অর্কর সঙ্গে একদিন অন্তর কথা হয় মাধবীলতার। মিনিট খানেকের মধ্যেই দুজায়গার খবরাখবর নিয়ে ফোন বন্ধ হয়। অর্ক সকালে ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, মাখন দিয়ে খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাত্রের খাবার বাইরে খেয়ে আসে। এতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
গতকাল তার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল। আজ মাধবীলতা সে কথা জিজ্ঞাসা করল। অর্ক বলল, হ্যাঁ মা, ও এসেছে। কলকাতায় থাকার জায়গা নেই ওর, আর তোমরাও এখন জলপাইগুড়িতে বলে থাকতে দিয়েছি। ও আমার ঘরেই শোয়।
কোথায় থাকে সে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
ওর বাড়ি হাজারিবাগে।
বাঙালি তো?
আশ্চর্য! তুমি এই প্রশ্ন করছ? ও যদি সাঁওতাল হত তাতে কী এসে যায়। ভদ্র মানুষ, এটাই শেষ কথা।
অর্ক হেসে বলেছিল।
শোন, তোকে আজকালের মধ্যে জলপাইগুড়িতে আসতে হবে।
আমি তো বলেছি, যাব, হঠাৎ আজকালের মধ্যে কেন?
খুব দরকার আছে, তুই না এলে হবে না। মাধবীলতা গম্ভীর।
মা, হুট করে তো কাজ ছেড়ে যাওয়া যায় না। আমি দেখছি!
মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, শোন, তুই এই সপ্তাহের মধ্যেই আয়। তোকে কোর্টে গিয়ে সইসাবুদ করতে হবে।
সে কী? আমি কী জন্যে কোর্টে যাব? অবাক হল অর্ক।
তুই এলে সব বলব। আচ্ছা, এক কাজ কর, এখানে কাগজপত্র সব রেডি হয়ে গেলেই আমি তোকে জানাব। তুই রাতের ট্রেন ধরে এসে সারাদিন কাজ শেষ করে ফিরে যাবি। মানুষের তো প্রয়োজনে একটা দিন ছুটি নেওয়া দরকার হয়। আর একটা কথা, তুই যখন এখানে আসবি তখন তোর বন্ধু কি ওই বাড়িতে থাকবে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
ও তোমরা ফিরে আসার আগেই চলে যাবে।
আরে, আমি জিজ্ঞাসা করছি তুই এলে ও কোথায় থাকবে?
একদিন আমি না থাকলে ওর অসুবিধে হবে না।
তুই ওকে সঙ্গে নিয়ে আয়, নতুন জায়গা দেখে যাবে।
না না, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। দুই সেকেন্ড চুপ করে থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোর এই বন্ধু পুরুষ না মেয়ে?
শব্দ করে হাসল অর্ক, যত বয়স বাড়ছে তত তুমি বাঙালি-মা হয়ে যাচ্ছ। তোমার মোবাইলের বিল বাড়ছে তা খেয়ালেই রাখছ না। আচ্ছা, এখন রাখছি।
মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল মাধবীলতা। অর্কর কথাবার্তা তার মোটেই ভাল লাগছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল ও কিছু লুকোতে চাইছে। এই এতগুলো বছর ধরে যে ছেলেকে সে দেখেছে তার সঙ্গে আজকের অর্ক যেন একটু আলাদা। সেই কমিউন গড়ার স্বপ্ন চোখ থেকে চলে যাওয়ার পর ও অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ওকে বুঝতে অসুবিধা হত না মাধবীলতার।
ঘর থেকে বেরিয়ে অনিমেষকে দেখতে পেল সে।
অনিমেষ বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর ক্রাচ তুলে তার তলা দিয়ে কিছু স্পর্শ করল।
মাধবীলতা বারান্দা থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ওখানে কী করছ?
অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল, এদিকে এসো।
মাধবীলতা গাছগাছালি বাঁচিয়ে কাছে গেলে অনিমেষ বলল, দ্যাখো।
একটা একরত্তি কুকুরের বাচ্চা মাটিতে শুয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এটা কোত্থেকে এল? কোনও কুকুরকে তো দেখিনি।
ইনি সারমেয় শাবক নয়। শেয়ালছানা। জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় একে ওর মা নিয়ে গিয়েছিল, এখন নিরাপদ ভেবে ফিরিয়ে এনেছে। মা নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে। আমাদের দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছে বাচ্চার ক্ষতি না করি। পৃথিবীর সব প্রাণীর মায়েরা একইরকম। শুধু জলে যারা বাস করে তারা ছাড়া। অনিমেষ যেন নিজের মনেই কথা বলছিল।
মাধবীলতা বলল, সরে এসো। ওর মাকে আসতে দাও। ওরা বারান্দায় উঠে আসতেই বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু কি বাড়িতে আছেন?
অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, ওপাশ দিয়ে ভেতরে আসুন।
একটু পরেই মিস্টার রায়ের সহকারী তরুণটিকে দেখা গেল। হাসিমুখে বলল, নমস্কার, স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। সে-ব্যাপারে কিছু কথা জেনে নেবেন। আপনি কি আজ সন্ধের পরে যেতে পারবেন?
সন্ধের পরে শুনেছি, জলপাইগুড়িতে রিকশা পাওয়া একটা সমস্যা।
তা ঠিক। তবে যে রিকশায় যাবেন তার রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বললে করবে। কিছু বাড়তি টাকা নেবে। আসলে ওই সময়ে স্যার ফ্রি থাকেন।
অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, আপনি এসে বসুন, চা আনছি।
না না, এখন একটুও সময় নেই। তরুণ মাথা নাড়ল।
ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যাবেলায় আমরা যাব। মাধবীলতা বলল।
তরুণ মাথা নেড়ে চলে গেলে বাবাকে দেখা গেল। হাতে একটা দড়ি আর কাটারি নিয়ে ঢুকছে। মাধবীলতা হাসল, কী রে তুই?
এর মধ্যে ছোটমা বেরিয়ে এসেছিলেন, বললেন, এসে গেছিস? পারবি তো?
ছেলেটি বেশ জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
ছোটমা বললেন, ওর বাবাকে বলেছিলাম কয়েকটা নারকোল পেড়ে দিতে, বলল, ছেলেই পারবে। পাইকাররা এসে সব নারকোল কিনে নিয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটা ঘর বলতে রাখি।
অনিমেষ বলল, ওইটুকু ছেলে গাছে উঠে নারকোল কাটবে?
ততক্ষণে বাবা চলে গিয়েছে যে গাছটার নীচে, সেটা একটু বাঁকা হয়ে ওপরে উঠেছে। গাছের মাথায় অনেকগুলো পুরুষ্ট নারকোল ঝুলছে। কোমরের সঙ্গে গাছে দড়ি বেঁধে তরতর করে ওপরে উঠে গেল বাবা। তারপর স্বচ্ছন্দে গোটা পাঁচেক নারকোল কেটে নীচে ফেলে দিল। ছোটমা চেঁচিয়ে বললেন, আর লাগবে না, নেমে আয়।
বাবা হাসিমুখে নারকোলগুলোকে তিনবারে তুলে নিয়ে বারান্দায় রাখতে মাধবীলতা বলল, এই, তোর বাবাকে বলবি আমরা একটা জরুরি কাজে সন্ধের সময় বের হব। সে যেন সাড়ে ছটার মধ্যে রিকশা নিয়ে চলে আসে।
বাবা ঘাড় নাড়তেই ছোটমা একটা নারকোল তুলে তার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তুই বাড়িতে নিয়ে যা। আমি নাডু বানালে এসে খেয়ে যাবি।
বাবা চলে গেলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, রিকশা যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন আমি একাই যেতে পারতাম। তুমি কেন কষ্ট করবে?
মাধবীলতা কিছু বলার আগেই ছোটমা বললেন, ও গেলে খুব ভাল হবে।
কেন? অনিমেষ তাকাল।
তোমাকে এ ব্যাপারে আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। গিয়ে এমন সব কথা বলবে যে সব ভেস্তে যাবে। মাধবীলতা মাথা ঠান্ডা করে কথা বলতে পারবে।
চমৎকার। সেই ছেলেবেলা থেকে আমায় দেখছ তুমি, মেনে নিলাম তুমি ভাবছ আমার মাথা ঠান্ডা নয়। কিন্তু মাধবীলতাকে তো আগের বার খুব অল্প সময়ের জন্যে দেখেছ, আর এবার এই কদিন। তার মধ্যেই জানতে পারলে ওর মাথা ঠান্ডা? একটু অবিচার হয়ে যাচ্ছে না?
অনিমেষ ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল।
ছোটমা গলা তুললেন, শোনো, ভাত হয়ে গিয়েছে কি না তা বোঝার জন্যে হাঁড়ির সব চাল টিপতে হয় না, একটাতেই বোঝা যায়।
.
মাধবীলতা বুঝতে পারছিল অনিমেষ পছন্দ করছে না ওর সঙ্গে সে উকিলের কাছে যায়। ওর সম্পর্কে মহীতোষের মনোভাব জানার পর এই বাড়ি সম্পর্কে আগ্রহও কমে গেছে। উকিলকে যে সহযোগিতা করবেই এমন ভরসা হচ্ছে।, কিন্তু এ নিয়ে অনিমেষের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না মাধবীলতা। ছোটমাকে এই বাড়িতে একা ফেলে রেখে কলকাতায় ফিরে যাওয়া অত্যন্ত অমানবিক কাজ হবে। এতদিন দূরে ছিল, এখানে চোখের আড়ালে কী ঘটেছে তা জানাও ছিল না, কিন্তু দেখার পর একটা ব্যবস্থা না করে সে যেতে পারবে না। পরে অনিমেষকে না হয় বোঝানো যাবে।
খাটের একপাশে বসে মাধবীলতা বলল, কলকাতার বাড়িতে একজন।
অতিথি এসেছে।
মানে? অনিমেষ তাকাল।
অর্ককে ফোন করেছিলাম। বলল, ওর কোনও এক বন্ধু নাকি থাকছে।
বন্ধু? কে? তুমি চেনো?
না। বলল, হাজারিবাগে বাড়ি। কলকাতায় কেউ নেই, তাই কয়েকদিন আমাদের ওখানে থাকছে। আমরা ফেরার আগেই চলে যাবে।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক শুনেছ তো?
একদম ঠিক।
কোনওদিন শুনিনি হাজারিবাগে ওর একজন বন্ধু আছে। অর্ক কখনও সেখানে যায়নি। তা ছাড়া গত দশ-বারো বছরে ওর কোনও বন্ধুকে বাড়িতে দেখেছ?
না, দেখিনি। মাথা নাড়ল মাধবীলতা।
আমরা যেই চলে এলাম অমনি তার এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কলকাতায় এল যে তাকে সে বাড়িতে থাকতে দিল? লতা, আমার ভাল লাগছে না। অনিমেষ বলল।
ভাল আমারও লাগছে না। আমি ওকে এখানে আসতে বলেছিলাম।
সে তো নিজেই আসতে চেয়েছিল।
হ্যাঁ। তখন সময় বলেনি। আমি বলেছিলাম এই সপ্তাহেই কয়েকদিনের জন্যে আসতে। কিন্তু বলল, ছুটি পাবে না।
অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল, ছুটি পাবে না? গত তিন বছরে ও কখনও দু-একদিনের অসুখ ছাড়া অফিস কামাই করেনি। তাই ছুটি চাইলে এক সপ্তাহের জন্যে ওকে ছুটি দেওয়া হবে না, তুমি বিশ্বাস করছ?
না
কিছু একটা করছে ও!
ভেবে কোনও লাভ নেই। সবচেয়ে যেটা আমাকে অবাক করেছে তা হল, আমি চাপ দিতে বলল, সে একদিনের জন্যে আসতে পারে, কিন্তু বন্ধুকে বাড়িতে রেখে আসবে। বললাম, তাকে নিয়েই আয়। বলল, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। মাধবীলতা জানাল।
ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া দরকার লতা।
পাগল! ও জানলে ভাববে গোয়েন্দা লাগিয়েছি।
হুম। পাড়ার কারও ফোন নাম্বার জানি না। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে পড়াতেন যে ভদ্রমহিলা, মাঝে মাঝে আসতেন, শীলাদি, হা, তার ফোন নাম্বার জানো? অনিমেষ তাকাল।
কী হবে?
জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, আমি শীলাদিকে বলব তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে এসো ছেলে কী করছে? কার সঙ্গে আছে?
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক। আমি যদি কলকাতায় চলে যাই? খাট থেকে নেমে পড়ল মাধবীলতা, নাঃ, বেশ কিছুদিন ধরে একটু-আধটু উলটোপালটা বলছিলে, আজ দেখছি একদম মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এখানে এসেছি কেন? যে জন্যে এসেছি তা না শেষ করে তুমি ফিরে যাবে? কার জন্যে যাবে? যার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, যাকে কয়েক বছর বাদে প্রৌঢ় বলা হবে, সে কার সঙ্গে আছে তা দেখার জন্যে? অর্ক ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হত তা হলে যে তুমি কী করতে আমি ভেবে পাচ্ছি না। যা ইচ্ছে করুক ও, ছেলেবন্ধু হোক বা মেয়েবন্ধু হোক আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু এমন কিছু যেন না করে যা নিয়ে পাঁচজন কথা বলবে। আমাদের তো ওইখানেই ফিরে যেতে হবে।
মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষের মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তাদের অনুপস্থিতিতে অর্ক কোনও মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। ওর আচরণ দেখে কখনওই মনে হয়নি ও কাউকে ভালবেসেছে। আজ এতদিন পরে মনে পড়ল নিজেদের কথা। শান্তিনিকেতনে সে মাধবীলতার সঙ্গে দেখা করে একটা রাত কাটিয়েছিল। মাধবীলতা সে সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। না এলে ওর বাবা মায়ের মনের অবস্থা কী হত তা সে আজ অনুমান করতে পারে। তখন তাদের বয়স খুব কম ছিল। আবেগই শেষ কথা হওয়ায় বাস্তব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি।
.
তখন দুপুর একটু একটু করে বিকেল হতে চলেছে।
মাধবীলতা ছোটমার ঘরে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল বাগান থেকে বেরিয়ে বারান্দার কাছে এসে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে একটা শেয়াল, যাকে কুকুর বলে ভুল করা যায়। মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, কী রে? সঙ্গে সঙ্গে লেজ নাড়ল শেয়ালটা।
মাধবীলতা রান্নাঘরে গিয়ে দুপুরের বেঁচে যাওয়া কিছুটা ভাত একটা কাগজে মুড়ে বারান্দার সিঁড়িতে রেখে সরে আসতেই শেয়ালটা সেটা মুখে তুলে নিয়ে দৌড়ে বাগানের ভেতরে চলে গেল। মাধবীলতার মনে হল গাছের আড়ালে তখন উত্তেজনা, নিশ্চয়ই ভাতগুলো গোগ্রাসে গিলছে শেয়ালটা। ওর ছানার তো ভাত খাওয়ার বয়স হয়নি। হয়তো সারাদিন কিছু জোটেনি শেয়ালটার, তাই মরিয়া হয়ে চলে এসেছিল এদিকে। পেট ভরলে শান্ত হয়ে ছানাকে দুধ খাওয়াবে। তারপরেই মনে হল, এই ছানা আর একটু বড় হলে, নিজে খাবার সংগ্রহ করতে শিখলেই মাকে ছেড়ে চলে যাবে। মায়ের এই ভূমিকার কথা বেমালুম ভুলে যাবে সে। হয়তো মা-ও ওর কথা আর ভাববে না, যা মানুষ পারে না। পারে না বলেই কষ্টে থাকে।
ছোটমার ঘরের দরজায় এসে থমকে গেল সে। ছোটমা খাটে বসে। তাঁর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে কাঁদছে ভাড়াটেদের ছোটবউ। মাধবীলতা ফিরে আসছিল কিন্তু ছোটমা ডাকলেন, এসো।
মাধবীলতা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকল।
একে বলা হয়েছে থাকার জায়গা খুঁজে নিতে। ছোটমা বললেন।
সে কী?
বেচারার কেউ নেই। স্বামী মরে যাওয়ার পর আঠারো ঘণ্টা ধরে যাদের সংসারের কাজ করে করে এই চেহারা তৈরি করেছে, আজ তারাই ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। বলছে, ফ্ল্যাটে উঠে গেলে সেখানে ওর জায়গা হবে না।
ছোটমায়ের কথার মধ্যেই বউটি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
মাধবীলতা বলল, এই ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে গেলে ওরা শুনবে কেন? উলটে অপমান করতে পারে।
এই কথাই তো ওকে বলছিলাম। বাড়ির সবাই একটু বেশি খেলে ওর ভাগ্যে যা জুটত তাতে চার বছরের বাচ্চারও পেট ভরবে না। আমার কাছে এলে আমি ভাতে ভাত যা রাঁধতাম, তা থেকে ওকে জোর করে খাইয়ে দিতাম। এর বেশি তো আমার সামর্থ্য নেই। এই যে ও কাঁদছিল তা দেখে নিজের জন্যেই কষ্ট হচ্ছিল। ছোটমা বউটির মাথায় হাত বোলালেন, ওঠ। ভগবান যা করবেন তা মেনে নিতে হবে।
মাধবীলতা বলল, আমি একটা কথা বলছি। যদি সত্যি ওঁর কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, তা হলে এই বাড়ি বিক্রি হওয়ার পর আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানেই তো উনি থাকতে পারেন।
ছোটমায়ের মুখ উজ্জ্বল হল, বাঃ। এই মেয়ে শুনলে তো? এবার মন হালকা হোক। আমার বউমা তোমার সমস্যার সমাধান করে দিল।
.
১৭.
লছমনের রিকশায় উঠে অনিমেষ বলল, ঝুলনা পুল দিয়ে বাবুপাড়ায় চলো।
মাধবীলতা একটু কাত হয়ে বসেছিল, বলল, অন্য রাস্তায় যাওয়া যায় না? এই বাঁ দিক দিয়ে? দেখতে দেখতে যাই।
অনিমেষ বলল, লছমনকে খামকা বেশি পথ রিকশা চালাতে হবে। শুনে লছমন বলল, না না, কোনও অসুবিধে নেই, আমি বাঁ দিক দিয়েই যাচ্ছি।
এখন জলপাইগুড়ি শহরের বুকে অন্ধকার ঘন হচ্ছে। অনিমেষ দেখল তার ছেলেবেলার মতন এখনও রাস্তার আলো টিমটিমে। তখনকার সঙ্গে একটাই পার্থক্য চোখে পড়ছে, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। কয়েকটা সাইকেল দ্রুত যাওয়া আসা করছে। রিকশা এক-আধটা। অথচ ষাট সালেও এই শহরের মানুষ নাইট শো-তে সিনেমা দেখে রিকশায় বা হেঁটে বাড়ি ফিরত।
এটা স্টেডিয়াম, না? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ। টাউনক্লাব স্টেডিয়াম। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন তৈরি হয়নি। বাঃ, এদিকে দেখছি একটা বড় হলঘর তৈরি হয়েছে। ওই যে বাড়িটা দেখছ, ওখানে পার্থ থাকত। বন্যার সময় একবার ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনিমেষ অন্যরকম গলায় কথাগুলো বলল।
পার্থ কে?
আমরা একই স্কুলে সহপাঠী ছিলাম। অনিমেষ বলল, এই যে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, সোজা গিয়েছে কিং সাহেবের ঘাটের দিকে। ওদিকেই আদালত বসত। আমরা বলতাম কাছারিপাড়া। আর এই যে, রিকশা যেদিকে যাচ্ছে তার শেষ হবে স্টেশনে।
তুমি কিছু ভোলোনি। মাধবীলতা অনেকদিন পরে অনিমেষের হাতে হাত রাখল।
অনিমেষ বলল, ডানদিকে দেখো, সুভাষচন্দ্র বসু স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেবেলায় স্ট্যাচুটাকে বেশ বড় মনে হত। আমার যত বয়স বাড়ছে স্ট্যাচু যেন তত ছোট হয়ে যাচ্ছে।
নদীর ওপর ব্রিজে উঠে মাধবীলতা বলল, করলা নদী তো!
