১৬. সাহেবী সমাজ

সাহেবী সমাজ

সাহেবরাই কলকাতা শহরকে গড়ে তুলেছিল। সুতরাং গোড়া থেকেই এটা সাহেবদের শহর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দে কলকাতায় ১২০০ ইংরেজ বাসিন্দা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৪০০০। কিন্তু তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ জন। সুতরাং যে সমাজে পুরুষের তুলনায় মেয়েছেলে কম থাকে, সে সমাজে যা ঘটে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। ইংরেজদের যৌন চরিত্রের মান খুব উচ্চস্তরের ছিল না। অধিকাংশ ইংরেজই তাদের যৌনক্ষুধা মেটাতো এদেশী মেয়েদের মাধ্যমে। সাহেবদের এরূপ এদেশী ঘরাণীদের ‘বিবিজান’ বলা হত।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাহেবরা যখন কলকাতায় বসবাস শুরু করে। তখন তারা ছিল মিতব্যয়ী ও খুব সংযমী। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিশেষ করে পলাশী যুদ্ধের পর তার হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিলাসপরায়ণ। তখন কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে ‘নবাব’ হবার বাসনা জেগে ওঠে। তারা অবৈধ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপায় করত। উৎকোচ গ্ৰহণ করা কোম্পানির উচ্চস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে বিশেষভাবে প্ৰচলিত ছিল। যুগের হাওয়া অনুযায়ী কোম্পানির নিম্নস্তরের কর্মচারীরাও অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে এক একজন খুদে নবাব হয়ে উঠেছিল। সে যুগের পাদরী, ডাক্তার, অ্যাটনী প্রভৃতির দক্ষিণাও ছিল অসম্ভব। এ সব সাহেবদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল নানারকম দাসদাসী রাখা। এ ছাড়া, সাহেবদের ক্রীতদাস ছিল। অনেক সাহেবের আবার এদেশী ঘরাণীও ছিল। (সাহেবদের এদেশী ঘরণী সম্বন্ধে লেখকের ‘কলকাতার চালচিত্ৰ’, পৃষ্ঠা ১৪-১৯ দ্রষ্টব্য)।

সস্তাগণ্ডার বাজার ছিল বলে সাহেবরা বেশ গাণ্ডেপিণ্ডে খেত। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে খাদ্যসামগ্রীর দাম ছিল–একটা গোটা ভেড়া দুটাকা, একটা বাচ্চা ভেড়া এক টাকা, ছয়টা ভাল মুরগী বা হাঁস এক টাকা, এক পাউও মাখন আট আনা, ১২ পাউণ্ড রুটি এক টাকা, ১২ বোতল বিলাতী ক্লারেট মদ ৬০ টাকা ইত্যাদি।  সাহেবরা দিনে তিনবার খেত। সকালে প্রাতরাশ। যার যা খুশী খেত, এবং পরিমাণের হিসাব থাকত না। তারপর দুটার সময় মধ্যাহ্ন ভোজন (পরবর্তী কালে এটা একটার সময় খাওয়া হত, এবং এটাকে ‘টিফিন’ বলা হত)। মধ্যাহ্নভোজনে যত পারত খেত ঝলসানো ও কষা মাংসের পদ। তা ছাড়া মুরগী বা হাঁসের মাংস, নানারকম শাকসবজী, আলু ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল মদ্যপান করার ধুম। প্ৰতি মেয়েছেলে দিনে এক বোতল ও পুরুষরা চার বোতল মদ খেত, মধ্যাহ্নভোজনের পর সকলেই এক ঘুম ঘুমিয়ে নিত। সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবার পালা পড়ত। তারপর ছিল সান্ধ্যভ্রমণ। বাড়ী ফিরে রাত দশটার সময় সান্ধ্যভোজনের পালা। এটাতেও রীতিমত চর্ব্য, চোষ্য, লেহ, পেয় সবই থাকত।

যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন হয়েছিল, তা হলেও সাহেবরা পালকি চড়েই যাতায়াত করত। বস্তুতঃ কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর সাহেব-মেমেরা দু’টো জিনিষ রপ্ত করে নিয়েছিল। একটা পালকি চাপা ও আর একটা হুকোয় তামাক খাওয়া।

মেয়েছেলে নিয়ে সে যুগে সাহেবদের প্রায়ই লড়াই হত। একে ‘ডুয়েল’ বলা হত। শুধু মেয়েছেলে নয়, কোন বিবাদ-বিসস্বাদও ডুয়েলের মাধ্যমেই মীমাংসিত হত।

আবার কোন কোন সাহেব এদেশে থেকে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে হিন্দু স্টুয়ার্ট (মেজর জেনারেল চার্লস স্টয়ার্ট) প্ৰসিদ্ধ। তিনি প্ৰত্যহ পদব্রজে গঙ্গাস্নান করতে যেতেন ও ব্ৰাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে শালগ্ৰাম শিলার পূজা করাতেন। তার বাড়ীতে বহু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ছিল।

দুই

ওয়ারেন হেস্টিংস তার এক বন্ধুকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে তিনি কলকাতাকে এশিয়ার এক বিশিষ্ট শহরে পরিণত করতে চান। হয়ত সাহেবদের শহর হিসাবে তিনি কলকাতার মানকে অনেকটা উন্নত করেছিলেন, কিন্তু কলকাতার বেশীর ভাগ উন্নতি হয়েছিল তার পরে। তার আমলে যে সকল উন্নতি হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল শহরের ময়লা পরিষ্কারের ব্যবস্থা, ডাকের প্রবর্তন, স্থলপথে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাবার ব্যবস্থা, ব্যাঙ্ক ও ইনসিওরেন্স কোম্পানি স্থাপন, সওদাগরী অফিসের উদ্ভব, ক্রিকেট ও ঘোড়দৌড়ের প্রবর্তন, ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন, থিয়েটার স্থাপন, সংবাদপত্রের প্রচলন, প্ৰাচ্যবিদ্যা অনুশীলনের জন্য এসিয়াটিক সোসাইটি প্ৰতিষ্ঠা ও বাংলা হরফের সৃষ্টি। এর মধ্যে বাংলা হরফের সৃষ্টিই উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের পথ সুগম করেছিল। বাংলা হরফের সৃষ্টি ও ছাপাখানার প্রসার সম্বন্ধে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করছি। আর অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিশদ বিবরণের জন্য পাঠক আমার ‘কলকাতা : পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস’ বইখান। দেখে নিতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *