বেতাল কহিল, মহারাজ!
চন্দ্ৰশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে বণিক বাস করিত। তাহার উন্মাদিনী নামে পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। সে বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা, তত্ৰত্য নরপতির নিকটে গিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমার এক সুরূপা কন্যা আছে; যদি আপনকার অভিরুচি হয়, গ্ৰহণ করুন; নতুবা, অন্য ব্যক্তিকে দিব।
রাজা, দুই তিন বয়োবৃদ্ধ প্রধান রাজপুরুষদিগকে, উন্মাদিনীর লক্ষণপরীক্ষার্থে, প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, রত্নদত্তের আলয়ে উপস্থিত হইলেন; এবং, উন্মাদিনীকে ইন্দ্রের অপ্সরা অপেক্ষাও অধিকতর রূপবতী ও সর্বপ্রকারে সুলক্ষণ দেখিয়া, পরামর্শ করিলেন, এই কন্যা মহিষী হইলে, রাজা, ইহার নিতান্ত বশতাপন্ন হইয়া, এক বারেই রাজ্যচিন্তা পরিত্যাগ করিবেন। অতএব উত্তম কল্প এই, রাজার নিকটে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া পরিচয় দেওয়া যাউক। অনন্তর, তাঁহারা রাজসমীপে পরামর্শানুরূপ সংবাদ দিলে, তিনি, তদীয় বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, অস্বীকার করিলেন। তখন রত্নদত্ত, সৈন্যাধ্যক্ষ বলভদ্রবর্মার সহিত, আপনি কন্যার বিবাহ দিল।
এক দিন, রাজা, নগরভ্রমণে নিৰ্গত হইয়া, সেনাপতির বাটীর নিকটে উপস্থিত হইলেন। ঐ সময়ে, উন্মাদিনী, মনোহর বেশভূষা করিয়া, অট্টালিকার উপরিদেশে দণ্ডায়মান ছিল। রাজা, উন্মাদিনীকে নয়নগোচর করিয়া, মোহিত ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰত্যাগমন করিলেন। রাজাকে সহসা প্ৰত্যাগত ও বিচেতন্যপ্রায় দেখিয়া, এক প্রিয় পার্শ্বচর জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! কি নিমিত্তে আজ। আপনাকে নিতান্ত চলচিত্ত দেখিতেছি। রাজা কহিলেন, আদ্য বলভদ্রের ভবনে একটি স্ত্রীলোক দেখিলাম; তদীয় লোকাতীত রূপলাবণ্য দর্শনে, আমার মন মোহিত হইয়াছে, ও আমি এইরূপ বিকলচিত্ত হইয়াছি।
পার্শ্বচর কহিল, মহারাজ! যাহাকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন, সে রত্নদত্তের কন্যা; তাহার নাম উন্মাদিনী। আপনি অস্বীকার করাতে, সেনাপতি বলভদ্রের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে। রাজা কহিলেন, আমি যাহাদিগকে ঐ কন্যার রূপ ও লক্ষণ দেখিতে পাঠাইয়াছিলাম, বুঝিলাম, তাহারা প্রতারণা করিয়াছে। অনন্তর, রাজার আহ্বান অনুসারে, রাজপুরুষেরা তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, তিনি তাঁহাদিগকে বলিলেন, দেখ, আজ আমি, নগরভ্রমণে নিৰ্গত হইয়া, রত্নদত্তের কন্যাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। জন্মাবচ্ছিন্নে, তাহার ন্যায় সুরূপা সুলক্ষণা নারী আমার নয়নগোচর হয় নাই। তবে তোমরা, কি নিমিত্তে, তৎকালে তাহাকে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া, আমায় তাদৃশ স্ত্রীরত্নলাভে বঞ্চিত করিলে।
রাজপুরুষেরা কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিলেন, মহারাজ! যে আজ্ঞা করিতেছেন, তাহা যথাৰ্থ বটে। কিন্তু তৎকালে আমরা বিবেচনা করিয়াছিলাম, এরূপ সুরূপা কন্যা মহিষী হইলে, মহারাজ, রাজকাৰ্য পরিত্যাগ করিয়া, অহোরাত্র অন্তঃপুরে অবস্থিতি করিবেন। তাহাতে রাজ্যভঙ্গের সম্ভাবনা। এই আশঙ্কায়, আমরা ঐ কন্যাকে, মহারাজের নিকট, কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদের যে অপরাধ হইয়াছে, ক্ষমা করিতে আজ্ঞা হয়। রাজা, তোমরা যাহা কহিলে, তাহা সৰ্বতোভাবে ন্যায়ানুগত বটে; ইহা কহিয়া তাহাদিগকে বিদায় দিলেন। কিন্তু আপনি, নিতান্ত বিচেতন হইয়া, দিন যামিনী, কেবল উন্মাদিনীচিন্তায় নিমগ্ন রহিলেন। রাজার এই অবস্থা কৰ্ণ পরম্পরায় নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, সেনাপতি বলভদ্ৰবৰ্মা, রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! বলভদ্র আপনকার দাস, উন্মাদিনী দাসী। দাসীর নিমিত্তে ঈদৃশ ক্লেশস্বীকারের আবশ্যকতা কি। মহারাজের আজ্ঞা হইলেই, সে উপস্থিত হইতে পারে।
রাজা শুনিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন; এবং কহিলেন, আমার কি ধৰ্মজ্ঞান নাই যে, পরস্ত্রীস্পর্শ দ্বারা পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইব। শাস্ত্রকারেরা পরস্ত্রীতে মাতৃদৃষ্টি করিতে কহিয়াছেন। বলভদ্ৰ কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রকারেরা ইহাও নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন, পত্নীর উপর পরিণেতার সর্বতোমুখী প্রভূত আছে। তদনুসারে, আমি আপনাকে উন্মদিনী দান করিতেছি; তাহা হইলে আর মহারাজের পরস্ত্রীস্পর্শদোষের আশঙ্কা থাকিতেছে না। রাজা কহিলেন, যাহাতে সমস্ত সংসারে অপযশ হইবেক, প্ৰাণান্তেও আমি এরূপ কৰ্ম করিব না। যশোধনেরা, পঞ্চীকৃতভূতপঞ্চময় ক্ষণবিনশ্বর শরীরের অনুরোধে, অবিনশ্বর যশঃশরীরের অপক্ষয় করেন না।
সেনাপতি কহিলেন, মহারাজ! আমি তাহাকে, গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিয়া, অন্য স্থানে রাখিব; তাহা হইলে সে সাধারণ স্ত্রী হইবেক; তখন আর অপযশের আশঙ্কা কি। রাজা, শুনিয়া, পূর্ব অপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া, কহিলেন, যদি তুমি পতিব্ৰতা কামিনীকে কুলটা কর, আমি তোমার গুরুতর দণ্ডবিধান করিব, এবং জন্মাবচ্ছিন্নে আর মুখাবলোকন করিব না। তখন বলভদ্র, ভীত ও নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, প্ৰণাম করিয়া বিদায় লইলেন। কিন্তু উন্মাদিনীচিন্তা, কালস্বরূপিনী হইয়া, দশম দিবসে রাজার প্রাণসংহার করিল।
প্রভূভক্ত বলভদ্র, এবংবিধ ধর্মশীল স্বামীর প্রাণবিনাশসংবাদ শ্রবণে, সাতিশয় শোক ও পরিতাপ প্রাপ্ত হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, এতাদৃশ প্রভূর লোকান্তর গমনের পর, আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি। বিবেচনা করিলে, আমার নিমিত্তেই স্বামীর এই অকালমৃত্যু হইল। জানি না, জন্মান্তরে, এই পাপে, আমায় কত যাতনাভোগ করিতে হইবেক। এক্ষণে, প্ৰাণত্যাগীরূপ প্ৰায়শ্চিত্ত করিয়া, আত্মাকে বিশুদ্ধ করি। এইরূপ অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া, তিনি প্ৰেতভূমিতে উপস্থিত হইলেন, এবং, চিতা প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া, সূর্যদেবের অভিমুখে দণ্ডায়মান হইয়া, প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, ভগবান ভাস্কর! আমি, কৃতাঞ্জলি হইয়া, একাগ্ৰচিক্তে প্রার্থনা করিতেছি, যেন জন্মে জন্মে এইরূপ ধর্মপরায়ণ প্ৰভূ পাই।
এই বলিয়া, বলভদ্ৰ প্ৰজ্বলিত চিতায় আরোহণ করিলে, তাহার পত্নী উন্মাদিনী মনে মনে বিবেচনা করিল, আমার আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি; বরং সহগমনপথ অবলম্বন করিলে, পরকালে সদগতি পাইব। ধর্মশাস্ত্রপ্রবর্তকেরা কহিয়াছেন, সহগমন স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম। নারী, চিরকাল দুশ্চারিণী হইলেও, সহগমনবলে, স্বামীর সহিত স্বৰ্গলোকে, অনন্ত কাল, সুখসম্ভোগ করে; এবং, পতি অতি দুরাচার ও পাপাত্মা হইলেও, সহগমনপ্রভাবে, নারী তাহারও উদ্ধারকারিণী হয়। এই ভাবিয়া, সহগামিনী হইয়া, উন্মাদিনী প্ৰাণত্যাগ করিল।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। এই তিন জনের মধ্যে, কোন ব্যক্তির ভদ্রতা অধিক। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, রাজার। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। তিনি কহিলেন, রাজা উন্মাদিনীর নিমিত্তে প্ৰাণত্যাগ করিলেন, তথাপি, অধর্ম ও আপযশের ভয়ে, পরস্ত্রীস্পর্শে প্রবৃত্ত হইলেন না। আর, স্বামীর নিমিত্ত সেবকের প্রাণত্যাগ করা উচিত কর্ম। স্ত্রীলোকেরও স্বামীর সহগামিনী হওয়া প্ৰধান ধর্ম। অতএব, রাজার ভদ্রতাই, আমার বিবেচনায়, সর্বাপেক্ষা অধিক।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।