3 of 11

১৬.১৭ সন্ধ্যাসমাগমে হরিধ্বনি — নরেন্দ্রের কত গুণ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৯শে অগস্ট

সন্ধ্যাসমাগমে হরিধ্বনি — নরেন্দ্রের কত গুণ

কিয়ৎক্ষণ পরে সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখিয়া অধিকাংশ লোক বাটী গমন করিলেন। নরেন্দ্রও বিদায় লইলেন।

বেলা পড়িয়া আসিতে লাগিল। সন্ধ্যা হয় হয়। ঠাকুরবাড়ির ফরাশ চারিদিকে আলোর আয়োজন করিতেছে। কালীঘরের ও বিষ্ণুঘরের দুইজন পূজারী গঙ্গায় অর্ধ নিমগ্ন হইয়া বাহ্য ও অন্তর শুচি করিতেছেন; শীঘ্র গিয়া আরতি ও ঠাকুরদের রাত্রিকালীন শীতল দিতে হইবে। দক্ষিণেশ্বর গ্রামবাসী যুবকবৃন্দ — কাহারও হাতে ছড়ি, কেহ বন্ধুসঙ্গে — বাগানে বেড়াইতে আসিয়াছে। তাহারা পোস্তার উপর বিচরণ করিতেছে ও কুসুমগন্ধবাহী নির্মল সান্ধ্য সমীরণ সেবন করিতে করিতে শ্রাবণ মাসের খরস্রোতা ইষৎ বীচিবিকম্পিত গঙ্গাপ্রবাহ দেখিতেছে। তন্মধ্যে হয়তো কেহ অপেক্ষাকৃত চিন্তাশীল পঞ্চবটির বিজনভূমিতে পাদচারণ করিতেছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণও পশ্চিমের বারান্দা হইতে কিয়ৎকাল গঙ্গাদর্শন করিতে লাগিলেন।

সন্ধ্যা হইল। ফরাশ আলোগুলি জ্বালিয়া দিয়া গেল। পরমহংসদেবের ঘরে আসিয়া দাসী প্রদীপ জ্বালিয়া ধুনা দিল। এদিকে দ্বাদশ মন্দিরে শিবের আরতি, তৎপরেই বিষ্ণুঘরের ও কালীঘরের আরতি আরম্ভ হইল। কাঁসর, ঘড়ি ও ঘন্টা মধুর ও গম্ভীর নিনাদ করিতে লাগিল — মধুর ও গম্ভীর — কেননা, মন্দিরের পার্শ্বেই কলকলনিনাদিনী গঙ্গা।

শ্রাবণের কৃষ্ণা প্রতিপদ, কিয়ৎক্ষণ পরেই চাঁদ উঠিল। বৃহৎ উঠান ও উদ্যানস্থিত বৃক্ষশীর্ষ ক্রমে চন্দ্রকিরণে প্লাবিত হইল। এদিকে জ্যোৎস্নাস্পর্শে ভাগীরথীসলিল কত আনন্দ করিতে করিতে প্রবাহিত হইতেছে।

সন্ধ্যার পরেই শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতাকে নমস্কার করিয়া হাততালি দিয়া হরিধ্বনি করিতেছেন। কক্ষমধ্যে অনেকগুলি ঠাকুরদের ছবি — ধ্রুব-প্রহ্লাদের ছবি, রাম রাজার ছবি, মা-কালীর ছবি, রাধাকৃষ্ণের ছবি। তিনি সকল ঠাকুরকে উদ্দেশ করিয়া ও তাঁহাদের নাম করিয়া প্রণাম করিতেছেন। আবার বলিতেছেন, ব্রহ্ম-আত্মা-ভগবান; ভাগবত-ভক্ত-ভগবান; ব্রহ্ম-শক্তি, শক্তি-ব্রহ্ম; বেদ-পুরাণ-তন্ত্র; গীতা-গায়ত্রী। শরণাগত, শরণাগত; নাহং, নাহং; তুঁহু, তুঁহু; আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; ইত্যাদি।

নামের পর শ্রীরামকৃষ্ণ করজোড়ে জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন। দুই-চারিজন ভক্ত সন্ধ্যা সমাগমে উদ্যানমধ্যে গঙ্গাতীরে বেড়াইতেছিলেন। তাঁহারা ঠাকুরদের আরতির কিয়ৎক্ষণ পরে পরমহংসদেবের ঘরে ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিতেছেন। পরমহংসদেব খাটে উপবিষ্ট। মাস্টার, অধর, কিশোরী ইত্যদি নিচে সম্মুখে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল — এরা সব নিত্যসিদ্ধ, ঈশ্বরকোটি। এদের শিক্ষা কেবল বাড়ার ভাগ। দেখ না, নরেন্দ্র কাহাকেও কেয়ার (গ্রাহ্য) করে না। আমার সঙ্গে কাপ্তেনের গাড়িতে যাচ্ছিল — কাপ্তেন ভাল জায়গায় বসতে বললে — তা চেয়েও দেখলে না। আমারই অপেক্ষা রাখে না! আবার যা জানে, তাও বলে না — পাছে আমি লোকের কাছে বলে বেড়াই যে, নরেন্দ্র এত বিদ্বান। মায়ামোহ নাই। — যেন কোন বন্ধন নাই! খুব ভাল আধার। একাধারে অনেক গুণ — গাইতে-বাজাতে, লিখতে-পড়তে! এদিকে জিতেন্দ্রিয়, — বলেছে বিয়ে করবে না। নরেন্দ্র আর ভবনাথ দুজনে ভারী মিল — যেন স্ত্রী-পুরুষ। নরেন্দ্র বেশি আসে না। সে ভাল। বেশি এলে আমি বিহ্বল হই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *