ষষ্ঠদশ অধ্যায় – সুফিচেতনা : মানবমিলনের উদারজমিন (Sufi Thought: A Liberal Ground for Universal Brotherhood)
সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
ইসলামে অনুসৃত একটি সর্বাধিক উদার মত সুফিবাদ। নৈতিক শৃঙ্খলা, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য কামনার্থে ইসলামে যে মরমী ভাবধারার উৎপত্তি হয় তাকেই সুফিবাদ বলা হয়। এটি একটি অরাজনৈতিক অধ্যাত্মবাদী দল যার প্রধান লক্ষ্য ছিল মুতাজিলা যুক্তিবাদ এবং গোঁড়া রক্ষণশীলদের অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের তীব্র প্রতিবাদ। নিগূঢ় অর্থে সুফিবাদ ইসলামের ধর্মীয় দর্শন যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐশ্বরিক সত্তার উপলব্ধি। ধর্মে যারা অধ্যাত্মবাদী তারা বিশ্ব চরাচরকে যিনি সত্য করে নিত্য প্রকাশমান সেই স্রষ্টাকে সহজে জানতে ও তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের আত্মার মধ্যে গোচরে ও অগোচরে সর্বক্ষণ কাজ করছে এক মিলন প্রত্যাশা। এই মিলন প্রত্যাশাই হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ— যার ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। ইসলাম ধর্মে একে বলা হয় ‘সুফি মতবাদ’; হিন্দু ধর্মে বলা হয় ‘ব্রহ্মবাদ- ভক্তিবাদ’ ও ‘মরমীবাদ’। খ্রিষ্টধর্মে ‘Mysticism,’ শিখ ধর্মে ‘অদ্বৈতবাদ, ইহুদী ধর্মে ‘কাব্বালা,’ বৌদ্ধধর্মে ‘বোধিত্ত্ব,’ তাও ধর্মে ‘সর্বোত্যাগবাদ’ এবং জোরাস্ট্রানিজমে বলা হয় ‘আশা’ ইত্যাদি।
অনেকে বলেছেন গ্রিক philosophos (প্রজ্ঞাপ্রিয়) শব্দের আরবি অপভ্রংশ ‘ফয়সূফ্’। ফয়সূফ্ (দার্শনিক) থেকেই সুফি শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এ ধারণায় বিশ্বাসীগণ মনে করেন, যেসব মুসলমান ইসলাম ধর্মের দর্শনসম্মত ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের জীবনকে অনুরূপভাবে পরিচালিত করেন তাঁরাই সুফি।
সুফি মতবাদ দর্শন কীভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল, সে বিষয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। নিকলসনের মতে, নিও-প্লোটানিজম থেকে সুফি মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। এটি ‘সুফি’ (সূরা ১৬ : ৮৬) অথবা পশম অর্থাৎ অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, আল-ই- সুফফা অর্থাৎ মদিনা মসজিদে বসবাসকারী সাহাবীগণ, বেদুঈন গোত্র বানু সুফফা, সাফানা নামক এক প্রকার সব্জি সাফওয়াদ-আল-কিফা, অর্থাৎ ঘাড়ের সন্নিকটে, একগুচ্ছ চুল, সর্বোপরি সফিস্ট (Sophist) নামধারী গ্রিক দার্শনিক গোষ্ঠী। সুফিদের মতে, ‘সাফা’ অর্থাৎ পবিত্রতা এবং আত্মার শুদ্ধি থেকে সুফি কথাটির উৎপত্তি। ই.জি. ব্রাউনের মতে বস্তুবাদী সেমেটিক ইসলাম ধর্ম ইরানের ভাবপ্রবণ আর্যদের মানস হৃদয়ে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তারই স্থানিক রূপ হচ্ছে সুফিমতবাদ দর্শন।
সুফি ভাবনার সঙ্গে খ্রিষ্টান মরমিয়াবাদ, জোরাস্টারবাদ, বৌদ্ধ ও ভারতীয় বৈদান্তিক দর্শনের প্রভাবের কারণ অনুসন্ধানে এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, ‘প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগ আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। কেননা শরিয়তভিত্তিক ইসলাম একটি লজিক্যাল ধর্ম— যার আওতার মধ্যে রহস্যবাদ কখনই স্থান পায় নি।
যেমন ইসলামে বলা হয়েছে, হজরত মহম্মদ (স.)-এর সঙ্গে মে’রাজে যখন আল্লাহর দিদার লাভ ঘটেছিল তখন আল্লাহ্র সঙ্গে তাঁর ইলমে তাসাউফ সম্পর্কিত নব্বই হাজার গূঢ় কথা হয়েছিল। সেই গূঢ় নব্বই হাজার কথার মধ্যে তিরিশ হাজার কথা প্রকাশ্য যা কোরানের তিরিশ পারাতে প্রকাশিত। বাকি ষাট হাজার কথা তিনি আল্লাহরই নির্দেশে গোপন রেখেছিলেন। (বোখারি শরিফ, ১ম খণ্ড)। এই প্রকাশ্য কথাগুলিকে বলা হয় ‘জাহের’ এবং গোপন কথাগুলিকে বলা হয় ‘বাতেন’। এই ষাট হাজার বাতুন কথা নিয়েই ইসলামে সৃষ্টি হয়েছে মরমি অধ্যাত্মবাদ। এই অধ্যাত্মবাদের রহস্যঅনুসন্ধানের নিরন্তর সাধনাই সুফিবাদের মূল লক্ষ্য। আর সুফিরাও বলেন, সেই ষাট হাজার বাতুন কথা নিয়েই তাঁরা স্রষ্টা ও সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন করতে চান। সেই রহস্য কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। যে বোঝে, সে বলে না, যে বলে, সে বোঝে না।
তাই ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হলে সাধকের সাধনার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতায় অন্তরায় সৃষ্টি করে। এই অন্তরায়ের বিড়ম্বনায় অতিষ্ঠ হয়ে আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮ খ্রি.) খেদোক্তি করে বলেছেন : ‘মৌলবীদের আমার সালাম জানিয়ে বলো, ‘কুরআনের যে ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে, তাতে আল্লাহ্, রাসূল ও জিবরাইল তাজ্জব বনে গেছেন’। প্রকৃতপক্ষে ধর্মবাণীর আক্ষরিক অর্থ অনুসরণই অজ্ঞতা, আর সেই অজ্ঞতাকে যথার্থ বলে চালিয়ে দেওয়া মূর্খতা।
আমাদের ধর্মীয় কূটাভ্যাস বা জটিলতাবোধের অনেকখানি আমাদের সীমিত দৃষ্টির ফল। এক্ষেত্রে আমাদের সহানুভূতি প্রসারিত করতে পারলে আমাদের ধর্মচিন্তাকে বর্তমানে প্রচলিত ক্ষুদ্র দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে নিবিষ্ট করতে পারি। এ প্রসঙ্গে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অন্যতম পুরোধা পুরুষ ম্যাক্সমূলারের (১৮২৩-১৯০০ খ্রি.) উক্তি হল : যে মাত্র একটি বিষয় জানে, প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই জানে না (One who knows one thing he knows nothing)। আর বহু ভাষাবিদ দার্শনিক কবি গ্যেটের (১৭৪৯-১৮৩২ খ্রি.) মন্তব্য হল: ‘যে একটি ভাষা জানে, সে কোন ভাষাই জানে না’ (One who knows only one language knows no language) — এসব উদ্ধৃতির উদ্দেশ্য হল যিনি সর্বধর্মী সমন্বয়ী সাধক তাঁর অধ্যাত্ম জীবনে এরকম বহুবিষয় এবং বহুভাষিক উপলব্ধিবোধের অনুধাবন ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। এই অর্জন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সামান্যই অর্জিত হয়। বিশেষত মৌলিক জ্ঞান তো নয়ই। কেননা ধর্মতাত্ত্বিক সূত্র (Theological Theory) অনুযায়ী এ জগতে মানুষ চারভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ১. ইলমে তাসাউফ (অধ্যাত্ম সাধনায় অর্জিত জ্ঞান) ২. ইলমে সফর (ভ্রমণের মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞান), ৩. ইলমে সোহবত (সান্নিধ্যের মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞান) এবং ৪. ইলমে কিতাব (বই পড়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞান)। এই চতুর্থ ধাপের শিক্ষায় আবার দুটি ধারা আছে- ক. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া এবং খ. আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। অর্থাৎ সকল সনদধারী শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এই চতুর্থ শ্রেণির বা চার-এর খ ধাপের শিক্ষিত।
শেখ মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবির (১১৬৫-১২৪০ খ্রি.) মতে জ্ঞান তিন প্রকার: ক. প্রত্যক্ষণলব্ধ জ্ঞান, খ. বৌদ্ধিক জ্ঞান ও গ. স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান। ইবনুল আরাবী রচিত ওয়াহদাতুল ওজুদ ও ওয়াহদাতুশ শহুদ শীর্ষক তাসাউফ সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থে আল্লাহ্র সত্তার প্রধানত তিনটি ধারণা দিয়েছেন— ক. ইজাদিয়া (আল্লাহ্র অস্তিত্বের মধ্যেই এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে), খ. শহুদিয়া (বিশ্বজগৎ সব কিছুই আল্লাহ্র মহিমার প্রকাশ) ও গ. ওয়াজুদিয়া (সমগ্র বিশ্বজগৎ ব্যাপীয়া একটিমাত্র সত্তাই বিরাজমান)।
নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে সর্বপ্রথম ‘সুফি’ শব্দটি একটি দরবেশ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে আরবি সাহিত্যে ব্যবহৃত হয় এবং প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক জাবির-ইবনে- হাইয়ান প্রথম এই ‘সুফী” উপাধিতে আখ্যায়িত হন। সুফিবাদের উন্মেষের মূলে ছিল ১. উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ; ২. সুন্নী মাযহাবের প্রভাব; ৩. মুতাজিলাদের যুক্তিবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ; ৪. মুতাজিলা এবং অংশীবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব; ৫. মুসলমানদের বিলাস-বাসন ও অতুলনীয় বৈভব। সুফিবাদের প্রধান প্রবক্তা আবু-সুলাইমান-আদ-দারানী হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মারুফ-আল- কারখী। সুফিবাদের উৎস এবং প্রভাব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের দ্বিমত রয়েছে; ক. ইসলামী ভাবধারার প্রভাব; খ. অনৈসলামিক ভাবধারার প্রভাব।
কুরআন এবং হাদিস সুফিবাদের প্রধান উৎস। কুরআনে অতীন্দ্রিয়বাদী আয়াতের উল্লেখ আছে: ‘আল্লাহ্ মানুষের ঘাড়ের রগ (হাব-লুল-ওয়ারিদ) অপেক্ষা নিকটবর্তী।’ এর মূল তাৎপর্য আল্লাহ্ সর্বজ্ঞানী এবং সর্বত্র বিরাজমান। মানুষ তাসাউফ বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লার এই স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোরআন-এ উন্মোচিত হয়েছে এভাবে: ‘ফাজকুরুনী আজকুরুকুম’ (২:১৫২)– অর্থাৎ ‘যদি তোমরা আমাকে স্মরণ করো তবে আমিও তোমাদের স্মরণ করবো।’ সুফি মতে ‘মান আরাফা নাফছাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’- অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেকে চিনেছে সে ব্যক্তি তার প্রভুকে চিনেছে। এই আত্মদর্শনই সুফিতত্ত্বের মূলকথা। হাদিস-ই-কুদসীতে বর্ণিত আছে ‘আমি একটি গুপ্তধন (Hidden Treasure) এবং আমি চাই যে, আমাকে সকলে জানুক; সে হেতু আমি সৃষ্টি করেছি যাতে আমাকে সকলে জানতে পারে।’ রাসূলে করীম বলেছেন, যে আমাকে (রাসূলকে) জানে সে আল্লাহকেও জানে।
সুফিবাদের ক্রমবিকাশে বিভিন্ন বাহ্যিক ও অনৈসলামিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ সুফিবাদের গতিধারা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে সুফিবাদের বৈদেশিক প্রভাব মোটেই ছিল না। ইসলামী সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিসরে মুসলমানগণ খ্রিষ্টান ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসে এবং তাদের মাধ্যমে তপস্যা ও সংযমবাদ ( Monasticism – Skepticism) এবং অতীন্দ্রিয়বাদ (Mysticism) সুফিবাদে অনুপ্রবেশ করে। সন্ন্যাসধর্ম ইসলামে অনুমোদিত না হলেও মরমীবাদের (মারেফাত) উন্মেষে খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সুফিবাদের দ্বিতীয় প্রভাব হচ্ছে নিওপ্লেটোনিজম। এরিস্টটল এবং প্লেটোর গ্রন্থাদি আরবিতে অনূদিত হলে গ্রিক ভাবধারা সুফিবাদ মুসলিম চিন্তাধারায় অনুপ্রবেশ করে এবং এর ফলে সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) গুপ্ত আধ্যাত্মিক ভাবধারা (Mysticism) নির্গমন (Emanation), স্বর্গীয় জ্যোতিতে আলোকিতকরণ (Illumination) এবং মোহান্বিত অবস্থার (Ecstacy) উদ্ভব হয়। জুন-নূন-আল- মিসরী সুফি আধ্যাত্মিকবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন এবং তাঁর শিষ্য বাগদাদের আল-জুনাইদ হেলেনিস্টিক প্রভাবে আল্লাহ্র সাথে মানবাত্মার সংযোগ স্থাপনের সাধন-পদ্ধতির সুষ্ঠু রূপ দান করেন। জুন-নূন-জাগতিক জ্ঞানের (ইলম) পরিবর্তে মারেফাত দ্বারা স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ এবং মারেফাতকে মুহাব্বত অর্থাৎ আল্লাহ্- প্রেমের সঙ্গে সংযুক্ত করে সুফিবাদকে সুদূরপ্রসারী করেন।
সুফিবাদের তৃতীয় উৎস হচ্ছে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব। নিকলসনের মতে, ‘নীতিশাস্ত্র সম্বন্ধীয় আত্মশুদ্ধি, সাধনা এবং বুদ্ধিবৃত্তি-সংক্রান্ত চিত্তবিক্ষেপ হিসাবে সুফি পদ্ধতি বৌদ্ধ ধর্মের নিকট অনেকাংশে ঋণী।’ মরমীবাদের ‘ফানা’ (অন্তর্ধান) বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ এবং হিন্দু বেদান্তের সর্বেশ্বরবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত। প্রথম যুগে ভারতীয় দর্শন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কারণ, দশম-একাদশ শতাব্দীতে আল-বেরুনী হিন্দু-দর্শন ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। উপরন্তু, ‘ফানা’ এবং নির্বাণের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য এই যে, নির্বাণ পদ্ধতিতে আত্মা স্বীয় স্বকীয়তা হারিয়ে একটি বিশাল নিশ্চলতায় রূপান্তরিত হয় পরমেশ্বরের সাধনায়, কিন্তু ‘ফানা’-রীতিতে আত্মা স্বীয় স্বকীয়তা হারিয়ে নির্লিপ্ত থাকে না; বরং নিগূঢ় আধ্যাত্মিক সাধনা দ্বারা অবিনশ্বরতা লাভ করে ও চিরজীবন্ত আল্লাহ্র সান্নিধ্য কামনা করে। এই সান্নিধ্যকে ‘বাক্বা’ অর্থাৎ সুফিদের আত্মার সাথে সর্বজনীন স্রষ্টার আত্মার সংমিশ্রণ বলে।
