১৬. লোপামুদ্রা

১৬. লোপামুদ্রা

বেশ পুরনো কালে, আমি যখন খুবই ছোট, তখন গাঁয়ে-গঞ্জে, এমনকী শহরেও বহুতর গোঁড়া বামুনবাড়ি ছিল। তাঁদের অনেকের ঘরেই আমি অনেক প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা, সধবা এবং বিধবা বামুন-গিন্নিদের দেখেছি, যাঁরা ওই বয়সেও অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন। বাড়িতে পুরুষদের মধ্যে খানিক বিদ্যাচর্চা থাকায় কেউ কেউ একটু চালিয়ে নেবার মতো শিক্ষিতাও ছিলেন। খুব ছোট বয়সে সেটা না বুঝলেও একটু বড় হতে সেটা বুঝেছি। আর যখন বুঝতে আরম্ভ করেছি, তখন তাদের অনেকেই পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক যন্ত্রণায়। দেশ-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক কারণে আমি কিছু পরিবর্তন লক্ষ করতাম উপরি-উক্ত সুন্দরী প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা এবং বিধবা-সধবাদের। গাঁয়ে থাকার সময় এঁদের দেখেছি তাদের শরীর এবং মনের চারদিকে ঘনিয়ে থাকত ব্রাহ্মণ্য দারিদ্র্যের অহংকার। অতিসস্তা শাড়ির সঙ্গে নিরলংকার শরীর, স্বামীর পুজো-আচ্চার জোগাড় দিচ্ছেন, অথবা বিধবা পিসি হলে সেটা ছিল তার আপন প্রয়োজন। উপভোগের প্রশ্ন উঠলে বলতেন– বামুন-ঘরের বউ, আমাদের কি আর সেজেগুজে লোকদেখানি চলে? আমাদের ওসব চলে না।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছেলে শহরে চাকরি পেয়েছে, গাঁ থেকে চলে এসেছেন উপরি উক্তারা। এবারে তাদের সাবান মাখতে দেখেছি, স্নো-পাউডার মাখতে দেখেছি, সাজতে দেখেছি, এমনকী ছেলের রোজগার থেকে হার-বাউটি বানাতেও দেখেছি। জিজ্ঞেস করলে ডগমগ হয়ে বলতেন– স্বামীর উপার্জনী ক্ষমতায় তো পারিনি। ছেলের কালে করে গেলাম। যদি এমন প্রশ্ন হত যে, ইচ্ছেটা তো তা হলে মনের মধ্যে ছিল? বলতেন– একটু সাজতে গুজতে, একটু গয়না পরতে কোন মেয়ের না ভাল লাগে, বাছা! কিন্তু ওঁর যা চাপ ছিল, শুধু টাকার ক্ষমতা নয়, উনি পছন্দই করতেন না। বলতেন– বামুন-ঘরের বউ, তাদের আবার অত সাজগোজ কী, লজ্জা হওয়া উচিত। আমার গাঁয়ের পিসি-মাসি-মামিরা তাই তেমনিই রয়ে গিয়েছিলেন। সকালে উঠোনে গোবর-ছড়া দিয়ে জীবন আরম্ভ হত, অবশেষে ছেঁড়া কাথায় ঘুমন্ত স্বামীর পাশে এসে শুয়ে পড়া। এই তো ব্রাহ্মণীর জীবন।

এটা অবশ্যই সত্যি যে, সত্তর-আশি বছর আগে এই জীবন এমনিই তৈরি হয়নি। এর একটা পরম্পরা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরম্পরা হল– পুরুষরা কিন্তু দশ ঘর বেছে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকেই ঘরে এনে তুলতেন, কিন্তু তারপর ব্রাহ্মণ্য এবং দারিদ্র্যের দার্শনিক প্রচার এমনভাবেই চলত, যাতে নীতিগত দৃষ্টিতে পুরুষরাও অনেক দারিদ্র্যের সহিষ্ণু জীবন কাটিয়েছেন, সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও। পণ্ডিত গবেষকদের একাংশ ব্রাহ্মণদের শোষণ-শাসন এবং তাদের বড়লোকি নিয়ে অনেক বড় বড় প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু সেটা সমাজের সামগ্রিক চিত্র নয়। উলটো দিকের চিত্রটা গবেষণার বিস্তারে দেখানোর জায়গা নেই এখানে। কিন্তু নৈতিক দৃষ্টিতে উপভোগের জীবন কাটানো ব্রাহ্মণের উপজীব্য ছিল না, ব্রাহ্মণীদের তো কথাই নেই। মহাভারত এক জায়গায় বলেছে– ব্রাহ্মণস্য দেহোহয়ং ন কামার্থায় জায়তে– অর্থাৎ ব্রাহ্মণের শরীর কখনওই জৈবিক কামনা উপভোগের জন্য নয়– সেটা পরিশ্রম করার জন্য, তপস্যার জন্য, তাতেই পরলোকের সুখ।

এই দার্শনিক ভিত্তি থাকার ফলে সমাজের বৃহত্তর অংশে, বিশেষত যাঁরা রাজা বা ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, সেইসব ব্রাহ্মণদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না, কিন্তু সেই আর্থিক অসচ্ছল্যই তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য এবং দারিদ্র্যের আড়ম্বর তৈরি করত, যা বেশির ভাগ সময়েই বরণ করে নিতেন বামুন ঘরের বউরা এবং পরম্পরাগত অশিক্ষিত-পটুত্বে তাদের বাণী ছিল– বামুনঘরের বউদের কী আর অমন সেজেগুজে ঢঙ করলে চলে? অন্যেরা কী শিখবে! ভাবতেই পারি, ব্রাহ্মণ্যের এই মহিমা আত্মস্থ করে আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা বড়ই মহতী অনুভব করতেন নিজেদের। কিন্তু কালান্তরের যে রমণীয় বাসনালোক, অনাদ্যনন্ত সংসারের অনন্ত পরম্পরাবাহী রমণী-হৃদয়ে আকাঙ্ক্ষার যে সংকেত নেমে আসে জন্মান্তর থেকে, সেখানে অভীষ্ট পুরুষের সঙ্গে মিলন যখন ঘটতেই চায়, তখন তার জন্য সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় সম্ভার এবং শৃঙ্গার-উপকরণের, অন্তত একটি রমণীর ক্ষেত্রে তা চির-আকাঙিক্ষত বস্তু।

আমার কাছে যদি উদাহরণ চান তা হলে মহাভারত-পুরাণ থেকে আমি এখনই অন্তত পঞ্চাশটা উদাহরণ দিতে পারি, যেখানে শুষ্ক-রুক্ষ ঋষি-মুনি রাজবাড়িতে রাজার মেয়ে বিয়ে করতে গিয়েছেন। অপিচ মহাভারতে এটা যেন একটা প্যাটার্ন হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, এইসব সময়ে, রাজকন্যার পিতা-মাতাদের ভীষণ মন খারাপ হবে, কিন্তু তাদের অতি অনিচ্ছায় আবার অভিশাপেরও ভয় থাকবে এবং পরিশেষে সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে রাজকন্যা নিজেই বরণ করে নেবেন ব্রাহ্মণ ঋষিকে। আর সুখৈশ্বর্য সব জলাঞ্জলি দিয়ে একই সঙ্গে বরণ করে নেবেন তপস্বিনীর জীবন। এ-রকম জীবন কত কেটে গেছে, তার ইয়ত্তাও নেই, কত ঋষিবধূ সতীত্বের মহা-উপাধি নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছেন এইভাবে, তারও ইয়ত্তা নেই কোনও। মনে রাখা দরকার, সতীত্বের প্রতি আমার বিরাগ নেই কোনও, সতীত্ব অতি শ্রদ্ধেয় বস্তু, কিন্তু মহাকাব্যের কবি যাঁরা সমাজ-মানসের প্রতিফলন ঘটান লেখনীতে, তারা অনন্যসাধারণ কৌশলে বুঝিয়ে দেন– যাঁরা নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত থাকলেন, থাকুন তারা। খুব ভাল কথা। কিন্তু এই ধরনের তপস্বী-জীবনে যাঁরা অসামান্যা রূপবতী হওয়া সত্ত্বেও তপস্বিনী হয়ে রইলেন, তাদের ভিতরে ‘সাপ্রেশন’-এর একটা প্রক্রিয়া তো চলেই এবং তারও একটা অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া থাকে।

এই প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে আদিকাব্য রামায়ণে। এখানে মহর্ষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যা– যাঁর রূপের মধ্যে সামান্য দোষ বা ‘হল্য’ ছিল না বলেই তার নাম অহল্যা। কিন্তু এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও ঋষিপত্নীর জীবনে যৌন সার্থকতা কম ছিল বলেই স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র যেদিন গুরু গৌতমের রূপ ধারণ করে এসে গুরুপত্নীর সঙ্গম প্রার্থনা করলেন, সেদিন কিন্তু ইন্দ্রকে স্বরূপে চেনা সত্ত্বেও শুধু দেবেন্দ্রের রতিপূরণ কেমন লাগে, সেটা বোঝার জন্যই তিনি সঙ্গত হলেন ইন্দ্রের সঙ্গে মুনিবেশং সহস্রাক্ষং বিজ্ঞায় রঘুনন্দন… দেবরাজ কুতূহলাৎ। এক্কেবারে অনুরূপ ঘটনা হয়তো রামায়ণ মহাভারতে বেশি নেই, কিন্তু এই ধরনের যৌন অতিক্রম, ধর্ষণ– হয়তো অনেক সময়ে না জেনেই, না চিনেই, তবু যখন সেটা ঘটেছে– তখন রমণীর দিক থেকে এগুলি যে সর্ব সময়েই অনাকাঙিক্ষত ছিল, তা আমাদের মনে হয়নি।

বিশেষত এইরকম একটা শব্দ মহাভারত-পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্রগুলিতে পাওয়া যায়, যা পুরুষের সম্বন্ধেই প্রধানত প্রযুক্ত– সেই শব্দটাও কিন্তু ভীষণই ইঙ্গিতবহ। কথাটা হল– ‘গুরুতল্পগামী’, ‘গুরুতল্পগ’ ‘তল্প’ মানে বিছানা অর্থাৎ যে মানুষ গুরুর বিছানায় ওঠে, গুরুর স্ত্রীকে লঙঘন করে। এসব লোকের অনেক পাপ হবে, অনন্ত নরক ভোগ, এসব ধর্মশাস্ত্রীয় ভয় তো আছেই, কিন্তু আমাদের বক্তব্য হল–এই ধরনের ঘটনা তা হলে ঘটত, কিন্তু কেন ঘটত– এখানেই কিন্তু একটা সামাজিক-মানসিক প্রশ্ন উঠে যায়। গুরুতল্পগামীর পাপ কিংবা নরকভোগের ক্ষেত্রে পুরুষ-মানুষগুলিই সর্বত্র দায়ী হয়েছে সর্বাংশে, কখনও কখনও গুরুপত্নীরাও তপস্বী ঋষি-স্বামীর অভিশাপ লাভ করেছেন কিন্তু এইসব প্রসঙ্গে সর্বক্ষেত্রে গুরুরমণীকুলের অনভিনন্দন ছিল কিনা, সে-কথা মহাভারত-পুরাণ স্পষ্ট করে বলে না। কিন্তু আমাদের সর্বাঙ্গীণ সমাজ-মানসের বিচার করলে এটা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, তৎকালীন ঋষি-মুনির তপস্বীভাব, ইন্দ্রিয়-সংযমের শাস্ত্রীয় শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিপ্রতীপে এক সুন্দরী রমণীর পত্নী-জীবন, ওপর থেকে নেমে-আসা সহধর্মচারিত্বের ব্রত, সংযম-নিয়মের পালনীয়তা এক ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবদমন তো বটেই। তাতে সকলেই অরুন্ধতী-অনসূয়ার মতো অবিচল সতীত্বের আড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন না। হয়তো তাতে স্বাভাবিক বিচলন কিছু ঘটত।

যেখানে যেখানে এই বিচলন ঘটেছে, তার বিস্তারিত দৃষ্টান্ত সাজিয়ে আমরা পাঠককুলকে বিচলিত করতে চাই না। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা যে থাকে, পরিপূর্ণ জীবনে কামনার আস্বাদন লাভ করতে গেলেও যে একটা উপকরণ-সামগ্রী লাগে– সেই আকাঙ্ক্ষার সোচ্চার শব্দ মহাভারত-পুরাণে বড় বেশি উচ্চারিত হয় না। হয়তো তা এই কারণেই যে, তাতে স্বামীর তপস্বী-স্বভাব এবং বৈরাগ্যের মাহাত্মে কলঙ্ক তৈরি হয়, আর নিজের ক্ষেত্রে ঘটে সেই কলঙ্কিত অতিক্রম, যেখানে স্ত্রী চিহ্নিত হন স্বামীর ধর্মে শ্রদ্ধাহীনা এক ‘স্বতন্তরী’ রমণী হিসেবে। প্রমাণিত হয়, যেন এমন স্ত্রীর ধর্মজ্ঞান নেই, নীতবোধ নেই এবং তিনি নারীজননাচিত সংসার ধর্মের চেয়েও নিজের রূপ-যৌবন নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এমন মহিলা কখনও সম্মানের যোগ্য হতে পারেন না। কিন্তু সমাজের এই উপদেশ্য বিধি-ব্যবহারের বিপ্রতীপে প্রবহমান এক বাস্তব আছে, যেখানে সুন্দরী রমণী তার প্রাপ্য বুঝে নিতে চায় এবং তার জন্য মাঝে মাঝে যে বিধি-প্রতিকূল ব্যবহার করে, অথবা করে ফেলে। তাতে চিরকালীন ভারতবর্ষের স্ত্রীজনোচিত যে সহনীয়তা এবং নৈঃশব্দ্য, সেখানেও বড় প্রকটভাবে আঘাত লাগে। সে নিজে বেশি কথা না বললেও তার ব্যবহার কথা বলে ফেলে অনেক বেশি। মেয়েদের দিক থেকে এই ঘটনা অবশ্যই এক নৈঃশব্দ্য-ভঙ্গ এবং তা একান্ত বৈপ্লবিক হলেও এই ভারতবর্ষেই ঘটেছে।

এই কাহিনি বোধহয় কাহিনি হিসেবে সকলেরই জানা যে, দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী ছিলেন তারা। তিনি অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন এবং সেই সৌন্দর্যের মধ্যে এমন একটা ঢলো ঢলো ভাব ছিল যাতে খানিক মদালসা মনে হত তাকে দেখলেই রূপ-যৌবন-যুক্তা সা চার্বঙ্গী মদবিহ্বলা। এহেন তিনি ব্রাহ্মণগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী। ওদিকে অত্রিমুনির পুত্র সোম বা চন্দ্র ছিলেন গ্রহ-নক্ষত্র ওষধিকুলের রাজা। তিনি একদা রাজসূয় যজ্ঞ করছিলেন এবং স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি ছিলেন তার যাজ্ঞিক পুরোহিত, আচার্য। রাজসূয় যজ্ঞের বিরাট পরিসরে বৃহস্পতি একদিন তারাকে নিয়ে যজমান শিষ্যের বাড়িতে গেলেন। গুরুর স্ত্রী তারাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন চন্দ্র এবং তারা বোধহয় চন্দ্রকে দেখে ততোধিক প্রেমাসক্ত হলেন–পরস্পর-স্পৃহান্বিতে। ঘটনা দাঁড়াল এই যে, কিছুদিনের মধ্যেই চন্দ্র গুরুপত্নীকে হরণ করে নিয়ে এলেন আপন গৃহে। বিষ্ণুপুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণ তথ্য দিয়ে জানিয়েছে যে, রাজসূয় যজ্ঞ করছিলেন বলে চন্দ্রের মনে নাকি একটু অহংকারই তৈরি হয়েছিল, সেই অহংকারেই গুরুপত্নীহরণ এবং তাকে নিজের বাড়িতে এনে তোলা– মদাবলেপাচ্চ অসৌ সকলদেবগুরোবৃহস্পতে-স্তারাং নাম পত্নীং জহার।

ব্রাহ্মণ-গুরু বৃহস্পতি প্রথমে এত ভাবেননি; ভেবেছিলেন– এই গেছে, এই চলে আসবে। কিন্তু সেটা আর হল না। চন্দ্র গুরুপত্নীর সরঙ্গে বেশ কিছুদিন উদ্দাম রতিক্রিয়ায় কাটিয়ে দেবার পর গুরু বৃহস্পতির টনক নড়ল। তিনি অন্য এক শিষ্যকে চন্দ্রদেবের বাড়িতে পাঠালেন পত্নীকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তারা তখন চন্দ্রের প্রেমে এতই মত্ত হয়ে আছেন যে, তিনি নিজেই ফিরে এলেন না– নায়াতা সা বশীকৃতা। স্ত্রী কিছুতেই ফিরে আসছেন না দেখে বৃহস্পতি নিজেই যজমান শিষ্যের বাড়ি গিয়ে প্রচুর তিরস্কার-সহ কটুক্তি করে বললেন– তুই আমার শিষ্য হয়ে গুরুপত্নীকে এমন নির্লজ্জভাবে ভোগ করে যাচ্ছিস, তাকে বাড়িতে আটকে রেখেছিস, তুই কি জানিস এর ফল কী– গুরুভার‍্যা কথং মূঢ় ভুক্তা কিং রক্ষিতাথবা। তুই এখনই আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিবি, আমি তাকে না নিয়ে বাড়ি যাব না–ন যামি সদনং মম। আমরা খেয়াল রাখছি– এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়। অপহরণকারী ব্যক্তির ওপরেই প্রকৃত স্বামীর রাগ হচ্ছে এবং তিনি ভাবছেন– তার স্ত্রী নির্দোষ, তাকে পৌরুষেয় শক্তিতে আটকে রাখা হয়েছে।

চন্দ্র অবশ্য দেবগুরুর ভুল ভাঙালেন না। বরঞ্চ একটা সত্য কথা জানিয়ে একটু ‘ভিলেইনাস্’ সুরে বললেন– যাবে, যাবে, নিশ্চয়ই ফিরে যাবে। কিন্তু কিছুদিন যদি এখানে থেকে একটু সুখ করে যায়, তাতে আপনার কী এত ক্ষতি হচ্ছে বলুন তো- কা তে হানি রিহানঘ। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো আপনার স্ত্রীকে জোর করে আটকে রাখিনি। আমার কাছে থাকতে তার ভাল লাগছে এবং তিনি নিজের ইচ্ছেতেই আমার সঙ্গে আছেন– ইচ্ছয়া সংস্থিতা চাত্র সুখকামার্থিনী হি সা। চন্দ্র এবারে জব্বর একটা শাস্ত্রবাক্যও শুনিয়ে দিলেন, যে-শাস্ত্র নাকি বৃহস্পতিরই লেখা। চন্দ্র বললেন– আর কিছুদিন আমার সঙ্গে থেকে রতিসুখ অনুভব করার পর যদি তিনি আপনার বাড়িতে ফেরেন, তাতেও তো কোনও অসুবিধে নেই। আপনিই তো ধর্মশাস্ত্রের বিধান দেবার সময় বলেছেন যে, ব্রাহ্মণ অন্যায় করলে বৈদিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শুদ্ধ হন আর স্ত্রীলোক যদি ব্যভিচারিণী হয়, তা হলে পরবর্তী রজঃসঞ্চারেই তিনি শুদ্ধ হয়ে যান। কাজেই উপপতির সঙ্গে কিছুদিন থাকলে আপনার স্ত্রীকে গ্রহণ করার কোনও অসুবিধে থাকতে পারে না– ন স্ত্রী দুষ্যতি। জারেণ ন বিপ্রো বেদকর্মণা।

আমরা অবশ্য এইরকম একটা উদার বিধান বৃহস্পতি-স্মৃতি বা বাৰ্হস্পত্য কোনও ধর্মশাস্ত্রে পাইনি, কিন্তু এইরকম একটা বিধান ধর্মশাস্ত্রে অবশ্যই আছে এবং চন্দ্র সেটাই বৃহস্পতির ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজে তার সুযোগ করে নিয়েছেন। বৃহস্পতির কোনও উপায় ছিল না এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তার স্ত্রীই পছন্দ করছেন না তার কাছে। ফিরে আসতে। আর কী আশ্চর্য এই মনোজগতের তত্ত্ব। যতদিন ঘরে তার সুন্দরী স্ত্রী ছিল, ততদিন তিনি তার রূপযৌবন অবহেলা করেছেন। কিন্তু এখন যখন সেই রমণীই অন্যের দ্বারা উপভুক্তা হচ্ছেন, এখন তার জন্য তিনি চরম কামনা অনুভব করছেন। তিনি বিতাড়িত হয়ে ঘরে ফিরছেন যতখানি যজমান শিষ্যের ওপরে রাগে, ঠিক ততখানি কামাতুর হয়ে জগাম স্বগৃহং তুর্ণং চিন্তাবিষ্টঃ স্মরাতুরঃ। কিছুদিন আবার ঘরে কাটালেন বৃহস্পতি। কিন্তু আর থাকতে পারলেন না, উপস্থিত হলেন শিষ্যবাড়িতে চরম ক্রোধ নিয়ে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। চন্দ্রের গৃহে পৌঁছে দ্বারদেশ থেকেই তিনি চাঁচাতে আরম্ভ করলেন– ওরে বদমাস! কোথায় শুয়ে আছিস তুই। বেরিয়ে আয়, আজ যদি তুই আমার স্ত্রীকে ফেরত না দিস, তা হলে অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করব তোকে করোমি ভস্মসায়ূনং ন দদাসি প্রিয়াং মম।

অসীম ব্যক্তিত্বশালী ভগবান চন্দ্র, যাঁর এই সাভিমান গুরুপত্নী-রমণ থেকেই প্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশের সৃষ্টি হয়েছে, তিনি এই অভিশাপের ভয় তত পেলেন না। বস্তুত তার সবচেয়ে বড় জোর তাঁর গুরুপত্নী নিজেই। তিনি নিজেই আর রুক্ষ-শুষ্ক বেদাধ্যয়ন-তৎপর গুরুর কাছে ফিরতে চাইছেন না। বৃহস্পতির নিন্দামন্দ শুনে নিজের প্রাসাদ-ভবনের দ্বারদেশে এসে মাথা ঠান্ডা করে সহাস্যে গুরুকে বললেন– কেন এত গালমন্দ করছেন শুধুমুধু। আপনার যে অসামান্যা রূপযৌবনবতী স্ত্রীটি আছেন, আপনি তার যোগ্য নন– ন তে যোগ্যাসিতাপাঙ্গী সর্বলক্ষণসংযুতা। আপনি তো নিজের অনুরূপ– মানে, দেখতে-শুনতে তত ভাল নয়, একটু নিম গাছের একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতে পারেন। সেটাই ঠিক হবে। কিন্তু আপনার মতো ভিখারি গুরুর ঘরে, যিনি যজন-যাজন-দক্ষিণায় জীবিকা নির্বাহ করছেন, তার ঘরে এত সুন্দরী একটি রমণীর কী তৃপ্তি হতে পারে ভিক্ষুকস্য গৃহে যোগ্যা নেদৃশী বরবর্ণিনী?

চন্দ্রের এই প্রত্যাখ্যান-তিরস্কারের মধ্যে অহংকার, অভিমান, কিংবা বলদর্পিতার ভাগ যতটুকুই থাকুক, আধুনিক দৃষ্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এখানে অর্থনৈতিক। এ-কথাটা এ-দেশের মেয়েরা পৌরুষেয় এবং শাস্ত্রীয় সহধর্মচারিত্বে’-র চাপে কখনওই বলতে পারেননি। কিন্তু আজকের দিনের গবেষণা থেকে এটা বোঝা কিছু অসম্ভব নয় যে, পুরুষের অর্থনৈতিক অসাচ্ছল্য প্রেম বা ভালবাসার নান্দনিক ক্ষেত্রে যদি বা খুব স্বর্গীয়ভাবেও আঘাত করে, বাস্তব জীবনে কিন্তু এই অসাচ্ছল্য কিংবা অর্থনৈতিক দুর্বলতা একটি স্বয়মাগতা রমণীকেও আস্তে আস্তে উদাসীন করে তোলে। আধুনিক গবেষক এবং মনস্তাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা পুরুষের আর্থিক অক্ষমতাকে অনেক সময়েই বিবাহিতা রমণীর ‘সেক্সয়াল ডিসফাংকশন’-এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। আমাদের দেশে দার্শনিক এবং ধর্মীয় প্রতিপত্তিতে পুরুষের আর্থিক পূর্ণতা মেয়েদের যৌবন-সাফল্যে খুব যে বাদ সেধেছে, তা নয়। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা এবং আশার জায়গাটা তবু রয়েই যেত– তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব মহাকাব্য এবং পুরাণগুলিতেই।

কিন্তু পুরুষের এই অর্থনৈতিক সাফল্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় যৌনতার সমঞ্জস আচরণ। মুনি-ঋষিরা অথবা পরবর্তীকালের তথাকথিত বৈরাগ্যবাদী ব্রাহ্মণেরা– যাঁরাই বড় ঘরের সুন্দরী মেয়েদের বিবাহ করেছেন কামনাবশে, তাঁদের নিজেদের যাজ্ঞিক কর্মজীবন, জীবিকা-জনিত ব্যস্ততা এবং অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়সংযমের শিক্ষা বিবাহিতা যৌবনবতাঁকে খানিক অবদমনের পথে তো চালিত করতই, তার মধ্যে সংসারে শ্বশুর শাশুড়ি, ভাসুর-ননদের সাংস্কারিক বিনয়-শিক্ষা ‘এলিট’ মহিলাদের চার দিকে এমনভাবেই এক সামাজিক আচ্ছন্নতা তৈরি করত, যার আবরণ ভঙ্গ করে সোচ্ছাস যৌনতার পরিসরে প্রবেশ করাটা তাদের পক্ষে কঠিন ছিল, এমনকী সাংস্কারিক ভাবনায় সেটা অন্যায়ও ছিল। এটাও সঙ্গে সঙ্গে বলা ভাল যে, যৌনতার সাংস্কারিক সংযম কিন্তু ব্রাহ্মণ্যের একটা অঙ্গ, যা মহিলারা নিজের অজ্ঞাতেই অত্যন্ত গৌরব-বোধে আত্মসাৎ করতেন অথবা করানো হত এবং এই গৌরববোধ এতটাই প্রবল যে নিম্নবর্গীয় জাতি-বর্ণের মধ্যেও সেটা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিম্নবর্গীয়া রমণীদের মধ্যে যেহেতু ব্রাহ্মণ্য আচার-আচরণ-শুদ্ধতা তেমন সাংস্কারিক কাঠিন্যে প্রতিষ্ঠিত হত না এবং যেহেতু সেটা ব্রাহ্মণের চোখেও ঘৃণার বস্তু ছিল, তাই বৈবাহিক জীবনে ওপর-ওপর একটা পাতিব্রত্যের পরিসর তৈরি হলেও যৌনতার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। এক ইতালীয় পণ্ডিত ফ্রানসেকা অসিনি উপরি-উক্ত ভাবনা প্রমাণ করার জন্য একটি মৌখিক গল্পকথার আশ্রয় নিয়েছেন।

অরসিনি প্রথমত ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর রচিত শুকসপ্ততি এবং তার অনুবাদ তুতিনামার প্রমাণ দেখিয়ে সাধারণ গৃহস্থ রমণীর যৌন অভিযানগুলিকে একটা গবেষণার উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বীরবলের একটি উর্দু গল্প শুনিয়ে বলেছেন– নিম্নবর্গীয়া রমণীদের ব্যবহার এখানে অনেকটাই ‘এসেনশিয়ালি ডুপ্লিসিটাস। তার উদ্ধৃত গল্পটা এইরকম– একদিন আকবর শাহ বীরবলকে বললেন আমার কাছে চার জন মানুষ নিয়ে এসো– যাদের একজন হবেন অত্যন্ত বিনয়ী, দ্বিতীয় এক নির্লজ্জ মানুষ, তৃতীয় জন এক কাপুরুষ, এবং চতুর্থত এক মহাবীর। পরের দিন বীরবল রাজাদেশ অনুসারে একটি যৌবনবতী মহিলা এনে হাজির করলেন আকবরের সামনে। আকবর সামান্য ক্রুদ্ধ হয়েই বললেন- আমি তোমাকে চারজন মানুষ ধরে আনতে বলেছিলাম। তুমি তো একজনকে নিয়ে এলে, আর তিন জন কোথায়? বীরবল বললেন– জাঁহাপনা। এই একজন রমণীর মধ্যেই আপনার চার-চারটি মানুষের গুণ আছে। আকবর বললেন সে আবার কেমন? বীরবল বললেন– এই মহিলা যখন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, তখন তার বিনয়-বোধ এমনই যে, একটি কথা পর্যন্ত তিনি মুখ ফুটে বলেন না। কিন্তু বিভিন্ন বিয়ে বাড়ির আসরে এই মহিলাই যখন প্রচণ্ড অশ্লীল সব গান করেন, তখন সে গান কিন্তু শুনছেন তার সামনে-পিছনে বসা তার বাবা, তার ভাইরা, তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন তথা স্বজাতের পরিজন, অথচ তখন কিন্তু এই রমণীর লজ্জা বলে কিছু থাকে না। তখন ইনি বেহায়া নির্লজ্জ। আবার এই রমণীই যখন রাত্রে তার স্বামীর সঙ্গে থাকেন, তখন কিন্তু একা-একা ভাড়ার ঘরেও যাবেন না, তাঁর এত ভয়। কিন্তু কোনও দিন– যেদিন সুযোগ আসে, কোনও পরপুরুষকে মনে ধরেছে তার, সেদিন কিন্তু তিনি নির্ভয়ে মধ্যরাত্রির অন্ধকারেও তার পিছনে দৌড়োবেন– একান্ত একাকী, হাতে কোনও অস্ত্র নেই, চোর ডাকাত-লুঠেরার ভয় নেই, ভূত-পেত্নীর ভয় নেই। এমন নির্ভীক বীর আপনি পাবেন নাকি কোথাও? আকবর আর দেরি করেননি বীরবলকে মোহর দেবার ব্যবস্থা করেছেন পুরস্কার হিসেবে।

বীরবলের এই উদাহরণ নিতান্ত মৌখিকতায় প্রকটিত হলেও এর মধ্যে গভীর সামাজিক সত্য নিহিত আছে এবং সে সত্য শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, সেটা বড় ঘরের সম্বন্ধেও বেশ খাটে। কিন্তু ওই যে বললাম– সামাজিক পরিশীলন। উচ্চবর্গের মহিলারা জন্ম ইস্তক অভিভাবক এবং শাস্ত্রের তত্ত্বাবধানে এমনভাবেই তৈরি হয়ে উঠতেন, এমনই সংযম-নিয়মের গৌরব-স্ফীতিতে তাদের মানসিক সংস্কার তৈরি করা হত, যাতে যৌনতার কোনও পরিসরে নিজেকে একবারের তরেও প্রকট করে তোলাটা চারিত্রিক দূষণের মধ্যে গণ্য হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা জানি– ভদ্রলোকের বাস্তব জগৎও শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে চালিত হয় না। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর ব্রাহ্মণ্য পরিশীলনে কালিদাস তার নায়িকা শকুন্তলাকে মূর্তিমতী সৎক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করলেও মহর্ষি কণ্বের অনুপস্থিতিতে শকুন্তলা কিন্তু রাজসম্ভোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন নির্জনে এবং তাতে গর্ভবতী হয়ে পড়াটাকেও শেষ পর্যন্ত গান্ধর্ব-বৈধ উপায়ে সিদ্ধ করতে হয়েছে। আর বিকীর্ণ কবিতায় অনুলক্ষ্মীর মতো সম্ভ্রান্ত মহিলা কবিও কিন্তু সোচ্ছাসে নিজের কবিতায় এক নবীন যুবককে রতিসুখের প্রশ্রয় দিয়ে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বলেছেন– দেখো হে নবীন! কুশলী বিদগ্ধ পুরুষের পুনঃপুনঃ আচরিত পূর্ণ রমণের মধ্যে যতই অনুরাগ থাকুক, সে কেমন ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ পুনরুক্তির মতো মনে হয়। তার চেয়ে এই যে যেখানে সেখানে, যেমন-তেমনভাবে আকস্মিক মিলনের সুযোগ নাও তুমি, তার মধ্যে যে তীব্রতা আর অভিলাষ থাকে, সেটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগে– যথা যত্র বা তত্র বা যথা বা তথা বা সদ্ভাব-স্নেহ-রমিতানি।

আমরা পূর্ব-প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলব– একজন হলেও এইরকম একটি অনুলক্ষ্মী রমণীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, যাঁর কাছে বিদগ্ধ পুরুষের নাগরক-জনোচিত কুশলী রমণও পুনঃ পুনঃ আবর্তিত হওয়ায় বার-বার এক কথা বলা পুনরুক্তির মতো লাগছে, সেখানে বৃহস্পতির মতো দেবগুরু যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার সমাধান-শেষে কতখানি তৃপ্ত করতে পেরেছেন তারাকে, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ এক সন্দেহের কথা তাঁর উপপতি চন্দ্রের কথায় ফুটে উঠেছে। চন্দ্র বলেছেন– মেয়েরা নিজের অনুরূপ কাম্য পুরুষের রতি-রমণই প্রার্থনা করে–রতিঃ স্বসদৃশে কান্তে নাৰ্যাঃ কিল নিগদ্যতে সেখানে তুই ব্যাটা গুরুগিরি করে দিন কাটাস, তুই কামশাস্ত্রের কী বুঝিস? তুই বাড়ি যা, তোর বউকে আমি ফেরত দেব না। তোর যা মনে হয় করতে পারিস, তুমি অভিশাপ দে, ভস্ম করে দে, তোর মতো কামুক লোকের অভিশাপে আমার কিছুই হবে না। তোর যা মনে হয় কর, কিন্তু তোর বউকে ফেরত দেব না আমি– নাহং দদে গুরো কান্তাং যথেচ্ছসি তথা কুরু।

পুরাণের কাহিনি অনুযায়ী এই ‘ই’ অনেক দূর গড়িয়েছিল। বৃহস্পতি তার শিষ্য দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। তিনি সসৈন্যে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন চন্দ্রের সঙ্গে। সুযোগ বুঝে অসুরগুরু চন্দ্রের পক্ষে অসুর-সৈন্য নিয়ে যোগ দিলেন। তারাকে উপলক্ষ করে স্বর্গরাজ্যে প্রায় দেবাসুরের পৌরাণিক যুদ্ধ লেগে যায় আর কী। ভগবান দেবদেব শংকর পর্যন্ত “ইনভলবড’ হয়ে গেলেন। কিন্তু এত বড় বড় সব দেবতারা চন্দ্রকে দোষী সাব্যস্ত করছেন শাস্ত্রীয়ভাবে, কিন্তু এই সত্য কেউ অবধারণ করছেন না যে, তারা নিজেই ফিরে আসতে চাইছিলেন না বৃহস্পতির ঘরে। অবশেষে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভগবান ব্রহ্মা অসুরগুরু শুক্রাচার্যের সহায়তায় চন্দ্রকে রাজি করাতে সমর্থ হলেন। পৌরাণিক মন্তব্য করেছেন– নিরুপায় হয়ে চন্দ্র গুরুর স্ত্রীকে ফেরত দিলেন যদিও তিনি মনে মনে খুব ভালই জানতেন যে, তারা তার স্বামীকে ভালবাসেন না। সবচেয়ে বড় কথা– যখন তারাকে ফেরত দিলেন চন্দ্র, তখন তিনি গর্ভবতী– দদৌ চ তৎপ্রিয়াং ভার্যাং গুয়োর্গর্ভবতীং শুভাম।

চন্দ্র তারাকে ফেরত দিলেন বটে, কিন্তু গণ্ডগোলটা শেষ হল না। বৃহস্পতি স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি গেলেন বটে, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে নিজের ঘরে ঢোকানোর আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছু যে ছিল না, সেটা ভারতবর্ষীয় বহুল পুরুষের মতো তিনি নিজেও বোঝেননি। আর সত্যি বলতে কী, এটাই বোধহয় প্রাচীন ভারতী-কথার অন্যতম বিরল উপাখ্যান, যেখানে এক বিবাহিতা রমণীর ইচ্ছে-অনিচ্ছের ব্যাপারটা তার মুখ দিয়েই শোনা যাচ্ছে। এত যে ঘটনা ঘটে গেল একটার পর একটা, বিবাহিত বৈধ স্বামী উপপতির দরজায় এসে দিনের পর দিন নরমে-গরমে দাঁড়িয়ে থাকছেন, উপপতির মুখে কামধর্মের উপদেশ শুনছেন, স্বামীর সঙ্গে অভীষ্ট প্রেমিক উপপতির যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি একবারের তরেও বলছেন না– আমি স্বামীর কাছে ফিরে যাই।

স্বামী বৃহস্পতির গৃহে ফিরে আসার কিছু দিন পর তারার একটি পুত্র হল। আত্মতৃপ্ত স্বামী হিসেবে পরম পুলকিত হয়ে বৃহস্পতি বিধি অনুসারে পুত্রের জাতকর্মাদি পুণ্য কর্ম সমাপ্ত করলেন। সব খবর পেলেন চন্দ্র, তারার প্রতি ভালবাসার অধিকার এবং ঔপপত্যের অসূয়া এই পুত্রজন্মের ঘটনাকে আবারও জটিল করে তুলল। চন্দ্র দূত পাঠালেন গুরু বৃহস্পতির কাছে। দূতের মুখে চন্দ্র বলে পাঠালেন– আপনি কার জাতকর্মাদি পুণ্য ক্রিয়া সম্পন্ন করছেন, এ-ছেলে আপনার ছেলেই নয়, এটা তো আমার ছেলে ন চায়ং তব পুত্রোহস্তি মম বীর্য-সমুদ্ভবঃ। চন্দ্রের কথা শুনে বৃহস্পতি ভাবলেন– শিষ্য আবারও ফন্দি আঁটছে। তিনি এতটুকুও ঘাবড়ে না গিয়ে চন্দ্রদূতকে জানালেন– বললেই হল, এটা ওর ছেলে। ছেলেটাকে দেখতে পুরো আমার মতো, আর বলছে কিনা ওর ছেলে। এটা আমারই ছেলে– উবাচ মম পুত্রো মে সদৃশো নাত্র সংশয়ঃ।

পুত্রের অধিকার নিয়ে আবারও গণ্ডগোল পেকে উঠল। আবারও দেবাসুর-যুদ্ধ লেগে যায় আর কী। প্রজাপতি ব্রহ্মাকে পুনরায় নেমে আসতে হল যুদ্ধ-দুর্মদ অসুর-দেবতাদের সামনে। তিনি কোনও মতে দু’পক্ষকে শান্ত করে তারার কাছে এসে বললেন– কল্যাণী! তুমি সত্যি করে বলো তো এই শিশুটি কার? প্রশ্ন শুনে তারা অনেকক্ষণ অধোমুখে থাকলেন। ব্রহ্মার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন– এ পুত্র চন্দ্রেরই বলেই তিনি লজ্জায় লাল হয়ে ঢুকে গেলেন ঘরে– চন্দ্রস্যেতি শনৈরন্তর্জগাম বরবৰ্ণিনী। ঘটনা শেষ পর্যন্ত এই পঁড়াল– বৃহস্পতির পৌরুষের কাঠিন্যে তারা তার ললাট-লিখিত স্বামীর কাছেই থেকে গেলেন বটে, কিন্তু তার ছেলেটিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন চন্দ্র– অর্থাৎ সেইকালে এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা যে, বৃহস্পতির আইনসঙ্গত স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তারা তার ঔপপত্যের ফল ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি শেষ পর্যন্ত, এবং চন্দ্রের পিতৃত্ব স্বীকার করে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সেখানে তার উপপতির ঘরেই তিনি ভাল ছিলেন।

চন্দ্র-তারার পৌরাণিক কাহিনি শুনিয়ে আমরা এতক্ষণ যেটা বোঝাতে চেয়েছি, সেটা হল– জীবনকে ‘যাপন করতে হলে মেয়েদেরও কিছু কাম্য থাকে। বিশেষত যেহেতু তারা উপযুক্ত বিদ্যালাভে প্রায়শ বঞ্চিত ছিলেন, এবং যেহেতু অর্থ রোজগার করার মতো ব্যস্ত বৃত্তিতেও তারা অনধিকারী ছিলেন, তাই স্বামীর ঘরে ভাল থাকার ইচ্ছের মধ্যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও যেমন প্রাচীন রমণীদের কাছে একটা মাত্রা ছিল, তেমনই যৌনতার ক্ষেত্রেও তাদের পরম ঈপ্সিত ছিল রমণীয়ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার সুখ। ঠিক এইরকম একটা কাম্যতা’ যদি প্রাচীনাদের চাওয়া-পাওয়ার মাত্রা হয়, অথবা সেটাই যদি হয় ‘ফ্রেম অফ রেফারেন্স’, তা হলে মহাভারত থেকে আমরা এক ঋষিপত্নীর কাহিনি শোনাব, আর এই ঋষি-পত্নীর কথার মধ্যে সেই প্রখ্যাত ঋষির কথা আগে আসবে যাঁর নাম অগস্ত্য। মহাভারতের এই কাহিনির মধ্যে অবশ্য মহাকবির ঈপ্সিত অন্যতর কাহিনির সংযোজন আছে, যাতে করে ঋষিপত্নীর ইচ্ছা এবং কাম্যতার ক্ষেত্রগুলি অনেক ধূসর হয়ে ওঠে। তার কারণটাও অবশ্য খুব ধ্যানগম্য নয়, কেননা মহাভারতের মধ্যে এই কাহিনি প্রবেশ করেছে ঋগবেদের পরম্পরায়। বৈদিক এবং উপনিষদোত্তর সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের কবি তার পূর্বকালের এক রমণীর অন্তর্যন্ত্রণাকে চিরন্তনী এক মানবিক প্রবৃত্তি হিসেবে বুঝেছিলেন বলেই ঋগবেদের সেই মন্ত্র মথিত সতাকে মহাভারতের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন ব্যাস। কিন্তু বৈদিক মূলের মধ্যে যে সরলতায় রমণী-মনের যে তীব্রতা ধরা পড়েছে, পরবর্তীতে মহাভারতের কবির মহাকাব্যিক আড়ম্বরে সেই দহন কিছু কাব্যায়িত হয়েছে হয়তো, কিন্তু তাতেও ঋষিপত্নীকে ঠিক চেনা যায় নারীর আপন দার্শনিকতায়।

আমরা বেদের মন্ত্রগুলিকে আগে বুঝে নিতে চাই। কিন্তু তারও আগে এটা বোঝা দরকার যে, বৈদিকের জীবন বুঝতে গেলে শুধু বৈদিক মন্ত্রের অর্থটুকু বুঝে নিলে চলে না। তার অগ্রপশ্চাৎ কিছু বুঝতে হয়। বুঝতে হয় এইসব মন্ত্রের প্রায়োগিক ক্ষেত্র যাঁকে তারা বলেন ‘বিনিয়োগ। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ এই মন্ত্রগুলির প্রয়োগ হয় কোথায়, এই মন্ত্রগুলির দেবতা কে এই তথ্যগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকগুলি মন্ত্রের সমষ্টি এই সূক্তটির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল– চিরপরিচিত কোনও ঐতিহ্যময় বৈদিক দেবতা- ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, সূর্য এই মন্ত্রগুলির দেবতা নন, কোনও দেবতার কাছে অভীষ্ট-প্রার্থনার একটি পঙক্তিও এখানে নেই। মন্ত্রগুলির ‘ফরম্যাট’ একটা বিশেষ মুহূর্তে এক ঋষি এবং ঋষিপত্নীর বাক্যালাপ এবং অনুভূতির দ্বন্দ্ব। পরিশেষে একটি মন্ত্রে এই গুরুকুলে থাকা একজন শিষ্য সম্পূর্ণ এই কথোপকণ্বনের যবনিকাপাত ঘটাচ্ছে নিজের মত ব্যক্ত করে। বৈদিক নিয়মমতো মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি থাকবেন না, এটা যেমন হয় না, তেমনই তার দেবতা থাকবে না, তাও হয় না, অতএব মন্ত্রগুলির প্রাচীন টীকাকার সায়নাচার্য মন্তব্য করেছেন– এই মন্ত্রগুলি লোপামুদ্রা, অগস্ত্য এবং তার শিষ্য দর্শন করেছেন বলে তারাই এই মন্ত্রসূক্তের ঋষি। এই সূক্তের প্রতিপাদ্য অর্থ যেহেতু রতি, তাই রতিই এই মন্ত্রগুলির দেবতা। আর লোপামুদ্রা এবং গুরু অগস্ত্যের রতিবিষয়ক কথোপকথন শুনে অন্তেবাসী শিষ্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে অন্যতর এক ছন্দে সেখানেই এই মন্ত্রগুলির তাৎপর্য অর্থাৎ বিনিয়োগ।

আমরা শুধু বলব– বৈদিক এই মন্ত্রগুলির টীকা করতে গিয়ে প্রাথমিক এই যে মন্তব্য, এটাই বৈপ্লবিক এবং ততোধিক বৈপ্লবিক হল– মন্ত্রারম্ভেই ঋষিপত্নী লোপামুদ্রার তীব্র জীবন-যন্ত্রণা। এও মনে হয় সেদিন বুঝি কোনও আকালিক চৈত্রী সন্ধ্যা ছিল, হয়তো উতলা হাওয়াও কানে কানে কথা কয়েছিল কিছু, ঋষিপত্নী লোপামুদ্রা আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। সামনে-বসা তপস্বী ঋষি অগস্ত্যকে দেখে তিনি সক্ষোভে বলে উঠলেন– আমার জীবনের কতগুলি শরৎকাল চলে গেল। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত্রি আমি তোমার সেবা করতে করতে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে গেছি। প্রতিটি সকাল আমার চৈতন্য সম্পাদন করেছে, প্রতিটি সকালে আমার বয়স বাড়তে বাড়তে আমার শরীরে জরা আসছে– পূর্বীরহং শারদঃ শশ্রমাণাঃ/ দোষা-বস্তোরুসো জরয়ন্তী। জরা তো শরীরের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। তবু এমন তো হতে পারে যে, পুরুষ আসুক এবার তার বিবাহিতা রমণীর কাছে অপূ নু পত্নীৰ্বষণা জগমঃ।

শেষের এই পঙক্তিটি ধ্রুবপদের মতো এসেছে লোপামুদ্রার সাবেগ উচ্চারণে। বস্তুত এই পঙক্তিটির মধ্যে একটা অসাধারণ নৈর্ব্যক্তিকতাও আছে। একজন তপস্বী ব্রাহ্মণের সহধর্মপরায়ণা স্ত্রী হিসেবে তিনি বোধহয় চান না যে, অন্যান্য হাজারো কুলবতী রমণীকুলের এমনই দশা হোক– যাঁরা দিনের পর দিন স্বামীদের আচার-ব্রতের সহমর্মিণী হয়ে শুধু সেবা করে যাবে, অথচ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা- যৌনতার দিকে ফিরেও তাকাবে না পুরুষ। অতএব সমস্ত নারীকুলের জন্য লোপামুদ্রার এই প্রার্থনা– পুরুষই যেন বুঝে নেয়। তার স্ত্রীর ইচ্ছে, সে যেন নিজেই সব বুঝে নিয়ে রমণীর অভীষ্ট পূরণ করে এবং প্রতিটি পুরুষই যেন তার আচার-বৃত্তি, ব্রহ্মচর্য-সংযম মাথায় তুলে রেখে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সঙ্গত হয় যৌনমিলনে অপি উ নু পত্নীৰ্বষণে জগমঃ। লোপামুদ্রার উচ্চারণে শব্দ খণ্ডেই এক অদ্ভুত ইচ্ছাময়ী সম্ভাবনা আছে, নিশ্চয়তার প্রার্থনা আছে এবং সংশয়ও আছে– অপি ঊ নু– অর্থাৎ এমনটা কি হবে কখনও হওয়াটাই তো উচিত, এখনই কি সেটা হয় না। সায়নাচার্যের ভাষায়- ‘অপি’-শব্দটা সম্ভাবনায় উচ্চারিত। উ’-শব্দটা নিশ্চয়ত্মক অবধারণ অর্থে। আর ‘নু’–শব্দটা সংশয়িত বিতর্কে এখনই সেটা হতে পারে– ইদানীমপি কিং সম্ভাবনীয়। বৈদিকী লোপামুদ্রার ভাষায় এখানে পুরুষ’ শব্দটাও ব্যবহার করা হয়নি। বলা হয়েছে ‘বৃষণঃ’। বৃষ-শব্দের সঙ্গে তাল রেখে যে পুরুষ যৌনাকাঙ্ক্ষায় আপন তেজোবীর্য সংযত করে রাখতে পারে না, সেইরকম এক ‘বৃষণ’ পুরুষের কথা বলছেন লোপামুদ্রা। তিনি নিজের কথা উহ্য রেখে সামগ্রিক সংসারের মধ্যে যেন এমনটা হয়, এই প্রার্থনা করে বলছেন– আমার যা হবার হয়েছে কিন্তু সংসারে বৃষণ পুরুষ এগিয়ে আসবে না এখনও তার স্ত্রীর কাছে অপূ নু পত্নীৰ্বষণো জগন্যুঃ?

লক্ষণীয়, লোপামুদ্রার প্রত্যেকটা সকাল এসেছে জরার সংকেত নিয়ে তাঁর ঈপ্সিত মিলন ঘটেনি যেহেতু উষসো জরয়ন্তীঃ। বৎসরের পর বৎসর– এমন একটা হীন সাংসারিক শব্দ ব্যবহার না করে কবির অভীষ্টতম– পূর্বজীবনের কতগুলি শরৎকাল আমি শুধু তোমার সেবা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি– এই কথার মধ্যে সেই সংশয়– শরৎকালের প্রাপ্যতা কী ছিল, আর কী হয়েছে? এই হাহাকারের সঙ্গে এক রমণীর চিরন্তনী আশঙ্কাটুকুও জড়িয়ে গেছে– জরা আমার সৌন্দৰ্য্য নাশ করে দিয়েছে– মিনাতি শ্রিয়ং জরিমা তন্না– এমনটা যেন আর কারও শারদীয় জীবনে না ঘটে, বৃষণ পুরুষ যেন সময়ে স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় এমন একটা প্রার্থনা এক রমণীর মুখে এবং তাও খ্রিস্টপূর্ব আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ভাবা যায়?

প্রাচীনেরা, মীমাংসা-দার্শনিকেরা বলেন- বেদ অপৌরুষেয়, অর্থাৎ বেদের মন্ত্র কেউ লেখেনি। ঋষিরা মন্ত্র দর্শন করেছেন, মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, তাই শ্রুতিপরম্পরায় নেমে এসেছে আমাদের কাছে। অবিশ্বাসী লোকেরা তর্ক করুন এই বিষয়ে। আমার শুধু বক্তব্য– এই দেখতে পাওয়ার মধ্যেই দার্শনিকের গভীরতা, মন্ত্র হাতে লিখলেন, না, সার্থক লিপির অভাবে মনের মাঝে স্মৃতির পাতায় লিখে রাখলেন, এটা আমার কাছে বড় কথা নয়। বড় কথা হল দেখাটা। লোপামুদ্রা জীবনকে দেখতে পেয়েছেন, তাই মন্ত্রটাকেও তিনি দেখতে পাচ্ছেন আপন অনুভূতিতে– ঠিক যেমন এক অসামান্য ক্ল্যাসিক্যাল গায়ক বলেছিলেন– সুরকে যতক্ষণ দেখতে না পাওয়া যায়, ততক্ষণ এক ধ্রুপদী গায়কের সিদ্ধি নেই। লোপামুদ্রার এই দার্শনিক অভিব্যক্তিটা এমন এমন শব্দে নিজেই বেঁধেছেন তিনি, যাতে এটা সম্পূর্ণভাবে এক রমণীর অভিজ্ঞতা উপলব্ধিকে প্রকট করে তুলেছে। লোপামুদ্রার উপলব্ধির গভীরতা এইখানে এই যে, তার জরাও ঠিক বয়স বেড়ে যাওয়ার জরা নয়। এ জরা অন্যরকম।

অনেক পরবর্তী কালে কতগুলি নীতিশাস্ত্রীয় শ্লোকের মধ্যে দেখেছি– দু’জন অভিজ্ঞ কবি দুটো গভীর কথা বলেছেন স্ত্রীলোকের যৌন জীবন সম্বন্ধে। একজন বলেছেন– যৌবনবতী রমণীর সঙ্গে স্বামী যদি এক বিছানায় না শুয়ে যদি তাকে পৃথক শয্যায় শোয়ার ব্যবস্থা করেন, তবে সে একরকম বিনা অস্ত্রাঘাতে তাকে মেরে ফেলার শামিল পৃথকশয্যা চ নারীনাম্ অশস্ত্রো বধ উচ্যতে। তার মানে জীবনের অভিজ্ঞতায় এটাই সবচেয়ে বড় উপলব্ধি যে, রমণীর শরীর উপভোগ করার জন্য পুরুষ যেভাবে লালায়িত হয়, সেই উপভোগে বিরত হয়ে রমণীকে যদি পৃথক শয্যায় শোয়ানোর ব্যবস্থা করো, তা হলে উপভোগ্য হওয়ার জন্য রমণীর যে আত্মাভিমান, সেও যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই আহত, শুষ্ক, জরাগ্রস্ত হয়ে ওঠে তার শরীর। আর এক নীতি-কবি লিখেছেন– ঘোড়া যদি পথে না দৌড়োয়, সেটাই যেমন তার জরা, তেমনই উপযুক্ত সম্ভোগ লাভ না করাটাই স্ত্রীলোকের জরা সৃষ্টি করে– অসম্ভোগগা জরা স্ত্রীণাম… অনধ্ব বাজিনাং জরা।

বলতেই পারেন– এ সব বাজে শ্লোক পুরুষের লেখা। আমরা বলব– যদি এটা পুরুষের লেখা হয়ও, তবু কথাটা বেঠিক নয়। আর সেটা যে কোনও রমণীও জানে। কুমারী অবস্থা থেকে প্রৌঢ়াকাল পর্যন্ত যে রমণী অনন্ত পুরুষের দৃষ্টি-রমণ উপভোগ করেছে স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায়, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, সে তার আপন উপভোগ্যতা সম্বন্ধে সাংস্কারিক ভাবে সচেতন বলেই যে কোনও অপ্রার্থমানতা তাকে যন্ত্রণা দিতে বাধ্য, সংযমসিদ্ধ পুরুষের অসম্ভোগ সেখানে জরা সৃষ্টি করবেই। লোপামুদ্রা এই জরার কথা বলছেন, তা নইলে এমন হাহাকার চূড়ান্ত হত না যে, প্রত্যেকটি শারদ সকালে আমার জরা তৈরি হয়েছে, তোমার সেবায় আমি ক্লান্ত, এমনটা যেন অন্যত্র না হয়, বৃষণ পুরুষ যেন সঙ্গত হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে।

আজ অনেক দিন, অনেক কাল পরে লোপামুদ্রা কথা বলতে আরম্ভ করেছেন। একজন মহান ব্রহ্মর্ষি পুরুষের সংযম-নিয়মের প্রয়োজন তিনি জানেন। আবার তিনি এও জানেন যে, তার বিবাহিত স্বামী-পুরুষটি শুধু সংযম আর তপস্যাই করে যাবেন, আর তার স্ত্রী শুধু সেবা করে যাবেন স্বামীর– এটা শুধু তার আপন গৃহচিত্র নয়, ভারতবর্ষের হাজারও গার্হস্থে অনেক ব্রাহ্মণ ঋষি আছেন এবং আছেন তাদের যৌবনবতী স্ত্রীরাও, সেখানেও কোথাও শরৎ সফল হয়ে ওঠে ঈপ্সিত সম্ভোগে আবার কোথাও তা অতিবাহিত হয় তারই মতো নিরুচ্চারে, অসম্ভোগে। লোপামুদ্রা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তিনি মন্ত্র দর্শন করছেন। জীবনকে দর্শন করেছেন বলেই বুঝি এমন মন্ত্রদর্শন। লোপামুদ্রা বলছেন স্বামীকে তুমিই তো সেই প্রথমতম ঋষি নও, যিনি সংযম-নিয়ম পালন করে সত্যদর্শন করছেন। তোমার আগেও ছিলেন অনন্ত ঋষিরা, যাঁরা সত্যকে লাভ করেছেন, দেবতাদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। তারা কিন্তু এই সংযম-নিয়ম-ব্রহ্মচর্যের কূল পাননি কোনও এবং সেই কারণেই প্রণয়সুখে আপন স্ত্রীদের রেতঃসিক্ত করতে তাদের বাধেনি কোথাও তে চিদবাসুন হ্যন্তপুঃ। আর তারা যদি এমন আচরণ করে থাকেন, তা হলে এটাই আমার প্রার্থনা যে, ঋষিপত্নীরা যারা স্বামীর সঙ্গে সংযমের তপস্যায় দিন কাটাচ্ছেন, তারা এবার সম্ভোগে মিলিত হোন কামুক স্বামীদের সঙ্গে সমু নু পত্নীৰ্বষভির্জগদ্মঃ।

পূর্বমন্ত্রের ধ্রুবপদে বার্তা ছিল পুরুষদের কাছে, তারা উদ্যোগী হোক সম্ভোগে। এবারে দ্বিতীয় মন্ত্রে বার্তা যাচ্ছে স্ত্রীদের কাছে, যাতে তারাই উদ্যোগী হন ‘বস্তুত’ কামকাতর পুরুষের সম্ভোগে। পূর্ব মন্ত্রে যেন কর্তা হলেন পুরুষ, দ্বিতীয় মন্ত্রে কর্তৃস্থানে যেন স্ত্রীরা। লোপামুদ্রার কথা শুনে অগস্ত্যের মতো তেজস্বী মহর্ষিও যেন থতমত খেয়ে গেছেন। অনেক সংযম-তপস্যায় তার দিন কেটেছে, ঋগবেদে অনেকগুলি মন্ত্রবর্ণের তিনি দ্রষ্টা পুরুষ। কিন্তু আজ তাকে এক অদ্ভুত গার্হস্থ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। তিনি বিবাহ করেছেন, কিন্তু তার ধর্মপত্নী বঞ্চিত বোধ করছেন, সম্ভোগ-বঞ্চনার মতো এক গুরুতর অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে। থতমত খেয়েই সম্পর্ক-সংশোধনে ব্যস্ত হচ্ছেন ঋষি অগস্ত্য। তিনি ‘অ্যাপোলোজেটিক’ এবং স্ত্রীকে প্রসন্ন করতে চাইছেন। অগস্ত্য বললেন– আমরা তো বৃথা শ্রান্ত হইনি। আমরা যে এত কৃচ্ছুতায় তপস্যা করেছি, দেবতারা তার ফল দিয়েছেন, তারা রক্ষা করছেন আমাদের ন মৃষা শ্রান্তং যদবন্তি দেবাঃ। আর তুমি এত শত ভাবছ কেন, লোপামুদ্রা? এই পৃথিবীতে যত উপভোগ্য বস্তু আছে, তা সবই আমরা ভোগ করতে পারি, যদি দু’জনেই আমরা একটু চেষ্টা করি। আমাদের সাংসারিক পৃথিবীতে ভোগ্য বস্তু আছে শত শত, আমরা পরস্পরেই জয় করে নিতে পারি সেগুলি– জয়াবেদত্র শতনীথমাজিম। এমনকী আমরা খুব সম্যকভাবেই পরস্পর মৈথুনে পরস্পরকে জয় করতে পারি– যৎসম্যঞ্চা মিথুনাবভ্যজাব।

অগস্ত্য বোধহয় অনুভব করতে পেরেছেন যে, তাঁর এই সংযম-নিরুদ্ধ স্বভাব তার বিবাহিতা বধূর জীবনে অনীপ্সিত এক বঞ্চনার আবরণ তৈরি করেছে সম্পর্কের মধ্যে। আর যেহেতু তিনি বিবাহিত এবং লোপামুদ্রা তার ধর্মপত্নী, সেখানে তপোনিষ্ঠার সংযমটাকে কারণ হিসেবে খাড়া করাটা একটা ব্যর্থ অজুহাত হিসেবেই গণ্য হবে। হয়তো এই কারণেই অগস্ত্য পশ্চাৎপদে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। অগস্ত্য লোপামুদ্রাকে বললেন– হয়তো আমি জপ-ধ্যানে নিরত হয়ে ব্রহ্মাচারীর সংযম নিয়ে বসে ছিলাম, তবে কিনা তোমার সঙ্গে সংসর্গের কারণেই হোক, অথবা আজ বসন্তের উতলা বাতাসে কোনও কিছু হল কিনা কে জানে, আজ কিন্তু আমার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে সেই আদিম কামনা- নদস্য মা রুধঃ কাম আগান। ইতঃ আজাতে অমুতঃ কুতশ্চিৎ। আজ তুমি লোপামুদ্রা, আমার এই কামনার প্রবর্তক হয়ে উঠেছ তুমি– এক অধীরা রমণী নিয়ম-নিরুদ্ধ ধীর স্বামীর সম্ভোগ স্বীকার করুক, আমার নিঃশ্বাস উষ্ণ হয়ে উঠেছে লোপামুদ্রা বৃষণং নীরিণতি। ধীরম অধীরা ধয়তি শ্বসন্ত– তুমি এসো, আমি প্রস্তুত।

বেদে একটা কণ্বথাপকণ্বনের মধ্যে অগস্ত্য এবং তার স্ত্রীর এই যে মানসিক সংশ্লেষ ঘটেছে, অপিচ সেই সংশ্লেষের মধ্যে গুরু এবং গুরুপত্নীর মুখে যে কাম-শব্দ উচ্চারিত হয়েছে, সেটা শুনে গুরুকুলবাসী একজন শিষ্যের একটা পাপবোধ তৈরি হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে গুরুর এইসব গোপন কথা তার শোনা উচিত হয়নি। প্রথমত যজ্ঞশেষে পীত সোমের কাছে সে প্রার্থনা করছে সে যেন সুখে থাকে। পরমুহূর্তেই সে গুরুপল্লী এবং গুরূক্ত কামনার বর্ণগুলিকে সহজ স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে বলছে– এই মর্ত পৃথিবীর মানুষগুলির বহুতর কামনাই তো থাকার কথা–পুরুকামো হি মর্তঃ। পরিশেষে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিষ্য জানাচ্ছে– আমার গুরু অগস্ত্য সংযমসিদ্ধ উগ্রতপা মহর্ষি। তিনি পুত্রলাভের জন্য আপন ধর্মপত্নীর সঙ্গে সঙ্গত হয়ে আপন বংশের গতি সুস্থির করেছেন। এইভাবে আমার গুরু পুত্রকামনার মাধ্যমে যেমন রতিসম্ভোগ সাধন করেছেন, তেমনই জপ-ধ্যান তপস্যার সংযমও সাধন করেছেন উভৌ বর্ণাবৃষিরুগ্রঃ পুপোষ। সত্যা দেবেম্বাশিষো জগাম।

বেদে উল্লিখিত লোপামুদ্রার কাহিনিটিই বোধহয় পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্যিক উপাদান, যা সামাজিক তথা ঐতিহাসিক দিক থেকে এক বিবাহিতা রমণীর অন্তরঙ্গ সম্ভোগেচ্ছার কথা স্পষ্টভাবে সেই রমণীর মুখ দিয়েই বলিয়েছে। মহাভারতে লোপামুদ্রার বক্তব্যের তীব্রতা অনেক পরিশীলিত, যৌনতার শব্দ সেখানে স্তব্ধ হয়ে এসেছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় এবং ব্যঞ্জনার আড়ম্বরে। পুত্রার্থে বিবাহের প্রয়োজন এবং পুত্রের প্রয়োজন বংশরক্ষার জন্য– এই স্থূল আর্য অধ্যবসায় বৈদিক সূক্তের শেষ ছত্রে অন্তেবাসী এক ছাত্রের মুখে। ধ্বনিত হয় এবং তাতে এক রমণীর প্রজননী ভূমিকাটাই যেন মুখ্য করে তোলে এবং সেটা যেন গুরুস্থানীয় এক পুরুষেরও প্রধান প্রয়োজন বলে নির্ধারিত হয়। কিন্তু বেদের এই বিশেষ সূক্তের মন্ত্রভাগে শিষ্যের এই অবেক্ষণটুকুকে যদি বৈদিক সমাজমুখ্য এক মোড়লের স্কুল টিপ্পনী হিসেবেও ধরে নিই এবং সেটাকে যদি লোপামুদ্রা এবং অগস্ত্যের দাম্পত্য কথোপকণ্বনের অংশ থেকে বাদও দিয়ে দিই, তাহলেও দেখব– লোপামুদ্রা বোধহয় পৃথিবীর প্রাচীনতম নারী, যিনি পুরুষের তীব্র ধর্মনিষ্ঠাকেও দাম্পত্যের বাইরে এক তীব্র আবেশ বলে চিহ্নিত করেছেন। পরবর্তী কালে যে স্বামীসেবা স্ত্রীলোকের কাছে অখিল ধর্মমূল তথা ধর্ম-কামার্থ-মোক্ষদা’ হয়ে উঠবে, সেই স্বামীসেবার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠাটাই প্রথমত এক চরম বিদ্রোহ। তার ওপরে লোপামুদ্রা সংযম-নিয়ম-নিষ্ঠ স্বামীর ঔদাসীন্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এখন। বলেছেন– অসম্ভোগে দিন কেটেছে আমার, আমি বুড়িয়ে গিয়েছি স্বামীর যৌনতাহীন অন্তহীন তপস্যায়, পুরুষ এবার আসুক তার স্ত্রীর কাছে– সমূ ন পত্নীৰ্বষভির্জগমঃ।

মহাভারত এইভাবে কথা বলে না। মহাভারত কাহিনি বলে, উপাখ্যানের মাধ্যমে সে বৈদিক-পরম্পরাকে ধরে রেখেছে মহাকাব্যের পরিমার্জন লেপন করে। সমাজের মধ্যে পৌরুষের প্রাধান্য বেড়ে ওঠায় সে বংশকর পুত্রজন্মের প্রয়োজনটাকেই যৌনতার প্রথম সূত্র হিসেবে দেখবে, কিন্তু প্রত্যেক দিনোদয়ে লোপামুদ্রার বৈদিক হতাশাকে মহাভারত কিন্তু কবির চেতনায় পরিশীলিত করেছে। ঋষি অগস্ত্যের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রার পার্থক্যটা প্রথমে সূচিত হয় একটা আর্থসামাজিক তথা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের নমুনা দিয়ে, কিন্তু কাহিনির বাঁধনটা শুরু হয় এক পৌরুষেয় পরাক্রমে এবং তা ঋষি অগস্ত্যকে দিয়েই। কীভাবে অগস্ত্য ইন্বল এবং বাতাপি দৈত্যকে বধ করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে অগস্ত্যের কাহিনি শুরু হয়, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা আবর্তিত হয় অগস্ত্যের জীবন-কাহিনির মধ্যে।

অগস্ত্য হঠাৎই একদিন তার প্রাচীন পূর্বপুরুষদের একটি গর্তের মধ্যে অধোমুখে ঝুলতে দেখেন। বস্তুত এ ধরনের প্রতীকী নরক, যা আমরা মহাভারতে একাধিক কাহিনিতে দেখেছি। আকাশের দিকে পা রেখে পিতৃপুরুষেরা অধোমুখে ঝুলছেন মানেই তাদের অধস্তন পুত্র এখনও বিবাহ করেননি এবং তার বংশধারা প্রবর্তিত হয়নি। জরায়ু-মধ্যস্থ সন্তান যেমন মাতৃগর্ভে বিপরীত দিকে মাথা রেখে জন্মানোর জন্য অপেক্ষা করে, পিতা পিতামহরাও তেমনই উলটো হয়ে ঝুলছেন পুত্র-কন্যা হয়ে জন্মানোর জন্য, প্রতীকীভাবে। অগস্ত্য জিজ্ঞাসা করতেই তাঁর পরলোকগত পিতা-পিতামহেরা একযোগে বললেন– তোমার মাধ্যমে আমাদের বংশ প্রতিষ্ঠিত না হলে আমাদের এই নরকেই পচে মরতে হবে। অগস্ত্য পিতৃপুরুষদের আর্তি শুনেই বললেন– আমি নিশ্চয়ই আপনাদের অভিলাষ পূরণ করব। আপনারা দুঃখ পাবেন না। তার মানে অগস্ত্যের বিবাহেচ্ছার মূলে আছে বংশকর পুত্রলাভের ভাবনা- যা চিরাচরিত ধর্মশাস্ত্রীয় নিয়মে ধর্মসঙ্গত বিবাহের মূল উদ্দেশ্য বলে মহাভারতও স্বীকার করে নেয়। কিন্তু কী অদ্ভুত দেখুন, পুত্রলাভের জন্য তো যে কোনও একটি সাধারণ রমণীই যথেষ্ট ছিল, অথচ অগস্ত্য সাধারণ কোনও রমণীর খোঁজ করেননি; কেননা, স্ত্রীলোকের খোঁজ করে নিজের যোগ্য কোনও রমণীই তিনি খুঁজে পেলেন না; যাঁর গর্ভে তিনি নিজেই পুত্র হয়ে জন্মাবেন– আত্মনঃ প্রসবস্যার্থে নাপশ্যৎ সদৃশীং স্ত্রিয়ম্।

মহা-মহর্ষির এই বাস্তব অনুসন্ধানের মধ্যে আমাদের মতো কলির জীবের কিছু ধর্মশাস্ত্রীয় সংশয় তৈরি হয় মনে মনে হয়, বিবাহের মুখ্য ফল যদি পুত্রলাভই হয়, তা হলে ধর্মশাস্ত্রীয় নিয়ম-মতে গৌণ ফল রতিক্রিয়ার জন্য অতিসুন্দরী রমণীর তো কোনও প্রয়োজন থাকে না। অথচ অগস্ত্য মুনির মতো এক মহর্ষিকে দেখছি- সাধারণ কোনও সুন্দরীকে দেখে তার মনেই হচ্ছে না যে, সে-রমণী তার সন্তান-ধারণের উপযুক্ত। এইখানটায় আমরা বুঝতে পারি যে, শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-ঋষি হলেও তার সামনে যখন কামনার রাজ্য উপস্থিত হয়, সেখানে তিনি অন্য সাধারণ মানুষের মতোই নিতান্ত মানবিক। আর এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, স্ত্রীলোকের সৌন্দৰ্য, আকর্ষণ এবং যৌবন বহিদৃষ্টিতে যতই পৌরুষেয় আকাঙ্ক্ষার বস্তু হোক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সেটাও কিন্তু শেষ জায়গায় ‘ফার্টিলিটি এবং উপযুক্ত সন্তান লাভের সঙ্গেই জড়িত। যে পুরুষ এক রমণীর পীন-পয়োধর দেখে মোহিত হচ্ছে এবং যেখানে সেই রমণীও তার পয়োধর-মাহাত্ম্যে গর্বিত, সেখানে বস্তু-বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু নির্বিকারভাবে বলবেন– উইমেন উই লার্জার ব্রেস্টস্ টেন্ড টু হ্যাভ হায়ার লেভেলস্ অব হরমোন ওস্ট্রেডিয়াল এ্যান্ড প্রোজেস্টেরোন হুইচ বোথ প্রোমোট ফার্টিলিটি। তার মানে যে পুরুষ ভদ্রলোক মিলন-কামনায় অতিসুন্দরী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তার রতি-ভাবনার অন্তস্তলে কিন্তু সন্তানলাভের শাস্ত্রীয় কামনাটাই সিদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ আমরা বলতে চাই– অগস্ত্য মুনি একজন ঋষি হওয়া সত্ত্বেও একটি সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে চাইছেন– এই ভাবনার মধ্যে ঋষিজনোচিত কোনও অশোভন ব্যবহার নেই।

যাই হোক, উপযুক্ত কন্যার অভাবে অগস্ত্য আপন আর্ষ প্রভাবে নিজেই নিজের জন্য এক কন্যারত্ন সৃষ্টি করলেন এবং তা করলেন মনে-মনে সমস্ত প্রাণীর সর্বোৎকৃষ্ট অঙ্গটি একত্র সংযোজিত করে স তস্য তস্য সত্ত্বস্য তত্তদমনুত্তমম্। ঠিক এই সময়ে বিদর্ভদেশের রাজা সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন। অগস্ত্য তার সংকল্পিত মনোময়ী রমণীটিকে স্থাপন করলেন বিদর্ভরাজার স্ত্রীর গর্ভে। বিদর্ভ-রাজমহিষীর গর্ভে কন্যা জন্মাল যেন সন্ধ্যাবেলায় বিদ্যুতের চমকানি লাগল সবার চোখে, কন্যা বড় হতে থাকল জলে বাড়তে থাকা পদ্মিনীর মতো, কাঠে জ্বলতে-থাকা অগ্নিশিখার মতো অপৃস্বিবোৎপলিনী শীঘ্রমগেরিব শিখা শুভা। কন্যার নাম হল ললাপামুদ্রা। মুদ্রা’ বা ‘আমুদ্রা’ মানে চিহ্ন, পণ্ডিতেরা বলেছেন লোপামুদ্রা বড় হতে থাকলে সৌন্দৰ্য-মাধুর্যের অন্যত্র-স্থিত সমস্ত চিহ্ন যেন লুপ্ত হয়ে গেল, সেইজন্যই তার নাম হল লোপামুদ্রা। রাজার ঘরে মেয়ে বলে ঐশ্বর্য এবং প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হতে লাগলেন তিনি। দাস-দাসী-সখীরা সব সময় তাকে ঘিরে রাখে। লোপামুদ্রা পূর্ণ যৌবনবতী হলেও বিদর্ভরাজের ব্যক্তিত্ব এবং লোপামুদ্রার সৌন্দর্য্যের তীক্ষ্ণতায় কোনও রাজপুত্র অথবা রাজপুরুষই তার ধারেকাছে আসার সাহস পেল না। তার পিতা বিদর্ভরাজও অত্যন্ত চিন্তিত হলেন– কার হাতে এই আগুনপানা সুন্দরী মেয়েটিকে তুলে দেবেন– মনসা চিন্তয়ামাস কস্মৈ দদ্যামিমাং সুতাম।

হয়তো এটাই মহাকাব্যিক অভিসন্ধি ছিল অগস্ত্যের বধূ হিসেবে লোপামুদ্রার তৈরি হয়ে ওঠার মধ্যে। লোপামুদ্রার রূপ স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের চাইতেও বেশি অথচ তিনি অত্যন্ত সদাচারসম্পন্না– সা তু সত্যবতী কন্যা রূপেণাঙ্গরসোপ্যতি– কোনও রাজপুরুষও তার কাছে ঘেঁষছেন না তার পিতার ভয়ে– এটা মহাভারতীয় তথ্য। যদিও মহাভারতে এমন খবর আর পেয়েছি বলে মনে হয় না। কেননা, রাজপুরুষেরা কন্যাপিতার ভয়ে যৌবনবতী রমণীকে এড়িয়ে যাচ্ছেন– ন বব্ৰে পুরুষঃ কশ্চিদ ভয়াত্তস্য মহাত্মনঃ– এমন হীনবীর্য পুরুষের কথা মহাভারতের কবি অন্য কোথাও বর্ণনা করেননি। আসলে অগস্ত্য ঋষির ভবিষ্যৎ-পরিগ্রহের কারণেই লোপামুদ্রার এই বিপ্রতীপ সংস্থান– তিনি আচারবতী, যৌবনবতী, পিতার ঘরে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী কিন্তু বৈদিক গ্রন্থে যেহেতু কোনও কাহিনি নেই এবং যেহেতু লোপামুদ্রা সেখানে যৌবন ব্যর্থ হবার প্রতিবাদ-শব্দ উচ্চারণ করছেন, অতএব তার কাহিনি সাজাতে হচ্ছে লোপামুদ্রার রূপ-গুণ এবং সামাজিক সচ্ছলতার পূর্বসিদ্ধি প্রতিষ্ঠা করে।

মহাভারতে ঋষি অগস্ত্য নিজেই তার ভবিষ্যৎ-পত্নীর স্রষ্টা। অতএব যৌবনস্থা এবং বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি বিদর্ভ রাজ্যে এসে কন্যাপিতার কাছে লোপামুদ্রার পাণিপ্রার্থনা করলেন। এক মহাশক্তিধর মুনি তার মেয়েকে চাইছেন– বিদর্ভরাজ এতে গৌরবও বোধ করলেন যেমন, তেমনই তার মনে দুঃখ হল মেয়ের জন্য। ভোগ-ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিতা কন্যাটি ঋষির ঘরের ত্যাগ-বৈরাগ্য সহ্য করতে পারবে তো? অগস্ত্যের প্রার্থনা শুনে তিনি তাই কিছুই বলতে পারলেন না, তিনি না পারছেন এই প্রার্থনা স্বীকার করতে না পারছেন ঋষিকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রত্যাখ্যানায় চাশক্তঃ প্ৰদাতুঞ্চৈব নৈচ্ছত। রাজমহিষীর সঙ্গেও অনেক আলোচনা করলেন বিদর্ভরাজ, রানী মেয়ের ভবিষ্যৎ-পরিণতির কথা ভেবে কোনও কথাই বলতে পারলেন না। এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় লোপামুদ্রা নিজেই পিতার কাছে এসে অগস্ত্যের প্রার্থনা পূরণ করতে বললেন এবং অভিশাপ-ভয় থেকে মুক্ত হতে বললেন তাকে। মেয়ের কথার মধ্যে যুক্তি আছে বুঝেই বিদর্ভরাজ বৈদিক বিধিতেই মেয়ের বিবাহ দিলেন অগস্ত্যের সঙ্গে।

স্বাভাবিক ভাবেই লোপামুদ্রার বধূবেশে রাজার ঐশ্বর্য আহিত ছিল–মহামূল্য অলংকার, রক্ত-কৌষেয় বাস উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল সকলের চোখে। মহামুনি অগস্ত্য অবশ্যই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তিনি নিজের সঙ্গে লোপামুদ্রাকে নিয়ে যাবার আগেই বললেন তুমি এইসব মহামূল্য বস্ত্র-অলংকার ত্যাগ করে আমার সঙ্গে চলো– মহাহাণুৎসৃজতানি বাসাংস্যভরণানি চ। লোপামুদ্রা স্বামীর কথা সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে চীরবাস, বল্কল এবং মৃগচর্ম– ততশ্চীরাণি জগ্রাহ বল্লাল্যজিনানি চ–মুনি-ঋষির উপযুক্ত বৈরাগ্যের সাধন। এই পতিধর্মানুবর্তিতা অথবা সহধর্মচারিতার আচরণ নববধূ হিসেবে লোপামুদ্রার পক্ষে খুবই প্রশংসনীয় হলেও ব্যাপারটা যৌবনবতী এক রাজনন্দিনীর পক্ষে যে বিপরীত কর্ম ছিল, তা এই মুহূর্তে মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন লোপামুদ্রার ওপর ‘রম্ভোরু’ এবং ‘আয়তেক্ষণা’ শব্দ-দুটি প্রয়োগ করে। কবি বললেন– কদলী-স্তম্ভের মতো যাঁর উরুদেশ এবং যিনি আয়তলোচনা, তিনি স্বামীর অনুশাসন মেনে মূল্যবান বসন ত্যাগ করলেন– সমুৎসসর্জ রম্ভোব্ধ-বসনান্যায়তেক্ষণা। অর্থাৎ এ-হেন সুন্দরীও চীর-বন্ধল ধারণ করলেন, সেটা খানিক বেমানানই লাগছিল।

অগস্ত্য লোপামুদ্রাকে নিয়ে গঙ্গাদ্বারে চলে গেলেন শ্বশুরের রাজবাড়ি ছেড়ে। সেখানে অনুবর্তিনী লোপামুদ্রার সঙ্গে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলেন। তপস্যার কৃচ্ছ্বসাধনে ব্যাপৃত অগস্ত্য মুনির সেবা-পরিচর্যা করাটা ছিল লোপামুদ্রার তপস্যা। পরম আদরে এই পরিচর্যা করছিলেন বলেই তার শরীরের মধ্যে এক অলৌকিক উজ্জ্বলতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল– সা প্রীতা বহুমানাচ্চ পতিং পৰ্য্যচরত্তথা। এমন বশবর্তিনী স্ত্রীর ওপরে অগস্ত্য মুনিরও প্রীতি কম ছিল না। তিনিও যথেষ্ট ভালবাসতেন তার স্ত্রীকে। কিন্তু শম-দমাদি-সাধনের নিরিখে তার ভালবাসাটা শরীরের পর্যায়ে যাবার আগেই কুণ্ঠিত হত। কিন্তু একদিন লোপামুদ্রাকে দেখে অগস্ত্যের বাসনালোক উন্মথিত হয়ে উঠল। এত দিন তপস্যার কারণে অগস্ত্য যেন খেয়ালও করেননি পরিচর্যায় অভ্যস্তা স্ত্রীকে ততো বহুতিথে কালে লোপামুদ্রাং বিশাম্পতে। কিন্তু সেদিন লোপামুদ্রাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল যেন। ঋতুকাল উত্তীর্ণ হবার পর তিনি স্নান করেছেন। স্ত্রীজনোচিত উর্বরতা এই মুহূর্তে যে ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করেছে তার শরীরে অগস্ত্য যেন সেটা নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তপসা দ্যোতিতাং মাতাং দদর্শ ভগবানৃষিঃ। অগস্ত্যের মন বুঝে মহাভারতের কবি লোপামুদ্রার এই ঔজ্জ্বল্যের কারণ নির্ণয় করে বলেছেন– অগস্ত্য বড় আনন্দিত হয়েছেন তার পরিচর্যায়, পবিত্রতায়, ইন্দ্রিয়দমনের ক্ষমতায় এবং তার সৌন্দৰ্য-মাধুর্যে। প্রথম তিনটি পরিচর্যা, পবিত্রতা এবং ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ যদি অগস্ত্যের মনে নিতান্ত এক পৌরুষেয় সন্তোষ তৈরি করে থাকে, তবে তার এই মুহূর্তের আকর্ষণ লোপামুদ্রার সৌন্দৰ্য– অগস্ত্য সোজাসুজি মৈথুনের আগ্রহ প্রকাশ করলেন– শিয়া রূপেণ প্রীতো মৈথুনায়জুহাব তাম্।

এত পরিষ্কার স্পষ্ট এবং সাগ্রহ এই পৌরুষেয় আহ্বান যা শুধু পৌরুষেয়তার কারণেই অপ্রতিরোধ্য এবং অনিবার্য ছিল চিরকাল, বিশেষত তপস্যা-নিষ্ঠ এক মুনির দিক থেকে এতটাই কৃপার মতো শোনায় যে, তাতে ব্রত-নিয়ম-পরিচর্যায় এতকাল অপেক্ষমাণ এক যৌবনবতী রমণী সমান আগ্রহে সাড়া দেবে- এটা তো সাংস্কারিকভাবে নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এই প্রথমে ভেসে এল সেই শান্ত-মধুর প্রতিবাদ– যা বেদের মন্ত্রে লোপামুদ্রার মুখে একই রকম ‘ব্লেটান্ট’– এতদিন তোমার পরিচর্যা করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমার জীবনের কতগুলি শরৎকাল কেটে গেল, প্রতিটি সকালে আমি কেমন বুড়িয়ে গেছি এতকাল ধরে– পূর্বীরহং শরদঃ শশ্ৰমাণাঃ। দোষাবস্তোরুসসা জরয়ন্তী। মহাভারত লোপামুদ্রাকে এই স্পর্শ-মুখরতা থেকে সরিয়ে এনে তাকে তার সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছে। লোপামুদ্রা এতকালের তপোদৃষ্টিতে এটা বুঝে গেছেন নিশ্চয় যে, তাঁর স্বামী তার পিতৃলোকের সন্তান-বৃদ্ধির কামনা পূরণ করতে গিয়ে শুধু সন্তান লাভের জন্যই প্রথমত লোপামুদ্রার পাণিগ্রহণ করেছেন। কিন্তু অগস্ত্যের মনেও রমণীর উপভোগ্যতার বিষয়টি নিশ্চয়ই আহিত ছিল, তা নইলে নিজের জন্য কোনও উপযুক্ত রমণী তিনি খুঁজেই পেলেন না এবং সেই অন্বেষণার হৃদয় নিয়েই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন লোপামুদ্রাকে।

লোপামুদ্রা ঋষি-স্বামীর হৃদয়টুকু জানেন বলেই এতকালের শারীরিক অনভিনন্দন তার সহ্য হল না। কিন্তু এখন সেই বৈরাগ্যবান স্বামীর মুখে মৈথুনের আহ্বান শুনে তিনি একেবারে উপবাসী বুভুক্ষুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন না। লোপামুদ্রা খানিক লজ্জা পেলেন– লজ্জমানেব ভাবিনী এবং সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান বাক্য উচ্চারণ করলেন মহাকাব্যিক উদারতায়। লোপামুদ্রা বললেন– ঋষি! তুমি আমাকে পুত্রলাভের জন্যই ভার‍্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলে, সে কথা আমি জানি– অসংশয়ং প্রজাহেতোৰ্ভাৰ্যাং পতিরবিন্দত। লোপামুদ্রা সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন যে, পুত্রলাভের ওই যান্ত্রিকতার চেয়েও আরও বেশি কিছু কাম্য আছে তার এবং তিনি বলেও ফেললেন সে কথা। বললেন- তুমি শুধুই সন্তান চাইলেও এখানে আমারও কিছু ইচ্ছে-অনিচ্ছে অথবা ভাল লাগার প্রশ্ন আছে এবং সেটা তোমায় আগে মেটাতে হবে– যা তু ত্বয়ি মম প্রীতিস্তামৃষে কর্তুমহসি।

লোপামুদ্রা বোঝাতে চাইলেন যে, বিবাহ মানেই শুধু চিরাচরিত সঙ্গমের এক যান্ত্রিক অনুষঙ্গ নয়, পুত্রলাভের হেতুটা সেখানে স্মার্ত নিয়মে মুখ্য হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তার মাধ্যম রতি, রমণ শৃঙ্গার কোনও গৌণ যান্ত্রিকতা নয়, বস্তুত তারও একটা প্রস্তুতি আছে। লোপামুদ্রা বললেন আমার পিতার ভবনে অট্টালিকার ভিতর আমার মহার্ঘ শয্যা ছিল, আমি চাই সেইরকম এক শয্যায় তোমার সঙ্গে মিলন হোক আমার– তথাবিধে ত্বং শয়নে মামুপৈতুমিহাহসি। স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গমে অন্যতর উপাদান হল শৃঙ্গারোচিত বেশ। আমি চাই তুমি অলংকার পরে মালা-চন্দনে বিভূষিত হয়ে আমার কাছে এসো। এবং আমিও চাই বিভূষিতা হতে, মাল্য-চন্দনের গন্ধে আমোদিত হয়ে তোমাকে লাভ করতে চাই আমি– উপসতুং যথাকামং দিব্যাভরণ-ভূষিতা। এবারে লোপামুদ্রার কণ্ঠে ভেসে এল সেই বৈদিক হাহাকার, যেটাকে মহাভারতীয় ভাষায় প্রকাশ করলে প্রত্যাখ্যানের ব্যঞ্জনাটুকু ঠিক ধরা পড়ে। লোপামুদ্রা বললেন– যদি এমন অলংকার-বিভূষণে উৎকৃষ্ট শয্যায় তুমি আমার কাছে আসো, তবেই সেই মিলন হবে আমাদের, তা নইলে এই গৈরিক কৌপীন ধারণ করে তোমার সঙ্গে আমি মিলিত হতে চাই না– অন্যথা নোপতিষ্ঠেয়ং চীর-কাষায়বাসিনী।

লোপামুদ্রার কথাবার্তা শুনে বরঞ্চ আমাদের নিন্দমুখর মুখে এটা বলে দেওয়াই সহজ যে– এই তো স্ত্রী-হৃদয়ের গোপন কথাটা ইনিয়ে-বিনিয়ে ঠিক বেরিয়ে এসেছে। মনের মধ্যে ভোগ-লালসা, টাকা-পয়সাওয়ালা স্বামী, খাট-বিছানা-ড্রেসিং টেবল সব রয়েছে, আর বাইরে এতদিন ছেঁড়া কাপড় আর গলায় সুতো পরার গৌরব দেখাচ্ছিলি। সময়কালে এখন গয়না-বেনারসি কিনে নিয়ে আয়, তবে তোর মতো স্বামীর সঙ্গে সোব– এই তো দাঁড়াল, চিরকালীন স্বল্প-মধ্যবিত্ত ঘরের মশারি-খাটানোর শব্দ। এর উত্তরে মহাকাব্যের উদার বোধ থেকে জানাই লোপামুদ্রার মুখে এই শাড়ি-গয়নার কথাটা এত আক্ষরিক অভিধায় গ্রহণ করলে চলবে না। কেননা বৈরাগ্য-সাধক স্বামীকে যদি তার ভাল না লাগত কিংবা তিনি যদি তাকে ভাল না বাসতেন, তা হলে স্বেচ্ছায় অগস্ত্য মুনিকে বিয়ে করতেন না, কিংবা বিয়ের পরের দিন থেকে তিনি স্বামীর হাত ধরে যোগিনী হয়ে আসতেন না গঙ্গাদ্বারে।

বরঞ্চ এইখানেই তার প্রতিবাদ– তুমি বিয়ে করে সংসারী হলে, অথচ গার্হস্থ্য ধর্মে স্ত্রীকে পাশে শুইয়ে তুমি ঊর্ধরেতা পুরুষ হয়ে জীবন কাটাবে- এমন বঞ্চনা কেন নেমে আসবে এক বিবাহিতা রমণীর ওপর। এখানে লোপামুদ্রার মুখে শাড়ি-গয়নার উচ্চারণটা প্রথমত এক প্রতীকী প্রতিবাদ এবং তিনি যেহেতু অগস্ত্য ঋষিকেও বিভূষণ-মণ্ডিত হয়ে শয্যায় আসতে বলেছেন, তাতে বোঝা যায় যে, এটা সেই শৃঙ্গার-মৈথুনের বঞ্চনা যা বৈদিকী লোপামুদ্রার শব্দমন্ত্রে স্পষ্টভাবে ধ্বনিত হয়েছিল। আমাদের ভরতের নাট্যশাস্ত্রে শৃঙ্গার রসের আলোচনায় একটা ভীষণ গভীর কথা আছে। শাস্ত্রকার বলছেন– শৃঙ্গার রসের স্থায়ীভাব হল রতি। শৃঙ্গারের চেহারাটা উজ্জ্বল। উজ্জ্বল তার বেশবাস। এই পৃথিবীতে যা কিছুই শুভ্র-শুচি এবং পবিত্র, যা কিছুই খুব উজ্জ্বল এবং দর্শনীয়, তার সঙ্গেই শৃঙ্গারের তুলনা হতে পারে অথবা সেখানেই শৃঙ্গার শব্দটা খাটে– যৎকিঞ্চিল্লোকে শুচি মেধ্যম উজ্জ্বলং দর্শনীয় তণ্ডুঙ্গারেপোপমীয়তে। লক্ষণীয়, শৃঙ্গারের মধ্যে এই উজ্জ্বলতার ভাবনাটা এতটাই প্রখর এবং গম্ভীর হওয়ার ফলেই বৈষ্ণব রসশাস্ত্রকারেরা– যাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বৈতিহ্যবাহী চৰ্চিত শব্দ পরিহার করেন, তারাও কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের চরম রস-পরিণতিতে শৃঙ্গার শব্দটা পরিহার করে ভরত-মুনি-কথিত ‘উজ্জ্বল’ শব্দটিকে বহু সমাদরে গ্রহণ করেছেন যার সুফল রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বল-নীলমণি।

আমরা এবার লোপামুদ্রার বক্তব্যে সেই মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাটা পরিষ্কার করে দিয়ে বলি– তিনি প্রিয়মিলনের জন্য নিজের এবং তাঁর স্বামীর সালংকার উজ্জ্বল উপস্থিতিটুকু যেভাবে চাইছেন– ইচ্ছামি ত্বাং থিনঞ্চ ভূষণেশ্চ বিভূষিত তার অর্থ এই অভিধেয় বেশ-বাস অলংকার নয়, সেটা আসলে শৃঙ্গার এবং তার স্থায়ী ভাব হল রতি–সেটা থেকে এতকাল তিনি বঞ্চিত। লোপামুদ্রা বলেছেন– এত দিন তোমার সহধর্মচারিত্বের এই বেশ চীর-বল্কল যেমন পবিত্র, তেমনই আমাদের মিলনের জন্য আমার প্রার্থিত উজ্জ্বল বেশ বাস-ভূষণও কোনও ভাবেই অপবিত্র নয় নৈবাপবিত্রো বিপ্রর্ষে ভূষপণাহয়ং কথঞ্চন।

মিলনের জন্য উদ্যত পুরুষ অগস্ত্য এতকালের সেবাবৃত্তি-অভ্যস্ত স্ত্রীর কাছে এমন একটা উত্তর শুনবেন এমন আশঙ্কা করেননি। অগস্ত্য অবশ্য এতটুকুও রাগ করলেন না, অন্যান্য মুনি-ঋষিদের মতো এতখানি পৌরুষেয় নন তিনি। তিনি ধর্মপত্নীকে বুঝেছেন সমবেদনাতে, কিন্তু এমন প্রত্যুত্তরে, সাংস্কারিকভাবে অনভ্যস্ত বলেই এক নিঃশ্বাসে তিনটি সম্বোধন করে বললেন– কল্যাণী, সুমধ্যমে, আমার লোপামুদ্রা! তুমি তোমার পিতার ঘরের আসন-বসন-আভূষণের কথা বলছ, তেমন ধন তো আমার নেই, আর তোমারও নেই– ন তে ধনানি বিদ্যন্তে লোপামুদ্রে তথা মম। লোপামুদ্রা আর এতটুকুও আঘাত করেননি। বলেছেন– তোমার অসাধ্য কিছু আছে নাকি, তপস্বী আমার! এই জীবলোকে যা ধনৈশ্বর্য লাভ করা সম্ভব, সে সব কিছুই তুমি তপস্যার বলে এনে দিতে পারো আমাকে। অগস্ত্য বললেন–হয়তো তা পারি, এটা সত্য। কিন্তু তাতে তপস্যার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়– এবমেত যথার্থ ত্বং তপোব্যয়করন্তু তৎ। বরঞ্চ তুমি সেইরকম কিছু বলা যাতে আমার তপস্যার তেজ নষ্ট না হয়ে যায়।

শাস্ত্র এবং বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ে এইরকম একটা কথা চালু আছে বটে যে, ঈশ্বর সন্নিধানের জন্য ধ্যান-জপ-তপস্যার সিদ্ধি যদি জাগতিক লাভের জন্য ব্যয়িত হয়– এমনও হতে পারে, তাতে শিষ্য, আত্মীয়, পরিজনের উপকার হচ্ছে, নিজের কিংবা অন্যের রোগ ব্যাধি পর্যন্ত নিরাময় হচ্ছে কিন্তু সিদ্ধি বা সিদ্ধাই-কে এইভাবে ব্যবহার করার জন্য নিজের যোগসিদ্ধি ব্যাহত হয়। তপঃক্ষয় হয় নিজের বা অন্যের কর্মবিপাক রোধ করার কারণে। ঈশ্বর-প্রণিধান অথবা মহৎকৃপায় যে কৃপাসিদ্ধি অথবা সাধনসিদ্ধি ঘটে, সেটাকে কর্মবিপাক রোধ করার জন্য ব্যবহার করলে ঐহিক-লৌকিক কিছু লাভ হয় বটে কিন্তু তাতে তপস্যার শক্তি নষ্ট হয়– অগস্ত্য সেই কথাই বলছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার স্ত্রী লোপামুদ্রা যা চাইছেন, সেই প্রার্থনার মধ্যে শত ভাগ যৌক্তিকতা আছে বলেই তিনি সানুনয়ে বলছেন– তুমিই বলল না কী করা যায়? যাতে আমার তপঃশক্তি নষ্ট না হয়, অথচ তোমার প্রার্থনাও পূরণ করতে পারি, সে রকম একটা উপায় তুমিই বলো না।

লোপামুদ্রা এতটুকুও বিগলিত হলেন না এই প্রস্তাবে। তিনি জানেন যে, সহধর্মচারিণী পত্নীরা স্বামীদের এই সানুনয় প্রার্থনা অবশেষে মেনে নেন, স্বামীদের আত্মলাভের প্রক্রিয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ান না। কিন্তু লোপামুদ্রাকে বেশ কঠিন দেখাল। তিনি বললেন- আমার ঋতুকালের আর অল্পই অবশিষ্ট আছে এবং আমি যেমনটা চেয়েছি। তেমনটা না হলে কোনওভাবেই তোমার সঙ্গে একশয্যায় সঙ্গত হবো না আমি, এখানে অন্যরকম হবে না– ন চান্যথাহমিচ্ছামি ত্বমুপৈতুং কথঞ্চন। আমি নিশ্চয়ই চাইব না যে, আমার ইচ্ছাপূরণ করার জন্য তোমার তপঃক্ষয় হোক, কিন্তু প্রিয়মিলনের জন্য যে উপকরণটুকু আমি চেয়েছি, সেটা তোমাকে মেটাতেই হবে– এবন্তু মে যথাকামং সম্পাদয়িতুমহসি। অগস্ত্য লোপামুদ্রার কথা মানতে বাধ্য হলেন। কারণ, এটা তো তেমন কোনও দৈনন্দিন উদাহরণ নয়, যেখানে সাধের বস্তুটা না পেলে বিবাহিতা স্ত্রী মিলনোন্মুখ স্বামীকে বাধা দিচ্ছে, বিছানা ছেড়ে অন্য খাটে শুচ্ছে। তাদের সেই মিলনই তো হয়নি, বিবাহের পর থেকেই স্বামী তার আত্মোন্নতিতে ব্যস্ত আছেন– এখানে সেটা না হয় ঈশ্বর-প্রণিধানের মতো মহা-মহৎ কাজই হল; কিন্তু তবুও বিবাহিতা স্ত্রীকে দিনের পর দিন অবহেলা করে নিজে বড় হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে আদর্শ ভারতীয় রমণীদের একজন অন্তত স্বযুক্তিতে অবিচল থাকেন– লোপামুদ্রা সেই উদাহরণ। তিনি স্বামীকে তপস্যার অধ্যাত্মভূমি থেকে অবতরণ করে সেই লৌকিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেছেন– যে প্রস্তুতি একান্তভাবে তারই জন্য আয়োজিত, অথবা এক সার্থক যুগ্ম-মিলনের জন্য আকাঙিক্ষত।

লোপামুদ্রার ইচ্ছে মেনে অগস্ত্য বেরোলেন অর্থলাভের জন্য। অগস্ত্যের এই অর্থৈষণায় মহাভারত অন্য এক কাহিনির অবতারণা করেছে, সে-কাহিনি অর্থলাভের মুখ্য চেষ্টার মধ্যেও মহাকাব্যের গৌণ প্রয়োজন সিদ্ধ করে দেয় এবং লোপামুদ্রা সেখানে অপ্রত্যক্ষে যুক্ত থাকেন। অর্থলাভের চেষ্টায় অগস্ত্য প্রথম গেলেন তর্বা নামে এক রাজার কাছে। তা সানুবন্ধে অগস্ত্যকে মহাসমাদরে ঘরে বসালেন। অগস্ত্য বললেন আমার কিছু অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থ দিলে অন্য কারও যদি ক্ষতি না হয়, তবে সেই উদ্বৃত্ত অর্থ আমাকে আপনি দান করুন– যথাশক্তি-অবিহিংস্যান্যান সংবিভাগং প্রযচ্ছ মে। বোঝা যাচ্ছে, অগস্ত্য রাজার ওপরে অন্যায় চাপ তৈরি করছেন না। রাজা তর্বা সবিনয়ে জানালেন আমার রাজ্যে আয় যতটুকু হয় ব্যয়ও ততখানিই। অতএব উদ্বৃত্ত যদি কিছু থাকে বলে আপনি মনে করেন, তবে সেটা আপনি অবশ্যই নিতে পারেন। অগস্ত্য রাজার আয়-ব্যয় পরীক্ষা করে দেখলেন এবং বুঝলেন যে, তা রাজার কাছ থেকে অর্থ নিলে, সেটা প্রজাদের পীড়ন তৈরি করবে। তিনি অর্থ নিলেন না, কিন্তু তা রাজাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গেলেন ব্রধশ্ব রাজার কাছে তিনিও একই কথা বললেন শ্রুতৰ্বার মতো। মহাভারতের কবি এইভাবে পরপর তিন জন রাজার নাম করলেন, যার শেষে ছিলেন পুরুকুৎস-বংশীয় সদস্য। তিন জন রাজাই নিজেদের আয়-ব্যয়ের সমতার কথা জানিয়ে অগস্ত্যের প্রার্থনা-পূরণে নিজেদের অক্ষমতা জানালেন এবং অবশেষে তিনজনে মিলে ঠিক করলেন যে, রাজাদের মধ্যে দানব ইল-ই একমাত্র ধনী যে কিনা এই রাজাদেরও ধন দিতে পারে এবং অগস্ত্যকেও প্রার্থিত সম্পদ দিয়ে সুখী করতে পারবে। অগস্ত্য এবার সেই রাজাদের নিয়ে ইল-দানবের কাছে গেলেন।

মহাভারত এরপর সেই বিখ্যাত ইহুল-বাতাপির গল্প বলেছে এবং আমরা জানি বাতাপি অগস্ত্যের বিভূতিতে মারা পড়েছিল। ভয়ভীত ইল তখন সেই রাজাদেরও যেমন অশ্ব, রথ, গোধন এবং অর্থ দান করেছিল, তেমনই তার দ্বিগুণ অর্থ-ধন, রথ-অশ্ব-গোধন দিয়ে অগস্ত্যকে সম্মানিত করেছিল। পৌরাণিক কবি বিশিষ্ট বিভূতিময় পুরুষকে দিয়ে এক কাজে দুই কাজ সম্পন্ন করলেন। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল এই যে, অগস্ত্য ন্যায়োপার্জিত অর্থ নিয়ে লোপামুদ্রার কাছে ফিরে এলেন এবং ফিরে এলেন সেইভাবে, যেমনটা লোপামুদ্রা অগস্ত্যকে দেখতে চেয়েছিলেন– কৃতবাংশ্চ মুনিঃ সর্বং লোপামুদ্রা-চিকীর্ষিতম্। সেই মহার্ঘ শয্যার ব্যবস্থা হল, অগস্ত্য বিভূষিত শৃঙ্গারোচিত বেশ-বাসে, আভরণে এবং তাকে দেখে লোপামুদ্রা বললেন– আমি যেমন যেমন চেয়েছিলাম, স্বামী! তুমি সব আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করেছ কৃতবানসি তৎ সর্বং ভগবন্ মম কাঙিক্ষত– এবার এসো আমার গর্ভে এক শক্তিশালী পুত্র উৎপাদন করো।

লোপামুদ্রা এবার আবেগ-মুখর শৃঙ্গার সরসতার শব্দগুলি অখিল প্রাচীন পুরুষকুলের সাংস্কারিকতায় আবদ্ধ করলেন–যেন পুত্রলাভের জন্যই এসব কথা বলেছিলেন তিনি। কথাটা বৈদিকী লোপামুদ্রার সার্বিক হতাশার সঙ্গেও মিলে যায়। সেই ঋষিপত্নীরা– যাঁরা এতকাল স্বামীর সঙ্গে সংযম, নিয়ম আর তপস্যায় স্বামীর সহধর্মিণী হয়ে বঞ্চিত জীবন কাটাচ্ছেন, এবার সময় এসেছে তাদের, এবার তারা সম্ভোগে মিলিত হোন কামুক স্বামীদের সঙ্গে সমূ নু পত্নীৰ্বষভির্জগমুঃ।

সত্যি বলতে কী, অগস্ত্য ঋষিও বোধহয় প্রথম সেই বৈদিক এবং মহাকাব্যিক পুরুষ যিনি স্ত্রীহৃদয়ের শৃঙ্গারোৎসিক্ত মর্মকথাটুকু বুঝেছেন। লোপামুদ্রার আকাঙ্ক্ষা-পূরণের পর এবার যখন তার মুখেই সন্তান-লাভের যৌন বার্তা ভেসে আসছে– এবার আমার গর্ভে অপত্য উৎপাদন করো– উৎপাদয় সকৃনমহ্যম অপত্যং বীর্যবত্তরম– তখন অগস্ত্য বুঝিয়ে দিয়েছেন– পৌরুষেয়তায় স্ফীত অন্য পুরুষের মতো ব্যবহার করেননি তিনি। তিনি স্ত্রীর মন বুঝেছেন, তাঁকে মর্যাদা দিয়েছেন, তাকে সমর্থন করে বলেছেন– তোমার চরিত্র, তোমার আচার-ব্যবহারে আমি সম্পূর্ণ সুখী হয়ে আছি– তুষ্টোহহমস্মি কল্যাণি তব বৃত্তেন শোভনে। এমনকী পুত্রলাভের ক্ষেত্রেও অগস্ত্য মত নিচ্ছেন লোপামুদ্রার। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন– তুমি দশটি উৎকৃষ্ট পুত্রের মতো একটি পুত্র চাও, নাকি শতপুত্রের সংখ্যামোহে দশটি পুত্র চাও। লোপামুদ্রা বিদ্যাশিক্ষিতা এক রমণীর মতো ততোধিক শক্তিতে উত্তর দিয়ে বললেন- সহস্র পুত্রের তুল্য একটিই মাত্র বিদ্বান পুত্র চাই আমি। কেননা বহুতর মূর্খ পুত্রের চাইতে একটি বিদ্বান পুত্র অনেক বেশি আকাঙিক্ষত– একো হি বহুভিঃ শ্রেয়ান বিদ্বান্ সাধুরসাধুভিঃ।

মুনি বললেন– তবে তাই হোক। মহাভারতের নিরপেক্ষ কবি মন্তব্য করলেন– সেই মহান মুহূর্ত ঘনিয়ে এল যখন এক সমস্বভাব সমশীল পুরুষ সমানশীলা রমণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। সেই মহান মুহূর্ত ঘনিয়ে এল– যখন স্ত্রীর প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল এক পুরুষ সমান-শ্রদ্ধাশীলা এক রমণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন– সময়ে সমশীলিন্যা শ্রদ্ধাবান শ্ৰদ্ধানয়া।

লোপামুদ্রার আকাঙ্ক্ষিত মিলন সম্পূর্ণ হল। অগস্ত্যের ঔরসে তার প্রিয় পুত্রের নাম দৃঢ়স্যু ইধুবাহ। মহাভারতের কণ্বক ঠাকুর এই পুত্রের আখ্যা দিয়ে বলেছেন- লোপামুদ্রার গর্ভচ্যুত হয়ে জন্মালেন এক মহাকবি– প্রাচ্যবৎ স মহাকবিঃ– এমন সমশীল সমবোধী জনক-জননীই তো ভূয়োদশী কবির জন্ম দিতে পারেন, যেমনটা লোপামুদ্রা এবং অগস্ত্য দিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *