১৬. সাজ্জাদরা নীলগঞ্জে পৌঁছল

সাজ্জাদরা নীলগঞ্জে পৌঁছল আটাশ তারিখ রাতে। এগারো মাইল হেঁটে প্রচণ্ড জ্বর এসে গেল নীলুর। সে কয়েকবার বমি করল। কোথায় ডাক্তার, কোথায় কী। নীলগঞ্জের লোকজন পালাচ্ছে, কারণ দেওয়ান বাজারে মিলিটারি এসে গেছে। তারা নির্বিচারে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দেওয়ান বাজার নীলগঞ্জ থেকে মাত্র পাঁচ মাইল। মিলিটারিরা এদিকেই হয়তো আসবে। নীলগঞ্জের লোকজন নৌকায় করে সুখানপুকুরের দিকে পালাচ্ছে। নীলু বলল, দাদুমণি আমি কোথাও যাব না। দাদুমণি বললেন, সুখানপুকুরে ডাক্তার পাওয়া যাবে।

নীলু থেমে থেমে বলল, আমার ডাক্তার লাগবে না।

দাদুমণি কী করবেন ভেবে পেলেন না।

সাজ্জাদ, কী করা যায়? যাবে সুখানপুকুরে?

চলেন যাই।

নৌকা জোগাড় করতে অনেক সময় লাগল। কেউ যেতে চায় না। গতরাতে নাক নদীতে গানবোট এসেছিল। আজও হয়তো আসবে। মাঝিরা বলল, হাটাপথে যান। হগগলেই হাঁটাপথে যাইতাছে।

অসুস্থ একটা মেয়ে সাথে আছে। হাঁটাপথে যাওয়া যাবে না। বড় নদীতে না গিয়ে যেতে পারবে না? বিশাখালি দিয়ে যাও।

কেউ রাজি হয় না। একজনকে শুধু পাওয়া গেল। তার নৌকাটা ছোট। দুপুররাতে তারা সবাই ভোলা নৌকায় করে রওনা হলো। অনেক লোকজন। একটা মাত্র নৌকা।

সে-রাতে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সুখানপুকুরের কাছাকছি আসতেই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল।

ঠিক এই সময় রোগামতো একটি ছেলে চেঁচিয়ে বলল, চুপ চুপ। শুনেন সবাই শুনেন। ছেলেটর হাতে একটি ট্রানজিষ্টার। সে ট্রানজিস্টার উঁচু করে ধরল বলল, স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান। স্বাধীন বাংলা বেতার।

ঘোষকের কথা পরিষ্কার না। ট্রানজিস্টারে ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। তবু সবাই শুনল–ওরা জানে না আমরা কী চীজ। জানে না ইবিআর কী জিনিস। আমরা ওদের টুপি টিপে ধরেছি। তুমুল যুদ্ধ চলছে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

ঘোষকের কথা শেষ হওয়া মাত্র রোগা ছেলেটি বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর আমাদের ভয় নাই। বলেন ভাই সবাই মিলে, জয় বাংলা। নৌকার প্রতিটি মানুষ আকাশফাটানো ধ্বনি দিল। ছেলেটি বলল, আবার বলেন।

জয় বাংলা।

বলেন, জয় বঙ্গবন্ধু।

জয় বঙ্গবন্ধু।

নীলু আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিল। সে বিড়বিড় করে বলল, কী হয়েছে?

সাজ্জাদ হাসতে হাসতে বলল, নীলু, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর আমাদের ভয় নেই। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বলল।

কে যুদ্ধ করছে।

বাঙালি মিলিটারিরা।

শুধু ওরা।

না, আমরাও করব। আমিও যাব।

তোমাকে কি ওরা নেবে?

সাজ্জাদ দৃঢ়স্বরে বলল, নিতেই হবে।

যুদ্ধ শুরু হলো। রুখে দাঁড়াল বাঙালি সৈন্য, বাঙালি পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দিল এ দেশের মানুষ। বৃদ্ধরা যেমন এগিয়ে এল তেমনি এগিয়ে এল নিতান্তই অল্পবয়েসী কিশোরেরা। তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, মাতৃভূমির জন্যে ভালোবাসা। দেখতে দেখতে সেই সহায়সম্বলহীন বাহিনী একটি মহাশক্তিমান দুর্ধর্ষ সৈন্যদলে পরিণত হলো। এদের যুদ্ধ মুক্তির জন্যে। তাই এদের আমরা ভালোবেসে ডাকলাম মুক্তিবাহিনী। এদের স্বপ্ন একটিই : অন্ধকার রজনীর শেষে এরা আনবে একটি সূর্যের দিন।

একটি সূর্যের দিনের জন্যে এ দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দান করতে হলো।

পরিশিষ্ট

খোকন মে মাসের শেষদিকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করার জন্যে একটি চৌদ্দ বছরের বালককে বীর প্রতীক উপাধি দেওয়া হয়। মেথিকান্দা অপারেশনে এই বালকটি শক্রর গুলিতে নিহত হয়। তার নাম সাজ্জাদ। একবার এই ছেলেটি ভয়াল-ছয় নামের একটি ছেলেমানুষী দল গঠন করেছিল। এবং ঠিক করেছিল ভয়াল-ছয়ের সদস্যরা পায়ে হেঁটে আফ্রিকার গহীন অরণ্য দেখতে যাবে। ছেলেমানুষদের কতরকম স্বপ্ন থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *