১৬. সরকারী ডাক্তার সিরাজুল করিম

সরকারী ডাক্তার সিরাজুল করিমের বাসা হাসপাতালের সাথে লাগানো। তৈরি করা হয়েছে এভাবে, যেন হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে বাসা থেকে এক ছুটে হাসপাতালে চলে যেতে পারেন। তার বয়স বেশি না। একটু মোটা মতন, মাথার সামনে চুল পাতলা হয়ে আসছে। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আমরা পরদিন সকালে তার সাথে দেখা করতে গেলাম, পরিকল্পনার এটা হচ্ছে প্রথম কাজ। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল চারজনই যাব কিন্তু রাশেদ বলল যে শুধুমাত্র একজন যাব। গোপনীয়তার জন্যে চারজন একসাথে যেতে পারবে না। আমরা তখন ঠিক করলাম আশরাফ যাবে। সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। আশরাফ ব্লাজি হল না, গত বছর তার যখন চিকেন পক্স হয়েছিল ডাক্তার সিরাজুল করিম তাকে দেখেছিলেন, তাকে চিনে ফেলতে পারেন। তখন সবাই বলল আমাকে যেতে। আমি মোটেও চাচ্ছিলাম না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতে হবে। কাজেই আমি রাজি হলাম। কি বলতে হবে কিভাবে বলতে হবে

সাহেব আমাকে দেখে বললেন, খোকা কাকে চাও?

আপনাকে।

আমাকে?

জী। ডাক্তার চাচা, খুব একটা জরুবী দরকারে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

কি কথা?

খুব গোপনে বলতে হবে।

গোপনে? ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এইটুকু ছেলে তোমার আবার কিসের গোপন কথা?

জী, আছে।

আস তাহলে ভিতরে।

আমি তার সাথে ভিতরে গেলাম। একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা চেয়ারে বসে বললেন, বিল।

যেদিন মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণ হয়েছে সেদিন গুলী খেয়ে ধরা পড়েছেন।

ডাক্তার সাহেব চমকে ওঠে ভুরু কুচকে আমার দিকে তাকলেন।

শফিক ভাই এখন আপনার হাসপাতালে আছেন।

ডাক্তার সাহেব তখনও কোন কথা বললেন না। আমি বললাম, আমরা তাকে উদ্ধার করে নিতে চাই। সেজন্যে আপনার একটু সাহায্য দরকার।

ডাক্তার সাহেব থমথমে গলায় বললেন, ছোট বাচ্চারা তোমরা ছোট বাচ্চাদের মত থাকবে। লাইফ এত সোজা না। লাইফ এডভাঞ্চর উপন্যাসের পৃষ্ঠা না। যাও বাসায় গিয়ে খেলাধুলা কর। যাও।

আপনি আমার কথা শুনেন আগে।

না, আমি শুনব না।

আমি মরীয়া হয়ে বললাম, মিলিটারী ক্যাম্পে যে এটাক হল আমরা সেটাতে সাহায্য করেছি। গুলী পোঁছে দিয়েছি। মুক্তিবাহিনী আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে। আমাদের কাছে আর্মস আছে। আমরা দরকার পড়লে তাদের আর্মস পৌঁছে দেই। আমির

আমি কিছু জানতে চাই না। তুমি বাসায় যাও।

আমরা কিভাবে করতে চাই সেটা একবার শুধু শুনেন।

না।

শফিক ভাইকে যদি মিলিটারী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ভয়ংকর অত্যাচার করে মেরে ফেলবে। অন্তয়ংকর অত্যাচার—

ডাক্তার সাহেব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা আগুন নিয়ে খেলতে যেয়ো না। বাসায় যাও, আমার অনেক কাজ।

ডাক্তার সাহেব উঠে দাড়ালেন, আমিও উঠে দাঁড়ালাম। রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। শেষবারের মত চেষ্টা করার জন্যে আমি কান্না আটকাতে আটকাতে বললাম, ডাক্তার চাচা, এখন এমন একটা সময় যেটা আগে কখনো আসে। নাই। কেউ ঠিক জানে না। এই রকম সময়ে কি করতে হয়। আপনারা বড় আর আমরা ছোট বলে আপনারা কিন্তু আমাদের থেকে বেশি জানেন না। —

ডাক্তার চাচা আমার কথা শুনে একটু হকচিয়ে গেলেন। আমি আবার বললাম, আমরা ছোট সেজন্য আমরা কিছু বুঝি না সেটা ঠিক না। আপনিও এক সময় ছোট ছিলেন।

আমি একটু দম নিয়ে বললাম, কিছু করা না হলে আজ কালকের মাঝে শফিক ভাইকে মেরে ফেলবে। তাকে এখনই উদ্ধার করতে হবে। আপনি সাহায্য করলে জিনিষটা সোজা হত। আপনি সাহায্য না করলে জিনিসটা কঠিন হবে, এই পার্থক্য। আমি চলে যাচ্ছিলাম, ডাক্তার সাহেব থামালেন, দাড়াও একটু।

আমি ঘুরে বললাম, বলেন।

তোমাদের প্ল্যানটা কি, শুনি।

আমি তখন প্ল্যানটা খুলে বললাম। সত্যি কথা বলতে কি যখন পুরোটা শুনলেন আমার মনে হল শেষের দিকে একটু হাসতে শুরু করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কার মাথা থেকে এটা বের হয়েছে?

আমাদের একজন বন্ধু আছে, নাম— নাম বলতে গিয়ে আমি থেমে গোলাম! মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু তার নাম বলতে পারব না। পারমিশন নাই।

ডাক্তার সাহেব চোখ বড় বড় করে বললেন, পারমিশন নাই?

না। যেটা না জানলেই না সেটা ছাড়া অন্য কিছু আমরা কাউকে কিছু বলিনা।

সেটা খারাপ না। ডাক্তার চাচা একটু থেমে বললেন, আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই।

কি জিনিস?

মনে কর তোমরা ধরা পড়লে। তখন তোমাদের ধরে শক্ত পিটুনী দিয়ে জিজ্ঞেস করবে। কে কে তোমাদের সাথে ছিল। তোমরা কি বলবে? বলবে ডাক্তার চাচা আমাদের সাহায্য করেছেন। তারপর কি হবে? তোমরা বাচ্চা মানুষ তোমাদের হয়তো শক্ত পিটুনী দিয়ে ছেড়ে দেবে। আর আমাকে কি করবে? নদীর ধারে দাঁড় করিয়ে গুলী করে দেবে। আমার লাশ নদীতে ভেসে যাবে দুই দিন। শেয়াল কুকুর শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। আমার দুইটা বাচ্চা আছে, বউ আছে, তাদের লাথি মেরে রাস্তায় বের করে দেবে। ঠিক বলেছি?

আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, আমরা যদি ধরা পড়ি কখনো আপনার কথা বলব না। কখনো বলব না।

মার কি জিনিস তোমরা জান না। মানুষকে কেমন করে টর্চার করতে হয় সেটা তোমরা জান না। ধরা পড়লে শুধু তুমি না তোমার বাবাও সব কিছু বলে দেবেন : এই যে শফিক ছেলেটা ধরা পড়েছে, মিলিটারী ক্যাম্পে যাবে পরশু তারপর তার কি অবস্থা হবে তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। বুঝেছি? আমার ইচ্ছে তাকে একটা ইনজেকশান দিয়ে মেরে ফেলি। একটা উপকার করি।

কিন্তু আপনার সেটা করতে হবে না। আমরা তাকে—

সেটা তুমি বলছি। আমি সব কিছু শুনলাম। ডাক্তার চাচা হঠাৎ রহস্যময় ভঙ্গি করে হেসে বললেন, আমি রাজী না।

আমি ভেবেছিলাম ডাক্তার চাচাকে রাজি করিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আবার দেখি বেঁকে বসলেন। আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু, কিন্তু –

ছোট ছেলেদের পাগলামী শুনলে বড়রা কি করে?

কি করে?

ধমক দিয়ে বের করে দেয়। দরকার হলে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। এখন আমি তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেব।

ডাক্তার সাহেব একটু হেসে আমার পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, বাসা থেকে বের হয়ে যাওঁ।

বের হয়ে যাব?

হ্যাঁ। বাসা থেকে বের হয়ে যাও।

আমি বোকার মত বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। এর আগে আমাকে কেউ কখনো বাসা থেকে বের করে দেয় নি। এই প্রথম। ডাক্তার সাহেব আমাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন, কিন্তু আমার যেটুকু অপমান হওয়ার কথা সেটুকু অপমান হল না। ডাক্তার সাহেবের গলার স্বরে কোন রাগ বা তিরস্কার ছিল না। গলার স্বরে কোন জোরও ছিল না। তিনি শুধু কথাগুলি উচ্চারণ করলেন মনে হল কথাগুলি বলতে হয় বলে বললেন।

আসতেই রাশেদ আশরাফ আর ফজলু আমার সাথে এক হল। আশরাফ গলা নামিয়ে বলল, কি বললেন?

ঠিক বুঝতে পারলাম না।

কি বুঝতে পারলি না?

মনে হল প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সব কথা যখন শেষ হল। তখন বললেন, আমি রাজি না।

তাই বললেন?

হ্যাঁ, তারপর বললেন তোমাকে এখন ঘড়ি ধরে বের করে দেব।

ঘাড় ধরে?

হ্যাঁ, তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে মনে হল বেশ আদর করেই বাইরে বের করে দিলেন। একবারও কিন্তু রাগ হয়ে কিছু বললেন না।

রাশেদ মুখ কাল করে বলল, কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম ডাক্তার সাহেব জয় বাংলার পক্ষে।

হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেব জয় বাংলার পক্ষে ঠিকই। কিন্তু আমাদের মত বাচ্চাদের সাথে কোন রকম প্ল্যান করতে ব্রাজি না। ভয় পান।

রাশেদ মুখ শক্ত করে বলল, আমরা যদি কিছু না করি শফিক ভাইকে এমনিতেই মেরে ফেলবে। চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। ডাক্তার সাহেবকে ছাড়াই। যখন দেখবেন আমরা কিছু একটা করে ফেলেছি তার আর কোন উপায় থাকবে না।

আমরা মাথা নাড়লাম।

আশরাফ বলল, আমাদের শেষবার গিয়ে হাসপাতালটা দেখে আসা দরকার। যদি প্ল্যানের কোন রদবদল করতে হয়।

হ্যাঁ। রাশেদ বলল, সবার গিয়ে কােজ নেই। দুইজন গেলেই হবে। আমি আর ইবু যাই। তোরা এখানে অপেক্ষ কর।

ঠিক আছে।

আমি আর রাশেদ একজন মেয়ে মানুষের পেছনে পিছনে হাসপাতালে ঢুকে গেলাম। হাসপাতালের ভিতরে ফিনাইলের গন্ধ, এক জায়গায় একটা রোগী চিৎকার করছে। এক পাশে শফিক ভাইয়ের ঘর, বাইরে একটা রাজাকার বসে সিগারেট টানছে। আমরা সেদিকে গেলাম না। অন্য পাশে দরজার কাছে একটা টেবিল তার উপর একটা খালি ষ্ট্রেচার রাখা। আমার হঠাৎ একটা খটকা লাগল, আমাদের প্ল্যান কাজে লাগানোর জন্যে একটা স্ট্রেচার দরকার, ডাক্তার সাহেবকে তাই বলেছিলাম। তিনি আমাদের সাথে রাজি হন নি। কিন্তু ঠিকই একটা স্ট্রেচার রেখেছেন। আমি তাড়াতাড়ি হেঁটে করিডোর পার হয়ে অনড় দিকে গেলাম। ঘরটিতে সারি সারি বিছানাপাত, তার মাঝে দেয়াল থেকে তিন নম্বর বিছানাটা খালি। ঠিক যেরকম ডাক্তার চাচাকে বলেছিলাম।

আমি রাশেদকে খামচে ধরে বললাম, রাশেদ।

কি?

ডাক্তার চাচা সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই দেখ খালি বিছানা! ঐ দেখা স্ট্রেচার!

তাহলে! তোকে যে বললেন রাজি না?

হঠাৎ করে আমি সব বুঝে গেলাম! বললাম, বুঝলি না? আমরা যদি ধরা পড়ে যাই কিছুতেই কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না ডাক্তার সাহেব আমাদের সাথে আছেন।

কেন? মনে নেই আমাকে বলেছেন রাজি না, শুধু তাই না। আমাকে বের করে দিলেন বাসা থেকে।

কিন্তু স্ট্রেচার? খালি বিছানা? হাসপাতালে স্ট্রেচার থাকবে না? একটা বেড়ে খালি হতে পারে না? রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে খুশিতে হেসে ফেলল। তাহলে আমাদের আর কোন সমস্যা নাই!

না।

 

দুপুরে আমরা সবাই বাসায় ফিরে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম। কেউ যদি আমাদের লক্ষ্য করে ঘূণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারবে না। আমরা আর কয়েক ঘন্টার মাঝে কি সাংঘাতিক একটা কাজ করতে যাচ্ছি। কিছু একটা গোলমাল হয়ে যেতে পারে, গোলাগুলী হতে পারে, কেউ একজন মরেও যেতে পারি। কিন্তু সেই সব মাথা থেকে সরিয়ে রেখেছি।

খাবার টেবিলে আম্মা বললেন, কি রে ইবু, তুই এত চুপচাপ কেন?

না, এমনি।

জানিস তো আমরা চলে যাব।

কবে?

এই কাল না হয়। পরশু। ফরহাদ সাহেব, অরুর আব্বা আজ নৌকা ঠিক করেছেন।

ও।

বাইরের খোঁজ খবর কিছু জানিস?

কিসের খোঁজ খবর?

শফিক কেমন আছে, এইসব।

একটু একটু নাকি হাঁটতে পারেন। আমার গলা কেপে গেল। হঠাৎ, কাল পরশুর মাঝে নাকি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে।

আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *