১৬. শো কেসে রবারের দস্তানা

শো কেসে রবারের দস্তানা দেখে এক আইরিশম্যান আরেক আইরিশম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিল, জিনিসটা কোন্ কাজে লাগে। দ্বিতীয় আইরিশম্যানও সেই রকম, বলল, জানিসনে, এ দস্তানা পরে হাত ধোয়ার ভারী সুবিধে। হাত জলে ভেজে না, অথচ হাত ধোওয়া হল।

কুঁড়ে লোকের যদি কখনো শখ হয় যে সে ভ্রমণ করবে অথচ ভ্রমণ করার ঝুঁকি নিতে সে নারাজ হয় তবে তার পক্ষে সবচেয়ে প্রশস্ত পন্থা কাবুলের সংকীর্ণ উপত্যকায়। কারণ কাবুলে দেখবার মত কোনন বালাই নেই।

তিন বছর কাবুলে কাটিয়ে দেশে ফেরবার পর যদি কোনো সবজান্তা আপনাকে প্রশ্ন করেন, দেহ-আফগানান যেখানে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে মিশেছে তার পিছনের ভাঙা মসজিদের মেহরাবের বাঁ দিকে চেনমতিফে ঝোলানো মেডালিয়োনেতে আপনি পদ্মফুলের প্রভাব দেখেছেন? তা হলে আপনি অম্লান বদনে বলতে পারেন না কারণ ওরকম পুরোনো কোনো মসজিদ কাবুলে নেই।

তবু যদি সেই সবজান্তা ফের প্রশ্ন করেন, বুখারার আমীর পালিয়ে আসার সময় যে ইরানী তসবিরের বাণ্ডিল সঙ্গে এনেছিলেন, তাতে হিরাতের জরীন-কলম ওস্তাদ বিহজাদের আঁকা সমরকন্দের পোলল খেলার ছবি দেখেছেন? আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন না কারণ কাবুল শহরে ওরকম কোনো তসবিরের বাণ্ডিল নেই।

পণ্ডিতদের কথা হচ্ছে না। যে আস্তাবলে সিকন্দর শাহের ঘোড়া বাঁধা ছিল, সেখানে এখন হয়ত বেগুন ফলছে। পণ্ডিতরা কম্পাস নিয়ে তার নিশানা লাগাতে পারলে আনন্দে বিহ্বল। কোথায় এক টুকরো পাথরে বুদ্ধের কোঁকড়া চুলের আড়াই গাছা ঘষে ক্ষয়ে প্রায় হাতের তেলোর মত পালিশ হয়ে গিয়েছে; তাই পেয়ে পণ্ডিত পঞ্চমুখ— পাড়া অতিষ্ঠ করে তোলেন। এদের কথা হচ্ছে না। আমি সাধারণ পাঁচজনের কথা বলছি, যারা দিল্লী আগ্রা সেকেন্দ্রার জেল্লাই দেখেছে। তাদের চোখে চটক, বুকে চমক লাগাবার মত রসবস্তু কাবুলে নেই।

কাজেই কাবুলে পৌঁছে কাউকে তুর্কীনাচের চৰ্কিবাজি খেতে হয় না। পাথর-ফাটা রোদ্দু রে শুধু পায়ে শান বাঁধানো ছফার্লোঙী চত্বর ঘষ্টাতে হয় না, নাকে মুখে চামচিকে বাদুড়ের থাবড়া খেয়ে খেয়ে পচা বোটকা গন্ধে আধা ভিরমি গিয়ে মিনার-শিখর চড়তে হয় না।

আইরিশম্যানের মত দিব্যি হাত ধোওয়া হল, অথচ হাত ভিজল না।

তাই কাবুল মনোরম জায়গা। এবং সবচেয়ে আরামের কথা হচ্ছে যে, যা কিছু দেখবার তা বিনা মেহন্নতে দেখা যায়। বন্ধুবান্ধবের কেউ না কেউ কোনো একটা বাগানে সমস্ত দিন কাটাবার জন্য একদিন ধরে নিয়ে যাবেই।

গুলবাগ কাবুলের কাছেই হেঁটে, টাঙ্গায়, মোটরে যে কোনো কৌশলে যাওয়া যায়।

তিন দিকে উঁচু দেওয়াল, একদিকে কাবুল নদী; তাতে বঁধ দিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা পুকুরের মত শান্ত স্বচ্ছ করা হয়েছে। বাগানে অজস্র আপেল-নাসপাতির গাছ, নরগিস ফুলের চারা, আর ঘন সবুজ ঘাস। কার্পেট বানাবার অনুপ্রেরণা মানুষ নিশ্চয় এই ঘাসের থেকেই পেয়েছে। সেই নরম তুলতুলে ঘাসের উপর ইয়ার-বক্সী ভালো ভালো কার্পেট পেতে গাদাগোব্দ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসবেন। পাঁচ মিনিট যেতে না-যেতে সবাই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়বেন।

দীর্ঘ তন্বী চিনারের ঘন-পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে দেখবেন আস্বচ্ছ ফিরোজা আকাশ। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখবেন কাবুল পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘের হুটোপুটি। কিম্বা দেখবেন হুটোপুটি নয়, এক পাল সাদা মেঘ যেন গৌরীশঙ্কর জয় করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কোমর বেঁধে প্ল্যানমাফিক একজন আরেকজনের পিছনে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে চূড়ো পেরিয়ে ওদিকে চলে যাবার তাদের মতলব। ধীরে সুস্থে গড়িয়ে গড়িয়ে খানিকটে চড়ার পর কোন্ এক অদৃশ্য নন্দীর ত্রিশূলে বা খেয়ে নেমে আসছে, আবার এগচ্ছে, আবার ধাক্কা খাচ্ছে। তারপর আলাদা ট্যাকটিক চালাবার জন্য দুতিনজন একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরে বিলকুল এক হয়ে গিয়ে নূতন করে পাহাড় বাইতে শুরু করবে। হঠাৎ কখন পাহাড়ের আড়াল থেকে আরেক দল মেঘের চূড়োয় পৌঁছতে পেরে খানিকটে মাথা দেখিয়ে এদের যেন লজ্জা দিয়ে আড়ালে ডুব মারবে।

উপরের দিকে তাকিয়ে দেখবেন চিনারপল্লব, পাহাড় সব কিছু ছাড়িয়ে উধ্বে অতি উধ্বে আপনারই মত নীল গালচেয় শুয়ে একখানা টুকরো মেঘ :অতি শান্ত নয়নে নিচের মেঘের গৌরীশঙ্করঅভিযান দেখছে আপনারই মত। ওকে মেঘদূত করে হিন্দুস্থান পাঠাবার যো নেই। ভাবগতিক দেখে মনে হয় যেন বাবুরশাহের আমল থেকে সে ঐখানে শুয়ে আছে, আর কোথাও যাবার মতলব নেই। পানশিরের আবদুর রহমান এরই কাছ থেকে চুপ করে বসে থাকার কায়দাটা রপ্ত করেছে।

নাকে আসবে নানা অজানা ফুলের মেশা গন্ধ। যদি গ্রীষ্মের অন্তিম নিঃশ্বাস হয়, তবে তাতে আরো মেশানো আছে পাকা আপেল, অ্যাপ্ৰিকটের বাসী বাসী গন্ধ। তিন পাচিলের বন্ধ হাওয়াতে সে গন্ধ পচে গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি নেশার আমেজ লাগায়। চোখ বন্ধ হয়ে আসে তখন শুনতে পাবেন উপরের হাওয়ার দোলে তরুপল্লবের মর্মর আর নাম-না-জানা পাখির জান-হানাদেওয়া ক্লান্ত কূজন।

সব গন্ধ ডুবিয়ে দিয়ে অতি ধীরে ধীরে ভেসে আসবে বাগানের এক কোণ থেকে কোর্মা-পোলাও রান্নার ভারী খুশবাই। চোখে তন্দ্রা, জিভে জল। দ্বন্দ্বের সমাধান হবে হঠাৎ গুড়ম শব্দে, আর পাহাড়ে পাহাড়ে মিনিটখানেক ধরে তার প্রতিধ্বনি শুনে।

কাবুলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় থেকে বেলা বারোটার কামান দাগার শব্দ। সবাই আপন আপন টাকঘড়ি খুলে দেখবেন হাতঘড়ির রেওয়াজ কম ঘড়ি ঠিক চলছে কিনা। কাবুলে এ রেওয়াজ অলঙ্ঘনীয়। ঘড়ি না-বের-করা বের লক্ষণ,–আহা যেন একমাত্র ওঁয়ার ঘড়িরই চেক-আপের দরকার নেই—

যাদের ঘড়ি কাটায় কাঁটায় বারোটা দেখালো না, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। কাবুলের কামান নাকি ইহজন্মে কখনো ঠিক বারোটার সময় বাজেনি। কারো ঘড়ি যদি ঠিক বারোটা দেখাল তার তবে রক্ষে নেই। সকলেই তখন নিঃসন্দেহ যে, সে ঘড়িটা দাগী-খুনী— ওঁদের ঘড়ির মত বেনিফিট অব ডাউট পেতে পারে না। গান্ধার শিল্পের বুদ্ধমূর্তির চোখেমুখে যে অপার তিতিক্ষা, তাই নিয়ে সবাই তখন সে ঘড়িটার দিকে করুণ নয়নে তাকাবেন।

মীর আসলম আরবী ছন্দে ফার্সী বলতেন অর্থাৎ আমাদের দেশে ভটচাযরা যে রকম সংস্কৃতের তেলে ডোবানো সপসপে বাঙলা বলে থাকেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভ্রাতঃ, চহারমগজ শিকন কি বস্তু তস্য সন্ধান করিয়াছ কি?

আমি বললুম, চহার মানে চার আর মগজ মানে মগজ, শিকন্তন মানে টুকরো টুকরো করা। অর্থাৎ যা দিয়ে চারটে মগজ ভাঙা যায়, এই আরবী ব্যাকরণ-ট্যাকরণ কিছু হবে আর কি?

মীর আসলম বললেন, চহার-মগজ মানে চতুর্মস্তিষ্ক অতি অবশ্য সত্য, কিন্তু যোগরূঢ়ার্থে ঐ বস্তু আক্ষোট অথবা আখবোট। অতএব চহার-মগজ-শিকন বলিতে শক্ত লোহার হাতুড়ি বোঝায়। তারপর দাগীঘড়িওয়ালা প্যারিসফের্তা সইফুল আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় বরাদরে আজীজে মন্, হে আমার প্রিয় ভ্রাতঃ, যোগরূঢ়ার্থে ঘটিকাযন্ত্র অথচ ধর্মত কার্যত যে দ্রব্য চহার-মগজশিকন সে বস্তু তুমি তোমার যাবনিক অঙ্গরক্ষার আস্তরণ মধ্যে পরম প্রিয়তমার ন্যায় বক্ষ-সংলগ্ন করিয়া রাখিয়াছ কেন? অপিচ পশ্য, পশ্য, অদূরে উদ্যানপ্রান্তে পরিচারকবৃন্দ উপযুক্ত যন্ত্রাভাবে উপলখণ্ড দ্বারা অক্ষরোট ভগ্ন করিবার চেষ্টায় গলদঘর্ম হইতেছে। তোমার হৃদয় কি ঐ উপলখণ্ডের ন্যায় কঠিন অথবা বজ্ৰাদপি কঠোর?

দাগী ঘড়ি রাখা এমনি ভয়ঙ্কর পাপ যে, প্যারিসকের্তা বাকচতুর সইফুল আলম পর্যন্ত একটা জুতসই উত্তর দিতে পারলেন না। সাদামাটা কি একটা বিড় বিড় করলেন যার অর্থ এক মাঘে শীত যায় না।

মীর আসলম বললেন, ঐ সহস্র হস্ত উচ্চ পর্বতশিখর হইতে তথাকথিত দ্বাদশ ঘটিকার সময় এক সনাতন কামান ধূম্র উদগিরণ করে— কখনো কখনো তজ্জনিত শব্দও কাবুল নাগরিকরাজির কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। শুনিয়াছি, একদা দ্বিপ্রহরে তোপচী লক্ষ্য করিল যে, বিস্ফোরকচুর্ণের অনটন। কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে আদেশ করিল সে যেন নগরপ্রান্তের অস্ত্রশালা হইতে প্রয়োজনীয় চুর্ণ আহরণ করিয়া লইয়া আইসে। কনিষ্ঠ ভাতা সেই সহস্র হস্ত পরিমাণ পর্বত অবতরণ করিল, শ্রান্তি দূরার্থে বিপণি মধ্যে প্রবেশ করত অষ্টাধিক পাত্র চৈনিক যুষ পান করিল, প্রয়োজনীয় ধূম্রচূর্ণ আহরণ করত পুনরায় সহস্রাধিক হস্ত পর্বতশিখরে আরোহণ করিয়া কামানে অগ্নিসংযোগ করিল। স্বীকার করি, অপ্রশস্ত দিবালোকেই সেইদিন নাগরিকবৃন্দ কামানধ্বনি শুনিতে পাইয়াছিল, কিন্তু ভ্রাতঃ সইফুল আলম, সেইদিনও কি তোমার চহার-মগজ-শিকন কণ্টকে কণ্টকে দ্বাদশ ঘটিকার লাঞ্ছন অঙ্কন করিয়াছিল?

আমি বললুম, এ রকম ঘড়ি আমাদের দেশেও আছে–তাকে বলা হয়, আঁব-পাড়ার ঘড়ি।

সইফুল আলম আর মীর আসলম ছাড়া সবাই জিজ্ঞেস করলেন, আঁব কি? সইফুল আলম বোম্বাই হয়ে প্যারিস যাওয়া-আসা করেছেন। কিন্তু মীর আসলম?

তিনিই বললেন, আম্র অতীব সুরসাল ভারতীয় ফলবিশেষ। দ্রাক্ষা আন্ত্রের মধ্যে কাহাকে রাজমুকুট দিব সেই সমস্যা এ যাবৎ সমাধান করিতে পারি নাই।।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, কিন্তু আপনি আম খেলেন কোথায়?

মীর আসলম বললেন, চতুর্দশ বৎসর হিন্দুস্থানের দেওবন্দ রামপুরে শাস্ত্রাধ্যয়ন করিয়া অদ্য তোমার নিকট হইতে এই প্রশ্ন শুনিতে হইল? কিন্তু শোকাতুর হইব না, লক্ষ্য করিয়াছি তোমার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল। শুভলগ্নে একদিন তোমাকে ভারত-আফগানিস্থানের সংস্কৃতিগত যোগাযোগ সম্বন্ধে জ্ঞানদান করিব। উপস্থিত পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাইবে তোমার অনুগত ভৃত্য আবদুর রহমান খান তোমার মুখারবিন্দ দর্শনাকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হইয়া দণ্ডায়মান।

কী আপদ, এ আবার জুটল কোত্থেকে?

দেখি হাতে লুঙ্গি তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বলল, খানা তৈরী হতে দেরী নেই, যদি গোসল করে নেন।

ইয়ারদোস্তের দুচারজন ততক্ষণে বাঁধে নেমেছে। সবাই কাবুল-বাসিন্দা, সাঁতার জানেন না, জলে নামলেই পাথরবাটি। মাত্র একজন চতুর্দিকে হাত-পা ছুঁড়ে, বারিমন্থনে গোয়ালন্দী জাহাজকে হার মানিয়ে বিপুল কলরবে ওপারে পৌঁছে হাঁপাচ্ছেন। এপারে অফুরন্ত প্রশংসাধ্বনি, ওপারে বিরাট আত্মপ্রসাদ। কাবুল নদী সেখানটায় চওড়ায় কুড়ি গজও হবে না।

কিন্তু সেদিন গুলবাগে কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল। কাবুলীরা কখনো ডুবসাঁতার দেখেনি।

ঐ একটিবারই এপার-ওপার সাঁতার কেটেছিলুম। ও রকম ঠাণ্ডা জল আমাদের দেশের শীতকালের রাতদুপুরে পানাঠাসা এদো পুকুরেও হয় না। সেই দুমিনিট সাঁতার কাটায় খেসারতি দিয়েছিলুম ঝড়া একঘণ্টা রোদ্দু রে দাঁড়িয়ে, দাঁতে সঁতে কত্তাল বাজিয়ে, সব্বাঙ্গে অশথপাতার কঁপন জাগিয়ে।

মীর আসলম অভয় দিয়ে বললেন, বরফগলা জলে নাইলে নিওমোনিয়ার ভয় নেই।।

আমি সায় দিয়ে বললুম, মানসসরোবরে ডুব দিয়ে যখন মানুষ মরে না, তখন আর ভয় কিসের? কিন্তু বুঝতে পারলুম বন্ধু বিনায়ক রাও মসোজী মানসসরোবরে ডুব দেবার পর কেন তিন ঘণ্টা ধরে রোদ্দু রে ছুটোছুটি করেছিলেন। মানস বিশ হাজার ফুটের কাছাকাছি কাবুল সাত হাজারও হবে না।

কিন্তু সেদিন মীর আসলম আর সইফুল আলম ছাড়া সকলেরই দৃঢ়বিশ্বাস হয়েছিল যে, আমি মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ায় তখন প্রাণের ভয়ে কাঁপছি। শেষটায় বিরক্ত হয়ে বললুম, আবার না হয় ডুব-সাঁতার দেখাচ্ছি।

সবাই হাঁ হাঁ, কর কি, কর কি, বলে ঠেকালেন। অবশ্যমৃত্যুর হাত থেকে এক মুসলমানকে আরেক মুসলমানের জান বাঁচানো অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য।

তিন টুকরো পাথর, বাগান থেকেই কুড়ানো শুকনো ডাল-পাতা আর দুচারটে হাঁড়িবাসন দিয়ে উত্তম রান্না করার কায়দায় ভারতীয় আর কাবুলী বঁধুনীতে কোনো তফাত নেই। বিশেষত মীর আসলম উনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহে গড়ে-ওঠা পণ্ডিত। অর্থাৎ গুরুগৃহে থাকার সময় ইনি রান্না করতে শিখেছিলেন। তাঁর তদারকিতে সেদিনের রান্না হয়েছিল যেন হাজিফের একখানা উৎকৃষ্ট গজল।

যখন ঘুম ভাঙলো, তখন দেখি সমস্ত বাগান নাক ডাকাচ্ছে— একমাত্র হুকোটা ছাড়া। তা আমরা যতক্ষণ জেগেছিলুম, সে এক লহমার তরেও নাক ডাকানোতে কামাই দেয়নি। কিন্তু কাবুলী তামাক ভয়ংকর তামাক— সাক্ষাৎ পেল্লাদ মারা গুলী। প্রহ্লাদকে হাতীর পায়ের তলায়, পাহাড় থেকে ফেলে, পাষাণ চাপা দিয়ে মারা যায়নি, কিন্তু এ তামাকে তিনি দুটি দম দিলে আর দেখতে হত না। এ তামাক লোকে যত না খায়, তার চেয়ে বেশী কাশে। ঠাণ্ডা দেশ বলে আফগানিস্থানের তামাক জাতে ভালো, কিন্তু সে তামাককে মোলায়েম করার জন্য চিটে-গুড়ের ব্যবহার কাবুলীর। জানে না, আর মিষ্টি-গরম ধিকিধিকি আগুনের জন্য টিকে বানাবার কায়দা তারা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি।

পড়ন্ত রোদে দীর্ঘ তরুর দীর্ঘতর ছায়া বাগান জুড়ে ফালি ফালি দাগ কেটেছে। সবুজ কালোর ডোরাকাটা নাদুসনুদুস জেব্রার মত বাগানখানা নিশ্চিন্দি মনে ঘুমচ্ছে। নরগিস ফুল ফোঁটার তখনন অনেক দেরী, কিন্তু চারা-ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারা যেন বোদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঙা হয়ে উঠেছে। কল্পনা না সত্যি বলতে পারব না, কিন্তু মনে হল যেন অল্প অল্প গন্ধ সেদিক থেকে ভেসে আসছে। রাত্তিরে যে খুশবাইয়ের মজলিশ বসবে, তারি মোহড়ার সেতারে যেন অল্প অল্প পিড়িং পিড়িং মিঠা বোল ফুটে উঠছে। জলে ছাওয়ায়, মিঠে হাওয়ায় সমস্ত বাগান সুধাশ্যামলিম, অথচ এই বাগানের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার ফুট উঁচু কালো নেড়া পাথরের খাড়া পাহাড়। তাতে এক ফোঁটা জল নেই, এক মুঠো ঘাস নেই। বুকে একরত্তি দয়ামায়ার চিহ্ন নেই— যেন উলঙ্গ সাধক মাথায় মেঘের জটা বেঁধে কোনো এক মন্বন্তরব্যাপী কঠোর সাধনায় মগ্ন।

পদপ্রান্তে গুলবাগের সবুজপরী কেঁদে কেঁদে কাবুল নদী ভরে দিয়েছে।

ফকীরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

 

বাড়ি ফিরে কোনো কাজে মন গেল না। বিছানায় শুয়ে আবদুর রহমানকে বললুম, জানলা খুলে দিতে। দেখি পাহাড়ের চূড়ায় সপ্তর্ষি। আঃ বলে চোখ বন্ধ করলুম। সমস্ত দিন দেখেছি অজানা ফুল, অজানা গাছ, আধাচেনা মানুষ, আর অচেনার চেয়েও পীড়াদায়ক অপ্রিয়দর্শন শুষ্ক কঠিন পর্বত। হঠাৎ চেনা সপ্তর্ষি দেখে সমস্ত দেহমন জুড়ে দেশের চেনা ঘর-বাড়ির জন্য কি এক আকুল আগ্রহের আঁকুবাকু ছড়িয়ে পড়ল।

স্বপ্নে দেখলুম, মা এষার নমাজ পড়ে উত্তরের দাওয়ায় বসে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *