রেজিস্ট্রি করা চিঠি
রেজিস্ট্রি করা চিঠি।
লিটন সই করে চিঠি নিল। রেজিষ্ট্র চিঠি তাকে কে পাঠাবে? সাধারণ চিঠিই আসে। না। আর রেজিস্ট্রি চিঠি। ইংরেজিতে টাইপ করে তার নাম লেখা।
হামিদুর রহমান। নিজের নাম অথচ অপরিচিত লাগছে। ভালো নামটা সে ভুলতে বসেছে। চিঠি এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। এটিও অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জেনারেল ম্যানেজার মাহিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। কে আছে সেখানে? বন্ধুবান্ধবদের কেউ। ভাগ্যবানদের একজন। বিদেশে চাকুরি করছে। তার সুখ ও আনন্দ পুরনো বন্ধুকে জানাতে চাচ্ছে। সে এই মেসের ঠিকানা জানল। কী করে?
পিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। লিটন বলল, কী ব্যাপার?
স্যার বকশিশ।
লিটন বিস্মিত হয়ে বলল, বিকশিশ কেন? সে কি এতই হতভাগ্য যে বিদেশ থেকে একটা চিঠি আসার জন্যে বকশিশ দিতে হবে?
যান ভাই বিকশিশ-টকশিশ নেই।
পিয়ন বিমর্ষমুখে চলে যাচ্ছে। টাকা থাকলে পাঁচটা টাকা দিয়ে দেয়া যেত। টাকা নেই।
লিটন খিচুড়ি বসিয়ে দিল। চালডালের খিচুড়ি। আনাজপাতি থাকলে দিয়ে দেয়া যেত। কিছু নেই। চিঠিটা বিছানায় পড়ে আছে। থাকুক পড়ে। বন্ধুর চিঠি পড়ার কোনো আগ্রহ এই মুহুর্তে সে অনুভব করছে না। তার মনটা খুব খারাপ। শম্পার শরীর ভালো না। গা দিয়ে গুটির মতো বের হয়েছে। সম্ভবত হাম। বড়দের হাম হওয়া খুব কষ্টের। বেচারি কষ্টের মধ্যে পড়েছে–অথচ সে কিছু করতে পারছে না। সে রোজই সন্ধ্যার পর যাচ্ছে। দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত থেকে চলে আসছে। তাকে ভদ্রতা করেও কেউ বলছে না–জামাই আজ থেকে যাও। শম্পাকে এখনো ডাক্তার পর্যন্ত দেখানো হয় নি। এমন কষ্টে মানুষ পড়ে?
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর লিটন চিঠি খুলে পড়ল। জন স্মিথ জুনিয়ার নামের এক ভদ্রলোক তাকে জানাচ্ছেন যে, মাহিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সিঙ্গাপুর শাখার একজিকিউটিভ অফিসার প্রোডাকশান শাখায় তাকে নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে। তিন বৎসর মেয়াদি এই নিয়োগ। পরবতী এক্সটেনশন কোম্পানি শর্তে আলোচনাসাপেক্ষ। মাসিক বেতন সাত হাজার সিঙ্গপুরি ডলার। ফ্রি ফার্নিশড কোয়ার্টার। ফ্রি মেডিকেল। তাকে অতি দ্রুত সিঙ্গাপুর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। ঢাকায় মতিঝিলে কোম্পানির একটা অস্থায়ী অফিসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এই ঠিকানায় যোগাযোগ করলে তারা তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।
এর মানে কী? কেউ কি রসিকতা করছে? এপ্ৰিল ফুল জাতীয় কিছু? কিংবা কোনো দুষ্ট লোক টাকা কামানোর ফন্দি করছে। সব অভাবি যুবকদের এই জাতীয় চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হবে। মতিঝিল অফিসে ছুটে যাবে। সেই অফিসের একজন বলবে–আমরা সব খবরাখবর আনিয়ে দিচ্ছি। তার খরচ বাবদ এক শ ডলার লাগবে। আমাদের অফিসে একটা ফরম ফিলাপ করতে হবে। ফরমের দাম তিন ডলার। সাত দিনে রমরমা ব্যবসার পর কোম্পানি ডুব মারবে।
আরেকটা ব্যাপার হতে পারে। হয়তো তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কোনো চিঠিই তার নামে আসে নি। পুরোটাই সে কল্পনায় দেখছে।
মতিঝিলের যে অফিসের ঠিকানা আছে সেখানে গিয়ে খোঁজ নেয়া যায়। কয়টা বাজে। অফিস কি বন্ধ হয়ে গেছে না খোলা? চারটা পর্যন্ত খোলা থাকলে অফিসে পৌঁছানো যাবে। কারণ তাকে যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। লিটন কাপড় পরল।
অফিস খোলাই ছিল। বয়স্ক একজন ভদ্রলোক তার ঘর বন্ধ করে চলে যাচ্ছিলেনলিটন তার চিঠিটা ভদ্রলোকের হাতে দিল। তিনি চিঠি খুলেই বললেন–ও আপনি। আপনার নামে ফ্যাক্স এসেছে আমাদের কাছে। আমাদের কাছ থেকে কী ধরনের অ্যাসিসট্যান্স চাচ্ছেন?
লিটন কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোক বললেন, আপনার হাতে তো এখনো দিন পনের সময় আছে। এর মধ্যে গোছগাছ করে নিন।
লিটন অস্পষ্ট গলায় বলল, ও আচ্ছা।
আপনার টিকিট সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে–পি.টি.এ। আমরা আনিয়ে রাখব। লিটন আবার বলল, জি আচ্ছা। কেন সে জ্বি আচ্ছা বলছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না।
কাল তো অফিস ছুটি আপনি পরশু সকালের দিকে চলে আসুন। লিটন আবার বলল, জ্বি আচ্ছা।
আপনার ভাগ্য খুব ভালো। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। পৃথিবী জুড়ে এদের শাখা। লিটন ক্ষীণ গলায় বলল, চাকরিটা কি সত্যি পেয়েছি?
ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন। লিটন কুষ্ঠিত মুখে বলল, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
ভদ্ৰলোক হেসে ফেললেন।
পরশু আসুন। বিশ্বাস না হবার কী আছে। আপনার হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এইসব কোম্পানি যে শুধু শুধু চাকরি দিচ্ছে তা তো না। বাংলাদেশে তারা কোটি কোটি টাকার কাজ করছে। এইসব কাজের একটা শর্ত আছে–এ দেশের কিছু ছেলেমেয়েকে চাকরি দিতে হবে। এইসব শর্ত তারা মানে না। কালেভদ্রে মানে। আপনার স্ট্রং রিকমন্ডেশন–আপনি পেয়ে গেছেন।
পরশু অ্যাসব?
জ্বি পরশু আসুন। আপনার পাসপোর্ট আছে তো?
লিটনের পাসপোর্ট আছে। সেই পাসপোর্টে কি কাজ হবে? সেখানে মালয়েশিয়ার একটা মিথ্যা মিথ্যা ভিসা আছে।
পাসপোর্ট না থাকলে অসুবিধা নেই। চব্বিশ ঘণ্টায় পাসপোর্ট পাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরে আপনি একা যাবেন না। ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন?
ফ্যামিলি নিয়ে যাব।
সব পার্টিকুলারস নিয়ে আসবেন। ফ্যাক্স করে দেব। কোনো সমস্যা হবে না।
জ্বি আচ্ছা। লিটন রাত ন’টা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় হাঁটল। সব কেমন অদ্ভুত লাগছে। শম্পাকে কি ব্যাপারটা জানানো উচিত না? উঁহুঁ–উচিত হবে না। পরে দেখা যাবে মালয়েশিয়ার ভিসার মতো ফলস অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। পরশুর আগে কিছু জানা যাবে না। বেছে বেছে কালই কিনা ছুটি পড়ে গেল?
আচ্ছা পুরো ব্যাপারটা তো সত্যি হতেও পারে! সে কত অসংখ্য মানুষকে চাকরির কথা বলেছে তাদের কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে সুপারিশ করেছে। পুরোটাই ভাগ্য। কথায় আছে না–পাথরচাপা ভাগ্য। তারটাও তাই ছিল। হঠাৎ পাথর সরে গেছে। হাসানের সঙ্গে কথা বললে হয়। ওকে চিঠিটা দেখানো যেতে পারে। না তাও ঠিক হবে না। হাসান মন খারাপ করবে। বেচারার মন খারাপ করিয়ে কোনো দরকার নেই।
আজ সারারাত রাস্তায় হাঁটলে কেমন হয়?
পকেটের চিঠিটার একটা ফটোকপি করিয়ে রাখা দরকার। যদি হারিয়ে যায়। একটা না কয়েকটা ফটোকপি করানো দরকার।
পুরো ব্যাপারটা সত্যি হলে সামনে বিরাট ঝামেলা। শম্পার পাসপোর্ট কাপড়চোপড় বানানো।
সিঙ্গাপুর দেশটা কেমন? শীতকালে বরফ পড়ে? বরফ পড়া দেখার তার খুব শখ ছিল এই শখটা বোধহয় এবার মিটবে।
লিটন চায়ের স্টলে ঢুকল। তার পকেটে একটি টাকাও নেই। না থাকুক-এক কাপ চা খেয়ে সে যদি বলে, ভাই ভুলে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি আপনাকে কাল টাকাটা দিয়ে যাব তাহলে দোকানদার নিশ্চয়ই তাকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেবে না। মানুষ এখনো এতটা নিচে নামে নি। মানুষের মনে মমতা, করুণা, দয়া এখনো আছে।
চা খেয়ে সে যাবে আজমপুর গোরস্থানে। বাবার কবর জিয়ারত করবে। কতদিন হয়েছে যাওয়া হয় না। কবরের চিহ্ন এখন আর নিশ্চয়ই নেই। না থাকুক।
লিটন চায়ে চুমুক দিচ্ছে। এরা তো চা খুব ভালো বানায়। অপূর্ব লাগছে। আরেক কাপ চা কি খাবে? এক কাপ চায়ের দাম বাকি রাখা আর দু কাপের দাম বাকি রাখা তো একই ব্যাপার।