১৬. সাজ্জাদ হোসেন

১৬

রাত আটটা।

সাজ্জাদ হোসেন অফিসের টেবিলেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছেন। গত রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। দিনের বেলায়ও ঘন্টাখানেকের মতো শোবার সময় পাওয়া যায় নি। এবং খুব সম্ভব আজ রাতটাও তাঁর জেগেই কাটবে। লোহার রড হাতের সেই নগ্নগাত্র আগন্তক তাঁর সর্বনাশ করে দিয়েছে। পুলিশ-বাহিনীর নাকের ডগায় আরেকটি খুন হয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! একটি লোক রোজ রাতে লোহার রড হাতে একই জায়গায় ঘোরাঘুরি করবে, অথচ তাকে ধরা যাবে না–এটা কেমন কথা!

‘স্যার, আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।’

সাজ্জাদ হোসেন টেবিল থেকে মাথা তুললেন। তাঁর অর্ডারলি দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটির কি কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? তাকে বলে দিয়ে এসেছেন, যেন কিছুতেই আগামী দু’ ঘন্টার মধ্যে তাঁকে ডাকা না হয়। অথচ দশ মিনিট পার না-হতেই ব্যাটা ডাকতে এসেছে। তিনি বরফশীতল গলায় বললেন, ‘বল আমি নেই।’

‘স্যার, আমি বলেছি যে আপনি আছেন।’

‘তাতে অসুবিধা নেই। এখন গিয়ে বল যে, আমার আগের কথাটা ঠিক না। উনি আসলে নেই, কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না।’

‘স্যার, উনি এক জন সাংবাদিক। পত্রিকা অফিস থেকে এসেছেন।’

সাজ্জাদ হোসেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। সাংবাদিকদের বিরাগভাজন হবার মতো সাহস তাঁর নেই। পত্রিকায় দীর্ঘ আর্টিকেল বের হয়ে যাবে–’পুলিশ অফিসারের দুর্ব্যবহার।’

‘আসতে বল, আর শোন–দু’ কাপ চা দিতে বল।’

সাংবাদিক ভদ্রলোকের নাম মীরউদ্দিন। ভদ্রলোক শুধু যে পেশায় সাংবাদিক তাই নয়–চেহারায়, পোশাকে, এমনকি হাবেভাবেও সাংবাদিক। প্রশ্নের ধরন ডিটেকটিভের মতো। প্রতিটি বাক্যের শেষে একটি খোঁচা আছে, যা ঠিক সহ্য করা মুশকিল। সাংবাদিক, কাজেই সহ্য করতে হবে। এবং কিছুতেই চটানো যাবে না। মীরউদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল যে, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নগ্নগাত্র বিভীষিকা’– এই শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপবে। কাজেই পুলিশের বক্তব্যটি শোনবার জন্যে তিনি দয়া করে এখানে তশরিফ রেখেছেন।

‘আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?’

‘না, নেই। প্রশ্ন করুন।‘

‘নগ্নগাত্র ব্যক্তিটি প্রসঙ্গে আপনার কী ধারণা?’

‘তেমন কোনো ধারণা নেই। পাগল-টাগল হবে আর কি।’

‘তাকে পাগল বলার পেছনে আপনার যুক্তি কী?’

‘একটাই যুক্তি—কোনো সুস্থ মাথার লোক একটা লোহার রড নিয়ে খুনখারাবি করে বেড়ায় না।’

‘কেন, সুস্থ লোকও তো খুনখারাবি করে।’

‘তা করে, কিন্তু তার পেছনে কোনো মোটিভ থাকে। এর কাণ্ডকারখানার পেছনে কোনো মোটিভ নেই।’

‘বুঝলেন কি করে, মোটিভ নেই? হয়তো মোটিভ আছে, আপনারা ধরতে পারছেন না।’

সাজ্জাদ হোসেনের বিরুক্তির সীমা রইল না। এ তো মহা ত্যাঁদড়ের পাল্লায় পড়া গেল! জ্বালিয়ে মারবে মনে হচ্ছে।

‘নগ্নগাত্রকে নিয়ে পুরানা পল্টন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা কি আপনি জানেন?’

‘না, জানি না। কী গুজব?’

‘সেটা আপনি নিজেই কষ্ট করে জেনে নেবেন। কারণ পুলিশের উচিত শহরের চালু গুজবগুলোর প্রতি লক্ষ রাখা। কি, উচিত না?’

সাজ্জাদ হোসেন জবাব দিলেন না। এই লোকের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।

‘এখন আপনি দয়া করে বলুন, লোকটিকে ধরবার ব্যাপারে পুলিশবাহিনী কি চড়ান্ত রকমের ব্যর্থতার পরিচয় দেয় নি?’

‘না। ধরবার চেষ্টা হচ্ছে, শিগগিরই ধরা পড়বে। হয়তো আজ রাতেই ধরা পড়বে।’

‘আচ্ছা, বিদেশে অপরাধীকে ধরবার জন্যে টেণ্ড পুলিশ-কুকুর আছে, এরা গন্ধ শুঁকে শুঁকে অপরাধীকে বের করে ফেলে। এখানে এমন কিছু নেই?’

‘না, নেই। কারণ এটা বিদেশ নয়, বাংলাদেশ।’

‘কিন্তু বাংলাদেশে তো পুলিশবাহিনীর একটা মাউন্টেড রেজিমেন্ট আছে। যার প্রতিটি ঘোড়া লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে কেনা। অপ্রয়োজনীয় ঘোড়ার পেছনে এত টাকা খরচ না করে দু’-একটা শিক্ষিত কুকুর কি কেনা যায় না?’

‘আমাকে এ সব বলছেন কেন ভাই? আমি সামান্য ব্যক্তি। এ সব কর্তাব্যক্তিদের বলেন।’

‘আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। উচিত কি উচিত না।’

‘উচিত তো বটেই।’

সাজ্জাদ হোসেন উঠে পড়লেন। শুকনো গলায় বললেন, ‘আমার ডিউটি আছে। আর থাকতে পারছি না।’ এই সাংবাদিকের সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটালে প্যাচে পড়ে যেতে হবে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। আজকের ইন্টারভ্যু দিয়েই তাঁর ভয়ভ লাগছে, না-জানি কী ছাপা হয়। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। চাকরি বাঁচিয়ে চলা ক্রমেই মুশকিল হয়ে পড়ছে।

.

সাজ্জাদ হোসেন জীপ নিয়ে খানিকক্ষণ একা একা পুরানা পল্টন এলাকায় ঘুরলেন। তারপর খুঁজে বের করলেন মিসির আলির বাড়ি।

এটা সেই বাড়ি, যা ‘নগ্নগাত্র’ এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। তাঁর জানা ছিল না। মিসির আলির সঙ্গে এর পরেও তাঁর দেখা হয়েছে, কিন্তু মিসির আলি এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। যেন এটা বলার মতো কোনো ব্যাপার নয়। অথচ মিসির আলিকে দু’-তিন বার স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে। এক জন ইনভেসটিগেটিং অফিসার এসে সব দেখেশুনে গিয়েছে। যথেষ্ট হৈচৈ করা হয়েছে এটা নিয়ে। অন্য যে-কেউ হলে প্ৰথম সুযোগেই ঘটনাটা বন্ধুবান্ধবদের বলত। মিসির আলি বলেন নি। লোকটি কি ইচ্ছে করেই নিজেকে আলাদা প্রমাণ করবার জন্যে এ-রকম করে?

সাজ্জাদ হোসেন কড়া নাড়লেন। মিসির আলি ঘরেই ছিলেন। তিনি দরজা খুললেন। সাজ্জাদ হোসেনকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, তিনি যেন বন্ধুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।

সাজ্জাদ হোসেন বললেন, ‘খবর কি তোর?’

‘ভালো।’

‘খোঁজ নিতে এলাম টিকে আছিস, না নগ্নগাত্র এসে তোকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে।’

‘না, এখনো বানায় নি।’

‘তোর ‘ইমা’র পাত্তা এখনো লাগাতে পারি নি। পারলেই জানবি।’

‘পারার সম্ভাবনা কী রকম?’

