সত্যনারায়ণ পার্কের ঠিক উলটোদিকে কয়েকটা সরবতের দোকান আছে। বেশ সাত্ত্বিকভাবে দোকানদাররা গুছিয়ে বসেছে। আনন্দ এদের কথা শুনেছিল। সামান্য সিদ্ধি মিশিয়ে এই রাবড়ির চেয়ে লোভনীয় স্বাদের সরবতের জন্যে জম্পেশ ভিড় জমেছে।
কলেজ স্ট্রীট থেকে হাঁটতে হাঁটতে হ্যারিসন রোড ধরে ওরা যতই পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিল ততই কলকাতার একটা সর্বভারতীয় চেহারা নজরে পড়ছিল। এই পথে অনেকবার যাতায়াত করেছে কিন্তু আজকের মত খুঁটিয়ে কখনও দ্যাখেনি। ব্যাপারটা একটা সময় এমন দাঁড়াল যে কল্যাণ না বলে পারল না, আমরা কোথায় এসেছি? রাজস্থান না উত্তরপ্রদেশে?
আনন্দ বলল, তুই প্রাদেশিকতাদোষে দুষ্ট। উলটোদিক দিয়ে ভাবতে পারছিস না কেন? এইসব পরিশ্রমী মানুষগুলো তাদের দেশ জমি ছেড়ে কলকাতায় এসে ধীরে ধীরে জায়গাটাকে শুধু নিজের মত করেই নেননি, এমনকি ভৌগোলিক চরিত্র বদলে দিয়েছেন। তুই এখানকার মাটি কিংবা আকাশের দিকে তাকা, দেখবি কোন বাংলাদেশী গন্ধ নেই। এটা চীনেরাও পারেনি।
সত্যনারায়ণ পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চারপাশে খুঁটিয়ে নজর করছিল। দোকানপাট, বাড়িঘর এমন কি মানুষজনের হাঁটাচলার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। বাইরে থেকে যারা আসে তারা সাধারণত নতুন দেশের অনেকটা গ্রহণ করে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিরাট একটা এলাকাকেই নিজেদের মত পালটে নেওয়া কম কথা নয়। অত্যন্ত ক্ষমতাবান না হলে সেটা সম্ভবও নয়।
এই সময় আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ, সরবত খাবি?
কল্যাণ মাথা নাড়ল, খালি পেটে সরবত জমবে না। সকাল থেকে সলিড কিছু পড়ছে না। শালা জয়িতাটাও লিকুইড খাওয়াল!
হঠাৎ আনন্দ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তোর খুব খেতে ভাল লাগে, না?
হ্যাঁ ভাই। কল্যাণ সরাসরি মাথা নাড়ল, আমি খেতে চাই, প্রাণভরে ভাল খাবার খেতে চাই। এক এক সময় ভাবতাম যখন চাকরি করব তখন খুব ভাল ভাল খাবার খাব। জেলখানায় তো যা দেবে তাতে আমার আশা কোনদিন পূর্ণ হবে না। আমার পকেটে যদি তিনশো টাকা থাকত তা হলে একটা সাধ মিটিয়ে নিতাম।
কি সেটা? এবার আনন্দ চারপাশে নজর বোলাচ্ছিল। সত্যনারায়ণ পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে ভেতরে। ওখানেই ঢুকতে হবে তাদের। ঠেলা রিকশায় বেশ মন্থর হয়ে আছে পথটা।
কল্যাণ বলল, আমার কাছে একটা লিস্ট আছে। কলকাতার কোথায় কোন্ দোকানে কি পাওয়া যায়। সেই সব খাবারের কি বৈশিষ্ট্য। অনেক কষ্টে কমিয়ে কমিয়ে ষাটটা দোকান বেছেছি। অ্যাভারেজে পাঁচ টাকা খরচ করলে তিনশোয় হয়ে যাবে। বেলা দশটায় শুরু করলে রাত দশটায় শেষ করা যাবে। খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে এই ইচ্ছেটা?
মোটেই না। চল্ হাঁটা যাক। ফেরার সময় ওই মিষ্টির দোকানটায় প্রথমে ঢুকব। কল্যাণ নামটা পড়ল। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে, এই দোকানটার নাম ছিল আমার লিস্টে। দারুণ মিষ্টি করে ওরা! বেনারসের ঘরানায় তৈরি ওদের একটা মিষ্টির নাম, যাঃ শালা ভুলে গেছি। হাঁটতে হাঁটতে আনন্দ বলল, তুই আজ খাবার নিয়ে খুব উত্তেজিত হচ্ছিস!
উত্তেজিত? মোটেই না। মন খারাপ হয়ে যায়। তুই কেন মনে করিয়ে দিলি? আসলে খাবারের বিষয়ে বেশি আলোচনা হতেই আমার কি রকম যেন হয়। আচ্ছা আনন্দ, তুই আজ অবধি যা যা খাবার খেয়েছিস তার মধ্যে বেস্ট কোষ্টা?
মনে নেই, বিশ্বাস কর। ভাল কিছু খেলেই মনে হয় এটাই সবচেয়ে ভাল।
তোকে একটা কথা বলি। আমি তো খুব বেশি কিছু খাইনি। কিন্তু ফুলকপি দিয়ে পোস্তর একটা তরকারি করেন মাতৃদেবী। তুলনা হয় না। দ্রুত এগিয়ে আসা একটা ঠেলার আক্রমণ শেষ মুহূর্তে সামলে নিল কল্যাণ। আনন্দ দেখল এখনও ওর মুখে তৃপ্তির চিহ্ন। ওর মনে হল এই খাদ্যবস্তুটা কল্যাণকে ওর মা নিশ্চয়ই সহজে দিতে পারেন। অন্তত শীতকালে। সে কল্যাণকে আর এ বিষয়ে কথা চালাতে উৎসাহিত করল না। এই কল্যাণকে সে এতকাল দ্যাখেনি। কোন কোন দুর্বল জায়গায় স্পর্শ পেলে বোধ হয় মানুষ এমন ক্রেজি আচরণ করে ফেলে।
এই রাস্তায় কোন বঙ্গসন্তান চোখে পড়ল না। হাঁটুর ওপরে কেঁচা তুলে বাণিজ্যে বের হচ্ছেন ব্যবসায়ী, মাথায় ঘোমটা তুলে স্কুলাঙ্গী মহিলারা বাজারে যাচ্ছেন। একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ভাই, মেডিসিনকা দোকান কিধার হ্যায়?
কোন্সা মেডিসিন?
এইবার অসুবিধেতে পড়ল আনন্দ। তার হিন্দির দৌড় খুব বেশি নয়। তাছাড়া ফ্যাক্টরির বদলে সে দোকান শব্দটা বলে ফেলেছে। চেষ্টা করে সে বলল, যাহা মেডিসিন বানাতা হ্যায়।
লোকটা হাসল, ও টিমার কোম্পানি! সিধা যাকে বাঁয়া গলি। মোহনলালজী কা কোম্পানি!
আনন্দ দোকান ছেড়ে এগিয়ে বলল, লোকটা টিমার কোম্পানি বলল কেন? ওই ঠিকানায় তো অন্য কোম্পানির নাম পেয়েছি। টিমার মানে কি? আর মোহনলাল লোকটা তার মালিক?
হবে কিছু একটা। তুই তো নম্বর জিজ্ঞাসা করলে পারতিস?
তুই লক্ষ্য করিসনি। এখানকার বাড়ির গায়ে নম্বর পর পর নেই। ফ্যাক্টরি তো ছোট নয়, তাই চেনা সহজ। জায়গাটা ভাল করে লক্ষ্য কর। এই সময় একটা ট্রাক প্রায় রাস্তা জুড়ে সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছিল। ওরা কোনরকমে একটা রকে উঠে দাঁড়াতে দেখতে পেল ট্রাকটা ওষুধের বাক্সে বোঝাই। ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে দুটো লোক তীব্র স্বরে চেঁচাচ্ছে যাতে সামনের রাস্তা পরিষ্কার হয়। ঠেলা এবং রিকশার কল্যাণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না যদিও। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, আমরা যা সন্দেহ করছি তাই যদি হয় তাহলে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বলতে হবে।
কেন? আনন্দ ট্রাকটার ওপরে সাজানো ওষুধের বাক্সগুলোকে লক্ষ্য করছিল। খুবই নিরীহ চেহারার, আর পাঁচটা যেমন হয়। কল্যাণ বলল, এই রকম বিশ্রী জায়গায় ওরা কোম্পানি করেছে কারণ এর চেয়ে ভাল জায়গা পায়নি। ব্যবসাটা যদি খুব চালু হত তাহলে ওরা স্বচ্ছন্দে সেই জায়গায় উঠে যেত যেখানে ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম নেই। বেআইনি মাল এত ঝামেলার মধ্যে কেউ ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে যায় না।
তুই যা ভাবছিস তা সত্যি হতে পারে। কিন্তু নিজের কানেই শুনলি ওই দুটো ওষুধ হোলসেলারকে সাপ্লাই করে বড়বাজারের এই ঠিকানার কোম্পানি। আনন্দ ট্রাকটাকে এগিয়ে যেতে দেখল।
কল্যাণ মাথা নাড়ল, এইটেই আমার কাছে গোলমাল লাগছে। যে দুটো ওষুধের এরা সাপ্লায়ার সে দুটো বাজারে খুব চালু। এর যদি সেটা বাজারে ছাড়ে তাহলে অরিজিন্যাল কোম্পানির ব্যবসা মার খাবেই। তখন তারা ছেড়ে দেবে? জাল কোম্পানিকে ধরিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগবে তারা। খুব গোলমেলে ব্যাপার আনন্দ।
যদি হোলসেলার আর এই কোম্পানি একই কনসার্ন হয়?
আনন্দের প্রশ্নে একটু থিতিয়ে গেল কল্যাণ। তারপর বলল, আমরা আধ ঘণ্টার চেষ্টাতেই হোলসেলারের ওখান থেকে জানতে পারলাম কোত্থেকে সাপ্লাই আসছে। এত সহজে খবর বেরিয়ে যাওয়ার বিজনেস করবে বলে মনে হয় এরা?
ওষুধের হোলসেল মার্কেটে গিয়ে চমকে গিয়েছিল ওরা। বড় বড় কোম্পানির নিজস্ব বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কলকাতার পশ্চিমের এই বাজার থেকে পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ ওষুধের দোকানগুলো রসদ সংগ্রহ করে। ওই ওষুধ দুটোর সঙ্গে আরও কিছু ওষুধের বিরাট লিস্ট করে ওরা দোকানে দোকানে ঘুরেছিল। বমির ওষুধটা মার্কেটে সাপ্লাই ছিল না সেই মুহূর্তে। ওদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। সেই সময় একটা টেম্পোতে নতুন মাল এল। বাক্স দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কি ওষুধ আছে। ব্যাচ নম্বর ইত্যাদি কোড তাদের জানাও ছিল না। কিন্তু তার কিছুক্ষণ বাদেই বলা হল ওষুধ এসে গেছে। টেম্পোটা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ টেম্পোর হেলপারের সঙ্গে কিছুটা খোসগল্প করে জেনেছিল ওরা আসছে বড়বাজারের এই ঠিকানা থেকে। সেখানে বিশাল কারখানা আছে। কল্যাণ বলছে এত সহজে খবর বেরিয়ে যাবে এমন কাজ ওরা করবে না। কিন্তু একটু আগে ট্রাকের ওপর ওষুধের বাক্সগুলোর গায়ে যে নম্বর পড়ল তা ওই টেম্পোর ওষুধের বাক্সের নম্বরের সঙ্গে মিলে গেছে। তাহলে সেই হেলপার ছেলেটির কথা মিথ্যে নয়।
ওরা যখন সত্যনারায়ণ পার্কের সামনে আবার এসে দাঁড়াল তখন আর কোন দ্বিধা নেই। টিমার কোম্পানি যে ওষুধ তৈরি করে তার চাহিদা বাজারে নেই। সরকারের কাছে লাইসেন্স পাওয়া মাথাধরার ট্যাবলেট এবং জ্বরের ইঞ্জেকশন মোটেই চালু নয়। আনন্দর স্পষ্ট ধারণা, এরই আড়ালে ওই দুটো ওষুধ তৈরি করে। কারণ দ্বিতীয় যে টেম্পো ওখান থেকে একটু আগে বের হল তার ওপরে ভোলা ওষুধের বাক্সের নম্বর আলাদা। একটু আগে শোনা নামের খোঁজে ওরা কারখানায় ঢুকেছিল। তাদের বসবার ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। সেইসময় একটা বেয়ারা গোছের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে আনন্দ জেনেছিল এখানে জ্বর, মাথাধরা, পেটব্যথা এবং বমির ওষুধ তৈরি হয়। লোকটা খুব গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিল এখানে কোন শ্রমিকবিক্ষোভ নেই। মালিক খুব ভাল লোক। মোট সওয়া দুশ মানুষ এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। কিছুক্ষণ বাদে যে খবর নিয়ে গিয়েছিল সে এসে জানাল আপনাদের ভেতরে ডাকছে। মোহনলালবাবু নামক লোকটির কাছে পৌঁছে গেল ওরা। ফিনফিনে ধুতি আর টেরিকটের পাঞ্জাবি-পরা সেই ভদ্রলোকটি জিজ্ঞাসা করলেন, কোত্থেকে আসছেন আপনারা? কি দরকার?
আনন্দ বলল, আমি চণ্ডীগড়ে থাকি। এদের বাড়িতে উঠেছি। চণ্ডীগড়ে আমাদের ওষুধের বিজনেস আছে। সেখানে আপনার এক বন্ধু প্রায়ই আসেন আমার বাবার কাছে। উনি বলেছিলেন এখানে এলে আপনার সঙ্গে দেখা করে যেতে। আনন্দর কথা বলার ভঙ্গি এত স্বাভাবিক যে কল্যাণ পর্যন্ত পাথর হয়ে গেল।
মোহনলালের মুখে এবার কৌতূহল, তোমরা চণ্ডীগড়ে থাকো?
ও না, আমি।
ওষুধের ব্যবসা? তোমার বাবার ওষুধের ব্যবসা আছে?
হ্যাঁ। এস কে রায় অ্যান্ড কোম্পানি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। রামনিবাস বলেছিল বটে। খুব ভারী ব্যবসা তোমাদের। এবার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকালেন মোহনলাল।
খুব বড় নয়, এই আর কি!
রামনিবাস কেমন আছে?
ভালই।
আরে তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো বসো। কি খাবে বল? চা না কোল্ড ড্রিঙ্কস্?
আনন্দ মাথা নাড়ল, না না, এখন কিছু খাব না। বাবা বলেছিলেন আপনার কাছে এলে ফ্যাক্টরিটা দেখে যেতে। ব্যবসা কি করে বড় হয় তা জানতে।
ব্যবসা? ব্যবসা হল আগুনের মত। তাকে যত খাবার দেবে তত বেড়ে যাবে। সব সময় সাপ্লাই দিয়ে যেতে হয়। এই কোম্পানি একটা লিমিটেড কোম্পানি। আমি একজন ডিরেকটার, ব্যস। আজ একটু অসুবিধে আছে। আমারও সময় নেই। যাওয়ার আগে একদিন এসো দেখিয়ে দেব ঘুরিয়ে।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওরা ফ্যাক্টরির কিছু অংশ দেখতে পেল। ওই অঞ্চলে প্যাকিং চলছে। প্রায় সদর পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন মোহনলাল। বললেন, রামনিবাসকে বললো আমাকে ফোন করতে। আমি দিল্লি যাব নেক্সট মানথে। তখন দেখা হবে।
যে বেয়ারা দুটো দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল তারা সসম্ভ্রমে তাকাল। বাইরে বেরিয়ে আনন্দ উলটো দিকের রাস্তায় হাঁটতে লাগল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
আনন্দ বলল, আয় না।
বাড়িটার গায়েই আর একটা সরু গলি। এ দিকটায় ছোটখাটো দোকান বেশি। ঠিক দোকান না বলে গদি বলাই ভাল। খুবই ঘিঞ্জি এলাকা। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাড়িটার পিছনে চলে এসে একটা বিশাল গেট দেখতে পেল। গেটটা বন্ধ। ভেতরে একটা দারোয়ান টুলের উপর বসে আছে। গেটের ভিতরে দুটো টেম্পো দাঁড়িয়ে। এদিকের পথটা অপেক্ষাকৃত চওড়া। খানিকটা বেঁকে আবার জে এন বাজাজ স্ট্রিটে পৌঁছে গেছে। টিমার কোম্পানির প্রধান প্রবেশপথ সত্যনারায়ণ পার্কের দিকে না হয়ে এদিকটায় হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
কল্যাণ বলল, তোর বুকের পাটা আছে। কি ঝটপট মিথ্যে কথা বলতে পারলি!
আনন্দ বলল, আমি ভাবছি মোহনলালের কথা। লোকটা অনেক বড় অভিনেতা।
কল্যাণ বলল, মানে?
আমি চণ্ডীগড় থেকে এসেছি জেনেও উনি হিন্দিতে কথা বললেন না। এস কে রায় অ্যান্ড কোম্পানির নাম জীবনে শোনেননি তবু ভান করলেন কত শুনেছেন?
এটা ভুল হল। হয়তো ওই রকম কোন কোম্পানির নাম শুনেছেন বন্ধুর কাছে, এখন গুলিয়ে ফেললেন। এটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
তাই? উনি যদি জিজ্ঞাসা করতেন ওঁর কোন্ বন্ধুর কথা আমি বলছি তা হলে কি আমি রামনিবাস নামটা বলতে পারতাম?
হ্যাঁ মাইরি! আমার তো রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ভদ্রলোক নিজে থেকেই বন্ধুর নামটা বলে ফেললেন! তুই যদি উলটোপালটা নাম বলতিস–কিভাবে চান্স নিলি?
শোন, আমি ভেবেছিলাম কোন একটা ডাকনামের সঙ্গে আঙ্কল শব্দটা জুড়ে দেব। কিন্তু মোহনলাল সেই ঝুঁকি নিতেই দিলেন না। আমার বিশ্বাস রামনিবাস বলে কোন মানুষকে মোহনলাল চেনেন না। আমাকে নিয়ে চমৎকার খেলে গেলেন ভদ্রলোক।
সেকি রে! উনি ফোন করতে বললেন, দিল্লিতে গিয়ে দেখা করতে বললেন, সব জালি?
হ্যাঁ। রামনিবাস না বলে রামঅবতার বললেও আমি তা মানতাম। আর সেই কারণেই ফ্যাক্টরি দেখানোর ব্যাপারে অসুবিধে হয়ে গেল।
কিন্তু উনি আমাদের ধরতে পারতেন মিধ্যে কথা বলার জন্য। তা না করে চা অফার করলেন। এটা করে কি লাভ ওঁর?
ঝামেলাটা বাড়ালেন না। আমাদের মিথ্যেবাদী বললে একটা কিছু করতে হত। তাতে লোক জমতো। অথচ ভদ্ৰব্যবহার করে কাটিয়ে দিতে অসুবিধে হল না। এর পরে নিশ্চয়ই আমরা ওঁর কাছে যাওয়ার সাহস পাব না বলে উনি ভেবেছেন। এবং আমার বিশ্বাস ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর মোহনলাল লোক পাঠিয়েছেন কোথায় যাই জানতে।
আনন্দর কথা শেষ হওয়া মাত্র কল্যাণ চট করে চারপাশে তাকাল। বাস, ট্যাকসি, প্রাইভেট আর রিকশার দঙ্গল সামনে। ফুটপাতে যাবতীয় দোকানের সামনে ভিড়। এর মধ্যে কেউ যদি দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করে তাহলে বোঝার উপায় নেই। ওর মনে হল আনন্দ বোধ হয় একটু বেশি বেশি ভাবছে। মোহনলালের সঙ্গে কথাবার্তায় লোকটাকে অতখানি ধূর্ত মনে হয়নি।
আনন্দ বলল, চল, মিষ্টি খাই।
ব্যাপারটা মনঃপুত হল কল্যাণের, সে রাস্তায় নেমে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু এখানে এসে কাজের কাজ হল না। আমরা তো কোন ডাইরেক্ট প্রমাণ পাচ্ছি না। কি করবি এখন?
মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়ল আনন্দ প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে। দোকানটা বিশাল। শো-কেসের ভেতরে ওপরে নানান ধরনের মিষ্টি সাজানো। চমৎকার একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সে জিজ্ঞাসা করলু, কি খাবি?
কল্যাণ থমকে গেল। এত বিরাট সাইজের রকমারি মিষ্টি সে একসঙ্গে কখনও দ্যাখেনি। দু-তিনটে ছাড়া বেশির ভাগই সে চেনে না। মাঝারি সাইজের একটা মিষ্টি দেখিয়ে সে দাম জিজ্ঞেস করল। সেলসম্যান জানাল, চার টাকা পিস।
সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ চাপা গলায় বলল, ডাকাত মাইরি! দুটাকার বেশি হওয়াই উচিত নয়।
আনন্দ বলল, কোন্টা খাবি ঠিক কর তুই।
কল্যাণ সেলসম্যানকে একটার পর একটা মিষ্টির দাম জিজ্ঞাসা করতে লাগল। আনন্দ বুঝতে পারছিল কোনটাই কল্যাণের পছন্দ হচ্ছে না। তখন আর মিষ্টি নয়, মিষ্টির দামটাই ওর কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত কল্যাণ কাঁধ নাচাল, না রে আনন্দ, চল্ অন্য দোকানে যাই।
কি হল? তোর তো কিছু সলিড খাওয়ার দরকার ছিল?
ছিল। কিন্তু এত হেভি দামের মিষ্টি আমি খেতে পারব না।
ঠিক আছে। তোকে তো দাম দিতে হচ্ছে না, তুই খা যা ইচ্ছে করে।
ইম্পসিবল। এগুলো যদি আমার অজানা বস্তু হত তা হলে খেয়ে নিতাম। যে জিনিস বাইরে অর্ধেকের চেয়ে কম দামে পাব সেটা এখানে খেতে যাব কেন? তোর পয়সা বলে আমার বোধ কাজ করবে না? তুই আমাকে পাবলিক ভাবছিস?
পাবলিক?
হ্যাঁ পাবলিক। সব সময় দুইয়ে নিতে চায়। অন্যের পয়সায় বিষ পেলেও খাবে। একবার একটা মেলায় দেখেছিলাম হাজারখানেক পাবলিক লাইন দিয়ে বরাদুরে দাঁড়িয়েছে। কি ব্যাপার? মা সাহেবরা বাজারের ব্যাগ বিনা পয়সায় বিতরণ করছে। ব্যাপারটা ভাব। চল বের হই।
কিন্তু কল্যাণ, এরা যখন দাম বেশি নিচ্ছে তখন জিনিসটাও তিনগুণ ভাল দিচ্ছে।
আমার খিদে লাগেনি, হয়েছে? বাইরে বেরিয়ে এল কল্যাণ। তারপর বলল, কোনদিন তো বেশি খরচ করিনি কিংবা করার ক্ষমতা হয়নি তাই কেমন যেন আটকে যায়। দ্যাখ না, চটি কিনতে বাটার দোকানে যাই না, ফুটপাত থেকে কিনি।
আনন্দ কোন কথা বলল না। ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ও অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কল্যাণ টিপিক্যাল নিম্নবিত্ত ছেলে। কিন্তু ছেলেটার মধ্যে দারুণ সততা আছে। নিজের বিশ্বাস বা পছন্দ সরাসরি বলতে কখনও দ্বিধা করে না। আর এইখানেই ওর সঙ্গে ওর শ্রেণীর তফাৎ। মাঝে মাঝে আনন্দ অবাক হয়ে ভাবে কি করে তারা চারজন একত্রিত হল। চারজনের রুচি, সমাজ এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন সংঘাত লাগেনি।
হঠাৎ সচেতন হল আনন্দ। কল্যাণ চুপচাপ তার পাশে হাঁটছে। এখন ওরা মহাত্মা গান্ধী রোডে। চট করে পাশের একটা পাইস হোটেলে কল্যাণকে নিয়ে ঢুকেই পেছন ফিরে তাকাল। দুটো লোক হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একজন রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। দ্বিতীয়জন কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে হোটেলের দিকে তাকাতে তাকাতে সরে গেল সামনে থেকে। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার রে?
আয় ভাত খাই। পাইস হোটেলে আমি কখনও খাইনি। তারপর দেওয়ালে ঝোলানো মেনুর দিকে তাকিয়ে বলল, তিন টাকা নিরামিষ পাঁচে আমিষ। দামটা তোর আওতায় থাকছে, কি বল?
কল্যাণ উত্তর না দিয়ে নোংরা বেসিনে হাত ধুয়ে এল।
মোটেই তৃপ্তি কবে খেতে পারল না ওরা। রান্না ভাল নয়, টেবিল এবং থালায় ময়লা দাগ লেগে আছে। আশেপাশের মানুষগুলো বোধ হয় অভ্যস্ত, তাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না। আনন্দর নজর ফুটপাতের দিকে ছিল। মোহনলাল যদি লোক পাঠায় তাহলে প্রমাণ হচ্ছে তার দুর্বলতা আছে। কিন্তু ওই দুটো লোক কি মোহনলালের কাছ থেকে এসেছে? চোখের আড়াল হবার পর তারা আর সামনে আসছে না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, বাস্তার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
বাইরে বেরিয়ে বলব।
দাম মিটিয়ে ওরা বাইরে এল। সেই লোকদুটোকে কাছাকাছি নজরে পড়ল না। একটা ট্রাম যাচ্ছিল শিয়ালদার দিকে। আনন্দ কল্যাণকে বলল তাতে উঠে পড়তে। দৌড়ে ওরা ট্রামের হ্যান্ডেল ধরে পাদানিতে পা রেখেছে, সেই সময় ভিড় ফুড়ে একটা লোক ছুটে সেকেন্ড ক্লাসে উঠে পড়ল। ট্রামে দাঁড়িয়ে আনন্দ হেসে ফেলল, চিনেছি।
কি চিনেছিস?
মোহনলাল আমাদের পেছনে লোক পাঠিয়েছে। আমার সন্দেহটা তাহলে ঠিক।
কি করে বুঝলি লোক পাঠিয়েছে?
আমরা যখন হোটলে ঢুকলাম তখন যে লোকটা থমকে দাঁড়িয়েছিল সেই লোকটাই এখন সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছে। আমরা কোথায় থাকি সেটাই বোধ হয় জানতে চাইছে।
কি করবি এখন? কল্যাণ প্রশ্নটা করেই ভেবে নিল, ব্যাটাকে ধরব?
পাগল! ও ওর মত থাক, আমরা আমাদের মত। হাতে বেশি সময় নেই, সুদীপ দাঁড়িয়ে থাকবে। চটপট টিকিট কাটল আনন্দ।
যাচ্চলে! কল্যাণ বলল, আমাকে তো একবার বাড়িতে যেতে হবে। কিছু জামাপ্যান্ট অন্তত আনা দরকার। কতক্ষণ সময় আছে হাতে?
তোর এখনই বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ তোরা এখনই ঠাকুরপুকুরে যাচ্ছিস না।
যাচ্ছি না?
না। নেমে পড়, একটা ট্যাকসি খালি হচ্ছে। বলতে বলতে আনন্দ নিচে পা বাড়াল। সেন্ট্রাল অ্যাভির ট্রাফিকের জন্যে ট্রামটা দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ ছুটে গিয়ে ট্যাকসিতে বসে পড়ল।
ট্যাকসিওয়ালা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, কোথায় যাবেন?
এসপ্লানেড। উঠে আয় কল্যাণ। আনন্দ দেখল ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস থেকে সেই লোকটা নেমে পড়েছে। কিন্তু এবার তার কি করা উচিত বুঝতে পারছে না।
ট্যাকসিওয়ালা বলল, আপনারা নেমে যান, অসুবিধে আছে।
কল্যাণ ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছিল, অসুবিধে কেন?
গাড়ি খারাপ আছে। নির্বিকার মুখে ড্রাইভার বলল।
কল্যাণ ঝুঁকে এল সামনে, আপনি একটু আগে প্যাসেঞ্জার নামালেন। ভদ্রভাবে বলছি এসপ্লানেড চলুন।
আনন্দ মুখ বাড়িয়ে একজন ট্রাফিক কনস্টেবলকে চিৎকার করে ডাকল, এই যে দাদা, এদিকে আসুন।
লোকটা খুব বিরক্ত হল ডাক শুনে। দূর থেকে মুখ নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? তাই দেখে ট্যাকসিওয়ালা হাসছিল। হঠাৎ কল্যাণ বলল, দেখুন মশাই, আপনি আমাকে চেনেন?
এবার লোকটা বলল, চেনাচেনির কি আছে? অফিসটাইমে অতটুকু পথ গেলে আমার লস হবে। আপনারা অন্য ট্যাকসি দেখুন।
আনন্দ জিজ্ঞেস করল, তাহলে বললেন কেন গাড়ি খাবাপ আছে?
এবার কনস্টেবল কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
আনন্দ অভিযোগ করল, উনি যেতে চাইছেন না। ট্যাকসিওয়ালা রিফুজ করলে আপনাদের কাছে কমপ্লেন করতে বলা হয়েছে। দুপুরবেলায় উনি অফিস টাইম বলছেন।
সঙ্গে সঙ্গে ট্যাকসিওয়ালা হাত নাড়ল, আরে না দাদা, গাড়ি খারাপ আছে, এঁরা শুনছেন না।
কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি খারাপ?
আনন্দ প্রতিবাদ করল, মিথ্যে কথা! গাড়ি ঠিক আছে। এসপ্ল্যানেড যাব বলে উনি এসব বলছেন।
কনস্টেবল মাথা নাড়ল, গাড়ি খারাপ কিনা আমি কি করে বুঝব? আমি তো মেকানিক নই। এসপ্ল্যানেড গেলে বাসে চলে যান। কাছেই তো! কনস্টেবল আবার ফিরে গেল।
কল্যাণের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। সে বলল, এই যে ড্রাইভার, এক মিনিটের মধ্যে যদি গাড়ি স্টার্ট না করেন তাহলে এটাকে জ্বালিয়ে দেব।
ওর গলার স্বরে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে ট্যাকসিওয়ালা চমকে ফিরে তাকাল। কল্যাণ বলল, কাগজে পড়েছেন প্যারাডাইস কিভাবে পুড়েছে?
আনন্দ শঙ্কিত হল। উত্তেজনায় কল্যাণ আরও কিছু না বলে বসে। হঠাৎ ট্যাকসিওয়ালা স্টিয়ারিংএর দিকে ফিরে গাড়ি স্টার্ট দিল। সেই লোকটা এখন অনেকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি চালু করে ড্রাইভার বলল, প্যারাডাইসে লোকে বদমাইসী করতে যেত এর বউ ওর মেয়েকে নিয়ে। ওটা পুড়িয়েছে যারা তারা ঠিক করেছে। আমার গাড়ি পুড়িয়ে আপনাদের কি লাভ হবে? পেটের ধান্দায় ট্যাকসি চালাই। দুটো পয়সার লোভ ছাড়ব কেন?
কল্যাণ এবার আনন্দের চোখের দিকে তাকাল। তখনই আনন্দ ফুটপাতে দাঁড়ানো লোকটাকে মিলিয়ে যেতে দেখেছিল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নেমেছেন আর প্যাসেঞ্জারদের কথা শুনবেন না? গাড়ি জ্বালাব না বললে তো আপনি যাচ্ছিলেন না!
গাড়ি আপনি জ্বালাতে পারতেন না। অ্যাক্সিডেন্ট না করলে আমাদের গাড়ি জ্বলে না। আপনি প্যারাডাইসের কথাটা বলামাত্র আমার মনে হল ফালতু ঝামেলা করে কি লাভ!
কেন মনে হল?
প্যারাডাইস যারা জ্বেলেছে তারা হিম্মতবাজ লোক। আমি মশাই একবার প্যাসেঞ্জার নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে। আপ ডাউন প্লাস তিরিশ টাকা। নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এক সাহেব তার সেক্রেটারিকে নিয়ে আমার ট্যাকসিতে ফুর্তি করতে গিয়েছিল। মেয়ের বয়সী সেক্রেটারি। ঠিক করেছে পুড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু কি লাভ? পুরো দেশটাই তো এখন প্যারাডাইস। শেষের দিকে ট্যাকসিওয়ালা যেন নিজের মনেই কথাগুলো বলল।
কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আনন্দ ওকে ইশারা করল চুপ করতে। ব্যাপারটা আনন্দর মন ভাল করে দিল। এই লোকটার বিরুদ্ধে একটু আগে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। যে ব্যবহার করতে ও অভ্যস্ত তাই করেছিল। এবং এখনও নিজের দোষ লোকটা দেখতে পাচ্ছে না। অথচ প্যারাডাইস সম্পর্কে বেশ খবরাখবর রাখে। অন্তত একটি মানুষকে সে দেখতে পেল যে মনে করছে কাজটা ভাল হয়েছে। আচ্ছা, যদি লোকটা জানতে পারত তার গাড়িতেই সেই লোকগুলোর দুজন বসে আছে তাহলে কি করত? হাত মেলাতে, না সোজা ওদের লালবাজারে পৌঁছে দিত? ঠিক উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
মেট্রোর সামনে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল ওরা। এখন বেশ বোদ। যদিও এসপ্ল্যানেড়ে বেশ ভিড়। মেট্রোতে যে হিন্দী ছবিটা চলছে সেখানে কোন লোক নেই অবশ্য। একজন বাঙালি পরিচালকের তৈরি আলাদা জাতের ছবি বলে কাগজগুলো খুব লিখেছে। অথচ দর্শক আসছে না মোটেই। ওরা রাস্তা পেরিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগোল।
দূর থেকে দেখতে পেল ওঁরা। সুদীপ সিগারেট খাচ্ছে। ওর পাশে জয়িতা, চোখে সানগ্লাস। জয়িতা তার খাটো চুল ঝুঁটি করে বেঁধেছে। এবং অবাক কাণ্ড, এখন ও শাড়ি পরেছে। সেই শাড়িটা যেটা ও পরে গিয়েছিল প্যারাডাইসে। মেয়েটাকে শাড়ি পরলে খারাপ দেখায় না। তারপরে সুটকেস দুটো নজরে এল। দেখলে মনে হবে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে ওরা। ওদের দেখে সুদীপ ঘড়ি চোখের সামনে আনল, কুড়ি মিনিট লেট।
আনন্দ বলল, সরি! তুই সানগ্লাসটা খোল।
জয়িতার কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন? খারাপ দেখাচ্ছে?
আনন্দ মাথা নাড়ল, না। সেটাই গোলমাল। সবাই তোর দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ শাড়ি পরতে গেলি কেন? সুদীপ, আমাদের হাতে সময় নেই।
সুদীপ শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?
তোদের আজই ঠাকুরপুকুরে যাওয়া হবে না। জয়িতা তোর বাড়িতে ফিরে চল্।
কেন? আমি তোকে বলেছি ওখানে থাকব না। সুদীপ প্রতিবাদ করল।
তোকে থাকতে বলছি না। আজ রাত্রেই বড়বাজারে অ্যাকশন করব আমরা। ওরা সন্দেহ করেছে। ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাববার আগেই অ্যাটাক করা দরকার। আর দেবি করিস না, তৈরি হতে হবে আমাদের। আনন্দ হাত বাড়িয়ে আর একটা ট্যাকসিকে থামাল।