লছমন আফশোসের গলায় বলল, ও আর নদী নেই। পানি কোথায়?
অনিমেষ বলল, এইভাবেই সময় সব কিছু কেড়ে নেয়।
সে হাত সরাল।
মাধবীলতা বলল, হাতটা সরালে কেন?
এসে গেছি, নামতে হবে তো। অনিমেষ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল।
সত্যি কথাটা বললে না!
সত্যি কথা!
হ্যাঁ। এখানে একটু বেশি আলো, দোকান খোলা। তাই আমার হাতে হাত রেখে বসতে তোমার সংকোচ হল। হাতে হাত থাকলে কি জলপাইগুড়ির মানুষ অশ্লীল বলে ভাবে? মাধবীলতার গলার স্বর ধারালো।
ভুল বুঝছ। একদম ভুল। লছমন, বাঁ দিকের ওই উকিলবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়াও। তোমাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ভাই।
মাধবীলতার মনে হল মিস্টার রায়ের বাড়িটা এসে যাওয়ায় যেন বেঁচে গেল অনিমেষ।
মিস্টার রায় তার চেম্বারে আর একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তার সহকারী এখন ওই ঘরে নেই। ইশারায় বসতে বললেন ভদ্রলোক।
দূরের চেয়ারে বসে মাধবীলতা দেখল দেওয়াল ভরতি মোটা মোটা বই। এত মোটা মোটা ইংরেজি বই ভদ্রলোক পড়েন কখন? বইগুলো যে ইংরেজিতে লেখা তা মলাটের একপাশে ছাপা নামেই বোঝা যাচ্ছে। সে নিচু গলায় বলল, একজন উকিলকে কত বই পড়তে হয় দেখো।
অনিমেষ দেখছিল, বলল, এইগুলো কিনে উকিলরা বোধহয় চেম্বার সাজিয়ে রাখে যাতে লোকে ভাববে উনি খুব বড় উকিল।
তোমার সবটাতেই সন্দেহ। আজকাল এটা বেড়েছে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক চলে গেলে মিস্টার রায় ডাকলেন, আসুন।
ওরা এগিয়ে গিয়ে ওঁর টেবিলের এপাশে বসল।
মিস্টার রায় হাসলেন, আমি প্রথমবার যখন আপনাদের বাড়িতে যাই তখন মহীতোষবাবুর দিদি বেঁচে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওই বাড়ি যিনি বানিয়েছিলেন মানে, আপনার ঠাকুরদা, আপনাকেই মালিকানা দিতে চেয়েছিলেন। তবে যতদিন আপনার পিসিমা বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনিই ভোগ করবেন কিন্তু বিক্রি করতে পারবেন না। তাঁর চলে যাওয়ার পরে আপনি পাবেন। এইরকম একটা ইচ্ছে তার ছিল যা পরে তিনি কার্যকর করে যাননি।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমিও এইরকম শুনেছিলাম, কিন্তু নিতে রাজি হইনি। মনে হয়েছিল দাদু সুবিচার করছিলেন না।
শুনে ভাল লাগল। কিন্তু আপনার এই মা উইল ছিঁড়ে ফেলে সব ভজকট করে দিলেন। মহীতোষবাবুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে এবং আপনার ছেলেকে আদালতে আবেদন করতে হবে। ভেবে দেখুন, আপনি কি সত্যি মালিকানা নিতে চান না?
ভেবেই তো বলেছি।
বেশ, আমি কাগজপত্র দিন তিনেকের মধ্যে তৈরি করে আপনাদের বাড়িতে পাঠাব। আপনার মা আর ছেলে যেন সই করে দেন। তার সঙ্গে একটি প্রচারিত খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে যে এই ব্যবস্থায় কারও আপত্তি থাকলে যেন দিন পনেরোর মধ্যে আদালতকে জানান। মিস্টার রায় বললেন।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ জানান?
তা হলে সমস্যা হবে। তিনি মামলা করতে পারেন।
মাধবীলতা বলল, তার সমাধান তো বহুদিন পরে হবে।
স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে খরচও কম হবে না। মিস্টার রায় বললেন, আবার বিজ্ঞাপন না দিয়েও তো উপায় নেই। এক কাজ করতে পারেন, যে কলকাতার কাগজ শিলিগুড়ি থেকে ছাপা হয় না, নর্থ বেঙ্গলে খুব কম আসে তাতেই বিজ্ঞাপনটা দিন। এতে ঝুঁকি কম থাকবে।
কম হলেও তো থাকবে। কেউ বদমায়েশি করতেও তো পারে। মাধবীলতা বলল।
মিস্টার রায় হাসলেন, সেজন্য আমি অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী?
সেদিন আপনাদের বাড়িতে আমি যে উইল নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা একটা ডুপ্লিকেট উইল! স্ট্যাম্প পেপারে টাইপ করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে মহীতাষবাবুর পুরো সই যেমন ছিল না, ফিঙ্গার প্রিন্টও নেই। আপনারা কেউ সেটা লক্ষ করেননি। মহীতোষবাবুর অরিজিন্যাল উইল আমার কাছে আছে। যদি দেখি মামলা জটিল হচ্ছে তা হলে ওই উইল আদালতে পেশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার মায়ের নামেই সম্পত্তি যাবে, তিনি চাইলে পরে আপনার ছেলেকে গিফ্ট করতে পারেন। মিস্টার রায় বললেন, এই খবরটা দয়া করে ভদ্রমহিলাকে এখন জানাবেন না।
তা হলে ছেলেকে কবে এখানে আসতে বলব?
ঠিক দুদিন পরে এলেই হবে।
মাধবীলতা ব্যাগ খুলল, আমি জানি না, এখন কত টাকা দিতে হবে?
মিস্টার রায় বললেন, কী বলি বলুন তো? লোকে বলে একশোটা শকুন মারা গিয়ে একজন উকিল হয়। আমিও নিশ্চয়ই তার বাইরে নেই। আপাতত পাঁচশো দিন। আমার জন্য নিচ্ছি না, কেস ফাইল করতে যা খরচ হবে তাই দেবেন।
অনিমেষ বলল, যদি একটা আন্দাজ দেন।
কী ব্যাপারে? মিস্টার রায় তাকালেন।
এখনই কী করে বলব ভাই! যদি শুধু উইলের পজেশনের ব্যাপার হত তা হলে বলা সহজ ছিল। বিজ্ঞাপন আর অন্যান্য খরচ বাবদ হাজার দশেক ধরে রাখতে পারেন।
মিস্টার রায় বললেন।
রিকশায় উঠে মাধবীলতা বলল, দশ হাজার। কী করবে?
ভেবে পাচ্ছি না।
একটা কিছু তো করতে হবে। মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।
অর্কর ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে?
জানি না। কোনওদিন খোঁজ নিইনি।
নাও। ও যা দেয় তাই তো চুপচাপ নিয়ে নাও। এবার যখন দরকার পড়ছে। তখন তো জিজ্ঞাসা করতে হবেই।
মাধবীলতা চুপ করে থাকল।
.
রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি দুজনের। মাধবীলতা রাত সাড়ে এগারোটায় শেষবার ফোন করেছে অর্ককে, ওর মোবাইলের সুইচ অফ করে রেখেছে। এরকমটা কখনও হয় না। নানান দুশ্চিন্তা ভিড় করছিল মনে। অনিমেষ বলেছিল ওর ওই বন্ধু আসার পর সব উলটো পালটা হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় না মেয়েবন্ধু, তা হলে ওখানে নিয়ে যেতে সাহস পেত না।
মাধবীলতা চুপ করে ছিল। অনিমেষের স্বভাব হল আগ বাড়িয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার সঙ্গে বাস্তব মেলে না।
সকালের চা-পর্ব শেষ হলে মাধবীলতা আবার অর্ককে ফোন করল। এবারে রিং হচ্ছে, একটু বাদেই অর্কর গলা কানে এল, বলো মা।
কী রে? কাল ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলি কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
চার্জে বসিয়েছিলাম মোবাইল।
ও। শোন, এখানে তোকে খুব দরকার। কালই তোকে রওনা হতে হবে।
কী দরকার সেটা বলবে তো?
ফোনে অত বলা যাবে না। আমি রাখছি। কথা বাড়াতে চাইল না মাধবীলতা।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। হঠাৎ আমাকে এরকমভাবে দরকার পড়ল কেন?
আমি তো তোকে বললাম, এখানে এলে জানতে পারবি।
তুমি আমাকে সমস্যায় ফেলে দিচ্ছ মা!
কোনও সমস্যায় ফেলছি না। তোর বাবা জানতে চাইছিল, যাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছিস তার সঙ্গে কী করে আলাপ হল?
আমার সঙ্গে যত লোকের পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়, তাদের প্রত্যেককে কি বাবা বা তুমি চেনো? ও খুব ভদ্র এবং শান্ত। তোমাদের ঘরে একবারও ঢোকেনি। বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ কোরো। অর্ক কথাগুলো বলতেই মাধবীলতা ফোনের লাইন কেটে দিল।
অনিমেষ তাকিয়ে ছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, কেন ফোন বন্ধ ছিল?
তুমি তো সাতপাঁচ ভেবে নিয়েছিলে। ওর মোবাইলের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছিল বলে চার্জে বসিয়েছিল। আগ বাড়িয়ে ভাবাটা এবার বন্ধ করো। বেশ জোরে পা ফেলে মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ নয়, অর্ক তাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না।
বেলা সাড়ে নটার সময় গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। অনিমেষ একটু কৌতূহলী হয়ে বারান্দা থেকে নেমে আসতেই স্বপ্নেন্দু দত্তকে দেখতে পেল। সঙ্গে দুজন মধ্যবয়সি মানুষ। স্বপ্নেন্দু বললেন, নমস্কার। আপনাদের বাড়িটাকে এঁদের দেখাতে চাই। আপত্তি নেই তো?
এঁরা?
আমার কোম্পানির লোক। সমস্ত কাজকর্ম এঁরাই করেন।
ও ঠিক আছে।
স্বপ্নেন্দু লোক দুজনকে বললেন, এই যে বাগান, ওই ওপাশের বাড়ি আর এই দিকের বড় বাড়িটা, ভালভাবে ঘুরে দেখুন। ওপাশের গলির রাস্তাটা কুড়ি ফুটের বেশি নয়। ফলে আমাদের জায়গা ছাড়তে হবে। সব দেখে শুনে নিন।
লোকগুলো মাথা নেড়ে বাগানের ভেতর চলে গেল। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, জগদীশবাবু আর কাউকে আনেননি তো?
অনিমেষ হাসল। স্বপ্নেন্দু বললেন, আরে বাব্বা, আমি এই জমির দালালদের বিশ্বাস করি না। যত দাম বাড়াতে পারবে তত তো ওদের লাভ। আপনাদের আইনি ব্যবস্থা ঠিক করে নিতে কত দেরি হবে?
উকিলবাবু বলছেন বেশি দেরি হবে না। অনিমেষ বলল।
বেশ। আমার খুব তাড়া নেই। বর্ষা চলে না গেলে তো কাজে হাত দেব না। স্বপ্নেন্দুর কথা শেষ হওয়ামাত্রই ওরে বাবা রে বলে চেঁচিয়ে উঠল বাগানে ঢোকা লোক দুটোর একজন। তারপর দুজনই প্রায় দৌড়ে চলে এল কাছে।
স্বপ্নেন্দু বললেন, কী হল? বাঘ দেখেছেন নাকি?
না। শেয়াল। আমাকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসছিল।
উঃ। একটা শেয়াল দেখেই এত ভয় পেয়ে গেলেন? অনিমেষবাবু, বাগানটাকে আগে পরিষ্কার করতে হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।
আপনি যদি কিনে নেন তা হলে যাতে সুবিধে হয়, তাই তো করবেন। অনিমেষ বলতে বলতে দেখল, মাধবীলতা একটা কিছু কাগজে মুড়ে বারান্দা থেকে ঘুরে বাগানের ভেতর ঢুকে গেল।
স্বপ্নেন্দু বললেন, উনি জানেন না বোধহয় ওখানে শেয়াল আছে।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ও নিজের চোখে দেখে এসেছে।
মাধবীলতা বেরিয়ে এসে স্বপ্নেন্দুকে দেখে হাত জোড় করে নমস্কার করল। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে কি শেয়ালটাকে দেখলেন?
হ্যাঁ। ছানাটার সঙ্গে আছে।
আপনাকে কিছু বলল না?
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ওকে কালকের বাসি খাবার দিয়ে এলাম। প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের তফাত হল, যে খাবার দেয় ওরা তার অনিষ্ট করে না। জগদীশবাবু আসেননি?
না। এই যে, আপনারা ওই জায়গাটা ছেড়ে বাকিটা ঘুরে দেখে নিন। স্বপ্নেন্দু বলাতে লোক দুটো বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগল।
মাধবীলতা বলল, কী স্থির করলেন?
আমার তো ইচ্ছে হয়েছে। এ পাড়ায় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি নেই। পাড়াটার খুব সুনামও আছে। আপনারা যেন অন্য কাউকে বিক্রি করবেন না।
অনিমেষ বলল, দেখুন, জগদীশবাবু যা বলবেন– ।
না না। দালালের কথায় কান দেবেন না। আমি না হয় আরও লাখখানেক টাকা ওঁকে না জানিয়ে আপনাদের দেব। স্বপ্নেন্দু বললেন, একটা প্রাথমিক লেখাপড়া হয়ে যাক। মালিকানা স্থির হয়ে গেলে কেনাবেচা হবে। আপনাদের আপত্তি নেই তো?
মাধবীলতা বলল, দেখুন, এই ব্যাপারে আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আপনি যখন জগদীশবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে নিষেধ করছেন, তখন আমাদের উকিলবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলে নিই।
নিশ্চয়ই নিন। স্বপ্নেন্দু পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে ধরলেন, এটা রাখুন। পঁচিশ হাজার অগ্রিম হিসেবে দেওয়া থাকল। রশিদ দিতে হবে না। ভদ্রলোকের চুক্তি।
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না, কী বলবে। মিস্টার রায় দশ হাজারের কথা বলেছেন। সেই সমস্যার সমাধান–।
স্বপ্নেন্দু দত্ত বললেন, আরে মশাই রাখুন তো।
খামটা অনিমেষের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি।
.
১৮.
স্বপ্নেন্দু দত্ত টাকা দিয়ে গিয়েছেন, আগাম হিসেবে, শুনে ছোটমায়ের মুখে হাসি ফুটল, যাক, তা হলে এই বাড়ির হিল্লে হচ্ছে।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হিল্লে হচ্ছে মানে? ছোটমা বললেন, আর কিছুদিনের মধ্যে তো বাড়িটা ভূতের বাড়ি হয়ে যেত। তোমরা কলকাতায় চলে গেলে আমি হয়তো ঘরেই মরে পড়ে থাকতাম।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, টাকাটা নেওয়া বোধহয় উচিত হল না। এখনও অনেক সিঁড়ি ভাঙার পর বাড়িটা বিক্রি করা যাবে।
মাধবীলতা চুপচাপ শুনছিল, বলল, সেই সিঁড়িগুলো ভাঙতে যে টাকার দরকার হবে, তা যদি আমরা জোগাড় করতে না পারতাম, তা হলে?
ছোটমা মাথা নাড়লেন, তোমরা বোধহয় মানো না, আমি মানি। ঈশ্বরের ইচ্ছে বাড়িটা বিক্রি হোক, তাই ওই ভদ্রলোক যেচে টাকাটা দিয়ে গেলেন।
মাধবীলতা হেসে ফেলল। তাই দেখে ছোটমা যে বিরক্ত হলেন তা তার মুখের অভিব্যক্তিতেই বোঝা গেল। মাধবীলতা বলল, যাক গে, আপনি মন থেকে চেয়েছিলেন বলেই প্রথম বাধাটা পার হওয়া গেল।
এইসময় মাধবীলতার মোবাইল জানান দিল। সে দ্রুত উঠে ভেতরে চলে গেল। অনিমেষ বলল, টাকাটা খরচ হয়ে যাওয়ার পর যদি দেখা যায় কোনও বাধায় বাড়ি বিক্রি করা যাচ্ছে না, তখন ফেরত দেওয়া সমস্যা হয়ে যাবে।
মাধবীলতা মোবাইল হাতে বেরিয়ে এল, তোমার ফোন।
কে? অর্ক? অনিমেষ হাত বাড়াল।
না, জগদীশবাবু। মোবাইলটা দিয়ে দিল মাধবীলতা।
হ্যালো, অনিমেষ বলছি।
জগদীশবাবুর গলা কানে এল, এটা কী হল মশাই?
কী ব্যাপারে বলছেন?
ক্লায়েন্ট লোকজন নিয়ে বাড়ি দেখতে গেল, অথচ আমাকে জানালেন না।
উনি আসার আগে আমাকে জানাননি। আপনাকে যে জানাব তার সুযোগ তো ছিল না।
অ। এইসব লোকগুলোর স্বভাব হল ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া। কোনও পাকা কথা দেননি তো?
আপনি থাকতে যে কথা হয়েছিল–।
সেটা তো কথার কথা থামিয়ে দিলেন জগদীশবাবু, আমি চেষ্টা করছি অন্য ক্লায়েন্ট জোগাড় করার যে বেশি দাম দেবে।
কিন্তু ইনি যে জোর করে আগাম দিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, করেছেন কী! সই করে টাকা নিয়েছেন নাকি?
না। সইসাবুদ করাননি।
ওঃ। বাঁচা গেল। বেশি দামের ক্লায়েন্ট পেলে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবেন। আমাকে ভদ্রলোক কিছু বলেননি, ওঁর কর্মচারীর কাছে শুনলাম আজ আপনার বাড়িতে গিয়ে পাকা করে এসেছেন। এখন থেকে যা হবে আমাকে জানাবেন। আরে, বেশি দাম পেলে আপনার যেমন লাভ, তেমনি আমার মঙ্গল। রাখছি। জগদীশবাবু ফোন রেখে দিলেন।
.
সকালে বাজারে যাচ্ছিল অনিমেষ। টাউন ক্লাবের মোড় অবধি রিকশা নেই। লছমনকে রোজ রোজ আসতে বলা শোভন নয় বলে এটুকু হেঁটে অন্য রিকশা ধরে সে, কিন্তু এই সকাল আটটায় হাকিমপাড়ার রাস্তা শুনশান। হঠাৎ চোখে পড়ল চারটে তরুণ তার দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে তাদের একজন বলল, কাকা, আপনি তো বাজারে যাচ্ছেন, কোনও সাহায্য লাগলে বলতে পারেন।
না ভাই, কিন্তু তোমরা কি এই পাড়ায় থাকো?
হ্যাঁ। ওই তো ওপাশেই আমাদের ক্লাব। তরুণ সঙঘ।
ও। আমি তো অনেকদিন পরে এলাম। তাই–!
আপনি কি রিকশা খুঁজছেন?
হ্যাঁ। পেয়ে যাব।
এবার দ্বিতীয় ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বাড়ি বিক্রি করছেন?
হ্যাঁ। চেষ্টা হচ্ছে।
ভাড়াটে কি উঠে যাচ্ছে?
একটু অসুবিধে হচ্ছে। ওই যে, রিকশা–
ছেলেরাই চেঁচামেচি করে খালি রিকশাটাকে দাঁড় করাল। একটু সাহায্য করল তারা। রিকশায় বসে বাজারের দিকে যেতে যেতে অনিমেষের মনে হল এই ছেলেগুলো সত্যি ভাল, হয়তো এদের বাবা বা জ্যাঠাদের সে চেনে, ওরা সেই পরিচয় দেয়নি বলে কথা বাড়ায়নি সে। এখনকার তরুণদের সবাই যে অভদ্র, শিষ্টাচার জানে না তা নয়। এদের দেখে সেটা বোঝা গেল।
আজ বাজারে দেবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দু-তিনটে কথার পর দেবেশ তাকে একটু ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, মাওবাদী আর নকশালদের মধ্যে পার্থক্য কতখানি?
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
একটা ইংরেজি কাগজে লিখেছে নকশালরা হচ্ছে গৃহপালিত আর মাওবাদীরা ওয়াইল্ড ডগ। দেবেশ বলল।
অশিক্ষিত লোকরাই এই ধরনের কথা বলতে পারে।
আবার তৃণমূল নেত্রী বলছেন মাওবাদী বলে কিছু নয়। সব নাকি সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী, দেবেশ হাসল।
এদেশে বাক স্বাধীনতা চালু আছে। অনিমেষ বলল, আমার ওখানে কবে আসছিস?
যাব।
তুই তো একবার ফোনও করলি না। দেবেশ বলল, আয় একবার দেখে যা, রাজনীতি ছাড়াও মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, অবশ্য খুব স্বল্প পরিসরে। তবুও–।
ফেরার পথে রিকশায় বসে অনিমেষ ভাবছিল, সাতাত্তর সালে জেল থেকে বেরিয়ে দেখেছিল পশ্চিমবাংলার মানুষ লালস্রোতে ভাসছে। বামপন্থী দলগুলো একত্রিত হয়ে যে সরকার গঠন করেছে তাকে জনগণের সরকার বলা হত। দুটো নির্বাচনের পর থেকে নেতাদের চেহারা বদলাতে শুরু করল। মফস্সলে, গ্রামে, গঞ্জে ক্যাডার বাহিনীর নেতারা এক-একজন চেঙ্গিজ খাঁ হয়ে উঠল। বিস্ময় লাগে, তার পরের নির্বাচনগুলোতেও বামফ্রন্ট জিতে চলেছে, একটা বড় অংশের ভোটার তাদের ভোট দেয়নি, কিন্তু নির্বাচন জেতার অন্য কায়দাগুলো আয়ত্তে থাকায় ফ্রন্টের জিততে অসুবিধে হয়নি। এখন অধিকাংশ মানুষ বামফ্রন্টকে অপছন্দ করলেও বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। জাতীয় কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় প্রায় মেরুদণ্ডহীন। বিজেপি-র কথা মানুষ ভুলেও ভাবে না, বারো মাসে তেরো পার্বণ করে, মাটির পুতুলকে ভগবান ভেবে একটার পর একটা পুজো করে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার মানুষ মৌলবাদী নয়। এই অবস্থায় কাকে ভোট দিয়ে সরকারের পরিবর্তন করবে সাধারণ মানুষ? কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিবাদ করছে, মিছিল বের করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করতেই সে রাজি হয়ে গেল বাজারের ব্যাগটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে। যে পথ দিয়ে ওরা এখন সচরাচর বাড়িতে ঢোকে, সেই পথে না গিয়ে ভাড়াটেদের দিকের গেট খুলে পা বাড়াতেই দেখল, নিবারণবাবু পড়ি নয় মরি করে ছুটে আসছেন। বৃদ্ধকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।
অনিমেষ দাঁড়াতেই বৃদ্ধ এসে দুই হাত জড়ো করে প্রায় কঁদোকাঁদো গলায় বললেন, আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আপনি আমার এরকম সর্বনাশ করলেন কেন?
অনিমেষ অবাক হয়ে বলল, আপনি কী বলছেন?
বৃদ্ধ বললেন, আপনি বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন বলেছেন, আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম যে এই ভাড়ায় এখন কোথাও বাড়ি ভাড়া পাব না। আপনি যদি কিছুটা সাহায্য করেন তা হলে উপকৃত হব। আপনি আমার অনুরোধ নাকচ করেননি। তাই না?
হ্যাঁ। অনিমেষ মাথা নাড়ল, এতে কী সর্বনাশ করা হল?
তা হলে আপনার আমার ব্যাপারে পার্টির ছেলেদের টেনে আনলেন কেন? এই পাড়ায় ওরা দিনকে রাত করে দিতে পারে।
আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না।
এ কী বলছেন! কিছুক্ষণ আগে ওরা আমাকে শাসিয়ে গেল। আপনার কাছ থেকে কিছু না জেনে? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? নিবারণবাবু বললেন।
মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, কাউকে আপনার কথা আমি বলিনি।
আপনি কি তরুণ সঙ্ঘের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেননি?
এতক্ষণে স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। অনিমেষ বলল, ওরা বাজারে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিল। জানতে চেয়েছিল বাড়িটা বিক্রি করছি কি না, ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে কি না? আমি ওদের একবারও বলিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে। অদ্ভুত ব্যাপার তো! ওরা কি পার্টির ক্যাডার?
হ্যাঁ। ওটা সিপিএমের ছেলেদের ক্লাব। ওদের কেউ চটাতে চায় না। ভোম্বলবাবুও ওদের এড়িয়ে যান। হাতে না রাখলে ভোটে জিতবেন না তাই খোশামোদ করেন। নিবারণবাবু বললেন।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এই যখন অবস্থা তখন এলাকার মানুষ কেন ভোম্বলবাবুকে ভোট দেন?
কাকে দেবে? কেউ আছে নাকি? তা ছাড়া ওই তরুণ সঙ্ঘই তো আমাদের ভোট দিয়ে দেয়। এখন আমি কী করি বলুন তো?
ওরা আপনাকে কী বলেছে?
দশ দিনের মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে হবে। শ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ।
সে কী?
এই অর্ডার না মানলে আমার পরিবারের লোকজনের কী কী হতে পারে তার লিস্টও শুনিয়ে গিয়েছে। আমি তখন প্রায় ওদের হাতে পায়ে ধরলাম, তা দেখে ওরা বিকল্প প্রস্তাব দিল। শুনবেন?
বলুন।
আমাকে কোনওদিন এই বাড়ি ছাড়তে হবে না। কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। শুধু প্রতিমাসে ওদের ক্লাবে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ নিবারণবাবু।
অনিমেষ হতভম্ব। বাজারে যাওয়ার সময় যে ছেলেদের অত্যন্ত ভদ্র বলে তার মনে হয়েছিল, তাদের যে এরকম ভয়ংকর চেহারা হতে পারে, তা এখন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এরকম সময়ে নিজেকে বাতিল মানুষ বলে মনে হয়। সে বলল, নিবারণবাবু, ওদের কথায় বিচলিত হবেন না। অল্পবয়সি ছেলে, কী ক্ষমতা আছে ওদের? আমি তো আপনাকে কোনও চাপ দিচ্ছি না।
অল্পবয়সি ছেলে। ওরা পিরানহা মাছের মতো। ওই যে, বইয়ে পড়েছিলাম, এক আঙুলের মতো লম্বা কিন্তু ওদের ঝকে একটা হাতি গিয়ে পড়লে দশ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা হাড় ছাড়া কিছু ফেলে রাখে না। আবার শ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক।
আরও কিছুটা সাহস জুগিয়ে বাড়ি ফিরে এল অনিমেষ। ছোটমা বারান্দায় বসে তরকারি কাটছিলেন, বললেন, বাজার পাঠিয়ে দিয়ে কোথাও গিয়েছিলে নাকি?
নিবারণবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলাম।
কবে উঠে যাবেন, কিছু জানতে পারলে?
অনিমেষ হেসে ফেলল, সবে তো শুনছেন, একটু সময় দিতে তো হবে।
রান্নাঘর থেকে মাধবীলতার গলা ভেসে এল, জলখাবার রেডি।
.
অনিমেষ ঠিক করল পাড়ার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলবে। একসময় এই পাড়ার অর্ধেক মানুষকে চিনত সে। কাকা জ্যাঠা বলে সম্বোধন করত। তাদের এখন আর পৃথিবীতে থাকার কথা নয়। কিন্তু তাঁদের ছেলেরা নিশ্চয়ই আছে। মাধবীলতা বলল, তারা তোমাকে চিনতে পারবে কি না সন্দেহ হচ্ছে। আর চিনতে পারলেও তরুণ সঙঘ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইবে না।
আশ্চর্য! তুমি একথা বলছ লতা? অন্যায়ের প্রতিবাদ করব না? হেসে ফেলল মাধবীলতা।
হাসছ কেন? অনিমেষ বিরক্ত হল।
প্রতিদিন আমাদের চারপাশে হাজার হাজার অন্যায় হচ্ছে, তার একটারও প্রতিবাদ আমরা করি? বা করতে পারি? মাধবীলতা বলল।
তা হলে?
তুমি পাড়ার মানুষদের বললে তারাই তরুণ সঙেঘর ছেলেদের জানিয়ে দেবে। ওরা তো এই পাড়ার ছেলে। হয়তো তুমি যাকে বলবে তার ছেলেই ওদের একজন। উনি খুশি হবেন? মাধবীলতা বলল।
মাধবীলতার কথায় যুক্তি আছে। হঠাৎ নৃপেনদার কথা মনে পড়ল। নৃপেনদা এই জেলার সম্পাদক। দীর্ঘদিন পার্টি করছেন। তাকে বলার জন্যই ভোম্বলবাবু রাতারাতি বদলে গেলেন।
চিরকুটটা খুঁজে পাওয়া গেল। নৃপেনদাই লিখে দিয়েছিলেন তার নাম্বার। মাধবীলতার মোবাইল ফোনে ওই নাম্বারের বোতাম টিপতেই কানে এল, ব্যস্ত আছে। প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পর ওপাশে গান শুরু হল, ধন ধান্য পুষ্প ভরা… বেশ চমকপ্রদ ব্যাপার। সত্তর সালেও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও অনুষ্ঠানে এসব গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথ বাতিল ছিলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল তো দূরের কথা। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরেও বেশ কয়েক বছর ধরে শুধু গণনাট্যের গান অথবা পল রবসন গাওয়া হত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ গৃহীত হলেন। তারা বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় না নিলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তাই বলে নৃপেনদার মতো কট্টর সিপিএম নেতা, যিনি জেলার সম্পাদক হয়ে আছেন দীর্ঘকাল, যাঁর বক্তৃতায় এমন সব শব্দ থাকত যা সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারত না, তার মোবাইলের রিংটোনে ধন ধান্য পুষ্প ভরা? ভাবাই যায় না।
গান থামতেই নৃপেনদার গলা শোনা গেল, কে ভাই?
নৃপেনদা, আমি অনিমেষ।
কোন অনিমেষ?
অনিমেষ মিত্র। হাকিমপাড়ায় বাড়ি। এখন কলকাতায় থাকি।
ওহো। বলো, কোনও দরকার আছে?
আপনার সঙ্গে দেখা করে বলতে চাই। খুব জরুরি।
এই তো, আমাকে সমস্যায় ফেললে হে! আমি তো আজই রাতের ট্রেনে কলকাতায় যাচ্ছি। এখনই চলে আসতে পারবে? আধঘণ্টার মধ্যে? এসো। নৃপেনদা ফোনের লাইন কেটে দিলেন।
.
১৯.
আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে রিকশা ধরে নৃপেনদার বাড়িতে পৌঁছোনো অনিমেষের পক্ষে একটু কঠিন ব্যাপার। মাধবীলতা বলল, চলো, আমিও যাব। তুমি যাবে? অনিমেষ খাটে বসে পাঞ্জাবি শরীরে গলিয়ে বলল, উনি বলেছেন আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোতে। তোমার তৈরি হতে সময় লাগবে।
মানে? রেগে গেল মাধবীলতা, আমি কি বিয়েবাড়িতে যাচ্ছি যে একঘণ্টা ধরে সেজে যাব? তা ছাড়া তুমি আমাকে কবে সাজতে দেখেছ?
অনিমেষ জবাব দিল না। এ কথা ঠিক মাধবীলতা পোশাক বা প্রসাধনের যেটুকু দরকার সেটুকুতেই সন্তুষ্ট। এটা আজকের কথা নয়, কলেজজীবন থেকে একটা হলুদ শাড়ি আর কখনও কখনও কপালে ছোট্ট চন্দনের ফোঁটা ছাড়া ওকে দেখা যেত না।
মিনিট চারেক বাদে পাশের ঘর থেকে মাধবীলতা বেরিয়ে এসে বলল, চলো। অনিমেষ দেখল পরিষ্কার সাদার ওপর হালকা নীল কাজ করা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরেছে মাধবীলতা। সে হাসল।
হাসছ কেন?
বলা যাবে না। ক্রাচ টেনে নিয়ে এগোল অনিমেষ।
এমন কী কথা যা তুমি আমাকে বলতে পারবে না?
কোনওদিন যখন বলিনি তখন এখন বলি কী করে? মাধবীলতার দুই স্র এক হল ক্ষণিকের জন্যে। বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটমায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আমরা নৃপেনবাবুর বাড়িতে যাচ্ছি, উনি আজ কলকাতায় চলে যাচ্ছেন, না গেলে সমস্যা হবে।
এসো। বাবা এসেছে, ওর সঙ্গে গল্প করছি।
লছমন কি এসেছে?
না। ঘণ্টাখানেক পরে এসে বাবাকে নিয়ে যাবে।
.
কপাল ভাল ছিল, কয়েক পা হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেল ওরা। রিকশায় উঠে মাধবীলতা বলল, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
সেটা কী? অনিমেষ তাকাল। পাশাপাশি বসায় মাধবীলতার শরীরের চাপ কিছুটা মেনে নিতে হচ্ছিল।
বাড়িটা বিক্রি করতে যখন এত সমস্যা হচ্ছে, তখন থাক না।
মানে? অবাক হল অনিমেষ, ছোটমার কথা ভুলে যাচ্ছ?
ভুলিনি।
তা হলে?
এবার তোমাদের এই শহরে এসে মনে হচ্ছে আমাদের কলকাতায় থাকার কোনও মানে হয় না। যখন স্কুলে পড়াতাম তখন ওখানে থাকার দরকার ছিল। এখন তো সারাদিন বাড়িতেই কেটে যায়! অথচ দেখো, এই শহরটা কী শান্ত, বাড়ি বিক্রির চেষ্টা না করলে কোনও টেনশন থাকবে না। আমরা যদি এখানে থাকি তা হলে ছোটমায়ের দেখাশোনা করতে পারব। ওঁকে অন্য কোথাও যেতে হবে না। মাধবীলতা বলল।
খুব অবাক হয়ে অনিমেষ বলল, তুমি কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে চাও?
কলকাতা কি আমাদের কিছু দিয়েছে যে ছেড়ে আসতে কষ্ট হবে?
আর অর্ক?
ও ওখানেই থাকুক। চাকরি করছে, অসুবিধে হবে না। এই যে এতবার বললাম, এখানে আসার জন্য, নানান বাহানা দেখাতে লাগল।
এখানে সংসার চালাতে পারবে?
পেনশনের টাকা তো আছে, কয়েকটা ছেলেমেয়েকে না হয় পড়াব।
বাঃ। তা হলে আর নৃপেনদার কাছে গিয়ে কী হবে? রিকশা ঘোরাতে বলি?
একদম না। আমি আমার ভাবনার কথা বললাম। তার মানে এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। আমরা কয়েকদিনের জন্য এসেছি। ছোটমা ডেকে এনেছেন। কিন্তু মাসের পর মাস উনি তো আমাদের সঙ্গে থাকতে নাও চাইতে পারেন। তা ছাড়া ক্লাবের ছেলেদের অত্যাচারের একটা বিহিত তো করা দরকার। বেশ গম্ভীর গলায় বলল মাধবীলতা।
এখন নৃপেনদার বাড়ির সামনে কোনও লাইন নেই। বাড়ির দরজায় একটা নোটিশ টাঙানো হয়েছে–জেলা সম্পাদক আগামী তিনদিন বাহিরে থাকিবেন। দয়া করিয়া লাইন দিবেন না।
নৃপেনদা নিজে তাদের আসতে বলেছেন শুনে একজন তাদের বাইরের ঘরে বসতে দিল। এর আগের দিন অনিমেষ লক্ষ করেনি, পেছনের দেওয়াল জুড়ে লেনিনের বিশাল ছবি টাঙানো আছে। কী করে সেদিন ওটা চোখ এড়িয়ে গেল কে জানে।
বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেমে এলেন নৃপেনদা। মাধবীলতাকে দেখে তার চোখ ছোট হল। অনিমেষরা উঠে দাঁড়িয়েছিল, নৃপেনদা ওদের বসতে বলে সামনের চেয়ারে বসলেন, খুব দেরি হয়ে গেছে। দুমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে ট্রেন মিস করব। বলো, কী ব্যাপার?
অনিমেষ সংক্ষেপে তরুণ সঙ্ঘ ক্লাবের ছেলেদের কথা বলে শেষ করল, ওরা আপনাদের দলের কর্মী।
নৃপেনদা বললেন, কর্মীদের গায়ে কি দলের ছাপ মারা থাকে? এঁকে তো চিনলাম না! মাধবীলতার দিকে তাকালেন তিনি।
আমার স্ত্রী। মাধবীলতা মিত্র।
ওহো। আপনার কথা কে যেন বলছিল। নকশালদের ধরতে পুলিশ আপনার ওপর খুব অত্যাচার করেছিল বোধহয়। ঘড়ি দেখলেন নৃপেনদা, কিন্তু অনিমেষ, তুমি আমাকে কী করতে বলছ?
ওদের বলুন যেন ওই ব্যাপারে নাক না গলায়।
তোমার কাছে ওরা সরাসরি টাকা চেয়েছে কি?
না। নিবারণবাবু, যিনি আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাঁর কাছে চেয়েছে। ভদ্রলোক খুব ভয় পেয়ে গেছেন।
কী বলব বলো! আজকালকার ছেলেরা যা ভাল বোঝে তাই করে। এই যে আমার শ্বশুরমশাই মারা গেলেন, বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। আমার স্ত্রী একমাত্র মেয়ে। ওঁর মা চলে গেছেন বছর দশেক আগে। খালি বাড়ি ফেলে রাখার কোনও মানে হয় না বলে বিক্রি করতে চাইলেন আমার স্ত্রী। অমনি ও পাড়ার ছেলেরা এসে পুজোর চাদা হিসেবে এক লক্ষ টাকা চাইল। তুমি ভাবো ব্যাপারটা! আমি পার্টির এতদিনের সম্পাদক, আমার স্ত্রীর কাছেই ওরা টাকা চাইছে। যদি না দিতাম, যদি শাসন করতাম তা হলে পরের নির্বাচনে কেউ আমাদের ক্যান্ডিডেটের হয়ে খাটত না। তবে হ্যাঁ, আমি বলে-কয়ে ওটা পঞ্চাশ হাজারে নামিয়েছিলাম। হাসলেন নৃপেনদা।
আপনি সম্পাদক হয়ে ক্যাডারদের প্রশ্রয় দিয়েছেন?
অনিমেষ হতভম্ব।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই করতে হয় অনিমেষ। আচ্ছা উঠছি। নৃপেনদা উঠে দাঁড়ালেন।
এতক্ষণে মাধবীলতা কথা বলল, আপনারা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। আপনাদের দলের ছেলে আমাদের উপরে অত্যাচার করছে দেখেও আপনি কোনও সাহায্য করবেন না! তা হলে তো বুঝতে হবে আমরা জঙ্গলে বাস করছি।
নৃপেনদা বললেন, এর আগে যখন অনিমেষ আমার কাছে এসেছিল। তখন আমি ভোম্বলকে বলে দিয়েছিলাম। কারণ ভোম্বলকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, এক কাজ করুন। আপনারা সৌমেনবাবুর সঙ্গে দেখা করুন। উনি এদের ব্যাপারটা দেখেন। আমি বলে দেব। আচ্ছা ভাই আর দেরি করা যাবে না। নৃপেনদা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
দরজার বাইরে পা রাখতে না রাখতেই নৃপেনদার গাড়িটাকে চলে যেতে দেখল ওরা। অনিমেষ বলল, চলো, রিকশার খোঁজ করি।
গেটের পাশে একটি যুবক দাঁড়িয়ে ছিল, কথাটা তার কানে গিয়েছিল। যেতেই বলল, এখানে দাঁড়ান, এখনই রিকশা পেয়ে যাবেন। কোথায় যাবেন?
অনিমেষ বলল, হাকিমপাড়ায়।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সৌমেনবাবু কোথায় থাকেন?
আমাদের জেলা কমিটির সৌমেনদার কথা বলছেন?
আন্দাজে বুঝে নিয়ে মাথা নাড়ল মাধবীলতা, হ্যাঁ।
বাবুপাড়ায়। থানার উলটোদিকে। এই খানিক আগে নৃপেনজ্যাঠার সঙ্গে মিটিং করে বাড়িতে গিয়েছেন। উনি আটটা নাগাদ পার্টি অফিসে যান।
যুবক হাত নেড়ে একটা রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল। ওরা রিকশায় উঠে বসলে অনিমেষ বলল, হাকিমপাড়ায় চলো।
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না। আগে বাবুপাড়ায় যাব।
অনিমেষ মুখ ফেরাল, কেন?
সৌমেনবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাব।
নাঃ। লোকটিকে আমি চিনি না। তা ছাড়া নৃপেনদা বলেছেন, ওর সঙ্গে কথা বলবেন। আগে বলুন, তারপর দেখা যাবে।
উনি আজ কলকাতায় চলে যাচ্ছেন, যদি শেষ পর্যন্ত ভুলে যান, তা হলে তরুণ সঙ্ঘের সমস্যাটা একই জায়গায় থেকে যাবে। তার চেয়ে আমরাই সৌমেনবাবুর সঙ্গে কথা বলি। মাধবীলতা শক্ত গলায় কথাগুলো বলল।
অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে বলল, বাবুপাড়া হয়ে যাবে ভাই।
দিনবাজার দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হত। রিকশাওয়ালা বলল।
একই হত। তুমি আমাকে জলপাইগুড়ির রাস্তা চেনাবে নাকি? বিরক্ত হল অনিমেষ। মাধবীলতা আড়চোখে তাকাল, কিছু বলল না।
থানার সামনে এসে সৌমেনবাবুর বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। একটি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করতেই রিকশাওয়ালা বলে ফেলল, আরে! আগে বললে আমিই নিয়ে যেতাম। চলুন।
তুমি ওঁকে চেনো?
কে চেনে না? রিকশাওয়ালা একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামল।
দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর যে ভদ্রলোক হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তাঁকে অনিমেষ আগে কখনও দেখেনি। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, আপনাদের আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বলবেন?
একটা সমস্যার কারণে এসেছি। মাধবীলতা বলল। পাশের ঘরের দরজা ঠেলে আলো জ্বালিয়ে সৌমেনবাবু বললেন, এই শহরের লোকজন সমস্যায় পড়লে ডাক্তারের কাছে যায়, উকিলের কাছে। যায়। সব শহরের লোকজনই যায়। তবে এই শহরের লোক সমস্যায় পড়লে থানায় না গিয়ে উলটো দিকের এই বাড়িটায় আসাই পছন্দ করে। বসুন। আগে আপনাদের পরিচয়টা জানি।
অনিমেষ বলল, আমি অনিমেষ, ও আমার স্ত্রী। নৃপেনদা আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন, ওঁকে আমি ছাত্রাবস্থা থেকে চিনতাম।
আচ্ছা। আপনি এখন কোথায় থাকেন?
কলকাতায়।
সমস্যাটা কী?
মাধবীলতা মুখ খুলল, পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বেশ গুছিয়ে বলল সে। চোখ বন্ধ করে শুনলেন সৌমেনবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেগুলোর নাম বলুন।
মাধবীলতা তাকাল অনিমেষের দিকে। অনিমেষ মাথা নাড়ল, নাম তো জানি না। ওরা কথা বলেছিল, নাম বলেনি।
নাম না জানলে আমি অ্যাকশন নেব কী করে? ওরা যে আমাদের লোক সে ব্যাপারে আমাকে নিঃসন্দেহ হতে হবে। আজকাল অনেকেই পার্টির কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে দুপয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে তাকেই এই আবর্জনার দায় বইতে হয়। আপনারা খোঁজ নিয়ে আমাকে নামগুলো বলুন। সৌমেনবাবু মিষ্টি হাসলেন।
মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, আপনি তরুণ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।
মাথা নাড়লেন সৌমেনবাবু, না, পারতাম না। আমিই ওদের প্রেসিডেন্ট, আমাকে জানিয়ে ওরা এই কাজটি করেনি। পার্টি থেকে বলা হয়েছে, ভাড়াটে এবং বাড়িওয়ালার ঝগড়ার মধ্যে কেউ যেন নাক না গলায়। যারা নাক গলাচ্ছে তারা যে পার্টির কর্মী নয় তা আমি জোর গলায় বলতে পারি। নকশালদের মধ্যে কংগ্রেস প্রচুর বদ ছেলেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যারা নিজেদের নকশাল বলে পরিচয় দিয়ে কনস্টেবলদের মেরেছে, স্কুল পুড়িয়েছে। ফলে মানুষ নকশালদের সমর্থন করেনি। এটাই ছিল কংগ্রেসের কৌশল। এখন দুই কংগ্রেস মিলে আমাদের বদনাম করার জন্য এইসব ছেলেদের রিক্রুট করেছে যারা আমাদের কর্মীদের সঙ্গে মিশে দলের বদনাম করবে। তবু, আমি দেখব।
রিকশায় উঠে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলে?
অনিমেষ মাথা নাড়ল, কোনও লাভ হল না এখানে এসে। একটা কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা কোথায় নেমে এসেছে। এতবছর ক্ষমতায় থেকেও মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দলটা।
নতুন কথা বলছ নাকি?
মানে?
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তোমার পায়ের গুলির দাগ দেখিয়ে ওরা তোমাকে বিপ্লবী সাজিয়েছিল, মনে নেই? মাধবীলতা বলল।
আছে, কিন্তু তখনও ওদের চক্ষুলজ্জা ছিল। অনিমেষ বলল।
ক্ষমতা দীর্ঘদিন হাতে পেলে লজ্জা ভয় দূর হয়ে যায়।
মাধবীলতা বলল, এখন তো আমার আরও বেশি মনে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে এখানে থাকতে।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, সেটা পরের কথা। এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা করা যায় কি না ভাবতে হবে।
মাধবীলতা বলল, ছোটমাকে শুধুনৃপেনবাবুর কথাই বলবে, সৌমেনবাবুর কাছে গিয়েছিলাম বলার দরকার নেই।
.
রাত্রের খাওয়ার পর শুতে এসে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এখন বলো তো, তখন বেরোবার সময় তুমি ওইভাবে হাসছিলে কেন? তুমি দেখছি ভোলোনি। অনিমেষ বিছানায় বসেছিল।
ওইরকম হাসি কখনও দেখিনি তো!
বললে তুমি রেগে যেতে পারো।
তাই! শোনাই যাক।
সাদা শাড়ি সাদা জামাও যে কখনও কখনও পুরুষের মন চঞ্চল করে দিতে সক্ষম তা তোমাকে দেখে তখন মনে হয়েছিল।
মাধবীলতা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, এ কী কথা শুনি মন্থরার মুখে! তোমার ওসব হয় নাকি?
ঠিক তখনই ওর মোবাইল জানান দিল। সেটা তুলে অন করে কিছু শুনে সে বলল আচ্ছা। ঠিক আছে। মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে মাধবীলতা বলল, অর্কর ফোন। ও এখন ট্রেনে। এখানে আসছে।
.
২০.
জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে নেমে পরে পড়ল অর্ক। ছেলেবেলায় যখন এসেছিল, এই স্টেশনেই নেমেছিল কিন্তু সেই স্মৃতি মুছে গিয়েছে। ট্রেনেই শুনেছিল, জলপাইগুড়িতে দুটো স্টেশন আছে। একটা শহরের বুকের মধ্যে আর এই রোড স্টেশনটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
নামতেই দেখল প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ছেলে, সঙ্গে সিপিএমের পতাকা। বোঝা গেল ওরা কোনও বড় নেতাকে রিসিভ করতে স্টেশনে এসেছে।
অর্ক ফঁপরে পড়ল, কারণ স্টেশনের বাইরে রিকশা ছাড়া আর কিছু নেই, যাতে উঠলে সে শহরে যেতে পারে। কোনও রিকশাওয়ালাই যাত্রী নিতে রাজি হচ্ছে না, বলছে, ভাড়া হয়ে গিয়েছে। বলছে, বাবু, পার্টির দাদারা বলে গেছে ওয়েট করতে যেতে পারব না।
স্টেশনে কোনও বাস আসে না, ট্যাক্সির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। একটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ধ্বনি দিতে দিতে বড় দুই নেতাকে নিয়ে বেরিয়ে এল পার্টির দাদারা। সঙ্গে আরও কয়েকজন যারা নেতাদের সঙ্গে এসেছে। দাদাদের গাড়িতে তুলে বাকিরা রিকশায় উঠে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলে অর্ক প্রশ্নটা শুনতে পেল, কোথায় যাবেন?
জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়া। কঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িমুখো প্রৌঢ়কে উত্তর দিল অর্ক। প্রৌঢ় হাসল, এখানে নতুন মনে হচ্ছে।
কী করে মনে হচ্ছে?
এখানে যাওয়া-আসা থাকলে বলতেন, হাকিমপাড়ায়। তার আগে জলপাইগুড়ি শব্দটা জুড়তেন না। যাক গে, আপনার সামনে দুটো রাস্তা আছে। এক, প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে থাকুন। ঘণ্টা চারেক বাদে একটা বড় ট্রেন আসবে এই স্টেশনে। তখন কিছু রিকশাওয়ালা পৌঁছে যাবে তোক নিয়ে। তার একটায় হাকিমপাড়ায় যেতে পারবেন। আর দ্বিতীয়টা খুব সহজ। পয়সা খরচ হবে না। সঙ্গে যখন কাঁধঝোলা ব্যাগ তখন সমস্যা নেই, হাঁটতে হাঁটতে চলে যান। মাইল আড়াই হাঁটতে হবে।
চার ঘণ্টা বসে থাকার চেয়ে আড়াই মাইল হেঁটে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে হল অর্কর। সে হেসে বলল, অনেক ধন্যবাদ, আমি হেঁটে যাব।
ধন্যবাদ দেওয়ার কোনও দরকার নেই। আমি হেঁটেই ফিরব। আপনার ইচ্ছে হলে সঙ্গে হাঁটতে পারেন।
প্রৌঢ়ের পোশাক বলে দিচ্ছে তার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। পরনে ময়লাটে ধুতি আর রং ওঠা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, এখন খুব কম বাঙালি পরে থাকেন। হাঁটা শুরু করে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এই স্টেশনে কি বেশি লোক যাওয়া-আসা করে না?
আগে খুব কম লোক এদিকে আসত। এখন কয়েকটা ভাল ট্রেন রোড স্টেশনে দাঁড়ায় বলে মানুষ আসছে। জলপাইগুড়ির লোক ট্যাক্সিতে চড়ে না, শহরের মধ্যে তো নয়ই। রিকশাই একমাত্র ভরসা। আপনি কোত্থেকে আসছেন? প্রৌঢ় তাকালেন।
কলকাতা থেকে। অর্ক জবাব দিল।
সে কী! আমি ভাবলাম শিলিগুড়ি থেকে আসছেন। কলকাতার কেউ আপনার মতো কাপড়ের কাঁধব্যাগ নিয়ে তো এখানে আসে না। প্রৌঢ় বললেন।
আমি সম্ভবত আজই ফিরে যাব। খুব বেশি হলে আগামীকাল।
মনে হচ্ছে আসাটা খুব জরুরি ছিল।
হ্যাঁ।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা একটা চওড়া পিচের রাস্তার সামনে পৌঁছোল। প্রৌঢ় বললেন, বাঁ দিকে গেলে তিস্তা ব্রিজ এবং তারপরে ডুয়ার্স, ডানদিকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা। সোজা জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে রায়কতপাড়া, মানে শহরে পৌঁছাবেন। আপনার ইতিহাসে আগ্রহ আছে?
অল্পস্বল্প।
দেবী চৌধুরানির নাম শুনেছেন?
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র।
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন। ডান পাশে একটু হাঁটলেই একটা কালীবাড়ি দেখতে পাবেন। দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ি। ওর চেহারা-চরিত্র অন্য যে-কোনও কালীবাড়ির থেকে আলাদা। সোজাই চলুন। প্রৌঢ় পা চালালেন।
আপনার নাম শুনতে পারি? হাসলেন প্রৌঢ়, কী নাম বলব? বাবা-মা যে নাম রেখেছিলেন সেই নাম বললে কেউ তো আর আমাকে চিনতে পারে না। সেই নামটা হল বলরাম দত্ত।
কী নামে সবাই আপনাকে চেনে?
রেডক্রশ দত্ত।
মানে? অর্ক হকচকিয়ে গেল।
ওই নামের যোগ্যতা আমার নেই। কেউ একজন শুরু করেছিল, সেটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে চালু হয়ে গেছে। বলরাম দত্ত মাথা নাড়লেন।
এটা কী করে হল?
জুনিয়ার স্কুলে মাস্টারি করতাম। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। চাকরির শেষদিকে একদিন জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি বউ হাউহাউ করে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে নতুন দৃশ্য নয়। কেউ মারা গেলে মানুষ ওইভাবে কাঁদে। কিন্তু শুনলাম কান্নার কারণ অন্য। হাসপাতাল বলেছে পেশেন্টকে এখনই শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে, এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। অথচ পেশেন্টপার্টির কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। মৃত্যু অনিবার্য বলে বউটি কাঁদছে তার স্বামীর জন্য। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কীরকম ঘোর লাগল মনে। আধঘণ্টার মধ্যে ধারধোর করে টাকা জোগাড় করে পেশেন্ট আর তার বউকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলাম। যমে ডাক্তারের মধ্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যম হেরে গেল। হাসপাতালে পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। একটা ওষুধের দোকানের মালিক, যিনি আমার ছাত্রের বাবা, পাশে দাঁড়ালেন। ছেলেটি সুস্থ হল সাড়ে ছয় হাজার টাকার বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে। হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল। ওর বউয়ের কাছে আমি তখন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কী বলব ভাই, বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সাড়ে ছয় হাজার আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কোনও বিকল্প জীবনে পাইনি।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরা আপনাকে টাকাটা শোধ করেনি?
কী করে করবে? কোনওরকমে যাদের দিন চলে তাদের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গরিবদের অসুখ হলে চিকিৎসা করানো বিলাসিতা। কিন্তু আমি মুশকিলে পড়লাম। বলরামবাবু হাসলেন।
কীরকম?
লোলাকে এসে আমাকে অনুরোধ করতে লাগল। প্রত্যেকের কোনও আত্মীয়ের খুব অসুখ, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না। এমনকী সেখানকার ইসিজি মেশিনও খারাপ। ডাক্তাররা পাঠাচ্ছে নার্সিংহোমে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। না না বললেও কেস খারাপ দেখলে রাজি হয়ে যেতাম। বলতাম, যা খরচ হবে তা আপনারা জোগাড় করে আনুন, চিকিৎসা যাতে ভালভাবে হয় সেটা আমি দেখব। তবু শেষ মুহূর্তে আটকে গেলে পকেট থেকে বের করতে হয়। তখন একজনের পরামর্শে শহরের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করলাম। দশজনের মধ্যে একজন সাহায্যের হাত বাড়ালেন। কিন্তু ততদিনে আমার নাম হয়ে গেছে রেডক্রশ দত্ত। বলরাম বললেন।
কিন্তু এসব করলে আপনার নিজের সংসার কী করে চলবে?
আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করিনি, মা-ও চলে গিয়েছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, অথচ লোকবল নেই, জানাশোনা কম, তারা নিজেরাই খুশি হয়ে আমাকে কিছু দেন। আর ডাক্তাররা তো বটেই, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির হাসপাতালের স্টাফরাও আমাকে এখন সাহায্য করেন। ওঁরা সব জেনে গেছেন। বলরাম বললেন, এই তো, আলিপুরদুয়ার থেকে একজন এসেছিল তার মাকে নিয়ে, গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করিয়ে আজ ফিরে গেলেন। ওঁদের পৌঁছে দিতেই স্টেশনে এসেছিলাম।
আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?
সেনপাড়ায়। আমার মনে হয় এখানে রিকশা পেয়ে যাবেন। ওই তো একটা আসছে। ডানদিকে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। আর-একটু এগিয়ে বা দিকে চলে যাব। ভাল থাকবেন ভাই।
বলরামবাবু রিকশাওয়ালাকে বললেন হাকিমপাড়ায় যেতে। রিকশাওয়ালা বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কত ভাড়া দিতে হবে?
রিকশাওয়ালা হাসল, রেডক্রশদার লোক আপনি, বেশি ভাড়া কি নিতে পারি?
বিদায় নিয়ে রিকশায় ওঠার কিছুক্ষণ পরে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে?
কী বলছেন বাবু, চিনব না? আমাদের অসুখ হলে উনি ছাড়া আর কে আছেন এখানে?
রিকশা চলছে। হঠাৎ অর্কর মনে হল যেসব রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতারা দেশসেবার কথা বলেন, নিজের এবং দলের কর্মীদের স্বার্থ ঠিকঠাক রেখে মানুষের উপকার করতে বক্তৃতা দেন, তারা হয় বলরামবাবুদের দলে টানতে চাইবেন, নয় এড়িয়ে চলবেন। দারিদ্র্যসীমার নীচে যারা বাস করে তারা প্রয়োজনে ছুটে যাবে বলরামবাবুদের কাছে কিন্তু তাদের বিপদের সময় কজন পাশে দাঁড়াবে তাতে খুব সন্দেহ থাকছে।
ডানদিকের লম্বা বাড়িগুলো যে হাসপাতাল তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কেমন গুম হয়ে আছে চারধার।
একটা মজা খালের ওপর ছোট ব্রিজ। দেখলেই বোঝা যায় জল খুব নোংরা। নিশ্চয়ই নিয়মিত মশারা ডিম পাড়ে ওখানে। সেটা পার হয়ে এসে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, বাবু, হাকিমপাড়ার কোনখানে যাবেন?
তিস্তার চরের কাছে বাড়ি।
রিকশা দাঁড় করিয়ে লোকটা হাসল, হাকিমপাড়ার একটা দিক তো তিস্তার পাড়েই। কার বাড়ি বলুন তো?
অর্ক বুঝল বাবার নাম বললে কোনও কাজ হবে না। সে বলল, যাঁর বাড়ি তিনি নেই। মহীতোষ মিত্র।
রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে নামটা বললে তিনি বললেন, উনি তো বহুদিন হল দেহ রেখেছেন। তবে ওঁর বিধবা স্ত্রী এখনও আছেন বলে শুনেছি। তুমি বাঁ দিকের রাস্তা ধরো। বিপুল ব্যানার্জির বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা যখন বাঁ দিকে জেলা স্কুলের দিকে বাঁক নিচ্ছে তখনই দেখতে পাবে ডান দিকে একটা গলি আছে যেটা টাউন ক্লাবের দিকে গেছে। ওই গলিতে ঢোকার পর বাঁদিকের দ্বিতীয় বাড়ি।
রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরাল। অর্ক মাথা নাড়ল। বাবার কাছে শুনেছিল এই শহরে ঠাকুরদার বাবা সরিশেখর দীর্ঘকাল ছিলেন। তাঁকেই সবার চেনার কথা। তুলনায় ঠাকুরদা বেশিবছর থাকেননি। তবু ওই বৃদ্ধ চিনতে পারলেন। এঁরা বোধহয় অনিমেষ মিত্রকে চিনতেই পারবেন না।
একটা গাছপালায় ঘেরা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াল। অর্ক মনে করতে পারছিল না। তার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আছে একটা লোহার গেট যেটা খুলে ঢুকতে হয়। সে জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ি?
হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা বলল।
কত দিতে হবে তোমাকে?
কী বলব! পাঁচটা টাকা দিন।