সুফিবাদের ক্রমবিকাশে পারস্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এই প্রভাব প্ৰাক্- মুসলিম পারস্যের মানী এবং অগ্নি-উপাসক নামক দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করে। প্রথম যুগে না হলেও পরবর্তীকালে ‘সর্বেশ্বরবাদ’ এর (Pantheism) উন্মেষে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন নিগূঢ় আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী সুফিসাধকগণ ঈশ্বর-প্রেম ভিত্তিক সুফিবাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন।
পরবর্তীকালে বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে, সুফিবাদের প্রথম সোপান রচনা করে কুরআন এবং হাদিস। কুরআনে সুফির বহুবচন আসওয়াফ শব্দটি রয়েছে (১৬ : ৮৬)। ‘আল্লাহ্-প্রেমে যারা বিশ্বাসী তাদের আল্লাহ্র জন্য অশেষ ভালবাসা রয়েছে।’ (২ : ১৬৫) জুনাইদ বোগদাদী, হজরত আবদুল কাদের জিলানী ও মৌলানা রুমির মতে, ইসলামের প্রেরণায় সুফিবাদের উন্মেষ হয়েছে।
সুফিবাদের ক্রমবিকাশকে দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায়; যথা— ‘ইনকিশাফী’ অর্থাৎ রক্ষণশীল পর্যায় যখন ইসলামের আদর্শ ও ভাবধারার মাঝে গোঁড়া সংযমপন্থিগণ ভক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক প্রশান্তির অনুসারী ছিল। তখন এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (র.) ও হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.)। দ্বিতীয় পর্যায়কে বলা হয়, ‘ইসতিদলালী’ অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন। অনৈসলামিক উপাদান পুষ্ট হলেও সুফিবাদের মৌলিকত্ব বিনষ্ট হয়নি এবং এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন জালালউদ্দীন রুমি, ইবন-উল-আরাবী প্রমুখ মনীষী। সুফিবাদের ক্রমবিকাশ চারটি সুনির্ধারিত স্তর রয়েছে। যেমন— গোঁড়া সংযমপন্থী, মরমীবাদ, ব্রহ্ম অথবা দিব্যজ্ঞানপন্থী এবং সর্বেশ্বরবাদ।
আরবেরীর মতে, প্রথম সুফি সাধকগণ প্রকৃতপক্ষে মরমীবাদের স্থলে ছিলেন সংযম ও সংসারত্যাগী এবং মানসিক প্রশান্তির অধিকারী। হেরা পর্বতে রাসূলে করীম (স.)-এর দিব্য-সাধনা, মিরাজে আল্লাহ্র দীদার লাভের সৌভাগ্য এবং তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপন প্রণালী সাহাবীদের প্রভাবান্বিত করে। গোল্ডজিহরের মতে, প্রধানত দু’টি কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে রক্ষণশীল সংযমবাদের উন্মেষ হয়। প্রথমত, পাপকার্যের সচেতনতা এবং দ্বিতীয়, দুষ্কর্মের জন্য পরকালের শাস্তি। আবুজর আল-গিফারী, জাবির ইবন-হাইয়ান, হাসান আল-বসরী এবং রাবেয়া বসরী এই সম্প্রদায়ভুক্ত। ইব্রাহিম-ইবন-আদহাম ‘জুহদ’ অর্থাৎ প্রশান্তিময় সন্ন্যাসব্রত প্রবর্তন করেন।
হিট্টির মতে, ‘খ্রিষ্টান এবং হেলেনিস্টিক ভাবধারার প্রভাবে মুসলিম সংযত দ্বিতীয় মুসলিম শতাব্দীতে মরমীবাদীতে রূপান্তরিত হয়’। উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের অধার্মিক কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই গোষ্ঠী আত্মার শুদ্ধির জন্য ‘ইসলামের’ পরিবর্তে ‘মারফাত’ দ্বারা আল্লাহ্র সম্যক জ্ঞান ও তাঁর সান্নিধ্য (‘নূর- ই-ইলাহী’) কামনা করে। ইসলামে সন্ন্যাসব্রত (রাহবানিয়া) না থাকলেও আবুল হাসান রামলাতে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আবু সুলায়মান আল-দারানী সর্বপ্রথম নিওপ্লেটোনিজমের প্রভাবে বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা ঐশ্বরিক জ্যোতির সন্ধানের (Gnosis) নীতির প্রবর্তন করেন। ‘আল্লাহ্র প্রেমে মগ্ন মানুষ’ মারুফ আল-কারখী মরমীবাদকে ‘আল্লাহ্র অস্তিত্বে অনুধাবন’ বলে ব্যাখ্যা করেন।
মারুফ-আল-কারখী সুফিবাদের প্রেমের উপাদান প্রচলিত করেন এবং এর ফলে পরবর্তীকালে বৈদেশিক প্রভাবে ব্রহ্ম অথবা দিব্যজ্ঞান সাধনার পদ্ধতির উন্মেষ হয়। রক্ষণশীল সন্ন্যাসব্রত (Orthodox ascetics) সুফিবাদ যেমন, ‘ইলম- উল-কুতুব (‘আত্মার জ্ঞান)’ মরমীবাদিগণ (Mystics) যেমন ‘জুহদের’ পরিবর্তে ‘মারেফাত’ প্রচলন করেন অনুরূপ ব্রহ্মজ্ঞানীরাও ‘ওয়াজদ্’ (Wajd) অর্থাৎ আল্লাহ্র জ্ঞান সান্নিধ্যলাভের জন্য মোহান্বিত অবস্থার প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতির উদ্ভাবক ছিলেন প্রখ্যাত সাধক জুন-নূন-আল-মিসরী (মৃ. ৬৬০ খ্রি.)। তিনি বলেন যে, আল্লাহ্র সাথে যে একাত্ম হয়ে গিয়ে একমাত্র তিনিই স্রষ্টাকে জানেন। তিনি দিব্যজ্ঞান-সাধক পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম সুষ্ঠু এবং সর্বাঙ্গীন রূপ দান করেন।
সর্বেশ্বরবাদ সুফি মতবাদ ক্রমবিকাশের চতুর্থ পর্যায় বলে পরিগণিত। জুন- নূনের-ব্রহ্ম অথবা দিব্যজ্ঞান সাধনার পদ্ধতি (ওয়াজুদ্) ব্যতীত সর্বেশ্বরবাদের উন্মেষ হতে পারত না। হিট্টি বলেন যে, সর্বেশ্বরবাদের আবির্ভাবে ইন্দো-ইরানী প্রভাব প্রকট ছিল। প্রকৃতপক্ষে সর্বেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বায়োজিদ-আল- বোস্তামী। পারস্যবাসী বায়োজিদ সর্বপ্রথম ‘ফানা’ অর্থাৎ লয় নীতি ভারতীয় নির্বাণ পদ্ধতির প্রভাবে প্রচলিত করেন। এর অর্থ ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে সমস্ত অশুভ, অকৃত্রিম এবং কুচিন্তার ধ্বংসসাধন করা। নির্বাণের সাথে এর পার্থক্য এই যে, ‘ফানা’ অথবা আত্মশুদ্ধিতে মোক্ষলাভ হয় না। এরপর ‘বাকা’র স্তর অর্থাৎ সাধক- প্রেমিকের আত্মা স্রষ্টার আত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই ধারণার বশবর্তী এর পারস্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক, প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদী নেতা মনসুর আল-হাল্লাজ মোহান্বিত অবস্থায় ঘোষণা করেন যে, “আমিই সত্য’ অর্থাৎ ‘খোদা’ (‘আনাল হক’)। তাঁর মতে, মানুষ যেহেতু আল্লাহ্ সৃষ্টি, তাঁর প্রতিচ্ছবি এবং প্রতিনিধি, সেহেতু সে ঐশ্বরিক জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী। এইরূপে তিনি ঘৃণ্য ‘হুলুল’ (Hulul) অথবা ‘মানুষে আল্লাহ্র গুণাবলি আরোপ’ নীতি প্রবর্তন করেন। মনসুর আল-হাল্লাজের বিরুদ্ধবাদী অনৈসলামিক ধর্ম-দর্শন মতের জন্য ৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ফাঁসি হয়। তাকে ‘ক্রুশে’ বিদ্ধকরণের (Crucifixion) ফলে তিনি ‘সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি শহীদ’ বলে পরিগণিত। সর্বেশ্বরবাদ সুফি মতবাদের অনুসারী ইবন-আল-আরাবী (১১৬৫-১২৪০ খ্রি.) ‘ওয়াহাদাত-আল-ওয়াজুদ’(Wahadad- al-Wujud) অর্থাৎ ‘সত্তার একীকরণ’ নীতি উদ্ভাবন করেন এবং স্পেনে এটি প্রসারের প্রচেষ্টা চালান।
সতারীর মতে’ ‘সুফিদর্শন অনুযায়ী বাস্তবতা হচ্ছে সর্বজনীন ইচ্ছা, প্রকৃত জ্ঞান, চিরন্তন জ্যোতি এবং সর্বোত্তম সৌন্দর্য। এর ধর্ম হচ্ছে সর্বজনীন দর্পণে প্রতিফলিত আত্মপ্রকাশ।’ মরমী ও সর্বেশ্বরবাদ সুফিগণের মোক্ষলাভের প্রধান উপায় হচ্ছে ব্যক্তিগত আত্মাকে সর্বজনীন আত্মায় নিমগ্ন করা। সর্বজনীন আত্মাকে বলা হয় ‘হুসন’ (Husn) অথবা ‘সুন্দর’। অনন্তের (Infinite) মাঝে সসীমকে (Finite) সমাহিত করবার চারটি নির্ধারিত পথ রয়েছে; যথা— ১. ‘শরীয়ত’ অর্থাৎ শরীয়তের বিধি মোতাবেক তাকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত প্রভৃতি পালন করে মানসিক প্রস্তুতি এবং আধ্যাত্মিক শুদ্ধি লাভ করতে হবে; ২. ‘তরিকা’ অর্থাৎ পীর অথবা কোন সাধকের তত্ত্বাবধানে উচ্চমানের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকতে হবে। এর পর নির্দিষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করলে তাকে সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত করা হবে; ৩. তৃতীয় স্তরে হচ্ছে ‘মারেফত, এই স্তরে শিক্ষানবিস আল্লাহর জ্ঞান দ্বারা উদ্ভাসিত হয়; ৪. সর্বশেষ স্তর ‘হাকিকত’-এ স্তর সুফি-সাধক স্বীয় ‘মোক্ষ’ অর্জন করতে সক্ষম হন। এ স্তরকে ‘ফানা ফীল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ্র ভিতরে আত্মবিলুপ্তি বলা হয়। শৃঙ্খলা, আল্লাহ্ ভক্তি, অনুরাগ, সৎকর্ম এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এটি অর্জন করা যায়। আল্লাহ্র সান্নিধ্যলাভের আশায় তারা ‘জিকির’ এবং মোহান্বিত- নৃত্য ও মৌলানা রুমি প্রবর্তিত দরবেশ-নৃত্য করেন। মরমীবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত পারস্যের সুফিসাধকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ফরিদুদ্দিন আত্তার, মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি (মসনবী খ্যাত), ওমর খৈয়াম, জা’মী. হাফিজ, সা’দী প্রমুখ সুফি ব্যক্তিত্ব।
খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে সুফি মতবাদ বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। আধ্যাত্মিক সচেতনতায় পুষ্ট এই গোষ্ঠীগুলো হচ্ছে—১. কাদেরিয়া, ২. নাখশাবন্দিয়া, ৩. সাত্তারীয়া, ৪. চিশতীয়া, ৫. সেনুশিয়া, ৬. রিফা, ৭. মৌলভী বা নৃত্যরত দরবেশ দল।
১. কাদেরিয়া : ইরানের জিলান বা গিলান শহরে জন্মগ্রহণকারী হজরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (র.) কাদেরিয়া সুফি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। বাগদাদে জুনায়েদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সুফি আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবদুল কাদের এই মতবাদ প্রচলিত করেন। তিনি সুন্নী জামাতের কাছে গোঁড়াপন্থী মাযহাবের পৃষ্ঠপোষক হজরত বড় পীর হিসেবে শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তিনি আধ্যাত্মিকতার মারেফত উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন। বাগদাদে তাঁর সমাধি রয়েছে। ভারতবর্ষের মুসলমানগণ কাদেরিয়া গোষ্ঠীভুক্ত।
২. নাখশাবন্দিয়া : এই সুফি গোষ্ঠীর প্রবর্তন করেছেন খাজা বাহাউদ্দীন মুহম্মদ। তাঁর অনুসারীরা ভারতবর্ষ, চীন এবং তুরস্কে এসেছেন।
৩. সাত্তারীয়া : এই সুফি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আব্দুল্লাহ সাত্তার।
তাঁদের অনুসারীরা জাভা, সুমাত্রা ভারতবর্ষে রয়েছেন।
৪. চিশতীয়া : প্রখ্যাত সুফি সাধক চিশতীয়া খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী সুফি ভ্রাতৃত্ব সংঘের (Fraternity) প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর অনুসারীদের মূলত ভারতবর্ষে দেখা যাবে। তিনি আজমীরে সমাহিত।
৫. সেনুশিয়া : আলী-আস-সেনুশীর পুত্র শেখ মুহাম্মদ সেনুশিয়া (৮৩৭ খ্রি.) এই সুফি Order-এর প্রবর্তক। কাদেরিয়া গোষ্ঠীর সাথে এই সম্প্রদায়ের ধ্যান-ধারণার সাদৃশ্য রয়েছে। মূলত উত্তর আফ্রিকায় এই গোষ্ঠী বসবাস করে। এই গোষ্ঠী ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে।
৬. রিফা : এই গোষ্ঠীর প্রবর্তক হচ্ছেন আহমদ রিফা।
৭. মৌলভী বা নৃত্যরত দরবেশ: প্রখ্যাত সুফি-সাধক মাওলানা জালালউদ্দীন রুমি মৌলভী বা নৃত্যরত দরবেশ গোষ্ঠীর প্রবর্তন করেন। তিনি পারস্য বংশোদ্ভূত হলেও তুরস্কের রুম শহরে বসবাস করতেন। সেখানে তাঁর সমাধি রয়েছে। তিনি যিকিরের উদ্দেশ্যে গোল হয়ে দরবেশদের নিয়ে নৃত্য করতেন।
সুফিবাদকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করে যিনি সুষ্ঠু পদ্ধতিকরণ এবং পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন তিনি মুসলিম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং ধর্মসংস্কারক ইমাম-আল-গাজ্জালী। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ‘মানুষের আত্মা পরকালে মোহান্বিত অবস্থায় আল্লাহকে চাক্ষুষ দর্শন করতে পারবে’। আল- গাজ্জালীর দর্শন ও মতবাদ তাঁর ইহাইয়া-উলুম-আল-দীন (ধর্মীয় জ্ঞানের পুনর্বিন্যাস) গ্রন্থে রক্ষণশীল চিন্তাধারার প্রয়োগকে সুনিশ্চিত করেন। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল এই যে, তিনি দর্শনকে ধর্মতত্ত্বের আওতায় আনেন এবং অনৈসলামিক প্রভাব থেকে সুফিবাদকে রক্ষা করে ধর্মীয় বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেন।
সুফিবাদ ইসলামী ধর্ম ও সমাজ জীবনে একটি বিশেষ স্থান দখল করলেও বিভিন্ন কারণে ক্রমশ এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। নিম্নোক্ত কারণগুলি সুফিবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের মূলে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
১. শরীয়ত মোতাবেক ধর্মীয় অনুশাসনগুলি সুফি সাধকগণ পালন করতেন না; তারা ধ্যান-তপস্যা, মোহান্বিত অবস্থায় আরাধনার পক্ষপাতী ছিলেন।
২. প্রাথমিক সুফি গোষ্ঠীদের মধ্যে ‘জিকির’ আধ্যাত্মিক অনুশীলন প্রচলিত ছিল; এ কারণে একে বিদাত মনে করা হয়।
৩. সন্ন্যাসজীবন এবং সুফি সাধকদের জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলি অনৈসলামিক বলে বিবেচিত হয়।
৪. বেদান্ত, জরথুস্ত্র, মানির ধর্ম, নিওপ্লেটোনিজম এবং অপরাপর বৈদেশিক প্রভাবে প্রথম যুগের মৌলিক সুফি মতবাদকে বিনাশ করে।
৫. ইবন-আল-আরাবী এবং জালালুদ্দিন রুমির আবির্ভাবে পরবর্তীকালে সুফিবাদের ক্রমবিবর্তন রুদ্ধ হয়ে যায়।
৬. পরবর্তীকালে সুফিবাদ সাক্ষাৎ ব্রহ্মজ্ঞান (Theosophy) এবং সর্বেশ্বরবাদে রূপান্তরিত হলে একটি জনসাধারণের নিকট দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে—ফলে জনপ্রিয়তা হারায়।
৭. শিয়া সাফাভী বংশের অভ্যুত্থান এবং সামাজিক ও ধর্মীয় বিপ্লবের সূচনা। ৮. ওয়াহাবী, হাম্বলী এবং শিয়া সম্প্রদায়সমূহের তীব্র বিরোধিতা।
৯. রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সুফি সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র খিবা এবং বোখারা ধ্বংস।
১০. পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রচলন।
হজরত মুহম্মদ (স.) এর মৃত্যুর পর ইসলামের চার খলিফার সর্বশেষ হজরত আলীর (রা.) ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর দুই পুত্র হজরত হাসান ও হজরত হোসেনসহ (রা.) চারজনকে মনোনীত করেন। এদের মধ্যে দু’জন অর্থাৎ দুই পুত্রই কারবালা যুদ্ধে শহীদ হন। অপর দু’জন হচ্ছেন খাজা কামিল বিন জিয়াদ এবং বসরার খাজা হাসান। এই খাজা হাসানই হচ্ছেন সুফি মতবাদের প্রধান প্রবর্তক। এঁর দু’জন শিষ্য খাজা হাবিব আজমী এবং আবদুল ওয়াহিদ-বিন জাহেদ। পরবর্তীকালে এই দু’জনের সমর্থকরা সুফি মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে চৌদ্দটা সুফি উপ-মতবাদের প্রবর্তন করেন।
খাজা হাবিব আজমীকে কেন্দ্র করে যে ন’টি সুফি সংঘ প্রবর্তিত হয় তা হচ্ছে— ১. হাবিবী, ২. তায়ফুরী, ৩. কারখী, ৪. সাকাতী, ৫. জুনাইদী, ৬. কাজরুনী, ৭. তুসী, ৮. ফেরদৌসী এবং ৯. সোহরাওয়ার্দী। অন্যদিকে আবদুল ওয়াহিদ-বিন জাহেদকে কেন্দ্র করে পাঁচটি সংঘের সৃষ্টি হয়। এগুলো হচ্ছে— ১. আয়াদী, ২, আধামী, ৩. জায়দী, ৪. হুবায়রী ও ৫. চিশতী।
মোগল সম্রাট আকবরের আমলে আবুল ফজল কর্তৃক প্রণীত বিখ্যাত পুস্তক আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখিত চৌদ্দটি সুফি মতবাদ ও তার প্রবর্তকদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে পাক-ভারত উপমহাদেশে সুফিবাদ ও সুফিতত্ত্ব বিষয়ে সর্বাধিক মান্যতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব হলেন ধর্মীয় প্রাজ্ঞপণ্ডিত-দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রি.)। সুফিতত্ত্বের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হচ্ছে আল হিকমাহ ফি মাখলুকাতিল্লাহ। আর তাসাউফ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মিশাকাত আল্ আনোয়ার এবং ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যগ্রন্থ ইয়াহিয়া উলুম আল দ্বীন। এসব গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ বাঙালি সমাজেও বহুল পঠিত ও সমাদৃত।
ভারতবর্ষ ব্যতীত মিসর, ইরান, মেসোপটেমিয়া এবং এর উত্তর আফ্রিকায় সুফি সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠে। ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দীন আওলিয়া, মঈনুদ্দিন চিশতী, সেলিম চিশতী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাহজাহানের প্রথম পুত্র দারাশিকো এবং দুহিতা জাহানারাও সুফিবাদে অনুপ্রাণিত হন। সুফিবাদের প্রভাবে আকবরের আমলে ভক্তি আন্দোলন শুরু হয় এবং রামানুজ, রামানন্দ, কবির, নানক সুফিবাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। তাই বলা হয় যে, ‘সুফিবাদ শুষ্ক, একেশ্বরবাদের অনমনীয় আইন-কানুন এবং কঠোর আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া।’ (নিকলসন ও অন্যান্য)।
সুফিবাদ ও মরমিবাদ
পাক-ভারত উপমহাদেশে সুফিবাদ আর মরমিবাদ সমর্থক। উভয় শব্দই একই তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। মরমিবাদেও স্রষ্টা ব্যতীত অপর কোন বাস্তব সত্তা নেই। তিনি অনন্ত সৌন্দর্য ও সূচিতার প্রতীক এবং তাঁর সান্নিধ্য পেতে হলে ঐশ্বরিক প্রেম, ভক্তি, আত্মত্যাগ, আত্মার পবিত্রতা ও সম্মোহনী শক্তির প্রয়োজন। সুফিবাদ বলতে আমরা বুঝি আল্লাহ্ সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয় ও বুদ্ধির অতীত জ্ঞান ( beyond intellect) এবং ওই শাস্ত্র যেটা মানুষকে আল্লাহ্ প্রেম হাসিল করতে, আল্লাহ্ এক পেতে এবং আল্লাহতে বিলীন (ফানা ফিল্লাহ) হতে সহায়তা করে। ফানার মাধ্যমে আত্মা তার আপন চেতনা ও সমগ্র জাগতিক চেতনাকে এমনভাবে বিস্মৃত হয়ে যায় যে এখানে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা, গুণ কিংবা কর্ম সম্পর্কে সচেতন থাকে না। এ অবস্থায় আত্মা অর্জন করে এক স্বজ্ঞাত অপরোক্ষ ভাব এবং প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে সব জিনিসের এক অনির্বচনীয়) একত্ব। একই সঙ্গে হৃদয়ের সব অবগুণ্ঠন ও অন্তরায় দূরীকরণের মাধ্যমে সুফি এখানে অর্জন করেন পূর্ণ স্বাধীনতা এবং আল্লাহকে দেখতে পান পরিপূর্ণ প্রকাশ্য রূপে। এখানে সুফি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করেন তাঁর (আল্লাহর) স্বগত রূপে, অনুভব করেন এক অনির্বচনীয় পরমানন্দ এবং স্থিতি লাভ করেন ঐশীসত্তায়। এটিই সুফি- অভিজ্ঞতার সেই চরম ও চূড়ান্ত অবস্থা— সুফিদর্শনে যা ‘বাকা বিল্লাহ’ নামে অভিহিত।
মানব শরীরের আলোক বিন্দুগুলিকে সুফি পরিভাষায় বলে লতিফা, তন্ত্রে তাদেরকে বলা হয় চক্র। যদিও চক্রের স্থান ও লতিফার স্থান ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু দুটির শব্দের স্থান ভিন্ন হলেও দুটি তত্ত্বই একটি বিষয়ে একমত যে- যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। এই ধারণাটি বৌদ্ধ ধর্মে ভিন্ন নামে রয়েছে। সুফি মতে মানব দেহই প্রাসাদ। সুফিদের ‘ফানা’ বৌদ্ধদের ‘নির্মাণ’-এর মত কোন নঞর্থক অবস্থা নয়। ফানার রয়েছে ইতিবাচক ‘বাকা’ বা আল্লাতে স্থিতি। ‘নিবার্ণ’ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য বোধকে ধ্বংস করতে চায়। এরপর আর কোন স্তর নেই। ‘ফানা’ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে চায় ঠিকই; কিন্তু সে বিসর্জন শুধু আল্লাহ্র মধ্যে সমর্পিত হয়ে অসীমত্বে পৌঁছার লক্ষে নিবেদিত। সমস্ত কামনা- বাসনা নির্বাপিত করাই নির্বাণ। আত্মবিলয়ের মধ্যেই বৌদ্ধ মতে জীবের মুক্তি। এরপর আর কোন স্তর নেই। কিন্তু সুফিতত্ত্বে আত্মবিলোপের পর আরও একটি স্তর রয়েছে যার নাম ‘বাকা’ বা আল্লাহ্তে স্থিতি।
যেমন রুমির কবিতায় ও চেতনায় দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়— ফানা এবং বাকা। কেউ জানে না যে ভিতরের জীবনটা কী; কিন্তু আমাদের সাহসী হয়ে দাবি করতে হবে যে, চেতনার, বিশেষ করে ভাবাবেশপূর্ণ জীবনের দুটি প্রধান ধারা রয়েছে এবং রুমির কবিতায় এই দুটি ধারাকে বলা হয়েছে ‘ফানা’ ও ‘বাকা’। এই দুটি আরবি শব্দকে সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের যথাক্রমে ‘খেলা’ ও ‘ব্যবচ্ছেদ’এর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এটাই সুফিচেতনা। সুফিবাদ Islami Theology থেকে উদ্ভূত আর মরমিবাদ মূলত Christian Theology থেকে উদ্ভূত। যেমন, সুফি আবাহনী সংগীতের প্রথম পঙ্ক্তিতে বলা হয়েছে Praise be to The, O Hidden One’ এবং অ্যানিবেশান্তের Invocation of Unity-তে স্রষ্টাকে স্মরণ ও সম্বোধনে বলা হয়েছে ‘O Hidden Life ‘O Hidden Light,’ ‘O Hiden Love’। মোট কথা পরম সত্য গুপ্ত এবং লুকায়িত থাকে, সন্ধানী সাধক লুকায়িত সত্য ও সত্তাকে খুজেঁ বের করে আনেন, এটি তাঁর সাধনা। এই সাধনার মূল সূত্র হল— ‘There is no Religion Higher than Truth’।
ইংরেজি ‘Misticism’ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলাসাহিত্যে ‘মরমিয়াবাদ’ কথাটি প্রচলিত। তবে এতদ্অঞ্চলে এ ধরনের কোন শব্দ প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত ছিল না। উপনিষদ-এ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার বা ব্রহ্মের মিলন মোক্ষ বা মুক্তি নাম দেয়া হয়েছিল এবং এই মিলনকেই মানবজীবনের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। জীবাত্মা ও পরমাত্মার এই মিলনের নাম ছিল যোগ, যা একাধারে একটি পন্থা এবং অভিজ্ঞতা। এই যোগের সঙ্গে মরমিয়াবাদ তুলনীয়। মিশর ও সুমেরু থেকে আগত প্রাচীন জন্মরহস্য ভিত্তিক ধর্মের (Fertility Cult) প্রভাবে প্রাচীন গ্রিসে যে ইলিউনিসীয় এবং অরফিয়াসের গুপ্তরহস্য বা মিস্টেরির চর্চা (Eleunisian and Orphic Mysteries) গড়ে উঠেছিল, তা থেকেই পরে মিস্টিসিজম কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। মানুষের আত্মার সঙ্গে স্রষ্টার মিলনই মিস্টিসিজম বা মরমিয়াবাদের মূল রহস্য।
সুফিবাদের মৌলিক দর্শন
ইসলাম স্বীকৃত আধ্যাত্মিক সাধনার একটি পথ হচ্ছে সুফিদর্শন। ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি এবং মানব কল্যাণের মতবাদ সুফিদর্শন। সব ধরনের পার্থিব আকর্ষণ থেকে মুক্ত থেকে আধ্যাত্মিক সাধনা, ভক্তবৃন্দের মাঝে এ সাধনার চর্চা, স্রষ্টার দর্শন সর্বোপরি মুক্তিলাভ সুফি-দর্শনের মূলকথা।
সুফি-দরবেশদের মধ্যে কোন গোড়ামি বা সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। এ শিক্ষা সম্ভবত তাঁরা ভারতীয় সুফি-দরবেশদের থেকেই অর্জন করেছিলেন। বস্তুত সুফিবাদের মূল দর্শনই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। বাংলার সুফি-দরবেশগণও এ দর্শন ও চেতনায় শাণিত ছিলেন। তাঁদের আশীর্বাদের দ্বার সবার জন্যই উন্মুক্ত ছিল। তাঁদের উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সব ধর্মের ও শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। পাপী-তাপী, পাষাণ যেমন তাঁদের সাদর-সান্নিধ্য লাভ করে পরিশুদ্ধ হত, তেমনি ফকির, কাঙাল, অস্পৃশ্য, অমুসলিমও তাঁদের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হত না। পীর-মুর্শিদদের এ উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা বাংলাদেশে ইসলামের জনপ্রিয়তা ও সম্প্রসারণ যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি পীর-মুর্শিদগণকেও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তাঁদের মাজারগুলোতে আরো সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষের যাতায়াত অব্যাহত রয়েছে।
কেননা ধর্ম এমন একটি বিষয় যাকে অনুভব করতে হয়, এটাই সুফির ধর্মোপলব্ধি। নিকলসন্ তাঁর The Mystics of Islam গ্রন্থে নিফারি (Niffari ) নামে একজন মিশরীয় সুফির অন্তরের উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন এভাবে:
God said to me, “Ask me and say, ‘O Lord, how shall cleave to thee, so that when my day ( of judgment ) comes. Thou will not punish me nor avert Thy face from me?’ Then I will answer thee and say, cleave in thy outword theory and practice to the Sunne (the rule of the prophet) and cleave in thy inward feeling to the gnosis which I have given thee; and kow that when I make myself known to thee, I will not accept from the anything of the Sunna but what My gnosis brings to thee, because thou art one of those to whom I speak: thou hearest me and knowest that thou hearest Me, and thou seest that I am the source of all things “
উপরোক্ত উদ্ধৃতির মর্মকথা এই যে, স্রষ্টাই বাইরে শরীয়তের নিয়মগুলি পালন করতে বলছেন এবং অন্তরে তাঁরই প্রদত্ত জ্ঞানোপলব্ধিকে বিকশিত করতে বলছেন এবং এই বিকশিত উপলব্ধির জ্ঞানই হবে সেই সাধকের শেষ পারানির কড়ি।
পাক-ভারত উপমহাদেশে সুফিবাদ
বঙ্গে আগমন করা বেশিরভাগ সুফিরা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন। এঁরা এসেছিলেন ইয়েমেন, তুরস্ক, খোরাসান, আফগানিস্তান, আরব প্রভৃতি স্থান থেকে স্থলপথ ও জলপথ দিয়ে। আরবদের সঙ্গে আগে থেকেই বঙ্গের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কারণে সুফিদের কাছে জলপথটি ইতোমধ্যেই পরিচিত ছিল, তবে সুফিরা সকলেই সরাসরি বাংলায় আসেননি। কেউ কেউ এসেছিলেন দিল্লিতে সুলতানাতের সেবা করার জন্য এবং এরপর তাঁদের বাংলায় আসতে বলা হয়েছিল। কেউ কেউ নিকটবর্তী বিহার রাজ্য থেকে আগমন করেছিলেন। কেননা তখনকার বঙ্গ বা বাঙ্গালা সে সময়ে বিহার এবং উড়িষ্যাসহ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই বিহার থেকে আগত সুফিদেরও বঙ্গের সুফিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে উল্লেখ্য যে, এঁদের বেশিরভাগের আগমনকাল ১২০১ থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের পরিসীমায়। পরবর্তীকালে স্থানীয় শাসকদের আনুকুল্য তথা সুফিদের সহিষ্ণু চরিত্রের বৈশিষ্টে স্থানীয়দের কাছে এঁরা শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। তবে আত্মপ্রচার বিমুখ বেশিরভাগ সুফিরা তাঁদের জীবনদৃষ্টি এবং সুফিদর্শন সম্পর্কিত প্রচার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন নি। ফলে পরবর্তীকালে গবেষকদের গবেষণায় সুফিদের জীবনেতিহাস বেশিরভাগই রচিত হয়েছে লোকমুখে প্রচারিত এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে। এতদ্ভিন্ন সুফিদের অলৌকিক কর্মকাণ্ডগুলো লোকসংস্কৃতি এবং সাহিত্যেও উদ্ধৃত হয়েছে। যা থেকে কিংবদন্তি ও সত্যি পৃথক করা এখন প্রায় দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে যিনি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ও অ্যাকাডেমিক গবেষণায় পথিকৃৎ হয়ে আছেন তিনি হলেন সুফিদের প্রবেশদ্বারের অধিবাসী চট্টগ্রামের মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-১৯৮২ খ্রি.)। তিনি History of Sufism in Bengal (1201-185০ AD) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ লিখে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অধীনে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
বাংলাদেশের সুফিবাদ মূলত একাদশ শতাব্দীর পূর্বের। যা উত্তর ভারতের সুফি সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। বঙ্গে আগত প্রথম সুফি শাহ সুলতান রুমী। তিনি ময়মনসিংহে ১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আগমন করেন। তারপরে ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাবা আদম শাহ এবং ত্রয়োদশ শতব্দীতে অন্যরা এসেছিলেন। বাংলাদেশে আগত সর্বাধিক স্মরণ তালিকায় যে সব সুফিদের নাম সাধারণ্যে উচ্চারিত হয় এঁদের মধ্যে : সিলেটে হজরত শাহ জালাল ও শাহ পরাণ। চট্টগ্রামে— শাহ আমানত, বায়েজিদ বোস্তামি, শাহ বদর, মহসিন আউলিয়া, শাহ গরিব উল্লাহ, শাহ ফরিদ, মিসকিন শাহ। বাগেরহাটে খান জাহান আলী, শাহ দৌলত। রাজশাহীতে— শাহ মখদুম। ঢাকায়— শাহ ইয়ামেনি এবং শাহ আলী বাগদাদী বিশেষ উল্লেখিত নাম।
বাংলাদেশের সুফিদের তিন পর্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়ে রয়েছেন বহির্ভারত থেকে আগত শিয়া এবং সুফিরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখি বহির্বঙ্গ থেকে আগত সাধকদের। তৃতীয় পর্যায়ে দেখি বাংলার নিজস্ব সুফিধারা। এ পর্যায়ের দ্বিতীয় পর্বে মূল সুফি গোষ্ঠী মিলনের ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে নতুন লোক-ধর্মের শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে।
সুফিরা কখনই ধর্মবিস্তার এবং রাজ্যবিস্তারকে এক করে দেখেন নি। সুফিরা হৃদয় ধর্মের মাধ্যমেই সকল মানুষকে এক বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় আনার কথা ভেবেছিলেন। সুতরাং ভারতে ইসলামের বিস্তার যেভাবে হয়েছিল, সুফিমতের বিস্তার সেভাবে হয়নি। যদিও সুফিরা মুসলমান রাজশক্তির আনুকূল্য পেয়েছিলেন এবং সেই আনুকূল্য তাঁদের প্রচারের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক হয়েছিল। ভারতবর্ষেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভারতে সুলতানী আমলে এবং মোগল আমলে রাজশক্তির আনুকূল্যে উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে সুফি মতবাদের বিকাশ ঘটে। বাংলাতেও ত্রয়োদশ শতকে তুর্কী আক্রমণের সময় থেকেই সুফি পীর এবং সাধকেরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজারা কেন এমন সাধকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যারা ইসলামের মূল বক্তব্যটাকেই স্বীকার করেন না? শুধু রাজারাই নন, এ কথা ঐতিহাসিক এবং সামাজিক সত্য, যে সুফি মতবাদে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান। এর একটা বাহ্যিক কারণ, শরিয়তি ইসলাম ধর্মের বজ্রবেষ্টনী মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল, যার থেকে মুক্তির জন্য মানুষ সুফির মুক্ত জীবনভাবনায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সুফি বিশ্বাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের পদধ্বনি সবচাইতে বেশি পরিমাণে পাওয়ার অন্তগূঢ় কারণ সুফির বক্তব্যের সঙ্গে ইসলামের সম্পৃক্ততা।
সাহিত্যে সুফিচেতনা
মসনবী শরীফ গ্রন্থে মাওলানা রুমি চার শতাধিক ছোট-বড় গীতিকাহিনী উপস্থাপনের মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টি তথা জীবন ও জগতের সকল জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধানে দৃষ্টান্তের আলোকে মূল কোরআনের ইংগিতপূর্ণ বিষয়গুলিকে চিন্তাশীল মানুষদের কাছে সহজতর করে তুলেছেন। ফলে কোরআন সন্ধিৎসার সহায়ক এই মসনবী প্রকৃতপক্ষে কোরআনের সারবস্তু হয়েও মানবমনের সকল জিজ্ঞাসার উৎস হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এবং পরবর্তীকালে সাহিত্যে মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়। তাই সঙ্গত কারণেই সমাজচিন্তায়, স্বদেশ ভাবনায়, সাহিত্য কর্মে তথা গবেষণায়ও এর প্রতিফলন দেখা যায়। ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম ঐতিহ্য এ সময়ে প্রিয় প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে। এ সময় পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধের বহু সুফির চিন্তাদর্শন ও সুফি কবিদের সাহিত্যকর্ম পূর্ব পাকিস্তানের পাঠককুল অনায়াসসাধ্য পাঠের সুযোগ পায়। পূর্বাঞ্চলেও প্রকাশিত হয় উল্লেখ্যযোগ্য অনেক সুফি গবেষণাকর্ম। খানবাহাদুর আহছান উল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫) প্রণীত ছুফি (১৯৪৭), আবদুল মওদুদ (১৯০৮-১৯৭০) প্রণীত শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই (১৯৬৪), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬) প্রণীত পাকিস্তানের সুফিসাধক (১৯৬৫), গোলাম সাকলায়েন (১৯২৬-১৯১২) প্রণীত পূর্ব পাকিস্তানের সুফি সাধক (১৯৬১), মনিরউদ্দীন ইউসুফ (১৯১৯-১৯৮৭) প্রণীত বাংলাসাহিত্যে সুফী প্রভাব (১৯৬৯) ইত্যাদি এ সময়ের সর্বাধিক স্মরণীয় সুফি গবেষণাকর্ম। তিরিশের দশক থেকে বর্তমান অবধি সুফিবাদ ও সুফিদর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষকদের গবেষণা ও গবেষণা পরিচালনা সর্বাধিক স্মরণীয়। এই বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ড. মানাল শাহ্ আল কাদরী, ড. ওসমান গণি ও বর্তমান শিক্ষক ড. কাজী সোফিওর রহমান সুফি গবেষকদের মধ্যে স্মরণীয় নাম। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সুফিবাদ গবেষণায় অগ্রণী হয়ে আছেন হরেন্দ্রচন্দ্র পাল (১৯১২-১৯৯৬)। তিনি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘Jalaluddin Rumi and his Tasawwuf শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
রুমি তাঁর জীবনের শেষ বারো বছর ধরে রচনা করেন এই সুদীর্ঘ ধারাবাহিক কবিতাগুচ্ছ। চৌষট্টি হাজার লাইন বিশিষ্ট কবিতাটি ছয় খণ্ডে বিভক্ত। বিশ্ব সাহিত্যে এর সমতুল্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই। এটি বহু বিষয়কে ঘিরে সমুদ্রের মতো স্ফীত হয়ে ওঠে। এটি আত্মব্যাখ্যামূলক। কাল্পনিক, কোথায়ও আত্মার স্বাস্থ্যের ওপর রসিকতামূলক মন্তব্য ও কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা। এতে লোককাহিনী, কৌতুক এবং কবিতা রচনার সময় উপস্থিত লোকদের সম্পর্কে মন্তব্য রয়েছে। রুমি তাঁর মহিমান্বিত উক্তিগুলিকে তাঁর লিপিকার হুশাম চেলেবিকে লিখে রাখতে বলতেন তারা যখন কোনিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন। দ্রাক্ষা কুঞ্জের কাছে, ক্লাস নেয়ার সময়ে এবং রাস্তায় ও হাম্মামখানায়। হুশাম ছিলেন শামসএর মুরিদ। অতএব, এই দীর্ঘ কবিতাকে বন্ধুর সাথে রুমির আলাপ-চারিতার সম্প্রসারিত রূপ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। রুমির এই অদ্ভূত একক বৈচিত্র্যের সর্বোত্তম রূপক ছিল তাঁর চারপাশের লোকদের কেন্দ্র করে- যেখানে কখনো তিনি উপস্থিত হতেন।
সুফিবাদের অন্যতম খ্যাতিমান গবেষক প্রফেসর ডক্টর আর. এ. নিকলসন (Dr. R. A. Nicholson), সুফিবাদ বিশেষজ্ঞ এ. জে. আরবেরি (Dr. A. J. Arberry) মসনবীকে একটি মহাসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করেন। এটি এখনো বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীতে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ভাষা নেই যেখানে পুরো মসনবী বা তার অংশবিশেষ অনূদিত হয়নি। এই মহাগ্রন্থ ইংরেজি সাহিত্য, ফরাসি সাহিত্য, জার্মান সাহিত্য, উর্দুসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যকে যুগ যুগ ধরে নানাভাবে প্রভাবান্বিত করে আসছে। উর্দু সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ডক্টর আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল গৌরবের সঙ্গে স্বীকার করেছেন, তিনি মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির ভাবশিষ্য ছিলেন।
বাংলার বৈষ্ণব কবিগণ, নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং আধুনিক কবিদের অনেকেই তাঁর ভাবধারা অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন। বৈষ্ণর কবি চণ্ডীদাসের অবিস্মরণীয় চরণ ‘শুনহ মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই,’ বিদ্যাপতির ‘কত চতুরানন মরি মরি যাওত, নতুয়া আদি অবসানা/তোহে জনমি পুনঃ তোহে সমাওত সাগর লহরী সমান’-এসব মানবীয় বাক্য রুমির মসনবীর প্রতিধ্বনি।
রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ‘দুই পাখি’, ‘সীমার সাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর,’ আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, /আমার প্রদীপ না জ্বালালে দেয় না কিছু আলো; নজরুল ইসলামের ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।’ তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ ইত্যাদি হয় মাওলানা রুমির মসনবীর সোজাসুজি অনুবাদ অথবা তাঁর ভাবধারার ঋণে ঋণী।
দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি মাওলানা রুমির আর একখানি বিশ্বপ্রসিদ্ধ গজল গ্রন্থ। মসনবী শরীফ মহাসমুদ্র হলে তাঁর দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি হবে ঐ মহাসমুদ্রের ঝড়। দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি-এর গজলে রয়েছে উন্মত্ততা ও আশেকীর মনমাতানো সুর। এ গ্রন্থের মধ্যে-এর বিধৃত হয়েছে মসনবী শরিফের মূলকথা ‘প্রেম’। রুমি নিজেই তাঁর মসনবী গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন : ‘স্রষ্টার কাছে পৌছানোর অজস্র পথ খোলা আছে, আমি তাঁর মাঝ থেকে প্রেমকে বেছে নিলাম’। সুফিতত্ত্বে আশেকীই আশেকের ধর্ম। রুমি বলেন—
মিল্লতে এক আজ হামা মিল্লাত জুদাস্ত,
আশেকাঁরা মাজহাবও মিল্লাত খোদাস্ত। (মসনবী)
অর্থাৎ ‘প্রেমের সম্প্রদায় অন্যান্য সম্প্রদায় হতে ভিন্ন। যারা প্রেমিক তাদের মাজহাব ও সম্প্রদায় হচ্ছেন আল্লাহ।’ প্রখ্যাত সুফি কবি হাফিজ সিরাজী বলেন-
না মান হানফী, না মান শাইফী, না মান মাজহাবে হাম্বলী দারাম,
মালেকি হাম না মান, মাগর মাজহাবে এশকি দারাম।
অর্থাৎ ‘আমি হানাফী, শাইফী, হাম্বলী ও মালেকী কোন মজহাবের অনুসারী নই। আমার মাজহাব হচ্ছে প্রেমের মাজহাব।
ইসলামে ধর্মীয় আচার পদ্ধতিতে ‘মাজহাব’ (ধর্মীয় চর্চাপদ্ধতি)-এর উৎপত্তি ও তার প্রভাব অপরিসীম। হজরত মুহম্মদ (স.) এর ওফাতের পরেও কোরআন ও হাদিসে যেসব সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত, সেগুলো নিয়ে বড় রকমের কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে ইসলামের সঙ্গে যখন বিভিন্ন জাতির সংযোগ ঘটতে শুরু করে এখন ভিনদেশি আচার অনুশীলন ও নিয়ম-কানুনেকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে দেখতে হয়। এবং কোন্ বিশেষ বিষয়টি ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আর কোটি ইসলামের পরিপন্থী তা-ও স্থির করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় স্বভাবতই মুসলমানরা পড়ল বিপাকে। তখনই দেখা দিল মতদ্বৈধ, তখনই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াল বাধ্যতামূলক বিস্মৃত আইন-কানুনের। এভাবে আইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে চিন্তাভাবনার এক সুস্পষ্ট পর্ব সূচিত হয় খ্রিষ্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকের দিকে। ওই সময়েই ইরাক, হেজাজ, সিরিয়া ও বিভিন্ন স্থানে বিকশিত হয় আইনবিষয়ক কিছু সুনির্দিষ্ট মত এবং এগুলোর ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে চারটি সুন্নি মাজহাব। এই মাজহাব চারটির প্রতিষ্ঠাতাদের প্রত্যেকেই অর্জন করেছিলেন জনগণের ব্যাপক স্বীকৃতি ও সম্মান। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন প্রণালির সঙ্গে এঁদের রায় বিবেচিত হত প্রায় অবশ্য পালনীয় বলে। তাঁদের অনুসৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগবুদ্ধির ব্যবহার (ইজতেহাদ) মুসলিম জাতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আজও পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান তাঁদের কোন-না-কোন একজনের নির্দেশিত পথের অনুসারী। মূলনীতির দিক থেকে এই চারটি মাজহাবের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই বটে; কিন্তু আইনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যায় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র। উল্লেখিত চারটি মাজহাব হল- ১. ইরাকের আবু হানিফা (৬৯৯- ৭৬৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হানাফি মাজহাব, ২. মালেক ইবনে আনাম (৭১৩-৭৯৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত মালেকি মাজহাব ৩. মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আস-শাফি (৭৬৭-৮১৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত শাফি মাজহাব ও ৪. আহমদ ইবনে হাম্বল ( ৭৮০-৮৫৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হাম্বলি মাজহাব।
বাংলার মরমী কবি লালন ফকির, হাসান রাজা, রমেশ শীল প্রমুখ মাওলানা রুমির মসনবী ও দিওয়ানে শামস্ তাবরিজ এর ওপর নির্ভর করে অসংখ্য অমর গীত রচনা করে গেছেন। রুমির দিওয়ানে শামস্ তাবরিজ মহাসমুদ্রের ঝড় হলেও ওটা হচ্ছে প্রেমের ঝড়- ওটাতে আছে প্রেমের উচ্ছ্বাস, ওটাতে ঝড়ের ধ্বংসলীলা নেই। রুমির ফিহি মা-ফিহি(যা আছে তা এতেই আছে)ও একটি মুল্যবান গ্রন্থ। এটাতে একাত্তরটি নিবন্ধ রয়েছে। এগুলোর কিছু কিছুতে মসনবী শরিফে বর্ণিত কাহিনিও তুলে ধরা হয়েছে। রুমি তুর্কী ও আরবী ভাষাতেও অনেক রচনা রেখে গেছেন। এগুলির বেশির ভাগই নানা ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে।
মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম (আনু. ১৪-১৫ শতক) মোল্লা জামীর (১৪১৪-১৪৯২ খ্রি.) ইউসুফ-জোলেখা প্রণেতা শাহ্ মুহম্মদ সগীর, মধ্যযুগের অন্যতম নীতিশাস্ত্রবার্তা (১৪১০ খ্রি.) রচয়িতা কবি মুজাম্মিল (মৃ. ১৪৪২ খ্রি.), অসিয়ত্নামা রচয়িতা শেখ সোলায়মান, নূরনামা কাব্যখ্যাত কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০ খ্রি.), নবীবংশ রচয়িতা সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮খ্রি.), জঙ্গনামা রচয়িতা শাহ গরীবুল্লাহ, আমীর হামজা রচয়িতা সৈয়দ হামজা (আনু. ১৭৩৩-১৮১৭ খ্রি.) রুমির মসনবী’র প্রথম বাঙালি ভাষ্যকার চাঁদ কাজী- এঁরা সবাই সুফিদর্শন প্রভাবিত সুফিকবি হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়াও নূরজামাল কাব্য রচয়িতা হাজী মুহম্মদ (আনু. ১৫৫০-১৬২০ খ্রি.), পদ্মাবতী খ্যাত সৈয়দ আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩ খ্রি.), আধ্যাত্মিক সংগীত রচয়িতা আলী রজা (১৬৯৫-১৭৮০ খ্রি.), উচিৎ শ্রবণ (১৮৬০ খ্রি.) রচয়িতা খন্দকার শাসসুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী (আনু. ১৮১২-? খ্রি.) প্রমুখ মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের অধিকাংশ কবি যেমন সুফিদর্শন প্রভাবিত ঠিক তেমনি হিন্দু কবিদের মধ্যেও আমরা সুফিদর্শন প্রভাবিত সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে স্মরণীয় হয়ে আছেন—এমন অনেক কবি যেমন মধ্যযুগে ছিলেন এবং এখনো আছেন।
সম্প্রীতি সম্প্রসারণে সুফি সংস্কৃতির ভূমিকা
বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজরত মহম্মদ (স.)-এর ইচ্ছা ছিল জীবন্ত। অন্যান্য ধর্মের অনুসারিদের প্রতি প্রকৃত ইসলামের কোন বিদ্বেষ নেই। পরিত্রাণের একমাত্র দাবিও খাঁটি ইসলাম করে না। মসনবী শরীফ-এর মরমী কবি মওলানা জালাল উদ্দীন রুমি এ সম্পর্কে বলেন—
‘True Parsi and true Brahmin, a Christian yet a Mussalman,
Thee I trust Supremely right: Be not far, Oh be not far.
In all Mosques, Pagodas, Churches, I do find one shrine alone;
Thy face is there my sole delight; Be not far, Oh be not far.’
কোরআনে বহুবার পরিত্রাণের বা বেহেশ্তপ্রাপ্তির একচেটিয়া দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কোরান বলে, “নিশ্চয়ই মুসলমান এবং ইহুদী, খ্ৰীষ্টান অথবা সাবেঈন— যে কেউ আল্লাহ্ এবং শেষদিনে বিশ্বাস রাখে এবং ভালো ও ন্যায্য কাজ করে, আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কৃত করবেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই, তারা দুঃখিত হবে না।’ (সূরা বাকারা : ৬২) তাই সঙ্গত কারণেই মানবসমাজে ধর্ম, গোত্র, বর্ণ বা কোন সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন সুফিচেতনায় স্বীকৃত নয়।
ভারত উপমহাদেশে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৬) ছাড়া প্রায় সকল শাসকই সুফিবাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আওরঙ্গজেবই একমাত্র মোগল শাসক যিনি সুফিবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি একদল হানাফি শরিয়তপন্থী উপদেষ্টা নিয়োগ করে ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরী’ অর্থাৎ আলমগীরের (আওরঙ্গজেব) ইসলামিক আইন ও ইসলামি আচার সংক্রান্ত নির্দেশাবলী পুস্তক রচনা করেন। মোগল সাম্রাজ্যে সুন্নি মুসলমানদের প্রতি আওরঙ্গজেব এই মর্মে নির্দেশ দিলেন যে, ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরী’ তাদের অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে এ মান্যতা সুফিসমাজে অগ্রাহ্য হয়। যার প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিতে একটি সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে লালন-রাধারমণ, দুদ্দু-পাঞ্জু, হাসনরাজা-জালাল-শাহ আবদুল করিম, মাইজভাণ্ডারী, মনসুর রশিদ, শাহ্ সুফি সদরউদ্দিন আহমেদ চিশতী প্রমুখ সাধকের সাধনক্ষেত্র। তাঁরা সবাই প্রচলিত শরিয়ত থেকে ইসলামকে ভিন্নরূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মানবঐক্য রচনায় এঁদের অবদান সর্বাগ্রগণ্য। কেননা কোন শরিয়তি বিধানই সুফিচেতনার ন্যায় এমন উদারজমিন রচনা করতে পারেনি—যা করেছেন সুফিরা।
পারস্য তথা মধ্য এশিয়ার সুফিবাদের ব্যাপক প্রসারের মধ্যে লক্ষ করা যায় যে, সুফি সাধকদের কেন্দ্র করে অসংখ্য দরগা ও খানকা শরীফ গড়ে উঠেছে। এসব দরগা ও খানকা শরীফে সুফি দর্শন চর্চা, কাব্য তথা সাহিত্য সৃষ্টি, আর আল্লাহ্র ‘জিকিরে’ মশগুল হয়ে উঠেছে। এমনি সময়ে বিজয়ীর বেশে মুসলমানদের ভারত উপমহাদেশে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্ম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে শত শত সুফি, পীর, দরবেশ, ফকির ও আউলিয়া পারস্য ও মধ্য এশিয়ার সুফি দরগা ও খানকা শরীফ থেকে ভারতে এসে হাজির হয়। এইসব সুফি সাধকদের কেউই আর জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেননি। ভারতের মাটিতে এঁরা চির নিদ্রায় শায়িত। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সর্বত্র এঁদের কবর ছড়িয়ে রয়েছে। এঁদের কবরকে ভিত্তি করেই এঁদের শিষ্যরা গড়ে তুলেছে অসংখ্য খানকা শরীফ যেগুলোকে সুফি মতবাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে— অবশ্য এ বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছয়টি ধর্মের মধ্যে সময়ের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটি এবং দেশ হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ ব্যাপী বিশাল এলাকায় বিস্তৃত ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের কথা বাদ দিলেও বিশ্বের অবশিষ্ট প্রায় সকল দেশেই কমবেশী ইসলামের অনুসারি রয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের প্রায় ছ’শত বছর পরে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। আরবের মক্কা নগরে কোরেশ বংশে জন্ম নেয়া বিশ্বের সর্বাধিক সফল এবং প্রভাবিত মহামানব হজরত মুহম্মদ (৫৭০-৬৩৩ খ্রি.) স. ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই ধর্ম প্রচার করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় হজরত মুহম্মদের জীবদ্দশায় আরবে সুফিবাদ সম্প্রসারিত হয়নি।
আরব এলাকায় সুফি মতবাদের পূর্বসুরি মুতাযিলার সুচনা হলেও, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমিতে পারস্য দেশে অতি দ্রুত সুফিবাদ একটা পরিচ্ছন্ন রূপ লাভ করে এবং পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। তবু একথা উল্লেখ্য করা প্রয়োজন যে, আরব দেশে মুতাযিলার প্রবর্তক ওয়াসিল বিন আতা ছাড়াও বহু মনীষী সুফিবাদ প্রবর্তনে সহায়তা করেছেন। এঁদের মধ্যে কুফা নগরীর আৰু হাশিম (মৃ. ১৬২), ইব্রাহিম আদহাম (মৃ. ১৬২ হিজরি), ফাজিল আয়াজ (মৃ. ১৮৮ হি.), দাউদ তায়ী (রা.) (মৃ. ১৬৫ হি.) প্রমুখ অন্যতম। ইসলামের উদ্ভবের মাত্র দেড়’শ বছরের মধ্যে অত্যন্ত সন্তর্পণে সুফিমত অঙ্কুরিত হয়। কুফা নগরীর আবু হাশেমই (মৃ. ১৬২ হি.) প্রথম সুফি সাধক বলে পরিচিত। তিনি হুজুইরির মতবাদকে ব্যাখ্যাদান করে সুফি দর্শনের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন।
ঐতিহাসিক সাক্ষ্যে দেখা যায়, ইসলামের আবির্ভাবের পরেই আরবের বণিকেরা মালাবার উপকূলে বসতি গড়ে ছিলেন। এই আরব বণিকদের হাত ধরেই ভারতবর্ষের কেরলে ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করে। আর এখানেই ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। মসজিদটির নাম ছিল— ‘চেরামান জুম’আ মসজিদ’। এটি ভারতের কেরালার ক্র্যগানোরে নির্মিত হয়েছিল।
কেরালার চেরা বা পেরুমল রাজবংশের সঙ্গে আরবদের সখ্যতা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে এবং এরা খুব উদার ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে ইসলামের প্রসার ঘটে এবং তাঁদের নামেই চেরামান জামে মসজিদ নির্মিত হয়। উল্লেখ্য, পেরুমলদের শেষ রাজা চেরামান পেরুমল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং শেষ জীবনে মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। পেরুমল ভাস্কর রবি বর্মা ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম, (আবু রায়হান আল-রেরুনী, কেতাবুল হিন্দ)। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, ভূ-তত্ত্ববিদ এবং পরিব্রাজক মাসুদি তাঁর ভারতবর্ষ বিষয়ক ইতিহাসে মন্তব্য করেছেন: ‘আদম সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় (তখন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল) অবতরণ করেছিলেন। তখন তাঁর সর্বাঙ্গ ছিল নন্দনকাননের (প্যারাডাইজ) সুগন্ধি পত্র-পল্লবে ঢাকা। ঐ পত্রপল্লবগুলো শুকিয়ে যাবার পর ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল’। এ-জন্যই ভারতবর্ষ সুগন্ধি ঔষধিপত্রে খ্যাতি?। সুলীমান নাদভী এবং হুসাইন আহমদ মাদানির মতো মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তি এ-দাবির সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণ উদ্ধার করেছেন যে ভারতবর্ষই হল মুসলমানদের আদিপুরুষের পিতৃভূমি।
ইসলাম একটি সাংগঠনিক এবং প্রচারমুখী বহিরাগত ধর্ম। এই প্রচারের পশ্চাতে রয়েছে নানা অভিমত। কারো মতে তলোয়ারের জোরে বা মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়, আবার কেউ কেউ মনে করেন, বহিরাগত সুফি- দরবেশরাই এ দেশে ইসলাম ধর্মের প্রসারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। কারো কারো মতে, এ দেশের মুসলমানদের বড় অংশটাই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় মুসলমান হয়েছে। বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে প্রধান দুটি মতবাদ হল: ইংরেজ ও হিন্দু ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে বাংলাদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। দ্বিতীয় মতবাদ বিশ্বাস করেন কতিপয় মুসলিম ঐতিহাসিক তাঁদের মধ্যে রয়েছেন খোন্দকার ফজলে রাব্বি, ডক্টর আবদুর রহিম ও ডক্টর মোহর আলি, এঁরা মনে করেন যে বাংলার বেশিরভাগই মুসলমান পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর। ধর্মান্তরিত হিন্দুরা মুসলমান জনসংখ্যার বড় অংশ নয়।
এই বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে বিত্ত-বৈভবমুক্ত নিরাসক্ত ধর্মবর্ণ গোত্র নির্বিশেষে যাঁরা এই জনপদের মানুষকে প্রেমের মাধ্যমে আপন করে নিয়ে সকলের হৃদয়পটে শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই করে নিয়েছেন— তাঁদের অধিকাংশই সুফিধারার সহনশীল মানুষ। এঁদের ওফাতের পর এঁদের কবরস্থানকে ভক্তরা মাজারে রূপান্তরিত করে যে বির্তকের জায়গা তৈরি করেছে— এর জন্য এই সত্যিকার মানবপ্রেমী সুফিকদের দায়ী করা চলে না। কেননা পরবর্তীকালে এঁদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যাঁরা ইসলামের মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক করে তুলেছে-মূলত তাঁদের জাগতিক ফায়দা লাভের লোভকেই দায়ী করা বাঞ্ছনীয়। আর এই লোভাতুর মনোভাব থেকেই বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে ‘মাজার সংস্কৃতি।’
যদিও ‘মাজার সংস্কৃতি’র বিশেষত্ব হচ্ছে এর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মাজারে আগতদের ৮.১৪ শতাংশ অমুসলিম। ইসলাম ধর্মের আর কোন কার্যক্রমে এ হারে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ বিরল। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার গরল বাংলাদেশের সামাজিক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ বাস্তবতায় সুফিবাদের অহিংস দর্শন এবং মাজারসংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অভিযোগ আছে, ধর্মভিত্তিক কিছু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল মাজারসংস্কৃতির কঠোর বিরোধিতা করেন। মাজার সংশ্লিষ্টরা প্রায়শ ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির বিরোধী। এ কারণে তাদেরকেও কারণে-অকারণে নানা সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় বলে বিতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ তথা বিশ্বে অসংখ্য মাজার রয়েছে যেখানে সত্যি সত্যি কোন বুজুর্গ ওলি বা কামেল পীর শায়িত আছেন। কিন্তু গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর লালসালু উপন্যাসে বিতর্কিত মাজার গড়ে ওঠার যে চিত্র এঁকেছেন তাঁর স্বরূপ প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হয়েই চলছে। মাজারকেন্দ্রিক পারলৌকিক প্রলোভন প্রদর্শন করে সরল মনের মানুষদের থেকে অর্থোপার্জন করে জীবিকামুখী মজিদ চরিত্র আমাদের চারপাশে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জসীম উদ্দীন তাঁর বাঙ্গালীর হাসির গল্প গ্রন্থে শিয়াল শাহ পীরের মাজার এর মাধ্যমে ভুয়া মাজার গড়ে তোলার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে সতর্ক করেছেন। মুনতাসির মামুন লিখেছেন সব মাজার মাজার নয়।
‘মাজার’ আরবি শব্দ। এর ফারসি প্রতিশব্দ ‘দরগাহ’। আরবি ‘জিয়ারুন’ শব্দ থেকে মাজার শব্দের উদ্ভব। শাব্দিক অর্থে মাজার হচ্ছে সাক্ষাতের স্থান। মাজারকে দর্শনীয় বা পরিদর্শনের স্থানও বলা হয়। কবর এবং মাজার সমার্থক নয়। কবর হচ্ছে আবৃত করে রাখা। অর্থাৎ মৃত্যুর পর মানুষের মরদেহকে আবৃত করে রাখার স্থান হচ্ছে কবর। সাধারণ মানুষের মরদেহ সমাহিত করার স্থানকে কবর বলা হয়। ‘মাজার’ এবং ‘কবর’-এর পাশাপাশি আরেকটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘রওজা’। রওজা হচ্ছে ফুল-ফলে সুশোভিত বাগান। রাসুল (স.) এর কবরকে মাজার নয়, রওজা বলা হয়। তাৎপর্যগত দিক থেকে রওজা হচ্ছে ‘জান্নাতের বাগান’। প্রচলিত অর্থে মাজার হচ্ছে এমন কবর যা বহু মানুষ ‘জিয়ারত’ করে। সাধারণত সুফি-দরবেশ, পীর-ফকির, বুজুর্গ বা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কবর মাজার হিসেবে গড়ে ওঠে। মাজারের ইংরেজি প্রতিশব্দ Mausoleum। ইংরেজি Tomb এবং Shrine প্রত্যয় দু’টিও মাজারের সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সুফিদর্শনে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি
এই উপমহাদেশে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সূত্রপাত করেন সম্রাট আকবর (১৫৫৬- ১৬০৬ খ্রি.)। ভারতে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির লক্ষে তিনি ফতেপুর সিক্রিতে আয়োজন করেছিলেন আন্তঃধর্মীয় সংলাপ (Interreligious Dialogue)। এই সংলাপের মাধ্যমেই তিনি সকল ধর্মের সারাৎসার সমন্বয় করে তৈরি করেছিলেন দ্বীন-ই-ইলাহী বা স্রষ্টার ধর্ম। আকবরের জীবদ্দশায় ঐকান্তিক উদ্যোগ ছিল নতুন এ ধর্মমত চালু করার; কিন্তু তাঁর লোকান্তরণের পর দ্বীন-ই-ইলাহী লীন হয়ে যায়। আকবরের দ্বিতীয় কাজটি ছিল ‘সুল-হি-কুল’ বা সর্বজনীন শান্তি নামে জাতীয় নীতি প্রণয়ন। আকবরের লক্ষ্য ছিল পরধর্মসহিষ্ণু ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিভিত্তিক একটি কল্যাণধর্মী সমাজ নির্মাণ। এই ধারাবাহিকতায় গীতাসংকলক শঙ্করাচার্য (৭৮৮- ৮২০খ্রি.) ভারতীয় আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-১৮৮৩ খ্রি.) প্রমুখ এই উপমহাদেশে ধর্মসংস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা পুরুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এর আগে মোগল সম্রাট শাহজাহান পুত্র দারাশিকো (১৬১৫-১৬৫৯ খ্রি.) এই উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে মিলন ঘটানোর অভিপ্রায় রচনা করেছিলেন মজমাউল বাহরায়েন (দুই সমুদ্রের মিলন / The Confluence of the Two Seas)। কাদেরিয়া তরিকার অনুসারি দারাশিকোর সুফিবাদী চেতনায় রচিত ওয়াহিদাতুল সাওয়ানিহ্ (১৬৪০ খ্রি.) আরেকটি সম্প্রীতিমূলক গ্রন্থ। ফারসি ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ তাঁর অমর কীর্তি। এর প্রায় আড়াই শত বছর পর তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)। একেশ্বরবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আরবি-ফারসি ভাষায় রচনা করেন তুহুফাউল মুয়াহিদ্দীন (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার)। ‘নিরাকার ব্রহ্মোপসনাই প্রকৃষ্ট’- এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রবর্তন করেন ব্রাহ্মধর্ম।
সুফিদর্শনে মানবতা ও মানবিক চেতনা
ইংরেজ কবি রবার্ট হেরিক (Robert Herrick, 1591-1674 ) রচিত To Daffodils কবিতায় মানব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব বোঝানোর জন্য একে শিশিরবিন্দু ও ড্যাফোডিল ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সকাল বেলা শিশির বিন্দু ঘাসের পাতায় প্রভাত সূর্যের নবীন আলোয় ঝলমল করে কিন্তু খানিক পরেই মাটিতে পড়ে হারিয়ে যায়। ড্যাফোডিল সকালবেলা ফোটে কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই শুকিয়ে যায়। যে শিশিরে বিন্দু ঝরে পড়ে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। তা ফিরে আসেনা, তেমনি যে ড্যাফোডিল শুকিয়ে যায় তা চিরকালের জন্য নিশ্চিন্ন হয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী শিশির বিন্দু ও ড্যাফোডিলের তুলনায় মানুষের জীবন দীর্ঘই মনে হতে পারে কিন্তু আদি অন্তহীন মহাকালের পটভূমিতে মানুষের জীবন একটা মুহূর্ত মাত্র। মূল কবিতাটি এখানে উপস্থাপন করছি :
To Daffodils
by Robert Herrick
Fair daffodils, we weep to see
You haste away so soon;
As yet the early-rising sun
Has not attain’ d his soon.
Stay, stay
Until the hasting day
Has run
But to the evensong;
And, having pray’d together, we
Will go with you along.
We have short time to Stay, as you,
We have as short a spring;
As qwick a growth to meet decay.
As you, or anything
We die
As your hours do, and dry
Away
Like to the summer’s rain;
Or as the pearls of morning dew,
Ne’er to be found again.
জীবনের ক্ষণিকতাই কবিতাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। সেই সাথে আছে স্বল্প স্থায়িত্বের মধুরতার স্মৃতি-রোমান্থন এবং তা পুনঃপ্রাপ্তির প্রত্যাশার আকুতি। জীবনের এই ক্ষণস্থায়িত্বের মধ্যেই আত্মদর্শনসম্পন্ন মানুষ জীবনের সার্থকতা পূর্ণ করার প্রয়াসী হন। বিশুদ্ধ মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ আত্মজ্ঞ ব্যক্তিই পারেন এই পূর্ণতায় পৌঁছতে। জীবনের সকল সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষা যখন পরহিতে পরিচালিত হয় তখন মানবিকবোধ ও মানবিক চেতনার উদ্ভাসনের মধ্যেই সার্থকতা পায় জীবনের এই ক্ষণিকতার প্রকৃত তাৎপর্য!
আল্লাহর সঙ্গে নির্লোভ সম্পর্ক ও প্রেমের অমর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সুফি জগতের অবিস্মরণীয় নারী দরবেশ হজরত রাবেয়া বসরী (মৃ. ৮০১ খ্রি.)। সুফি জগতের চিরভাস্বর রাবেয়া বসরীর জীবনে উল্লিখিত অসংখ্য ঘটনার একটি এরকম: একবার দেখা গেল তিনি আগুনে কী যেন পোড়াচ্ছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তিনি কী পোড়াচ্ছেন? তিনি উত্তর করলেন— ‘আমি বেহেশত ও দোযখ পোড়াচ্ছি, কেননা লোকে বেহেস্তের লোভে বা দোযখের ভয়ে আল্লাহকে ভালোবাসে। আল্লাহকে আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসতে হবে’। সুফিচেতনায় জীবনের লাভ লোকসান তথা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন সাধনা নেই। হৃদয়ের অন্তস্থিত উত্থিত নিঃস্বার্থ প্রেমই এই চেতনার মৌলিক মহিমা। এখানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন লেনদেন নেই- প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সকল যুক্তি এখানে নিষ্ক্রীয় হয়ে যায়- কেননা, যখন হৃদয়ে প্রেম প্রবেশ করে, তখন যুক্তি বের হয়ে যায়। ইংরেজি প্রবাদ বাক্যে আছে : When love is in, Reason is out ।
ইংরেজি সাহিত্যে খ্যাতিমানদের মধ্যে অধিকাংশের রচনায় মরমিচেতনা (Mystic Consciousness) বিদ্যমান। বাঙালি পাঠকদের কাছে উইলিয়াম শেকপিয়র (William Shakespear 1564-1616), জন ডান (John Donne 1572-1631), হেনরী ভন (Henry Vaughan 1621-1695 ), আলেকজান্ডার পোপ ( Alexander Pope 1688-1744 ), জন কীট্স (John Keats 1795-1821), উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ (William Words Worth 177০-185০), স্যামুয়েল টেইলর কোলরীজ (Samuel Taylor Coleridge 1772-1834), লর্ড বায়রণ (Lord Byron 1788-1824), পার্শি বিশী শেলী ( Percy Bysshe Shelley 1792-1822), আলফ্রেড টেনিসন (Alfred Tennyson 18০9-1892), ম্যাথু আর্নল্ড (Matthew Arnold 1822-1888), জোসেফ কনরাড (Joseph Conrad 1857-1924), উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (William Batler Yeats 1865-1939) প্রমুখ কবি স্মরণীয় হয়ে আছেন। এদেঁর লেখা ছাত্রপাঠ্য সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে এঁরা বেশি পরিচিত। এঁদের বাইরেও রয়েছেন অনেক খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক। যারা সরাসরি সুফিবাদ বা মরমিবাদে আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষত জার্মান কবি যোহান ভোল্গা ফন গ্যেটে (Johann Wolfgong Von Goethe 1749-1832) রচিত Mohometi Gesang (মহম্মদের গান), রাশিয়ান ঔপন্যাসিক War and Peace খ্যাত কাউন্ট লিও টলস্টর (Count Leo Nikolaevich Tolstoy 1828- 191০) রচিত ‘How Much Land Does a Man Requir?’ (একজন মানুষের কতটুকু জমির প্রয়োজন?), ব্রহ্মবিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেন্নাইয়ের থিওসোফিক্যাল সোলাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মিসেস অ্যানি বেশান্ত (Mrs. Annie Besant 1847-1933) রচিত Beauties of Islam, হজরত মহম্মদ (স.) এর আদর্শভক্ত আইরিশ ঔপন্যাসিক জর্জ বার্নাড শ’ (George Bernard Shaw 1856-195০)-মৃত্যুকালে যাঁর কোটের পকেটে পাওয়া যায় আবদুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী প্রণীত Sayings of Mohammad (S) (মহম্মদের বাণী) নামের পুস্তিকা-এঁরা ধর্মপ্রাণ পাঠকের কাছে আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
সুফিদর্শনে মানব ঐক্য ও সমন্বয়ী চেতনা
পাশ্চাত্য পণ্য সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকেরা ইসলামের একাংশকে মৌলবাদ আখ্যা দিয়ে অন্য রক্ষণশীল অংশকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববাজারে তুলে ধরছে। কিন্তু ইসলামের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, প্রগতিশীল সাম্যচেতনার সংস্কৃতি তেমন গুরুত্ব বা প্রচার পায় না। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি আরব-পারস্য-ইরাক-মিশর-স্পেনে সভ্যতার বিচিত্র বিকাশ ঘটেছিল। তারা গ্রিক দর্শন-সংস্কৃতিকে খ্রিষ্টানদের অগ্নিদাহ থেকে রক্ষা করেছিলেন। সমস্ত ধর্মগোষ্ঠীর মত ইসলামেরও রক্ষণশীলতা এবং প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্ব ছিল। ভিন্ন দেশকালে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের শিক্ষা-সংস্কৃতি- ভাষা-দর্শন চেতনা, ইসলামি পরিমণ্ডলে সুফি-অভিধায় চিহ্নিত হয়ে আছে। ভারতে রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি দেশজ উপাদান নিয়ে বহু সুফি গান লিখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের লায়লা-মজনু প্রভৃতি প্রেমকাহিনি ইসলামের পূর্বযুগের। যে সুফিরা এ- সমস্ত গান লিখেছেন, সাহিত্য রচেছেন, তারা নিজেদের মুসলমান বলেই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশে ধর্মান্ধদের পীড়নে একশ্রেণির মানুষ শরিয়তের বিধিবিধান অগ্রাহ্য করে ইসলামের লক্ষণ-রেখা পার হয়ে নিজেদের ফকির-দরবেশ বলেছেন। অনেকে আরও এগিয়ে তৃতীয় সমাজভুক্ত বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। হিন্দুসমাজে ভেক-সন্ন্যাস নিয়ে বহু মানুষ বর্ণাশ্রমের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশে লালন-রাধারমণ, দুদ্দু-পাঞ্জু, হাসনরাজা-জালাল- শাহ আবদুল করিম, মাইজভাণ্ডারী, মনসুর রশিদ, শাহ্ সুফি সদরউদ্দিন আহমেদ চিশতী প্রমুখ সাধকের সাধনক্ষেত্র। তাঁরা সবাই প্রচলিত শরিয়ত থেকে ইসলামকে ভিন্নরূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মানব ঐক্য রচনায় এঁদের অবদান সর্বাগ্রগণ্য। কেননা কোন শরিয়তি বিধানই সুফিচেতনার ন্যায় এমন উদারজমিন রচনা করতে পারেনি— যা করেছেন সুফিরা। একারণে ভারতীয় উপমহাদেশে সুফিদর্শন তথা সুফিসাহিত্য এই জনপদে সম্প্রীতি সম্প্রসারণে এবং মানব ঐক্য রচনায় সুফিবাদচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রখ্যাত সুফি কবি আমীর খসরু (র.) (১২৫২-১৩২৫) তাঁর দিওয়ানে বলেন-
মন তু শোধম তু মন শোধি তা কস না গোয়েদ বাদ আর্জি
মন তন শোধম, তু জান শোধি মন দিগরম তু দিগরি
‘অর্থাৎ- ‘আমি হলাম তুমি, তুমি হলে আমি, আমি হলাম শরীর, তুমি হলে প্রাণ- যাতে লোকে না বলে আমি একজন, আর তুমি অন্যজন।’ ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন : বাদশা আকবর গজলটি খুব পছন্দ করতেন।
সুফিদর্শনে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও সুফিবিশ্ব
রুমির রহস্যময় জগতের পরিসীমা তথা সুফিবিশ্বের চিন্তার পরিধি উপলব্ধি করতে আমরা তাঁর ইংরেজি অনুদিত ‘Egypt That Does Not Exist’ (মিশর প্রতিভাত হতে পারে নি) কবিতাটির স্মরণ নিতে পারি:
The Prophet said, “There are some who see me
by the same light in which I am seeing them.
Our natures are one.
Without reference to any strands
of lineage, without reference to texts or traditions,
we drink the life-water together.”
Here’s story
about that hidden mystery:
The Chinese and the Greeks
were arguing as to who were the better artists.
The King said,
“We’ll settle this matter with a debate”.
“The Chinese began talking,
but the Greeks wouldn’t say anything.
They left.
The Chinese suggested then
that they each be given a room to work on
with their artistry, two rooms facing each other
and divided by a curtain.
The Chinese asked the king
for a hundred color, all the variations,
and each morning they came to where
the dyes were kept and took them all.
The Greeks took no colors.
“They’re not part of our work.”
They went to their room
and began cleaning and polishing the walls. All day
every day made those walls as pure and clear
as an open sky.
There is a way that leads from all-colors
to colorlessness. Know that the magnificent variety
of the clouds and the weather comes from
the total simplicity of the sun and the moon.
The Chinese finished, and they were so happy.
They beat the drums in the joy of completion.
The king entered their room,
astonished by the gorgeous color and details.
The Greeks then pulled the curtain dividing the rooms.
The Chinese figures and images shimmeringly reflected
on the clear Greek walls. They lived there,
even more beautifully, and always
changing in the light.
The Greek art is the sufi way.
They don’t study books of philosophical thought.
They make their loving clearer and clearer.
No wanting, no anger. In that purity
they receive and reflect the images of every moment,
from here, from the stars, from the void.
They take them in
as though they were seeing
with the lighted clarity
that sees them.
এ কবিতার বাংলা ভাবার্থ এরকম :
নবিজি (স.) বললেন-
‘এমন কিছু ব্যক্তি আছে যারা আমাকে সেই আলোয় দেখে
যেই আলোয় আমি তাদের দেখি।
আমরা প্রকৃতিগতভাবে এক।
কোন বংশীয় সূত্র ছাড়া, কোন পাঠ্যসূত্র বা প্রথাবিহীন অবস্থায়
আমরা একসাথে জীবন সুধা পান করি’
এই গোপন রহস্য সম্পর্কে এখানে একটি গল্প আছে:
চীনা ও গ্রিকরা এই বিষয়ে বিতর্ক করছিল যে কে সর্বোত্তম শিল্পী?
রাজা বললেন- ‘এর নিষ্পত্তি আমরা বির্তকের মাধ্যমে করব’
চীনারা কথা বলা আরম্ভ করল,
কিন্তু গ্রিকরা নিশ্চুপ থেকে প্রস্থান করল।
চীনারা প্রস্তাব দিল যে,
তাদের উভয়কে পৃথকভাবে একটি মুখোমুখি অবস্থানরত কক্ষ দেয়া হোক
তাদের সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করবার জন্য, যা একটি পর্দা দিয়ে বিভক্ত থাকবে।
(যাতে এরা না দেখে ওরা কী করছে, ওরা না দেখে এরা কী করছে)।
চীনারা রাজার কাছে সকল ধরনের, শত রকমের রঙ চাইল,
এবং প্রতি সকালে তারা যথাস্থানে এসে সকল রঙ নিয়ে যেত।
গ্রিকরা কোন রং নিল না।
তাঁরা বলল ‘এগুলো আমাদের কাজের অংশ নয়।
তাঁরা তাদের কক্ষে যেয়ে সমস্ত দেয়াল পরিষ্কার এবং পালিশ করা শুরু করল।
প্রতিদিন, সারাদিন ধরে তাঁরা দেয়ালগুলোকে খোলা আকাশের মতো স্পষ্ট
ও নিখাদ করে তুলল। এই পদ্ধতিতে তাঁরা সকল রঙকে রংহীন অবস্থায় নিয়ে যায়।
(গ্রিকরা বলল) জেনে রাখো যে মেঘের এবং আবহাওয়ার অপূর্ব
বৈচিত্র্যের উৎপত্তি চাঁদ ও সূর্যের সরলতা থেকে।
চীনারা কাজ শেষে অত্যন্ত খুশি। ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দ ও উদ্যাপন করছে।
রাজা কক্ষে এলেন, বিস্মিত, বিমুগ্ধ হলেন বাহারি রঙের মেলা ও খুঁটিনাটি দেখে।
গ্রিকরা কক্ষ বিভাজনকারী পর্দা উন্মোচন করল।
গ্রিকরা কক্ষ এত ঝকঝকে করে পরিষ্কার করেছে যে, চীনাদের দেয়ালের
ছবির প্রতিচ্ছবি গ্রিকদের দেয়ালে গিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মিরর রিফ্লেকশন হয়েছে।
গ্রিক শিল্প সুফি ঘরানার। তারা দর্শন ভাবনার পুস্তক পড়ে না।
তারা তাদের ভালোবাসাকে করেছে স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর।
নেই কোন চাওয়া, নেই কোন ক্রোধ।
এই পবিত্রতা ধারণ করার মাধ্যমে তারা প্রতি মুহূর্তের বাণী ধারণ এবং প্রতিফলন করে,
এখান থেকে, নক্ষত্ররাজি থেকে, শূন্য থেকেও। তারা তা গ্রহণ করে
যেন তারা দেখছে সেই আলোকিত স্পষ্টতার নিরিখে যা তাদের দেখছে।
এই কবিতায়, রহস্যময়ী রুমি, মিরর রিফ্লেকশনের পদ্ধতিটাই সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। অত্যন্ত সহজবোধ্য এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি যা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও পরিলক্ষণ করি। এটা সবাই জানি, যে আয়নার উপরিভাগ যতটা পালিশ করা, ততই উন্নত হয় তার প্রতিচ্ছবি। কবিতায় গ্রিক শিল্পের উদাহরণ দিয়ে রুমি জোর দিয়েছেন, সুফিদের হৃদয় অত্যন্ত পরিষ্কার ও উজ্জ্বল। নির্মল হৃদয়ের সুফিরা সেই হৃদয়ে ধারণ করতে পারে সব কিছু। তাঁরা বাণী গ্রহণ করে এখান থেকে, নক্ষত্র থেকে, শূন্য থেকে এমনকি সবখান থেকে।
প্রকৃতপক্ষে এই কবিতায় রুমি যা বলতে চেয়েছেন তাঁর অন্তর্নিহিত দর্শন হল: আত্মা যদি শুদ্ধ হয়, হৃদয় যদি ঝকঝকে আর পরিশোধিত হয়, একটি স্বচ্ছ কাচের আয়নার মতো হয়, তাহলে সেখানে ঐশী বারতা আসবে। তাই আমাদের নতুন নতুন মেসেজ পাওয়ার জন্য চাই একটি বিশুদ্ধ অন্তর। এ মেসেজ আসতে পারে যে কোন জায়গা থেকে (message may come from here, from the stars, from the void) নক্ষত্র থেকে, এমন কি শূন্য থেকেও। সুফিতত্ত্বে একে বলা হয় ‘লতিফায়ে খলা’। আধ্যাত্মিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে লতিফায়ে খলার দেহস্থিত শূন্যস্থান ধারণা একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা। বিশিষ্ট সুফি ইমামুত তরিকত আল্লামা শায়খ সায়্যিদ বোরহানুদ্দীন উয়েসীর (র.) ‘তরিকায়ে আহমদিয়া’ নামে একটি স্বতন্ত্র তরিকার ইমাম। এই স্বতন্ত্র তরিকা মানবদেহের একাদশতম লতিফা লতিফায়ে খলা’র (শূন্যস্থান) সন্ধান দিয়েছেন। মানব দেহে যে সকল স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল অংশ যিকির এর সময় উদ্দীপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বলোকের সংগে সংযোগ স্থাপন করে তাকে বলে লতিফা। ‘তরিকায়ে আহমদিয়া’র বক্তব্য অনুযায়ী মানবদেহের অভ্যন্তরীণ ফাঁকা স্থান আছে যেখানে লতিফায়ে খলা’র অবস্থান। ( Dr. M. Shamsher Ali, Scientific Indication in the Holy Qur’an, Bangladesh Islamic Foundation, 2014 )।
মাওলানা রুমি প্রবর্তিত ‘সামা নৃত’ বা ‘ঘূর্ণি নৃত্য’ (Whirling Dance) পশ্চিমা দেশে যা এখন Whirling Darwish Dance (নৃত্যপর দরবেশ) নামেও পরিচিত। মহাজাগতিক ঘূর্ণায়মান এই নৃত্যশৈলী নিয়ে সুফিরা অনেক গবেষণা করেছেন। তাঁরা কা’বা শরিফ ঘূর্ণিতে (তাওয়াফ) যে তাৎপর্য-এই সুফিনৃত্যেও সেই তাৎপর্যই খুজেঁ পান। কোরআনে আছে, সমগ্র সৃষ্টিই মহাজাগতিক আন্দোলনের সন্তরণে রত। এই সন্তরণ নৃত্যভঙ্গিমায় যুক্ত। রুমির এই ঐশীশান্তি নৃত্য ভঙ্গিমা আর সনাতন শাস্ত্রের মহাকালের দেবাদিদেব মহাদেব (King of Kings ) নটরাজের প্রলয়নৃত্য ভঙ্গিমাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়! রুমির দরবেশি নৃত্য অনন্ত অসীমের পানে ধাবমান। প্রথমে স্রষ্টার শানে হামদ ও রাসুলের শানে না’ত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এই নৃত্যের সূচনা। তারপর চন্দ্রতারকার ঘূর্ণমান অস্তিত্বের সঙ্গে সাজুয্য রেখে ঊর্দ্ধে উদ্ধাহু অনন্ত অসীমকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা। সুফি দর্শনে বলা হয় সমস্ত ঐশী জগতে চলছে মহানৃত্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি নৃত্যের পারমানবিক জগৎ। পদার্থের অন্তর্নিহিত গতিময় চরিত্র যাতে প্রকাশিত পরমাণুর উপাদান। এটাই মহাবিশ্বের পারস্পরিক গতিময় আন্তঃক্রিয়ার অবিরাম সৃষ্টি ও ধ্বংসের ছন্দবন্দ সংগীত!
পারস্যের ফেরদৌসী (৯৪১-১০২৫ খ্রি.), খৈয়াম (১০৪৮-১১২৫ খ্রি.), রুমি (১২০৭-১২৭৩ খ্রি.), সা’দী (১২০৯-১২৯১ খ্রি.) ও হাফিজ (১৩২০-১৩৯০ খ্রি.) বিশ্বসাহিত্যে সুপরিচিত নাম। আমাদের বাংলা সাহিত্যের বহু নৈতিক ও মানবিক উপাদানের উৎস এই পারস্য সাহিত্য। মানব ঐক্যের মহান বাণীস্বরূপ জাতি সংঘের প্রধান ফটকে উৎকীর্ণ হয়েছে শেখ সা’দীর গুলিস্তা কাব্যের চারটি পঙ্ক্তি—
Human beings are like parts of a body
(literally : limbs of one another)
as they are created from the same substance.
When the World causes pain to a single part,
the other also cannot be at ease.
You who are indifferent to the sufferings of others,
do not deserve to be called a human being.
অর্থাৎ- একই দেহের অঙ্গীভুত এই মানবজাতি (একে অপরের পরিপূরক), তারা সকলেই একই রক্তমাংসে তৈরি। দেহের একাংশ ব্যাধিগ্রস্ত হলে অপরাংশ যেমন সুস্থ্য রাখা সম্ভব নয়; ঠিক তেমনি কোন মানুষ যদি একে অপরের সমব্যথি না হয়-তবে সে মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত নয়।
বর্তমান বিশ্বে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে Sufism Studies একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (Subject) হিসেবে অধ্যয়ন ও গবেষণার সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর উইলিয়াম সি, চিটিক (William C Chittick) The Sufi Path of Love: The Spiritual Teachings of Rumi (1983) গ্রন্থে সুফিদর্শনের যে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন, তা আজ বিশ্ববলয়ে সুফিবিশ্ব নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বর্তমান সুফিবিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জার্মান বিদূষী অ্যান মেরী শিমেল (Anne Marie Schimmel) তাঁর বিখ্যাত সুফি গবেষণাগ্রন্থ I am Wind, You are Fire (1992) বিশ্বের সুফিমানসে যে প্লাবণ সৃষ্টি করেছে তা আজ ক্রমশ রুমির রহস্য জগৎ আরও উন্মোচিত হয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সুফিবিশ্ব সৃষ্টির দিকেই ধাবমান বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
রুমির সুফিচেতনায় সৃষ্ট এই ‘সামা নৃত্য’ বা ‘ঘূর্ণিনৃত্য’ শৈলীর উৎপত্তির পশ্চাতেও রয়েছে একটি মর্মান্তিক বেদনাবিদ্ধ ঘটনা। রুমির সুফি জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তাঁর ধর্মগুরু শামস তামরিজির সঙ্গে আকস্মিক অলৌকিক সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ ছিল রুমির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এই সম্পর্কই রুমিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি কবিতে পরিণত করতে ভূমিকা রাখে। এই সাক্ষাতেই রুমির সুফি জীবনের আধ্যাত্মিক আলোকিত সোপান চরম উৎকর্ষে পৌঁছে। রুমি ও শামস-এর মধ্যে প্রথম সাক্ষাতের একটি বিবরণ অনুসারে, কোনিয়ার এক চত্বরে ফোয়ারার পাশে বসে রুমি তাঁর মুরিদদের তাঁর পিতার মা’রিফ (আত্মাকে ভালোবাসার কথা) পড়ে শোনাচ্ছিলেন। শামস ভিড় ঠেলে সেখানে প্রবেশ করে বইটি এবং অন্য কাগজগুলো পানিতে ফেলে দিলেন।
‘আপনি কে, আর এটা কী করছেন’? রুমি প্রশ্ন করেন।
‘তুমি যা পড়ছিলে তা আর পড়া উচিত নয়।’
রুমি পানির তলদেশে বইগুলোর দিকে ফিরলেন। ‘আমরা এ গুলো তুলে নিতে পারি। আগে যেমন শুকনো ছিল, এখনও তেমনই আছে’, শামস বললেন।
তিনি একটি তুলে রুমিকে দেখালেন। ঝকঝকে শুকনো।
‘ও গুলো ওখানেই পড়ে থাকুক,’ রুমি বললেন।
এই পরিত্যাগের মধ্য দিয়েই রুমির গভীর জীবনের এবং অধ্যাত্ম চেতনার নতুন দিগন্তের সূচনা। তিনি বললেন ‘আগে আমি আল্লাহ বলতে যা ভেবেছি, একজন মানুষের মাঝে আমি তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করলাম’। ধর্মীয় গুরু হিসেবে তাঁর জীবনের অবসান ঘটলো। তিনি এবং শামস একত্রে মাসের পর মাস ধরে নিভৃতে কাটাতে শুরু করলেন। তাঁদের আধ্যাত্মিক সংলাপ ও রহস্যময় বন্ধুত্ব ক্রমেই গাঢ় বিকশিত হতে থাকে। তাঁদের এই বন্ধুত্বে কিছু লোক ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। শামসকে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারে না এবং তাদের শিক্ষক রুমিকে শিক্ষাদানের কাজ থেকে বিচ্যুত করায় ক্ষুব্ধ হয়। তারা শামসকে দামেসকে চলে যেতে বাধ্য করে, কিন্তু রুমি তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনেন। শেষপর্যন্ত এটা মনে হয় যে, রুমির মুরিদদের কেউ কেউ, এবং সম্ভবত রুমির পুত্র আলাউদ্দিনও তাদের মধ্যে ছিল- তারা শামসকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে। বন্ধুকে হারানোর বেদনায় রুমি তাঁর বাগানে একটি খুঁটিকে প্রদক্ষিণ করতে করতে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন, যে কবিতাগুলো তাঁর দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি গজল গ্রন্থে স্বর্গীয় মিলনের সন্ধানে উচ্চারিত। রুমির এই বিরহ বেদনানাশক খুঁটি প্রদক্ষিণের স্মৃতিবাহি ঘটনা থেকেই রুমি অনুসারি দরবেশদের বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ধ্যানের পদ্ধতি উদ্ভাবন। (Coleman Barks, The Soul of Rumi, Introduction, 2002)। রুমির উদ্ভাবিত দরবেশ বা সুফি তরিকার লক্ষ্য ছিল আত্মাকে উন্মোচন, মিলনের রহস্য আবিষ্কার, ব্যাকুলভাবে সত্য অনুসন্ধান ও সত্য বলার চেষ্টা করা এবং একজন মানুষের মধ্যে অস্তিত্বের মহিমা ও বিঘ্নগুলোকে পর্যবেক্ষণ। রুমির সুফি চেতনার সারমর্ম হল : ‘প্রেমই ধর্ম এবং পৃথিবী একটি গ্রন্থ’। রুমি আজ পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন কেন? পাশ্চাত্যের গবেষকরাই এর উত্তর খুঁজেছেন। তাঁরা মনে করেন, আত্মার সাথে রুমির সৃষ্টির একটি সম্পর্ক আছে। তাঁদের আরও ধারণা, যেহেতু খ্রিষ্টীয় অনুশাসনে ভাবাবেশ সৃষ্টি করার মত উপাদান বাতিল করা হয়েছে— সেজন্যে খ্রিষ্টান প্রধান পাশ্চাত্যে রুমি সেই প্রয়োজন পূরণ করছেন। ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় রুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রুমির দাফনের সময় সকল ধর্মের প্রধান প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতি বছর ১৭ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে তাঁর মৃত্যবার্ষিকী পালন করা হয় স্রষ্টার সাথে তাঁর মিলনের রাত হিসেবে।
‘বহুর মধ্যে এক’–এই দর্শনই পরবর্তীকালে ভারতীয় ঋষি, চিন্তাবিদ এবং মনীষিগণ সমগ্র দেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থার মধ্যে সঞ্চারিত করেন, যার মূল ভাবটি হল ‘বৈচিত্রের মাঝে একত্ব’ (Unity in Diversity)— ‘সমরূপের ঐক্য (Unity not Similarity) নয়। এই দর্শনের উৎস অথর্ব বেদ। এখানে বলা হয়েছে—
জনং বিভ্রতী বহু বিবাচসং নানা ধর্মানাং পৃথিবী যথৌকসম্।
সহস্রং ধারা দ্রবিণস্য মে দুহাং ধ্রুবেব ধেনুরণপস্ফুরন্তি।।
(-দ্বাদশ কাণ্ড, প্রথম অনুবাক, প্রথম সূক্ত, ৪৫ মন্ত্ৰ)।
অর্থাৎ-হে পৃথিবী, নানা ভাষাভাষীর নানা ধর্মমতের বহু মানুষকে তুমি ধারণ করে আছ, গাভী যেমন দুগ্ধের অবিচ্ছিন্ন ধারা প্রদান করে, সেই ভাবে নানা সম্পদের সহস্র ধারা তুমি আমার দিকে প্রবাহিত কর।
নজরুলের একটি কবিতার পঙ্ক্তিতে ঘোষিত হয়েছে— ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম’। এই পক্তির তাৎপর্য হল : ইসলামের নবী হল ‘রহমাতুল্লীল আলামীন’– অর্থাৎ তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ। তাই যদি হয়, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সম্পদ হয়ে থাকতে পারেন না। তাঁর অবদানের শরিক সম্প্রদায়-নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষই। কিন্তু সকলের মধ্যে এ বোধ সঞ্চারের চেষ্টা কি হয়েছে কখনো?
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে জগতের সকল মানব সমাজ একই আচ্ছাদনের অধিবাসী। সকলেই প্রকৃতির একই আলো বাতাসে বর্ধিত ও বিকশিত। মায়া মমতা আবেগ উদ্বেগ ক্ষুধা তৃষ্ণা ব্যথা বেদনার অনুভূতিও সকলের অভিন্ন। ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ ভিতরে সবারই সমান রাঙা’। অর্থাৎ অন্তঃস্থিত মানব অনুভূতির রঙও সবার এক এবং অভিন্ন। তা হলে মানব ঐক্যে অন্তরায় কোথায়? শাস্ত্র না-সমাজ? না-মানবসৃষ্ট বিধান? না, কোন ধর্মগ্রন্থেই মানব বিভাজনের বিধান নেই, আছে ঐক্য ও বিশ্বজনীনতার কথা। আল কোরআনে বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘ওয়ালাউ শায়াল্লাহু লাড়াআলাকুম উম্মাতাওঁ ওয়াহিদাতহ’ (৫ : ৪৮ এর অংশ)। অর্থাৎ ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন।’ কিন্তু তিনি তা করেন নি। কেন করেন নি? কারণ তিনি বৈচিত্র্য পছন্দ করেন। কোরআন আরো বলছে: সুবুলানা ওয়া ইন্নাল্লাহা লামা আল মুহসেনিন’ (২৯ : ৬৯)। অর্থাৎ আল্লাহর পথ একটি নয়, বহু। তবে তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোরআনে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলছেন : ‘লিকুল্লি উম্মাতিন জাআলনা মানছাকান হুম নাছিকুহু ফালা ইউনাযিউন্নাকা ফিল আমরি অদউ ইলা রাব্বিকা; ইন্নাকা লা আলা হুদাম মুস্তাকীম’ (২২ : ৬৭)। দেখা যাচ্ছে, ধর্ম সম্প্রদায়ের ভিন্নতাকে কোরআন মোটেই কোন গুরুত্ব দেয়নি। বৈচিত্রের ভিন্নতার এই মানবাগানের সকল অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে মানুষের বিভ্রান্তি নিরসন করে কোরআনে আল্লাহ নিশ্চিয়তা দিয়ে বলছেন: ‘ইন্নাল্লাজিনা আমানু ওয়াল্লাজিনা হাদূউ ওয়ান্নাসারা ওয়াস্ সাবেঈনা মান আমানা বিল্লাহি ওয়াল ইয়ালমাল আখিরি ওয়া আমিলা সালিহান ফালাহুম আজরুহুম ইন্দা রাব্বিহিম; ওয়ালা খাউফুন আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহজানুন’ (২ : ৬২)।
অর্থাৎ ‘যাহারা বিশ্বাস করে, যাহারা ইহুদী হইয়াছে এবং খৃষ্টান ও সাবেইন- যাহারাই আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে তাহাদের জন্য পুরস্কার তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে। তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না’ (ইফা)। কোরআনে প্রদত্ত আল্লাহর উপরোক্ত প্রতিশ্রুতির আলোকে বলা যায়, যে-কোন বিধান ধর্মের বা সম্প্রদায়ের লোক হোক না কেন, সে যদি বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের উপর ঈমান আনে (বিশ্বাস স্থাপন করে) এবং সৎকর্ম করেন তা হলে নিষ্কৃতি পাবেন। কোথাও কোথাও এই ‘সৎকর্মের’ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও কোরআনে উল্লিখিত আয়াতের মূল উদ্দেশ্য অপরাপর ধর্মানুসারিদের প্রতি কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা স্পষ্ট করা। ভিন্ন ধর্মানুসারিদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে কোরআনে নির্দেশিত ওই ‘সৎকর্ম’ যদি কোন সৎব্যক্তি তার স্বধর্মে নিষ্ঠাবান থেকে সম্পন্ন করে তা হলে কি তিনি কোরআন ঘোষিত ‘পুরস্কার’ পাবেন? এতে যদি কোন ‘আলেম’ আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, ‘অবশ্যই তাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে’- নইলে তিনি ওই পুরস্কার পাবেন না। এই আপত্তি আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধিতা। বস্তুত ওই আয়াত আল্লাহ ‘আমলে সালেহা’ অর্থাৎ সৎ ও শুদ্ধ কর্মের ভিত্তিতে সকল সম্প্রদায়কে সর্বমানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন। রামকে রহিম হতে বলেন নি। *
[* ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সুফি সেমিনারে (২০১৯) পঠিত মূল প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ।]
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
J.B. Bury, A History of Freedom of Thought, Cambridge, 1914.
A. R. Nicholson, Secrets of Self, Cambridge University Press, 1924.
A. J. Arberry, Sufism: An Introduction; London, 1950
R.C. Zaehner, Hindu and Muslim Mysticism; London, 1960
AneeMarie Schimmel, Mystical Dimensions of Islam: The Matyr-Mytic Hallaj in Sindh Folk Poetry; Numeu 9, No. 3, 1962.
Sidney Speneer, Mysticism in World Religion; penguin, 1963
S.K. Chatterjee, Islamic Mysticism, Iran and India; Peoples Publishing House, New Delhi, 1972.
R. A, Nicholson, The Mystics of Islam; New York, 1975
Muhammad Enamul Huq, A History of Sufism in Bengal; Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka, 1975
G. Parrinder, Mysticism in the World Religion; London, 1976
T.W. Arnold, The Preaching of Islam, Oxford University Press, 1896.
Allama Dr. Mahammad Iqbal, The Reconstruction of Religious Thoughts in Islam; Islamic Academy, East Pakistan, 1957 (2nd Edition) Islamic Foundation, Bangladesh, 1981
S.A.A,A Rizvi, History of Sufism in India; Vol, I, II, Munshiram Monoharlal Publisher’s Pvt. Ltd, New Delhi, 1978, 1983
W.C. Chittick, The Sufi Path of Love: The Spiritual Teachings of Rumi; Albany, New York, State University of New York Press, 1983
AnneMarie Schimmel, I am Wind, You Are Fire: The Life and Work Rumi; Boston, Massachusetts, Shambhala Publicatios, 1992
Shabram Star, Jonathan and Shiva, A Garden Beyond Paradise : The Mystical Poetry of Rumi; Bantam Books, New York, 1992
Coleman Barks, The Soul of Rumi; Harper San Francisco, 1995
Lewellyn Vaughan Lee, Love is a Fire and I am Wood: The Sufis Mystical Journey Home; Sounds True Recordings, 1998
Kamala K Kapur, Pilgrimage to Paradise : Sufi Tales from Rumi; Penguine Books, India 2009
Mohammad Abdul Hye, The Trancendental Travel to Iran; Al Doha International, Tehran, 2012
গোলাম সাকলায়েন, পূর্ব পাকিস্তানের সুফি সাধক; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৬১
ড. আবদুল করিম, সুফিবাদ ও আমাদের সমাজ; নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ১৯৬৯
আহমদ শরীফ, বাংলার সুফি সাহিত্য; বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৬৯
কাজী দীন মহম্মদ, সুফীবাদের গোড়ার কথা; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা ১৯৭৭
আ ন ম বজলুর রশজীদ, আমাদের সুফি সাধক; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা ১৯৭৭
ফকির আবদুর রশীদ, সুফী দর্শন; প্রোগ্রেসিভ বুক কর্ণার, ঢাকা ২০০০
ওসমান গণি, ইসলাম জগৎ ও সুফি সমাজ; মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ২০০২
মাহমুদা খানম, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে হিন্দী সুফি কাব্যের প্রভাব; বাংলা একাডেমী ঢাকা, ২০০৩
সৈয়দ রশীদ আহমদ জৈনপুরি, কোরআন, হাদীস ও সুফিতত্ত্বের ভূমিকা; সৈয়দ রশীদ আহমদ মিশন ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০৬
আবদুল মালেক নূরী, সুফিবাদ; অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, দ্বি. সং., ঢাকা, ২০০৮
মুস্তাফা জামান আব্বাসী, রুমির অলৌকিক বাগান; মুক্তদেশ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০
সদর উদ্দিন আহমদ চিশতি, কোরআন দর্শন (১ম-২য় খণ্ড), সদর প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ২০১১
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, জালাল উদ্দীন সুফিদর্শন ও তরিকা প্রসঙ্গে; আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০১৩
মোহাম্মদ তফিজ উদ্দিন কাদেরী, সুফিবাদ ও আত্মদর্শন; রোদেলা, ঢাকা প্র. প্র. ২০১৩ দ্বি.প্র. ২০১৭
ড. শামসুল ইসলাম লতিফী, ইসলাম ও সুফীবাদ; সুন্নী প্রকাশন, ঢাকা, প্ৰ. প্র. ২০১৮
ড. মোহাম্মদ গোলাম রসূল, সুফীতত্ত্বের ইতিকথা, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, প্র.প্র. ২০১৮
প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, বঙ্গে সুফি প্রভাব ও সফিতত্ত্বের ক্রমবিকাশ; রোদেলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৮
মোবারক করীম জওহর, ভারতের সুফী (১ম, ২য় খণ্ড); করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১৮
শরদিন্দু ভট্টাচার্য, বাউল বৈষ্ণব সুফী; রোদেলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৯
শক্তিনাথ ঝা, সুফি: মদিনা থেকে মহাস্থানগড়; রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৯
পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য, সুফীতত্ত্বের উৎসসন্ধানে; নালন্দা, ঢাকা. ২০20।
মোহাম্মদ আবুল খায়ের, সুফিসাধনা : তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ; জিনিয়াস পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০২০
মোহাম্মদ আবুল খায়ের, সুফিকোষ; জিনিয়াস পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০২১
এসএমএ খালেক, সুফিদর্শনে আত্মদর্শন; রোদেলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০২১
আবদুল করিম, বাংলার সুফিসমাজ ও বার আউলিয়া; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০২১
রেজা মাহবুব চিশতী, সুফিবাদে বিকৃত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ; লালন বিশ্বসংঘ, ঢাকা, ২০২১