১৬. হোসেন সাহেব লক্ষ্য করেছেন

হোসেন সাহেব লক্ষ্য করেছেন তিনি যখন খুব আনন্দে থাকেন তখনই বড় বড় নিরানন্দের ব্যাপারগুলি ঘটতে থাকে। মনে করা যাক, তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে তাঁর প্রিয় খাবার কই মাছের ঝোল খাচ্ছেন, হঠাৎ দেখা গেল ঝোলের ভেতর মরা একটা মাছি। মাছিটা শুরুতেই দেখেছিলেন, তখন ভেবেছেন পেয়াজের খোসা। শুরুতে পরীক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। আরাম করে বেশ কিছুক্ষণ খাওয়ার পর হঠাৎ চামচ দিয়ে সেই পেয়াজের খোসা পাতে নিয়ে দেখবেন–হাত-পা কুকড়ে একটা মরা মাছি পড়ে আছে। এতক্ষণ তিনি তাড়িয়ে তাড়িয়ে মৃত মাছির রসমািখানো ঝোল খাচ্ছিলেন।

সাজ্জাদের চাকরির পর তিনি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, পিতা হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন। এখন সত্যিকার অবসর জীবন শুরু করতে পারেন, তখনই দেখলেন সাজ্জাদ অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছে। এর মানে কি? তিনি ভেবেছেন ছুটি নিয়েছেন। শরীর খারাপ সেই জন্যে ছুটি। কারণ সাজ্জাদ এই কদিন ঘরেই আছে, কোথাও বের হচ্ছে না। শরীর খারাপ বলেই বের হচ্ছে না। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে তাঁর ভয়ভয় লাগছে। জিজ্ঞেস করবেন, সে বলে দেবে, অফিস আর ভাল লাগছে। না বাবা। এরচে না জিজ্ঞেস করাই ভাল। নীতুকে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, সাজ্জাদ অফিসে যাচ্ছে না কেন?

নীতু চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, আমি কি জানি?

তুই জিজ্ঞেস করিসনি?

আমি কেন জিজ্ঞেস করব? তুমি জিজ্ঞেস কর।

নীতু বেশ কিছুদিন থেকেই তার সঙ্গে ক্যাট ক্যাট করে কথা বলছে। তিনি বুঝতে পারছেন না–হঠাৎ করে তিনি কি সবার কাছে অপ্রিয় হয়ে গেলেন? সেদিন তথ্যমন্ত্রীর বাসায় গেলেন। তাঁর অনেক দিনের পরিচিত মানুষ। ভাবলেন, দেখা করা যাক। সেইজন্য সাক্ষাত। সাজ্জাদের চাকরির খবরটা দেবেন। নীতুর বিয়ে হচ্ছে সেই খবর দেবেন।

তথ্যমন্ত্রীর বাড়িভতি মানুষ। সবাই দর্শনপ্রার্থী। মন্ত্রীর পিএ বলল, কি জন্যে দেখা করতে এসেছেন? নাম-ঠিকানা এইসব একটা কাগজ লিখুন।

হোসেন সাহেব বললেন, কিছু লিখতে হবে না। তুমি গিয়ে বল, হোসেন আলি সাহেব এসেছেন। সেতাবগঞ্জের হোসেন আলি। আর কিছুই বলতে হবে না। নাম শুনলেই ছুঢ়তে ছুড়তে আসবে।

আপনাকে একটু বসতে হবে। ভেতরে এখন ভিজিটার আছে।

ঠিক আছে, বসলাম খানিকক্ষণ।

আপনার কোন কার্ড থাকলে দিন। ভেতরে পাঠিয়ে দেই।

আমার কোন কার্ড নেই। আমি তো আর ছুটকা-ফটিকা বিজনেস করি না যে কার্ড নিয়ে ঘুরব। হা হা হা।

কার্ড আজকাল শুধু বিজনেসম্যানরাই রাখেন না–সবাই রাখেন।

তুমি রাগ করছ নাকি বাবা? এম্নি বললাম, দেখি একটা কাগজ দাও, আমি নামঠিকানা লিখে দেই। কাগজটা দুলুর হাতে দেবে। ম্যাজিক দেখবে। তোমাদের মন্ত্রীর ডাকনাম দুলু। তোমরা বোধ হয় জান না।

পিএ গম্ভীর মুখে কাগজ এনে দিল। হোসেন সাহেব সেই কাগজে লিখলেন–

দুলু,
কেমন আছিস?
অনেক দিন খোঁজ নেই। খোঁজ নিতে এলাম।
হোসেন আলি

পিএ নিজেই কাগজ নিয়ে গেল। কিছুক্ষণের ভেতরই ফিরে এসে বলল, স্যার এখন খুব ব্যস্ত। আপনাকে কিছুদিন পরে আসতে বলেছেন।

হোসেন সাহেব কল্পনাও করেননি। এ জাতীয় ব্যাপার ঘটতে পারে। দুলু কি তাকে চিনতে পারেনি? চিঠিতে তিনি অবশ্যি সেতাবগঞ্জ লিখেননি। তার প্রয়োজন বোধ করেননি। নাকি দুলু লেখায় সে রাগ করেছে? রাগ করার তো কথা না।

হোসেন সাহেব লজ্জিত হয়ে বাসায় ফিরলেন। দুপুরে ভাত পর্যন্ত খেতে পারলেন না। ইদানীং তাঁকে ঘন ঘন লজ্জা পেতে হচ্ছে। সেদিন নীতুর কারণেও খুব লজ্জা পেলেন। যে ছেলেটির সঙ্গে নীতুর বিয়ে হচ্ছে তার কিছু ভাগ্নে-ভাগ্নি নীতুকে নিয়ে চায়নীজ খাবে। সব ঠিকঠাক করা আছে। হোসেন সাহেব নীতুকে টাকা দিয়ে দিলেন, খাওয়া-দাওয়ার পরে বিলটা যেন নীতু দেয়। নীতু টাকা নিল। বিকেলে সে হঠাৎ বলল, সে যাবে না। তার প্রচণ্ড মাথাধরা।

হোসেন সাহেব বললেন, মাথাধরার দুটা ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থোক। ব্যথা কমে যাবে। এখনো তো দেরি আছে। সাতটার সময় যাবি।

নীতু কঠিন মুখে বলল, আমি যাব না। বাবা। তুমি ওদের টেলিফোন করে জানিয়ে পাওঁ।

যাবি না কেন?

বললাম না মাথাব্যথা। তুমি এক্ষুণি ওদের টেলিফোন করে দাও।

টেলিফোনটা তুই কর। মাথাব্যথার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল।

না, আমি করতে পারব না। তুমি কর।

আমার করা কি ঠিক হবে?

অবশ্যই ঠিক হবে।

আমি টেলিফোন করলে ওরা নানানভাবে চাপাচাপি করতে থাকবে। তুমি করলে তোমাকে কিছু বলতে পারবে না।

হোসেন সাহেব টেলিফোন করলেন। মাথাব্যথার কথাটা তিনি বলতে পারলেন না। মাথাব্যথা মেয়েদের সহজ এক্সকিউজ। মাথাব্যথার জন্যে কেউ কোন প্রোগ্রামে যেতে পারছে না শুনলেই মনে হয় মিথ্যা কথা। কাজেই তিনি বললেন, নীতু আজ দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ পা মচকে পড়ে গেছে। পায়ে অসম্ভব ব্যথা। তিনি চিৎকার শুনে ভেবেছিলেন পা ভেঙেই গেছে। তবে আসলে ভাঙেনি। হলুদের পুলটিশ লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। সে তো কোনক্রমেই চায়নীজে যেতে পারবে না।

নীতুর কথাই ঠিক। ওরা আর চাপাচাপি করল না। তবে সন্ধ্যাবেল দল বেঁধে নীতুকে দেখতে চলে এল।

তিনি তখন বারান্দায় বসেছিলেন আর নীতু বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিল। কি ভয়ংকর লজ্জার কথা! সেই লজ্জা তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়ে নীতু তাদের সঙ্গে চায়নীজ খেতে চলে গেল। একা একা বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হল–কিছু কিছু মানুষের বোধহয় জন্মই হয় লজ্জা পাবার জন্যে। সারাজীবনে তিনি কতবার লজ্জা পেয়েছেন তার তালিকা তৈরি করলে সেই তালিকার জন্যে দশ-বারো দিস্তা কাগজ লাগার কথা। এর মধ্যে রাশিচক্রের কোন ব্যাপার আছে কি? জন্মতারিখ অনুসারে তিনি মীন রাশির জাতক। এই রাশিতে যাদের জন্ম তারা কি ক্রমাগতই লজ্জা পায়? রাশিচক্রের কিছু বইপত্র এনে পড়তে হয়। খবরের কাগজে রোজদিনকার রাশিফল ছাপা হয় তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, ভাল ভাল কথা কোনটাই মিলে না। কিন্তু খারাপ কথা সবই মিলে। এও এক রহস্য। এই রহস্য নিয়ে আতাহারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

আতাহারের সঙ্গে অনেকদিন হল বসা হচ্ছে না। বাবার মৃত্যুর পর সে এ বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। আর এলেও তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। আতাহারকে সান্তুনা দিয়ে তিনি যেসব কথা বলবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন তার কোনটিই এখনো বলা হয়নি। আত্যহারের জন্যে তিনি মৃত্যু-বিষয়ে বেশ পড়াশোনাও করেছেন। কোরআন শরীফ থেকে কিছু আয়াত টুকে রেখেছেন। সব গুছিয়ে বলতে হবে। মৃত্যুশোকে কাতর মানুষকে সান্ত্ৰনা দেয়া কঠিন কর্ম। কোরআন শরীফ থেকে তিনি রহস্যময় একটা আয়াত খুঁজে বের করেছেন। সবশেষে এই আয়াত নিয়েও কথাবার্তা বলা যাবে।

তিনি ঠিক করেছেন, আতাহারকে নিয়ে বাগানে চলে যাবেন। গাছের নিচে বেতের চেয়ার নিয়ে দুজন মুখোমুখি বসবেন। তিনি বলবেন, আতাহার শোন, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অনেক কিছু আছে। তার ভেতর সবচে রহস্যময় কথাগুলি শোন। সূরা আল-যুকারে বিয়াল্লিশ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন–

মরণ এলে আল্লাহ প্ৰাণ নেন,
যারা মারা যায় না তাদেরও, ওরা যখন ঘুমিয়ে থাকে।
তারপর যার জন্যে মৃত্যু অবধারিত করেছেন, তিনি তার প্রাণ রেখে দেন।
আর অপরদের এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফিরিয়ে দেন।
এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।

বুঝতে পারছি কিছু আতাহার–কি রহস্যময় কথা আল্লাহ পাক বলছেন। আল্লাহ যারা মারা যায় না। তাদের প্রাণও নেন যখন তারা ঘুমিয়ে থাকে। এর অর্থ কিছু বুঝতে পারছি? গভীরভাবে চিন্তা কর। গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখবে, সব পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। এই জগৎ, এই সংসার যে কি বিশাল মায়া আতাহার–আমরা তা বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না বলেই প্রিয়জনদের মৃত্যুতে কাতর হই। ব্যথিত হই। বরং আমাদের উল্টোটা হওয়া উচিত। মৃত্যু প্রসঙ্গে মহামতি বালজাকের একটা কথাও আমার খুব প্রিয়। তিনি তাঁর বিখ্যাত Le Pere Goriot গ্রন্থে বলেছেন–মৃত্যু আছে বলেই জীবন সুন্দর। মৃত্যু না থাকলে জীবনের মত কুৎসিত আর কিছু হত না।

আতাহারকে বলার জন্যে তিনি আরো অনেক তথ্য জোগাড় করে রেখেছেন। সে আসছে না। এই ছেলেটিকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তার দুঃসময়ে তিনি কিছু করতে পারছেন না, এটা দুঃখজনক ব্যাপার। তাঁর মনের খুবই গোপন বাসনা–নীত্র সঙ্গে আতাহারের বিয়ে হোক। একদিন তিনি স্বপ্নেও দেখেছেন। নীতুর বিয়ে হচ্ছে–বর আসতে দেরি করছে। সবাই চিন্তিত। গুজব শোনা যাচ্ছে–বর আসছে না। তিনি নিজে দুঃশ্চিন্তায় মারা যাচ্ছেন, এমন সময় আতাহারের সঙ্গে দেখা। সে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে বিয়ের গেট সাজাচ্ছে। তিনি আতাহারকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন–এরকম শুভদিনে তুমি লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বসে আছ? তোমার কি স্বাভাবিক বৃদ্ধিও নেই? আতাহার বলল, চাচা, আমার পায়জামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করতে দিয়েছি, এখনো আসেনি। গেট সাজানোর কাজটা শেষ করেই আমি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরব।

তিনি আরো রেগে গিয়ে বললেন, তুমি গেট নিয়ে ব্যস্ত আর এদিকে শুনছি। বর আসছে না। মেয়েরা কান্নাকাটি করছে।

আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, মেয়েরা কান্নকাটি করবে। কেন? আমিই তো কর। আমি আলাদা করে আসব কিভাবে? আমি তো এসেই আছি। এই সময় তীব্র ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর তিনি বুঝলেন যে, তার গভীর আনন্দ হচ্ছে। আনন্দে তাঁর চোখ পর্যন্ত ভিজে গেল। আর তখনি তার মনে হল এই বিয়ে সম্ভব না। আতাহার নীতুকে ছোটবোনের মত দেখে। তুই—তোকারি করে। নীতু তাকে ঠিক পছন্দও করে না। সব সময় কঠিন কঠিন কথা বলছে। তিনি অনেকবার নীতুকে বলতে শুনেছেন, রোজ রোজ মানুষের বাড়িতে এসে নাশতা খেতে আপনার লজ্জা লাগে না? সকালবেল ভিখিরীর মত এসে বসে থাকেন। ওদের সঙ্গে আপনার তফাৎ একটাই–ওরা থালা হাতে আসে, আপনি থালা ছাড়া আসেন।

যে ছেলের প্রতি নীতুর এরকম মনোভাব সেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ঠিক না। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি শ্ৰদ্ধাবোধ থাকা দরকার। একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধা করবে। তবেই না সংসার সুন্দর হবে। প্রথমে শ্রদ্ধা তারপর ভালবাসা।

এখন যে ছেলেটির সঙ্গে নীতুর বিয়ে হচ্ছে তার প্রতি নীতুর শুদ্ধাবোধ কতটুক তিনি জানেন না। জানতে পারলে ভাল হত। এইসব বিষয় নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে তার অস্বস্তি লাগে, তবু একদিন তিনি বলবেন। দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দেবেন। তিনি এটা নিয়ে ভাবছেন। গভীরভাবেই স্বভাবছেন।

হোসেন সাহেব বাগানে হাঁটছিলেন। ঘাসগুলি অনেক বড় বড় হয়েছে। কাটা দরকার। মালি বাগানের দেখাশোনা কিছুই করছে না। বর্ষাকালে নাকি বাগানে হাত দিতে নেই। সব গাছ যে রকম আছে সেরকম রেখে দিতে হয়। গাছকে বিরক্ত না করে বর্ষার পানি খাওয়াতে হয়। বাগানের কাজ বর্ষার শেষে। মালির কথা তিনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না বুঝতে পারছেন না। তার কথাবার্তা খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না–তবে কথা খুব জোরালোভাবে বলে। হোসেন সাহেব লক্ষ্য করলেন, সাজ্জাদ বেরুচ্ছে। সন্ধ্যাবেলায় ছেলেমেয়েদের ঘর থেকে বের হতে দেখলে ভাল লাগে না। সন্ধ্যা ঘরে ফেরার সময়, ঘর থেকে বেরুবার সময় না। সাজ্জাদ। বাবার দিকে তাকাল। হোসেন সাহেব হাসলেন। এত দূর থেকে সাজ্জাদ তার হাসি দেখবে না, তারপরেও অভ্যাসবশে হাসলেন–বুঝানোর চেষ্টা করলেন, আছি, আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের সুসময়ে এবং দুঃসময়ে আছি। হোসেন সাহেব মনে মনে আশা করছিলেন সাজ্জাদ তাকে একা বাগানে হাঁটতে দেখে এগিয়ে আসবে। দুজনে কিছু কথাবার্তা বলবেন। কথা অনেক বড় ব্যাপার–মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয় কথায়। সাজ্জাদ গেটের কাছে চলে গিয়েছে। হোসেন সাহেবের ইচ্ছা করল গলা উচিয়ে ছেলেকে ডাকেন। সাজ্জাদ গেটের কাছে আরো কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত ডাকতেন। সে গেট খুলে দ্রুত বের হয়ে গেল।

নীতু বাসায় নেই। কোন এক বান্ধবীর জন্মদিনে নাকি গেছে। বান্ধবীর বাড়ি উত্তরায়। ফিরতে দেরি হবে। খুব বেশি দেরি হলে সে থেকে যাবে। কে জানে সাজ্জাদও হয়ত রাতে ফিরবে না। এতবড় বাড়িতে রাত কাটাতে হবে একা। আজকের দিনের রাশিফলে লিখেছিল, অপ্রত্যাশিত আনন্দের ঘটনা ঘটতে পারে। শরীরের প্রতি লক্ষ্য রাখুন। স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা।

অপ্রত্যাশিত আনন্দের কিছু এখনো ঘটেনি। সম্ভাবনা একেবারে যে শেষ হয়ে গেছে তা না। তিনি আতাহারকে আনার জন্যে গাড়ি পাঠিয়েছেন। বলে দিয়েছেন যত রােতই হোক গাড়ি আতাহারের জন্যে অপেক্ষা করবে। তাকে সাথে করে নিয়ে আসবে। অনেকদিন ছেলেটাকে দেখা যায় না। সে সন্ধ্যায় চলে এলে তাকে নিয়ে বাজারে যাবেন। নীতুর বিয়ের কার্ড পছন্দ করবেন। এবং আজ তিনি আতাহারকে দামী একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবেন। ছেলেটার দুটা মাত্র পাঞ্জাবি।

 

আতাহার বসে আছে মনসুর আলির বাড়ির বারান্দায়। তার সামনে চানাচুর এবং চা। চানাচুর দীর্ঘদিনের পুরানো, খেতে টক টক লাগছে। চায়ে চিনি-দুধের পরিমাণ বেশি, খেতে গরম লাচ্ছির মত লাগছে। আতাহার চানাচুর এবং চা। দুইই আগ্রহের সঙ্গে খাচ্ছে।

মনসুর আলি বাড়িতে নেই–সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছেন। বাড়িতে খবর দিয়ে গিয়েছেন–আতাহার এলে যেন বসতে বলা হয়। আর মনসুর আলি তাকে নিয়ে চিত্রনায়িকা মৌ-এর এপার্টমেন্ট হাউসে যাবেন। মৌ আজ সন্ধ্যার পর যেতে বলেছেন।

আতাহার ইস্ত্রি করা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। আসার আগে আয়নায় নিজেকে দেখেছে–নিজেকে নায়কের মতই লেগেছে। ভদ্র বিনয়ী মধ্যবিত্ত নায়ক এরকমই হওয়া উচিত। তবে জানি দুশমন ছবির নায়ক কেমন হওয়া উচিত কে জানে। নাম থেকে আন্দাজ করা যায় কংফু, কেরাতে পারদশী নায়ক। প্রয়োজনে সাব-মেশিনগান বের করে ট্যা ট্যা শব্দে গুলি চালাতে হবে। নায়িকাকে নিয়ে যখন-তখন পার্কে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গান ধরতে হবে–

ও আমার জন
তোমাকে দেখে আমার উড়ে গেছে প্ৰাণ
আ আ আ
উ উ উ।

এইসব জটিল প্রক্রিয়া শিখতে আতাহারের কোন আপত্তি নেই। বরং আগ্রহ আছে। সত্যি সত্যি ছবির জগতে নায়ক হয়ে গেলে কবিতা ছাপানো তার জন্যে সহজ হবে। কে জানে গনি সাহেব নিজেই হয়ত বাসায় চলে এসে বলবেন, এই যে নায়ক, বর্ষ শুরু সংখ্যার জন্যে কিছু দাও। বর্ষ শুরু সংখ্যায় তোমার কবিতা থাকবে না এটা কেমন কথা

প্রচুর ইন্টারভ্যু তখন ছাপা হবে। প্রশ্ন কর্তারা বিচিত্র সব প্রশ্ন করবে। তাদের প্রশ্নের বিচিত্ৰ উত্তর দেয়া যাবে। সেই সব সাক্ষাতকার বিশাল ছবিসহ ছাপা হবে।

প্রশ্ন : আতাহার ভাই, অভিনয় এবং কবিতা এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যমে আপনি কাজ করছেন–আপনার অনুভতি কি?

উত্তর : নিজেকে প্রথম শ্রেণীর গর্দভের মত লাগছে।

প্রশ্ন : আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না–একটু কি ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর : দুটি ভিন্ন মাধ্যমে কাজ করা মানে প্রচুর কাজ করা। প্রচণ্ড পরিশ্রম করা। গাধা। যা করে। সেই অর্থে বলেছি।

প্রশ্ন : আপনার প্রথম কবিতা লেখার অনুভূতি এবং প্রথম অভিনয়ের অনুভূতি সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?

উত্তর : একটিতে পেয়েছি সৃষ্টির অনুভূতি, অন্যটি অনাসৃষ্টির অনুভূতি।

প্রশ্ন : দয়া করে একটু যদি ব্যাখ্যা করেন।

উত্তর : ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আমার স্টুডিওতে যাবার সময় হয়ে গেছে। গাড়ি চলে এসেছে। অন্য একদিন আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে তারপর আসবেন। আমার ব্যস্ততা বুঝতেই পারছেন।

প্রশ্ন : অবশ্যই বঝতে পারছি। আপনি হচ্ছেন বাংলাদেশের সবচে ব্যস্ত নায়ক। যাবার আগে আপনি কি দয়া করে নয়া চিত্র ভুবনের পাঠকপাঠিকাদের জন্যে কোন বাণী দেবেন?

উত্তর : তোমরা ভাল হও। সুন্দর হও।

প্রশ্ন : খুব সুন্দর বলেছেন আতাহার ভাই। একটু যদি কষ্ট করে লিখে দেন তাহলে অফসেটে প্রিন্ট করে ছাপিয়ে দেব। পাঠক-পাঠিকারা স্বচক্ষে আপনার হাতের লেখা দেখবে। এই একটা বাড়তি পাওনা।

 

মনসুর আলি আতাহারকে সন্ধ্যা ছাঁটার আগেই আসতে বলেছেন। সে এসেছে সাড়ে পাঁচটায়। এখন প্রায় নটা বাজতে চলল। নাপিতকে দিয়ে তিনি যদি একটা একটা করে চুলও কাটান তাহলেও এত সময় লাগার কথা না। আতাহারকে দ্বিতীয় দফায় চা দেয়া হয়েছে। চায়ের সঙ্গে ক্রম বিসকিট। এবারের বিস্কিটগুলিও ভাল, চা-টাও ভাল। আরো ঘণ্টা দুই পরে যদি চা দেয় তাহলে দেখা যাবে সেই চা এর চেয়েও ভাল। চায়ের সঙ্গে নাশতাও ভাল।

মনসুর আলি সাহেবের একতলা বাড়িটা মফঃস্বলের বাড়ির মত। চারদিকে ফাঁকা। মূল বাড়ি থেকে বারান্দা বড় হয়ে এসেছে। শুধু মফঃস্বলের বারান্দায় এত মশা থাকে না–এই বারান্দায় হাজারে-বিজারে মশা। মনে হয় কাছেই কোথাও মশার চাষ হচ্ছে। উন্নত মানের মশা। যাদের শরীর স্বাস্থ্য এবং কামড়াবার শক্তি সবই উন্নত মানের।

বাড়ির ভেতর থেকে ন-দশ বছরের একটা ছেলে এসে বলল, চাচা, আপনি কি ভিতরে এসে বসবেন?

আতাহার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে এল। সে জানে মশারা এতে বিভ্রান্ত হবে না–তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে। তবু এক জায়গায় আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। হাতপায়ে ঝি-ঝি ধরেছে। বসার ঘরে কিছু ম্যাগাজিন বা বই-টই থাকতে পারে। বইম্যাগাজিন পড়ে যদি সময় কিছুটা কাটে। আতাহার ঠিক করে রেখেছে সে ঠিক এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, যাতে মনসুর আলি সাহেব পরবর্তী সময়ে তাকে বলতে না পারেন–আরে, তুমি হুট করে চলে যাবে? সামান্য দু-তিন মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না? তোমরা এত ব্যস্ত–ব্যস্ততার জন্যেই কিছু হয় না।

মনসুর আলি সাহেব এলেন রাত দশটা কুড়ি মিনিটে। আতাহারকে বসে থাকতে দেখে তিনি অবাকও হলেন না, অস্বস্তিও বোধ করলেন না। স্বাভাবিক গলায় বললেন, আতাহার শোন–আমার সঙ্গে ম্যাডামের কথা হয়েছে। উনার বাড়ি থেকেই এখন আসছি। ম্যাডাম এই রোল নতুন কাউকে দিতে চন না। পুরানো কাউকে দিয়ে করাতে চান। উনার পছন্দের একজন আছে, বুঝতেই পারছি, ম্যাডামের কথামত কাজ করতে হবে। ময়না ভাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। উনি হয়ত মনে করছেন আমি কোন চেষ্টা করিনি। এটা ঠিক না, চেষ্টা করেছি। তবে তোমার কথা মনে থাকবে। তুমি তোমার ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখে যাও। কোন ব্যবস্থা হলে খবর দেব।

চা-টা কিছু খেয়েছ আতাহার?

জ্বি।

মনসুর আলি গলা উচিয়ে ডাকলেন, কুহু, একটা কাগজ আর কলম দাও।

কুহু কাগজ আর বলপয়েন্ট দিয়ে গেল। সেই বলপয়েন্টে লেখা হয় না। আতাহার সেই কলমেই তার নাম-ঠিকানা লিখলা। কেউ পড়তে পারবে না। তাতে কি? তার লেখার কথা, সে লিখল। অদৃশ্য কালিতে নাম লিখে আতাহারের মনটা ভাল লাগছে। কেন লাগছে তা সে জানে না। সে হেঁটে হেঁটে রওনা হল হাসপাতালের দিকে।

আশ্চর্য, পথে নামতেই আতাহারের মাথায় পঙতি ওড়াউড়ি করতে লাগল। এরকম তো কখনো হয় না।

টেবিলের চারপাশে আমরা ছজন।
চারজন চারদিকেল দুজন কোনাকুনি
দাবার বোড়ের মত
খেলা শুরু হলেই একজন আরেকজনকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত।
আমরা চারজন শান্ত, শুধু দুজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে।
তাদের স্নায়ু টানটান।
বাড়ালের নখের মত তাদের হৃদয় থেকে
বেরিয়ে আসবে তীক্ষ্ণ নখ।
খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে,
আম্পায়ার এখনো আসেনি।
খেলার সরঞ্জাম একটা ধবধবে সাদা পাতা
আর একটা কলম।
কলমটা মিউজিক্যাল পিলো হাতে হাতে ঘুরবে
আমরা চারজন চারটে পদ লিখব।
শুধু যে দুজন নখ বের করে কোনাকুনি বসে আছে
তারা কিছু লিখবে না।
তারা তাদের নখ ধারালো করবে
লেখার মত সময় তাদের কোথায়?
প্রথম কলম পেয়েছি আমি,
আম্পায়ার এসে গেছেন।
পিস্তল আকাশের দিকে তাক করে তিনি বললেন
এ এক ভয়ংকর খেলা,
কবিতার রাশান রোলেট–
যিনি সবচে ভাল পদ লিখবেন
তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে।
আমার হাতের কলম কম্পমান
সবচে সুন্দর পদ এসে গেছে আমার মুঠোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *