, অন্যদিকে কাপুরুষতা আমাকে চিরে যেন দুটুকরো করে ফেলছিল। এই ঠাণ্ডাতেও আমার শরীরে ঘাম দেখা দিল। আমি চাপাগাছটার গোড়ায় হেলান দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, এ অবস্থায় আমি কিভাবে শামারোখের কাজে আসতে পারি? অঙ্গভরা সৌন্দর্য এবং তুলনা-রহিত হৃদয়বৃত্তির অধিকারী এই অসাধারণ নারী সব কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য আমি ঝুঁকি নিয়ে হলেও কিছু যদি না করতে পারি, আমার মানবজনম বৃথা। শামারোখ যাতে সম্মান নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে ব্যাপারে কিছু করার চেষ্টা তো আমি করতে পারি । আবার মনে পড়ল, শামায়োখ প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্যই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমি তার চাকরিটার চেষ্টাই করি না কেন? কিন্তু আমি কতটুকু সাহায্য করতে পারি? বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিটাই হয় নি, সেই আমি শামারোখকে চাকরি দেব কেমন করে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কর্তাব্যক্তি তাদের একটা ত্রুটি ঢাকা দেয়ার জন্য, শামারোখ যাতে কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে না পারে, তার জন্য সবাই এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমি ধৈর্য ধরে টানাটানি করলে হয়তো মোষের শিং থেকে দুধ বের করে আনতে পারব, কিন্তু এই নিষ্ঠুর মানুষগুলোর প্রাণে দয়া এবং অনুকম্পা সৃষ্টি করব কেমন করে? তক্ষুনি আমার, কেন বলতে পারব না, প্রধানমন্ত্রীর কথাটা মনে হলো। আজকাল তার ইচ্ছেতেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে সব কিছু ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী যার কথা শুনবেন, এমন একজন মানুষ আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার মনে হঠাৎ করেই সৈয়দ দিলদার হোসেনের মুখখানা ভেসে উঠল।

গত এক সপ্তাহ ধরে আমার মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমার এই মানসিক অবস্থা বন্ধু-বান্ধব কারো কাছে তুলে ধরতে পারছি নে। আমার অকৃত্রিম বন্ধুদের প্রায় সবাই পরামর্শ দিয়েছিলেন শামারোধের সঙ্গে আমি যেন মেলামেশা না করি । কারণ তারা মনে করেন, শামারোখ আমাকে বিপদে ফেলে দেবে। এই বন্ধুদের কাছে আমার মুখ খুলবার উপায় নেই। আর যারা আমার নামকাওয়াস্তে বন্ধু, তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করার প্রশ্নই ওঠে না। এরা মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি, আমাকে তারা মনে মনে ভীষণ ঈর্ষা করে। আমি সবদিক দিয়ে একজন দাগ-ধরা মানুষ। দেখতে আমি সুদর্শন নই, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার উজ্জ্বল কৃতিত্বের দাবিদার নই। আমার টাকা-পয়সা নেই এবং পেশায় আমি একজন বেকার। এইরকম একজন মানুষের সঙ্গে শামারোখের মতো একজন রূপসী মহিলা সকাল-দুপুর ঘোরাঘুরি করবে, তারা সেটা সহ্য করবেন কেন? পথে ঘাটে দেখা হলে তাদের কেউ কেউ চিকন করে হাসে। তাদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে বসে, কি ভায়া, প্রেম-তরণী কোন ঘাটে নোঙর করল? হালটা শক্ত হাতে ধরবে। যদি একেবারে ভেসে যাও, সেটা ভাল কাজ হবে না।

শামারোধের সঙ্গে মেলামেশার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে আমি আমার শিক্ষকদের সঙ্গেও দেখাশোনা করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ তাদের অনেকেই এর মধ্যে সিদ্ধান্ত করে বসে আছেন আমি শিক্ষক সমাজকে অপমান করার জন্যই শামারোখকে নিয়ে এমন বেপরোয়াভাবে সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করছি। নিজের ভেতরে সন্দেহ, সংশয় এবং অনিশ্চয়তার যখন পাহাড় জমে ওঠে এবং সেটা যখন কারো কাছে প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, যন্ত্রণা তখন হাজার গুণে বেড়ে যায় ।

আমি যদি শামারোখের কথা মাফিক তাকে বিয়ে করে ফেলতাম সেটা খুব ভাল কাজ হতো। হয়তো এ বিয়ে টিকত না। অনেক বিয়েই তো টেকে না। কিন্তু আমি মনের ভেতরে কোনো সাহস সঞ্চয় করতে পারছি নে। শামারোখকে বিয়ে করলে আমাকে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে একটা বাসা করতে হবে। আমার চাকরিবাকরিও কিছু নেই। বাসা ভাড়া দেব কেমন করে? আর শামারোখকে চালাবোও-বা কেমন করে? শামায়রাখের যদি একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় থাকত, তা হলেও না হয় চিন্তা করা যেত। ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হওয়ার কথা দূরে থাক, ওর নিজেরও ঠাই নেই। তাকে বড় ভাইয়ের বউয়ের হাতে রীতিমতো অপমান সহ্য করে সে বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। শামারোখ একটা ভাসমান অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাকে আমি এই কমাসে যতদূর বুঝতে পেরেছি, এই মানসিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের পেছনে সত্যিকার ভালোবাসা সত্ত্বেও আমি তাকে একবিন্দু নিশ্চয়তাও দিতে পারব না। শামারোখকে নিয়ে আমি কি করব?

আমি যদি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি, শামায়োখ যেসব মানুষের হাতে গিয়ে পড়বে, যাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, হয়তো তাদের একজনকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। আমি জানি শামারোখের মাথায় অনেক রকমের কিড়ে আছে, কিন্তু তার যে লোভ নেই, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই যদি থাকত এই সমস্ত টাকাঅলা প্রতিষ্ঠাবান মানুষদের কোনো একজনকে সরাসরি সে বিয়ে করে ফেলত। শামারোখ তার শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন, একথা সত্য। কিন্তু মানসিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটি তার কাছে তারও চাইতে বড় । কিন্তু পরিস্থিতি যখন চাপ দিতে থাকে, অনেক সময় বনের বাঘও ঘাস চিবিয়ে খেতে বাধ্য হয়। অস্তিত্বের যে সংকট কোনো মানুষই সেটা অতিক্রম করতে পারে না। শামারোখের পছন্দ করার গণ্ডি অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। ওই অবস্থায় সে ওই তাড়িয়ে-বেড়ানো লোকদের ভেতর থেকে যদি একজনকে বিয়ে করে বসে, হয়তো জীবনে অসুখী হবে। কিন্তু আমি সবার উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে। সবাই বলবে, আমি এতদিন শামায়োখের ভেড়য়াগিরি করে কাটিয়েছি। এতদিন সে আমাকে দেহরক্ষী হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং যখনই সুযোগ পেয়েছে আমাকে ল্যাং মেরে এক ধনী লোকের ঘরণী হয়ে বসেছে। কারো কাছে আমার মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। সবাই আমাকে করুণা করবে। যতই ভেতরের কথা আমি বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করি কেন, কে আমার কথা বিশ্বাস করবে?

আমি তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম ওই অবস্থা থেকে শামায়োখকে এবং আমাকে উদ্ধার করার জন্য এমন একটা কিছু করা প্রয়োজন, যাতে করে অল্প পরিমাণে হলেও শামারোখ তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে । ভেবে ভেবে ঠিক করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটি যদি সে কোনোভাবে পেয়ে যায়, আপাতত সবদিক রক্ষা পেতে পারে। আমি মনে মনে সান্ত্বনা পাব এই ভেবে যে, শামারোখকে একটা অবস্থানে অন্তত দাঁড় করিয়ে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে পেরেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা তাকে ঢুকতে না দেয়ার জন্য যে ধনুক ভাঙা পণ করে বসে আছেন, সেটাও ভেঙে ফেলা যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুই ঘটছে না। যদি কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রী অবধি যাওয়া যেত একটা রাস্তা হয়তো পাওয়া যেত। আমি একথা আগেও চিন্তা করেছি।

চিন্তাটা মাথায় রেখেই মতিঝিলে দিলদার হোসেন সাহেবের অফিসে গেলাম। আমি তাকে অফিসের সামনেই পেলাম। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে দরাজ গলায় হুংকার ছাড়লেন, এই যে ছোঁড়া এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে, আস নি কেন? আমি আমতা আমতা করে বললাম, দিলদার ভাই, হঠাৎ করে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, সে জন্য আসতে পারি নি। দিলদার সাহেব জোরালো গলায় বললেন, জানি, জানি, সব খবর জানি। আমার কাছে কোনো সংবাদ গোপন থাকে? এমন এক সুন্দরীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, যাকে দেখলে ঘোড়াগুলো পর্যন্ত নাকি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সব জায়গায় যাচ্ছ, আমার কাছে আস নি কেন? আমি কি তোমার সঙ্গে ভাগ বসাতে চাইতাম? ছোঁকড়া এখন তোমরা ওড়ার চেষ্টা করছ। এক সময় আমাদেরও দিন ছিল, আমরাও চুটিয়ে প্রেম করেছি হে। তুমি একা কেন? তোমার সুন্দরী কোথায়? সেই সময়ে তার হাঁপানির টানটা প্রবল হয়ে উঠল। তিনি চেয়ারে বসে পকেট থেকেই ইনহেলার বের করে টানলেন। তারপর দুতিন মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

দিলদার হোসেন সাহেব একজন সত্যিকার ডাকাবুকো স্বভাবের মানুষ। তিনি ভাল কি মন্দ এসব কথা চিন্তা করার সময় আমার হয়নি। ওই মানুষটির পৌরুষ এবং সাহস আমাকে সব সময় আকর্ষণ করেছে। হাঁপানি তাকে কাবু করে ফেলেছে। তারপরও এই প্রায় ছয় ফিট লম্বা মানুষটা যখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান, তাকেও আমার চিরন্তন যৌবনের প্রতীক বলেই মনে হয়। তার কাছে অসম্ভব বলতে কিছু নেই, সব সময় যেন ঝুঁকি গ্রহণ করতেই তিনি তৈরি হয়ে রয়েছেন।

কঠিন সমস্যায় পড়লেই মানুষ তার কাছে আসে। তিনি সবকিছু মোকাবেলা করেই যেন আনন্দ পেয়ে থাকেন। কেউ টাকা-পয়সা চাইলে উদার হাতে বিলিয়ে দেন। আবার কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিজে গ্রহণ করলে শোধ দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে যেতেও কসুর করেন না। ক্লাবে বসে গ্লাসের পর গ্লাস তাজা হুইস্কি যেমন পান করেন, তেমনি তাকে তার অত্যন্ত গরিব পিয়নের সঙ্গে কচুর লতি দিয়ে পান্তা ভাত খেতেও দেখেছি। এই মানুষটাকে আমি কোনো সীমা, কোনো সংজ্ঞার মধ্যে বাঁধতে পারি নি, যেন অনায়াসে সব কাজ করার জন্যই তার জন্ম হয়েছে।

কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি ছন্দ-মাত্রা মিলিয়ে নিখুঁত কবিতা লিখে দিতে পারেন। অবসরে হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের চেয়ার-টেবিল বানাতে তার জুড়ি নেই। তার গাড়িটা বিকল হলে মিস্তিরি ডাকার বদলে নিজেই আধময়লা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে গাড়ির তলায় শুয়ে নাট-বল্ট খুলে খুলে মেরামত করে ফেলেন। এক সময় রেসের ঘোড়া পুষতেন। এক সময়ে গরুর ব্যবসাও করেছেন বলে শুনেছি। দিলদার সাহেব এত প্রবলভাবে বেঁচে আছেন যে কোনো ব্যাপরে তার বাছ-বিচার নেই বললেই চলে। এই বুড়ো বয়সেও এক তরুণীকে কেন্দ্র করে তার নামে কেলেংকারীর কাহিনী রটে যায়। এই নিয়ে তার অত্যন্ত আধুনিকা রুচিবান স্ত্রী রাগারাগি করলে সেই তরুণীকে বিয়ে করে ফেলেন। বাড়িটা ছিল স্ত্রীর নামে। মহিলা তাকে খোটা দিলে দিলদার সাহেব বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে অফিসে থাকতে আরম্ভ করেন। তখন তার হাতে বিশেষ টাকা-পয়সা ছিল না। বন্ধু-বান্ধব একে তাকে ধরে আরেকটা বাড়ির ব্যবস্থা করেন এবং তখন তিনি নতুন স্ত্রী নিয়ে সেই বাড়িতেই থাকছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছেন, যেগুলো আমাদের চোখেও মনে হয়েছে রীতিমতো অন্যায়। যখন কৈফিয়ত চেয়ে জিজ্ঞেস করেছি, দিলদার ভাই ও কাজটা কেন করলেন, তিনি দরাজ গলায় জবাব দিয়েছেন, আমার খুশি আমি করেছি। তোমার খারাপ লাগলে আসবে না। আমি ঘ্যানঘ্যান করা অপছন্দ করি।

দিলদার সাহেবের হাঁপানির টানটা কমে এলে আমি তার কাছে শামারোখের চাকরি সংক্রান্ত কাহিনীটি বয়ান করি। তার বর্তমান অসহায়তার কথাটাও উল্লেখ করি। তিনি আমার কথা শুনে ক্ষেপে উঠলেন, শালা তুমি একটা আস্ত হিজড়ে, কিছু করার মুরোদ নেই, আবার ওদিকে প্রেম করার শখ। দিলদার সাহেব, ওরকমই । প্রথমে একচোট গালাগাল শুনতে হবে, সেটা জেনেই এসেছি। আমি চুপচাপ অগ্ন্যুৎপাতটা হজম করলাম। তিনি কাজের ছেলেটাকে ডেকে হুকুম করলেন, এই বাচ্চা, দু-কাপ চা লাগাও। তিনি নিজের কাপটা টেনে নিয়ে আমাকে বললেন, চা খাও। চায়ে চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বুঝলাম, প্রথম ধকলটা কেটে গেছে। এখন তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা যাবে। তিনি বললেন, শালা তোমার অবস্থা হয়েছে পীরের বাড়ির কলা চোরের মতো। চোর পীরের বাড়ির কলার ছড়াটা কেটেছিল ঠিকই। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার বেলায় দেখল ব্যাটার এক পা-ও নড়ার সাধ্য নেই । পীর সাহেব দোয়া পরে কলার ছড়াটা আগে থেকেই রক্ষা করার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তা আমার কাছে কেন এসেছ, সেটা আগে বলে ফেল। তোমার সামান্য লাজ-লজ্জাও নেই। প্রেম করবে তুমি আর কষ্ট দেবে আমাকে। শালা, আমার যে তোমার বাপের মতো বয়স, সে কথাটি খেয়াল করেছ? দিলদার সাহেবের এসব কথা তো শুনতেই হবে।

আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রীকে যদি একবার অনুরোধ করা যায়, তাহলে হয়তো শামারোখ কাজটা পেতে পারে। আজ আমার কপালটাই খারাপ। দিলদার সাহেব ফের চটে গেলেন। তোমার কি আক্কেল, একটি মেয়ে মানুষের সঙ্গে তুমি প্রেম করবে, আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তার চাকরির ব্যবস্থা করবেন। এই জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছ তোমাদের মতো লোকদের জন্যই দেশটা গাড়ায় পড়ে আছে।

আমার মনটা দমে গেল। দিলদার সাহেব বোধহয় আমার অনুরোধটা রাখবেন না। আমি অনুভব করছিলাম, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। দিলদার সাহেব পাঞ্জাবির গভীর পকেট থেকে নস্যির কৌটোটা বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অমন করে আচাভুয়োর মতো বসে রইলেন কেন? এখন কাটো, আমার কাজ আছে।

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। আমার কণ্ঠ দিয়ে সমস্ত আকুলতা মেশানো একটা স্বরই শুধু বেরিয়ে এল, দিলদার ভাই। আমার মনে হচ্ছিল আমি কেঁদে ফেলব। হঠাৎ দিলদার সাহেবের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পেলাম । তার চোখ জোড়া মমতায় মেদুর হয়ে এসেছে। তিনি বললেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা সেকি চাট্টিখানি কথা! তুমি তো শালা মিনমিন কর। হুলো বেড়ালের মতো ইশক মাথায় উঠে গেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলব কি? কাগজপত্র কোথায়, তোমার সুন্দরীকে নিয়ে আসবে আগামী শনিবার। মনে মনে তৈরি থাকবে যদি আমার মনে ধরে যায় আর ফেরত পাবে না।

শনিবার সকালে আমি শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গেলাম। তখন বেলা বড়জোর আটটা। শামারোখের বাবা খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি সব লেখালেখি করছেন। খাটে ছড়ানো আরবি বই । হয়তো তিনি কোরআনের সেই তরজমার কাজটাই করছেন। ভদ্রলোকের গায়ে একটা অতি সাধারণ গামছা। তাতে পিঠের একাংশ মাত্র ঢাকা পড়েছে। আমি দেখতে পেলাম তার সারা শরীরে লম্বা সাদা লোমে ভর্তি। আমি সালাম দিলাম । উত্তর দেয়ার বদলে ভদ্রলোক বললেন, টুলু তো ঘুমিয়ে আছে। আমি বললাম, একটু ডেকে দেয়া যায় না? ভদ্রলোক বললেন, আমি তো মেয়েদের ঘরে যাই নে। আমি একটু চাপ দিয়েই বললাম, ডেকে দিতে হবে, একটা দরকার আছে। ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন, কিন্তু খাট থেকে নেমে মোটর টায়ারের স্যান্ডেলে পা গলিয়ে একটুখানি ভেতরে গিয়ে ডাকতে লাগলেন, ও টুলু, টুলু, ওঠো। তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এক ভদ্রলোক এসেছেন।

কে আব্ব, শামারোখের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

তার বাবা বললেন এক ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য বসে আছেন।

এত সকালে আবার কে এল? আর পারি নে বাবা! শামারোখের করুণ ক্লান্ত কণ্ঠ। কলের পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম, শামারোখ বাথরুমে ঢুকেছে।

আমাকে বেশিক্ষণ বসতে হলো না। শামারোখ দরজার ভেতর থেকেই আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, ও, আপনি? তার গলার স্বর আটকে গেল। সেই রাতে ফেরত পাঠাবার পরে শামারোখের সঙ্গে আমার আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। আমাকে দেখে সে খুশি হয়েছে, চোখ-মুখের ভাব থেকেই সেটা ফুটে উঠেছে। আমি বললাম, শামারোখ আপনি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলোও সঙ্গে রাখবেন । এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে ।

শামারোখ বলল, আপনি সকালে নাশতা করেছেন? আমি বললাম, না। সে বলল, বসুন নাস্তা দিতে বলি। আমি বললাম, সময় হবে না, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। পথে কোথাও নাশতা খেয়ে নেয়া যাবে। শামারোখের একটি অভ্যাসের তারিফ অবশ্যই আমাকে করতে হবে। ভদ্রমহিলারা সাধারণত বাইরে বেরুবার আগে সাজতেগুজতে এত সময় ব্যয় করে ফেলেন যে অপেক্ষমাণ লোকটির চূড়ান্ত বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়েন। শামারোখ এদিক দিয়ে অনেক নির্ভার। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই পরনের শাড়িটা পাল্টে একটা ফাইল হাতে করে বেরিয়ে এল।

আমরা একটা রিকশা নিলাম এবং পুরনো পল্টনের মোড়ে এসে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে নাশতাটা সারলাম। খেতে বসেই আমি শামারোখকে দিলদার সাহেব সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করলাম। আমাকে খুব বেশি বলতে হলো না। শামারোখ নিজেও দিলদার হোসেন সাহেবকে চেনে। আমি আরো বললাম, আমি তাকে তার চাকরিটার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতে দিলদার সাহেবকে একরকম রাজি করিয়েছি। বিস্ময়ে শামারোখের চোখজোড়া কপালে উঠে গেল, এখনো আপনি আমার চাকরির কথা মনে রেখেছেন? আমার ডান হাতে সে একটা চাপ দিল। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। শামারোখকে আজ অনেকটা সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।

দিলদার হোসেন সাহেব অফিসে একা ছিলেন। আমরা যখন স্যুয়িং ডোর টেনে ভেতরে ঢুকলাম, তিনি কলকণ্ঠে অভ্যর্থনা জানালেন, এসো। আমি এখন বুড়ো হয়ে গেছি, মহিলারা আর আমার খোঁজ নিতে আসে না। শামারোখের একটা সুন্দর জবাব যেন তৈরি হয়েই ছিল। সে বলল, আপনি একটা খবর দিলেই তো পারতেন। আমি চলে আসতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের খতরনাক লোকগুলো তোমাকে আটকে দিয়েছে, না? কাগজপত্রগুলো বুঝিয়ে দাও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা সম্ভব হয়েছে। দিলদার সাহেবের কথা শেষ হতেই আমার গা থেকে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। আমি আশঙ্কা করেছিলাম দিলদার সাহেব তার খিস্তির তোড়ে আমাদের নাজেহাল করে ছাড়বেন। আজকে তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যবহার করলেন।

আমরা কাগজপত্র বুঝিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আজকে আমার হাতে সময় নেই। আরেকদিন এসো, গল্প করা যাবে। দেখি তোমাদের জন্য কিছু করা সম্ভব হয় কিনা। তিনি বাইরে বের হবার জন্য পা বাড়ালেন । আমাদেরও উঠতে হলো।

সাত আট দিন পর দিলদার হোসেন সাহেবের অফিসের পিয়ন একটা চিরকুট নিয়ে এল। তিনি লিখেছেন, ‘জাহিদ, তুমি আগামীকাল সন্ধ্যে বেলা তোমার বান্ধবীকে নিয়ে ডেইজির বাড়িতে আসবে। তুমি বোধহয় জানো, আমি এখন ডেইজির ওখানে থাকি। ডেইজি বড় একা থাকে। তোমাদের দেখলে খুশি হবে । রাতের খাবারটাও ওখানে খাবে। তোমার বান্ধবীর জন্য একটা সুখবর আছে। সাক্ষাতে জানাবো । জায়গাটা একটুখানি দুর্গম । কিভাবে আসবে পথের ডিরেকশানটা দিচ্ছি। এগার নম্বর বাস স্টেশনের গোড়ায় এসে নামবে । তারপর হাতের ডানদিকে একটি চিকন গলি পাবে। সেই গলি দিয়ে হাজার গজের মতো এসে দেখবে গলিটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা আরেকটা গলিতে এসে মিশেছে। যে নতুন গলিটা পাবে তার ডান দিকটাতে ঢুকবে। পাঁচশ গজের মতো সামনে এগুলে একটা তালগাছ চোখে পড়বে। সেই তালগাছের পাশ দিয়ে দেখবে আরেকটা চিকন পথ আবার পুবদিক গেছে। কিছুদূর এলেই একটা ধানখেত এবং ধানখেতের পাশে পুকুর দেখতে পাবে। পুকুরের উত্তর পাড়ে টিনের বেড়া এবং টিনের ছাউনির একটা ঘর দেখতে পাবে। সেই ঘরটাতেই এখন আমরা থাকছি। রাস্তা চেনার জ্ঞান তোমার অল্প। সে জন্য পথের নিশানাটা চিঠির পেছনে এঁকে পাঠালাম। একটু বেলা থাকতেই এলে তোমাদের বাড়িটা খুঁজে নিতে সুবিধে হবে। যদি রাত করে আস, বিপদে পড়ে যেতে পার । এদিকটাতে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। একবার কারেন্ট গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আর রাস্তা-ঘাটে ডাকাত হাইজ্যাকারদের বড় উৎপাত।

আমি চিঠিটা নিয়ে শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গেলাম। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কড়া নাড়তেই খুলে গেল। শামারোখকেই সামনে পেয়ে গেলাম। মনে হলো সারা বাড়িতে আর কেউ নেই। আগে যখনই গিয়েছি প্রতিবার তার বাবাকে খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ে কোরান অনুবাদ করতে দেখেছি। আজ তাকে দেখলাম না। খাটময় আরবি-বাংলা কোরআন এবং কোরআনের তফসির ইতস্তত ছড়ানো। কি কারণে জানি নে আজ শামারোখের মুখখানা অসম্ভব রকমের থমথমে। তার এ-রকম মূর্তি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সে ঠাণ্ডা গলায় আমাকে বলল, বসুন। দড়িতে ঝোলানো গামছাটা নিয়ে কাঠের চেয়ার থেকে ধুলো মুছে দিল। আমি জুত করে বসার পর শামারোখ ভেতর থেকে এসে একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, আপনার জন্য চা করে আনি। ততক্ষণে বসে বসে এগুলো পড়ে দেখুন।

রুল করা দামি কাগজ। এক পাশে ফাঁক ফাঁক করে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে লেখা। শিটগুলো নাড়াচাড়া করতেই নাকে মিষ্টি মতো ঘ্রাণ পেয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই এই কাগজের শিটগুলোর সঙ্গে সেন্ট বা এসেন্স জাতীয় কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। দুএকটা বেয়াড়া রকমের বানান ভুলও লক্ষ্য করলাম। হাতের লেখা দেখে মনে হলো, যে ভদ্রলোক লিখেছেন তার মনটা বিক্ষিপ্ত । পড়ে ফেললে তো ভালমন্দ যাই থাকুক জেনে যাব! আর জেনে গেলে তো সমস্ত কৌতূহলের অবসান হয়ে গেল ।

আমি কাগজের শিটগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিলাম। তারপর সিগারেট ধরালাম। আগে শামারোখ চা নিয়ে আসুক। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখা যাবে শিটগুলোতে কি আছে । দিলদার সাহেবের চিঠিটা আমার পকেটের ভেতর থেকে কৈ মাছের মতো উজান ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল । অন্য কোনো কিছু পড়ে দেখবার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই । শামারোখ চা এবং বিস্কুট টেবিলের ওপর রেখে বলল, পড়ে দেখেছেন? আমি বললাম, না। উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, ওগুলো কি? শামারোখ বলল, প্রেমপত্র। কাগজ থেকে গন্ধ পান নি? আমি বললাম, হ্যাঁ পেয়েছি। কিন্তু আপনি বলবেন তো প্রেমপত্রগুলো কে কাকে লিখেছে? শামারোখ বলল, আর কাকে লিখবে? লিখেছে আমাকে। আমি বললাম, সে তো নতুন কথা নয়। আপনাকে তো সব্বাই প্রেমপত্র লেখে। শামারোখ বলল, কই, আপনিতো লেখেন নি? আমি বললাম, সময় পেলাম কই? ঝুট-ঝামেলা নিয়েই তো ব্যস্ত থাকতে হলো। চা খেতে খেতে বললাম, ওই গন্ধঅলা চিঠিগুলো কি একান্তই আমাকে পড়ে দেখতে হবে?

পড়বার জন্যই তো দিলাম ।

আপনাদের হার্ভার্ড ফেরত প্রফেসর আবু তায়েবের কাণ্ড দেখুন ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তায়েব সাহেবের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?

পরিচয় না থেকে উপায় কি বলুন! ভদ্রলোক প্রতি হপ্তায় আসেন। একবার বসলে আর উঠতেই চান না। আমাকে জ্বালিয়ে মারলেন। প্রতি হপ্তায় চিঠি আসছে তো আসছেই।

ঠিক তক্ষুনি আবার মনে পড়ে গেল, একবার প্রফেসর তায়েব আমাকে জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বনানীর আকাশছোঁয়া রেস্টুরেন্টটায় নিয়ে গিয়েছিলেন। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমার কাছ থেকে শামারোখ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন। তায়েব সাহেব প্রায়ই শামারোখের কাছে আসেন এবং প্রতি হপ্তায় তাকে সেন্ট মাখানো কাগজে প্রেমপত্র লেখেন, এ সংবাদ শুনে তার ওপর আমার মনে একটা প্রবল ঘৃণার ভাব জন্মাল।

শামারোখকে আর কিছুই বলতে হলো না। একটা একটা করে চিঠিগুলো পড়ে গেলাম। চিঠি পড়ার পর আমার মনে একটা বিশ্রী প্রতিক্রিয়া জন্ম নিল । কাঁচের শোকেসের ভেতর সবকিছু যেমন খালি চোখে দেখা যায়, আমিও তেমনি তায়েব সাহেবের মনের চেহারাটা দেখতে পেলাম। আমার চোখের সামনে একজন হতাশ, অসহায়, একই সঙ্গে কামুক এবং অহংকারী মানুষের ছবি ফুটে উঠল। এই নিঃসঙ্গ বয়সী মানুষটার ওপর আমার মনে সহানুভূতির ভাব জন্মাতে পারত। কিন্তু সেটা হলো না। শামারোখের কাছে উলঙ্গভাবে প্রেম নিবেদন করেছে, সেটাই আমার প্রধান নালিশ নয়। বরং আমার রাগ হলো এ কারণে যে, ভদ্রলোক অতি সাধারণ বাংলা বানানও ভুল করেন। আর তিনি মনের অনুভূতি রুচিস্নিগ্ধ ভাষায় গুছিয়েও প্রকাশ করতে পারেন না। প্রতি ছত্রেই অহমিকা এবং দাম্ভিকতা হুংকার দিয়ে ওঠে। ভদ্রলোকের প্রায় প্রত্যেকটা চিঠির মর্মবস্তু বলতে গেলে ওই একই রকম। আমি একজন বিরাট মানুষ, সম্প্রতি বড়ই নিঃসঙ্গ এবং কামাতুর, সুতরাং তুমি আমার কাছে এসো। যা চাও সব দেব। প্রফেসর আবু তায়েবের বাড়িতে মেয়েরাও থাকতে চায় না কেন, এখন কারণটা অনুধাবন করতে পারলাম। তিনি মহিলাদের একটা পণ্য হিসেবেই দেখেন।

আমি এবার চিঠিগুলো শামারোখের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। শামারোখ বলল, ওগুলো নিয়ে আমি কি করব? আমি বললাম, আপনি কি করবেন, আমি কি করে বলব। ইচ্ছে হলে জবাব দেবেন, ইচ্ছে হলে চন্দন কাঠের বাক্সে রেখে দেবেন। শামারোখ বলল, কি করি দেখুন । এই বলে সে ভেতরে চলে গেল। একটা হিটার নিয়ে এসে প্লাগটা সুইচ বোর্ডে লাগিয়ে নিল। কয়েলটা যখন লাল হয়ে উঠেছে, শামারোখ তখন একটা একটা করে চিঠিগুলো সেই জ্বলন্ত হিটারে ছুঁড়ে দিল। আমি দেখলাম, আবু তায়েবের হৃদয়-বেদনা, আসঙ্গলিপ্সা, নিঃসঙ্গতার আর্তি সবকিছু সর্বশুচি আগুনের শিখায় ভস্মে পরিণত হচ্ছে। শামারোখ এরকম একটা কাণ্ড করতে পারে, ভাবতে পারি নি। আমি ভীষণ খারাপ বোধ করতে থাকলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি দিলদার সাহেবের চিঠিটা পকেট থেকে বের করতে পারলাম না। বাতাসে পুড়ে যাওয়া চিঠির ছাই ইতস্তত ওড়াওড়ি করছে। মনে হলো, আবু তায়েবের মনের অতৃপ্ত কামনা-বাসনা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ছাই এসে আমার বাম চোখে পড়ল এবং চোখটা জ্বালা করতে থাকল। বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসে আমি চিঠিটা শামারোখের হাতে দিলাম। শামারোখ চিঠিটা পড়ে মন্তব্য করল, মনে হচ্ছে, জায়গাটা উত্তর মেরুরও উত্তরে। অত দূরে যাব কেমন করে? আর ভদ্রলোকও-বা অত দূরে থাকেন কেন?

আমি বললাম, দিলদার সাহেব আগে ধানমন্ডি পনের নম্বরে থাকতেন। সম্প্রতি তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়িটা দিলদার সাহেবের প্রথম বেগমের নামে। শামারোখ জানতে চাইল, এই বয়সে স্বামীকে তাড়িয়ে দেবে কেন? আমি পাল্টা জবাব দিলাম, এই বয়সে আপনিও-বা স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসবেন কেন? আমার প্রশ্নটা শুনে শামারোখ সোজা হয়ে বসল। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তারপর উঠে কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। মনে হলো, আমি তার অসম্ভব নরম জায়গায় আঘাত করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পরে এসে শামারোখ জিজ্ঞেস করল, আপনার দিলদার সাহেব মানুষটা কি বদমাশ? এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আবার বিয়ে করলেন কেন? আমি বললাম, এক অর্থে আপনার কথা সত্যি। কিন্তু মানুষটা আরো অনেক কিছু। তিনি ভাল কবিতা লেখেন, চমৎকার বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। অসাধারণ সাহসী মানুষ। শামারোখ আমার মুখের কথা টেনে নিয়ে বলল, সাহস জন্তু-জানোয়ারেরও থাকে। আপনারা পুরুষ মানুষেরা আপনাদের অপরাধগুলোকে গুণ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টার কসুর করেন না।

আমি বললাম, দিলদার সাহেব, আপনাকে কি একটা খবর দেয়ার জন্য ডেকেছেন। আপনি যেতে চান কি না, সেটা বলুন। এখন বারোটা বাজে। ওখানে পাঁচটার সময় না পৌঁছুতে পারলে বাড়ি খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে। শামায়োখ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বলল, হ্যাঁ যাব।

আমি বললাম, তাহলে আপনাকে চারটের সময় আমার হোস্টেলে আসতে হবে।

শামারোখ তাদের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে আসতে অনুরোধ করেছিল। আমি রাজি হই নি।

আমাদের ধারণা ছিল অনধিক সাড়ে ছ’টা নাগাদ আমরা দিলদার সাহেবের বাড়িতে পৌঁছব । এ-গলি,সে-গলি, তস্য গলি এবং তস্য গলির তস্য গলি ঘুরে ধান খেত পেরিয়ে পুকুরপাড়ে একতলা বাড়ি খুঁজে বের করতে সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেল। আর আমরা যেই ঘরের ভেতরে পা দিয়েছি, অমনি কারেন্ট চলে গেল। জমাট বাঁধা ভুতুড়ে অন্ধকারের মধ্যে আমরা অসহায়বোধ করতে লাগলাম। দিলদার সাহেব হারিকেনটা জ্বালিয়ে একপাশে রেখে বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম, আজ তোমরা আর আসছ না। ডেইজি সেই গানটাই বার বার শুনিয়ে দিচ্ছিল, কাঙাল হইলে ভবে কেউ তো জিগায় না। হারিকেনের স্বল্প আলোতে আমি ঘরের চেহারাটা জরিপ করতে থাকলাম। এক কোণে সাদাসিধে একখানা তক্তপোশ। তিন-চারটে চেয়ার এবং কেরোসিন কাঠের একটা টেবিল। খুব সাধারণ একটা আলনায় গুছিয়ে রাখা হয়েছে ডেইজির শাড়ি, পেটিকোট এইসব । এছাড়া ঘরে অন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। ভদ্রলোককে আমি গত দশ বছর ধরে তার ধানমন্ডির তিনতলা বাড়িতে দেখে এসেছি। তার বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো যেসব ছবি ছিল, সেগুলোর মূল্যও এই বাজারে তিন-চার লাখ টাকার কম হবে না। এখন ডেইজিকে নিয়ে যে ঘরে থাকছেন, চেহারা দেখে মনে হলো, ধানমন্ডির বাড়ি থেকে একটা কুটোও তিনি নিয়ে আসেন নি। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা আমার অনেক পরিমাণে বেড়ে গেল। ইচ্ছে করলে তিনি ডেইজির দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারতেন। দুর্বল মুহূর্তে তো মানুষ অনেক কিছুই করে! দায়িত্ব স্বীকার করে এরকম জঙ্গলে বসবাস করার এই যে সাহস, কজন মানুষ সেটা করতে পারে? অনেকে দিলদার সাহেবকে ভাল মানুষ বলবেন না। কিন্তু আমার চোখে তিনি একজন যথার্থ পুরুষ। মাঝে মাঝে হাঁপানির টানে তাকে ধনুকের মতো বেঁকে যেতে হয়। কিন্তু তিনি যখন সোজা হয়ে দাঁড়ান, তার চোখের ভেতর থেকে যে দীপ্তি বেরিয়ে আসে, দেখলে মনে হয়, ওই বয়সে, ওই শরীরে তিনি বনের হিংস্র সিংহের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত। তার ঠোঁট জোড়া পাতলা, দেখলে ঝুঁটি শালিকের কথা মনে পড়ে যায়। যখন কথা বলেন গলার স্বর গমগম করে বাজে।

আমাদের কথাবার্তা শুনে ডেইজি বেরিয়ে এল। হাসল আমাদের দুজনকে দেখে। ফুলের মতো স্নান সে হাসি। আমি প্রশ্ন করলাম, কেমন আছেন? সে মাথা একদিকে কাত করে বলল, ভাল। আমি ডেইজির সঙ্গে শামারোখকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ডেইজি শামারোখকে বলল, আপনি খুব সুন্দর। উনি, মানে দিলদার সাহেব, কয়েকদিন থেকে আপনার কথাই বলছেন শুধু। শামারোখ তার চিবুকটা স্পর্শ করে বলল, আপনিও কম সুন্দর নন। ডেইজি বলল, আপনারা গল্প করুন, আমি রান্নাটা শেষ করে আসি।

ডেইজির সঙ্গে দিলদার সাহেবের বয়সের তফাৎ কম করে হলেও চল্লিশ বছর । স্বভাবতই ডেইজির সঙ্গে এত বেশি বয়সের একজন মানুষের বিয়ে হবার কথা নয়। অর্থ-সম্পদের লোভে যে সে দিলদার সাহেবকে বিয়ে করে নি সে তা তাদের ঘরকন্নার ধরনধারণ এবং ঘরের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। এই অসমবয়সী দুটি নারী-পুরুষ পরস্পরের মধ্যে এমন কি অমৃতের সন্ধান পেয়েছে দুজন দুদিক থেকে এই চরম আত্মত্যাগ করতে পারে? নাকি দুজনই পরিস্থিতির শিকার! ডেইজি নিচে মাদুর পেতে খাবার সাজাচ্ছিল। দিলদার সাহেব এমন খোশ-মেজাজে কথা বলে যাচ্ছিলেন যেন তিনি পরম সুখে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন। মানুষটা এতটা দুর্ভোগের মধ্যেও এমন প্রাণ প্রাচুর্যে কিভাবে কথাবার্তা বলতে পারেন, সেটা আমার কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আমি হঠাৎ করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করলাম, দিলদার ভাই, আপনার গাড়ি তো এখানে আনতে পারেন না। রাখেন কোথায়? তিনি জবাব দিলেন, এগার নম্বরের পেছনে এক বন্ধুর গ্যারেজে রেখে বাকি পথটা রিকশায় চেপে চলে আসি। তারপর তিনি আহত স্বরে বলে ফেললেন, ধানমন্ডির বাড়ি থেকে একমাত্র ওই গাড়ি এবং কিছু কাপড়-চোপড় ছাড়া আর কিছুই আনা হয় নি। গাড়িটা না থাকলে খোঁড়া হয়ে ওই অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে থাকতে হতো। তার এই একটা কথার ভেতর দিয়েই অনেক কথা বলা হয়ে গেল।

আমরা খেতে বসলাম। ডেইজি রাধে চমৎকার। ছোট মাছ, ঘন করে মুগের ডাল বাচ্চা মুরগির ঝোলসহ রান্না করেছে। সঙ্গে শসার সালাদ। আমরা আরাম করে খেতে থাকলাম। না খেতে পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। চোর-ছ্যাঁচ্চোড়ে দেশ ভরে গেছে। স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হচ্ছে না। রাস্তা-ঘাটে ডাকাত, হাইজ্যাকারদের ভয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, এই দেশটা কোন্ রসাতলের দিকে যাচ্ছে আমি তো ভেবে ঠিক থাকতে পারি নে। গত পরশু প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে এক ভিন্নরকমের ছবি দেখলাম। অসংখ্য তদবির করার মানুষ । প্রধানমন্ত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। আমি হলে সব ব্যাটাকে গুলি করে দিতাম। আমার ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রীকে আমার নিজের কথাটাও বলব, কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে আমার মনটা এমন বিগড়ে গেল যে, ঠিক করলাম, এ ধরনের মানুষদের কাছ থেকে আমি কোনো সুযোগ গ্রহণ করব না।

আমি আর শামারোখ পরস্পর চকিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। তাহলে তিনি কি শামারোখের চাকরির বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেন নি? দিলদার সাহেবের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। তিনি মুহূর্তেই আমার মনোভাবটা আঁচ করে নিলেন, না না তোমাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর যত অপূর্ণতা থাকুক বন্ধু-বান্ধবদের ব্যাপারে তার মনে অঢেল মায়ামমতা। শামারোখের কথাটা সব খুলে বলার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিএস-কে দিয়ে ফোনে শরীফকে তলব করলেন। ধমকের চোটে শরীফের তো যায় যায় অবস্থা, শামারোখ তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। এক হপ্তার মধ্যে ওরা তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দেবে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর দিলদার সাহেব বর্তমান পরিস্থিতির ওপর যেসব কবিতা এবং গান লিখেছেন পড়ে শোনাতে লাগলেন। খাতার সমস্ত গান এবং কবিতা পড়া শেষ হয়ে গেলে শামারোখ বলল, আর লেখেন নি? দিলদার সাহেব বললেন, অনেক কিছু লিখেছি কিন্তু আজ আর শোনাবো না। তোমাদের তো ফেরত যেতে হবে। এ সমস্ত জায়গায় বেশি রাতে চলাফেরা করা ভয়ংকর বিপজ্জনক।

শামারোখ ডেইজির কাছ থেকে বিদায় নিতে ভেতরে গেল। এই ফাঁকে দিলদার সাহেব আমাকে বললেন, তোমার চাকরিবাকরির কিছু হলো? আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আশঙ্কার সুরে বললেন, তুমি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছ, দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে, কিছু একটা করো। নয়তো ধরা খেয়ে যাবে। দেখছ না আমার অবস্থা। শামারোখ বেরিয়ে এসে বলল, আমি মাঝেমধ্যে যদি আপনার কাছে আসি, আপনি বিরক্ত হবেন? দিলদার সাহেব বললেন, মোটেই না। তোমার যখন ইচ্ছে হয়, চলে এসো। মুশকিল হলো, এতদূর আসবে কেমন করে? শামারোখ বলল, সে দায়িত্ব আমার।

শামারোখের কাছে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দেয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এল, সে দিনটাকে আমার বিশেষ বিজয়ের দিন বলে ধরে নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা আমাকে এতদিন যেভাবে করুণার পাত্র মনে করে এসেছেন, আমি সে রকম তুচ্ছ মানুষ নই। আমি প্রমাণ করে ছেড়েছি, একজন মহিলার বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত নীরব প্রতিরোধ আমি অকার্যকর করতে পেরেছি। শামারোখকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা, এই অসম্ভবকে শেষ পর্যন্ত আমিই সম্ভব করলাম । এই কাজটাই করতে গিয়ে আমাকে কত জায়গায় যে যেতে হয়েছে, আর কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। নীরব চেষ্টার ভেতর দিয়ে এরকম একজন অসহায় মহিলাকে জীবনে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করলাম, এই ঘটনাকে একটা অসমযুদ্ধে জয়লাভ করা ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারলাম না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি এই রকম একটি বড় কাজ করার জন্য কেউ আমার তারিফ করবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, সব্বাই আমার দিকে এমন একটা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন, আমি যেন যজ্ঞের-বেদিতে একটা অপবিত্র পশুর লাশ এনে ফেলে দিয়েছি। তারা বাধা দিয়েও শামারোখকে ঠেকাতে পারেন নি, সে জন্য তারা তাদের পরাজয়ের গ্লানিটা আরো তীব্র-তীক্ষভাবে অনুভব করছিলেন। এই জিনিসটাই আমার কাছে পরম উপভোগ্য মনে হচ্ছিল। মনে মনে বলছিলাম, ভেবে দেখুন, কেমন গোলটা দিলাম।

সেদিনই সন্ধ্যেবেলা একটা কাজ করে বসলাম। হাইকোর্টের মাজারের সামনে যে ফুলঅলা বসে, তার কাছ থেকে একটা জমকালো করবী ফুলের মালা কিনে আনলাম। তারপর ঘরে এসে ভাল করে জামা-কাপড় পরে নিলাম। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দু-হাতে সেই হলুদ করবী ফুলের মালাটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর আমাকে কেমন দেখায়, নানা ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাই দেখতে লাগলাম । যুদ্ধজয়ী বীরের সঙ্গে নিজের তুলনা করে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেলাম। একাকী এই নীরব বিজয়োৎসব পালন করছি, কাজটা নিজের কাছেই একটু পরে আমার হাস্যকর মনে হলো। আবার ভালও লাগল। আমার নিজের কাজের মূল্য আছে, তার স্বীকৃতি অন্যেরা যদি দিতে কুণ্ঠিত হয়, আমি বসে থাকব কেন? কেউ না দেখুক, আমি তো নিজে আমাকে দেখছি। আমার ইচ্ছে হলো, এই অবস্থায় একবার ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী, একবার ড. মাহমুদ কবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারা যদি জিজ্ঞেস করেন, জাহিদ আবার কি নতুন পাগলামো করলে, গলায় করবী ফুলের মালা কেন? আমি জবাব দেব, স্যার, আজই তো মালা পরার দিন । জানেন না শামারোখ আজ ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে কাজ করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। অথচ বাস্তবে আমি ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে কোথাও গেলাম না। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত দুঃখ প্রকাশের মতো অতিরিক্ত আনন্দও মানুষকে ক্লান্ত করে ফেলে। তাই ক্লান্তিবশতই জামা কাপড় এবং গলায় মালা-পরা অবস্থাতেই বিছানার ওপর নিজের শরীরটা ছেড়ে দিলাম। দরজা বন্ধ করতেও ভুলে গেলাম ।

অধিক রাতে কামাল আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন। সবচেয়ে ভাল জামা-কাপড় পরা অবস্থাতেই গলায় মালা দোলানো দেখে কামাল জিজ্ঞেস করলেন, জাহিদ ভাই, আপনার হয়েছে কি? মনে হচ্ছে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি বললাম, জানেন না কামাল কি হয়েছে? কামাল বললেন, জানব কেমন করে, আজকাল আপনি তো কিছুই জানান না, সব কাজ একা-একাই করেন। আমি বললাম, আজ শামারোখ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। আমার উত্তরে কামালের কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। কেবল বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম, আপনি শামারোখকে সেজেগুজে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, কোনো কারণে বিয়েটি ভেঙে যাওয়ায় মনের দুঃখে আপনি ঘরে এসে লম্বা নিদ্রা দিচ্ছেন। যাক বিয়েটি যে করে ফেলেন নি, সে জন্য আপনাকে কংগ্রাচুলেট করব । কামালের এই ধরনের মন্তব্য শুনে চট করে আমার মনে পড়ে গেল, কোনো বিজয়ই নিরবচ্ছিন্ন বিজয় নয়। তার আরেকটি দিকও রয়েছে। সব বিজয়ের পেছনে একটি পরাজয় লুকিয়ে থাকে।

আরো একটি কারণে আমি একটুখানি আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিলাম। সেই বিষয়টি বয়ান করি। শামারোখ আমার ঘরে এসে জানিয়েছে, আমি যেন তাকে বিয়ে করি। এটা একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক প্রস্তাব নয় । চোরের ভয়ে মানুষ যেমন এরন্ডা হাতে নেয়, শামারোখের বিয়ের প্রস্তাবটিও অনেকটা সেরকম। চারপাশ থেকে ধাক্কা খেয়ে মানুষ হাতের কাছে যাকে পায়, অবলম্বন করে বাঁচতে চেষ্টা করে, তেমনি শামারেখও আমাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে দাঁড়াবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করছে। আমি তাকে দাঁড় করাতে পারব না; বরং নিজেই তলিয়ে যাব। তাছাড়া আরো একটি কথা, শামারোখ আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে, একথা সত্যি বটে। তার আকর্ষণ করার সমস্ত উপাদান আছে। আমি যেমন আকর্ষণ বোধ করি, সেরকম তাকে যে-ই দেখে সবাই একইভাবে তার দিকে ঢলে পড়ে। অনেকদিন একসঙ্গে চলাফেরার পর আমার মনে এরকম একটি ধারণা জন্মেছে, শামারোখ জলসা ঘরের ঝাড় লণ্ঠনের মতো একজন মহিলা। একসঙ্গে অনেক মানুষের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়ার জন্যই তার সৃষ্টি হয়েছে। মোমের আলোর ক্ষীণ যে শিখা তার আলোয় একজন মানুষ তার ভেতরটা উপলব্ধি করতে পারে, শামারোখ সে রকম কেউ নয়। সে মানুষকে তার আপন অস্তিত্বই ভুলিয়ে দেয়। এই মহিলার মধ্যে একান্ত গোপনীয়, একজন ব্যক্তি যেখানে তার আপন স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সেরকম কোনো বস্তুর সন্ধান আমি পাই নি ।

তারপরেও কথা থেকে যায়। শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য, শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ, সরল-সহজ ব্যবহার এবং সহজাত সম্মানবোধ একজন মাত্র মহিলার মধ্যে এই এতগুলো গুণের সমাবেশ জন্মের পর থেকে আমি কোথাও দেখি নি । এই রকম একজন মহিলা যখন আমার কাছে এসে অবলীলায় বলতে পারে, তুমি আমাকে উদ্ধার কর । আপাতত বিয়ে করাই হচ্ছে উদ্ধারের একমাত্র পথ। আমি তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তার আত্মসম্মানবোধ যে জখম করি নি, সে জন্য নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার অনেকখানিই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করছে, এমন একজন অসহায় মহিলাকে যে তার নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে পারলাম, এই জিনিসটি আমার কাছে হিমালয়ের উচ্চতম শৃঙ্গে আরোহণের চাইতেও বেশি গৌরবের কাজ বলে মনে হলো। এখন শামারোখ ইচ্ছে করলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। সেই সুযোগটি আমি নিজেই তৈরি করে দিয়েছি। সুন্দর বস্তু পশুদের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে দেখে বেদনা আমি অনুভব করে থাকি। আমি ধরে নিলাম, শামারোখের পায়ের তলার মাটিটির ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি সুন্দরের মান রক্ষা করলাম।

দুতিন দিন বাদে শিক্ষকদের লাউঞ্জে গিয়ে আমি মনে মনে মস্তরকম একটা চোট খেয়ে গেলাম। শামারোখের জন্য লড়াই করার পেছনে আমার ব্যক্তিক অহং কাজ করে নি, সে কথাটা সত্যি নয়। তারপরেও ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের মধ্যে যে বিরোধ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে মানবিক মহত্ত্ববোধ প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে একটি পৌরুষ রয়েছে, সেটাই আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম । লাউঞ্জে গিয়ে দেখলাম ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর টেবিলের উল্টোদিকে বসে শামারোখ হেসে হেসে তার সঙ্গে খোশ-গল্প করছে। আমার চট করে মনে হলো, সকলের সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে শামারোখের চাকরিটি পাইয়ে দিয়ে আমি শুধু একটি মামলা জিতেছি মাত্র। মামলার পাল্টা মামলা আছে। আপিল আছে। আপিলের ওপর আপিল আছে। যে সমস্ত মহৎ অনুষঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে আমি মনে মনে অহংকারে স্ফীত হয়ে উঠছিলাম, তার সঙ্গে এই চাকরি পাওয়ার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এটা নেহায়েতই একটা মামুলি ব্যাপার ।

শামারোখ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেই বুঝে গেছে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী এবং তার দলের লোকদের সঙ্গেই তাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং জয়েন করেই তার প্রথম কাজ দাঁড়িয়ে গেছে, তাকে চাকরি পেতে যারা বাধা দিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করা। তাদের অমতে শামারোখ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে পারলেও তারা যদি বেঁকে বসেন, তাহলে তার পক্ষে নিরাপদে কাজ করে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রথম কাজ। আমি কোণার টেবিলে বসে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে শামারোখের টুকরোটাকরা আলাপ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রতি কথায় সে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর দিকে তার পদ্মপলাশ চোখ দুটো এমনভাবে মেলে ধরছিল, আমার মনে হচ্ছিল, একমাত্র এই মানুষটাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য নিয়ে শামারোখ জন্ম নিয়েছে। বুঝতে আমার কালবিলম্ব হলো না আমি জিতেও হেরে গেছি। এই ভণ্ড লোকদের সংঘবদ্ধ একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার প্রয়োজনে কত রকম হিল্লিদিল্লি করে শামারোখের এখানে আসার ব্যবস্থা করলাম। এখন শামারোখ নিজেও এই দুষ্টচক্রের একটি খুচরো যন্ত্রাংশে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগল। সারা জীবন আমি আমার মেধা-প্রতিভা-শ্রম-সময় ভুল কাজে ব্যয় করে গেলাম । শামারোখকে যখন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে হবে, তাকে ঝাকের কই হয়ে ঝাকের সঙ্গেই মিশে থাকতে হবে । শামারোখের মধ্যে একটি শিকারি স্বভাব আছে আমি জানতাম। তাকে এইখানে যখন কাজ করতে হবে, তখন সবচেয়ে প্রবল প্রতিপক্ষটিকে তার সৌন্দর্যের অস্ত্রে ঘায়েল করে কাবু করতেই হবে। শামারোখ তার ডিপার্টমেন্টের লোকদের সঙ্গে পানিতে চিনির মতো মিশে যাবে। অথচ আমি সকলের শত্রু হয়ে রইলাম। খেলার এটাই নিয়ম। আমি ওই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও দূরেটুরে চলে যেতে পারলে সবচাইতে ভাল হতো। কিন্তু সেটাই সম্ভব হচ্ছে না। আমার আশঙ্কা মিথ্যে হবে না, যে আগুন আমি জ্বালিয়ে তুলেছি, তার তাপ আমার শরীরে এসে লাগবেই।

