১৬. স্কিতজোফ্রেনিয়া

১৬. স্কিতজোফ্রেনিয়া

শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটি সত্যি যে প্রতি একশত মানুষের মাঝে একজন স্কিতজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয়। একজন মানুষ যখন তার শৈশব শেষ করে যৌবনে প্রবেশ করে সাধারণত তখন এটি দিয়ে আক্রান্ত হয়। পুরুষ আর মহিলারা প্রায় সমান সমানভাবে আক্রান্ত হলেও একজন পুরুষ সাধারণত আগে এবং আরো কঠিনভাবে আক্রান্ত হয়। স্কিতজোফ্রেনিয়া নামটি কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সারা পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এটিতে ভুগছে। স্কিতজোফ্রেনিয়া শব্দটির অর্থ খণ্ডিত মন, একজনের মনকে খণ্ডিত করে কখনো কখনো দ্বৈত ব্যক্তিত্ব দেখা যায়–এটি সেই বিষয় নয়। এখানে খণ্ডিত মন বলতে বোঝানো হচ্ছে বাস্তব জগৎ থেকে মনকে খণ্ডিত করে নিয়ে আসা, যেখানে চিন্তা ভাবনাগুলো হয় এলোমেলো, পরিচিত জগৎটাকে মনে হয় দুর্বোধ্য এবং অনুভূতিগুলো হয় সঙ্গতিহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাকে প্রায় নিয়মিতভাবেই কোনো না কোনো ছাত্রছাত্রীর সাথে মুখোমুখি হতে হয়। যাদের মানসিক জগৎটুকু অন্যরকম, প্রায় সময়েই তারা অজানা আতঙ্কে ভুগে, বিনা কারণেই গভীর বিষাদে ডুবে থাকে, নিদ্রাহীন যন্ত্রণাকাতর রাত কাটায়। কাউকে কাউকে শুধুমাত্র বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করা যায়, কাউকে কাউকে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়, মানসিক চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হয়। আমি নিশ্চিত, সাহস করে আমাদের কাছে আসে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গভীর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে এরকম ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা খুব নয়। মানসিক বিষাদ, অস্থিরতা বা ডিপ্রেশন যদি সর্দি-কাশির সাথে তুলনা করি তাহলে স্কিতজোফ্রেনিয়া হচ্ছে ক্যান্সার বা এইডসের মতো ভয়াবহ একটা বিষয়।

এলোমেলো চিন্তার বিষয়টা একজন স্কিতজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষের কথা শুনলেই বোঝা যায়। তাদের কথাবার্তা হয় অসংলগ্ন, একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে কথার মাঝখানে তারা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করতে পারে। এমন কী একটা বাক্যের মাঝখানেই। আরেকটা বাক্য বলতে শুরু করে দেয়। সাধারণ মানুষের একটা অসাধারণ ক্ষমতা আছে যেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু আলাদা করে ভেবে দেখি নি। একটা ভিড়ের মাঝে যখন অনেক মানুষ কথা বলছে তার মাঝেও আমরা একটা নির্দিষ্ট মানুষের সাথে কথা বলতে পারি কারণ আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য মানুষের কথাবার্তার মাঝে থেকে শুধু নির্দিষ্ট মানুষের কথাটুকু বের করে আনতে পারে। দেখার মাঝেও সেটা হতে পারে, সামনে অনেক কিছু থাকলেও আমরা যেটা দেখতে পাই শুধু সেটার দিকে মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখতে পারি। যারা স্কিতজোফ্রেনিয়ায় ভুগে তারা অনেক সময় এটা করতে পারে না, নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তুচ্ছ একটা বিষয় তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে কাজেই তাদের চিন্তাগুলো হয়ে যায় পুরোপুরি অসংলগ্ন । আমরা যে রকম সহজে আমাদের চারপাশের ভুবনটুকু দেখতে পারি, শুনতে পারি বা অনুভব করতে পারি স্কিতজোফ্রেনিয়া সেরকম দেখতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারে না। তাদের শুধু যেটুকু দেখা, শোনা বা অনুভব করার কথা তার বাইরেও আরো অনেক জঞ্জাল দেখতে হয়, শুনতে হয় বা অনুভব করতে হয়।

স্কিতজোফ্রেনিকদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন অংশ সম্ভবত তাদের উপলব্ধির জগৎটুকু। চারপাশের অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় তথ্য তারা যে শুধু হেঁকে সরাতে পারে না তাই নয় একই সাথে তারা অনেক কিছু দেখে বা শুনে যেটা আসলে নেই। অদৃশ্য কেউ হয়তো অনবরত তাদেরকে কিছু একটা বলতে থাকে, সেটি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে যায় যখন সেই কণ্ঠস্বরটি তাকে নিষিদ্ধ কিছু করার জন্যে প্ররোচনা দিতে থাকে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা কল্পনা করা কঠিন, আমরা মাঝে মাঝে যে দুঃস্বপ্ন দেখি এগুলো অনেকটা সেরকম। ঘুম থেকে জেগে উঠে আমরা সেই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে পারি, যারা স্কিতজোফ্রেনিয়াতে ভোগে তারা কখনো সেটা থেকে মুক্তি পায় না কারণ তারা সেটা দেখে জেগে থাকতেই।

স্কিতজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের অনুভূতিগুলোও হয় বিচিত্র। কারো মৃত্যু সংবাদের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা শুনে তারা হাসতে শুরু করে দিতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াও তারা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। আবার ঠিক তার উল্টোটাও ঘটতে পারে, জগৎ সংসারের আনন্দ-দুঃখ-বেদনার ঘটনাগুলো হয়তো তাদের স্পর্শ করে না। পুরোপুরি ঔদাসীন্যে তারা নিশ্চল হয়ে বসে থাকে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কেন স্কিতজোফ্রেনিয়া হয় সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন নি। ধারণা করা হয় একটি মাত্র বিষয়কে এর জন্যে দায়ী করা যাবে না। কেউ কেউ হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার চাপে রাতারাতি স্কিতজোফ্রেনিক হয়ে যায়, আবার অনেকের বেলায় সেটা ঘটে খুব ধীরে ধীরে। যদি হঠাৎ করে কেউ স্কিতজোফ্রেনিক হয়ে যায় তাহলে তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশি, ধীরে ধীরে সেটা ঘটলে তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসে। অনেক ধরনের ঘটনা বা পরিবেশের চাপে একজন মানুষ স্কিতজোফ্রেনিক হতে পারে কিন্তু ধারণা করা হয় তার মাঝে জেনিটিক ব্যাপারগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এরকম বিশ্বাসের পেছনে কারণ রয়েছে, আগেই বলা হয়েছে। প্রতি একশ জনের ভেতরে একজন স্কিতজোফ্রেনিক হতে পারে কিন্তু

পরিবারে বাবা-মা বা ভাইবোনদের স্কিতজোফ্রেনিয়া থাকলে সংখ্যাটি দশগুণ বেড়ে যায়, তখন দশ জনের ভেতর একজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া হতে পারে। যদি দুজন ভাইবোন যমজ হয় (যারা দেখতে এক রকম) তখন তাদের জিনগুলো হয় শতভাগ এক রকম, তখন একজন স্কিতজোফ্রেনিক হলে অন্যজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। শুধুমাত্র এই কারণ থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি যে নিশ্চয়ই আমাদের কোনো একটি জিন থাকে যেটি একজনকে স্কিতজোফ্রেনিক করে তুলতে পারে। বিজ্ঞানীরা সেই জিনটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু এখনো সেটি খুঁজে বের করতে পারেন নি।

তবে যে ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে যমজ ভাই বা যমজ বোনদের একজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া থাকলে অন্যদের স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার আশঙ্কা কিন্তু শতকরা একশ ভাগ নয়, এটি হচ্ছে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। যদি স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার আশঙ্কা শুধুমাত্র জেনিটিক হতো তাহলে যমজ ভাই বা বোনের একজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া হলে অন্যজনেরও নিশ্চিতভাবে স্কিতজোফ্রেনিয়া হয়ে যেত। সেটি হয় না–তার থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে একজন মানুষের স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার পেছনে তার পরিবেশ অনেকখানি দায়ী। সেই পরিবেশ একটি দেশ থেকে অন্য দেশে ভিন্ন বলে স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার আশঙ্কাও এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভিন্ন হতে পারে। আমাদের মতো দেশে খুব ভালো পরিসংখ্যান নেই, যেসব দেশে পরিসংখ্যান নেয়া হয় তাদের কিছু তথ্য 16.1 নং তালিকায় দেখানো হয়েছে, সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো দেশের পরিবেশ নিশ্চিতভাবেই অন্য কোননা দেশ থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন।

তালিকা : 16.1 স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার ঝুঁকি (শতাংশে)

 পরিবারে একজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া আছেযমজ ভাই/বোনদের একজনের স্কিতজোফ্রেনিয়া আছে
জাপান১৩৫০
ডেনমার্ক১০৪৩
ফিনল্যান্ড১০৪৭
জার্মানি৩০৬৫
যুক্তরাজ্য৪২

জন্মগতভাবে স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার কোনো একটি জিন নিয়ে বড় হবার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশ কোনো একজন মানুষকে এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে। পরিবেশ দূষণ নিশ্চিতভাবেই তার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যুক্তরাজ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল “হ্যাট নির্মাতার মতো পাগল” (Mad as a hatter), কারণ দেখা গিয়েছিল যারা হ্যাট তৈরি করে তাদের মাঝে এক ধরনের মানসিক রোগের জন্ম নেয়। আসল কারণটা বোঝা গেছে অনেক পরে, যখন জানা গেছে সেই হ্যাট নির্মাতারা ঠোঁট দিয়ে হ্যাটের কিনারাগুলো ভিজিয়ে নিত এবং সেখানে থাকত সিসা। কাজেই সিসা দিয়ে তাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে যেত। কাজেই এটা হয়তো খুবই স্বাভাবিক যে আমাদের পরিবেশে কোনো বিষাক্ত পদার্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের অজান্তে আমরা সেগুলো গ্রহণ করে আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদের মাঝে ঠেলে দিচ্ছি।

স্কিতজোফ্রেনিয়া মানসিক সমস্যাগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যা তাই সেটা নিয়ে গবেষণাও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি বের হয়েছে যেটা দিয়ে বাইরে থেকেই মস্তিষ্কের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা সম্ভব। দেখা গেছে একজন স্কিতজোফ্রেনিক মানুষ যখন অদৃশ্য কোনো মানুষের কণ্ঠ শোনে তখন তার মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশে তুমুল যজ্ঞদজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। স্কিতজোফ্রেনিক মানুষের মৃত্যুর পর তার মস্তিষ্কের টিস্যু বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সেখানে বিশেষ এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটারের জন্যে গ্রাহকের সংখ্যা ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ছয় গুণ বেশি। এই নিউরোট্রান্সমিটারের প্রভাব কমিয়ে দেবার ওষুধ দিয়ে অনেক সময়েই স্কিতজোফ্রেনিয়া আক্রান্তদের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

গর্ভবতী মায়েদের অসুখ-বিসুখের সাথেও স্কিতজোফ্রেনিয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। গর্ভ ধারণের পর মায়েদের ফ্লু হলে সেটা কোনোভাবে সন্তানদের স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়। চারপাশের পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে জানলেও ঠিক বিশেষ ধরনের একটা ঘটনা বা সামাজিক অবস্থা এরকম একটি বৈকল্য ঘটিয়ে দিতে পারে সে ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞানী এখনো একমত হন নি। ধারণা করা হয় সামগ্রিক একটা ব্যাপার এর জন্যে দায়ী, বিচ্ছিন্ন একটি বা দুটি বিষয় নয়।

আমাদের সবারই মাঝে মাঝে অকারণে মন খারাপ হয়। কখনো কখনো আমরা শুধু শুধু একজনকে কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ করি, কোনো কোনো সময় আমরা কিছু একটা বুঝতে ভুল করে ফেলি বা অসংলগ্ন কথা বলে ফেলি। কিন্তু আমরা কখনোই স্কিতজোফ্রেনিকদের ভয়ঙ্কর আতঙ্ক অনুভব করি না, কেউ একজন আমাদের খুন করে ফেলবে সেই ভয়ে অস্থির হয়ে যাই না বা অদৃশ্য কোনো মানুষ আমাদের সাথে কথা বলে না। কোনো দুঃসংবাদ শুনে আমরা আনন্দে অট্টহাসি শুরু করে দিই না। তাই দুর্ভাগা স্কিতজোফ্রেনিকদের জন্যে আমরা সবসময়েই গভীর এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করি–বিজ্ঞানীরা তাই এই রহস্যময় বিষয়টি বোঝার জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একবার সেটি বুঝে গেলে হয়তো সেটি অপসারণ করা যাবে, সেটাই আমাদের আশা।

তথ্যসূত্র : Psychology David G. Myers

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *