ষোড়শ পরিচ্ছেদ – শিল্প
[এই পরিচ্ছেদে নিম্নলিখিত পরিভাষা ব্যবহৃত হইয়াছে : অট্টালক (Tower); অধিষ্ঠান (Basement); অর্ধচিত্র Bas-relief); অলিন্দ (Corridor) কক্ষ (Bay); কুড্যস্তম্ভ (Pilaster); google (Niche); cpogettent saptamattani (Nave and Aisle); usipo পলকাটা (Cusp); পরট (Parapet); পলকাটা (Flueted); বলভি (Turret);
এই অধ্যায় প্রধানত আহম্মদ হাসান দানি প্রণীত “Muslim Architecture in Bengal মনোমোহন চক্রবর্তী লিখিত Bengali Temples and their characteristices’ নামক প্রবন্ধ এবং শ্রীঅমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ অবলম্বনে রচিত হইয়াছে।]
১
সুলতানী যুগ
মধ্যযুগে বাংলার স্থাপত্য-শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় মুসলমান সুলতানদের নির্মিত মসজিদ ও সমাধি-ভবনে। এই শিল্পের কয়েকটি বিশেষত্ব আছে।
প্রথমত, এগুলি প্রধানত ইষ্টকনির্মিত। স্তম্ভ ও কোন কোন স্থলে প্রাচীরের বহিরাবরণের জন্য পাথর ব্যবহার করা হইয়াছে। কখনও কখনও আর্দ্রতা হইতে রক্ষা করিবার জন্য সর্বনিম্নে একসারি পাথর বসান হইয়াছে। ইহার কারণ বাংলা দেশের পশ্চিমপ্রান্তে রাজমহলের নিকটবর্তী অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও পাহাড় নাই। সুতরাং প্রস্তর খুবই দুর্লভ ছিল। ইটের গাঁথনি মজবুত করার জন্য চুণ ব্যবহার করা হইত। তাহা ছাড়া মুঘল যুগে পলস্তারার জন্যও চুণ ব্যবহার করা হইত।
দ্বিতীয়ত, বাংলা দেশে বেশিরভাগ বাঁশের খুঁটি ও খড়ের চাল দিয়া ঘর তৈরি হইত। দোচালা ও চারচালা সাধারণত ঘরের এই দুই শ্ৰেণী। দেখা যায়, কাঠের ও ইটের বাড়ির ছাদ ইহার অনুকরণেই নির্মিত হইত। অর্থাৎ সরলরেখার পরিবর্তে খড়ের চালের ন্যায় কতকটা বাঁকানো হইত। ঘরগুলিতে যেমন চারিকোণে বাঁশের খুঁটি আড়াআড়িভাবে বাঁশ লাগাইয়া মজবুত করা হইত, ইটের বাড়িতেও তেমনি চারিকোণে চারিটি ইষ্টক স্তম্ভ অট্টালকের (Tower) আকারে নির্মিত হইত। দুইটি বাঁশ অল্পদূরে পুঁতিয়া তাঁহার মাথা নোয়াইয়া বাঁধিয়া দিলে যে আকৃতি ধারণ করে, ইটের ও পাথরের স্তম্ভের উপর গঠিত খিলানগুলিও তাঁহার অনুকরণ করিত।
তৃতীয়ত, দেয়ালের গঠনে অংশবিশেষ সম্মুখে বাড়াইয়া এবং পশ্চাতে হঠাইয়া বৈচিত্র্য সৃষ্টি, ইহার গায়ে নানারকমের নক্সা, ও এক খণ্ড প্রস্তরে গঠিত স্তম্ভ প্রভৃতি প্রথম প্রথম হিন্দুযুগের অনুকরণে করা হইত। ক্রমে ক্রমে ইহার পরিবর্তন হয়। হিন্দুমন্দিরের গায়ে চতুষ্কোণ প্রস্তরের ফলকের উপর মানুষের মূর্ত্তি খোদিত হইত। কিন্তু ইসলাম ধর্ম্মে মনুষ্যমূর্ত্তি গঠন নিষিদ্ধ হওয়ায় তাঁহার বদলে নানারূপ লতাপাতা ও জ্যামিতিক নক্সা খোদাই করা হইত।
চতুর্থত, নূতন এক প্রণালীতে খিলান নির্মিত হইত। হিন্দুযুগে সাধারণত একখানা ইট (বা পাথরের উপরে ঠিক সমান্তরালভাবে আর একখানা ইট (বা পাথর) বসান হইত, কেবল তাঁহার সামান্য একটু অংশ নিচের ইটের (বা পাথরের) চেয়ে একটু বাড়ানো থাকিত। এইভাবে দুইটি স্তম্ভের উপর দুই দিক হইতে ইটের (বা পাথরের) অংশ বাড়িতে বাড়িতে যখন দুইখানি ইটের (বা পাথরের) মধ্যে ব্যবধান খুব সঙ্কীর্ণ হইত তখন এক খণ্ড বড় ইট বা পাথর এই ব্যবধানের উপর বসাইয়া খিলান তৈরি হইত। মধ্যযুগে ইট বা পাথরগুলি সমান্তরালভাবে একটির উপর একটি না বসাইয়া কোণাকুণিভাবে পাশাপাশি সাজাইয়া খিলান তৈরি হইত। ইহার নাম প্রকৃত খিলান (True Arch)। ঠিক এই প্রণালীতেই বড় বড় গম্বুজ (dome) নির্মিত হইত। এই প্রকার খিলান ও গম্বুজ মুসলমান শিল্পের বিশেষত্ব। হিন্দুযুগে ইহা অজ্ঞাত ছিল না, কিন্তু ইহার ব্যবহার ছিল খুবই কম।
পঞ্চমত, নানা রংয়ের ও নানা আকৃতির মিনা করা কাঁচের ন্যায় মসৃণ টাইল ও ইটের ব্যবহার। ভিতরের ও বাহিরের দেওয়ালে এইগুলির ব্যবহারের দ্বারা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই ছিল সাধারণ বিধি।
ষষ্ঠত, ছাদের উপর গম্বুজের পাশে বাংলা দেশের খড়ের চালের ঘরের ন্যায় ইষ্টক নির্মিত ক্ষুদ্র কক্ষের সমাবেশ। ইহার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নহে।
মুসলমান আমলের যে সকল ইমারৎ এখন পর্যন্ত মোটামুটি সুরক্ষিত অবস্থায় আছে তাঁহার কোনটিই চতুর্দ্দশ শতকের পূর্বে নির্মিত নহে। সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হর্মের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় হুগলি জিলার অন্তঃপাতী ত্রিবেণী ও ছোট পাণ্ডুয়া গ্রামে। ত্রিবেণীতে জাফরখান গাজির সমাধি-ভবন ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে প্রাচীন হিন্দুমন্দির ভাঙ্গিয়া তাঁহারই বিভিন্ন অংশ ও খোদিত কারুকার্য জোড়াতাড়া দিয়া নির্মিত হইয়াছিল। ত্রিবেণীতে একটি বিশাল মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে। ইহাও জাফরখানের নির্মিত (১২৯৮ খ্রীষ্টাব্দ)। ইহা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭৭ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৩৫ ফুট। ইহাতে খিলানযুক্ত পাঁচটি দরজা ও ছাদে পাঁচটি গম্বুজ ছিল। এগুলির ধ্বংসাবশেষ হইতে হিন্দু মন্দিরের কারুকার্যখোদিত ও মূর্ত্তিযুক্ত বহুসংখ্যক ফলক পাওয়া গিয়াছে। ছোট পাণ্ডুয়াতে একটি মসজিদ ও একটি মিনার আছে।
স্বাধীন বাংলার মুসলমান সুলতানদের রাজধানী ছিল প্রথমে গৌড়, পরে ইহার ১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত পাণ্ডুয়া এবং তাঁহার পরে আবার গৌড়। সুতরাং মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই দুই শহরেই আছে। এই দুই শহরে যে সকল মসজিদ ও সমাধি-ভবন আছে তাহা মোটামুটি নিম্নলিখিত চারি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
প্রথম : সমচতুষ্কোণ একটি গম্বুজওয়ালা কক্ষ–ভিতরে কোন স্তম্ভের ব্যবহার নাই, কার্নিসের উপর চারিকোণে চারিটি অষ্টকোণ বলভি এবং সম্মুখে অলিন্দ।
দ্বিতীয় : প্রথমের অনুরূপ, তবে ইহার তিনদিকে তিনটি অলিন্দ।
তৃতীয় : বেশি লম্বা, কম চওড়া একটি বৃহৎ ও উচ্চ কেন্দ্রশালা–ইহার উপরে খিলানের ছাদ ও দুই পাশে দুইটি কম উঁচু পার্শ্বশালা। পার্শ্বশালার উপরে একাধিক গম্বুজ এবং অভ্যন্তরভাগ স্তম্ভশ্রেণী দ্বারা লম্বালম্বি ও পাশাপাশি অনেকগুলি কক্ষায় বিভক্ত।
চতুর্থ : বেশি লম্বা, কম চওড়া একটি বৃহৎ কক্ষ–ইহার ছাদে বহুসংখ্যক গম্বুজ এবং ভিতর স্তম্ভশ্রেণী দ্বারা অনেকগুলি কক্ষায় বিভক্ত। প্রত্যেকটি লম্বালম্বি কক্ষার পশ্চিমপ্রান্তে একটি মিহরাব এবং পূর্বপ্রান্তে অর্থাৎ সম্মুখদিকে ঠিক সেই বরাবর একটি খিলান। ছাদের বহুসংখ্যক গম্বুজের খিলানগুলি স্তম্ভশ্রেণীর শীর্ষদেশে প্রতিষ্ঠিত।
পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ উল্লিখিত তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত এবং সুরক্ষিত মসজিদগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।
১৩৬৪ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান সেকন্দর শাহ ইহার নির্মাণ আরম্ভ করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষে এত বড় মসজিদ আর কখনও নির্মিত হয় নাই। ৩৯৭ ফুট দীর্ঘ এবং ১৫৯ ফুট প্রস্থ একটি মুক্ত অঙ্গনের চারি পাশে চারি সারি কক্ষ। পশ্চিমের সারি আবার স্তম্ভশ্রেণী দ্বারা পাঁচ ভাগে বিভক্ত এবং ইহার মধ্যেই উপাসনা কক্ষ। অপর তিন দিকের সারিগুলি তিন তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম সারিতে মধ্যস্থলে একটি বিশাল উচ্চ কক্ষ (৬৪ ফুট x ৩৪ ফুট) এবং দুই পাশে নীচু আর দুইটি কক্ষ। ইহার প্রত্যেকটি পাঁচ সারি স্তম্ভ দিয়া পাঁচটি কক্ষায় বিভক্ত এবং পাঁচটি খিলানের মধ্য দিয়া মধ্যের কক্ষ হইতে ঐ পাঁচটি কক্ষায় যাওয়ার পথ। মধ্যের বিশাল কক্ষটির উপরে একটি প্রকাণ্ড খিলান আকৃতি ছাদ ছিল, এখন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। মধ্য কক্ষের পশ্চাতের দেয়ালে প্রকাণ্ড মিহরাব, ইহার দক্ষিণে অনুরূপ কারুকার্য শোভিত কষ্টিপাথর নির্মিত উপাসনার বেদী। দুই পার্শ্বকক্ষের প্রত্যেকটিতে পশ্চাদভাগের প্রাচীরগাত্রে আঠারোটি কুলুঙ্গি এবং ইহাদের বরাবর অপর প্রান্তে সম্মুখের দিকে আঠারোটি উন্মুক্ত খিলান আছে। উত্তরের দিকের পার্শ্বকক্ষের খানিকটা অংশ জুড়িয়া ৮ ফুট উঁচু মোটা খাটো ২১টি কারুকার্যখচিত স্তম্ভের উপর বাদশাহ কা তখৃত অর্থাৎ রাজপরিবারের বসিবার জন্য মঞ্চ তৈরি হইয়াছে। মোট স্তম্ভ সংখ্যা ২৬০।
চারি দিকে চারি সারি কক্ষের উপরের ছাদ মোটামুটি ৩৭৬টি ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রে ভাগ করিয়া প্রত্যেকটির উপর একটি করিয়া ছোট গম্বুজ নির্মিত হইয়াছে। পশ্চিম দিকের কক্ষের সারির ঠিক মাঝখানে যে বৃহদাকার খিলান আছে তাহা ৩৩ ফুট চওড়া এবং ৬০ ফুটের বেশি উঁচু। ইহার দুই পাশে যে খিলানগুলি আছে তাহাও ৮ ফুট চওড়া। হিন্দু মন্দির হইতে উৎকৃষ্ট কারুকার্যশোভিত স্তম্ভ খুলিয়া নিয়া মিহরাবটি তৈরী হইয়াছে।
আদিনা মন্দিরের ধ্বংসের মধ্যে হিন্দু দেবদেবীর অনেক পাথরের মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। মিহরাব দুইটি উৎকৃষ্ট হিন্দু শিল্পের উপকরণ দিয়া নির্মিত।
গৌড় নগরীর গুণমন্ত এবং দরসবারি মসজিদ আদিনা মসজিদের ন্যায় পূর্ব্বোক্ত তৃতীয় শ্রেণীর মসজিদ। এই দুই মসজিদের নিকটে যে দুইটি লেখ পাওয়া গিয়াছে তাহাদের তারিখ ১৪৮৪ এবং ১৪৭৯ খ্রীষ্টাব্দ এবং অনেকেই মনে করেন যে উক্ত মসজিদ দুইটিও ঐ তারিখ। কিন্তু আদিনা মসজিদের সহিত সাদৃশ্য বিবেচনা করিলে মনে হয় মসজিদ দুইটি আরও পূর্বেই নির্মিত হইয়াছিল। লেখ দুইটি যে ঐ দুইটি মসজিদেই উত্তীর্ণ হইয়াছিল তাঁহার কোন নিশ্চয়তা নাই। গুণমন্ত মসজিদের মধ্যবর্তী বৃহৎ কক্ষের খিলান আকারের ছাদটি এখনও আছে। আদিনা ও দরসবারির ছাদ ধ্বংস হইয়াছে। সুতরাং গুণমন্ত মসজিদের ছাদের, বিশেষত ইহার নিম্ন অংশের বরগা ও খিলান-যুক্ত কুলুঙ্গিগুলি সম্ভবত অন্য দুইটি মসজিদেও ছিল।
পান্ডুয়ার একলাখী পূর্ব্বোক্ত প্রথম শ্রেণীর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অনেকেই অনুমান করেন যে ইহা জলালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের সমাধি। বাহিরের দিকে ইহা দৈর্ঘ্যে ৭৮ ফুট ও প্রস্থে ৭৪ ফুট, সুতরাং প্রায় সমচতুষ্কোণ। কিন্তু ভিতরে ইহা অষ্ট কোণ, এবং ইহার উপর অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ। ইহার প্রতি দিকে একটি করিয়া খিলানযুক্ত তোরণ। কোনও প্রাচীন হিন্দু মন্দির ধ্বংস করিয়া তাঁহার উপকরণ দিয়া এই সমাধি ভবন নির্মিত হইয়াছিল। কারণ, ইহাতে হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শনযুক্ত বহু প্রস্তরখণ্ড দেখিতে পাওয়া যায় এবং ইহার কষ্টি পাথরে নির্মিত তোরণের তলদেশে হিন্দু দেবতার মূর্ত্তি খোদিত আছে। ইহার কার্নিসটি খড়ের চালের মত ঈষৎ বাঁকানো এবং দেয়াল হইতে অনেকটা বাড়ানো।
গৌড়ের নত্তন বা লত্তন মসজিদ প্রথম শ্রেণীর মসজিদের আর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কানিংহামের মতে ইহা ১৪৭৫ খ্রীষ্টাব্দে, কিন্তু কাহারও কাহারও মতে ইহা হোসেন শাহের আমলে অর্থাৎ আরও ৩০/৪০ বৎসরে পরে নির্মিত হইয়াছিল। প্রবাদ এই যে রাজার কোন প্রিয় নর্তকী ইহা নির্মাণ করে বলিয়াই মসজিদের নাম নত্তন। মসজিদের অভ্যন্তর ৩৪ ফুট বর্গক্ষেত্র এবং বহির্দেশ ৭২ ফুট দীর্ঘ এবং ৫১ ফুট প্রস্থ। পূর্বদিকে ১১ ফুট চওড়া অলিন্দ এবং প্রতি কোণে অষ্টকোণ অট্টালক। পূর্বদিকে খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ। মধ্যবর্তী প্যানেলগুলিতে বিচিত্র কারুকার্যখচিত কুলুঙ্গি। কার্নিসগুলি ঈষৎ বাঁকানো। বারান্দার উপর তিনটি গম্বুজ, মধ্যবর্তীটি চৌচালা ঘরের আকৃতি। অন্তর্কক্ষের উপর বৃহৎ গম্বুজ, কিন্তু ইহার ভিত্তিবেদী অতিশয় নীচু। এককালে সমগ্র মসজিদটির ভিতর ও বাহির নানা রঙের মসৃণ টালির বিচিত্র জ্যামিতিক নকসায় সজ্জিত ছিল। এখন ইহার বাহিরের অংশের সাজসজ্জা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কানিংহাম, ফ্রাঙ্কলিন প্রভৃতি এই মসজিদের উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন।
গৌড়ের চিকা মসজিদ একলাখীর মত, কিন্তু আয়তনে ছোট। ইহার মধ্যে মিহরাব বা বেদী নাই। কেহ কেহ বলেন, ইহা সুলতান মামুদের (১৪৩৭-৫৯ খ্রী) সমাধি-ভবন, কিন্তু ইহার মধ্যে কোন কবর নাই। কাহারও কাহারও মতে ইহা সুলতান হোসেন শাহের নির্মিত একটি তোরণ (১৫০৪ খ্রী)–কিন্তু ইহার গঠনপ্রণালী অনেক প্রাচীন বলিয়াই মনে হয়।
গৌড়ে এবং বাংলা দেশের নানা স্থান প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক মসজিদ আছে। কোন কোনটিতে মসজিদের সামনে একটি দরদালান আছে এবং ইহার ছাদে তিনটি গম্বুজ মসজিদে যাইবার তিনটি দরজার ঠিক উপরিভাগে। কোন কোনটিতে চারি কোণে চারিটি মিনারের জায়গায় ছয়টি মিনার আছে–অতিরিক্ত দুইটি দরদালানের দুই প্রান্তে। কোন কোনটিতে ছাদের উপর বিশাল গম্বুজ একটি বৃত্তাকার স্বতন্ত্র অধিষ্ঠানের উপর থাকায় সমস্ত হৰ্মটি অনেকটা উচ্চ বলিয়া মনে হয় এবং ইহার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এইরূপ অধিষ্ঠানের অভাবে অধিকাংশ গম্বুজ খর্বাকৃতি হওয়ায় সমস্ত সৌধটির সৌন্দর্য ও মহিমা ম্লান হয়।
গৌড়ের তাঁতিপাড়া এবং ছোট সোনা মসজিদ, ত্রিবেণীতে জাফর খার মসজিদ এবং বাংলা দেশের নানা স্থানে বহুসংখ্যক মসজিদ পূর্ব্বোক্ত চতুর্থ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কেহ কেহ তাঁতিপাড়া মসজিদকে (আ ১৪৮০ খ্রী) গৌড়ের সর্বোকৃষ্ট হ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইহার ছাদ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। কিন্তু দেয়ালের উপর পোড়া মাটির ফলক এবং অন্যান্য খোদিত আভরণগুলির যে বিচিত্র সৌন্দর্য এখনও বর্তমান তাহা উক্ত মতের সমর্থন করে।
ছোট সোনা মসজিদটিও উৎকৃষ্ট শিল্পের নিদর্শন। ইহার ইষ্টক নির্মিত বাহিরের দেয়াল পুরাপুরি এবং ভিতরের দেয়াল আংশিক ভাবে প্রস্তরমণ্ডিত। এই পাথরের উপর অনেক রকমের চিত্র ও নকসা খোদিত আছে। কিন্তু এগুলি অর্ধচিত্র অপেক্ষা আরও কম উচ্চ হওয়ায় তাঁতিপাড়ার মসজিদের ভাস্কর্যের অপেক্ষা নিকৃষ্ট। ছোট সোনা মসজিদের কোন কোন গম্বুজের ভিতরের দিকে সোনার গিল্টি করার চিহ্ন আছে। সম্ভবত ইহা ইহাতেই “সোনা মসজিদ” নামের উৎপত্তি। ছোট সোনা মসজিদে গম্বুজগুলির মধ্যে একখানি চৌচালা খড়ের ঘরের আকৃতি ছোট কুটির আছে।
গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ এবং বাগেরহাটের সাত গম্বুজ মসজিদ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহাদের অভ্যন্তর ভাগ স্তম্ভের সারি দিয়া এগারটি পাশাপাশি ভাগ করা হইয়াছে। সাধারণত তিনটি বা পাঁচটি ভাগ থাকে। কেবলমাত্র ছোট পাণ্ডুয়ার (হুগলি জিলা) বারদোয়ারি মসজিদে একুশটি ভাগ আছে।
বড় সোনা মসজিদ সুলতান নসরৎ শাহ ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। ইহা দৈর্ঘ্যে ১৬৮ ফুট ও প্রস্থে ৭৬ ফুট। ইহাতে ছয়টি মিনার আছে–চারি কোণে চারিটি এবং সম্মুখের দরদালানের দুই প্রান্তে দুইটি। দরদালান ও প্রধান কক্ষের মধ্যে দশটি বৃহৎ স্তম্ভ আছে। এই কক্ষের অভ্যন্তরে দশ দশ স্তম্ভের দুইটি সারি লম্বালম্বিভাবে তিনটি ভাগে ইহাকে বিভক্ত করিয়াছে। দরদালান ও কক্ষে এগারটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার আছে ও সেই বরাবর পশ্চাৎ ভাগের প্রাচীরে এগারটি মিহরাব আছে। কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে তিনটি পাশাপাশি ভাগ জুড়িয়া একটি উচ্চ মঞ্চ আছে অনেকটা আদিনা মসজিদের বাদশাহকা তখৃতের ন্যায়। অন্য দুএকটি মসজিদেও এরূপ ব্যবস্থা আছে। কক্ষের লম্বালম্বি তিন ভাগের উপর তিন সারি, দরদালানের উপর এক সারি এবং এই প্রতি সারিতে এগারটি করিয়া মোট ৪৪টি গম্বুজ দিয়া ছাদ করা হইয়াছিল কিন্তু কক্ষের গম্বুজগুলি সবই ধ্বংস হইয়াছে। মসজিদটি ইটের তৈরী কিন্তু বাহিরে পুরাপুরি এবং ভিতরে খিলানের আরম্ভ পর্যন্ত দেয়ালের অংশ প্রস্তরমণ্ডিত। ছোট সোনা মসজিদের ন্যয় বড় সোনা মসজিদেও সোনার গিল্টি করা ছিল। ইহাতে খোদাই করা আভরণের আধিক্য নাই, কিন্তু ইহার খিলানযুক্ত দরদালান, আয়তনের বিশালতা এবং পাথরের মজবুত গঠন ইহাকে একটি অনির্বচনীয় গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য প্রদান করিয়াছে। ফাণ্ডসন ইহাকে গৌড়ের সর্বোৎকৃষ্ট সৌধ বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। এই মসজিদের সম্মুখে একটি মুক্ত সমচতুষ্কোণ অঙ্গন আছে, ইহার প্রতি দিক ২০০ ফুট এবং ইহার উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে তিনটি খিলানযুক্ত তোরণ আছে।
বাগেরহাটের সাতগম্বুজ মসজিদ দৈর্ঘ্যে ১৬০ ফুট ও প্রস্থে ১০৮ ফুট। ইহার বৈশিষ্ট্য-অভ্যন্তর ভাগে ছয় সারি সরু স্তম্ভ দিয়া লম্বালম্বি সাতটি ভাগ, এগারটি মিহরাব ও এগারটি খিলানযুক্ত প্রবেশ দ্বার (ঠিক মাঝেরটি অন্য দশটির চেয়ে বড়) এবং ছাদে সাত সারিতে ৭৭টি গম্বুজ–কতকগুলি গম্বুজ বাংলা দেশের চৌচালা ঘরের মত। ঠিক মধ্যখানের দরজার উপর দোচালা ঘরের চালের প্রান্তের মত একটি ত্রিভুজাকৃতি গঠন–ইহা হইতে দুইধারে কার্নিস নামিয়া কোণের মিনারের দিকে গিয়াছে। কোণের মিনারগুলি গোল, সাধারণ মিনারের মত বহুকোণযুক্ত নহে, এবং দুই তলায় বিভক্ত।
ছোট পাণ্ডুয়ার বারদোয়ারি মসজিদ দৈর্ঘ্যে ২৩১ ফুট ও প্রস্থে ৪২ ফুট। বিভিন্ন নকসার দুই সারি স্তম্ভ (মোট কুড়িটি) দিয়া লম্বালম্বি তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চাতে একুশটি মিহরাব, সম্মুখে একুশটি খিলানমুক্ত প্রবেশদ্বার এবং প্রতিপাশে আরও তিনটি। মিহরাবগুলি এবং বেদীর উপর একখণ্ড পাথরে নির্মিত একটি ছত্রী নানা কারুকার্যখোদিত। ছাদে তিন সারিতে ২১টি করিয়া ৬৩টি গম্বুজ।
দ্বিতীয় শ্রেণীর হর্মের একমাত্র নিদর্শন ১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দে নসরৎ শাহ কর্ত্তৃক ইষ্টকনির্মিত গৌড়ের কদম রসুল। ইহার প্রধান কক্ষটি সমচতুষ্কোণ এবং ভিতরের দিকে ১৯ ফুট বর্গক্ষেত্র। [অনেকে কানিংহামের অনুকরণে ইহার দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট ও প্রস্থ ১৫ ফুট বলিযা বর্ণনা করিয়াছেন। A.H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, ১২৭ পৃ. দ্রষ্টব্য।] ইহার তিন দিকে তিনটি দরজা। এই কক্ষের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে ১৫ ফুট চওড়া তিনটি বারান্দা। পূর্বদিকের বারান্দার সম্মুখ ভাগ খোদিত ইষ্টকের কারুকার্যশোভিত ফলকে সম্পূর্ণ ঢাকা। খাটো পাথরের স্তম্ভের উপর খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ আছে। প্রধান কক্ষের উপর একটিমাত্র গম্বুজের ছাদ। গম্বুজের উপর পদ্মের ন্যায় চূড়া। প্রতি বারান্দার ছাদ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের আকৃতি, চারি কোণে চারিটি অষ্টকোণ মিনার এবং প্রত্যেক মিনারের উপর একটি স্তম্ভ। সাধারণত মসজিদশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইলেও কদম রসুল মসজিদ নহে। হজরৎ মহম্মদের পদচিহ্নাঙ্কিত একখণ্ড কাল মার্বেল পাথর এখানে রক্ষিত হইয়াছিল বলিয়া ইহা কদম রসুল নামে খ্যাত।
পূর্ব্বোক্ত মসজিদগুলি ছাড়াও বাংলা দেশের নানা স্থানে উল্লিখিত শ্রেণীর আরও বহু কারুকার্যখচিত মসজিদ আছে। ইহাদের মধ্যে চারিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১। শ্রীহট্ট জিলার শঙ্করপাশা গ্রামের মসজিদ।
২। রাজশাহীর ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা গ্রামে নসরৎ শাহ নির্মিত মসজিদ।
৩। রাজশাহী জিলার কুসুম্বা গ্রামের মসজিদ (১৫৫৮ খ্রীষ্টাব্দ)।
৪। পাণ্ডুয়ার কুত্ত্বশাহী মসজিদ (১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দ) মুঘল আমলের প্রথমে নির্মিত, কিন্তু সুলতানী আমলের স্থাপত্যরীতি।
মসজিদ বাদ দিলে কয়েকটি তোরণকক্ষ ও মিনার মধ্যযুগে স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য।
গৌড়ের দাখিল-দরওয়াজা অর্থাৎ দুর্গের উত্তর প্রবেশদ্বার এই শ্রেণীর সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইহা ইষ্টকনির্মিত এবং ইহার ৬০ ফুট উচ্চ এবং ৭৩ ফুট প্রশস্ত ও কারুকার্যে শোভিত সম্মুখ ভাগের মধ্যস্থলে ৩৪ ফুট উচ্চ খিলানযুক্ত বিশাল তোরণ। ইহার দুই ধারে দুইটি বিশাল কুড্যস্তম্ভ এবং তাঁহার সহিত সংযুক্ত দ্বাদশ-কোণ সমন্বিত দুইটি অট্টালক (Tower) ক্ৰমশঃ সরু হইয়া উপরে উঠিয়াছে। প্রতি অট্টালক পাঁচটি তলায় বিভক্ত। সম্মুখ ভাগের ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত তোরণের প্রবেশদ্বার হইতে অভ্যন্তরে যাইবার পথ ১১৩ ফুট লম্বা এবং ২৪ ফুট উচ্চ খিলানে ঢাকা। ইহার দুই ধারে রক্ষীদের কক্ষ। এইটিই দুর্গের প্রধান তোরণ ছিল এবং সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে নির্মিত হইয়াছিল।
গৌড়দুর্গের পূর্বদিগের তোরণ–সুমতি দরওয়াজা। একটি গম্বুজের ছাদে ঢাকা এবং সমচতুষ্কোণ কক্ষ। কক্ষের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪২ ফুট, প্রবেশপথের খিলান ৫ ফুট চওড়া। ইহার দুই ধারে পল-কাটা ইটের স্তম্ভ তিন তলায় বিভক্ত। কক্ষের চারিটি মিনার ছিল, সবই ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।
গৌড়ের আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সমাধির তোরণও উৎকৃষ্ট কারুকার্যের নিদর্শন।
গৌড়ের ফিরোজা মিনার এই শ্রেণীর স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এটি পাঁচ তলায় বিভক্ত এবং ৮৪ ফুট উচ্চ। ইহার সর্বনিম্ন অংশের পরিধি ৬২ ফুট। নীচের তিনটি তলা দ্বাদশ-কোণ-সমন্বিত এবং উপরের দুই তলা গোলাকৃতি। ইটের তৈরী এই মিনারের উপরিভাগ পোড়ামাটির নানা নকসার এবং নীল ও সাদা রংয়ের মসৃণ টালি দ্বারা শোভিত। কেহ কেহ মনে করেন যে হাবসী সুলতান সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহই ইহা নির্মাণ করেন। ইহা সম্ভবত দিল্লির কুতব মিনারের আদর্শে নির্মিত।
হুগলি জিলার ছোট পাণ্ডুয়াতে ফিরোজ মিনার নামে আর একটি ইটের মিনার আছে। এটি সম্ভবত চতুর্দ্দশ শতকের প্রথমে নির্মিত হইয়াছিল। ইহা প্রায় ১২০ ফুট উচ্চ এবং পাঁচটি তলায় বিভক্ত। ইহা গোলাকৃতি এবং লম্বালম্বিভাবে পলকাটা। ইহার উচ্চতা ও নীচের বিশাল ছয় ফুট পরিধির মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় এবং কারুকার্যের অভাবে গৌড়ের ফিরোজ মিনারের সহিত ইহার তুলনা হয় না।
২
মুঘল যুগ
রাজশক্তির সহিত শিল্পের উৎকর্ষের যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের যুগের শিল্পের সহিত মুঘল যুগের শিল্পের তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যায়। মুঘল যুগের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল দিল্লি ও আগ্রায় মুসলমান শিল্পের চরম উৎকর্ষ হইয়াছিল। কিন্তু বাংলা দেশে তখন কোন স্বাধীন রাজশক্তি ছিল না, একজন সুবাদার শাসন করিতেন–কার্যান্তে তিনি বাংলার বাহিরে স্বদেশে ফিরিয়া যাইতেন। উচ্চ কর্মচারীদের সম্বন্ধেও ঐ কথা বলা যায়, এবং এই অবস্থা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মুর্শিদকুলী খাঁর শাসন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সুতরাং বাংলা দেশের প্রতি তাহাদের অন্তরের টান ছিল না। তাহা ছাড়া সুবাদার ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা এদেশ হইতে লইয়া যাইতেন এবং কোটি কোটি টাকা রাজস্বস্বরূপ বাংলা দেশ হইতে আগ্রা ও দিল্লিতে যাইত। রাজশক্তির ইচ্ছা ও উৎসাহ এবং ধনসম্পদের প্রাচুর্য না থাকিলে কোন দেশেই শিল্পের উন্নতি সম্ভবপর হয় না। মুগল যুগের বাংলা দেশে পূর্বযুগের তুলনায় এ দুইয়েরই অভাব ছিল, সুতরাং শিল্পের উৎকর্ষ বিশেষ কিছুই হয় নাই।
অবশ্য এ যুগেও বহু সংখ্যক মসজিদ, সমাধিভবন, স্তম্ভ ও তোরণ নির্মিত হইয়াছিল; কিন্তু শিল্পের উৎকর্ষ হিসাবে তাহা খুব উচ্চ স্থান অধিকার করে না। সুতরাং সংক্ষেপে এই বিভিন্ন শ্রেণীর স্থাপত্য কলার বর্ণনা করিব। এখানে বলা আবশ্যক যে স্থাপত্য-শিল্পে ছোটখাট পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হইলেও মুঘলযুগে বিশেষ কোন রীতিগত পরিবর্তন দেখা যায় না–সুলতানী আমলের শিল্পের ধারা মোটামুটি অব্যাহতই ছিল। বিশেষ প্রভেদ এই যে ইট, পাথর বা পোড়া মাটির ফলকে খোদিত ভাস্কর্যের পরিবর্তে চূণের পলস্তারা দ্বারা বাহিরের দেয়ালের শোভাবর্ধন করা হইত।
(ক) মসজিদ
এ যুগের সর্বপ্রাচীন উল্লেখযোগ্য মসজিদ পুরাতন মালদহে অবস্থিত। এই জমি মসজিদ ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ইহা ইটের তৈরী, দৈর্ঘ্যে ৭২ ফুট ও প্রস্থে ২৭ ফুট। ইহার দুইটি বিশেষত্ব আছে।
প্রথমত, পূর্বদিকের সম্মুখভাগে মধ্যকার খানিক অংশ সম্মুখে প্রসারিত। ইহার দুই পাশে দুইটি ছোট মিনার এবং মধ্যভাগে খিলানযুক্ত প্রবেশপথের দুই ধারে ছোট দেয়াল। এই খিলানের তলদেশ সমতল নহে–ছোট ছোট তরঙ্গিত পলকাটা (Cusp)।
দ্বিতীয়ত, প্রসারিত অংশের পরট (Parapet) অন্য দুই অংশের পরট অপেক্ষা উচ্চ। ইহার ছাদ অনেকটা ছোট নৌকা বা গরুর গাড়ীর ছইয়ের আকৃতি। দুই পাশের নিম্নতর অংশের ছাদ নীচু গম্বুজের মত। এই দুই অংশের খিলানযুক্ত প্রবেশ-পথও মধ্যকার প্রবেশপথ অপেক্ষা নীচু।
ঢাকার অলুকুরি মসজিদ সম্ভবত সপ্তদশ শতকের শেষভাগে নির্মিত। ইহা সুলতানী আমলের প্রথম শ্রেণীর ন্যায় একটি মাত্র গম্বুজে ঢাকা একটি সমচতুষ্কোণ ক্ষুদ্র কক্ষ। ইহার তিনটি বিশেষত্ব। প্রথমত, ইহা একটি উচ্চ ও প্রশস্ত অধিষ্ঠানের উপর প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, ইহার চারিদিকের মধ্যকার অংশই ঈষৎ প্রসারিত। তৃতীয়ত, চারি কোণের চারিটি স্তম্ভই কক্ষের দেয়াল ছাড়াইয়া অনেকটা উঁচুতে উঠিয়াছে। এগুলি পাঁচটি তলায় বিভক্ত এবং তাঁহার উপরে একটি ছত্রী।
ঢাকার লালবাগের মসজিদে পূর্ব্বোক্ত প্রথম ও তৃতীয় বিশেষত্বটি বর্তমান তবে ইহার ছাদে তিনটি গম্বুজ এবং গম্বুজগুলির গাত্রে পাতাকাটা নক্সা এবং উপরে একটি চূড়া। ইহা দৈর্ঘ্যে ৬৫ ফুট ও প্রস্থে ৩২ ফুট।
ঢাকার নিকটবর্তী সাতগম্বুজ মসজিদ দৈর্ঘ্যে ৫৮ ফুট ও প্রস্থে ২৭ ফুট। ইহার চারি কোণের স্তম্ভগুলির ভিতরে ফাঁপা ও মাথায় একটি করিয়া গম্বুজ। ছাদের তিনটি গম্বুজ লইয়া মোটমাট সাতটি গম্বুজ।
ময়মনসিংহ জিলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অধীনে এগারসিন্দুর গ্রামে ইশা খানের দুর্গ ছিল। এখানে অনেকগুলি সুন্দর সুন্দর মসজিদ আছে। শাহ মুহম্মদের মসজিদ আকারে ক্ষুদ্র (৩২ X ৩২ ফুট) এবং সমসাময়িক ঢাকার পূর্ব্বোক্ত অলুকুরি মসজিদের অনুরূপ। কিন্তু মসজিদটি ইটের হইলেও ইহার সম্মুখের অঙ্গন শানবাঁধানো। ইহার প্রধান বিশেষত্ব এই যে ইহার প্রবেশদ্বার ঠিক একখানি দোচালা ঘরের আকৃতি (২৫ X ১৪ ফুট)। মুর্শিদাবাদের নিকটে মুর্শিদকুলী খাঁ কর্ত্তৃক ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত কাটরা মসজিদ একটি বৃহৎ সমচতুষ্কোণ অঙ্গনের (১৬৬ ফুট) মধ্যস্থলে এক অধিষ্ঠানের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহা দৈর্ঘ্যে ১৩০ ফুট ও প্রস্থে ২৪ ফুট। ইহার চারিদিকে প্রায় ২০ গজ উচ্চ চারিটি বিশাল অষ্টকোণ মিনার ছিল। অভ্যন্তরস্থিত ৬৭টি ঘোরান সিঁড়ি দিয়া মিনারের চূড়াতলে ওঠা যায়। অঙ্গনের চারিপাশে দুই তলায় বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘর। ১৪টি সোপান বাহিয়া অঙ্গনে উঠিতে হয়। এই সোপানের নিম্নে মুর্শিদকুলী খাঁর সমাধি-কক্ষ। অনেকগুলি হিন্দু মন্দির ভাঙ্গিয়া তাঁহার উপকরণ দিয়া এই মসজিদ নির্মিত হয়।
এই মসজিদগুলি ছাড়া ঢাকায় কর্তলব খানের মসজিদ, নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়মের মসজিদ, ময়মনসিংহ জিলার আতিয়ায় জামি মসজিদ ও গুরাইয়ের মসজিদ এবং চট্টগ্রামের বায়াজিদ দরগা ও কদম-ই-মুবারিক মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(খ) সমাধি-ভবন, তোরণ-কক্ষ ও মিনার
গৌড়ে পূর্ব্বোক্ত কদম রসুল নামক সৌধের পাশে ইষ্টকনির্মিত নাতিবৃহৎ একটি গৃহ আছে (৩১ X ২২ ফুট), ইহা ঠিক একখানি দোচালা ঘরের অনুকৃতি। কেহ কেহ অনুমান করেন যে এটি ফৎ খানের সমাধি এবং সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি নির্মিত। আবার কেহ বলেন যে ইহা রাজা গণেশের সময়কার একটি হিন্দু মন্দির, কারণ ঘরটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এবং ইহার চাল হইতে শিকলে ঘণ্টা বাঁধার জন্য একটি হুকের চিহ্ন দেখা যায়। ঘরটির তিনদিকে তিনটি দরজা আছে।
ঢাকার লালবাগ কিল্লার মধ্যে পরীবিবির সমাধি-ভবন আছে। বাহিরের গঠনপ্রণালী লালবাগের মসজিদের মত। তবে সমতল ছাদের উপরে তামার একটি কৃত্রিম গম্বুজ আছে অর্থাৎ ইহার নীচে কোন খিলান নাই। এককালে ইহা সোনার গিল্টি করা ছিল। অভ্যন্তর ভাগে নয়টি কক্ষ আছে। ঠিক মাঝখানে সমচতুষ্কোণ সমাধি-কক্ষ (১৯ ফুট), চারিকোণে চারিটি সমচতুষ্কোণ কক্ষ (১০ ফুট) এবং সমাধি-কক্ষের চারিপাশে চারিটি প্রবেশ-কক্ষ (২৫ X ১১ ফুট)। কেবলমাত্র দক্ষিণদিকের কক্ষই এখনকার প্রবেশপথ। ইহার চৌকাঠ পাথরের এবং দরজা চন্দন কাঠের। অন্য তিন দিকের দরজায় সুন্দর মার্বেলের জালি। সমাধি-কক্ষের দেয়াল সাদা মার্বেল পাথরের এবং মেজে ছোট ছোট নানা নক্সার কালো মার্বেল পাথরের খণ্ড দিয়া মণ্ডিত। সমাধি-কক্ষের মধ্যস্থলে মার্বেল পাথরের কবর–ইহার তিনটি ধাপের উপর লতাপাতা উৎকীর্ণ। সব কক্ষের দরজাতেই চৌকাঠ, কোন খিলান নাই। ইহা এবং ছাদের অভ্যন্তর ভাগের নির্মাণপ্রণালী হিন্দু শিল্পের প্রভাব সূচিত করে।
কক্ষের বিন্যাসপ্রণালী আগ্রা ও দিল্লির সৌধের অনুরূপ। মোটের উপর এই সমাধিসৌধের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য বাংলা দেশের শিল্পে খুবই অপরিচিত-ইহার গঠনপ্রণালীও বাংলা দেশের গঠনপ্রণালী হইতে স্বতন্ত্র। লোকপ্রবাদ এই যে নবাব শায়েস্তা খাঁ তাঁহার কন্যা পরীবিবির এই সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।
মুঘল যুগের অনেকগুলি তোরণ-কক্ষ কারুকার্যখচিত। গৌড়ের দুর্গের দক্ষিণ দিকের তিনতলা বৃহৎ (৬৫ ফুট) তোরণটি শাহসুজা আনুমানিক ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। ইহার অল্পকাল পরেই (১৬৭৮-৭৯ খ্ৰীষ্টাব্দে) নির্মিত ঢাকার লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ চোরণটি এখনও মোটামুটি ভালভাবেই আছে। মুর্শিদাবাদের খুসবাগে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব আলিবর্দী ও সিরাজউদ্দৌলার কবর তিনটি প্রাচীর দিয়া ঘেরা। ইহার প্রবেশপথে একটি তোরণকক্ষ আছে।
মুঘল যুগের একমাত্র উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ নিমাসরাই মিনার। ইহা ঠিক গৌড় ও পাণ্ডুয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত। একটি উচ্চ অষ্টকোণ মঞ্চের উপর এই মিনারটি প্রতিষ্ঠিত। মঞ্চটির প্রতিদিক ১৮ ফুট দীর্ঘ এবং কয়েকটি সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া উঠিতে হয়। মঞ্চের ভিতরে ছোট ছোট খিলানযুক্ত কক্ষ আছে; এগুলি সম্ভবত প্রহরীদের বাসস্থান ছিল। মিনারটি গোল এবং ক্রমশঃ ছোট হইয়া উপরে উঠিয়াছে; ইহার পাদদেশের ব্যাস প্রায় ১৯ ফুট। ইহার চূড়া ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। এখন যে অংশ আছে। তাঁহার উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝখানে একটি ছজ্জ অর্থাৎ গোল প্রস্তরখণ্ড চারিদিকে একটু বাড়ান থাকায় মিনারটি দুই ভাগে বিভক্ত। ইহার ঠিক উপরেই আলো বাতাস প্রবেশের জন্য একটি গবাক্ষ ছিদ্র। অভ্যন্তরে একটি ঘোরান সিঁড়ি দিয়া চূড়ায় ওঠার ব্যবস্থা আছে। মিনারের গায়ে গজদন্তের অনুকারী বহু প্রস্তর শলাকাবিদ্ধ করা আছে–প্রত্যেকটি প্রায় আড়াই ফুট লম্বা। ইহা সম্ভবত পর্যবেক্ষণ স্তম্ভের কাজ করিত অর্থাৎ কোন বিপদ বা শত্রুর আক্রমণ আসন্ন হইলে ইহার চূড়ায় উঠিয়া আগুন জ্বালাইয়া সঙ্কেত করা হইত। গৌড় বা ছোট পাণ্ডুয়ার ফিরোজ মিনারের সহিত এই মিনারের বিশেষ কোন সাদৃশ্য নাই। কিন্তু ফতেপুর সিক্রীতে সম্রাট আকবর নির্মিত হিরণ মিনারের সহিত ইহার খুব সাদৃশ্য দেখা যায়। সম্ভবত হিরণ মিনারের অনুকরণে এবং তাঁহার অল্পকাল পরেই নিমাসরাই মিনার নির্মিত হইয়াছিল।
৩
মধ্যযুগের রাজপ্রাসাদ
মধ্যযুগের সুলতানদের প্রাসাদ ও ধনীগণের সুরম্য হর্মের কোন নিদর্শনই নাই। পঞ্চদশ শতকের প্রথমে লিখিত চীনদেশীয় পর্যটকের বর্ণনায় রাজধানী পাণ্ডুয়ায় সুলতানের প্রাসাদের বর্ণনা আছে; দরবার কক্ষের পিত্তলমণ্ডিত স্তম্ভগুলিতে ফুল ও পশুপক্ষীর মূর্ত্তি খোদিত ছিল। চুনকাম করা ইটের তৈরী বাড়ি খুব উঁচু ও প্রকাণ্ড ছিল। তিনটি দরজা পার হইয়া গেলে প্রাসাদের অভ্যন্তরে নয়টি অঙ্গন দেখা যাইত। [বিভিন্ন চীনা পর্যটক প্রাসাদের বর্ণনা করিয়াছেন। একটি বর্ণনায় ‘তিনটি দরজা ও নয়টি অঙ্গনের উল্লেখ আছে। কিন্তু অনুরূপ আর একটি বর্ণনায় সেই স্থলে আছে ভিতরের দরজাগুলি তিনগুণ পুরু এবং প্রত্যেকের নয়টি পাল্লা (panels)। সম্ভবত শেষের বৃর্ণনাটি 793 (Visva Bharati, Annals 1.pp. 121, 126, 130)] দরবার কক্ষের দুই দিকের বারান্দা এত দীর্ঘ ও প্রশস্ত ছিল যে এক সহস্র অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, বর্মে আচ্ছাদিত অশ্বারোহী এবং ধনুর্বাণ ও তরবারি হস্তে পদাতিকের সমাবেশ হইতে পারিত। অঙ্গনে ময়ূরপুচ্ছের তৈরী ছত্র হস্তে লইয়া একশত অনুচর দাঁড়াইত এবং বিরাট দরবার কক্ষে হস্তীপৃষ্ঠে ১০০ সৈন্য থাকিত। আঙ্গিনার সম্মুখে কয়েক শত হস্তী সারি দিয়া রাখা হইত।
কিন্তু সুলতানী আমলের পর যখন বাংলা দেশ মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হইল, তখন এ সকল কিছুই ছিল না। ট্যাভার্ণিয়র ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার রাজধানী ঢাকায় আসিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন যে শাসনকর্ত্তা উঁচু দেয়াল দিয়া ঘেরা একটা ছোট কাঠের বাড়ীতে থাকেন। বেশির ভাগ তিনি ইহার আঙ্গিনায় তাঁবুতে বাস করেন। সমসাময়িক গ্রন্থে প্রকাণ্ড বাড়ী, বাগান প্রভৃতিরও উল্লেখ আছে–কিন্তু বিস্তৃত বর্ণনা নাই। বাড়ীগুলি সাধারণত ইটের, কাঠের বা বাঁশের তৈরী হইত। কিন্তু ইহা অনেক সময় বিচিত্র কারুকার্যে খচিত হইত। আবুল ফজল লিখিয়াছেন যে খগরঘাটার বাদশাহী কর্মচারীরা ১৫০০০ টাকা খরচ করিয়া এক একটি বাংলো তৈরী করিত এবং বাঁশের তৈরী বাড়িতে অনেক সময় পাঁচ হাজার টাকারও বেশি খরচ হইত। দীনেশচন্দ্র সেন এইরূপ একখানি খড়ের ঘরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন। তাহাতে খরচ পড়িয়াছিল ১২,০০০, কাহারও মতে ৩০,০০০ টাকা। [বৃহৎ বঙ্গ, ৫৬০-৬১ পৃষ্ঠা]
৪
মধ্যযুগের হিন্দু শিল্প
(ক) মন্দির
হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই শিল্প ধর্মভাবের উপরই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। মুসলমানদের মসজিদ ও সমাধি-ভবন তাহাদের শিল্পের প্রধান ও সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। মন্দির এবং দেবদেবীর মূর্ত্তি ও ছবির মধ্য দিয়াই হিন্দু শিল্প প্রধানত আত্মপ্রকাশ ও উৎকর্ষলাভ করিয়াছিল। কিন্তু ইসলামের নির্দেশ অনুসারে হিন্দু মন্দির ও দেবদেবীর মূর্ত্তি ধ্বংস করাই মুসলমানের কর্তব্য ও পুণ্যার্জনের অন্যতম উপায়। কার্যত যে মুসলমানেরা ভারতে এই নীতি পালন করিয়াছে তাঁহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে সিন্ধুদেশবিজয়ী মুহম্মদ বিন কাশিম হিন্দুর মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ তৈরী করেন। সহস্র বৎসর পরে ঔরঙ্গজেবও ভারতের বৃহত্তর পটভূমিতে ঠিক সেই একই নীতির অনুসরণ করিয়াছিলেন। বাংলা দেশেও ঠিক ঐ নীতিই অনুসৃত হইয়াছিল। ত্রয়োদশ শতকে অর্থাৎ বাংলা দেশে মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগে হিন্দুর প্রসিদ্ধ তীর্থ ত্রিবেণীতে এক বা একাধিক বিচিত্র কারুকার্যখচিত হিন্দু মন্দির ভাঙ্গিয়া জাফর খা গাজি তাঁহার উপকরণ দিয়া মসজিদ ও সমাধি-ভবন তৈরী করিয়াছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলমান রাজত্বের অবসানে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ কয়েকটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করিয়া রাজধানী মুর্শিদাবাদের নিকটে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করিয়াছিলেন। সুতরাং বাংলার মধ্যযুগের হিন্দু মন্দির বা দেবদেবীর মূর্ত্তির যে বিশেষ কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না তাহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কোন কারণ নাই। তবে ধ্বংস করিবার শক্তিরও একটা সীমা আছে; তাই ঔরঙ্গজেবও ভারতকে একেবারে মন্দিরশূন্য করিতে পারেন নাই। বাংলা দেশেও অল্পসংখ্যক কয়েকটি মধ্যযুগের মন্দির এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু হয়ত যাহা ছিল তাঁহার এক ক্ষুদ্র অংশমাত্র এখনও আছে–সুতরাং ইহা দ্বারা হিন্দু শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা যায় না। তবে ইহাও খুবই সম্ভব যে হিন্দুরাও কতকটা অর্থ-সম্পদের অভাবে এবং কতকটা মুসলমানদের হাতে ধ্বংসের আশঙ্কায়, বিশাল মন্দির গড়িতে উৎসাহ পায় নাই। সেজন্য মধ্যযুগে খুব বেশি উৎকৃষ্ট হিন্দু মন্দিরও তৈরী হয় নাই। এই কারণে হিন্দু শিল্পেরও অবনতি হইয়াছিল এবং উৎকৃষ্ট নূতন মন্দিরের সংখ্যাও অনেক কম ছিল। আর যে কয়েকটি তৈরী হইয়াছিল তাঁহারও কতক প্রাকৃতিক কারণে এবং কতক মুসলমানদের হাতে ধ্বংস হইয়াছে। বাকী যে কয়টি এই উভয়বিধ ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পাইয়া এখনও কোন মতে টিকিয়া আছে তাহাদের উপর নির্ভর করিয়াই হিন্দু শিল্পের পরিচয় দিতে হইবে।
মধ্যযুগে বাংলা দেশের মন্দিরও মুসলমান মসজিদ ও সমাধি-ভবনের ন্যায় প্রধানত ইষ্টকনির্মিত। তবে বাংলার পশ্চিম প্রান্তে মাকড়া (laterite) ও বেলে পাথর (sandstone) পাওয়া যায়। সুতরাং এই দুই প্রকারের পাথরে নির্মিত মন্দিরও আছে।
বাংলা দেশের মধ্যযুগের মন্দিরগুলি দুইটি বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এই দুইটিকে রেখ-দেউল ও কুটির-দেউল এই দুই সংজ্ঞা দেওয়া যাইতে পারে।
(খ) রেখ-দেউল
রেখ-দেউলের বিবরণ এই গ্রন্থের প্রথম ভাগে দেওয়া হইয়াছে। উড়িষ্যার সুপরিচিত মন্দিরগুলির ন্যায় সুউচ্চ বাঁকানো শিখরই ইহার বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন হিন্দুযুগের যে কয়টি মন্দির এখনও টিকিয়া আছে তাঁহার প্রায় সবগুলিই এই শ্রেণীর এবং প্রথম ভাগে তাহাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। কালক্রমে উড়িষ্যার রেখ-দেউল ক্ষুদ্রতর ও অলঙ্কারবর্জিত হইয়া অনেকটা সরল ও আড়ম্বরহীন স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হইত। ময়ূরভঞ্জের অন্তর্গত খিচিং-য়ের মন্দিরগুলি ইহার দৃষ্টান্তস্থল। বাংলা দেশের মধ্যযুগের রেখ-দেউলেও এই পরিবর্তন অর্থাৎ প্রাচীন অলঙ্কত রেখ দেউলের সরলীকরণ ঘটিয়াছে। হিন্দুযুগের নির্মিত বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের সহিত মধ্যযুগের ধরাপাট অথবা হাড়মাসড়ার মন্দির তুলনা করিলেই এই পরিবর্তন বুঝা যাইবে। পূর্ব্বোক্ত মন্দিরের বিচিত্র কারুকার্য শেষোক্ত মন্দিরে নাই, কিন্তু উভয়ই যে একই স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত তাহা সহজেই বুঝা যায়।
পুরুলিয়া জিলার অন্তর্গত চেলিয়ামা নামক বর্ধিষ্ণু গ্রামের নিকটবর্তী বান্দা গ্রামে একটি উৎকৃষ্ট বেলে পাথরের রেখ-দেউল আছে। ইহাতে অনেক কারুকার্য আছে। ইহার তারিখ নিশ্চিতরূপে জানা যায় না-সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকের কিছু পূর্বে বা পরে ইহা নির্মিত হইয়াছিল। এইটি বাদ দিলে বাংলা দেশে মুসলমান রাজত্বের প্রথম দুই শত বত্সরে নির্মিত কোন হিন্দু-মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায় না। পরবর্তী দুই শত বৎসরের মধ্যে নির্মিত মাত্র ৪/৫ টি মন্দির এখনও আছে। ইহার মধ্যে চারিটি বর্ধমান জিলায়। তিনটি বরাকরের বেগুনিয়া মন্দির, সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে, এবং গৌরাঙ্গপুরে ইছাই ঘোষের মন্দির সম্ভবত আরও কিছুকাল পরে নির্মিত। এই সব মন্দির এবং কল্যাণেশ্বরীর মন্দির প্রস্তরনির্মিত রেখ-দেউল। ইহার মধ্যে কেবল বরাকরের একটি মন্দির ১৪৬১ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হইয়াছিল বলিয়া নিশ্চিতরূপে জানা যায়। অপরগুলি কেহ কেহ হিন্দুযুগের মন্দির বলিয়া মনে করেন। কিন্তু সম্ভবত এইগুলিও পঞ্চদশ শতকে অথবা তাঁহার পরে নির্মিত হইয়াছিল ইহাই অধিকাংশ পণ্ডিতগণের মত। পরবর্তী কালে নির্মিত বাঁকুড়ায় বা মল্লভূমে এই শ্রেণীর যে পাঁচটি মন্দির আছে তাঁহার বিষয় পরে আলোচনা করিব। ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত বীরভূম জিলার ভাণ্ডীশ্বরের প্রস্তর-মন্দিরও একটি রেখ দেউল। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত [বিংশ শতাব্দীতে নদীগর্ভে নিমজ্জিত] পদ্মাতীরবর্তী রাজাবাড়ীর মঠও এই স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত রেখ-দেউলের প্রচলন ছিল।
(গ) কুটির-দেউল
মধ্যযুগে বাংলার অন্যান্য মন্দিরগুলি যে নূতন স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত তাঁহার বিশেষত্ব এই যে ইহা বাংলাদেশের চিরপরিচিত কুটির বা কুঁড়ে ঘরের–অর্থাৎ দোচালা ও চৌচালা খড়ের ঘরের গঠনপ্রণালী অনুসরণ করিয়া নির্মিত হইয়াছে। সুতরাং ইহাকে কুটির-দেউল এই সংজ্ঞায় অভিহিত করা যায়। এই শ্রেণীর মন্দির ইষ্টক বা প্রস্তরনির্মিত হইলেও চালাগুলির ঊর্ধ্ব মিলনরেখা এবং কার্নিসগুলি অস্বাভাবিকভাবে খড়ের ঘরের মতই বাঁকানো।
এই মন্দিরগুলি নিম্নোক্ত পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা যাইতে পারে।
প্রথম শ্রেণী–দোচালা
দোচালা খড়ের ঘরের অবিকল অনুকৃতি। কেহ কেহ ইহাকে একবাংলা মন্দির বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। ইহাকে দোচালা বলাই সঙ্গত মনে হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণী–জোড় বাংলা
পাশাপাশি দুইটি দোচালা। ইহাকে জোড়দোচালা বা জোড়-বাংলা বলা যাইতে পরে। জোড়-দোচালার পার্শ্ববর্তী সংলগ্ন দুইটি চালার সংযোগরেখার ঠিক মধ্যস্থলে দেয়াল দুইটির উপর একটি শিখর স্থাপন করাই সাধারণ বিধি ছিল।
তৃতীয় শ্রেণী–চৌচালা
চারচালা খড়ের ঘরের মত চারটি দেওয়ালের উপর ত্রিভুজের ন্যায় আকৃতি চারটি সংলগ্ন চালা, ঊর্ধ্বে একটি বক্র সংযোগরেখা বা একটি বিন্দুতে সংযুক্ত। এখানেও খড়ের চালার কার্নিসের ন্যায় প্রতি চালার নিম্নাংশ বাঁকানো। চারিটি চালার ঢাল (slope) অনেকটা কমাইয়া কেন্দ্রস্থলে একটি শিখর স্থাপন করাই সাধারণ বিধি (চিত্র নং ৩০-৩৪)।
চতুর্থ শ্রেণী–ডবল চৌচালা
নীচের চৌচালার উপর অল্পপরিসর বেদী দ্বারা একটু ব্যবধান করিয়া, ক্ষুদ্রতর আকৃতির অনুরূপ আর একটি চৌচালা স্থাপন করাই এই শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য। এই দ্বিতল মন্দিরের মাথায় ত্রিশূল এবং (অথবা) এক বা একধিক চূড়া থাকিত–কখনও বা ক্ষুদ্র সৌধাকৃতি অথবা কার্নির্সযুক্ত শিখর থাকিত।
পঞ্চম শ্রেণী–রত্নমন্দির
চৌচালা বা ডবল চৌচালা মন্দিরের মাথায় কেন্দ্রস্থলে একটি বৃহৎ শিখর ব্যতীত প্রতি তলের কার্নিসের প্রতি কোণে এক বা একাধিক ক্ষুদ্রতর শিখর স্থাপন করাই এই শ্রেণীর বিশেষত্ব। মন্দিরের তলের পরিমাণ বাড়াইয়া এবং প্রতি তলের কার্নিসের প্রতি কোণের শিখর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া মন্দিরের মোট শিখরের সংখ্যা পঁচিশ বা ততোধিক করা যাইতে পারে। শিখরের সংখ্যা অনুসারে এই মন্দিরগুলিকে পঞ্চরত্ন, নবরত্ন, পঁচিশ রত্ন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। এই শ্ৰেণীর মন্দিরের সাধারণ নাম রত্ন-মন্দির।
মন্দিরের সাধারণ প্রকৃতি
বাংলার কুটির-দেউলের শিখর উড়িষ্যার মন্দিরের জগমোহনের ছাদের মত ক্রম হ্রস্বায়মান উপর্যুপরি বিন্যস্ত বহুসংখ্যক সমান্তরাল কার্নিসের বিন্যাস দ্বারা গঠিত। এই কার্নিসের সারির উপর আমলক অথবা (এবং) চূড়া স্থাপিত হইত। কার্নিসগুলির সমান্তরাল রেখার দ্বারা পর্যায়ক্রমে আলোছায়ার সমন্বয়ে অপরূপ সৌন্দর্যসৃষ্টি এই গঠনের বৈশিষ্ট্য। উড়িষ্যার প্রসিদ্ধ কোণারক মন্দিরের জগমোহন এই শ্রেণীর স্থাপত্যের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সাধারণত মন্দিরের সম্মুখভাগে তিনটি পত্ৰাকৃতি (cusped) খিলানযুক্ত প্রবেশপথ থাকে। মধ্যে দুইটি স্কুল খর্বাকৃতি স্তম্ভ এবং দুই পার্শে প্রাচীরগাত্রে অর্ধপ্রোথিত দুইটি কুড্যস্তম্ভের শীর্ষদেশের উপর এই খিলানগুলির নিম্নভাগ অবস্থিত। এই খিলানের খানিকটা উপরে এক বা একাধিক কার্নিস থাকিত। অনেক স্থলে মন্দিরের এই অংশও বিচিত্র কারুকার্যে শোভিত হইত।
প্রবেশপথের ঠিক পরেই অনেক মন্দিরে একটি ঢাকা বারান্দা থাকিত। কখনও কখনও এই ঢাকা বারান্দা গর্ভগৃহের চারিদিকেই বেষ্টন করিয়া থাকিত। কখনও কখনও এই বারান্দার প্রতি কোণে একটি কক্ষ থাকিত। রত্ন মন্দিরের সম্মুখের বারান্দার কোণের কক্ষ হইতে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি থাকিত।
মন্দিরগুলি সাধারণত অঙ্গন হইতে তিন চারি হাত উচ্চ চতুষ্কোণ ভিত্তিবেদীর (platform) উপর স্থাপিত হইত। কোথাও উঠিবার সিঁড়ি আছে (হুগলি জিলার বক্সায় রঘুনাথ মন্দিরে)। মন্দিরের গর্ভগৃহ সাধারণত চতুষ্কোণ এবং অভ্যন্তরভাগ প্রায়ই অলঙ্কারবর্জিত। কিন্তু কোন কোন স্থলে, যেমন গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে, দেওয়ালগুলি চিত্রিত।
কতকগুলি মন্দির কারুকার্যখচিত টালি বা পোড়ামাটির ফলক (terracotta) দ্বারা অলঙ্কৃত হইয়াছে। কোন কোন মন্দিরে এই শ্রেণীর ভাস্কর্য বিশেষ উত্তৰ্ষ লাভ করিয়াছে এবং বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়াছে। এই ভাস্কর্যগুলির বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। লতা পাতা ফুল প্রভৃতি প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং নানারূপ জ্যামিতিক নকসা প্রভৃতির সম্মিলনে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি হইয়াছে। এই চিত্রগুলি হইতে সমসাময়িক জীবনযাত্রা, নরনারীর পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, যানবাহন, তল্কালীন সামাজিক আচারপদ্ধতি, গৃহপালিত নানা পশুপক্ষী প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যা। তবে সবই শিল্পের প্রথাবদ্ধতার পরিচায়ক। নরনারী, জীবজন্তু প্রভৃতির আকৃতি পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করিলে ইহাকে খুব উচ্চাঙ্গের শিল্প বলা যায় না। অনেকটা বর্তমান কালের সাধারণ পটুয়া, কুমার প্রভৃতি কারিকর সৃষ্ট শিল্পের জ্ঞাতি বলিয়াই মনে হয়, নূতন সৃজনশক্তির বা সূক্ষ্ম সৌন্দর্যানুভূতির কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। বস্তুত লোকসাহিত্যের সহিত উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যের যে সম্বন্ধ, এই সমুদয় শিল্পের সহিত গুপ্ত পাল ও সেনযুগের বাংলাশিল্পের সেই সম্বন্ধ। তবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে মধ্যযুগে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের শিল্প সম্বন্ধেও ঠিক এই মন্তব্য প্রযোজ্য।
বাংলার কুটির-দেউলের স্থাপত্যপদ্ধতি বাংলার বাহিরেও প্রচলিত হইয়াছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মন্দির উড়িষ্যায় গৌড়ীয় বা বাংলারীতি নামে প্রচলিত। এই দুই শ্রেণীর মন্দির সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দে দিল্লি, রাজপুতনা ও পঞ্জাবেও প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। অন্যান্য শ্রেণীর মন্দিরগুলি বাংলার বাহিরে তেমন আদৃত হয় নাই।
বাংলার কুটির-দেউলগুলির শিল্পরীতি যে বাংলা দেশের নিজস্ব সম্পদ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। বাংলায় মুসলমান স্থপতিও যে এই শ্রেণীর সৌধ নির্মাণ করিয়াছে তাহা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু ইহা তাহাদের সাধারণ স্থাপত্যরীতির ব্যতিক্রম। নিছক অভিনবত্বের জন্যই কদাচিৎ বাংলার মুসলমানেরা এবং বাংলার বাহিরের শিল্পীরা এই রীতির অনুসরণ করিয়াছে এইরূপ সিদ্ধান্তই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয়। সম্ভত বাংলায় দোচালা ও চৌচালা খড়ের ঘরই প্রথমে দেবালয়রূপে ব্যবহৃত হইত, যেমন এখনও হয়। পরে যখন ইষ্টক বা প্রস্তর উপকরণস্বরূপ ব্যবহৃত হইল তখনও দেবালয়নির্মাণের পূর্বরীতিই বহাল রহিল।
রত্নমন্দির বা বহু শিখরযুক্ত কুটির-দেউল বাংলার বাহিরে বড় একটা দেখা যায় না। উড়িষ্যার মন্দিরের জগমোহনের সহিত ইহার সাদৃশ্য পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু এই গ্রন্থের প্রথম ভাগে বাংলার দ্ৰ দেউলের যে বর্ণনা আছে তাহা হইতেই যে কালক্রমে এই শ্রেণীর শিখর ও বহু শিখরযুক্ত রত্নমন্দিরের উদ্ভব হইয়াছে এরূপ অনুমান অসঙ্গত নহে। অরপচনের মন্দিরের [A.K. Coomaraswamy, History of Indian and Indonesian Art PL. LXXI. Fig. 29] যে অংশ বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে চিত্রিত হইয়াছে তাহা হইতে বেশ বুঝা যায় ইহার ছাদ কয়েকটি ক্রমহ্রস্বায়মান স্তরে গঠিত; প্রতি স্তরের কোণে কোণে একটি শিখর এবং সর্বোপরি একটি বৃহত্তর শিখর। এই কয়টি বৈশিষ্ট্যই বাংলার রত্নমন্দিরে দেখা যায়। সুতরাং অসম্ভব নয় যে বাংলার রত্নমন্দির প্রাচীন শিখরযুক্ত ভদ্র-দেউলেরই শেষ বিবর্তন। তবে মাঝখানে পাঁচ ছয় শত বৎসরের মধ্যে এরূপ কোন মন্দিরের নিদর্শন না থাকায় এ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত কিছু বলা যায় না।
কুটির-দেউলগুলির যে সমুদয় নিদর্শন এখনও বর্তমান আছে তাহা ষোড়শ শতকের পরবর্তী। এই শতকে এবং তাঁহার পূর্বেই বাংলায় মুসলমান স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী বহু সৌধ নির্মিত হইয়াছিল; সুতরাং ইহার কিছু প্রভাব যে কুটির দেউলগুলিতে পরিলক্ষিত হইবে ইহা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ইহার প্রাচীনতর দৃষ্টান্ত না থাকায় এই প্রভাব কিরূপে কতদূর বিস্তৃত হইয়াছে তাহা বলা শক্ত। কেহ কেহ মনে করেন যে প্রবেশ-পথের পত্রযুক্ত খিলান ও হ্রস্বাকৃতি স্থূল স্তম্ভগুলি, পোড়ামাটি-ফলকের অলঙ্কৃতি এবং কার্নিসের কোণার শিখরগুলি নিঃসন্দেহে মুসলমান শিল্পের প্রভাব সূচিত করে। কিন্তু প্রথম দুইটি সম্বন্ধে এই মত গ্রহণযোগ্য হইলেও অপর দুইটি সম্বন্ধে সন্দেহের যথেষ্ট অবসর আছে। পোড়ামাটির উৎকীর্ণ ফলক এদেশে মুসলমানদের আগমনের পূর্ব হইতেই প্রচলিত। শিখরের সম্ভাব্য উৎপত্তি সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করিয়াছি।
মল্লভূমির মন্দির
মধ্যযুগের যে কয়টি উৎকৃষ্ট মন্দির এখনও অভগ্ন আছে তাঁহার অনেকগুলিই মল্লভূমে অবস্থিত। ইহা একটি আকস্মিক ঘটনা নহে–এই অঞ্চলে হিন্দু মল্লরাজারা কার্যত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেন এবং মুসলমান রাজশক্তি কখনও এই অঞ্চলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এই কারণেই হিন্দুরা মন্দির গড়িয়াছে এবং তাহা রক্ষাও পাইয়াছে। খরস্রোতা দামোদর নদী ও অতি বিস্তৃত শাল গাছের নিবিড় অরণ্য এই ক্ষুদ্র হিন্দুরাজ্যটিকে মুসলমান সম্রাটদের কবল হইতে রক্ষা করিয়াছে। এই অঞ্চলের অধিবাসী সাহসী আদিম বন্যজাতি ও বীর মল্লরাজাদেরও এ বিষয়ে কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। মোটের উপর মাঝে মাঝে দিল্লির বাদশাহ ও বাংলার সুলতানদের অধীন নামেমাত্র স্বীকার করিলেও আভ্যন্তরিক শাসনকার্যে যে মল্লভূমের হিন্দু রাজারা স্বাধীন ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। বাংলা দেশের এই কোণে স্বাধীন হিন্দু রাজত্ব ছিল বলিয়াই মল্লভূমিতে (বাঁকুড়া জেলা ও পার্শ্ববর্তী স্থানে), বিশেষত মল্লরাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুরে, এই যুগের অর্থাৎ সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দের বহু হিন্দু মন্দির এখনও টিকিয়া আছে। ইহাদের মধ্যে অনেকগুলি মন্দিরের গাত্রে উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠা-ফলক হইতে মন্দিরনির্মাণের তারিখও জানা যায় (১৬২২ হইতে ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দ); সুতরাং মল্লভূমের মন্দিরগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই প্রথমে দিব।
পুরুলিয়া জিলার বান্দাগ্রামের মন্দিরের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। বাঁকুড়া জিলার ঘটগেড়িয়া ও হাড়মাসড়া গ্রামে দুইটি প্রস্তর-নির্মিত রেখ–দেউল আছে। ইহার কোনটিই ৪০ ফুটের বেশি উচ্চ নহে এবং মূল মন্দিরটি ছাড়া উড়িষ্যার রেখ-দেউলের ন্যায় জগমোহন, প্রশস্ত অঙ্গন ও প্রাকার প্রভৃতি কিছুই নাই। এই দুইটি মন্দিরই সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দে নির্মিত। ধরাপাট গ্রামের প্রস্তরনির্মিত রেখ দেউলটি সম্ভবত ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত। ইহারও পরবর্তীকালে নির্মিত দুইটি রেখ-দেউল বিষ্ণুপুরে আছে। মন্দিরগুলি কোনপ্রকার বৈশিষ্ট্যবর্জিত।
পুরুলিয়া জিলায় একাধিক প্রথম শ্রেণীর কুটির-দেউল আছে, কিন্তু বাঁকুড়ায় একটিও নাই। তবে বিষ্ণুপুরের দুই তিনটি দেবালয়ের ভোগরন্ধনগৃহ ঠিক দোচালা ঘরের মত।
বিষ্ণুপুরের জোড়-বাংলা মন্দিরটি গঠন-সৌকর্যে এবং পোড়ামাটির ভাস্কর্যের উৎকর্ষ ও বাহুল্যে বাংলার মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মন্দিরসমূহের অন্যতম বলিয়া পরিগণিত হয়। সাধারণ প্রথাগত গঠনরীতি অনুযায়ী হইলেও এই জোড়-বাংলা মন্দিরের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। ইহার প্রধান প্রবেশপথের খিলানতিনটি পত্রাকৃতি নহে। ইহাতে কেবল দক্ষিণ দিকেই একটিমাত্র ঢাকা বারান্দা আছে। গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয় দোচালাটির পূর্ব দেওয়ালে নীচু খিলানের একটি পৃথক দরজা আছে। দোচালা দুইটির সংযোগস্থলে যে চতুষ্কোণ চূড়া-সৌধটি আছে তাহা একটি ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং এই সৌধের শীর্ষদেশে চৌচালা আকৃতির একটি ছাদ সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলকে লিখিত আছে যে শ্রীরাধিকা ও কৃষ্ণের আনন্দের জন্য রাজা শ্ৰীবীর হাম্বিরের পুত্র রাজা শ্রীরঘুনাথ সিংহ কর্ত্তৃক ইহা ৯৬১ মল্লাব্দে (বাংলা সন ১০৬১, ইংরেজী ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে) প্রতিষ্ঠিত হইল। সুতরাং কৃষ্ণলীলাবিষয়ক কাহিনী ভাস্কর্যের প্রধান বিষয়বস্তু হইয়াছে। তাহা ছাড়া রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী, পৌরাণিক উপাখ্যান, স্থল ও জলযুদ্ধ এবং নানাবিধ কার্যে ব্যস্ত বহু নরনারী ও পশুপক্ষী প্রভৃতির মূর্ত্তি আছে।
বিষ্ণুপুর শহর ও শহরতলীতে এক শিখরযুক্ত চৌচালা মন্দির বারোটি আছে এবং আরও তিনটি এককালে ছিল। ইহার মধ্যে দুইটি পোড়ামাটির ইটে এবং বাকি কয়টি ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথরে নির্মিত। ইহাদের মধ্যে লালজীর মন্দিরটি মল্লভূমের এই শ্রেণীর মন্দিরগুলির মধ্যে বৃহত্তম। ভিত্তিবেদীর প্রত্যেক দিকের দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট এবং দক্ষিণমুখী মন্দিরটির সম্মুখভাগ প্রস্থে প্রায় ৪১ ফুট। ইহার পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে তিনটি করিয়া তোরণযুক্ত প্রবেশপথ ও সংলগ্ন দরদালান আছে। দক্ষিণ দরদালানের দেওয়ালে বহুবর্ণ ফ্রেসকো অঙ্কিত ছিল কেহ কেহ এরূপ অনুমান করিয়াছেন। নীচের খাড়া অংশের চারিদিকে চারিটি খিলানযুক্ত অলিন্দ ও সাতটি করিয়া পগ (লম্ববান উদ্গত অংশ) আছে। উপরের অংশে উচ্চাবচ কার্নিসের সমবায়ে নির্মিত শিখর আছে। ইহাও রাধাকৃষ্ণের মন্দির, ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত।
লালবাধের তীরবর্তী কালাচাঁদ মন্দিরে চারিটি দেওয়ালেই প্রবেশ–তোরণ এবং পূর্ব্বোক্ত মন্দিরের ন্যায় সাতটি পগ ও শিখর আছে। ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত রাধাশ্যাম মন্দিরটি মধ্যযুগের প্রায় শেষ নিদর্শন। মাকড়া পাথরের “এত নিপুণ ও এত অধিকসংখ্যক প্রস্তর-অলংকরণ বাঁকুড়া জেলার আর কোন মন্দিরে আছে কিনা। সন্দেহ।” রাধাবিনোদ মন্দির এই শ্রেণীর ইটের মন্দিরের মধ্যে প্রাচীনতম। ইষ্টকনির্মিত মদনমোহনের মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য খুবই উচ্চ স্তরের। ভিত্তিবেদীর প্রত্যেক দিকের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট ও মন্দিরের সম্মুখভাগের প্রস্থ ৪০ ফুট; সুতরাং লালজীর মন্দির অপেক্ষা কিছু ছোট। বিষ্ণুপুরের আরও কয়েকটি এই শ্রেণীর মন্দির ভাস্কর্য-মণ্ডিত।
মল্লভূমের অন্যান্য অংশেও কয়েকটি এই শ্রেণীর মন্দির আছে। ইহাদের মধ্যে পাত্রসায়েরের প্রসিদ্ধ শিবমন্দির ও সাহারজোড়া গ্রামের নন্দদুলালের মন্দিরের শীর্ষে রেখ-দেউল-আকৃতির চূড়া আছে। ইহা হইতে কেহ কেহ মনে করেন যে এগুলি পূর্বে রেখ-দেউল ছিল, চৌচালাটি পরে সংযোজিত হইয়াছে। পুরুলিয়া জিলায় একাধিক চৌচালা মন্দির আছে।
মল্লভূমে অল্পসংখ্যক এবং বিশেষত্ববর্জিত কয়েকটি মাত্র ডবল চৌচালা শ্রেণীর মন্দির আছে। ১৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত সারাকোনের রামকৃষ্ণমন্দিরটি সম্বন্ধে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। পাচালের এই শ্রেণীর শিবমন্দিরটি অতিশয় বিখ্যাত। রত্নমন্দিরের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিষ্ণুপুরের শ্যামরায়ের পঞ্চরত্নমন্দির। এই মন্দিরটিও শ্রীরাধাকৃষ্ণের আনন্দের জন্য রাজা শ্রীরঘুনাথ সিংহ ১৬৪৩ খ্রষ্টাব্দে জোড়–বাংলা মন্দিরের বারো বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেন। আকৃতিতে খুব বড় না হইলেও পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকরণের অজস্র সমাবেশে ইহা অপূর্ব শোভায় মণ্ডিত হইয়াছে। কেবলমাত্র ঢালু ছাদ ও শিখরগুলি ছাড়া মন্দিরের আর সকল অংশই ভাস্কর্যসজ্জিত। ইহার কেন্দ্রীয় চূড়াটি অষ্টকোণাকৃতি ও প্রান্তবর্তী শিখরগুলির প্রস্থচ্ছেদ চতুষ্কোণ। ইহার আর একটি বৈশিষ্ট্য, ভিত্তিবেদীর অত্যধিক উচ্চতা। এই মন্দিরটি মধ্যযুগের বাংলার হিন্দুশিল্পের একটি অমূল্য সম্পদ। প্রাচীনত্বে এই মন্দিরটি বিষ্ণুপুরে দ্বিতীয়। মাকড়া পাথরে নির্মিত এবং মদনগোপালের নামে ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুপুরের পঞ্চরত্ন মন্দিরটি আয়তনে মল্লভূমের মন্দিরগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম। সলদা গ্রামের মাকড়া পাথরে নির্মিত গোকুলচাঁদের মন্দির পঞ্চরত্ন দেবালয়ের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন, কারণ কেহ কেহ মনে করেন যে এইটিই মল্লভূমের সর্বপ্রাচীন দেবালয়।
বিষ্ণুপুরের বসুপল্লীতে নবরত্ন শ্রীধর মন্দির বসু-পরিবারের কোন ব্যক্তি সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দে নির্মাণ করেন।
১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত সোনামুখীর পঞ্চবিংশতি-চূড়-মন্দিরটি প্রতিপন্ন করে যে মল্লভূমের স্থাপত্যশিল্প মধ্যযুগের পরেও একেবারে লুপ্ত হয় নাই।
বাঁকুড়া শহরের দুই মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এক্তেশ্বরের শিবমন্দির খুবই প্রাচীন, কিন্তু পুনঃ পুনঃ সংস্কারের ফলে ইহার আদিম আকৃতি সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করা কঠিন। ১৬২২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুপুরের প্রাচীনতম মল্লেশ্বর মন্দির সম্বন্ধেও একথা খাটে। ইহাদের বর্তমান আকৃতি পরিচিত কোন স্থাপত্যশৈলীর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।
পরম বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বির কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চও একটি উল্লেখযোগ্য সৌধ। রাসলীলার সময় বিষ্ণুপুরের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ এই সৌধে একত্র করা হইত। যাহাতে লক্ষ লক্ষ লোক ইহার চতুর্দিকস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ হইতে উৎসব দেখিতে পারে সেই জন্য চৌচালা ছাদে আবৃত এই সৌধের নিম্নাংশ বহু খিলানযুক্ত তিন প্রস্থ দেয়ালে পরিবেষ্টিত। ভিতরের দিক হইতে এই তিনটি দেয়ালের প্রতিদিকে যথাক্রমে ৫, ৮, ও ১০টি প্রশস্ত খিলান সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। শীর্ষদেশের চারিটি ঢালু চান পিরামিডের আকৃতিতে ক্রমহ্রস্বায়মান ধাপে ধাপে উপরে উঠিয়া একটি বিন্দুতে মিলিত হইয়াছে। খিলানগুলির ঠিক উপরে এবং পিরামিডের ঠিক নিম্নপ্রান্তের চারি কোণে চারিটি চারচালা এবং অন্তর্বর্তী স্থানে তিন দিকে চারিটি করিয়া দোচালা নির্মিত হইয়াছিল। এগুলি অলঙ্কারমাত্র, কোন স্থাপত্য প্রয়োজনে গঠিত নহে।
বিষ্ণুপুরের আর দুইটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন-ইষ্টকনির্মিত রথ এবং দুর্গ-তোরণ।
মল্লভূমের বাহিরে মন্দির
মল্লভূমের বাহিরে যে সমুদয় মন্দির আছে তাঁহার মধ্যে মালদহ জিলার হরিশ্চন্দ্রপুর থানার দশ মাইল উত্তরে অবস্থিত ওয়ারি গ্রামে যে একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে দুইটি কারণে তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ, মন্দিরসংলগ্ন প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় যে এই প্রস্তরনির্মিত মন্দিরটি ১৪৬৭ শকাব্দে (১৫৪৫-৪৬ খ্রীষ্টাব্দে) নির্মিত হইয়াছিল। মধ্যযুগে সঠিক তারিখযুক্ত এরূপ প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের নিদর্শন বিরল। দ্বিতীয়তঃ উপরিভাগ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলেও এই মন্দিরের অভ্যন্তর ভাগ এখনও যেটুকু অবশিষ্ট আছে–তাঁহার অনুরূপ আর কোন মন্দির অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। উত্তীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় যে এই মন্দিরে বিষ্ণু, সূর্য, গণেশ, পার্ব্বতী এবং বিশ্বনাথের মূর্ত্তি যথাক্রমে মধ্যস্থলে এবং অগ্নি, নৈঋত, বায়ু ও ঈশান কোণে অবস্থিত ছিল।
মন্দিরটি চতুষ্কোণ। ইহার চতুর্দিকে চারি ফুট প্রশস্ত ইটের প্রাচীরের দুই দিকই নীলোপল’ (Basalt) প্রস্তরফলক দ্বারা আবৃত ছিল। মন্দিরের অভ্যন্তর ভাগ ইটের দেওয়াল দিয়া নয়টি ক্ষুদ্র কক্ষে বিভক্ত। কেন্দ্রের কক্ষটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ১১ ফুট। ইহার চারিকোণে চারিটি বর্গাকৃতি ও চারিপার্শ্বে দীর্ঘাকৃতি চারিটি কক্ষ। উত্তর-পূর্ব কোণে এখনও একটি শিবলিঙ্গ আছে–সুতরাং মধ্যের কক্ষে বিষ্ণু ও অন্য চারিটি কোণের কক্ষে পূর্ব্বোক্ত দেবদেবীর মূর্ত্তি ও শিবলিঙ্গ ছিল ইহা সহজেই অনুমান করা যায়। এই মন্দিরটি প্রাচীন পঞ্চায়তন মন্দিরের একটি অপূর্ব নিদর্শন। কিন্তু মন্দিরের উপরিভাগ সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াতে ইহা কোন শ্রেণীর মন্দির তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। [এই মন্দিরের বিস্তৃত বিবরণের জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থ দ্রষ্টব্য : Epigraphia Indica, Vol. XXXV. Pp. 179-84]
মল্লভূমের বহিরেও কুটির-দেউলের পূর্ব্বোক্ত সকল শ্রেণীর নিদর্শনই পাওয়া যায়।
চন্দননগরের নন্দদুলালের মন্দির প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ দোচালা মন্দিরের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
দ্বিতীয় শ্রেণী অর্থাৎ জোড়-বাংলা মন্দিরের বহু নিদর্শন আছে। তন্মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য :
১। হুগলি জিলার গুপ্তিপাড়ায় চৈতন্যের মন্দির [Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1909, p. 160. Fig 9]–ইহার প্রতি দোচালার উপর একটি লোহার শিকের চূড়া, সম্ভবত ১৭শ শতাব্দে নির্মিত।
২। মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বড়নগর নামক স্থানে। রাণী ভবানী (১৮শ শতাব্দে) বহু মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে একটি পুষ্করিণীর চারিপাশে চারিটি ইষ্টকনির্মিত জোড়-বাংলা আছে। অর্ধভগ্ন বিশাল ভবানীশ্বর মন্দিরই এখানকার বহুসংখ্যক মন্দিরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ।
৩। মহানাদে একটি জীর্ণ জোড়-বাংলা মন্দির আছে।
হুসেন শাহের সময়কার (ষোড়শ শতাব্দী) একটি জোড়-বাংলা মন্দির নাটোরের ৩৬ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ভবানীপুর গ্রামে ছিল, কিন্তু ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ভূমিকম্পে ইহা ধ্বংস হয়। রাজা সীতারাম রায় নির্মিত মামুদাবাদের বলরাম মন্দিরেরও এখন কোন চিহ্ন নাই।
হুগলি জিলায় আরামবাগ হইতে পাঁচ মাইল দূরে বালী দেওয়ানগঞ্জ গ্রামে একটি জোড়-বাংলার উপরে একটি নবরত্ন মন্দির স্থাপিত হইয়াছে।
বর্ধমান জিলার গারুই গ্রামে প্রস্তরনির্মিত একটি চৌচালা মন্দির আছে [Ib. d, 153, Fig. 1]। অষ্টাদশ শতাব্দের শেষে নির্মিত হুগলি জিলার গুপ্তিপাড়ায় চৌচালা রামচন্দ্র মন্দিরের শীর্ষদেশের শিখর একটি অষ্টকোণ বাঁকানো কার্নিসযুক্ত ছাদওয়ালা সৌধের অনুকৃতি। হুগলি জিলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামে ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত বিষ্ণুমন্দির [দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, দ্বিতীয় খণ্ড ৬৬০ (খ) পৃষ্ঠা] এই শ্রেণীর মন্দিরের অন্যতম নিদর্শন।
চতুর্থ শ্রেণী অর্থাৎ ডবল চৌচালা মন্দির বাংলায় সর্বত্র ও বহু সংখ্যায় দেখিতে পাওয়া যায় এবং বর্তমান কালে ইহাই হিন্দুমন্দিরের আদর্শরূপে গৃহীত হইয়াছে। প্রায় তিন শত বৎসরের পুরাতন কালীঘাটের কালীমন্দির ইহার সুপরিচিত দৃষ্টান্ত। নদীয়া জিলার শান্তিপুর গ্রামে ১৬২৬-২৭ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত শ্যামচাঁদের মন্দির সম্ভবত এই শ্রেণীর মন্দিরের মধ্যে বৃহত্তম [J.A.S. B 1909, p. 159, Fig. 8]। অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়টি উল্লেখযোগ্য :
১। আমতার (হাওড়া) মেলাইচণ্ডীর মন্দির (১৬৪৯-৫০ খ্রীষ্টাব্দে)।
২। চন্দ্রকোণার (ঘাটাল, মেদিনীপুর) লালজী মন্দির (১৬৫৫-৫৬ খ্রীষ্টাব্দ)।
৩-৮। শান্তিপুরের গোকুলচাঁদ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্র, কালনার বৈদ্যনাথ এবং তারকেশ্বর ও উত্তরপাড়ার শিবমন্দির।
এই শ্রেণীর মন্দিরে সাধারণত কোন ভাস্কর্যের নিদর্শন থাকে না। অষ্টাদশ শতাব্দে অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির একসঙ্গে সারি সারি নির্মাণ করার প্রথা দেখা যায়। বাক্সার দ্বাদশ মন্দির ও বর্ধমান জিলার নবাবহাটলিঙ্গে আমবাগানের চতুর্দিকে একটি কেন্দ্রীয় মন্দিরকে বেষ্টন করিয়া নির্মিত ১০৮টি মন্দির ইহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বলাবাহুল্য, সংখ্যাধিক্যহেতু এই সকল মন্দিরে কোনরূপ বিশেষত্ব থাকে না।
রত্নমন্দির-শৈলীটি মল্লভূমে খুব বেশি প্রচলিত ছিল না। ভাগীরথীর তীরবর্তী প্রদেশে ইহা খুব বেশি সংখ্যায় দেখা যায়। তবে মল্ল রাজবংশের পতনের পর বর্ধমান রাজ্যের সমৃদ্ধির দিনে বহুচূড় ভাস্কর্যে অলঙ্কৃত রত্নমন্দির-শৈলী প্রবর্তিত হয়।
হুগলি জিলার সোমড়া-সুখড়িয়া গ্রামের পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট আনন্দ-ভৈরবীর মন্দির রত্নমন্দিরের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এই ত্রিতল মন্দিরের প্রথম তলে প্রতি কোণে তিনটি, দ্বিতীয় তলের প্রতি কোণে দুইটি, তৃতীয় তলের প্রতি কোণে একটি এবং সর্বোপরি কেন্দ্রীয় শিখরটি লইয়া মোট ২৫টি শিখর সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। বর্ধমান জিলার কালনা গ্রামে পঁচিশ রত্ন লালাজীর মন্দির [J.A.S.B 1909, p. 153. Fig.7] ও কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির মধ্যযুগের অনতিকাল পরেই ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়।
মেদিনীপুর জিলার অন্তর্গত চন্দ্রকোণায় রঘুনাথপুরে বুড়া শিবের মন্দিরটি সতের রত্ন, কিন্তু ইহার নির্মাণকার সঠিক জানা যায় না।
ষোড়শ শতাব্দীতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পিতা কর্ত্তৃক নির্মিত নবরত্ব মন্দিরের ভগ্নাবশেষ খুলনা জিলার সাতক্ষীরার নিকট দামরাইল গ্রামে এখনও দেখিতে পাওয়া যায়।
দিনাজপুর হইতে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত ১৭০৪-২২ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত কান্ত নগরের বিচিত্র কারুকার্যখচিত নবরত্ন মন্দির দেশীয় ও বিদেশীয় লেখকগণের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। ইটের এই মন্দিরটির গাত্রে পোড়ামাটির ফলকে যে সকল মূর্ত্তি ও দৃশ্য খোদিত আছে তাহাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় বাঙালীর জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-ব্যবহার প্রতিফলিত হইয়াছে। শিল্পের দিক হইতে প্রাচীন হিন্দুযুগের শিল্প অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইলেও ইহার কঠোর শ্রমসাধ্যবহুল জীবন্ত আলেখ্য বিশেষ প্রশংসনীয় [James Fergusson, History of Indian and Eastern Architecture Vol. II. p. 161.]। ফার্গুসনের এই মন্তব্য এ যুগের আরও কয়েকটি মন্দির সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। পঞ্চরত্ন মন্দিরের অনেক নিদর্শন আছে–যথা, চন্দ্রকোণায় ১৬৫৫-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত রামেশ্বরের মন্দির, বিক্রমপুরের অন্তর্গত জপসায় লালা রামপ্রসাদ রায় কর্ত্তৃক অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথম পাদে নির্মিত মন্দির, প্রায় সমসাময়িক রাজা সীতারাম রায়ের (অধুনা ভগ্ন) কৃষ্ণমন্দির (১৭০৩-০৪ খ্রীষ্টাব্দ) এবং বর্ধমান জিলার অন্তর্গত খাটনগরের লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির। ইহার নিকটেই খর্বাকৃতি শিখরযুক্ত মন্দিরে একটি লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। প্রস্তরফলকে উত্তীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় যে ইহা ১১৬১ বঙ্গাব্দে (১৭৫৪ খ্র.) নির্মিত হইয়াছিল। লক্ষ্মীনারায়ণের পঞ্চরত্ন মন্দিরটিও সম্ভবতঃ ঐ সময়ে নির্মিত। ইহার স্তম্ভ ও অন্যান্য কারুকার্য উচ্চশ্রেণীর শিল্পের নিদর্শন। [Report of the Regional Records Survey Committee for West Bengal, (1952-3), pp 35-6.]
সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত দুইটি মন্দিরের উল্লেখ করিয়া এই প্রসঙ্গের উপসংহার করিব-মুর্শিদাবাদ জিলায় বড়নগরে রাণী ভবানীকৃত শিখরযুক্ত অষ্টকোণ মন্দির এবং চারিটি দোচালা মন্দিরের সমবায়ে গঠিত মন্দির।
চিত্র বিদ্যা
মধ্যযুগের অনেক পুঁথিতে এবং কাঠের তাহাদের মলাটে ছবি আছে। ইহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য :
১। কালচক্ৰতন্ত্র (১৪৪৩ খ্রী.)।
২। ‘হরিবংশ (১৪৭৯ খ্রী)। বর্তমানে এসিয়াটিক সোসাইটীতে রক্ষিত।
৩। ভাটপাড়ায় প্রাপ্ত ভাগবত পুঁথি (১৬৮৯ খ্র.)
দীনেশচন্দ্র সেন মন্দিরগাত্র, পুঁথি, পুঁথির মলাটে রঞ্জিত চিত্রপট প্রভৃতি হইতে বহু বৈষ্ণব চিত্রের প্রতিকৃতি দিয়াছেন (বৃহৎ বঙ্গ, ৪৩৮ ও ৪৩৯ এবং ৬৯৬ ও ৬৯৭ পৃষ্ঠার মধ্যে)। তিনি এগুলিকে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। এই ছবিগুলি খুব উন্নত শিল্পের পরিচায়ক নহে। অনেকটা পটের ছবির মত। তবে লোকসংগীতের মত এই সমুদয় লোকশিল্পের ঐতিহাসিক মূল্য আছে।