প্রায় মাসখানেক পরে একদিন শামারোখ আমাকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল । এই সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে এক-আধবার দেখা হয়েছে, তবে বিশেষ কথা হয় নি। যতবারই দেখা হয়েছে, বলেছে, খাটতে খাটতে তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস করা, টিউটোরিয়াল দেখা, সিলেবাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিদিন নতুন করে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চাকরি পেলে মানুষ নিজের গুরুত্ব জাহির করার জন্য লম্বা-চওড়া যেসব বোলচাল ঝাড়ে, শামারোখকেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না। কিন্তু তার অসহায়ত্ববোধটা কেটে গেছে। আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সে কথাবার্তা বলছে।

শামারোখ জানালো আজ সে প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে। তাই আমাকে খেতে ডেকেছে। খেতে খেতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতসব খবরাখবর বলতে থাকল শুনে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। মাত্র একমাস সময়ের মধ্যে শামারোখ এতসব সংবাদ সংগ্রহ করল কেমন করে? আমি এই এলাকায় দশ বছরেরও বেশি সময় বসবাস করছি, অথচ তার এক-দশমাংশ খবরও জানি নে। কোন শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে নষ্টামি-ফস্টামি করে বেড়ায়, কোন্ শিক্ষক বউকে ধরে পেটায়, কোন্ শিক্ষক বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে অকর্ম-কুকর্ম করে, কোন্ শিক্ষকের মেয়েকে স্বামী তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে, কোন শিক্ষক জাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমোশন আদায় করেছে- সব খবর তার নখদর্পণে। এক কথায় শামারোখ বিশ্ববিদ্যালয়ের যত আধিব্যাধি আছে, তার এক সরস বর্ণনা দিল।

এরই মধ্যে খাওয়া শেষ হয়ে এল। খাওয়ার পর চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে মহিলা শিক্ষকদের সম্বন্ধে তার পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলো প্রকাশ করতে থাকল। ইতিহাসের হামিদা বানু এত জাহাবাজ মহিলা যে স্বামী বেচারাকে আলাদা বাসা করে থাকতে হয়। অর্থনীতির জিন্নাতুন্নেসা আসলে থুথুরে বুড়ি, অথচ এমন সাজগোজ করে এবং এত রঙচঙ মাখে দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। সাইকোলজির ফাহমিদা বেগমের ঘাড়টা জিরাফের মতো, অথচ ভণ্ডামি কত, মনে করে সে সবচাইতে সুন্দরী। কোদালের মতো দাঁত বের করে এমনভাবে হাসে দেখলে চোপাটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। শামারোখের সব রাগ দেখা গেল পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জেবুন্নেসার ওপর। মহিলা হাইহিলে খুট খুট করে এমনভাবে আসে যেন মাটিতে তার পা পড়ছে না। আর এমন নাসিক্য উচ্চারণে কথাবার্তা বলে যেন এক্ষুনি এয়ারপোর্ট থেকে নেমেছে, এখনো লাগেজ-পত্র এসে পৌঁছায় নি। তারপর শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে মহিলা কিভাবে হাঁটেন, অনুকরণ করে দেখালো । আমি বললাম, আপনার মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার কথা আরেকদিন শোনা যাবে। আজ একটু কাজ আছে। শামারোখ বলল, আরে বসুন। এখন কি যাবেন। আমি বললাম, আপনাকে তো বলেছি, আমার একটা কাজ আছে। সে বলল, কাজ তো আপনার সব সময় থাকে। তার আগে আপনার পেয়ারের জহরত আরার কথা শুনে যান।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, নিজের হাতে ছিপি খুলে আরব্যপোন্যাসের জীবনটা মুক্ত করে দিয়েছি। এই তো সবে শুরু, সামনে আরো কত দেখতে হবে, কে জানে! এই মহিলার মেটাল ডিটেক্ট করার মতো একটা আলাদা ক্ষমতা আছে। প্রথম দৃষ্টিতেই কার কোথায় খুঁত আছে চট করে ধরতে পারে। একটা কথা ভেবে আমি অবাক না হয়ে পরলাম না। শামারোখের তো নানাবিধ গুণ রয়েছে। সেগুলোর পরিশীলন করার বদলে মানুষের খুঁত আবিষ্কার করার কাজে এমন তৎপর হয়ে উঠবে কেন? আরো একটা কথা ভেবে শঙ্কিত হলাম যে জহরত আরার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করল কেমন করে? তার দৃষ্টি থেকে কিছুই কি এড়াতে পারে না?

জহরত আরা বয়সে আমার সামান্য বড় হবেন। অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করেন। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলেন। দেশের মধ্যে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায় কি ঘটছে জানেন বলে মনে হয় না। অথবা জানলেও সেগুলোর মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্রও নেই। মহিলা সব ধরনের ভজকট ব্যাপার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন। গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটান। সব সময় দেখেছি মোটা মোটা খামে দেশের বাইরে টাইপ করা চিঠি পাঠাচ্ছেন। সব সময় রুমের মধ্যে আটক থাকেন। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে লাউঞ্জে এসে হাসানাত সাহেবের সঙ্গে এক কাপ চা খান। পনের-বিশ মিনিট লাউঞ্জে কাটিয়ে বাড়ি চলে যান। জহরত আরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকার সময় থেকেই হাসানাত সাহেবের প্রিয় ছাত্রী। হাসানাত সাহেবের বয়স যদি সত্তর না হতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের যা পরিবেশ জহরত আরার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে নানারকম মুখরোচক গল্পের সৃষ্টি হতে পারত। তার কারণ জহরত আরা নিজেও বিয়ে করেন নি । কেন বিয়ে করেন নি, সেই সংবাদটিও কেউ বিশদ করে বলতে পারে না। এমনকি ডিপার্টমেন্টের যেসব মহিলা সহকর্মী, যারা জহরত আরাকে রীতিমতো অপছন্দ করেন, তারাও না। জহরত আরা কারো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কুমারী জীবন যাপন করছেন, কিংবা কারো প্রতীক্ষায় এমন একলা-একা জীবন কাটাচ্ছেন, সে খবর যদি জানা সম্ভব হতো, আমার ধারণা, অবশ্য অবশ্যই শামারোখের স্বয়ংক্রিয় মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে যেত।

চলাফেরা করার সময় জহরত আরার চারপাশে একটা গাম্ভীর্য বেষ্টন করে থাকে। সেটা ভেদ করে তার কাছাকাছি পৌঁছুনো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। আমি যদি সাহস করে বলি, জহরত আরার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটেছিল, তাহলে খুব সম্ভবত মিথ্যে বলব না। ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসানাত সাহেব । অমি তাকে আমার লেখা একটা বই পড়তে দিয়েছিলাম। এই নাক উঁচু স্বভাবের ভদ্রমহিলা, যার কাছে দেশের সবকিছু তুচ্ছ অথবা চলনসই, মন্তব্য জানতে চেয়ে পড়তে দিয়েছিলাম। তিনি দুদিন পর তার ডিপার্টমেন্টের পিয়ন দিয়ে আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, য়ু আর এ্যাপ্রোচিং গ্রেটনেস। তারপর থেকে ফাঁক পেলেই মহিলার ঘরে যেতাম। তিনি আমাকে কোনোদিন ডাকেন নি । অথচ আমি যেতাম। কখনো তার গাম্ভীর্যের আবরণ টলেছে এমন আমার মনে হয় নি। আমি ধরে নিয়েছিলাম, যে মানুষ গ্রেটনেসের পথে পা বাড়িয়েছে, তার এই গাম্ভীর্যের আবরণটুকু কেয়ার না করলেও চলে। মহিলা একদিনও আমাকে চলে আসতে বলেন নি।

জহরত আরাকে সুন্দরী বলা ঠিক হবে না। তিনি ছিলেন বেঁটেখাট ধরনের। মুখের ছিরিছাঁদও বিশেষ ছিল না। মুখখানা ছিল মঙ্গোলীয় ধাঁচের। কিন্তু নাকটা মঙ্গোলীয়দের মতো চ্যাপ্টা ছিল না, স্বাবলম্বী দৃঢ়চিত্তের মহিলাদের মধ্যে যেমন মাঝে মাঝে দেখা যায়, তার নাকের নিচে খুব ভাল করে তাকিয়ে দেখলে সূক্ষ্ম একটা অবিকশিত গোঁফের রেখা লক্ষ্য করা যায়। তিনি মাথার ঠিক মাঝখানটিতে সিঁথি কেটে চুলগুলো পেছনে নিয়ে জোর করে খোঁপা বাঁধতেন। হাঁটার সময়ে দোদুল খোঁপাটা কেঁপে কেঁপে উঠত। তার মাথায় চুল ছিল অঢেল। কানের গোড়ার দিকে কয়েকটি পাকা চুলের আভাসও দেখা যেত। তিনি যখন হাঁটতেন, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন। এ সময়ে দোদুল খোঁপাটা দুলে দুলে উঠত। তার পরনের শাড়ি, পায়ের জুতো, চলার ভঙ্গি সবকিছু গাম্ভীর্যের কঠোর অনুশাসন মেনে চলত। জহরত আরার গায়ের রঙ ছিল মাজা মাজা, সাদাও বলা যেতে পারে। কাঁধের পিঠের যে অংশ দেখা যেত, তার থেকে কোনো জৌলুস ঠিকরে বোরোতো, একথা মোটেও বলা যাবে না। জহরত আরাকে সুন্দরী কিংবা অসুন্দরী এই অভিধায় ফেলে বিচার করা যাবে না। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এক ধাতুতে গড়া প্রতিমার মতো- সবটাই জহরত আরা- সবটাই ব্যক্তিত্ব।

জহরত আরার এই যে একাকীত্ব এবং অটল ব্যক্তিত্ব, সেটাই আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে যেত। তিনি ঠোঁটকাটা স্বভাবের মহিলা ছিলেন। যেদিন হাতে কাজ থাকত মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতেন, হাতে খুব কাজ, বসতে বলতে পারব না। আজ তুমি এসো। যেদিন মহিলার সময় থাকত, থুতনিতে মাথা রেখে চুপচাপ আমার কথা শুনে যেতেন। তিনি শুধু মাঝে মাঝে হুঁ-হাঁ করতেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর যখন বেরিয়ে আসতাম, মহিলার সঙ্গে কি বিষয়ে কথা বলেছি, একদম মনে করতে পারতাম না। নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, তাহলে এতক্ষণ কি বকবক করলাম!

জহরত আরার কাছে এই যে যাওয়া-আসা করছি, তার পেছনে কোনো গূঢ় কারণ আছে কি না, নিজের কাছেও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। আসলে জহরত আরার কাছে আমি কেন যাই? সাদা কথায় ভাল লাগে বলেই যাই। কেন ভাল লাগে কখনো ভেবে দেখি নি, কারণ ভেবে দেখার সাহস হয় নি।

শামারোখ খুব সহজে যখন পেয়ারের জহরত আরা শব্দটি বলে ফেলল আমার সচকিত না হয়ে উপায় রইল না। আ য উঠি-উঠি করছিলাম, বসে পড়লাম। মহিলা আমার মনের গহনের এমন একটা জায়গায় ঘা দিয়ে বসে আছে, যা আমি অত্যন্ত নির্জন গোপন মুহূর্তেও উচ্চারণ করতে সাহস পাই নি, পাছে বাতাস বিশ্বাসঘাতকতা করে। মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে এনে বললাম, অনেকের কথাই তো বললেন, জহরত আরা বাকি থাকবে কেন? শামারোখ হাসতে হাসতে বলল, জানেন জাহিদ ভাই, আপনার পেয়ারের জহরত আরা যখন শাড়ির গোছাটা হাতে ধরে থপ থপ করে হেঁটে যায়, অবিকল একটা বাচ্চা হাতির মতো দেখায়। আমার খুব শখ হয়, এক জোড়া গোঁফ কিনে মহিলার মুখে লাগিয়ে দিই। একেবারে বেঁটেখাট নেপালির মতো দেখাবে। এইরকম একজন মেয়ে মানুষ, যার যেখানে মাথা, সেখানে চোখ, যেখানে গাল, সেখানে নাক-মুখ-ঠোঁট, এমন একটি বদসুরত মেয়েমানুষের সঙ্গে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান কেমন করে?

খুব কষ্টে হেসে বললাম, খুব ভাল বলেছেন, বাকিটা আরেকদিন শুনব, এখন যাব।

শামারোখ বলল, খুব লেগেছে না!

আমি বললাম, লাগবে কেন?

.

১৯.

মনস্তত্ত্ব জিনিসটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। যেসব মানুষ মনস্তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করে পারতপক্ষে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করি। আমার মনে হয়েছে মনস্তত্ত্বের কারবারীরা নিজেরাই মানসিক রোগী। তাদের সঙ্গে বেশি ঘাটাপিটা করলে অন্যকেও তারা রোগীতে পরিণত না করে ছাড়ে না। একটি মানুষের কত অংশ মন? তার তো শরীর আছে, শরীরের শরীরসমাজ আছে। সবকিছু বাদ দিয়ে মন নিয়ে টানাটানি করলে যে জিনিসটা বেরিয়ে আসে, সেটা শূন্য। পেঁয়াজের খোসার পর খোসা উন্মোচন করতে করতে একেবারে শেষে কি থাকে, কিছুই না। এগুলো একজন আনাড়ির কথা। মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রের ওপর মতামত দেয়ার ক্ষমতা আমার থাকবে কেন? আমি শুধু নিজের মনোভাবটুকু প্রকাশ করলাম।

শামারোখের পাল্লায় পড়ে, এখন টের পেতে আরম্ভ করেছি, আমার ভেতর থেকে মনস্তত্ব উঁকি মারতে আরম্ভ করেছে। আমি এই অক্টোপাশের থাবা এড়িয়ে যেতে পারছি নে। শামায়োখ কখন কি কাজ কোন্ উদ্দেশ্যে করে, দাবার বোড়ের মতো একটার পর একটা চাল আমাকে সামনে রেখে যেভাবে প্রয়োগ করে তার ভেতরের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারি। আমি শামারোখের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না। মায় নে কমলিকো ছোড়নে মাংতা, মাগার কমলি নে হামকো নেহি ছোড়। উয়ো কমলি নেহি ভালুক হ্যায়। আমি শামায়োখের বিষয়টা আমার তরফ থেকে যেভাবে চিন্তা করেছি, সেটা খুলে বলি। তাকে আমি তীব্রভাবে পছন্দ করেছি। এমন একটা সময়ও ছিল, যদি শামারোখ বলত, জাহিদ, তুমি পাঁচতলা থেকে লাফ দাও, আমি লাফ দিতাম। যদি বলত, তুমি ছুটন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ো, আমি একটি কথাও না বলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। যদি বলত, তুমি আমার গৃহভৃত্য হিসেবে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে, আমি নির্বিবাদে গৃহভৃত্যের অবস্থান কবুল করে নিতাম। কিন্তু শামারোখের সে ধরনের সরল আত্মোৎসর্গের প্রয়োজন ছিল না। তার প্রেমে অন্ধ হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে হৃৎপিণ্ড কেটে তার পায়ের তলে অর্ঘ্য দেবে, সেটা শামারোখের কামনা ছিল না এবং সেজন্য এখনো আমি বেঁচে রয়েছি।

এই এখন নিজের মধ্যে হাজার চেষ্টা করেও আমি সেই মুগ্ধ আবেশ সৃষ্টি করতে পারি নে। শামারোখ যখন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করল, আমি ভড়কে গেলাম। আমার যদি তাকে ধারণ করার ক্ষমতা থাকত, অবশ্যই আমি তাকে বিয়ে করতাম। শামারোখের মতো মূল্যবান শ্বেতহস্তী পুষব, আমার তেমন গোয়াল কোথায়? আমি যে তাকে বিয়ে করতে রাজি হই নি, এটা আমার একান্তই দুঃখ-বেদনা এবং লজ্জার বিষয়। তার আত্মমর্যাদাবোধ যাতে আহত না হয়, সে জন্য তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে চেষ্টা-তদবির করে তার কাজটি জুটিয়ে দিয়েছি, যাতে তার ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করতে পারে এবং আমি একান্ত ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক দুঃখগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।

আমার মনে হচ্ছে শামায়োখ তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা এভাবে দেখতে চেষ্টা করেছে। তার জীবনের এক দুর্বল মুহূর্তে তার জীবনের একান্ত লজ্জা এবং পরাজয়ের কাহিনী আমার কাছে প্রকাশ করেছে। এটা সে এই বিশ্বাসে করেছিল যে, শামারোখ ধরে নিয়েছিল তার ভাল, তার মন্দ সবকিছু জেনে আমি তাকে বিয়ে করব। তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে আমি তাকে যখন চাকরিটি পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করলাম এবং সেটা সে যখন পেয়ে গেল, শামারোখ ভাবতে আরম্ভ করেছে আমি তাকে করুণা করেছি। আমার কাছে সব চাইতে দুঃখের ব্যাপার হলো আমার এই সাহায্যটুকু সে বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে না। শামায়োখ তো আমাকে কম দেয় নি। এখন সে তার পথে যাক না কেন। তার তো কোনো কিছুর অভাব থাকার কথা নয়। মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রের ওপর একবিন্দু দখল না থাকা সত্ত্বেও আমি শামারোখের মনের গতিবিধি ‘ক্যাট’ মানে যেমন ‘বেড়াল’ সে-রকম প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পারছি।

শামারোখ বিষয়টা খুব সম্ভবত এভাবেই চিন্তা করছে। সে আমাকে গোপন গহন লজ্জা এবং পরাজয়ের কথা বলেছে এবং গভীর আকাক্ষাটির কথাও প্রকাশ করে ফেলেছে। আমি তাকে একটা অবস্থানে দাঁড়াতে সাহায্যও করেছি। সুতরাং সে ধরে নিয়েছিল আঁচল-বাঁধা-চাবির মতো আমাকে নিজের হাতে রেখে দেয়ার অধিকার আছে তার। তারপরে যখন তার পছন্দ হবে না ইচ্ছেমতো প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাটুকুও সে নিজের হাতেই রেখে দিতে চায়। আমি তার উপকার করেছি অথচ তার কাছে বাঁধা পড়ি নি এই জিনিসটাকে সে ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি যদি ওই এলাকায় না থাকতাম, তার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হবার অবকাশ না থাকত, এ-ধরনের মর্জি ও মানসিকতা তার মধ্যে আদৌ জন্ম নিত কি না, সন্দেহ।

দুঃখের কথা হলো আমি এই এলাকায় বাস করছি, প্রতিদিন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছে এবং সে নিজের চোখে দেখছে নানা মহিলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাদের কারো ঘরে বসে আলাপ করছি, কারো বাড়িতে যাচ্ছি। শামারোখ মনে করছে এই মহিলাদের কারো-না-কারো সঙ্গে আমার হৃদয়ের ব্যাপারস্যাপার আছে। আর এই কারণেই আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে আসার চেষ্টা করছি। শামায়োখ সঠিক ধরতে পারছে না কার সঙ্গে কি ধরনের সম্পর্ক আমার আছে এবং শোধ নেয়ার ঠিক ঠিক কর্মপন্থাটি গ্রহণ করতে পারছে না বলেই আমাকে ডানে-বামে আক্রমণ করার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। সে জীবনে পরাজিত হয়েছে একথা আমার কাছে বলেছে। এখন মনে করতে আরম্ভ করেছে আমার কাছে তার আরেকটা পরাজয় হলো। যে সমস্ত মহিলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে তাদের কেউই কোনোদিক দিয়ে তার চাইতে যোগ্য নয়। শারীরিক সৌন্দর্যে বলুন, লেখাপড়ায় বলুন, রুচি এবং সুকুমার উপলব্ধিতে বলুন, এই মহিলাদের সবাই শামারোখের চাইতে খাট। সুতরাং একমাত্র শামারোখ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পর্ক থাকবে কেন? অবশ্য শামারোখের সঙ্গে অন্য পুরুষ মানুষের যদি সম্পর্ক হয়, সেটা মোটেই ধর্তব্যের নয়। কারণ শামায়োখ অপরূপ মহিলা। সুন্দরী গুণবতী নারীর প্রতি তো পুরুষ মানুষেরা আকৃষ্ট হবেই। এতে শামারোখের দোষ কোথায়? জ্বলন্ত আগুনে যে পোকারা ঝাঁপ দিয়ে মরে তাতে কি আগুনের অপরাধ আছে? কারণ পোকাদের ভাগ্যই আগুনে পুড়ে মরা। শামারোখকে সব দিক দিয়ে সেকালের রানীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। রানী কি মনের মধ্যে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ লালন করে রানীগিরি টিকিয়ে রাখতে পারেন?

আমার দৃঢ় ধারণা, আমি যে তাকে সাহায্য করেছি এই ব্যাপারটিকে মানুষ করুণা এবং অনুকম্পাবশত যেমন পতিতা উদ্ধার করে কিংবা দুঃস্থ মহিলাদের সমাজে পুনর্বাসিত করে, সেভাবে সে বিচার করছে। শামারোখ পতিতা নয়, দুঃস্থাও নয়। অথচ আমি যখন অন্য মহিলাদের সঙ্গে আলাপসালাপ করছি, তীক্ষ্ণ মর্মবেদনায় অনুভব করছে, আমি তাকে করুণার পাত্রী হিসেবে দেখছি। এখানেই হলো সমস্ত গণ্ডগোলের উৎস। একদিনের একটি ঘটনার কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা কি একটা ব্যাপারে হরতাল ডেকেছে। গোলাগুলির আশঙ্কায় ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই সকাল সকাল ঘরে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে ফাঁকা। আমি জহরত আরার কাছে একটি ধার-করা বই ফেরত দিতে গিয়েছি। জহরত আরার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি অন্য একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, জাহিদ, তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা কর। আমি তখন জহরত আরার ঘরের সামনে সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়ালে নোটিশ বোর্ড দেখছি। নোটিশ বোর্ডে কি দেখব আমি? আসলে সময়টা পার করছিলাম মাত্র। হঠাৎ পিঠে কার হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি শামারোখ। শামারোখ আমাকে এভাবে আবিষ্কার করবে আমি ভাবতে পারি নি। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? আমি বললাম, আপার কাছ থেকে একটা বই ধার করেছিলাম, ফেরত দিতে এসেছি। শামারোখ বলল, টসটসে রসগোল্লার মতো রাক্ষুসী মহিলাদের কাছে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আপনার কি কোনো কাজ নেই? লাজলজ্জাও আপনার কম। সে সময়ে জহরত আরা তার মহিলা অতিথিকে বিদেয় দিতে ঘরের বাইরে এসেছিলেন। কথাগুলো তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। হে ধরণী দ্বিধা হও- মনে মনে উচ্চারণ করলাম।

আমার শিক্ষিকা তাহমিনা খানের কাছ থেকে আমি কিছু টাকা ধার করেছিলাম। অনেক দিনের পুরনো ঋণ শোধ করব-করব করেও করা হয় নি। অত টাকা এক সঙ্গে জড়ো করা সম্ভব হয় নি। এই ঋণটার জন্য তাহমিনা খানের কাছে আমার মুখ দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। সেদিন আমার প্রকাশক আমার বইয়ের রয়্যালটি বাবদ কিছু টাকা দিয়ে গেলেন, আমি স্থির করলাম, প্রথমেই তাহমিনা ম্যাডামের ঋণটা শোধ করব। টাকাটা যদি রেখে দিই অন্য কাজে খরচ করে ফেলব। সুতরাং টাকাটা শোধ করতে ছুটলাম। সকালের দিকে তার ক্লাশ থাকে, ডিপার্টমেন্টে অথবা তার ঘরে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।

তাহমিনা ম্যাডামের কথা সামান্য পরে বলব। তার আগে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী সম্পর্কে একটা মজার কথা বলে নিই। শুধু আমি নই, এ পাড়ার সকলেই জানেন, ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী প্রবন্ধ-ব্যাকরণের মতো মানুষ। তার রসবোধ অল্প। অথচ তিনি মাঝে মাঝে রসিকতা করেন না, এমন নয়। কিন্তু সেগুলো এমন বানিয়ে তোলা যে তাতে রসের ভাগ থাকে নিতান্ত অল্প, খিস্তির ভাগ থাকে বেশি। কিন্তু এইবার একটি কাজ করে তিনি যে সত্যি সত্যি রসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তিনি দুই তারকা-শিক্ষিকা শামারোখ এবং তাহমিনা খানকে একই রুমে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যৌবনে তাহমিনা খানও ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। ভাল ছাত্রী, ভাল বাংলা গদ্য লিখতেন এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। সবকিছু মিলিয়ে তার আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল। তিনি নিজের সম্পর্কে যা ভাবতেন, অন্যদেরও সেরকম ভাবতে বাধ্য করাতে পারতেন। কারণ তার চরিত্রের তেজ এবং দৃঢ়তা দুই-ই ছিল। কিন্তু তারপরেও একটা পাগলামো ভাব তার মধ্যে বরাবর ছিল। সেটা একটুও বেমানান ছিল না। প্রতিভাময়ী, সুন্দরী এবং ধনী বাবার মেয়েদের এরকম একআধটু পাগলামো থাকলে খারাপ তো দেখায় না, বরং সেটাকেই বাড়তি গুণ হিসেবে বিবেচনার মধ্যে ধরা হয়। মধ্য বয়সে এসে তাহমিনা ম্যাডামের সৌন্দর্যের দীপ্তি ম্লান হয়ে এসেছে, যৌবনে ভাটা পড়েছে কিন্তু পাগলামোর পরিমাণ কমে নি ।

শামারোখ এবং তাহমিনা খানকে যখন একই রুমে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো, আমরা তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটা করে ছোটখাট দুর্ঘটনার সংবাদ পেতে আরম্ভ করলাম । দুজনের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলতে থাকল। দোষ কার সে বিচারের চাইতেও দুই সুন্দরীর মধ্যবর্তী বিরোধের সংবাদ সবাই আনন্দসহকারে উপভোগ করছিলেন। শামারোখ এবং তাহমিনা খান দুজনের কেউ হারবার পাত্রী নন। দুজনে দুদিক দিয়ে শক্তিমান। তাহমিনার রয়েছে প্রতিষ্ঠা। আর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি প্রফেসর হয়ে যাবেন। শামারোখের চাকরিটি এডহক বেসিসে হলেও তার শরীরে এখন ভরা যৌবন এবং বিবাহ-ছিন্ন কুমারী মহিলা। বেলা এগারটার সময় আমি তাহমিনা ম্যাডামের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, তিনি বসে বসে টিউটোরিয়ালের খাতা দেখছেন। এখনো শামারোখ আসে নি । আমি মনে করলাম, ভাল সময়ে আসা গেছে। শামারোখ আসার আগে তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যাবে । আমি সালাম দিলাম। ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অ জাহিদ, কি মনে করে বসো। আমি টাকাটা গুণে টেবিলে রেখে বললাম, ম্যাডাম টাকাটা দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তিনি খাতা দেখতে দেখতেই বললেন, আজকাল বুঝি তোমার অনেক টাকা, চাকরিবাকরি তো কর না, কোথায় পাও টাকা, কে দেয়? এই ম্যাডামটি এরকমই । আমি অপেক্ষা করছিলাম আগে ম্যাডামের রাগটা কমুক।

এই সময়ে ঘরে ঢুকল শামারোখ । আমাকে দেখেই বলে ফেলল, জাহিদ ভাই, কখন এসেছেন? এদিকে আসুন। তাহমিনা ম্যাডাম হাতের খাতাটা বন্ধ করে শামারোখের দিকে একটা অগ্নিময় দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, জাহিদ আমার এখানে এসেছে। ওখানে যাবে না। সে আমার ছাত্র। চুপ করে বসে থাক জাহিদ, একচুলও নড়বে না। শামারোখ গলার স্বর আরেকটু চড়িয়ে বলল, আপনার ছাত্র, তাতে কি? উনি এসেছেন আমার কাছে, জাহিদ ভাই এদিকে চলে আসুন। কি করব বুঝতে না পেরে আমি শুধু ঘেমে যাচ্ছিলাম। শামারোখ আমার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এদিকে চলে আসুন। অন্য হাতটা ধরে তাহমিনা ম্যাডাম বললেন, তোমাকে

নড়তেচড়তে নিষেধ করেছি। আমি কোন্‌দিকে যাই! ঠিক এই সময় একটা কাজ করে বসলাম আমি। এক ঝটকায় দুমহিলার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে জোরে হেঁটে একেবারে আর্টস বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে এলাম।

এই ঘটনাটি গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নানারকম শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে গেল, আমার মুখ দেখাবার উপায় রইল না। আসল ঘটনা যা ঘটেছিল এবং যা প্রচারিত হয়েছিল, দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একদিন আমি ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ির পাশে দিয়ে যখন হেঁটে আসছিলাম, আমার অপর শিক্ষিকা মিসেস রায়হানা হক বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছিলেন। এই একরোখা মহিলাকে আমি বাঘের চাইতে বেশি ভয় করি। তিনি আমাকে রাস্তার একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, আচ্ছা জাহিদ, তোমার লাজলজ্জার বালাই কি একেবারেই নেই? ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ এবং উল্টোপাল্টা কাহিনীর জন্ম দিচ্ছ। আরেকদিন যদি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ধারেকাছে তোমাকে দেখি, তাহলে, সবার সামনে তোমাকে জুতোপেটা করে ছাড়ব। তখন তোমার শিক্ষা হবে। কথাগুলো বলে তিনি গট গট করে চলে গেলেন। আমার ইচ্ছে হলো দুহাতে মাথা ঢেকে সেখানে বসে পড়ি।

এ কমাসে আমি সবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে উঠেছি। এটাই শামারোখের প্রত্যক্ষ অবদান। নিচের দিকের ছাত্রেরা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। জুনিয়র শিক্ষকেরা ঈর্ষা করেন। শামারোখের মতো অনিন্দ্য সুন্দরী এবং বিদূষী মহিলাকে আমি পেছন পেছন ঘোরাচ্ছি, কি আছে এমন আমার। আমি সুদর্শন চেহারার অধিকারী নই। চাকরি নেই বাকরি নেই, একেবারে অসহায় মানুষ আমি। শামারোখ আমার মধ্যে কি দেখতে পেয়েছে! এরকম কথা সবাই বলাবলি করত। এই ধরনের প্রচারের একটা মাদকতার দিক তো অস্বীকার করা যায় না। আমার টাকা নেই, পয়সা নেই, রূপ নেই, গুণ নেই, তারপরও আমি মনে করতে থাকলাম, আমার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যার কাছে বাড়ি-গাড়ি, টাকা বিদ্যে-বুদ্ধি সব হার মেনে যায়। সে হলো আমার পৌরুষ । কখনো কখনো নির্জন মুহূর্তে আমি নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ মনে করতাম। সুন্দর মহিলাদের কেন পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়, তার হেতু আমি এখন বুঝতে পারছি। একমাত্র সুন্দরের বাতাবরণের মধ্য দিয়ে মিথ্যেকে সত্যে রূপান্তরিত করা যায়। তরুণ মেয়েরা যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসত। কখনো কখনো মনে হতো মেঘেতে ঠেকেছে আমার মস্তক।

এদিকে কি দশায় আমি এসে দাঁড়িয়েছি সে বিষয়ে একটু ধারণা দিতে চেষ্টা করি। বজলুর মেসে তিন মাসের খাওয়ার বিল আমি শোধ করতে পারি নি। বজলু খাবার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। বালিশ, বিছানার চাদর, মশারি ইত্যাদি চরম দফায় এসে পৌঁছেছে। বাড়ি থেকে ক্রমাগত টাকার তাগাদা জানিয়ে চিঠি আসছে। আমি এখন কি করি, আমাকে নিয়ে নানা রঙিন কাহিনী তৈরি হচ্ছে। অথচ আমার নাশতা কেনার পয়সা নেই। গুরুজনদের সামনে দাঁড়াতে পারছি নে। তাদের সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যেতে পারি নে, তারা আমাকে ঈর্ষা করেন। এক সময়ে আমি সাহস করে বলতাম, শামারোখ যদি বলে তার পেছন পেছন পৃথিবীর অপর প্রান্ত অবধি ছুটে যাব। পৃথিবীর অপর প্রান্তে চলে যাওয়াটাই বোধহয় আমার জন্য ভাল ছিল। আমাকে অসংখ্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বিরাগভাজন হয়ে এমন করুণ জীবন যাপন করতে হতো না। শামারোশের কল্যাণে এখানে আমি যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি তার নাম সীমাহীন শূন্যতা। নামতেও পারি নে, উঠতেও পারি নে। হাজার জনতার মাঝখানেও এমন নিঃসঙ্গ জীবন একজন মানুষ কেমন করে যাপন করে?

মেয়েদের হোস্টেলে সুলতানা জাহান হাউজ টিউটরের কাজ করে। সে আমাকে ভাই বলে ডাকে। ছ’ মাসও হয় নি বেচারির স্বামীটি খুন হয়েছে। তার তিনটি বাচ্চা। তার এত সময় এবং সুযোগ কোথায় যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হৃদয়, দহন, স্থলন, পতন, কেলেঙ্কারি এসবের দিকে মন দেয়। আমি প্রায় দিন সন্ধ্যেবেলা সুলতানার বাড়িতে যাই। তার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলো করে সময় কাটিয়ে আসি। আমিও এক ধরনের স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছিলাম। ক্রমাগত উত্তেজনা থেকে উত্তেজনার মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ওপর একরকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিলাম। সুলতানার বাসাতে যখন যেতে আরম্ভ করি, তার শিশুদের সঙ্গে যখন সময় কাটাতে থাকি, যখন এই দুঃখী গরিব সংসারের হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভাবের দিকে দৃষ্টিপাত করতে থাকি, আমি অনুভব করলাম, আমার ভেতরে একটা প্রশান্তির রেশ ফিরে আসছে। এই দুঃখী বোনটির প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। তাকে অর্থ-কড়ি দিয়ে সাহায্য করব, এমন ক্ষমতা আমার কোথায়? তবু তার বাড়িতে এটা-ওটা নিয়ে যেতাম। কখনো বাচ্চাদের খেলনা, কখনো কোনো খাবার কিংবা মওসুমের নতুন ফল। বাচ্চারা এই সামান্য জিনিস পেয়ে কী যে খুশি হয়ে উঠত! তাদের খুশিতে আমি নিজেও খুশি হয়ে উঠতাম। সুলতানার বাড়িতে আমি প্রায় ন’টা অবধি থাকতাম। না খাইয়ে সুলতানা আমাকে আসতে দিত না।

একদিন সুলতানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের গেট অবধি এসেছি, পেছন থেকে ডাক শুনলাম, দাঁড়ান। বুঝতে পারলাম, শামায়োখ। সে কি এই হোস্টেলে থাকতে আরম্ভ করেছেন? বুঝলাম সুলতানার বাড়িতে আসাও আমার বন্ধ করতে হবে। একদিন সুলতানার বাড়ি থেকে ফিরতে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল। কারণ সুলতানার ওখানে দেশের বাড়ি থেকে কিছু আত্মীয়-স্বজন এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে গল্পগাছা করতে করতে এতটা রাত পার করে ফেলেছি, সেদিকে খেয়ালও করি নি। সিঁড়ি থেকে যখন পথে নামলাম অমনি কারেন্ট চলে গেল। পথঘাট ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। পা ফেলা দায়। শামারোখের কণ্ঠস্বর শুনলাম, এই অন্ধকারে আপনি যাবেন কেমন করে? আমি বললাম, যেতে পারব। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যে কি করছেন? শামায়োখ খিলখিল করে হেসে উঠল। মনে হলো বোতল ভাঙা কাঁচের মতো তার হাসির রেশ অন্ধকারকে বিদ্ধ করল। সে বলল, জানতে চান, আমি কি করছি? এত রাতে এই বিধবা মহিলার বাড়িতে কি করেন, জানার জন্য পাহারা দিচ্ছি। আমার ইচ্ছে হলো চড় বসিয়ে দিই। তারপরের সপ্তাহে সুলতানার বাড়িতে যখন গেলাম, সে হাতজোড় করে জানালো, জাহিদ ভাই, আপনি আমাদের এখানে আর আসবেন না। মুখটা ফিরিয়ে সে কেঁদে ফেলল।

শিক্ষকদের লাউঞ্জে যাওয়া আমাকে একরকম ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবু মাসের তিন তারিখে আমাকে যেতে হতো। চেয়ারম্যানের খোঁজে আমি ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কারণ তিনি ফর্মে সই না করলে আমি স্কলারশিপের টাকা ওঠাতে পারব না। পিয়ন জানালো, তিনি অফিসে নেই, তবে লাউঞ্জে থাকতে পারেন। আমি তার খোঁজে লাউঞ্জে গেলাম। দেখলাম তিনি ওখানেও নেই। মস্ত ফাপড়ে পড়ে গেলাম। আজকেই আমার টাকাটা ওঠানো প্রয়োজন। আমি টাকা না দিলে বজলু রেশন তুলতে পারবে না। চেয়ারম্যান সাহেবকে কোথায় পাওয়া যায় খোঁজ করে দেখা প্রয়োজন।

আমি বেরিয়ে আসছিলাম। কিন্তু কামাল পথ আটকালেন, জাহিদ ভাই, পালাচ্ছেন কোথায়? আমি বললাম, পালাচ্ছি না। একটু কাজ আছে। কামাল বললেন, আপনার যে এখন অনেক কাজ সে তো আমরা জানি। কিন্তু আমাদের খাওয়া কোথায়? আমি বললাম, কিসের খাওয়া? তিনি বললেন, বা রে আপনি বিয়ে করবেন আর আমাদের খাওয়াবেন না! পেয়েছেনটা কি? আমি জানতে চাইলাম, কোথায় শুনেছেন আমার বিয়ে হয়েছে। তিনি বললেন, শোনাশুনির মধ্যে নেই, যাকে বিয়ে করেছেন তিনিই বলেছেন। আমি বললাম, ওই তিনিটা কে?

আর কে? আমাদের সুন্দরী শ্ৰেষ্ঠা বেগম শামারোখ ।

কথাটা শুনে আমি কেমন থতমতো খেয়ে গেলাম। শামায়োখটা কি? সে কি পাগল, না মতলববাজ? আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে না তো? আমি দেখলাম এই সময় ময়ূরের মতো পেখম মেলে শামারোখ লাউঞ্জে ঢুকছে। আমি স্থানকালের গুরুত্ব ভুলে গিয়ে শামারোখকে ডাক দিলাম, এই যে শামারোখ, শোনেন তো। শামারোখ অনেকটা উড়তে উড়তে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ তার মনে খুব ফুর্তি। আমি বললাম, সুসংবাদটা আমি এই এক্ষুনি পেলাম। আপনি একেবারে না জানিয়ে যে আমাকে বিয়ে করে বসলেন, কাজটা ঠিক হয় নি। অন্তত খবরটা আমাকে জানানো উচিত ছিল। কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের খোঁজে বেরিয়ে গেলাম। কোথাও তাকে না পেয়ে ঘরে এসে নিজেকে সটান বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম। আজ টাকা না দিলে বজলু খাবার দেবে না বলেছে।

আমার চোখে তন্দ্রার মতো এসেছিল। ভেজানো দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। চেয়ে দেখি শামারোখ। তার মুখ লাল, চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। অনেকটা চিৎকার করেই বলল, এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে অপমান করার সাহস আপনার হলো কেমন করে? আমি বললাম, আমাকে না জানিয়ে একেবারে বিয়ে করার সাহস কি করে আপনি পেলেন, আগে বলুন। সে বলল, আপনি একটা শয়তান। আমি এক্ষুনি মজা দেখাচ্ছি। এক্ষুনি আমি দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছি। তখন বুঝবেন মজা। সে রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । তার এই হুমকির মুখে আমার মনে কৌতুকবোধ চাড়া দিয়ে উঠল। আমি চেয়ারটা রেলিংয়ের গোড়ায় এগিয়ে দিয়ে বললাম, এই চেয়ারে ভর দিয়ে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়ান। তারপর শরীরটা ওপাশে ছুঁড়ে দিন। সে এক কাণ্ড হবে। মজা আমি একা নই রাস্তায় যেসব ছাত্র যাওয়া-আসা করছে, তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললাম, তারাও দেখবে। আপনার ভেতরের সুন্দর থেতলে যাওয়া অঙ্গ-প্রতঙ্গ সবার সঙ্গে আমিও দেখতে পাব। দাঁড়িয়ে কেন, দিন, লাফ দিন।

শামারোখ রেলিংয়ের গোড়া থেকে সরে এসে আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলতে লাগল, আপনি একটা বদমাশ, লুচ্চা। জহরত আরার সঙ্গে কি করেন, আধারাত সুলতানার বাড়িতে কী রকম আসনাই করে কাটান, আজ সব বলে দেব। একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। আমি বললাম, প্রথম যে কাজটা করতে চেয়েছিলেন সেটার চাইতে একটু খারাপ। তবু মন্দ না, দিন হাটে হাঁড়ি ভেঙে। সে ছুটে এসে আমার বাহুমূলে একটা কামড় বসিয়ে দিল। আমি একটা মশারির স্ট্যান্ড ভেঙে তাই দিয়ে তাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলাম। ঠিক কোন্ সময়ে কোন উপলক্ষে শাহরিয়ারের সঙ্গে শামায়োখের পরিচয় হয় আমি বলতে পারব না। শাহরিয়ার তখন সবে আমেরিকা থেকে এসেছে। ওখানকার ডাক্তারেরা তার রোগের কেমন চিকিৎসা করেছেন, সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা আছে কি না, আমি কোনো কিছু জানি নে। শুধু সংবাদপত্রের খবর থেকে জানতে পেরেছি, আমেরিকা থেকে চিকিৎসা করিয়ে শাহরিয়ার দেশে ফিরেছে।

শাহরিয়ারের বর্তমান অবস্থা কেমন, সে কোথায় থাকছে এসব খবরও আমাকে কেউ জানায় নি। আমারও এত ব্যস্ত সময় কাটছে, নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে তার ব্যাপারে তত্ত্বতালাশ করার কোনো অবকাশ হয় নি। একদিন কোনো একটা পত্রিকায় শাহরিয়ারের একটা কবিতা পড়লাম। পড়ে চমকে গেলাম। এই রকম একটা কবিতা শাহরিয়ারের কলম থেকে বেরুল কেমন করে? কবিতাটি পড়ার পর আমার চেতনায় একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ খেলে গেল। কবিতাটি বার বার পড়তে হলো। সাদা চোখে দেখলে এটাকে প্রেমের কবিতা বলতে হবে এবং শাহরিয়ারও একজন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছে। কবিতার বাক্যকে ছাড়িয়ে আরো একটা গভীর অর্থময়তা আমার চেতনার দুয়ারে দুয়ারে টোকা দিতে থাকল। কবিতাটি উদ্ধৃত করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। তাই উদ্ধৃত করা গেল না। একটি বিষাদের ভাব আমার মনে চারিয়ে গেল। শাহরিয়ার কাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছে? সে কি কোনো নারী- না তার মৃত্য? মৃত্যু কেন সুন্দরী নারীর মূর্তি ধরে এমন শোভন সুন্দর বেশে তার কবিতায় এসে দেখা দিল!

সেই মুহূর্তে শাহরিয়ারকে এক ঝলক দেখার আকাঙ্ক্ষা, তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার মনে তীব্র হয়ে উঠল। শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার এমন কোনো গভীর সম্পর্ক আছে, সে কথাও ঠিক নয়। আমাকে শাহরিয়ার বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। লোকজনের সামনে আমাকে অপদস্থ করতেও তার বাধে না। সে আমার চাইতে বয়সে ছোট। শাহরিয়ার এই বয়সের ব্যবধানের কথা ভুলে গিয়ে আমাকে আক্রমণ করত। বয়সে বড় হওয়ার এই এক দোষ। কম বয়সী কেউ আক্রমণ করলে পাল্টা অক্রমণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আবার আঘাতটাও বুকে বাজে। এই ধরনের বিদঘুঁটে পরিস্থিতির মুখোমুখি যাতে না হতে হয়, সে জন্য আমি শাহরিয়ারকে এড়িয়ে চলতাম। আমার সম্পর্কে শাহরিয়ার যাই-ই মন্তব্য করুক না কেন আমি জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করতাম না। আমি জানতাম, আসলে এগুলো তার নিজের কথা নয়। যেসব মানুষের সঙ্গে ইদানীং তার চলাফেরা শাহরিয়ার তার নিজের মুখ দিয়ে তাদের কথাই প্রকাশ করছে। এমনও সময় গেছে মাঝে মাঝে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার দুতিনমাসও দেখা হয় নি। এই অদর্শনের সময়টিতে শাহরিয়ারের কথা যখন মনে হতো, তার সঙ্গে আমার কখনো মনোমালিন্য হয়েছে, কখনো ঝগড়াঝাটি হয়েছে, সেসব ব্যাপার একেবারেই মনে থাকত না। তার মুখ এবং চোখ দুটোই আমার মনে ভেসে উঠত। শাহরিয়ারের মুখের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল, আমার চোখে সেরকম কিছু ধরা পড়ে নি। তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, কোনো ভাস্কর যদি মূর্তি গড়ে, তার মুখমণ্ডলটি তৈরি করার বেলায় তাকে গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে। যদিও শাহরিয়ার প্রকৃতিতে ছিল খুবই চঞ্চল, তথাপি তার মুখে একটা ধ্যান-তন্ময়তার ভাব সময় সময় লেগে থাকত। সবচাইতে সুন্দর ছিল তার চোখ দুটো। পুরুষ মানুষের এমন আশ্চর্য সুন্দর চোখ আমি খুব কমই দেখেছি। যেদিকেই তাকাতো, মনে হতো, একটা স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার ধারণা শাহরিয়ারের সঙ্গে মতামতের গড়মিল সত্ত্বেও খুব সহজে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে তার যে বন্ধুত্ব হয়ে যেত, তার প্রধান কারণ ছিল তার চোখের দৃষ্টি।

শাহরিয়ারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে কামাল সাহেবের অফিসে। কামাল সাহেব একটি ছোট গল্পের পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তিনিই প্রথম আমাকে শাহরিয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, জাহিদ ভাই আপনাকে আমার পত্রিকার এক নতুন লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, ছোট গল্প লেখে। কথা বলে দেখুন, আপনার ভাল লাগবে । শাহরিয়ার যখন কথা বলল, কণ্ঠস্বর শুনেই আমার মনে একটা ভাবান্তর এসে গেল। ভরা কলসির পানি ঢালার সময় যেমন থেকে থেকে একটা মিষ্টি সুন্দর আওয়াজ সৃষ্টি হয়, শাহরিয়ারের কণ্ঠস্বরে সে রকম একটা জল ছলছল ভাবের আভাস আমার শ্রবণে মননে বিধে গেল। ছেলেটিকে তো আমার মনে ধরে গেল।

তারপরে তো শাহরিয়ার গল্প ছেড়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করল। আমি কবিতার সমঝদার নই। তবু শাহরিয়ারের কবিতার মধ্যে এমন একটা মেজাজ পেয়ে যেতাম, বক্তব্য বিষয় ছাপিয়ে গড়ানো পঙক্তিসমূহের ভেতর থেকে শব্দ শুনছি, শব্দ শুনছি, জল চলছে জল চলছে এমন একটা ভাব বেরিয়ে এসে আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। মাত্রা ভুল এবং ছন্দগত ত্রুটিকে উপেক্ষা করেও শাহরিয়ার তার কবিতায় আশ্চর্য একটা সম্মোহন সৃষ্টি করতে পারত। এটাই শাহরিয়ারের আসল ক্ষমতা। কিন্তু শাহরিয়ারের কবিতার প্রতি আমার মুগ্ধতা-বোধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নি। এক সময় তার কবিতা আর পড়তে পারতাম না। পড়লেও বিরক্ত হয়ে উঠতাম। কারণ কবিতায় আমি অন্য জিনিস চাইতাম।

শাহরিয়ারের কবিতা পছন্দ করিনে বলে তার তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের চিড় ধরে নি। শাহরিয়ার যে আমার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক সময় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। কজন বন্ধু মিলে আরমানিটোলার হোটেল ওরিয়েন্টের দুতিনটে রুম ভাড়া করে একটা মেস চালু করেছিলাম। সেই মেসে শাহরিয়ার আমার সঙ্গে থাকতে আসে। সে ছাত্র পরিচয়ে আমাদের এখানে এসেছিল। কিন্তু মেসের সদস্য ছিল না। আমার গেস্ট হিসেবেই থাকত। কদিন না যেতেই একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। শাহরিয়ার ঠিক সময়ে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। আজেবাজে মানুষদের সঙ্গে চলাফেরা করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। এরকম তিন চারদিন দেখার পর, একদিন আমি বললাম, শাহরিয়ার তুমি য়ুনিভার্সিটিতে যাচ্ছ না। কেন? সে বলল, জাহিদ ভাই, সেটা একটা দুঃখের কথা। আমি বললাম, বলে ফেল, কি দুঃখের কথা। সে বলল, আপনাকে জানাতে আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। আমি বললাম, আমরা এমন এক অবস্থায় বাস করছি যেখানে সংকোচ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তোমার দুঃখের কথাটা বলে ফেল। শাহরিয়ার বলল, জাহিদ ভাই, ডিপার্টমেন্টে আমার নামটা কাটা গেছে। তিনমাস টুইশন ফি দিই নি। আব্বাও টাকা পাঠাচ্ছেন না। আমি ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। আপনাদের এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা না হলে আরো বিপদে পড়ে যেতাম।

শাহরিয়ারের নামটা কাটা যাওয়ার সংবাদ শুনে আমি খুব ব্যথিত বোধ করলাম । বিশ্ববিদ্যালয়ে আমারো নাম কাটা গিয়েছিল। আজ তুলব, কাল তুলব করে টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় আমার নামটি তোলা আর সম্ভব হয় নি। এক সময় পড়াশোনাটা আমার বাদ দিতে হলো। একই ব্যাপার শাহরিয়ারের ক্ষেত্রেও ঘটতে যাচ্ছে।

সে সময় বাংলাবাজারের এক প্রকাশকের কাছে আমি একটা উপন্যাস গছাতে পেরেছিলাম। আমি একেবারে নাম-পরিচয়হীন উগ্র একজন তরুণ লেখক। আমার লেখা প্রকাশক ছাপার জন্য গ্রহণ করবেন কি না, সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তবু পরদিন সকালবেলা প্রকাশকের বাড়িতে গিয়ে দাবি করে বসলাম, তাদের তো আমার উপন্যাসটি ছাপতে হবে, উপরন্তু অগ্রিম হিসেবে আজই দেড় হাজার টাকা রয়্যালিটি পরিশোধ করতে হবে । প্রকাশক ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে, আপনি আজই পনেরশ টাকা নিয়ে যান। কিন্তু বই ছাপার জন্য চাপাচাপি করবেন না। আমাদের সময় হলেই বই প্রেসে যাবে।

আমার হাতে প্রকাশক ভদ্রলোকের দেয়া কড়কড়ে নোটের পনেরশ টাকা। আমার প্রথম উপন্যাস লেখার টাকা। দক্ষিণ মেরু জয় করে এলেও আমার এরকম আনন্দ হতো না। এ টাকা দিয়ে কি করব, তাই নিয়ে একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। কখনো মনে হলো আমার প্রিয় লেখকদের বইগুলো কিনে ফেলি। আবার ভাবলাম, বই কেনা আপাতত থাকুক। আমি ঠিক সময়ে টাকা শোধ করতে পারি নি বলেই আরমানিটোলার মেসের বন্ধুদের কষ্ট করতে হয়। তাদের সবাইকে নিজের হাতে বাজার করে একবেলা ভাল খাওয়াবো। আবার ভাবতে হলো মাকে আমি আপন রোজগারের টাকা এ পর্যন্ত কোনোদিন পাঠাতে পারি নি। সামান্য হলেও কিছু টাকা মার কাছে পাঠাতে হবে। নিজের জামা-কাপড়ের দিকেও তাকালাম। আমার পরনের শার্ট একটিতে এসে ঠেকেছে। একটা নতুন শার্ট না বানালে আর চলে না। শীত এসে গেছে। একটা গরম সুয়েটার বা জ্যাকেট কেনা প্রয়োজন। বই কেনা, মেসের লোকদের খাওয়ানো, মার কাছে টাকা পাঠানো এবং নিজের জামাকাপড় কেনা ওসব বিষয় একপাশে ঠেলে রেখে ভাবলাম, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় শাহরিয়ারের নাম উঠানো প্রয়োজন। নাম ওঠানোর পরে যদি বাকি টাকা থাকে অন্য সমস্ত কিছু করা যাবে।

আমি মেসে এসে শাহরিয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম ওঠানোর জন্য কত টাকা প্রয়োজন? শাহরিয়ার হিসেবটিসেব করে বলল, জাহিদ ভাই, সব মিলিয়ে একশ পঁয়ত্রিশ টাকা প্রয়োজন। আমি তার হাতে একশ টাকার একটি, তিনটি দশ এবং একটি পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললাম, এই তোমার একশ পঁয়ত্রিশ টাকা। রেজিস্ট্রার অফিসে জমা দিয়ে নামটা তোলার ব্যবস্থা কর। শাহরিয়ার হাত পেতে টাকাটা নিল। টাকাটা তাকে দিতে পেরে আমার কী যে ভাল লাগল, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার প্রথম লেখার টাকা দিয়ে একজন তরুণ কবির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া রোধ করতে পারলাম। তার পরদিন সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখি শাহরিয়ার ফজলুর রহমানের সঙ্গে বসে বসে কেরাম খেলছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগল। প্রথম লেখার টাকা দিয়ে তোমার নামটা ওঠাবার ব্যবস্থা করলাম, আর তুমি ক্লাশে না গিয়ে সকালবেলাটা কেরাম খেলে কাটিয়ে দিচ্ছ! অবশ্য মুখে শুধু বললাম, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছ না? শাহরিয়ার বলল, জাহিদ ভাই, কাল আপনি রাত করে এসেছিলেন, তাই আপনাকে বলা হয় নি। আমার নাম উঠিয়েছি, তবে আরো পঁয়তাল্লিশ টাকা দিতে হবে। সেমিনার চার্জ পঁয়তাল্লিশ টাকা, হিসেব করার সময় আমার মনে ছিল না। আমি বললাম, আর পঁয়তাল্লিশ টাকা দিলে তোমার নাম উঠে যাবে তো? শায়রিয়ার বলল, নাম তো উঠে গেছে। এই চার্জটা আলাদা দিতে হবে। আমি বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকাল কি ছুটাছুটাভাবে ফি আদায় করা হয়। শাহরিয়ার বলল, হ্যাঁ, এরকম একটা নতুন নিয়ম করা হয়েছে। আমি বাক্যব্যয় না করে আরো পঁয়তাল্লিশ টাকা তার হাতে তুলে দিলাম।

সে রাতে শাহরিয়ার আর মেসে ফেরে নি। তারপরের রাতেও না। আমি তার কোনো বিপদআপদ হয়েছে কিনা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। এই সময়ে ফজলুর রহমান এসে আমাকে আসল খবর জানালো। সে বলল, জাহিদ ভাই, শাহরিয়ার তো আপনার খুব পেয়ারের লোক। আর আমাদের মনে করেন নষ্ট মানুষ। আপনি মনে করেন আমাদের সংসর্গে থাকলে আপনার শাহরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। কে কাকে নষ্ট করছে, আপনাকে আজ হাতেনাতে দেখিয়ে দেব। আপনি প্যান্টটা পরুন এবং চলুন আমার সঙ্গে।

ফজলুর রহমান আমাকে বাবু বাজারের একটা কানাগলির মধ্যে নিয়ে এল। প্রস্রাবের গন্ধে পেটের নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায় সেই সরু গলির মধ্যে খোপ খোপ ঘর। প্রতি ঘরের সামনে রঙচঙ মাখা একেকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা শরীরে এমনভাবে পাউডার মেখেছে, মনে হয়, মাগুর মাছের শরীরে ছাই মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এই সেই ঢাকা শহরের প্রসিদ্ধ পতিতা পট্টি। ঘেন্নায় আমার নাক মুখ কুঞ্চিত হয়ে এল। আমি ফজলুর রহমানকে বললাম, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে? ফজলুর রহমান বলল, জাহিদ ভাই, উতলা হচ্ছেন কেন, আপনাকে আসল জায়গাতেই নিয়ে এসেছি। আপনি আমার পেছন পেছন আসুন। আপনার সঙ্গে কবি শাহরিয়ারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেব। ফজলুর রহমান এবারে একটি ঘরের দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, এই দরজায় আপনি টোকা দিন, শাহরিয়ারের দেখা পেয়ে যাবেন।

আমি সেই বন্ধ ঘরের কাঠের কপাটে টোকা দিতে থাকলাম। ভেতর থেকে লোকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। এক সময় নারী কণ্ঠের একটা আওয়াজ শুনলাম, আউজকা অইব না, অন্য ঘরে যাও। আমার ঘরে লোক আছে। সেই কথা শোনার পরও আমি টোকা দিয়ে যেতে থাকলাম। অবশেষে দরজা খুলে গেল। একটি মেয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ঢেমনির পুত তোরে কই নাই আমার ঘরে আইজ মানুষ আছে। মেয়েটির পরনে ব্লাউজ এবং সায়া ছাড়া শরীরে আর কোনো বসনের বালাই নেই। আমি একেবারে তার মুখোমুখি চলে এলাম। ভক ভক করে দেশী মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তাকে হাত দিয়ে ঠেলে আমি ঘরে ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল । আমার পরিচিত আরেকজন বুড়ো কবির সঙ্গে বসে বসে শাহরিয়ার বাংলা মদ টানছে। আমার প্রথম বই লেখার টাকা কোন সুড়ঙ্গ পথে যাচ্ছে বুঝতে বাকি রইল না । শাহরিয়ারের চুল ধরে কিল-চড় মারতে আরম্ভ করলাম। তাকে কিল-চড় মেরেই যাচ্ছিলাম, কি করছি আমার কোনো হুঁশ ছিল না। এই ফাঁকে সেই পরিচিত বুড়ো কবি কোথায় উঠে পালাল, খেয়াল করতে পারি নি। এখন ভেবে অবাক লাগে শাহরিয়ার আমাকে পাল্টা মার দিতে চেষ্টা করে নি কেন? মেয়েটি আমাকে থামাবার অনেক চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে পাড়ার গুণ্ডাটিকে ডেকে আনল। গুণ্ডাটি এসে আমার ঘাড়ের কাছে এমন একটা ঘুষি লাগাল যে, আমাকে বসে পড়তে হলো। তারপরে মারতে মারতে একেবারে কাহিল করে ফেলে চুল ধরে সেই নোংরা গলি দিয়ে হাঁটিয়ে এনে সদর রাস্তার ওপর ছেড়ে দিল। আমি এদিক ওদিক তাকালাম। কিন্তু ফজলুর রহমানের চিহ্নও কোথায়ও দেখতে পেলাম না।

এই ঘটনার পর থেকে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার আর কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় নি। কিন্তু তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা আমার বন্ধ হয় নি। একই শাহরিয়ারের মধ্যে আমি দুজন মানুষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। এক শাহরিয়ার ছিল নিরীহ, ফুলের মতো কোমল। তার চোখের দিকে তাকালে বনের হরিণের কথা মনে পড়ে যেত। হরিণের মতো তার চোখে একটা অসহায়তার ভাব ছল ছল জেগে থাকত। আরেক শাহরিয়ার ছিল চালবাজ, অকৃতজ্ঞ এবং লোভী। তবু শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নেই। শাহরিয়ার বেশ্যাপাড়ায় যাতায়াত করেছে এবং বেশ্যাসক্ত হয়ে পড়েছে এ নিয়েও বলার কিছু ছিল না। কারণ কবিতা লেখা এবং বেশ্যাসক্ত হওয়া একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবি যশোপ্রার্থী তরুণেরা অনেকেই যেত, শাহরিয়ার ছিল তাদেরই একজন। সে সময়ে বেশ্যাপাড়ায় যাওয়াটা একটা বিশেষ মর্যাদার ব্যাপার বলে ধরে নেয়া হতো।

শাহরিয়ারের প্রতি আমার নালিশ নেই, কিন্তু দুঃখ আছে। দুঃখ এই কারণে যে দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো সে এই বেশ্যাদের কাছ থেকেই পেয়েছে। অপরিমিত মদ্যপান, অনাহার, অনিয়ম এবং বেশ্যা সঙ্গের কারণে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছিল, এখানকার ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন, এ দেশে তার চিকিৎসা নেই। বাইরেটাইরে কোথাও চেষ্টা করলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়তো অসম্ভব নাও হতে পারে। অনেকে শাহরিয়ারের অসুখের কথা জানত, অনেকেই তার কবিতা ভালোবাসতো। বিনা চিকিৎসায় শাহরিয়ারের মতো একজন সম্ভাবনাময় কবি মারা যাবে, এটা কেউ মেনে নিতে পারে নি। শাহরিয়ারকে মার্কিন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর একটা জোর দাবি উঠেছিল। সরকারকে সে দাবি মেনেও নিতে হয়েছে । পুরিসির চিকিৎসার জন্য সরকার তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পাঠিয়েছিল। আমি এতদূর পর্যন্ত শাহরিয়ারের খবর রাখতাম। চিকিৎসা শেষ করে দেশে এসেছে, এই সংবাদ আমি পত্রিকায় পড়েছিলাম। তারপরেইতো পড়লাম, কবিতা। শাহরিয়ারের খবর জানার জন্য আমার মনটা আকুল হয়ে উঠল। আমি মোহাম্মদপুরে মাহফুজের বড়িতে গেলাম। কারণ একমাত্র মাহফুজই গত আট-দশ বছর ধরে শাহরিয়ারকে বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে আসছে। বিদেশে পাঠানোর বেলায়ও মাহফুজ যত খাটাখাটনি করেছে, তার তুলনা হয় না।

মাহফুজ মোহাম্মদপুরে এক সঙ্গে শ্বশুরএবং শালা-শালিদের নিয়ে থাকে। একদিন তার ওখানে শাহরিয়ারের খবর নিতে গেলাম। মাহফুজ বলেছিল লেপ তোশকের দোকানের পেছন দিক দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বেল টিপতে। ওটাই ঊনত্রিশ নম্বর। দোতলায় উঠে বেল টিপলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। ম্যাক্সি পরা একটি যুবতী মহিলা বেরিয়ে এসে কাট কাট জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চান? আমি বললাম, মাহফুজ সাহেবকে। মহিলা আমাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, পাশের দরজায় বেল টিপুন। পাশের দরজায় বেল টিপতেই একটি বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, কার কাছে আইছেন? আমাকে আবার মাহফুজ সাহেবের নাম বলতে হলো। মেয়েটি বলল, আমার পাছ পাছ আইয়েন। একটি প্যাসেজ মতো করিডোর পার করিয়ে একটা বদ্ধ দরজা দেখিয়ে বলল, ওই হানে কড়া নাড়েন। কড়া নাড়লাম। মাহফুজ স্বয়ং দরজা খুলে দিলেন। আমি তার ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে-না-বসতেই মাহফুজ বলে ফেললেন, জাহিদ ভাই আমি ঠিক করেছিলাম আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না। বাসায় আসছেন যখন কথা তো বলতেই হবে, কি খাবেন কন? আমি বললাম, আমার সঙ্গে যে কথা বলতে চান না, আমি অপরাধটা কি করলাম? মাহফুজ বললেন, সমস্ত অপরাধ তো আপনার । আপনি কোত্থেকে শামারোখ না কি এক ডাকিনী মহিলাকে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বসিয়েছেন, সে তো এদিকে সর্বনাশ করে ফেলেছে। আমি বললাম, একআধটু সর্বনাশ করার ক্ষমতা না থাকলে সুন্দরী হয়ে লাভ কি? শামারোখ কোথায় কার সর্বনাশটা করল বুলন দেখি। মাহফুজ পুনরায় জানতে চাইলেন, এই মহিলার সাম্প্রতিককালের কাজকর্ম সম্পর্কে আপনি কিছু কি জানেন? আমি বললাম, এত দ্রুতগামী মানবী শামারোখ তার সমস্ত কাজকর্মের হিসেব রাখা একজন মানুষের পক্ষে কি সম্ভব? তিনি বললেন, ওই ডাকিনী তো শাহরিয়ারকে খুন করতে যাচ্ছে। আমি বললাম, তাই নাকি? তাহলে তো একটা কাজের কাজ করছে। শাহরিয়ারকে পুরিসির মতো জবরদস্ত রোগ খুন করতে পারল না, আর তাকে শামারোখ খুন করবে! তাহলে তো একটা ঘটনাই ঘটে যায়। মাহফুজ বললেন, রসিকতা বাদ দিয়ে আসল ব্যাপার শুনুন। মাহফুজের কথা শুনে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।

শাহরিয়ারকে মার্কিন ডাক্তার বলেছেন, চার বছর তাকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাকে ঠিক সময়ে খেতে হবে, ঠিক সময়ে ঘুমোতে হবে। ওষুধ-পথ্য সব যথাযথ নিয়মে চালিয়ে যেতে হবে। ওই নিয়মের যদি খেলাপ হয় তাহলে পুরনো রোগটা আবার নতুন করে দেখা দেবে। যদি রোগ নতুন করে দেখা দেয় তাকে বাঁচানো আর সম্ভব হবে না। শামারোখের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে শাহরিয়ার ওষুধ-পথ্য কিছুই ঠিকমতো খাচ্ছে না। মহিলার সঙ্গে দেশের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন বারোটা একটা অবধি রাত জাগছে। অহরহ সিগারেট টানছে। শাহরিয়ারকে ওই মহিলার সঙ্গে ছুটোছুটি করতে বারণ করলে কিছুতেই সে শোনে না, অনর্থক রাগারাগি করে। মাহফুজ বললেন, আমি অনেক করে শাহরিয়ারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি, তুমি একটা সিরিয়াস রোগী, এ ধরনের অনিয়ম করে গেলে তোমার শরীর ওই ধকল সহ্য করবে না। আমি বললাম, শাহরিয়ার কি বলল। মাহফুজ বললেন, সে কথা আর বলে লাভ কি? সে বলে পৃথিবীতে একজন মানুষও যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে সেই একজন মানুষ হলো শামারোখ । অন্য সব ব্যাপারে সে পরামর্শ-উপদেশ ওসব শুনতে রাজি। কিন্তু শামারোখের বিষয়ে শাহরিয়ার কারো কোনো কথা শুনবে না।

আমি বললাম, শামারোখকে শাহরিয়ারের রোগের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন? মাহফুজ বললেন, সে অত্যন্ত খতরনাক মেয়ে মানুষ। আমি মহিলাকে শাহরিয়ারের রোগের কথা জানিয়ে সতর্ক করতে চেষ্টা করলে ওই অসভ্য মহিলা আমার মুখের ওপর বলে বসল, শাহরিয়ারের কোনো ভাবনা আর তার বন্ধুদের না ভাবলেও চলবে। সব দায়-দায়িত্ব শামারোখ একা তার ঘাড়ে করে তুলে নিয়েছে। আমি বললাম, একদিক দিয়েতো ভাল হলো। শাহরিয়ারের শরীরের ওই অবস্থায় এরকম কেউ একজন থাকা তো প্রয়োজন, যে তাকে সর্বক্ষণ দেখাশোনা করতে পারে । শামারোখকে আমি যতটুকু জানি, যে মানুষকে সে ভালোবাসে তার জন্য এমন আত্মত্যাগ নেই যা সে করতে পারে না। মাহফুজ বললেন, দেখবেন অবস্থাটা কি দাঁড়ায়। এরকম চলতে থাকলে চারমাসও সুস্থ থাকতে পারে কিনা সন্দেহ। মাঝখান থেকে আমার মেহনতটাই বরবাদ। গত আট বছর ধরে শাহরিয়ারকে আগলে আগলে রাখছি। এখন আমি কেউ নই শাহরিয়ারের। ওই মহিলাই সব। মহিলা আজকাল আমাকে শাহরিয়ারের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না। মাহফুজের কথার মধ্যে একটা গভীর বেদনার আভাস পাওয়া গেল। আমি মাহফুজের দুঃখটা অনুভব করতে পারি। মাহফুজ গত আট বছর শাহরিয়ারের জন্য যা করেছেন, কোনো মানুষ তার নিকটাত্মীয়ের জন্যও অতটা করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাহরিয়ারকে পাঠানোর জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দিনে-রাতে খেটেছেন। মার্কিন দেশের হাসপাতালে ভর্তি করানো, সরকারের ঘর থেকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ, পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা করা সবকিছুর ধকল একা মাহফুজকেই পোহাতে হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে একদিন এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে আমার সঙ্গে শাহরিয়ার এবং শামারোখের দেখা হয়ে গেল । শাহরিয়ার চমৎকার একটি আকাশী নীল উলের জ্যাকেট পড়েছে। মাফলারটা গলার চারপাশে জড়ানো। তার সারা শরীর থেকে তারুণ্য ঝরে ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় দেখে কারো মনে হওয়ার উপায় নেই, শাহরিয়ারের শরীরে কোনোরকম রোগব্যাধি আছে। আগের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে শাহরিয়ারকে। শামারোখ পরেছিল মেরুন রঙের শাড়ি। শাহরিয়ারের পাশে শামায়োখকে এত অপূর্ব দেখাচ্ছিল, অনেকক্ষণ আমি দুজনের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি নি।

আসর ভেঙে যাওয়ার পর শামারোখ আমাকে নেহায়েত ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করেছিল, গান কেমন শুনলেন? নেহায়েত একটা জবাব দিতে হয়, তাই বলেছিলাম, ভাল। শাহরিয়ার আমার দিকে একজন অপরিচিতের দৃষ্টি দিয়ে তাকালো এবং জিজ্ঞেস করল, জাহিদ সাহেব নাকি? কেমন আছেন, আপনি এখন কোথায় থাকেন? শাহরিয়ারের এই ধরনের সম্ভাষণ শুনে আমি মনের মধ্যে একটা আঘাত পেয়ে গেলাম। সে ঢাকা আসার পর থেকেই আমাকে জাহিদ ভাই ডেকে আসছে। বুঝতে পারলাম, শামারোখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে আমার অস্তিত্বটাই তার পক্ষে অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে শামারোখের এতদিনের মেলামেশা সম্পর্কে সে জানতে পেরেছে। নানা মানুষের কাছ থেকে আমি নানা সংবাদ পাচ্ছিলাম। একজন বলল, শামারোখকে শাহরিয়ারের সঙ্গে শেরাটন হোটেলে দেখা গেছে। আরেকজন বলল, এক শুক্রবার শামারোখ এবং শাহরিয়ার চিড়িয়াখানার বানরদের বাদাম খাইয়েছে। আবার কেউ এসে বলল, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে দুজনকে পরস্পর হাত ধরাধরি করে ঘুরতে দেখা গেছে। এই সমস্ত খবরে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু যারা এসে খবরগুলো বলছে তাদের বিকৃত আনন্দ উপভোগের পদ্ধতিটি দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। এতকাল তারা শামারোখের সঙ্গে আমাকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। অনেকেই জানে শামারোধের জন্য আমি একটা লড়াই করেছি। এখন শামারোখ আমাকে ছেড়ে শাহরিয়ারের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে, ওই সংবাদটা আমাকে জানানোর উদ্দেশ্য হলো অনেকটা এরকম: এতদিন তো এই মহিলাকে নিয়ে আকাশে উড়ছিলে, আশপাশের মানুষকে মানুষ মনে কর নি। এখন মহিলা তোমাকে ল্যাং মেরে অন্য মানুষের সঙ্গে ঘুরছে, এখন বোঝো মজাটা! শামারোখকে আমি একরকম চিনে ফেলেছি। তার কোনো ব্যাপারেই আমার উৎসাহ নেই। সে যা ইচ্ছে করুক। কিন্তু শুনে কষ্ট লাগল শাহরিয়ার নানা লোকের কাছে নানা জায়গায় আমার নামে নিন্দেমন্দ বলে বেড়াচ্ছে। শাহরিয়ার আমার নামে যা ইচ্ছে বলে বেড়াক। আমি হিসেব করে দেখেছি, এটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমার বুঝতে বাকি রইল না, আমাকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্যই মহিলা শাহরিয়ারকে বেছে নিয়েছে। শাহরিয়ার যা বলবে আমি প্রতিবাদ করতে পারব না। লোকে মনে করবে আমার ঈর্ষার ভাব জন্মেছে বলেই আমি শাহরিয়ারের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেমেছি। শাহরিয়ার পথেঘাটে যেসব বলে বেড়াচ্ছে এর কোনোটাই তার কথা নয়। শামারোখ যা বলাচ্ছে, সে তাই বলে যাচ্ছে।

একজন তরুণ কবি রসিকতা করে বলেছিলেন ঢাকা শহরের কাকের সংখ্যা যত, কবির সংখ্যা তার চাইতে কম হবে না। কথাটার মধ্যে একটা শ্লেষ আছে । তারপরেও আমার মনে হয়, একটা বিষয়ে কবিদের সঙ্গে কাকদের মিল আছে। একটা কাক যখন বিদ্যুতের তারে আটকে যায়, কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়ে, রাজ্যের কাক ছুটে এসে সাহায্য করতে পারুক না পারুক সমবেদনা প্রকাশ করে। কাকদের যেমন সমাজবোধ প্রবল, কবিদের সমাজবোধ তার চাইতে কম নয়। একজন কবির ভাল-মন্দ কিছু যখন ঘটে অন্য কবিরা সেটা খুব সহজে জেনে যায়। তারা বিষয়টা নিয়ে এমন জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে, সেটা সকলের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। একজন কবি যখন বিয়ে করে, প্রেমে পড়ে, কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসে, কিংবা যৌন রোগের শিকার হয়, সেটা খুব সহজেই সবার আলোচনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কবিদের সঙ্গে কাকদের প্রজাতিগত সহমর্মিতার ব্যাপার ছাড়া আরো একটি বিষয়ে মিল আছে। একটি কাক আরেকটি কাকের মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার জন্য যতরকম ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে থাকে, একজন কবি আরেকজন কবির প্রাপ্য সম্মানটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য তার চাইতে কিছু কম করে না।

কবি এবং কাকের চরিতমানস যে বিশ্লেষণ করতে হলো তার একটা বিশেষ কারণ আছে। শাহরিয়ার এবং শামারোখের সম্পর্ক নিয়ে প্রায় প্রতিদিন এত কথা আমাকে শুনতে হতো যে, মেজাজ ঠিক রাখা একরকম দায় হয়ে দাঁড়ালো। আমি বুঝতে পারি নে শামারোখ এবং শাহরিয়ারের সমস্ত সংবাদ আমার কাছে বয়ে নিয়ে আসা হয় কেন? আমাকে নিছক মানসিক কষ্ট দেয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, এমনতো মনে হয় না। শামায়োখ যখন আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো, তখনো কি আমাদের নিয়ে মানুষ এত কথা বলত? হয়তো বলত, আমি জানতাম না। নিজের ভেতর এতটা বিভোর হয়েছিলাম যে, কোনদিকে কি ঘটছে, কোথায় মানুষ কি বলছে, তাকাবার অবকাশ ছিল না।

তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আমি নিজেও স্বীকার করব। শামায়োখ-শাহরিয়ারের সম্পর্ক এমন একটা নতুন মাত্রা অর্জন করেছে, মানুষ সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে পারছে না। তার প্রথম কারণ শাহরিয়ার এই সবে মৃত্যুর কবল থেকে কোনোরকমে ফিরে আসতে পেরেছে। সে যে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছে, এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত কিছু বলতে পারে না। শামায়োখের মতো এমন অপরূপ বিদুষী একজন মহিলা, যার পরমায়ু নিশ্চিত নয় এমন একজন তরুণ কবির পেছনে ছায়ার মতো লেগে আছে, এই ঘটনাটিকে মানুষ অস্বীকার করবে কেমন করে? কুকুর মানুষ কামড়ালে সংবাদ হয় না, মানুষ যখন কুকুরকে কামড়ায় সেটাই সংবাদের বিষয়বস্তু হওয়ার মর্যাদা অর্জন করে। একজন চালচুলোহীন তরুণ কবি, কদিন বেঁচে থাকবে যে জানে না তার পেছনে সমাজে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একজন সুন্দরী নারী হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা এমন করে উজাড় করে দিচ্ছে, সে জিনিসটি নিয়ে মানুষ যদি মাথা না ঘামায়, তাহলে মানুষ সম্পর্কে খুব ছোট করে ভাবতে হয়। শাহরিয়ার এবং শামারোখের সম্পর্কের ধরনটাই একটা বিশেষ শিল্পকর্মের মতো মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এই সম্পর্কের কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা নেই, সবটাই বর্তমান। যে ফুল ফোঁটার পর একরাতের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়, তার সৌন্দর্যের মতো, গন্ধের মতো শামায়োখ-শাহরিয়ারের সম্পর্ক।

এই সময় পত্র-পত্রিকায় শাহরিয়ারের কবিতা ক্রমাগত প্রকাশিত হচ্ছিল। এগুলো পড়ে আমি একা শুধু মুগ্ধ বোধ করছিনে, যারাই পড়ছে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। একজন রুগ্‌ণ তরুণ তার জীবনী-শক্তির উত্তাপ দিয়ে এমন সুন্দর প্রাণবন্ত কবিতা কেমন করে লিখতে পারে! এমন প্রাণশক্তিতে ভরপুর কবিতা শাহরিয়ার লিখছে, কবিতায় শরীরের রোগ কিংবা যন্ত্রণার সামান্য স্পর্শও নেই। এমন আশ্চর্য স্নিগ্ধ প্রশান্তি শাহরিয়ারের এল কেমন করে? শামারোখের ভালোবাসাই কি শাহরিয়ারের কল্পনাকে স্বর্গ সৃষ্টিতে পারঙ্গম করে তোলে নি? আমি নিজেকে ঘৃণা করতে থাকলাম। শামায়োখের সঙ্গে আমারওতো একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। আমি শাহরিয়ারের মতো এমন প্রাণস্পন্দনময়, এমন প্রশান্ত একটি পঙক্তিও তো রচনা করতে পারি নি? প্রজাপতি যেমন ফুল থেকে বিষ আহরণ করে, আমারও কি তেমনি খারাপ দিকটির প্রতি প্রথম দৃষ্টি পড়ে? আমি শামারোখের ভেতরের ওই বিস্ময়কর অংশটি আবিষ্কার করতে পারি নি কেন? শুধু খালি চোখে যতদূর দেখি তার বাইরে দেখার ক্ষমতা কি আমার একেবারে নেই?

আমার মনে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। তবু শাহরিয়ার এবং শামায়োখের অকুণ্ঠ প্রশংসা না করে পারলাম না। মাহফুজের কাছে আমি জেনেছি, শাহরিয়ারের একটি পা কবরের ভেতর। তার পরেও প্রেমের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে মৃত্যুর শীতল স্পর্শকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে শাহরিয়ার। তার ওই কবিতাগুলো তো মৃত্যুর বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। হয়তো শাহরিয়ার বেশিদিন বাঁচবে না। কিন্তু বেশিদিন বেঁচে কি লাভ? জীবন-মরণের যা অভীষ্ট, শাহরিয়ার তো তার সন্ধান পেয়ে গেছে। শাহরিয়ারের কাছে আমার নিজেকে বিবমিষা উৎপাদনকারী তুচ্ছ কৃমিকীট বলে মনে হতে থাকল।

তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিরও একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য প্রথমদিকে পূর্ণিমার চাঁদ যেমন সমুদ্রের জলকে আকর্ষণ করে সেভাবে আমাকে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে মেলামেশার এক পর্যায়ে তার সৌন্দর্যের প্রতি আমি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। শেষের দিকে ভয় করতে আরম্ভ করেছিলাম। তার শরীর দেখলে আমার রং-করা মাংস বলে মনে হতো। এই সৌন্দর্যের ফঁসে যাতে আমি আটকে না যাই, পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করতাম। এখন অনুভব করতে পারছি শামায়রাখের অপরূপ সৌন্দর্য হলো ঈশ্বরের এক মহান দান। এই সৌন্দর্য কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে সক্ষম, শাহরিয়ারের কবিতাগুলো পড়েই বুঝতে পারছি। আমি ধরে নিলাম আমার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে গেছে। এক সময় ইচ্ছে করলে আমি শামায়োখকে সম্পূর্ণ আপনার করে নিতে পারতাম। তার প্রকৃত রূপ অন্তরের চোখ দিয়ে অবলোকন করতে পারতাম। আমি একজন পাষণ্ড, আমার হৃদয়ে চোখ জন্মাবে কেমন করে । ঈশ্বরের মহত্তম দান আমি অবহেলা করেছি বলে, দাম দেবার কেউ থাকবে না, সেটা কেমন করে হতে পারে? ঈশ্বরের রাজত্বে এত অবিচার কি সম্ভব?

শামারোখ শেষ পর্যন্ত সেই মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছে, যে তাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে। হোক না তা অত্যন্ত ক্ষণিকের। আমার অনুভব করতে বাকি রইল না আমি নিতান্তই একজন হতভাগা। মানুষ হিসেবে আমার অপূর্ণতাই আমাকে পীড়িত করছিল। এখন আয়নায় নিজের মুখ দেখতে আমার কষ্ট হয়।

.

২০.

একদিন রাতে ঘুমিয়ে আছি। মাহফুজ এসে আমার ঘুম ভাঙালো। ঘড়িতে দেখি। একটা বেজে গেছে। আমি মাহফুজের দিকে একটু বিরক্তির দৃষ্টিতেই তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বিত্তান্ত, এত রাতে? মাহফুজ বললেন, আপনাকে একটু আসতে হয়। আমি বললাম, কোথায়? মাহফুজ বললেন, হাসপাতালে। আমি বললাম, হাসপাতালে কেন? তিনি বললেন, পরশুদিন শাহরিয়ারকে ভর্তি করানো হয়েছে, ছটফট করছে। ডাক্তার বলছেন, আর বেশি দেরি নেই। আপনাকে দেখতে চাইছে। জাহিদ সাহেব আপনি যেদিন আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন আমি তো বলেছিলাম এই ডাকিনী মহিলা শাহরিয়ারকে চারটি মাসও বেঁচে থাকতে দেবে না। এখন মাত্র তিনমাস। দেখছেন তো আমার কথাটা এখন সত্যি হতে যাচ্ছে। আমি মাহফুজের কথার কোনো জবাব দিলাম না। মনে মনে বললাম, শাহরিয়ার না বাঁচলেও এমন কি ক্ষতি! সে তো অমৃতের সন্ধান পেয়ে গেছে।

আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ তার বিছানার চারপাশে। ছোট্ট কক্ষের মধ্যে স্থান সংকুলান হচ্ছে না দেখে অনেকে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার শেষ অবস্থা নিশ্চিত জেনে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটি খুলে নিয়েছেন। শাহরিয়ারের পাশের একটি খাটে শামারোখ মুখে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাকে একটি ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছে। আমি যখন গিয়ে শামারোখের কপালে হাত রাখলাম, দেখি তার চোখের কোণ দুটো পানিতে ভরে গেছে। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। বিড় বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে। আমার কান একেবারে তার মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কি বলছে কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। তারপরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ। শাহরিয়ারের বোনটি ডুকরে কেঁদে উঠে দুহাত দিয়ে নিপ্রাণ শরীরটাকে আঁকড়ে ধরল।

শামারোখের কোনো ভাবান্তর নেই। গালের ওপর হাতটা রেখে শাহরিয়ারের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। আমার কেন জানি মনে হলো, সে আমাকে বলছে, ওহে পাষণ্ড, তুমি চেয়ে দেখো একজন তরুণ আমার সৌন্দর্যের বেদিমূলে এইমাত্র তার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করল।

প্রিয় সোহিনী, শামারোখের উপাখ্যানটা যদি এখানে শেষ করতে পারতাম, তাহলে সবচাইতে ভাল হতো। এই রকম একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি যেখানে মৃত্যুর সঙ্গে শিল্প হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছে, জীবনের সঙ্গে এসে মিশেছে কবিতা, তার মধ্যে শামারোখকে স্থাপন করে কাহিনীটি যদি শেষ করতে পারতাম, সেটা আমার জন্য, শামারোখের জন্য এবং আমার তরুণ লোকান্তরিত বন্ধু শাহরিয়ারের জন্য সর্বোকৃষ্ট হতো। কিন্তু কাহিনীটা সেভাবে শেষ করতে পারলাম না। কারণ জীবন শিল্প নয়, কবিতা নয়। জীবনে যা ঘটে শিল্প এবং কবিতায় তা ঘটে না। জীবন জীবনই। জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না এবং জীবন ভয়ানক নিষ্ঠুর। সমস্ত প্রতিশ্রুতি, সমস্ত প্রতিজ্ঞা, সমস্ত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের ওপারে জীবনের লীলাখেলা ।

প্রিয় সোহিনী, এখন তোমার কাছে শামারোখের আসল ঘটনাটি ফাস করি। শাহরিয়ারের মৃত্যুর পনের দিনের মধ্যেই শামারোখ জমিরুদ্দিনকে বিয়ে করে ফেলেছিল। জমিরুদ্দিনের পরিচয় জিজ্ঞেস করবে না। তাহলে তুমি মনে শামারোখ সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ একটি ধারণা পোষণ করবে। লেখক, কবি, শিল্পী কিংবা অভিনেতা কিছুই ছিল না সে। এমনকি সে অঢেল টাকার মালিকও ছিল না। যথার্থ অর্থেই সে একটি দুপেয়ে পশু ছিল। শামারোখকে সকাল-বিকেল ধরে পেটানো ছাড়া আর কোনো গুণপনা সে প্রদর্শন করতে পারে নি। সব জেনেশুনে শামারোখ এই জমিরুদ্দিনকেই বিয়ে করেছিল। এটাই হলো জীবনের ভোজবাজি।

প্রিয় সোহিনী, তুমি যদি জানতে চাও, এখন শামারোখ কোথায়? আমি বলব, হারিয়ে গেছে। ফের যদি জিজ্ঞেস করো কোথায় হারিয়ে গেছে, তার সংবাদও আমি তোমাকে দিতে পারি। যেই দেশটিতে গিয়ে আমাদের ব্রিলিয়ান্ট তরুণেরা হোটেল বেয়ারা কিংবা ড্রাইভারের চাকরি পেলে জীবন সার্থক মনে করে, আমাদের অভিজাত এলাকার অত্যন্ত স্পর্শকাতর অপরূপ তরুণীরা শিশু পাহারার কাজ পেলে মনে করে আহ্ কী সৌভাগ্য! সেই দেশটিতে যাওয়া হয় নি বলেই সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ এই নশ্বর জীবনে স্বর্গ দেখা হবে না বলে আফসোস করে, শামারোখ জমিরুদ্দিনকে নিয়ে সেই স্বপ্নের দেশ আমেরিকার কোথায় হারিয়ে গেছে, কে বলতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *