লক্ষ্য ও পন্থা
আপনার একমাত্র লক্ষ্য যদি হয়: মাথা ধরা ভালো করা, তা হলে তার মোক্ষম ওষুধ বলে দিতে পারি। আপনাকে! প্যারাসিটামল অথবা অ্যাসপিরিন নয়–তার থেকে অনেক কার্যকর। মাথাটা কেটে ফেলুন, ব্যস, মাথা ধরা সেরে যাবে। গ্যারিন্টি দিতে পারি! তবে আপনি একে গ্রহণযোগ্য সমাধান বলে মেনে নেবেন কিনা, সে আপনিই জানেন। অন্য পন্থাও আছে। ওষুধ খেয়ে ভালো হতে পারে। কিছুক্ষণ শান্ত থাকলে অথবা বিশ্রাম করলে ভালো হতে পারে। এমন কি, এমনিতেও ভালো হতে পারে। অর্থাৎ লক্ষ্য নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিতর্কটা পন্থা নিয়ে। আমার বিবেচনায় মাথা ধরা ভালো করার জন্যে মাথা কেটে ফেলাটা মোটেই সন্তোষজনক পন্থা নয়। তার অর্থ লক্ষ্য অর্জনই একমাত্ৰ কাম্য হতে পারে না। কিভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন করছেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
খৃষ্টের জন্মের আগেই গ্ৰীক নাট্যকার সোফোক্লিস বলেছিলেন যে, ভালো লক্ষ্য হাসিল করতে গিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়া অন্যায় নয়। রোম্যান কবি ওভিদও। বলেছিলেন কমবেশি একই কথা। এ রকমের দুজন বিখ্যাত লোক বলা সত্ত্বেও, লক্ষ্য লাভের জন্যে যে-কোনো পন্থার আশ্রয় নেওয়া যুক্তিযুক্ত অথবা নৈতিক–এ কথা অনেকেই মানতে পারেননি। বস্তুত, এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। কোন জিনিশটা ভালো, কোন জিনিশটা মন্দ, তার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যা চোরের কাছে ভালো, সেটা গৃহস্থের কাছে খারাপ। গরু, মরলে শকুনের জন্যে সেটা ভালো হয় বটে, তবে গরু অথবা গরুর মালিকের জন্যে সেটা আদৌ সুখবর নয়। কাজেই কোনটা ভালো, কোনটা ভালো নয়, সেই কটতর্কের মধ্যে না-গিয়েও কেবল লক্ষ্য এবং পন্থা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
বেশির ভাগ ধর্ম এবং নৈতিকতা অনুযায়ী লক্ষ্য ভালো হলেও অন্যায্য পন্থা গ্রহণের নীতিকে সমর্থন করা হয় না। মহাভারতের গল্প দিয়ে এর একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। দ্রোণাচাৰ্যকে সরাতে না-পারলে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ জয়ের কোনো উপায় ছিলো না। কৃষ্ণ জানতেন, দ্রোণাচার্যকে যদি বলা হয় যে, তাঁর পুত্ৰ অশ্বথামা নিহত হয়েছেন, তা হলে তিনি যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াবেন। কৃষ্ণের বুদ্ধিতে পাণ্ডবরা তাই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই চীৎকার করে বললেন “অশ্বথামা হত”। দ্ৰোণাচার্য বললেন যে, এ কথা তিনি বিশ্বাস করবেন যুধিষ্ঠির বললে। কিন্তু সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এই মিথ্যে বলতে রাজি ছিলেন না। তাই অশ্বখামা নামে ইন্দ্ৰবৰ্মার যেহাতিটি ছিলো, সেটি মেরে ফেলা হয়। তখন যুধিষ্ঠির চীৎকার করে বললেন, “অশ্বথামা হত।” তারপর গলা নামিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “… ইতি গজ।”— পুরো বাক্যটা দাঁড়ালো–অশ্বখামা হত ইতি গজ–অশ্বথামা নামে হাতি নিহত হয়েছে। দ্রোণাচার্য “ইতি গজ” শুনতে পাননি। যাতে শুনতে না-পান, তার জন্যেই যুধিষ্ঠির নিম্নকণ্ঠে ইতি গজ বলেছিলেন। অর্থাৎ তিনি যা বলেছিলেন, তা সত্য; কিন্তু পুরো সত্য নয়। এবং সেই অর্ধসত্য দ্ৰোণাচার্যের মৃত্যুর কারণ হয়। যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্য সফল করার জন্যেই যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে এই অর্ধসত্য বালানো হয়েছিলো। আর, এই অর্ধসত্য বলার জন্যে তাঁকে নরকে থাকতে না-হলেও মৃত্যুর পর নরক দর্শন করতে হয়েছিলো।
এ গল্প থেকে যা বোঝানো হচ্ছে, তা হলো ভালো কাজে সাফল্য লাভ করার জন্যেও খারাপ কাজ করা যাবে না। করলে তার জন্যে শাস্তি হবে। সুতরাং লক্ষ্য যতোই মহৎ হোক না কেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে অন্যায়কে সমর্থন করা যায় না–অন্তত নৈতিকতার বিচারে।
কিন্তু নীতিবাদ যা-ই বলুক না কেন, মতবাদ এবং আদর্শবাদে বিশ্বাসী লোকেরা নীতির কথা মানেন না। তাদের কাছে নীতি অথবা মানুষের চেয়ে মত এবং সে মতের বাস্তবায়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কথা হলো: মারি অরি পারি যে কৌশলে! দরকার হলে ছলে, বলে, কলে, কৌশলে, ন্যায্য, অন্যায্য যে-কোনো উপায়ে তারা চান তাদের মতবাদকে বাস্তবায়িত করতে। অনেক দার্শনিকই তাই ভালো উদ্দেশ্যের জন্যে যেটা কম খারাপ সেটাকে গ্ৰহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। ধরা যাক, সন্ত্রাসবাদীরা একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে একটা নগরীর আকাশে এসেছে। তারা এই বিমানের ধাক্কায় একটা উচু ভবন ধ্বংস করতে চাইছে। বিমানে আছেন শতাধিক যাত্রী। আর উচু ভবনটি ধ্বংস করলে মারা যাবেন হাজার হাজার লোক এবং প্রভূত ক্ষতি হবে ঐ নগরীর। এটা ঠেকানোর একটা উপায় হলো ভবনের ওপর ধাক্কা দেওয়ার আগেই ঐ বিমানটিকে ধ্বংস করা। অনেক দার্শনিকের কাছে এই বিমানটি ধ্বংস করা যুক্তিযুক্ত। কারণ, তার ফলে কম লোকের জীবন হানি হবে। কিন্তু নৈতিকতার দিক দিয়ে এটা কি সমর্থন যোগ্য? নীতিবাগীশদের মতে, এটা অনৈতিক কারণ ঐ শতাধিক নিরপরাধ যাত্রীরও বাঁচার অধিকার আছে। ছিনতাইকারীদের হাতে তারা মারা যেতে পারেন–মারা যাবেন এটা প্ৰায় নিশ্চিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা ভবনে আঘাত করবে। কিনা অথবা আঘাত করতে পারবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। এমন কি, আঘাত করলেও কোনো অলৌকিক কারণে কোনো কোনো যাত্রী হয়তো বেঁচেও যেতে পারেন। সুতরাং বাস্তবের যুক্তিতে যাই হোক, অন্তত তত্ত্বের যুক্তিতে বিমানটি ধ্বংস করা অনৈতিক ব্যাপার।
অপর পক্ষে, উপযোগিতাবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকরা এই নৈতিকতাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া অন্যায় নয়। বেশি। মানুষের কল্যাণের জন্যে অল্প সংখ্যক মানুষের অমঙ্গল হলেও তাদের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকরা মনে করেছিলেন যে, বৃহত্তর জনগণের উপকারের জন্যে কিছু লোকের রক্তপাত ঘটানো কিছু অন্যায় নয়। ফরাসি বিপ্লব কেন, সব বিপ্লবের পেছনেই কাজ করে এই আদর্শ, এই যুক্তি। এমন কি, ধর্মযুদ্ধ অথবা ধর্মীয় বিপ্লবের পেছনেও।
কার্ল মার্কস ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। কেবল ব্যাখ্যা নয়, তিনি ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ তৈরি হবে। তাঁর বিশ্লেষণ মেনে নিয়ে বামপন্থী রাজনীতির সূত্রপাত। সেই রাজনীতিতে প্রথম সফলতা আসে রাশিয়ায়। বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট শাসন-ব্যবস্থা। তারপর সেই শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে এবং তাকে সম্প্রসারিত করে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে চলতে থাকে। এই নীতির প্রয়োগ। সে নীতির সামনে ব্যক্তি অথবা ব্যক্তির স্বাৰ্থ বিবেচনার যোগ্য নয়। সমষ্টিই একমাত্র বিবেচ্য। তা ছাড়া, সব ক্ষমতারই ভেতরেই থাকে বিকৃতির বীজ। যে-ক্ষমতা যতো নিরঙ্কুশ সেই ক্ষমতা ততো প্রবলভাবে বিকার লাভ করে। সেই বিকৃতি ক্যান্সারের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ক্ষমতার প্রতিটি কোষে। স্তালিন অংশত নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার লোভে, অংশত দল ও কমিউনিজমের শ্ৰীবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে লাখ লাখ লোকের প্রাণ নিয়েছিলেন। একমাত্র ইউক্রেনেই ১৯২৯-৩০ সালে পনেরো লাখ লোককে নাখাইয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সাইবেরিয়ার শ্রম-শিবিরে পাঠিয়ে ছিলেন। লাখ লাখ লোক। কিন্তু তাতে স্তালিন অথবা কমিউনিস্ট কর্মীরা কিছুমাত্র বিবেকের দংশন অনুভব করেননি। কারণ, কোটি কোটি প্লোলেটারিয়েটের রাজত্ব স্থাপনই তাদের লক্ষ্য ছিলো। তাদের মতে, তার জন্যে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানিও যুক্তিযুক্ত।
মাও সে তুংও ছিলেন একই নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু তার চেয়ে অনেক উৎসাহী এবং কট্টর বিশ্বাসী ছিলেন পল পট। তিনি যতো কম সময়ের মধ্যে যতো বেশি লোক মেরেছিলেন তাতে মানুষ মারার দৌড়ে তিনি স্তালিন এবং মাওকে অনায়াসে হারিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির কাছের এবং সাম্প্রতিক কালের কমিউনিস্টরাও ছোটো ছোটো স্তালিন, মাও, পল পট। এরা কেউ কেউ বেশি সাফল্য লাভ করেছেন। বেশি সাফল্য লাভ করে ইতিহাসে কারো চোখে খ্যাত, কারো চোখে কুখ্যাত হয়েছেন। তার অর্থ বেশি সংখ্যক মানুষের ভালো করতে গিয়ে মার্কসপাহীরা অনেক লোকের ক্ষতি, এমন কি, প্রাণহানি করছেন। নীতিবাদীদের চোখে এটা গ্রহণযোগ্য না-হলেও উপযোগিতাবাদীদের চোখে এটাই করণীয়।
মার্কসবাদীদের মতো হিটলারও এক ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনিও তাঁর জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে ষাট লাখ ইহুদী আর জিপসিকে মেরেছিলেন। তুর্কীরা তাদের জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে না-খাইয়ে মেরেছিলেন আর্মেনিয়ানদের। নিজেদের জাতীয় স্বার্থে জাপানীরা লাখ লাখ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন কোরিয়ায়, চীনে, মাথুরিয়ায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। জাপানীরা এখন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন ক্ষমতায় সমগ্র বিশ্বে প্রথম সারিতে আছেন। গণহত্যা এবং নিৰ্যাতনেও তারা নানা বৈচিত্ৰ্য এবং উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়ে প্রথম সারিতে ছিলেন।
পশ্চিমা বিশ্বে ব্যক্তির স্বাৰ্থকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করা হয়। তা সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর আণবিক বোমা ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আণবিক বোমার ফলাফল সম্পর্কে ভালো করেই জানতো যুক্তরাষ্ট্র, তবু দ্বিধা করেনি। এমন কি, তিন দশক ধরে নিজেদের মতবাদ এবং স্বার্থের খাতিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে লাখ লাখ লোক মারতে এবং অথবা তাদের ওপর নির্যাতন করতেও কিছুমাত্ৰ পিছুপা হয়নি।
সম্প্রতি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো, ধরা যাক, ইরাকে যে-অভিযান চালিয়েছে তার ফলে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছেন এবং নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার লোকের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। যে-অত্যাচারের কাহিনী প্ৰকাশিত হওয়ায় বুশের মতো সাম্রাজ্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী লোকও লজ্জিত হয়েছেন। সাদাম হোসেনের একনায়কত্ব থেকে রক্ষা করে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে যো-পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছে, তাকে কি সমর্থন করা যায়?
এমনি, আরও একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। পশ্চিমা দেশে সাম্প্রতিক কালে পশুদের অধিকার নিয়ে অনেক লোক আন্দোলন করছেন। গবেষণাগারে পশুদের ওপর ওষুধ পরীক্ষা করার ফলে পশুদের কষ্ট হয় এবং অনেক পশুর প্রাণ যায়। আন্দোলনকারীরা এই অসহায় পশুদের হয়ে লড়াই করছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা নৈতিকতার কথা ঠিকই। কিন্তু এর জন্যে তাঁরা অনেক সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছেন। এমন কি, মানুষের প্রাণও নিয়েছেন। পশুদের ক্লেশ নিবারণ করার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তারা যে-সহিংসতার পন্থা বেছে নিয়েছেন, তাকে সমর্থন করা যায় কি?
উপযোগিতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, মার্কসবাদ–সব “বাদের”ই মূল কথা তার লক্ষ্য হাসিল করা, ব্যক্তি অথবা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা নয়। কেবল তাই নয়, সেই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে যে-কোনো পন্থা অবলম্বনকে এই মতবাদীরা অন্যায় বা অনৈতিক বলে মনে করেন না। কিন্তু এই পন্থার শিকার হন যারা, বলা বাহুল্য, তারা একে মেনে নিতে পারেন না। বরং এর সমালোচনা করেন। তাঁরা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে-সব তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ চলে, তা এক পক্ষের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ, বিরোধীদের দৃষ্টিতে তা দুস্কৃতি। ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের দখলদারি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে-বোমাবাজি অথবা হত্যা এবং সন্ত্রাস চালাচ্ছেন, তাকে তারা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ বলে বিবেচনা করেন। এমন কি, অনেকে তাকে ধর্মযুদ্ধ বলেও বিশ্বাস করেন। অনেকে সেই যুদ্ধে স্বেচ্ছায় জীবন দিয়ে ধন্য হতে চান এবং তার মাধ্যমে পুণ্য অর্জন করতে চান। কিন্তু তারা যখন ইসরাইলী সামরিক লক্ষ্যবস্তু ছাড়া অন্য কিছুর ওপর আক্রমণ করেন অথবা নিরপরাধ লোককে হত্যা করেন, তখন তাকে নীতিবাগীশ বা মানবাধিকারবাদীরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারনে না।
এমন কি, প্ৰায় সব লোকই যাকে মনে করেন। ঐশ্বরিক, পবিত্র এবং অবশ্য পালনীয়, সেই ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে অথবা ধর্মের নামে উৎসাহী ধাৰ্মিক কমীরা অধৰ্ম করতে বিবেকের দংশন অনুভব করেন না। যেমন, ধরা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খৃস্টান মৌলবাদীদের একাংশ ধর্মীয় কারণে গর্ভপাতকে এতো অন্যায় বলে মনে করেন যে, গর্ভপাত করান যে-ডাক্তাররা, তাদের কয়েকজনকে তাঁরা খুন করেছেন। বা ধরা যাক, ভারতে রামমন্দির নির্মাণ করার নামে শত শত মুসলমান হত্যা করতে দ্বিধা করেননি হিন্দু ধর্মের উৎসাহী কর্মীরা। সেই রামমন্দিরের শতশত মাইল দূরের বাংলাদেশেও হিন্দুদের মারতে অথবা তাদের নারীদের ধর্ষণ করতে দ্বিধা করেননি কিছু মুসলমান। এ রকমের আর-একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলো: ইসলামী জাতীয়তাবাদের নামে উড়োজাহাজ দিয়ে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার ঘটনা। নিরপরাধ ও অসহায় যাত্রীদের নিয়ে নিজেরা মরতে অথবা টুইন টাওয়ারের নিরপরাধ হাজার হাজার লোককে মারতে দ্বিধা করেননি আল-কাইদার ইসলামী সন্ত্রাসীরা। কেবল দ্বিধা করেননি বললে মিথ্যে বলা হয়। এঁরা মনে করেন, এটা ধর্মের নামে যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে নিহত হলে তা অতীব পুণ্যের ব্যাপার। এমন পুণ্য যে, মরার পরই সশরীরে স্বৰ্গ এবং স্বর্গের অন্সরা লাভ করবেন তারা।
একাত্তর সালে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর যেপাশবিক অত্যাচার করেছিলো, তার পেছনে কেবল জাতীয়তাবাদ কাজ করেনি। ধর্মীয় উৎসাহও সেই জাতীয়তাবাদী ধারণাকে উস্কে দিয়েছিলো। সেই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ছিলো বলেই পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা বিনা দ্বিধায় লাখ লাখ নারীর সতীত্ব হানি করতে পেরেছিলো। অমন লুটপাট করতে পেরেছিলো। এই সৈন্যদের স্থানীয় দালালরাও এই ধর্মীয় জোশে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো। সৈন্য এবং তাদের দোসররা যে বাড়াবাড়ি করেছিলো, তার অনেকটাই করেছিলো ধর্ম রক্ষা এবং বিধমী বিনাশের মাধ্যমে পুণ্য লাভের প্রেরণা থেকে। সেই মিথ্যে পুণ্যের ধারণা তাদের বিবেক এবং বিবেচনাকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দিয়েছিলো।
বস্তুত, ধর্মের নামে ধর্মান্ধরা যা করে, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তা সত্যি সত্যি ধর্মের জন্যে নয়; বরং করে ধর্মের নামে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি লাভের উদ্দেশে। মার্কিন, জার্মান, ব্রিটিশ, ফরাসি অথবা জাপানী সাম্রাজ্যবাদ। যেমন মানুষের মৌল অধিকার হরণ করেছে অথবা এখনো করছে, তেমনি ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদও একই রকমে মনুষ্যত্ব এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের মতো যুগে যুগে বৌদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ, খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসলামী সাম্রাজ্যবাদও অসংখ্য মানুষের রক্তে রাঙা হয়েছে। তবে বৌদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ এবং হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ ইতিহাসে পরিণত হলেও খৃষ্ট এবং ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ এখনো প্রবল স্রোতে বহমান। বিশেষ করে পেট্রোডলারের জোরে এবং মধ্যপ্রাচ্যে হতাশাজনক ইহুদী আধিপত্য থাকার প্রতিক্রিয়ায় ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের নামে সহিংসতার একটা প্ৰবল ধারা গোটা মানবতাকেই হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের সমান্তরালভাবে আর-একটি স্রোতও বহমান বিভিন্ন জায়গায়। সেটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী চেতনা দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে না; বরং সক্রিয় থাকে দেশের মধ্যেই। কিন্তু এই মতবাদও মানবাধিকার খর্ব করে। মানুষের মুক্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে। এমন কি, এর নামে সংখ্যালঘু জনগণ এবং মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী উদারনৈতিক লোকেদের ওপরও অবাধে অত্যাচার চালানো হয়। এর সঙ্গে নীতিবোধের কোনো যোগ থাকে না। বরং ধর্মের নাম ব্যবহার করে এই মতবাদে বিশ্বাসীরা লাভবান হতে চান। এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে অধর্মের পন্থা অনুসরণ করতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না। ইহুদী র্যাবাইরা, এভানজ্যালিক্যাল খৃস্টানরা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা, আল কাইদা এবং তালেবান সদস্য–সব শিয়ালের একই রী। সবাই মনে করেন, ধর্মের লক্ষ্য হাসিল করতে অধর্মের পন্থা অবলম্বন করলে সেটা অন্যায় নয়। এই বিবেকবর্জিত ধারণা সৃষ্টি হওয়ার ফলে গোটা মানবতাই আজ হুমকির সম্মুখীন। আজ তাই নতুন করে ভাবা দরকার লক্ষ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, না। পন্থা।
(যুগান্তর, ডিসেম্বর ২০০৬)