১৬. শাঙ্কর দর্শন
(প্রুফরীড আবশ্যক)
শাঙ্করদর্শন সকল দর্শন অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ও সর্বত্র সমাদরণীয়। পূর্ব কালে যত প্রধান প্রধান অসামান্যধীসম্পন্ন পণ্ডিতবর্গ ছিলেন, তন্মধ্যে অনেকেই শাঙ্করদর্শন প্রদর্শিত পথের পথিক হইয়া সাধারণের সুগমতার নিমিত্ত ঐ পথেরই পরিস্কারচ্ছলে নানাগ্রন্থ ৰচনা করিয়াছেন । এ কারণ শাঙ্করদর্শনানুযায়ী গ্রন্থ যে কত আছে তাহার সংখ্যা করিতে পারা যায় না । অধিক কি, এক মাধবাচার্য্যই যে কত গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন তাহাই নিশ্চয় করা দুষ্কর ৷ স্বকৃত অন্যান্য গ্রন্থে শঙ্কর দর্শন বিস্তারিত রূপে বর্ণিত হইয়াছে, এই হেতু সৰ্ব্বদর্শন সংগ্রহে মাধবাচার্য্য শাঙ্কর দর্শনের সংগ্রহ করেন নাই । কিন্তু মাধবাচার্য্য যে কারণে শঙ্কর দর্শনের পরিত্যাগ করিয়াছেন, অন্মদাদির পক্ষে সে করণের অসদ্ভাব থাকায় আমরা শঙ্কর দর্শনের পরিত্যাগে পরাভূখ হইয়। তৎসংগ্রহে প্ররক্ত হইলাম ।
এই দর্শনপ্রণালী পূজ্যপাদ শঙ্করাচার্য্য কর্তৃক আবিষ্কৃত হওয়াতে ইহাকে শাঙ্করদর্শন কহে, এবং শঙ্করাচার্য মহর্ষি বেদব্যাসকৃত বেদান্তস্থত্রকে অবলম্বন করিয়া এই অদ্বৈত মত ংস্থাপন করিয়াছেন এনিমিত্ত এই দর্শনকে বেদান্তদর্শন ও অদ্বৈতদর্শনও কহে। মহর্ষি বেদব্যাস এমত অস্ফুট রূপে বেদান্তস্থত্র রচনা করিয়াছেন যে তাহার তাৎপৰ্য্য কোনক্রমেই অনায়াসে বোধগম্য হয় না, বরং যাহার যেরূপ অভিপ্রায় হয় সে সেইরূপেই অর্থ করিতে পারে । একারণ বেদান্ত স্থত্রের নানা প্রস্থান হয়, অর্থাৎ ঐ স্থত্রের রামানুজকৃত ব্যাখ্যান্তসারে রামানুজ প্রস্থান, মাধ্যাচাৰ্য্য কৃত ব্যাখ্যানুসারে মাধ্বপ্রস্থান ও শঙ্করাচাৰ্য্য কৃত ব্যাখ্যানুসারে শাঙ্কর প্রস্থান হইয়াছে (১)। বেদান্তস্থত্র চারি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং অধ্যায় সকলও প্রত্যেকে চারি পাদে বিভক্ত তন্মধ্যে প্রথমাধ্যায়ের প্রথমপাদে ব্রহ্মের জগৎকর্তৃত্বাদি, দ্বিতীয়ে ও তৃতীয়ে অস্ক টার্থ শ্রুতি সকলের ব্রহ্মপরত্বাদি, চতুর্থে সাত্ম্যমতসিদ্ধ প্রধানের জগৎকর্তৃত্ববোধক গ্রমাণাভাসের সমন্বয়াদি । দ্বিতীয়াধ্যায়ের প্রথম পাদে অদ্বৈতমতবিরুদ্ধ শ্ৰুতি ও স্মৃতির সমন্বয়াদি, দ্বিতীয়ে যুক্তি ও শ্রুতিদ্বারা সাঙ্খা মত প্রভূতির নিরাকরণ, তৃতীয়ে সৃষ্টিক্রমনিরূপণপ্রসঙ্গে আকাশের নিত্যত্ব খণ্ডন ও জন্যত্ব সংস্থাপন, চতুর্থে প্রাণের নিত্যত্ববোধক শ্রুতি সমন্বয় পূৰ্ব্বক জন্যত্ব সংস্থাপন । তৃতীয়াধ্যায়ের প্রথম পাদে পঞ্চাগ্লিবিদ্যানুসারে জীবের সংসার গতি ক্রমাদি, দ্বিতীয়ে জগতের অবস্থভেদাদি, তৃতীয়ে বেদাস্তুের প্রতিপাদ্য যে ব্রহ্ম তাহার বিচারাদি, চতুর্থে বেদান্তসিদ্ধ তত্ত্বজ্ঞান যে স্বতন্ত্ররূপে পুরুষার্থসাধন তাহার নিরূপণাদি । চতুর্থাধ্যায়ের প্রথম পাদে সাধনবিষয়ক বিচারাদি, দ্বিতীয়ে বাগাদির প্রয়াণনিরূপণাদি, তৃতীয়ে অচিরাদিমার্গ নিরূপণাদি, চতুর্থে মুচ্যমান ব্যক্তির শরীরত্যাগানস্তুর পরামজ্যোতিঃপ্রাপ্তিপ্রকরণাদি নিরূপিত হইয়াছে, এবং সকল অধ্যায়েই প্রসঙ্গক্রমে অন্যান্য অনেক বিষয়ও প্রদর্শিত হইয়াছে । .
শাঙ্কর দর্শনে এক মাত্র ব্রহ্মই সত্য, আর সমুদায় জগৎই মিথ্যা, ব্রহ্ম জ্ঞান হইলেই মুক্তি হয়—ইত্যাদি বিষয়সকল প্রাধান্যরূপে শ্রুতি, স্মৃতি ও যুক্তি প্রদর্শন দ্বারা প্রতিপাদিত হইয়াছে । সুতরাং শঙ্কর দর্শনপ্রদর্শিতপথাবলম্বন করিয়া চলিলেই পরমপদ মুক্তি পাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবন ; কিন্তু যেমন, যাহার জলসর্প ধরিবারও ক্ষমতা নাই তাহার কাল সৰ্প ধরিতে যাওয়া প্রকৃতফলোপযোগী না হইয়া কেবল কালকবলে কলেবর সমর্পণ করিবার নিমিত্তই হয়, সেইরূপ যিনি অধিকারী না হইয়াই কৰ্ম্ম কাণ্ড সকল পরিত্যাগ করিয়া শাঙ্কর দর্শনের প্রধান উদেশ্য সৰ্ব্বোপাস্য নিগুণ ব্রহ্মোপাসনায় উদ্যত হয়েন ; তাঁহাকে “জ্ঞানাদ্বৈ নরকম” অর্থাৎ কেবল জ্ঞান কাণ্ডের আলোচনা করিলে নরক হয়, ইত্যাদি শ্রুতির অনুসারে কেবল নারকী হইতে হয়, ফলতঃ প্রকৃত ফলের অণুমাত্রও লাভ হয় না। এই ব্ৰহ্মজ্ঞানের অধিকারী হওয়াও সহজ নহে, যে ব্যক্তি, অধ্যয়ন বিধির অনুসারে বেদ ও বেদান্ত সকল অধ্যয়ন করিয়া বেদার্থ সকল এক প্রকার হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন, ইহজন্মেই হউক বা জন্মাস্তরেই হউক কাম্যকৰ্ম্ম অর্থাৎ স্বর্গাদিজনক যাগদি, ও নিষিদ্ধ কৰ্ম্ম অর্থাৎ নরককারক ব্ৰহ্মহত্যাদি হইতে নিৰ্বত্ত হইয়। কেবল সন্ধ্যাবন্দনাদি স্বরূপ নিত্যকৰ্ম্ম, নৈমিত্তিক কৰ্ম্ম অর্থাৎ পুত্ৰ জননকালাদি কৰ্ত্তব্য জাতেষ্টি প্রভূতি, প্রায়শ্চিত্ত এবং উপসনা অর্থাৎ ছান্দেগ্য উপনিষদ্ভুক্ত শাণ্ডিল্য বিদ্যানুসারে সগুণ ব্রহ্মবিষয়ক মানস উপাসনা প্রভৃতি উপাসনকাণ্ডের অনুষ্ঠান দ্বারা চিত্তকে নিতান্ত নিৰ্ম্মল করিয়া, পরিশেষে সাধন চতুষ্টয় সম্পন্ন হইয়া অভ্রান্ত হইবেন, সেই ব্যক্তিই ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী, ডাহারই ব্রহ্মজ্ঞানে ইচ্ছা করা কৰ্ত্তব্য, যেহেতু তাঁহারই ঐ ইচ্ছা অচিরাৎ ফলবতী হয় ; অন্মদাদির ব্রহ্মজ্ঞানে ইচ্ছা করা দরিদ্রের রাজ্যাভিলাষের ন্যায় উপহাসাম্পদ মাত্র । ইহা প্রাচীন বৈদান্তিক মহাশয়েরাই স্ব স্ব গ্রন্থে স্বীকার করিয়াছেন ।
উল্লিখিত সাধন চতুষ্টয়ের প্রথম সাধন নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক, দ্বিতীয় ইহামুত্র ফলভোগ বিরাগ, তৃতীয় শম দমাদি ষটসম্পৎ, চতুর্থ মুমুক্ষুত্ত্ব। নিত্যানিত্যবস্তু বিবেক শব্দে কোন বস্তু নিত্য আর কোন বস্তু অনিত্য ইহার বিবেচনাকে বুঝায়, নিত্যানিত্য বস্তুর বিবেচনা করিতে হইলে “এক মাত্র ব্রহ্মই নিত্য আর সকলই অনিত্য” এইমাত্র বলিলেই পর্যাপ্ত হইতেছে । ইহামুত্র ফলভোগ বিরাগ শব্দে আক, চন্দন, ও বনিতা-সম্ভোগাদিশ্বরূপ ঐহিক সুখভোগ এবং স্বৰ্গভোগাদি স্বরূপ পারলৌকিক সুখভোগে যে এক কালেই বিতৃষ্ণ, তাহাকে বুঝিতে হইবে । শমাদি সম্পৎ শম, দম, উপরভি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধাভেদে ষড় বিধ । ব্রহ্ম ব্যক্তিরিক্ত বিষয়ের শ্রবণাদি হইতে মনের নি গ্রহকে শম, বাহেন্দ্রিয়কে শ্রবণাদি ভিন্ন বিষয় হইতে নিবৃত্ত করণকে দম, বিহিত কৰ্ম্ম সকলের বিধিপূৰ্ব্বক পরিত্যাগকে উপরভি, শীত বা উষ্ণতা প্রভৃতি দ্বন্দ্ব সহিষ্ণুতাকে তিভিক্ষা, উক্তপ্রকারে ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করিয়া ব্রহ্ম বা তদুপযোগি বিষয়ে মনোনিবেশকে সমাধান, এবং গুরু ও বেদাস্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা কহে । এবং মোক্ষেচ্ছাকে মুমুক্ষুত্ব কহে ।
উল্লিখিত প্রকারে ব্রহ্মজ্ঞানে অধিকারী হইয়া জ্ঞান কাণ্ডের আলোচনা করিলেই অচিরাৎ ব্রহ্মভাব গ্রাপ্তিস্বরূপ মুক্তি ভাজন হইতে পারে ।
ব্রহ্ম সৎ, অর্থাৎ “সত্যস্বরূপ” চিৎ অর্থাৎ “চৈতন্যপদবাচ্য জ্ঞানের স্বরূপ” পরম আনন্দ স্বরূপ, অখণ্ড অর্থাৎ “অপরিচ্ছিন্ন, অদ্বিতীয়, এবং নিধৰ্ম্মক, অর্থাৎ “ব্রহ্মে জ্ঞান বা সুখাদি কোন ধৰ্ম্মই নাই, ব্রহ্মই স্বয়ং জ্ঞান ও সুখ স্বরূপ ।“ যদিও “ঘট জ্ঞান হইতে পট জ্ঞান ভিন্ন এবং তোমার জ্ঞান হইতে আমার জ্ঞান পৃথকৃ” এইরূপ ভেদ ব্যবহার দর্শন করিয়া জ্ঞানের নানাতুই স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, জ্ঞানের ব্রহ্মস্বরূপত বা সকল জ্ঞানের ঐক্য সাধক কোন যুক্তি আপাততঃ দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, তথাপি বিশিষ্ট বিবেচনা করিয়া দেখিলে বোধ হইবে যে বিষয় স্বরূপ উপাধির নানাত্ব লইয়াই জ্ঞনের নানাত্ব ভ্রম হয় মাত্র, বাস্তবিক জ্ঞান নানা নহে একমাত্র । যথা এক মুখই, তৈলে প্রতিবিম্বিত হইলে একরূপ, অণর জলে প্রতিবিম্বিত হইলে রূপান্তর রূপে দৃষ্ট হয় বটে, কিন্তু বাস্তবিক ঐ ঐ স্থলে একই মুথ, মুখের ভেদ নাই, তৈলাদি রূপ উপাধির ভেদ লইয়াই ভেদ ব্যবহার হয় মাত্র, সেইরূপ জ্ঞানের ঐক্য থাকিলেও ঘট পটাদি বিষয় স্বরূপ উপাধির ভেদ লইয়াই জ্ঞানের বিভিন্নত প্রতীতি হয় ।
আর যথা এক ব্যক্তিই যখন যদেশের রাজসিংহাসনে অধিরূঢ় হয়, তখন ভাহাকে ভদেশের রাজা বলিতে হয়, আর যখন দেশান্তরের নৃপতি হয়েন, তখন তাহাকেই দেশস্তরের রাজাই সকলে বলে, পূৰ্ব্বাধিকৃত দেশের রাজ আর কেহই বলে না, সেইরূপ যখন যাহার অন্তঃকরণ বৃত্তি (২) দ্বারা বিষয়ের আবরণ স্বরূপ অজ্ঞান নষ্ট হইয়া জ্ঞানদ্বারা বিষয় প্রকাশমান হয়, তখনই তাহার জ্ঞান বলা যায়, আর যখন ঐরূপ না হয়, তখন তাহার জ্ঞান বলিয়াও ব্যবহার হয় না, অতএব জ্ঞান এক হইলেও ‘‘তোমার জ্ঞান আমার জ্ঞান ’ ইত্যাদি ভেদ ব্যবহারের বাধক কি আছে ; বরঞ্চ জ্ঞানের ঐক্য সাধক প্রমাণই অনেক দৃষ্ট হয়, তন্মধ্যে এস্থলে একটা প্রমাণ মাত্র উদ্ধত হইতেছে ; দেখ যে বস্তুর সহিত ষে বস্তুর বাস্তবিক ভেদ থাকে, তাহার উপাধি পরিত্যাগ করিলেও ভেদ ব্যবহার হইয়া থাকে, যেমন ঘট ও পটের বাস্তবিক ভেদ আছে বলিয়া ঘট ও পটের উপাধি পরিত্যাগ করিলেও ভেদব্যবহারের বাধ হয় না, অতএব যদি ঘটজ্ঞান ও পটজ্ঞানের পরস্পর বাস্তবিক ভেদ থাকিত ভাহা হইলে ঐ ঐ জ্ঞানের যথাক্রমে ঘট ও পটরূপ উপাধিদ্বয় পরিত্যাগ করিলেও ভেদ ব্যবহার হইত সন্দেহ নাট, কিন্তু যখন ঘটক্তান ও পটক্সানের ঘট পটন্ধপ উপাধি পরিত্যাগ করিয়া “জ্ঞান জ্ঞান হইতে ভিন্ন” এরূপ ভেদ ব্যবহার কেহই স্বীকার করেন না, তখন ঐ ঐ জ্ঞানের বাস্তবিক ভেদ কি রূপে সিদ্ধ হইতে পারে, বরঞ্চ ঐ ঐ জ্ঞানের ঘট পটন্ধপ উপাধি লইয়াই “যেহেতু ঘটজ্ঞানের বিষয় ঘট আর পটজ্ঞানের বিষয় পট অতএব ঘটজ্ঞান পাটজান হুইতে ভিন্ন” এইরূপ ভেদব্যবহার হয় বলিয়া ঐ ঐ জ্ঞানের ঔপাধিক ভেদ মাত্র আছে ইহাই সিদ্ধ হইতেছে, এতদ্ভিন্ন জ্ঞান সকলের পরস্পর বাস্তবিক ভেদ সাধক কোন প্রমাণ বা যুক্তি নাই, বরং ঐক্য প্রতিপাদক শ্রুতি ও স্মৃতির প্রচুরভাই দ্বষ্ট হয়, আরও যখন সামান্যভঃ জানা যাইতেছে যে ঘটজ্ঞানও জ্ঞান, আর পটজ্ঞানও জ্ঞান, তখন ঐ ঐ জ্ঞানের কিরূপ ভেদ স্বীকার করা যাইস্তে পাৱে ? অতএব ইহা সিদ্ধ হইল যে সৰ্ব্ববিষয়ক সকল ব্যক্তির জ্ঞানই এক, বিভিন্ন নহে, এই জ্ঞানেরই নামান্তৱ চৈতন্য ; চৈতন্য, জ্ঞান হইতে পৃথকভূত নহে, এবং এই জ্ঞানস্বরূপ চৈতন্যই আত্মা ; আত্মা, চৈতন্যভিন্ন নহে, অতএব উল্লিখিত যুক্তিক্রমে যখন জ্ঞানের ঐক্য সিদ্ধ হইতেছে তখন আত্ম-সকলের পরস্পর ঐক্য এবং পূর্ণচৈতন্য স্বরূপ ব্রহ্মের সহিত জীবাত্মারও যে ঐক্য সিদ্ধ হইতেছে তাহা আর বলিবার অপেক্ষ কি ! এই জীবব্রহ্মের ঐক্যই “তত্ত্বমসি” ইত্যাদি শ্রীতি দ্বারা প্রতিপাদিত হইয়াছে, আত্মার জন্ম, স্থিতি, পরিণাম, বৃদ্ধি, অপচয় ও বিনাশরূপ ষড়বিধ বিকারের মধ্যে কোন বিকারই নাই, আত্মা সৰ্ব্বত্র সর্বদাই দেদীপ্যমান রহিয়াছেন, এবং আত্মাই পরম আনন্দ স্বরূপ, যেহেতু আত্মাই সকলের নিরতিশয় স্নেহের অদ্বিতীয় পাত্র, দেখ, আত্মার প্রীতির নিমিত্তই অন্যত্র পুত্র কলত্রাদিতে স্নেহ জন্মে, অন্যের প্রীতির নিমিত্ত আর কেহই কোন কালে আত্মাতে স্নেহ করে না। এস্থলে এই আপত্তি উৰ্থিত হইতে পারে, “যদি আত্মার আনন্দরূপতা প্রতীত না হয় তাহা হইলে আত্মার আনন্দরূপতা অজ্ঞাত রহিল, সুতরাং তাহাতে স্নেহ হইবার সম্ভাবনা কি ; এই দোষ পরিহারার্থে যদি আনন্দরূপভার প্রতীতি স্বীকার করা যায়, তাহ হইলে আত্ম-স্বরূপ পুর্ণানন্দ থাকিতে তুচ্ছ বিষয়ানন্দ পাইবার মানসে কোন ব্যক্তি আক চন্দন ও বনিতাদির মম্ভোগে প্রবৃত্ত হইত, সিদ্ধ বস্তুর নিমিত্ত কি লোকের প্রবৃত্তি হইয়া থাকে। অতএব আত্মার আনন্দরূপতার প্রতীতি বা অপ্রতীতি উভয় পক্ষই সদোষ হইতেছে ;” কিন্তু এই আপত্তি তবে বদ্ধমুল হইত, যদি আমার আনন্দরূপতার সম্পূর্ণ প্রতীতি বা সম্পূর্ণ অপ্রভাতি স্বীকার করা যাইত । বাস্তবিক আত্মার আনন্দরূপত অজ্ঞানস্বরূপ অবিদ্যার প্রতিবন্ধক বশতঃ প্রতীত হইয়াও অপ্রতীত হইতেছে, অর্থাৎ সীমান্যতঃ প্রতীত হইতেছে বটে, কিন্তু বিশেষতঃ প্রতীতি হইতেছে না, ইহার অবিকল দৃষ্টান্ত, অধ্যয়নশীল ছাত্ৰ-মধ্যস্থিত চৈত্রনামক ব্যক্তির অধ্যয়ন শব্দ । এই স্থলে অন্যান্য বালকের অধ্যয়ন রূপ প্রতিবন্ধক বশতঃ এইটা চৈত্রের অধ্যয়ন শব্দ এইরূপ বিশেষ জানা যায় না বটে, কিন্তু সামান্যতঃ এই মাত্র জানা যায় যে ইহার মধ্যে চৈত্রেরও অধ্যয়ন শব্দ আছে । পরব্রহ্মের প্রতিবিম্ব যুক্ত সত্ব, রজঃ, ও তমোগুণাত্মক ও সৎ বা অসৎ রূপে অনির্ণেয় পদার্থ বিশেষকে অজ্ঞান কহে, এই অজ্ঞান জগতের কারণ বলিয়া ইহাকে প্রকৃতিও কহে, অজ্ঞানের আবরণ ও বিক্ষেপ ভেদে ছুইটী শক্তি আছে। যেরূপ মেঘ পরিমাণে অলপ হইয়াও দর্শক জনগণের নয়ন অণুচ্ছন্ন করিয়া বহুষোজনবিস্তভ স্থৰ্য্যমণ্ডলকেই যেন আচ্ছাদিত করিয়াছে, বোধ হয়, সেইরূপ অজ্ঞান, পরিচ্ছিন্ন হইয়াও যে শক্তি দ্বারা দর্শক ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছাদিত করিয়া যেন অপরিচ্ছিন্ন আত্মাকেই তিরোহিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐ শক্তিকে আবরণ শক্তি কহে । আর যে শক্তি সহকারে অজ্ঞান উপাদান কারণ রূপে জগৎ সৃষ্টি করেন ঐ শক্তিকে বিক্ষেপ শক্তি কহে । এই অজ্ঞান বাস্তবিক এক হইলেও অবস্থাভেদে দ্বিবিধ মায়া আর অবিদ্যা । বিশুদ্ধ অর্থাৎ রক্তে বা তমোগুণ দ্বারা অনভিভূত সত্ত্বগুণ প্রধান অজ্ঞানকে মায় আব মলিন অর্থাৎ রজে বা তমোগুণ দ্বারা অভিভূত সত্ত্বগুণ প্রধান অজ্ঞানকে অবিদ্যা কহে । উল্লিখিত মায়াতে পরব্রহ্মের যে প্রতিবিম্ব হয় ঐ প্রতিবিম্বই ঐ মায়াকে স্বায়ত্ত্ব করিয়া জগৎ সৃষ্টি করেন এ কারণ ঐ প্রতিবিম্বই সৰ্ব্বজ্ঞ, সৰ্ব্বশক্তিমান, সৰ্ব্বনিয়ন্ত ও অন্তর্যামী স্বরূপ ঈশ্বরপদবাচ্য, আর অবিদ্যাতে যে পরব্রহ্মের প্রতিবিম্ব পতিত হয়, আর অবিদ্যাতে যে পরব্রহ্মের প্রতিবিম্ব পতিত হয় ঐ প্রতিবিম্বই ঐ অবিস্যার বশীভূত হইয়া মনুষ্যাদি যাবৎ জীব পদ বাচ্য হয় । অবিদ্যা নানা, সুতরাং তৎপতিত প্রতিবিম্বও নানা বলিয়া জীবও নানা, (৩) মায়া ও অবিদ্যাকেই যথাক্রমে ঈশ্বর ও জীবের সুষুক্তি আনন্দময় কোষ ও কারণ শরীর কহে, এই কারণ শরীরে অভিমানী ঈশ্বর ও জীব যথাক্রমে সৰ্ব্বজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ পদ বাচ্য হয়েন । জীবের উপভোগের নিমিত্ত পরমেশ্বর জীবগণের পূৰ্ব্বকৃত সুকৃত ও দুষ্কৃত অমুসারে অপরিমিত শক্তি বিশিষ্ট মায়া সহকারে নাম রূপাত্মক নিখিল প্রপঞ্চকে প্রথমতঃ বুদ্ধিতে কম্পনা করিয়া : এইরূপ করাই কৰ্ত্তব্য” এই প্রকার সংকল্প করেন, পরে সেই মায়াবিশিষ্ট আত্মা হইতে আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে তেজ, তেজ হইতে জল, জল হইতে পৃথিবী উৎপন্ন হয় । এই আকাশাদি পৃথিবী পর্য্যন্ত পাঁচটা পদার্থকে পঞ্চ স্বক্ষ ভূত অপৰ্কীকৃত ভূত ও পঞ্চ ভস্মাত্র কহে । “কারণগুণাঃ কাৰ্য্যগুণমারভন্তে” অর্থাৎ কারণে যে যে গুণ থাকে তদনুরূপ গুণ কার্য্যেও উৎপন্ন হয়, এই ন্যায়ানুসারে অজ্ঞানরূপ কারণের সত্ত্ব রজ ও তম আদি গুণ ও আকাশাদি পঞ্চভূতে সংক্রান্ত হয়, কিন্তু ঐ সকল পদার্থের জাডের অতিশয্য প্রযুক্ত ঐ ঐ পদার্থে তমোগুণের প্রাধান্য স্বীকার করিম্ভে হইবে ।
উল্লিখিত এক একটা পঞ্চভূতের এক একটা সত্ত্বাংশ হইতে ক্রমশঃ জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চক জন্মে । অর্থাৎ আকাশের সত্ত্বাংশ হইতে শ্রোত্র, বায়ুর সত্ত্বাংশ হইতে ত্বক, ভেজের সত্বাংশ হইতে চক্ষু, জলের সত্ত্বাংশ হইতে রাসন অর্থাৎ জিহ্বা, এবং পৃথিবীর সত্ত্বাংশ হইতে ব্ৰাণেন্দ্রিয় জন্মে । আর ঐ পঞ্চ ভূতের পঞ্চ সত্ত্বাংশ মিলিত হইলে তাহ দ্বারা অন্তঃকরণের উদ্ভব হয়, অন্তঃকরণ, বৃত্তি অর্থাৎ অবস্থাভেদে দ্বিবিধ (৪) বুদ্ধি আর মন । যৎকালে অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি হয়, ভৎকালে বুদ্ধি, আর যখন অন্তঃকরণের সঙ্কল্প বিকল্পক্সক বৃত্তি হয়, তখন অন্তঃকরণকে মনঃপদে নির্দেশ করা যায়। উক্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চক, বুদ্ধি ও মনের যথাক্রমে দিক, চন্দ্র, বায়ু, স্বর্য, বরুণ, অগ্নি, চতুৰ্ম্ম,খ ইহার অধিষ্ঠাতৃ দেবতা । জ্ঞানেন্দ্রিয় সকল ঐ ঐ দেবতা কর্তৃক অধিষ্ঠিত হইয়াই যথাক্রমে শদ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ প্রভূক্তি বিষয়ের উপলম্ভক অর্থাৎ প্রকাশক হয়। প্র্যত্যেক পঞ্চ ভূতের প্রত্যেক রজোংশ পঞ্চক হইতে যথাক্রমে বাকু, পাণি, পাদ, পায়ু, তার উপস্থ রূপ পঞ্চ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় জন্মে। বহ্নি, ইন্দ্র, উপেন্দ্র, মৃত্যু, আর পূজাপতি ইহার যথাক্রমে ঐ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় পঞ্চকের অধিষ্ঠাত্ দেবতা, ঐ ঐ দেবতার অধীন হইয়াই ঐ ঐ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় যথাক্ৰমে বচন, আদান, গমন, বিসর্গ অর্থাৎ পুরীষভাগ, ও আনন্দ অর্থাৎ স্ত্রীসম্ভোগাদি সুখ এই কয়েকট কৰ্ম্ম সম্পন্ন করে । পঞ্চভূতের সমুদিত রজোংশ পঞ্চক হইতে পুণবায়ু জন্মে। পুণ, নিজবুদ্ধিভেদে পুণি, অপান, সমান, উদান আর ব্যান, এই পাঁচ প্রকার (৫) হয়। এই প্রাণ বায়ু নাসাগ্রস্থায়ী পুগিগমন আর শ্বাস প্রশ্বাসাত্মক গমনশালী, অপান পায়ুপ্রভৃতি দেশ স্থিত ও অবাগগমনবান, পায়ু পুস্তৃতি দেশ হইতে যে বায়ু নিঃসৃত হয় তাহাকেই অপান বায়ু কহে, সমান বায়ু শরীরের মধ্যস্থিত, এবং ভূক্ত পীত যে অন্ন পানীয়াদি তৎ সমুদায়ের পাকজনক, উদান বায়ু কণ্ঠদেশবৰ্ত্তী ও উৰ্দ্ধগমনশীল, এবং ব্যান বায়ু অখিল শরীর সঞ্চারী এবং সমুদায় দেহস্থায়ী । পুৰ্ব্বোক্ত বুদ্ধি, জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চক সহিত বিজ্ঞানময় কোষ, এবং মন কৰ্ম্মেন্দ্রিয় সহকারে মনোময় কোষ, আর কৰ্ম্মেন্দ্রিয় সহিত পাণ, পাণময় কোষ হয়। এই তিন কোষের মধ্যে বিজ্ঞানময় কোষ, জ্ঞানশক্তিমান এবং কর্তৃত্বশক্তি সম্পন্ন, মনোময় কোষ, ইচ্ছাশক্তিশীল এবং করণ স্বরূপ, আর প্রাণময় কোষ, ক্রিয়াশক্তিশালী ও কার্য্যস্বরূপ । পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চকৰ্ম্মেন্দ্রিয় পঞ্চপ্রাণ বুদ্ধি আর মন এই সপ্তদশটা পদার্থ মিলি ত হইয়া সুক্ষ্য শরীর হয়, ঐ সুহ্ম শরীরকেই লিঙ্গ শরীর কহে, লিঙ্গ শরীর ইহলোক ও পরলোক গামা এবং মুক্তিপর্য্যন্ত স্থায়ী । এই এক এক লিঙ্গ শরীরের অভিমনা জীবকে তৈজস অণুর সকল লিঙ্গ শরীরের অভিমানীকে হিরণাগত কহে, ঈশ্বর, জীবের উপভোগ সম্পাদক স্থূল বিষয়ের সম্পাদনাৰ্থে পঞ্চ সূক্ষ্ম ভূতের পঞ্চীকরণ করেন, তাহারও প্রণালী এইরূপ “পরমেশ্বর আকাশাদ প্রত্যেককে পুথমতঃ দুই দুই অংশে বিভক্ত করেন, পরে প্রত্যেক ভূতের ঐ এক একটি অংশকে চারি চারি খণ্ড করিয়া পূৰ্ব্বকৃত আকাশের দুই খণ্ডের যে এক খণ্ড আছে তাহাতে বায়ু তেজ জল ও পৃথিবীর চারি চারি খণ্ডের মধ্যে সকলেরই এক একটা খণ্ড দিয়া স্থলাকাশের এবং পুৰ্ব্বস্থিত বায়ুর এক অংশে আকাশ, তেজ, জল ও পৃথিবীর ঐ চারি চারি খণ্ড হইতে এক এক খণ্ড দিয়া স্থূল বায়ুর এবং ঐ রীতিক্রমে স্থূল তেজ জল ও পৃথিবীরও সৃষ্টি করেন। এইরূপে পঞ্চাকৃত পঞ্চভূতকেই পঞ্চ স্থূলভূত কহে । এই স্থূল ভূতেই শব্দাদি গুণের অভিব্যক্তি অর্থাৎ প্রকাশ হয়। যদিও সূক্ষ্ম ভূতেও শব্দাদি গুণ আছে তথাপি তাহ অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলিয়া অনুভূত হয় না। আকাশের গুণ প্রতিধ্বনিস্বরূপ শব্দ, বায়ুর গুণ “বীসী” এইরূপ অব্যক্ত শব্দ ও অতুষ্ণাশীত অর্থাৎ “না শীত না উষ্ণ মধ্যম রূপ স্পর্শ, ভেজের উষ্ণম্পর্শ, ভুগু ভূগু এইরূপ অনুকরণশব্দ, জলের চুলু ঢুলু এই রূপ অনুকরণশব্দ, শীতস্পর্শ, শুক্লরূপ, এবং মধুর রস, এবং পৃথিবীর গুণ কড়কড়া এইরূপ অক্ষুটশদ, কঠিনস্পর্শ, শুক্ল নীল ও পৗভাদি নানা রূপ, কটু কষায়, তিক্ত, অম, লবণ ও মধুর এই ছয় রস, এবং সুরভি ও অসুরভিভেদে গন্ধদ্বয় আছে । যেরূপ পরমেশ্বর পঞ্চভূতের পঞ্চীকরণ করেন, সেইরূপ তেজ জল ও পৃথিবী এই তিন ভূতের ত্ৰিৱং করণও করেন, তাহা এইরূপ ; পরমেশ্বর পৃথিবী জল ও ভেজ এই তিনট ভূতকে প্রথমতঃ দুই দুই অংশে বিভক্ত করেন, পরে প্রত্যেকের ঐ এক এক অৰ্দ্ধাংশকে পুনরায় দুই দুই খণ্ডে বিভক্ত করিয়৷ পৃথিবীর অবশিষ্ট অৰ্দ্ধাংশে জলের এবং ভেজের ঐ এক এক খণ্ড দিয়া মিশ্রিত করেন এবং অরশিষ্ট জলের অৰ্দ্ধাংশে পৃথিবী ও ভেজের ঐ এক এক খণ্ড দিয়া ত্রিরৎ কৃত জল ও তেজের সৃষ্টি করেন । এইরূপে পঞ্চীকৃত (৬) ও ত্রিবৃৎ-কৃত স্থূলভূত হইতেই যথাসম্ভব ভূর, ভুবর, স্বর, মহর, জনর, তপর, আর সত্য এই সাতটা ক্রমশঃ উপরি উপরি বর্তমান উৰ্দ্ধতন লোক, আর অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল মহাতল, পাতল, এই সপ্ত যথাক্রমে অধোইধে। বৰ্ত্তমান অধস্তন লোক ও স্থূল শরীর এবং অন্নপানীয়াদির উৎপত্তি হয় । জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ আর উদ্ভিজ্জ ভেদে স্থূলশ্বরীর চতুর্বিধ। জরায়ুতে (৭) ষে শরীরের উৎপত্তি হয় তাহাকে জরায়ুজ কহে, ঐ শরীর মনুষ্য ও পশ্বাদির। অগু অর্থাৎ ডিম্ব হইতে যে শরীরের উৎপত্তি হয় তাহাকে অগুজ কহে ; ঐ শরীর পক্ষী ও সপাদির । স্বেদ অর্থাৎ উষ্ম হইভে যে শরীরের উৎপত্তি হয় তাহাকে স্বেদজ কহে ; ঐ শরীর মশক ও ব্লুশ্চিকাদির। এবং উৰ্দ্ধ ভেদ করিয়া অর্থাৎ মৃত্তিক ভেদ করিয়া ষে শরীরের উৎপত্তি হয় তাহাকে উদ্ভিদ কহে ; ঐ শরীর লতা ও ব্ৰক্ষাদির। রক্ষাদিরও চৈতন্য আছে, এবং পুণ্য পাপের ভোগ হয় বলিয়া উহাদিগেরও শরীর স্বীকার করিতে হয়। এই স্কুল দেহ সকলের অভিমানীকে বৈশ্বানর এবং এক এক স্থূল শরীরাভিমানী জীবকে বিশ্ব কহে। এই স্থূল দেহই অন্নময়কোষপদবাচ্য ; ঐ স্থূলদেহের কান্তি ও পুষ্টির কারণ অন্ন ও পানীয়াদির ভক্ষণ । অন্ন উদর স্থ হইলে তাহার মূলাংশে পুরীষ, মধ্যম অংশে মাংস, এবং স্থম্মাংশে মনের পুষ্টি হয়, আর পীত পানীয়াদি বস্তুর স্থূল, মধ্যম ও সুক্ষাংশ যথাক্রমে মুত্র, রক্ত ও প্রাণের পুষ্টি রূপে পরিণত হয়। আর ঘূতাদি ভক্ষণ করিলে ঐ ঘূতাদির স্থূল, মধ্যম ও স্বক্ষ অংশ ক্রমশঃ অস্থি, মজ্জা ও বাকশক্তি রূপে পরিণত হয় ।
যদিও বাস্তবিক পরব্রহ্ম ভিন্ন সকল বস্তুই মিথ্যা, এই জগতে যে কিছু বস্তু দৃষ্ট হইতেছে তৎসমুদায়ই রক্ষুমপের ন্যায় অজ্ঞান কম্পিত মাত্র, এবং জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার ভেদ নাই, জীবাত্মাই পরমাত্মা আর পরমাত্মাই জীবাত্মা, অতএব এই জগতের সৃষ্টিক্রম এবং জীবাত্মা ও পরমাস্কার বিভাগ ইত্যাদি করা বন্ধার পুত্রের নামকরণের ন্যায় উপহাসাম্পদ এবং “দ্বৈতাদ্বৈ ভয়ম্ ” ইত্যাদি শ্রুভির অনুসারে অধৰ্ম্মজনক হইতেছে ; তথাপি যেরূপ বালককে তিক্ত ঔষধ সেবন করাইতে হইলে প্রথমতঃ মিষ্ট দ্রব্য দিতে হয়, নতুব কখনই তাহার ভিক্ত ঔষধ সেবনে প্রবৃত্তি জন্মে না, যদিও ঐ বালকের পক্ষে মিষ্ট দ্রব্য অপকারক এবং ভিক্ত দ্রব্য উপকারক হইতেছে বটে, কিন্তু ঐ বালক বাল্য দোষে দূষিত হইয়। আপাততঃ রমণীয় মিষ্ট দ্রব্যকেই উপকারক, আর দুঃসেবা বলিয়া তিক্ত ঔষধকে অপকারক বিবেচনা করে, সেই রূপ সাক্ষাৎ প্রতীয়মান আপাততঃ সুখকর জগতের মিথ্যা প্রভূতি স্বীকারও নিশ্চয়রূপে হৃদয়ঙ্গম করা অজ্ঞানদোষে দূষিত ব্যক্তিদিগের পক্ষে কোন প্রকারেই সম্ভবে না, বরং জগতের সভ্যত্বেরই যৌক্তিকতা ও ঔচিত্য হৃদয়ে উদিত হয় ; অতএব অজ্ঞ ব্যক্তিদিগের নিগুণ, নিৰ্ব্বিকার ও নিরাকার পরব্রহ্ম হঠাৎ বুদ্ধিপ্রবিষ্ট হওয়া অত্যন্ত অসম্ভাবিত বিবেচনা করিয়া প্রথমতঃ জগতের সত্যত্বাদি স্বীকার করিয়াই সৃষ্টিক্রমাদি প্রদর্শিত হইয়াছে । কিঞ্চ যথা মরুমরীচিকায় জলভ্রম হইলে ষতক্ষণ ঐ ভ্রান্তিকপিত্ত জলের স্বরূপ ও কারণাদির অনুসন্ধান রূপ তত্ত্বানুসন্ধান না হয়, ততক্ষণ ঐ জলকে কোন মতেই মিথ্য বোধ হয় না, সত্ত্য বলিয়াই বোধ হয়, কিন্তু যখন তত্ত্বায়ুসন্ধানদ্বারা ঐ কম্পিতজলের স্বরূপ ও কারণাদি অবগত হওয়া যায়, তখন আর ঐ জলকে সত্য বলিয়া বোধ হয় না, তখন সত্যস্বরূপ মরুমরীচিকারই প্রকাশ হয়, সেইরূপ যত কাল পরব্রহ্মে পরিকম্পিত এই জগতের স্বরূপ ও কারণাদির অনুসন্ধান না হইতেছে, তত কাল পর্যন্ত জগৎ অসৎ হইয়াও সৎরূপে প্রতীত হইতেছে ; কিন্তু যখন ইহার স্বরূপ ও কারণাদির নিরূপণ দ্বারা অজ্ঞান নিবৃত্ত হইবে, তখন আর জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হইবে না, অসৎ বলিয়াই বোধ হইবে, এবং তৎকালে সত্য স্বরূপ পরব্রহ্মই কেবল প্রকাশমান হইবেন। অতএব জগৎ বাস্তবিক মিথ্যা হইলেও জগৎকে সত্য বলিয়া সৃষ্টিক্রমাদির প্রদর্শন করা কেবল জগতের মিথ্যাজু নিরূপণের নিমিত্ত হইতেছে, সুতরাং অদ্বৈতমত্ত প্রদর্শনপ্রস্তাবে সৃষ্টি ক্রমাদি প্রদর্শন অবশ্য কৰ্ত্তব্য ও প্রকৃতোপযোগী সন্দেহ নাই । উল্লিখিত রূপে অজ্ঞান নিবৃত্তি পৰ্য্যন্ত সংসার দশায় জগতের সত্যত্ব প্রতীতি হয় বলিয়া সংসারদশায় জগৎ সৎ আর তদন্তে জগৎ অসৎ ; অতএব জগভের সত্যত্ব ও অসভ্যত্ব উভয়ই বিরুদ্ধ হইতেছে না । পরমেশ্বর উল্লিখিতরূপে কত দিন জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন নির্ণয় করা যায় না এবং “ এই অবধি জগৎ সৃষ্টি করিলেন, ইহার পুৰ্ব্বে জগৎ ছিল না” এরূপ কল্পনা করিলেও নানা দোষ ঘটে বলিয়া সংসারের অনাদিত্ব স্বীকার করিতে হয় ।
এস্থলে কেহ কেহ এই আপত্তি করেন যে, “সংসার শব্দে দৃশ্যমান পদার্থকে বুঝায়, সুতরাং যখন সকল বস্তুকেই সাদি দেখিতেছি তখন আর সংসারের অনাদিত্ব কোথায় রহিল’ । কিন্তু এ আপত্তি কেবল অনাদি শদের তাৎপর্যার্থের অজ্ঞানবি ললিওমাত্র বলিতে হইবে ; যেহেতু অনাদি শব্দের এরূপ অর্থে তাৎপর্য নহে, কিন্তু “সংসার, প্ৰলয়, পুনঃ সংসার, পুনঃ প্রলয় ও পুনঃ সংসার” এইরূপ সংসার প্রবাহের অদি নাই এই অর্থেই তাৎপর্য্য । অতএব যখন দৃশ্যমান প্রবাহের আদি দৃষ্ট হইতেছে না, তখন কেবল দৃশ্যমান কয়েকটী বস্তুর সাদিত্ব দর্শন করিয়া সংসারের অনাদিত্ব খণ্ডিত হইতে পারে না । যেরূপ মায়াবী ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা দ্বারা ঐন্দ্র জালিক বস্তু সকল প্রকাশ করিয়া জনগণের দর্শনেীৎসুক্য নিবারণ করিয়া পুনৰ্ব্বার ঐ সকল বস্তুর সংহার করে, সেইরূপ পরমেশ্বর অচিন্তাশক্তিশালি মায়াসহকারে জগৎ সৃষ্টি করিয়া জনগণের সুকৃত ও দুষ্ক তের ফল প্রদানাস্তে পরিশেষে জগতের প্রলয় করেন ।
প্রলয় চারি প্রকার ; নিত্য, প্রাকৃত, নৈমিত্তিক ও আভ্যন্তিক। সুষুপ্তিকে অর্থাৎ যে অবস্থায় অত্যন্ত নিদ্রাভিভূত ব্যক্তির ঘট পট দিবিষয়ের জানাদি না হয় সেই অবস্থাবিশেষকে নিভ্য প্রলয় কহে । ঐ নিত্য প্রলয় হইলে ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্ম সংস্কার এবং লিঙ্গশরীর প্রভূতি কয়েকলি পদার্থমাত্র কারণরূপে অবস্থিত হয়, আর সকল বস্তুর প্রলয় হইয়া যায়, কিন্তু ঐ নিত্যপ্রলয়স্বরূপ সুষুপ্তির ভঙ্গ হইলেই পুনৰ্ব্বার পূৰ্ব্বমত সংসার জন্মে, এ জন্য ঐ প্রলয়ের আপাততঃ অনুভব হয় না । জীবগণের জাগ্রং, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি ভেদে যে তিনটী অবস্থা আছে, তন্মধ্যে নিত্য প্ৰলয়স্বরূপ সুষুপ্তিই সৰ্ব্বাপেক্ষায় উৎকৃষ্ট ; এই অবস্থায় জীবের পরব্রহ্ম ভাব উপস্থিত হইয়া কেবল পরমানন্দের অনুভব হয়, তৎকালে আর কিছুই অনুভূত হয় না। কার্য্যব্ৰহ্মার লয়নিবন্ধন সকল কার্য্যের বিলয়কে প্রাকৃত লয় কহে । উহার রীতি এইরূপ ; যিনি অতি কঠোর তপস্যাদির অসুষ্ঠান দ্বারা ‘ব্রহ্মাণ্ডাধিকারী” অর্থাৎ ব্রহ্মত্বপদ প্রাপ্ত হইয়াছেন, এবং এই রূপ প্রারব্ধ কৰ্ম্ম সঞ্চিত করিয়া, ঐ ব্ৰহ্মত্বপদ প্রাপ্তির পূৰ্ব্বেই হউক বা পরেই হউক, জ্ঞানকাণ্ডের আলোচনা দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানীও হইয়াছেন, তিনি প্রারব্ধ কৰ্ম্মের ফলভোগম্বরূপ ব্ৰহ্মাণ্ডাধিকার অনিচ্ছাপূৰ্ব্বকও অধিকৃত করিয়া, পরিশেষে ঐ রূপ ফলভোগ দ্বারা ঐ কৰ্ম্মের ক্ষয় হইলেই “বিদেহ কৈবল্য” নামক পরম মুক্তি প্রাপ্ত হয়েন, তৎকালে ঐ ব্রহ্মার অধিকৃত ব্রহ্মলোকে যত ব্ৰহ্মজ্ঞানী থাকেন, তাঁহারাও ঐ ব্রহ্মার সহিত মুক্ত হয়েন ; এইরূপ ব্ৰহ্মাকেই কার্যাব্রহ্মা এবং তঁহার ঐরূপ মুক্তিকেই কাৰ্য্যত্রহ্মবিলয় কহে । ঐরুপ কার্যত্রহ্মার লয় হইলে তাহার অধিকৃত ব্ৰহ্মাণ্ডেরও মায়াতে লয় হয় ; ঐ রূপ লয়কেই কার্ষ্যব্রহ্মার লয়নিবন্ধন সকল কার্য্যের লয় কহে। উক্ত রূপে মায়াত্মক প্রকৃতিতে ঐ লয় হয় বলিয়া উহাকে প্রাকুতলয়ও কহে । পূৰ্ব্বোক্ত কাৰ্য্যব্রহ্মার দিনাবসান নিমিত্তক ত্ৰৈলোক্যের লয়কে নৈমিত্তিক প্রলয় কহে । কার্য্যত্র হ্ম নিজ দিনাবসানে ব্রহ্মাগুকে আত্মসাৎ করিয়া শয়ন করেন এবং নিজরাত্রির অবসানে গাত্ৰোখান করিয়া পুনরায় জগৎ সৃষ্টি করেন । ব্রহ্মার দিবা ও রাত্রির পরিমাণও সামান্য নহে ; অন্নদাদির (৮) চতুযুগসহস্ৰপরিমিতকালে ব্রহ্মার এক দিন আর ঐ রূপ কালে এক রাত্রি হয় । ব্রহ্মার এতাদৃশ প্রকাণ্ড রাত্রির মধ্যে লোকত্রয়ের কিছুই থাকে না কেবল নৈমিত্তিক প্রলয় মাত্র থাকে, অতএব নৈমিত্তিক প্রলয়ের পরিমাণ ও চতুযুগসহস্ৰ । ব্রহ্মজ্ঞাননিমিভক পরম মুক্তি প্রাপ্তিকে অত্যপ্তিক প্রলয় কহে । ব্রহ্মজ্ঞান দ্বার সংসারের মূল কারণ মুলা জ্ঞান নিবৃত্ত হইলে আর সংসারস্থিতির বা পুনরুৎপত্তির সম্ভাবনা কি ? ঐ প্রলয় হইলে আর সংসার জন্মে না বলিয়া ইহার “অত্যন্তিক প্রলয়” এই নামটী যৌগিক হইতেছে । প্রলয়ের ক্রম এইরূপ ; প্রথমতঃ পৃথিবীর লয় জলে হয়, জলের লয় তেজে, তেজের লয় বায়ুতে, বায়ুর লয় আকাশে, আকাশের লয় জীবের অহঙ্কারে, তাহার লয় হিরণ্যগর্ভের অহঙ্কারে এবং তাহার লয় অজ্ঞানে হয় ; এই রূপ “কার্য্যলয়ক্রমেই কারণের লয়’ এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া অন্যান্য বস্তুরও লয় ক্রম কল্পনা করিতে হইবে । এই রূপ লয়ক্রমই বিষ্ণুপুরাণাদিতে উক্ত হইয়াছে বলিয়া ইহাই প্রমাণিক, এতদ্ভিন্ন অন্যমতসিদ্ধ লয়ক্রমে কোন প্রমাণ বা যুক্তি নাই ।
প্রমাণ প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, আগম, অর্থপত্তি এবং অনুপলব্ধি ভেদে ষড়বিধ । প্রত্যক্ষ নামক জ্ঞানের করণস্বরূপ শ্রোত্রাদি পঞ্চেন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষ প্রমাণ কহে । জ্ঞান ৰুক্তি ও ফলভেদে দ্বিবিধ। যথা জলাশয়স্থিত জল ছিদ্র হইতে নির্গত হইয়া পুণালিকা দ্বারা কেদারখণ্ডে (৯), প্রবেশ করিয়া কেদারাকারে অর্থাৎ কেদারের যে রূপ চতুষ্কোণাদি আকার থাকে সেইরূপ আকারে পরিণত হয়, তথা প্রত্যক্ষ স্থলে বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয় সংযোগ হইলে অন্তঃকরণ ঐ ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ে নিপত্তিত হইয়া বিষয়ের যে রূপ আকার থাকে সেই রূপ আকারে পরিণত হয়, ঐ পরিণামকেই বৃত্ত্বিরূপজ্ঞান কহে ৰুক্তিরূপজ্ঞান দ্বারা বিষয়ের অজ্ঞান নষ্ট হয়, আর ফলরূপজান দ্বারা বিষয়ের স্ফূৰ্ত্তি অর্থাৎ প্রকাশ হয়। ফলরুপজ্ঞান পরব্রহ্ম স্বরূপ চৈতন্য, সুতরাং ফলরূপ জ্ঞান নিত্য । যদি অজ্ঞান দ্বারা ঘটাদি বিষয় আবৃত না থাকিত তাহা হইলে সৰ্ব্বদাই ঘন্টাদি বিষয় অনুভূয়মান হইত, কাহারই কখন কোন বিষয় অজ্ঞাত থাকিত না, কাণ ব্যক্তিরও সকল বস্তু প্রত্যক্ষ হইত, জ্ঞানের নিমিত্ত আর ইন্দ্রিয়গণের অবশ্যকতা থাকিভ না। ইন্দ্রিয়গণ দ্বার। কেবল বিষয়ের আবরণ স্বরূপ অজ্ঞানের নিরাস হয় বলিয়া জ্ঞানেন্দ্রিয়াদিরূপ কারণের, আবশ্যকতা আছে ; যেহেতু ঐ আবরণ নষ্ট না হইলে বিষয়ের মূৰ্ত্তি হয় ন। অতএব ফলরূপ জ্ঞান নিত্য হইলেও উক্ত আবরণের প্রতিবন্ধকতাবশতঃ সৰ্ব্বদা সকলের সর্ব্ব বিষয়ের প্রকাশ হয় ন। । যখন যাহার উল্লিখিত বৃত্ত্বিরূপ জ্ঞান দ্বারা যে বিষয়ের অজ্ঞান নষ্ট হয়, তৎকালেই তাহার সম্বন্ধে সেই বিষয়ের স্ফূৰ্ত্তি হয়, আর যখন এরূপ না হয় তখন ঐ রূপ প্রকাশও হয় না । অতএব ইহা সিদ্ধ হইল, ফলরূপ জ্ঞান নিত্য হইয়াও অজ্ঞানের পুতিবন্ধকতাবশতঃ জন্যের ন্যায় কারণনিয়ম ও অসাৰ্ব্বত্রিক হইতেছে। প্রত্যক্ষ প্রমাণের অন্যান্য বিশেষ ধৰ্ম্ম, অনুমান, উপনান ও আগমাদির অর্থাৎ শব্দাদি প্রমাণের বিষয় ও স্বরূপাদি ন্যায়দর্শন পুস্তাবে লিখিত হইয়ছে; ন্যায়মতবিরুদ্ধ যে যে বিশেষ আছে তাহা সংস্কৃত ভাষাতেই চমৎকুত এবং স্বল্পষ্টরূপে প্রভীত হয়, প্রচলিত বঙ্গভাষায় অমুবাদিত হইলে তাদৃশ রমণীয় বা সুস্পষ্ট হওয়া কঠিন, এ বিবেচনায় তাহ উদ্ধ ত হইল না ।
অর্থাপত্তি (কম্পন) রূপ প্রমিতির করণকে অর্থপত্তি প্রমাণ কহে । যাহা ব্যতিরেকে যাহা অসম্ভাবিত হয়, তাহার উপপাদ্য সে হয় । আর যাহাঁর অসন্তুবে যাহার অসস্তব হয়, সে তাহার উপপাদক হয় ; যথা দিবাতে অভোজী ব্যক্তির শরীর স্থূলতা উপপাদ্য, আর রাত্রিভোজন উপপাদক ; যেহেতু দিবাতে অভোজী ব্যক্তির শরীরস্থূলত উহার রাত্রিভোজন ব্যতীত কোন মতেই সম্ভবে না । অতএব যখন দিবাতে অভোজী ব্যক্তির শরীরস্থূলতা দৃষ্ট বা শ্রুত হইবেক, তখন ঐ ব্যক্তির রাত্রিভোজন সাক্ষাৎ দৃষ্ট ন হইলেও অর্থাপত্তি প্রমাণ দ্বারা কম্পিত হইবে । দৃষ্টাৰ্থপত্তি ও শ্রুভার্থপত্তি ভেদে অর্থপত্তি প্রমাণ দ্বিবিধ। দৃষ্ট ও শ্রুত বস্তুতে উপপাদ্যের অনুপপত্তি দ্বারা উপপাদকের কল্পনাকে যথাক্রমে দৃষ্টাৰ্থপত্তি ও শ্রুতার্থপত্তি কহে । যেমন দৃশ্যমান ঐন্দ্রজালিক বস্তুর নিষিধ্যমানত্ত্ব রূপ উপপাদ্য জ্ঞান দ্বারা তদুপপাদক মিথ্যাস্তুের কম্পনাকে দৃষ্টাৰ্থপত্তি, আর “জীবিত দেবদত্ত গৃহে নাই” এই শব্দ শ্রবণানন্তর জীবিত ব্যক্তির বহিঃসত্ত্বব্যতিরেকে কোন মতেই গৃহে অসন্তু সম্ভবে না— এই রূপ অমুপপত্তি জ্ঞান দ্বারা উহার বহিঃসত্ত্ব কপিনাকে শ্রীতার্থাপত্তি কহে । শ্রুতার্থপত্ত্বিও অভিধানাল্পপত্তি ও অভিহিতামুপপত্তি ভেদে দ্বিবিধ । বাক্যের একদেশ মাত্র শ্রবণ করিয়া দেশান্তরের কম্পনাকে অভিধানাচুপপত্তি কহে। যথা “দ্বারমৃ” অর্থাৎ দ্বারকে, এই মাত্র শ্রবণ করিয়া “পিধেহি” অর্থাৎ পিধান (আবরণ) কর, এই পদের কল্পনা । শ্রুত অর্থের সম্ভবপরত্ব প্রতিপাদনার্থে অর্থান্তরের কম্পনাকে অভিহিতানুপপত্তি কহে । যথা “অদ্য পঙ্গু ব্যক্তি অতি দূরদেশ হইতে আগত হইল, ইহা শ্ৰুত হইলে, পঙ্গুর গতি শক্তি না থাকা প্রযুক্ত তাহার দূর হইতে আগমন অসম্ভব, এই রূপ অল্পপত্তি জ্ঞান দ্বারা তদুপপাদক শকটাদি রূপ দ্বার কম্পন ।
প্রতিযোগীর যোগ্যামুপলম্ভকে অনুপলব্ধি প্রমাণ কহে । কোন বস্তুর অভাব হয় তাহার প্রভিযোগী সেই বস্তুই হয়, যেমন ঘটাভাবের প্রতিযোগী ঘট, এবং পটাভাবের পুতিযোগী পট। যে যে কারণ সত্ত্বে প্রতিযোগীর প্রত্যক্ষ হয়, সেই সেই কারণের সদ্ভাব থাকিলেও কেবল প্রতিযোগীর অসত্ত্ব নিবন্ধন যে পুভিযোগীর অপ্রত্যক্ষ ভাহাকে যোগ্যামুপলম্ভ কহে । এই যোগ্যামুপলব্ধি কোন স্থলে সম্ভবে ও কোন স্থলেই বা উহার দ্বার অভাবের প্রতীতি হয়, ইহার নিশ্চয় করিম্ভে হইলে এই মাত্র স্থির করিতে হইবে “যদি অমুক বস্তু এই স্থানে থাকিত, তাহা হইলে অবশ্যই,তাহার পুভক্ষ হইভ” । এই রূপ প্রতিযোগীর প্রত্যক্ষের আপত্তি যে স্থানে উত্থাপিত হইতে পারে সেই স্থানেই উল্লিখিত প্রমাণ দ্বারা অভাবের অনুভব হয়, আর যে স্থলে ঐ রূপ আপত্তি না হয় সে স্থানে অভাবের অনুভব হয় না ; যথা উজ্জ্বলালোকান্বিত আলয়ে চক্ষুষ্মান ব্যক্তির “যদি এই গৃহে ঘট থাকিত, তাহা হইলে অবশ্যই এস্থলে ঘটের প্রত্যক্ষ হইত” এই রূপ আপত্তি উত্থাপিত হয় বলিয়া ঐ স্থলে ঐ ব্যক্তির ঘটাভাবের প্রত্যক্ষ হয়। আর অন্ধ ব্যক্তির বা অন্ধকার গৃহে চক্ষুষ্মান ব্যক্তির ঐ রূপ আপত্তি উথাপিত হইতে পারে না বলিয়া উক্ত স্থলে উক্ত প্রমাণ দ্বারা অভাবেরও প্রতীতি হয় না । এই অনুপলব্ধি প্রমাণ দ্বারা কেবল অভাবেরই অনুভব হয়, এবং ইহা অভাবস্বরূপ, এ কারণ এই প্রমাণকে কোন কোন পণ্ডিত অভাব প্রমাণ কহেন । অভাব চতুবিধ ; প্রাগভাব, ধ্বংস, অত্যন্তাভাব ও ভেদ । ন্যায়মতে প্রাগভাবাদির লক্ষণ ষেরূপ, এমতেও প্রায় সেইরূপ ; বিশেষ এই, ন্যায় মতে ধ্বংসের ধ্বংস স্বীকার নাই, এ মতে তাহা স্বীকৃত হইয়াছে, এবং ন্যায়মতে ভেদ এক রূপ, এ মতে ভেদ দ্বিবিধ ; সোপাধিক ও নিরুপাধিক (১০) । যথা আকাশ এক হইলেও ঘট ও মঠরূপ উপাধি দ্বয়ের ভেদ লইয়া ঘটাকাশ হইতে মঠাকাশ ভিন্ন’ এ রূপ ষে ভেদ ব্যবহার হয় তাহাকে ঔপধিক ভেদ আর ঘট ও মঠের পরস্পর ভেদকে নিরুপাধিক ভেদ কহে ।
উল্লিথিভ ষড় বিধ প্রমাণ দ্বারাই যাবতীয় পদার্থের সিদ্ধি হইবেক ; ঐ ষড়বিধ প্রমাণাভিরিক্ত অণর প্রমাণ নাই। পেীরাণিকেরা সম্ভব ও ঐতিহ্য নামক ষে অতিরিক্ত প্রমাণ দ্বয় স্বীকার করেন তাহাতে কোন প্রমাণ বা প্রয়োজন দৃষ্ট হয় ন। বলিয় তাহ প্রমাণরূপেই গণ্য হইতে পারে না । “যাহার লক্ষ মুদ্রা আছে তাহার শত বা সহস্র মুদ্রা থাকা সম্ভব” এই রূপ সম্ভাবনাকে সম্ভব প্রমাণ কহে, আর ‘’এই বটবৃক্ষে যক্ষ আছে” এই রূপ প্রবাদ পরম্পরাকে ঐতিহ্য প্রমাণ কহে, এই ঐতিহ্য প্রমাণ দ্বারা ঐ বটবৃক্ষে যক্ষ আছে সিদ্ধ হইবেক । এইরূপ পৌরাণিক পণ্ডিতেরা বলিয়া থাকেন; কিন্তু বিশিষ্ট বিবেচনা করিলে বোধ হইবে সম্ভবপ্রমাণ অনুমানের অন্তর্গত, অনুমান হইতে বিভিন্ন নহে, এবং ঐতিস্থ প্রমাণের মধ্যে প্রায় অনেক ঐতিস্থ প্রমাণের প্রামাণ্যই নাই, আর যাহার আছে সে শব্দ প্রমণের অন্তর্গত । অতএব ইহা সিদ্ধ হইল যে, প্রত্যক্ষাদি ষড়বিধ প্রমাণাতিরিক্ত আর প্রমাণাস্তুর নাই । এই ষড়বিধ প্রমাণ দ্বারা বুদ্ধিমান জনগণ ঐহিক ও পারত্রিক সুখ সম্ভোগাদির অস্থিরত্বাদি দোষ দর্শন করিয়া পরম মুখস্বরূপ পরাৎপর পরব্রহ্ম প্রাপ্তির নিমিত্ত ভৎসাধনীভূত-তত্ত্বজ্ঞানেচ্ছ, হইয়া উহার উপায় স্বরূপ শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ও সমাধির অনুষ্ঠানে প্রত্নত্ব হয়েন ।
ষড় বিধ লিঙ্গদ্বারা সকল বেদান্তেই পরব্রহ্মে তাৎপর্যাবধারণকে শ্রবণ কহে । ঐ ষড়বিধ লিঙ্গের প্রথম লিঙ্গ উপক্রম ও উপসংহার, দ্বিতীয় অভ্যাস, তৃতীয় অপূৰ্ব্বভা, চতুর্থ ফল, পঞ্চম অর্থবাদ, ও ষষ্ঠ উপপত্তি । যে প্রকরণে যে বিষয় প্রতিপাদিত হইবে সে পুকরণে আদিতে ও অন্তে সে বিষয়ের উৎকীৰ্ত্তনকে যথাক্রমে উপক্রম ও উপসংহার কহে ; যথা ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ প্রপাঠকের আদিতে “একমেবাদ্বিতীয়ম্” ইহা দ্বারা, এবং অন্তে “ঐতদাত্মামিদং সৰ্ব্বম্” (অর্থাৎ ব্রহ্মাত্মকই সকল) ইহা দ্বারা ঐ প্রকরণ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্মেরই উৎকীৰ্ত্তন আছে। প্রকরণ প্রতিপাদ্য অর্থের পুনঃপুনঃ কীৰ্ত্তনকে অভ্যাস কহে । যথা ঐ প্রপাঠকেই “তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ সেই পরমাত্মাই তুমি । ইহা নয় বার কীৰ্ত্তিত হইয়াছে । প্রকরণ প্রতিপাদ্য অর্থের প্রমাণান্তর দ্বারা অপ্রাপ্তিকে অপূৰ্ব্বত কহে। যথা ঐ পুপাঠকেই ঐ প্রকরণ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্মের বেদান্তাতিরিক্ত পুমাণ দ্বারা অসম্প্রাপ্তি। প্রকরণ প্রতিপাদ্য অর্থের অনুষ্ঠানের ফলশ্রুতিকে ফল কহে । যথ “আচাৰ্য্যবান বেদ” ইভ্যাদি “অন্থ সম্পৎস্যে” ইত্যন্ত গ্রন্থসন্দত দ্বারা ঐ প্রপাঠকে প্রকরণ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্মের জ্ঞানাচুষ্ঠানের ব্রহ্মপ্রাপ্তিরূপ ফলশ্রুতি । তৎপ্রকরণ প্রতিপাদ্য অর্থের তৎপ্রকরণে প্রশংসাকে অর্থবাদ কহে । যাথ ওই প্রপাঠকেই “উত ভমাদেশমপ্রাক্ষীঃ” ইত্যাদি “অবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্” ইত্যন্ত গ্রন্থ দ্বারা, যাহা শ্রুত হইলে আর কিছুই অশ্রুত থাকে না, এবং যাহা বিজ্ঞাত হইলে অবিজ্ঞাত বস্তুও বিজ্ঞাত হয়, সেই পরব্রহ্মের প্রশ্ন করিয়াছ, ইত্যাদি প্রকরণপ্রতিপাদ্য পরব্রহ্মের প্রশংসা। তৎপ্রকরণ প্রতিপাদ্য অর্থের সম্ভাব্যত প্রতিপাদনার্থ যুক্তির উপন্যাসকে উপপত্তি কহে ; যথা ঐ প্রপাঠকেই ‘যথা সোম্যৈকেন” ইত্যাদি “যুক্তিকেতে্যুব সত্যমৃ” ইত্যন্ত গ্রন্থ দ্বারা “যেরূপ এক মৃৎপিণ্ড জানিলেই তা হার বিকার স্বরূপ ঘট সরাবাদি জানা হয়, ঘট সরাবাদি বাক্যদ্বারা কম্পিত নামমাত্র, মৃত্তিকাই সভ্য” ইত্যাদি সদৃষ্টান্ত যুক্তি প্রদর্শিত হইয়াছে । উল্লিখিত ক্রমে শ্রুত অদ্বিতীয় পরব্রহ্মের বেদান্তামুগুণ যুক্তি দ্বারা অনবরত চিন্তনকে মনন কহে । দেহাদি বিবিধ বিষয়ক বুদ্ধিপরম্পরা পরিত্যাগ পুরঃসর একমাত্র অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিষয়ক বুদ্ধিধারাকে নিদিধ্যাসন কহে ।
সবিকল্পক ও নিৰ্ব্বিকল্পক ভেদে সমাধি দ্বিবিধ । জ্ঞান, জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতা ইত্যাদি বিকল্পের (অর্থাৎ বিভাগের) বিলয়নিরপেক্ষ আর তৎসাপেক্ষ পরব্রহ্ম বস্তুতে নিবিষ্ট চিত্তের স্থিরতাকে যথাক্রমে সবিকল্পক ও নিৰ্ব্বিকপক সমাধি কহে । নিৰ্ব্বিকাপক সমাধি অবস্থায় চিত্তবৃত্তি নিৰ্ব্বায়ু দেশস্থিত প্রদীপশিখর ন্যায় নিশ্চল হয় । উক্ত নিৰ্ব্বিকপক সমাধির অঙ্গ যম নিয়মাদি অষ্টাঙ্গ যোগ পাতঞ্জলদর্শনে সবিশেষ বৰ্ণিত হইয়াছে ।
এই নিৰ্ব্বিকাপক সমাধি সিদ্ধ হইলে তত্ত্বজ্ঞানী হইয়া ক্রমশঃ জীবন্মুক্ত ও পরমমুক্ত হওয়া যায় । জীবন্মুক্ত তাঁহাকেই বলা যায় যাহার অদ্বয় ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা মূলাজানের নিরসনানস্তর স্ব স্বরূপ পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হওয়াতেই অজ্ঞান ও তৎকার্য্য দ্বারা সঞ্চিভ সকল কৰ্ম্ম, সংশয় এবং বিপৰ্য্যয়াদি নিরস্ত হওয়ায় সকল বন্ধ দূরীকৃত হইয়াছে, এবং যাহার “মাংস, শোণিত, মৃত্র ও পুরীষ পূরিত শরীর, আন্ধা, মাদ্য এবং অপটুত্বাদি দোষে দৃষিভ ইন্দ্রিয় সকল, এবং ফুৎপিপাসা-শোক-মোহাদি-ভাজন অন্তঃকরণ দ্বারা পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব বাসনাজনিত কৰ্ম্মফল ভোগ করিতেছেন” ইহা দৃষ্টি গোচর হইলেও পরমার্থ রূপে দৃষ্টিগোচর হয় না, যেরূপ “ইহা ইন্দ্রজালমাত্র” এবশ্বকার যাহার নিশ্চয় আছে সে ঐ ইন্দ্র জাল দর্শন করিয়াও তাহার পরমার্থত্ব দর্শন করে না । যদিও উক্ত জীবন্মুক্ত ব্যক্তির বৈধ বা নিষিদ্ধ কৰ্ম্মামৃষ্ঠান দ্বারা শুভদৃষ্ট বা অশুভাদৃষ্ট কিছুই জন্মে ন সত্য, ভথাপি জ্ঞানী ব্যক্তির নিষিদ্ধ বিষয়ে বিতৃষ্ণ হওয়া উচিত, কারণ যদি জ্ঞানী হইয়াও নিষিদ্ধ বিষয়ের অনুষ্ঠান করেন তাহ হইলে কুকুরের সহিত জ্ঞানীর আর ভেদ কি রহিল : জীবন্মুক্ত ব্যক্তির অলঙ্কারের ন্যায় অণিমা প্রভৃতি তত্ত্বজ্ঞানসাধন সিদ্ধি এবং দ্বেষপূন্যতা প্রভৃতি সদগুণ স্বয়ংই উপস্থিত হয়। জীবন্মুক্ত ব্যক্তির (১১) ভোগ দ্বারা প্রারব্ধকৰ্ম্ম ক্ষয় হইলে বৰ্ত্তমান শরীর পতনান্তে পরব্রহ্মপ্রাপ্তি স্বরূপ (অর্থাৎ ব্রহ্মৈকভাব স্বরূপ) পরম মুক্তি লাভ হয় ।
এস্থলে দ্বৈতমতাবলম্বীরা মহাবাগাড়ম্বর সহকারে এই এক আপত্তি করেন “যদি ব্রহ্মের সহিত জীবের বাস্তবিক ভেদ না থাকে জীবই পরব্রহ্ম স্বরূপ হয়, তবে জীবের অনর্থনিৰ্বত্তি এবং ব্রহ্মভাব প্রাপ্তি রূপ পরম মুক্তি স্বতঃসিদ্ধই আছে, তন্নিমিত্ত তত্ত্বজ্ঞানের আবশ্যক তা থাকে না, সিদ্ধ বস্তুর সাধনে কে যত্নবান হইয়া থাকে?” কিন্তু এই আপত্তি কেবল জিগীষা ও স্থূলদর্শিতা প্রভৃতি দোষের কার্য্য বলিতে হইবে, যেহেতু সিদ্ধ বস্তুরও অসিদ্ধত্ব ভ্রম হয় এবং ঐ ভ্রম নিরাকরণার্থ উপায়ান্তর অবলম্বন করিতে হয় ; ইহার অবিকল দৃষ্টান্ত, দশ জন মৃঢ় ব্যক্তি, নদী পার হইয়া সকলেই আপনাকে পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক গণনা করিয়া দেখে যে নয় জন বই হয় না ; তখন তাহারা “আমরা দশ জন আসিয়াছি নয় জন বই হয় না কেন, তবে বোধ করি এক জন কুম্ভীরহত হইয়াছে” এইরূপ বিবেচনা করিয়া তাহার অন্বেষণ করিক্তে করিতে ক্ৰন্দন করে ; কিন্তু যখন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কর্তৃক “দশমস্ত্বমসি’ (দশম তুমি) এইরূপ উপদিষ্ট হয়, তখন আপনাকে লইয়া গণনা করাতে ‘দেশ জনই আছি” এইরূপ নিশ্চয় করিয়া অলব্ধ বস্তুর লাভে পরম আনন্দিত হয়, আর এই রূপ প্রায়ই ঘটিয়া থাকে অন্যমনস্কতা অবস্থায় নিজস্কন্ধে গাত্রমাৰ্জ্জুনী রাখিয়া অন্যত্র অন্বেষণ করিতে হয়। অতএব জীব ব্রহ্মস্বরূপ হইলেও অজ্ঞান নিৰুক্তির জন্য উপায়াবলম্বন করায় হানি কি ? বরং উক্ত যুক্তিক্রমে অবশ্য কৰ্ত্তব্যই হইতেছে ; অতএব শ্রুতি স্মৃতি বিরুদ্ধ স্থূল যুক্তিরূপ অস্তু দ্বারা কখনই হীরক ভুল্য অদ্বৈত মত খণ্ডিত হইতে পারে না।
—————-
(১) এতদ্ভিন্ন আরও অনেক প্রস্থান আছে, কিন্তু তাহা এই ক্ষণে প্রচলিত নাই এ কারণ তাহfর উল্লেখ করা হইল না ।
(২) অন্তঃকরণের বৃত্তি যেরূপ হয় এবং তদ্দ্বারা যেরূপে অজ্ঞানের নিবৃত্তি হইয়া বিষয় প্রকাশ হয় তাহ পরে লিখিত হইবে ।
(৩) জীবের নানাত্ববাদ, সকল বৈদাস্তিকের মত-সিদ্ধ নন্তে, কোন কোন বৈদাম্ভিক জীবের একত্ব ৰাদ, যুক্তি দ্বারা সংস্থাপিত করিয়াছেন, কিন্তু প্রায় অনেকেই জীবের নামাক্স বাদে নির্ভর করিয়াছেন, অতএব আমরা সেই মতানুসারে জীবের মানত্ব লিখিলাম ।
(৪) ৰেদাত্তপরিভাষাকার মতে অন্তঃকরণ চতুৰ্ব্বিধ ; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার অfর চিত্ত, যে অবস্থfয় অন্তঃকরণ মন ও বুদ্ধি পদ বাচ্য হয় তাহ মূল গ্রন্থেই উল্লিখিত হইয়াছে, অন্তঃকরণের অভিমানাজুক বৃত্তি হইলে অন্তঃকরণকে অহঙ্কার তার অন্তঃকরণের অনুসন্ধানাত্মক বৃত্তি হইলে অন্তঃকরণকে চিত্ত কহে । ঐ চতুবিধ অন্তঃকরণের যথাক্রমে চতুমুখ চন্দ্র, শঙ্কর, ও অচ্যুত ইঁহারা অধিষ্ঠাতৃ দেবতা হয়েন । কিন্তু বেদান্ত সার ও পঞ্চদশীকারের মতে অন্তঃকরণ, মন আর বুদ্ধি ভেদে দ্বিবিধ অন্তস্কার আর চিত্ত, মন আর বুদ্ধিরই অবস্থাস্তর হইতেছে, বুদ্ধি ও মন হইতে পৃথগ ভূত নহে, ফলতঃ বিশিষ্ট বিবেচনা করিয়া দেখিলে বোধ হয় উভয় মতেই ফলের ঐক্য আছে অতএব এক মত আশ্রয় করিয়| অন্তঃকরণ দ্বিবিধ বলিয়া লিখিত হইল ।
(৫) মতাত্তরে নাগ কূৰ্ম্ম কৃকর দেবদত্ত এবং ধনঞ্জয় নামে আরও অন্য পাঁচটা বায়ু আছে, নাগ বায়ু উদিগরণকর, কূৰ্ম্ম নায় নির্মীলন কর, কুকর বায় ক্ষুধাকর, দেবদত্ত বায়ু, জম্ভনকর, এবং ধনঞ্জয় বায়ু, পোষণকর, কিন্তু বেদাস্তসারকার প্রভৃতির মতে এই পাঁচটা বায়ু, প্রাণাদি পঞ্চবায়ুরই অন্তর্গত, পৃথগ ভূত নহে, অতএব এস্থানে বায়ু পঞ্চকেরই উল্লেখ করা হইল।
(৬) পঞ্চীকৃত পৃথিবীতে পৃথিবীর আট আনা, আর চারি ভূতের দুই দুই আনি করিয়া আট আনা আছে, পঞ্চীকৃত জলাদিতেও এইরূপ জানিৰে । ত্রিবৃৎ কৃত পৃথিবীতে পৃথিবীর আট আনা আর জলের চারি আনা ও তেজের চারি আনা আছে, ত্রিবৃৎকৃত জলে জলের আট আনা, পৃথিবীর চারি অfনা, তেজের চারি আনা আছে, ত্রিবৃৎকৃত তেজেতেও এইরূপ জানিৰে ।
(৭) জরায়ুশব্দে গর্ভবেষ্টন চর্মস্থালীকে বুঝায়, গৌড়দেশে যাহাকে ফল কহে ।
(৮) সত্য ত্রেত দ্বাপর ও কলি এই চারি যুগ ।
(৯) কেদার শব্দে ক্ষেত্রকে বুঝায় ।
(১০) উপাধির ভেদ লইয়। কপিত যে ভেদ তাঁহাকে সোপাধিক এবং বাস্তবিক যে ভেদের কালত্রয়ে বাধ হয় না তাহাকে নিরুপধিক ভেদ কহে ।
(১১) যে কর্ম দ্বারা শরীর হয় তাহাকে প্রারব্ধ কর্ম কহে, ভোগ না হইলে কোন ক্রমেই প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয় না, একারণ জীবন্মুক্ত ব্যক্তিকেও প্রারব্ধ কর্ম ভোগ করিবার নিমিত্ত শরীর ধারণ করিতে হয় ।