চর্তুদশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৯শে অগস্ট
‘সমাধিমন্দিরে’ — কাপ্তেন ও নরেন্দ্রের আগমন
এমন সময়ে নরেন্দ্র ও বিশ্বনাথ উপাধ্যায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিশ্বনাথ নেপালের রাজার উকিল — রাজপ্রতিনিধি। ঠাকুর তাঁহাকে কাপ্তেন বলিতেন। নরেন্দ্রের বয়স বছর বাইশ, বি.এ. পড়িতেছেন। মাঝে মাঝে, বিশেষতঃ রবিবারে দর্শন করিতে আসেন।
তাঁহারা প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হইলে, পরমহংসদেব নরেন্দ্রকে গান গাহিতে অনুরোধ করিলেন। ঘরের পশ্চিম ধারে তানপুরাটি ঝুলানো ছিল। সকলে একদৃষ্টে গায়কের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বাঁয়া ও তলবার সুর বাঁধা হইতে লাগিল — কখন গান হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — দেখ, এ আর তেমন বাজে না।
কাপ্তেন — পূর্ণ হয়ে বসে আছে, তাই শব্দ নাই। (সকলের হাস্য) পূর্ণকুম্ভ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — (কাপ্তেনের প্রতি) — কিন্তু নারদাদি?
কাপ্তেন — তাঁরা পরের দুঃখে কথা কয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ নারদ, শুকদেব — এঁরা সমাধির পর নেমে এসেছিলেন, — দয়ার জন্য, পরের হিতের জন্য, তাঁরা কথা কয়েছিলেন।
নরেন্দ্র গান আরম্ভ করিলেন — গাইলেন:
সত্যং শিব সুন্দর রূপ ভাতি হৃদমন্দিরে।
(সেদিন কবে বা হবে)।
নিরখি নিরখি অনুদিন মোরা ডুবিব রূপসাগরে ৷৷
জ্ঞান-অনন্তরূপে পশিবে নাথ মম হৃদে,
অবাক্ হইয়ে অধীর মন শরণ লইবে শ্রীপদে।
আনন্দ অমৃতরূপে উদিবে হৃদয়-আকাশে,
চন্দ্র উদিলে চকোর যেমন ক্রীড়য়ে মন হরষে,
আমরাও নাথ তেমনি করে মাতিব তব প্রকাশে ৷৷
শান্তং শিব অদ্বিতীয় রাজ-রাজ চরণে,
বিকাইব ওহে প্রাণসখা আফল করিব জীবনে।
এমন অধিকার, কোথা পাব তার, স্বর্গভোগ জীবনে (সশরীরে) ৷৷
শুদ্ধমপাপবিদ্ধং রূপ হেরিয়া নাথ তোমার,
আলোক দেখিলে আঁধার যেমন যায় পলাইয়ে সত্বর,
তেমনি নাথ তোমার প্রকাশ পলাইবে পাপ-আঁধার।
ওহে ধ্রুবতারাসম হৃদে জ্বলন্ত বিশ্বাস হে,
জ্বালি দিয়ে দিনবন্ধু পুরাও মনের আশ,
আমি নিশিদিন প্রেমানন্দ মগন হইয়ে হে।
আপনারে ভুলে যাব তোমারে পাইয়ে হে ৷৷
(সেদিন কবে হবে) ৷৷
“আনন্দ অমৃতরূপে” এই কথা বলিতে না বলিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হইলেন! আসীন হইয়া করজোড়ে বসিয়া আছেন। পূর্বাস্য। দেহ উন্নত। আনন্দময়ীর রূপসাগরে নিমগ্ন হইয়াছেন! লোকবাহ্য একেবারেই নাই। শ্বাস বহিছে কি না বহিছে! স্পন্দনহীন! নিমেষশূন্য। চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। যেন এ-রাজ্য ছাড়িয়া কোথায় গিয়াছেন।