‘কম। খুবই কম। ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবি? খুব ঠাণ্ডা।’

‘ঠাণ্ডা পানি হবে না। ঘরে ফ্রীজ নেই।’

‘বাড়িওয়ালার ঘরে নিশ্চয়ই আছে। তোর ইমাকে পাঠিয়ে দে না, নিয়ে আসুক। ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।’

মিসির আলি ইমাকে পাঠালেন না। নিজেই ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে এলেন। সাজ্জাদ হোসেন টেবিলে পা তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। দেখলেই মায়া লাগে। লোকটির ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ‘চা খাবি?’

‘না। তোর সোফায় ঘন্টাখানিক শুয়ে থাকব।’

‘সোফায় কেন? বিছানায় শুয়ে থাক।’

সোফা হলেই চলবে, বিছানা লাগবে না। তুই কাঁটায় কাঁটায় এক ঘন্টা পরে ডেকে তুলবি।’

‘ঠিক আছে, তুলব।’

সাজ্জাদ হোসেন সোফায় লম্বা হলেন এবং দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন। তবে তাঁকে ডেকে তুলতে হল না। ঠিক এক ঘন্টা পরে নিজেনিজেই জেগে উঠলেন। প্রাণী হিসেবে মানুষের তুলনা নেই। তার অবচেতন মন সর্বক্ষণ কাজ করে। যথাসময়ে তাকে সজাগ করে দেয়। বিপদের আভাস দিতে চেষ্টা করে। মুশকিল হচ্ছে, তার কর্মপদ্ধতি আমাদের জানা নেই। সাজ্জাদ হোসেন বললেন, ‘এক কাপ চা খাব। তারপর যাব। আজ সারারাত ডিউটি। যেভাবেই হোক, আজ নগ্নগাত্রকে ধরবই।’

মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ম্যানিয়াকদের ধরা খুব মুশকিল। এদের ইন্দ্রিয় খুব সজাগ থাকে।’

‘সজাগ থাকুক আর যা-ই থাকুক, ব্যাটাকে আজ ধরবই।’

‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দেশ খোদ ইংল্যান্ডেও কিন্তু কিছু-কিছু ম্যানিয়াকদেরকে ধরতে তিন-চার বছর সময় লেগেছে। এক জনের নাম তুই নিশ্চয়ই জানিস—রোড-সাইড স্ট্র্যাংগলার। বেছে বেছে ব্লন্ড মেয়েদের খুন করত। সাড়ে ছ’ বছর চেষ্টা করেও কিন্তু ওকে ধরা যায় নি।’

‘আমি ধরব। আজ রাতেই ধরব।’

মিসির আলি চুপ করে গেলেন। সাজ্জাদ হোসেন বললেন, ‘উঠি?’

‘চা না খাবি বললি?’

‘মত বদলেছি, খাব না।

মিসির আলি বললেন, ‘আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি?’

‘আমার সঙ্গে যাবি? কেন?’

‘আমি ধানমণ্ডির একটা বাড়িতে ঢুকতে চাই। ওরা ঢুকতে দিচ্ছে না। গেট বন্ধ করে রাখছে এবং বলছে বাড়িতে কেউ নেই। কিন্তু আমি জানি, বাড়িতে লোকজন আছে। পুলিশের গাড়িতে করে গেলে দারোয়ান ভয় পেয়ে গেট খুলবে।’

‘আজ রাতেই যেতে হবে?’

‘হুঁ।’

‘তোকে ঢুকতে দিচ্ছে না কেন?’

‘আছে, অনেক ব্যাপার আছে, পরে বলব। আমাকে ও-বাড়িতে নামিয়ে দিতে তোর অসুবিধা আছে? অসুবিধা থাকলে থাক।’

‘না, অসুবিধা নেই।’

.

রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে।

দারোয়ান জেগেই ছিল। মিসির আলি যা ভেবেছিলেন, তা-ই হল। পুলিশ এসেছে শুনে সে গেট খুলল। মিসির আলি ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী দু’ জনেই দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন, মিসির আলি গেট দিয়ে ঢুকছেন এবং বেশ সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে আসছেন। ওসমান সাহেব নিচে নেমে এলেন। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি ভালো আছেন?’

ওসমান সাহেব সে প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ‘অসময়ে এসেছি। উপায় ছিল না বলেই আসতে হয়েছে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *