পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ২১শে জুলাই
যদু মল্লিকের বাড়ি — সিংহবাহিনী সম্মুখে — ‘সমাধিমন্দিরে’
অধরের বাটিতে অধর ঠাকুরকে ফলমূল মিষ্টান্নাদি দিয়া সেবা করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, আজ যদু মল্লিকের বাড়ি যাইতে হইবে।
ঠাকুর যদু মল্লিকের বাটী আসিয়াছেন। আজ আষাঢ় কৃষ্ণ প্রতিপদ, রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী। যে-ঘরে ৺সিংহবাহিনীর নিত্যসেবা হইতেছে ঠাকুর সেই ঘরে ভক্তসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মা সচন্দন পুষ্প ও পুষ্প-মালা দ্বারা অর্চিত হইয়া অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছেন। সম্মুখে পুরোহিত উপবিষ্ট। প্রতিমার সম্মুখে ঘরে আলো জ্বলিতেছে। সাঙ্গোপাঙ্গের মধ্যে একজনকে ঠাকুর টাকা দিয়া প্রণাম করিতে বলিলেন; কেননা ঠাকুরের কাছে আসিলে কিছু প্রণামী দিতে হয়।
ঠাকুর সিংহবাহিনীর সম্মুখে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। পশ্চাতে ভক্তগণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।
ঠাকুর অনেকক্ষণ ধরিয়া দর্শন করিতেছেন।
কি আশ্চর্য, দর্শন করিতে করিতে একেবারে সমাধিস্থ। প্রস্তরমূর্তির ন্যায় নিস্তব্ধভাবে দণ্ডায়মান। নয়ন পলকশূন্য!
অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। সমাধি ভঙ্গ হইল। যেন নেশায় মাতোয়ারা হইয়া বলিতেছেন, মা, আসি গো!
কিন্তু চলিতে পারিতেছেন না — সেই একভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।
তখন রামলালকে বলিতেছেন — “তুমি ওইটি গাও — তবে আমি ভাল হব।”
রামলাল গাহিতেছেন, ভুবন ভুলাইলি মা হরমোহিনী।
গান সমাপ্ত হইল।
এইবার ঠাকুর বৈঠকখানার দিকে আসিতেছেন — ভক্তসঙ্গে। আসিবার সময় মাঝে একবার বলিতেছেন, মা, আমার হৃদয়ে থাক মা।
শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক স্বজনসঙ্গে বৈঠকখানায় বসিয়া। ঠাকুর ভাবেই আছেন, আসিয়া গাহিতেছেন:
গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ করো না।
গান সমাপ্ত হইলে আবার ভাবোন্মত্ত হইয়া যদুকে বলিতেছেন, “কি বাবু, কি গাইব? ‘মা আমি কি আটাশে ছেলে’ — এই গানটি কি গাইব?” এই বলিয়া ঠাকুর গাহিতেছেন:
মা আমি কি আটাশে ছেলে।
আমি ভয় করিনে চোখ রাঙালে ৷৷
সম্পদ আমার ও রাঙাপদ শিব ধরেন যা হৃৎকমলে।
আমার বিষয় চাইতে গেলে বিড়ম্বনা কতই ছলে ৷৷
শিবের দলিল সই রেখেছি হৃদয়েতে তুলে।
এবার করব নালিশ নাথের আগে, ডিক্রি লর এক সওয়ালে ৷৷
জানাইব কেমন ছেলে মোকদ্দমায় দাঁড়াইলে।
যখন গুরুদত্ত দস্তাবিজ, গুজরাইব মিছিল চালে ৷৷
মায়ে-পোয়ে মোকদ্দমা, ধুম হবে রামপ্রসাদ বলে।
আমি ক্ষান্ত হব যখন আমায় শান্ত করে লবে কোলে ৷৷
ভাব একটু উপশম হইলে বলিতেছেন, “আমি মার প্রসাদ খাব।”
৺সিংহবাহিনীর প্রসাদ আনিয়া ঠাকুরকে দেওয়া হইল।
শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক বসিয়া আছেন। কাছে কেদারায় কতকগুলি বন্ধুবান্ধব বসিয়াছেন; তন্মধ্যে কতকগুলি মোসাহেবও আছেন।
যদু মল্লিকের দিকে সম্মুখ করিয়া ঠাকুর চেয়ারে বসিয়াছেন ও সহাস্যে কথা কহিতেছেন। ঠাকুরের সঙ্গী ভক্ত কেউ কেউ পাশের ঘরে, মাস্টার ও দুই একটি ভক্ত ঠাকুরের কাছে বসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আচ্ছা, তুমি ভাঁড় রাখ কেন?
যদু (সহাস্যে) — ভাঁড় হলেই বা, তুমি উদ্ধার করবে না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — গঙ্গা মদের কুপোকে পারে না!
[সত্যকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণ — “পুরুষের এককথা” ]
যদু ঠাকুরের কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, বাটীতে চন্ডীর গান দিবেন। অনেকদিন হইয়া গেল চন্ডীর গান কিন্তু হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কই গো, চন্ডীর গান?
যদু — নানা কাজ ছিল তাই এতদিন হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি! পুরুষ মানুষের এককথা!
“পুরুষ কি বাত, হাতি কি দাঁত।
“কেমন, পুরুষের এককথা, কি বল?”
যদু (সহাস্যে) — তা বটে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি হিসাবী লোক। অনেক হিসাব করে কাজ কর, — বামুনের গড্ডী খাবে কম, নাদবে বেশি, আর হুড়হুড় করে দুধ দেবে! (সকলের হাস্য)
ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ পরে যদুকে বলিতেছেন, বুঝেছি, তুমি রামজীবনপুরের শীলের মতো — আধখানা গরম, আধখানা ঠাণ্ডা। তোমার ঈশ্বরেতেও মন আছে, আবার সংসারেও মন আছে।
ঠাকুর দু-একটি ভক্তসঙ্গে যদুর বাটীতে ক্ষীর প্রসাদ, ফলমূল, মিষ্টান্নাদি খাইলেন। এইবারে ৺খেলাৎ ঘোষের বাড়ি যাইবেন।