রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি থাকে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো, আড্ডা, বিকেলের দিকে প্রীতম বা সোমনাথের বাড়িতে যাওয়া কিংবা আর্ট একজিবিশন, ভাল নাটক, বিচিত্র কোনও অনুষ্ঠান দেখে বেড়ানোর প্রোগ্রাম থাকে তার।
কিন্তু এই রবিবার ছুটি পেল না সে। বোস সাহেব বিরাট দল নিয়ে শিকারে যাচ্ছেন। মিঠাপুকুরের বাগানবাড়ি ছেড়ে দিয়েছে একজন বড় মহাজন। সেখানে কেটারারের এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
দীপনাথের এইসব আমোদ-ফুর্তিতে কোনও সম্মানজনক ভূমিকা নেই। তাই সে আনন্দ পায় না, বরং যথেষ্ট উৎকণ্ঠিত থাকে। তবু এবার তার কোথায় একটু উত্তেজনাময় আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। তার কারণ, অন্যান্য মহিলাকুলের সঙ্গে মণিদীপাও যাচ্ছেন।
নিজের মনের এই সাম্প্রতিক পাপবোধ দীপনাথকে যথেষ্ট খোঁচা দেয়। কিন্তু সে যেন তপ্ত ইক্ষু চর্বণ, জ্বলে গাল না যায় তাজন।
মিঠাপুকুরের মস্ত ঝিলে যে বালিহাস থাকবেই এমন কোনও কথা নেই। তবে ঝোপ-জঙ্গল বাঁশঝাড়ে বিস্তর নিরীহ পাখি-টাখি এসে বসবে। তাদের দু-চারটে মারা পড়লেও পড়তে পারে। কারণ সঙ্গে যাচ্ছে তিন-তিনটে বন্দুক।
অ্যামবাসাডরে ড্রাইভারের কনুইয়ের তো আর আলবার্ট টমসনের চিফ অ্যাকাউনট্যান্ট মিস্টার গুহর ভারী উরুর পার্শ্বচাপ সহ্য করতে করতে সেই তিনটে খাপে ভরা ভারী বন্দুক খাড়া করে ধরে থাকতে হচ্ছে তাকে আগাগোড়া। লাগেজ বুট জায়গা হয়নি, সেখানে বিস্তর জিনিস।
আর দীপনাথ থাকতে অন্য কোথাও জায়গা হওয়ার দরকারই বা কী?
তবে দৃশ্যটা মণিদীপা দেখছে না। মেয়েরা দুটো গাড়ি বোঝাই হয়ে আগে আগে যাচ্ছে। পিছনে আর দুটো গাড়িতে পুরুষমানুষের দল। মণিদীপা দেখলে একটু অস্বস্তি বোধ করত দীপ। ভদ্রমহিলা মনে করেন, দীপনাথ বোস সাহেবের চামচা। কথাটা হয়তো তেমন মিথ্যেও নয়।
সকালের নরম রোদে শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তা আর দু’ধারে প্রাকৃতিক সবুজের মধ্যে পড়ে দীপনাথের ভাল লাগার কথা। বন্দুকগুলোর জন্য তেমন লাগছে না। মুখের সামনে তিনটে খাপে ঢাকা নল উঁচু হয়ে তার চোখ আড়াল করে আছে। এই বন্দুকে পাখি মারা পড়বে ভাবতেই তার বুকে কষ্ট হয়। খুনখারাপি—তা সে পাখিই হোক আর বাঘই হোক—দীপনাথ সহ্য করতে পারে না। বড়দা মল্লিনাথ তাতে বন্দুক চালাতে শিখিয়েছিল। মলিনাথের হাত ছিল সাফ। মাথা ঠান্ডা, আর বুকে ছিল যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা। একজিকিউটিভ ইনজিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন উত্তর বাংলায় ছিল মল্লিনাথ। তখন বনে-জঙ্গলে তার সঙ্গে ঘুরে দীপনাথ তালিম নিয়েছিল। কিন্তু আজও সে বন্দুক জিনিসটাকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি।
গুহ সাহেব পিছনে একটু ঘুরে ব্যাক সিটে বসা বোস সাহেব এবং আর তিন কোম্পানির তিন বড় মেজো কর্তার সঙ্গে অফিস নিয়ে কথা বলছিলেন। ফলে ঊরুর চাপে দীপনাথ আরও চ্যাপটা হয়ে গেল। শীতকালেও তার অল্প ঘাম হচ্ছে। দমফোট লাগছে।
হাওড়া ছেড়ে উনিশ কুড়ি মাইল দূরে মিঠাপুকুর। ইতিমধ্যেই গাছ-গাছালি ঘন হয়ে উঠেছে। বসতির ঘনত্ব কমে এসেছে। চাষের মাঠ দেখা যাচ্ছে। বন্দুকের নল সরিয়ে দেখতে থাকে দীপনাথ। সামনের একটা গাড়িও খুব তৃষিত চোখে দেখে নেয় সে। সবুজ একটা ফিয়েট গাড়ি। ওতে মণিদীপা রয়েছে। মণিদীপা আজও শাড়ি পরেনি। জিনস আর টি শার্ট। তার ওপর একটা কাশ্মীরি কোট। বড্ড বেশি চমকি দেখাচ্ছিল।
গাড়িটা ডাইনে বাঁক নিল। আর দেখা গেল না।
বিশুদ্ধ মার্কিন ইংরেজিতে এ গাড়ির সাহেবরা অফিস বিজনেস আর বিভিন্ন একজিকিউটিভের দোষ-ত্রুটি নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। দীপনাথ বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করে না। চোখ বুজে সে মনের চোখটি খোলে। অমনি নীল আকাশের গায়ে স্বর্গের সমান উঁচু মহান পর্বতের দৃশ্য ভেসে ওঠে।
সব তুচ্ছতা ছেড়ে একদিন কি সে পাহাড়ে যাবে না?
গাড়ি ডাইনে বাঁক নিয়ে একটা গাছপালায় নিবিড় শুড়িপথে ঢোকে। কাঁচা রাস্তা। গাড়ি হোঁচট খাচ্ছে। খুব আস্তে চলছে। প্রচণ্ড ধুলো উড়ছে চাকার ঘষড়ানিতে। চারদিকের গাছপালার ডাল আর পাতা ছটাছট আছড়ে পড়ছে গাড়ির গায়ে। বাঁশের একটা ডগা গুহ সাহেবের গালে চুমু খেয়ে গেল। উনি একটু সরে এলেন। ঊরুর চাপে দীপনাথ আরও সরু হল এবং ড্রাইভারের কনুই তার পেটে ঘোত করে বসে গেল।
প্রায় আধ ঘণ্টা এই যন্ত্রণা সহ্য করে বাগানবাড়িতে পৌঁছল দীপনাথ।
ধূলিধূসর দুটো গাড়ি থেকে মহিলারা নেমেছেন। বাগানময় অজস্র সুন্দর নিবিড় গাছপালা, কুঞ্জবন, পুকুর, বাড়িটাও বিশাল। চারদিকে উঁচু দেয়ালের প্রতিবোধ। চারদিক ম ম করছে কফির গন্ধে। বাগানে পুকুরের ধারে মস্ত গার্ডেন আমব্রেলার নীচে টেবিল সাজানো। এখুনি হালকা জলখাবার দেওয়া হবে। ড্রিংকস চাইলে ড্রিংকসও। কেটারের বেয়ারারা ট্রে নিয়ে তৈরি হচ্ছে।
বন্দুকগুলো ঘাসে শুইয়ে রেখে দীপনাথ হাত-পা টান টান করল। পুলওভার গায়ে রাখা যাচ্ছে এই রোদে। সেটা খুলে পিঠে ঝুলিয়ে হাত দুটো গলায় ফাঁস দিয়ে রাখল। একটা ফাঁকা টেবিলে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে হাঁফ ছাড়ল সে।
কিছুক্ষণ সে হাঁফ ছাড়তে পারবেও। শিকারের প্রোগ্রামে সে সাহেবদের সঙ্গে যাবে না, এ কথা বোসকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
বোস শুনে একটু হেসে বলেছেন, রক্ত দেখলে ভয় পান নাকি?
ওসব আমার ঠিক সহ্য হয় না।
ঠিক আছে। মিসেসরাও কেউই নাকি যাবেন না। আপনি না হয় ওঁদের সঙ্গে সময়টা কাটাবেন।
কথাটায় খোঁচা আছে। কিন্তু সারা দিন কত খোঁচাই তাকে হজম করতে হয়।
শিকারের পর লাঞ্চ এবং লাঞ্চের পর কলকাতা থেকে আসা এক ম্যাজিসিয়ান ম্যাজিক দেখাবেন। এক গায়িকা গান শোনাবেন। তারপর মিস্টার এবং মিসেসরাও হয় গাইবেন, না হলে মজার গল্প বলবেন, কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন, যার যা খুশি।
সুতরাং দীপনাথের খুব একটা কাজ নেই। অনেকটা সময় সে একা কাটাতে পারবে।
কফির কাঁপের কানার ওপর দিয়ে তার চোখ খুব আলতোভাবে লক্ষ করছিল, কিন্তু মণিদীপাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। রাই মাখিয়ে গোটা দুই ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ খেয়ে ফেলল সে। তারপর আবার বসে বসেই খুঁজতে লাগল চোখ দিয়ে। অবাধ্য চোখ বশ মানছে না। বড় জ্বালা।
অনেকটা দূরে একটা লিচু গাছের আড়ালে ক্যাম্বিসের চেয়ারে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে মণিদীপা বসে আছে, এটা আবিষ্কার করতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। মণিদীপার সঙ্গে জনা দুই মহিলা ও জনা তিনেক পুরুষ রয়েছে। হাত পা নেড়ে প্রচণ্ড কথা বলছে তারা।
দীপনাথ উঠল এবং একটু লক্ষ্যহীন পায়ে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে লিচুতলার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। মণিদীপার চোখে পড়ার জন্য সে ইচ্ছে করেই ওর মুখোমুখি উলটো দিক থেকে খানিকটা হেঁটে কাছাকাছি চলে গেল প্রায়।
কিন্তু মণিদীপা একদমই পাত্তা দিল না তাকে। ডাকল না, তাকালও না।
দীপনাদের কাছে এটুকুই যথেষ্ট অপমান। মণিদীপা সম্পর্কে যত বেশি সচেতন হয়ে উঠছে সে, তত বেশি অভিমান আর অপমানবোধ বেড়ে যাচ্ছে তার।
দীপনাথও স্পষ্ট করে তাকাল না। উদাস মুখে হটা অব্যাহত রেখে সে ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা পরিচ্ছন্ন ঘাসজমিতে চলে এল। খুঁজে-পেতে একটা পছন্দসই গাছের ছায়ায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে, হাতে মাথা রেখে। চোখ জ্বালা করছে রোদের তেজে। তাই চোখ বুজল। তারপর পাহাড়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ।
কিন্তু ঘুমোলেও দীপনাথের ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ু সব সময়ে সজাগ থাকে। সামান্য শব্দ বা সামান্য চলাফেরাও সে টের পায়। ঘুমের চটকার মধ্যেই সে একটা ভারী সুন্দর গন্ধ পেল। ঘুম ভাঙলে চোখ চাইল না সে, কে এসেছে তা সে জানে।
বড় অভিমান হল তার। পাশ ফিরে শুল।
মণিদীপা আস্তে করে ডাকল, দীপনাথবাবু!
প্রথমে উত্তর দিল না দীপনাথ।
আরও দু’বার ডাক শুনে হঠাৎ উঠে বসল।
মণিদীপা হাসছিল। বলল, কুম্ভকণ।
দীপনাথ হাইটা চেপে দিয়ে বলল, কিছু কাজ নেই, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছু বলছেন? তেমন কিছু নয়। আমার ভাল লাগছে না।
কেন?
এরা কেউ তো আমাদের ক্লাসের লোক নয়। আপনি যেরকম মধ্যবিত্ত পরিবারের, আমিও তাই। আই হেট দেম।–বলতে বলতে মণিদীপা একটু জ্বলে ওঠে।
দীপনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, তা বললে হবে কেন? একজন একজিকিউটিভের বউকে এই সমাজে মিশতেই হবে। অন্য উপায় তো নেই।
খুব জেদের গলায় মণিদীপা বলে, আমার যা ভাল লাগে না তা মানিয়ে নিতে আমি রাজি নই।
তা হলে কী করবেন?
আমি এখানে সারা দিন থাকতে পারব না।
একটু আগে তো লিচুতলায় হাই সোসাইটির লোকদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছিলেন।
ওঃ আই ওয়াজ প্রিচিং কমিউনিজম।
কী সর্বনাশ!
মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, খুবই সর্বনাশ। মিস্টার বোস শুনলে মূৰ্ছা যাবেন। উনি কমিউনিজমকে সাংঘাতিক ভয় পান। আমাদের বাড়িতে লাল মলাটের কোনও বই ঢুকতে পারে না। তা বলে ভাববেন না হাই-সোসাইটিতে কমিউনিস্ট নেই। বরং অনেক আছে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তাদের একজনই তো কট্টর মার্কসিস্ট।
হতেই পারে।
হচ্ছেও। কমিউনিজম ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে সব ক্লাসের মধ্যে।
খুব ভাল। দীননাথ আবার হাই তোলে। মণিদীপার এই একটা ব্যাপারই তার যা একটু–পছন্দ। সে জিজ্ঞেস করল, বসরা সব কোথায়?
মণিদীপা ঘাসে বসে বলল, শিকার শিকার খেলা করতে গেল সব। প্রত্যেকটাই মাতাল। কারও হাতে টিপ নেই।
থাকলেই ভাল। পাখি মারা আমার একদম ভাল লাগে না। মণিদীপা হাসে। বলে, আপনাকে দেখেই মনে হয়, আপনি ভীষণ সফট-হার্টেড।
মণিদীপার হাসিটা এতই ঝকমকে এবং হাসলে বয়সটা এতই কম দেখায় যে, দীপনাথের চোখ আঠাজালে পড়া পাখির মতো মণিদীপার মুখে আটকে থেকে ছটফট করছিল।
মণিদীপা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে, দি হামবার্গস আর অ্যাওয়ে। চলুন আমরা একটু ঘুরে আসি।
কোথায় যাবেন?
যে-কোনও জায়গায়। জাস্ট টু কিপ ডিসট্যানস ফ্রম দি হবুচন্দ্র কিংস অ্যান্ড গবুচন্দ্র মিনিস্টারস। কোনও চাষার বাড়িতে গেলে কেমন হয়?
দীপ শঙ্কিত হয়ে বলে, ও বাবা!
ভয় পাচ্ছেন কেন? চলুন। রিয়্যাল হিউম্যান বিয়িং-এর কাছে গেলে অনেক ভাল লাগবে।
চাষা বলতেই যে রিয়্যাল হিউম্যান বিয়িং নয় এ কথাটা বোঝনোর বৃথা চেষ্টা করল না দীপ। তবে উঠল।
মণিদীপা হাঁটতে হাঁটতে বলে, ধারে-কাছে দেখার মতো কোনও জায়গা নেই?
দীপ মাথা নেড়ে বলে, জানি না, তবে কয়েক মাইলের মধ্যে রতনপুর নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে আমার মেজদা থাকে।
মণিদীপা তুলে বলে, উনি কি বড়লোক?
না। তবে একটা খামার মতো আছে ওদের। গেরস্থ।
আমি যদি যেতে চাই আপনার কোনও অসুবিধে নেই তো?
থাকলে তো কথাটা বলতামই না। চেপে যেতাম।
মণিদীপা ঘড়ি দেখে বলে, এখন মোটে সাড়ে নটা বাজে। গিয়ে লাঞ্চের আগে ফেরা যাবে তো?
তা যাবে।
তবে গাড়ি জোগাড় করি? বলে প্রায় দৌড়ে চলে যায় মণিদীপা।
বেশ খুশি ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল মণিদীপাকে। দীপনাথ স্পষ্ট টের পায়, একা সে নয়। মণিদীপাও তার প্রতি টানে টানে একটু একটু এগিয়ে আসছে। বেশ আগ্রহী। হয়তো সেটা প্রেম নয়। কারণ মণিদীপার সত্যিকারের ভালবাসার লোক একজন বয়স্ক স্কুলমাস্টার, যার নাম স্নিগ্ধদেব এবং যে সাংঘাতিক বিপ্লবী। কিন্তু মণিদীপার মন উপচে যে বাড়তি লাবণ্যটুকু ঝরে পড়ছে তার কিছু ভাগ অবশ্যই দীপেরও। আপাতত এই রবিবারটার যাবতীয় কষ্ট, কাজ ও অপমানকে ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে সেটুকুই ঢের।
মণিদীপা ফিয়েট গাড়িটা জোগাড় করেছে। দীপ সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসতে যাচ্ছিল, মণিদীপা বলল, ও কী? পাশাপাশি না বসলে কথা বলব কার সঙ্গে?
দীপ লজ্জা পেয়ে মণিদীপার পাশে উঠে বসে।
মণিদীপা বলে, আপনি ড্রাইভিং জানেন?
না, একটু শিখেছিলাম, ভুলে গেছি।
জানলে ড্রাইভারটাকে কষ্ট দিতাম না।
আপনি তো জানেন।
মণিদীপা মাথা নেড়ে বলে, জানলে কী হবে? এসব অচেনা জায়গায় কি পারব? ঠিক সাহস পাচ্ছি না।
পারবেন।–দৃঢ় স্বরে বলে দীপনাথ।
পারব?–মণিদীপা উজ্জ্বল চোখে তাকায়।
নিশ্চয়ই। বেচারাকে খামোখা কেন কষ্ট দেবেন? ছেড়ে দিন।
দীপনাথ এ কথা বলার সময়েও টের পাচ্ছিল, তার বুক কাপছে। নির্জন গাঁ-গঞ্জের রাস্তায় এই অ্যাডভেঞ্চারে ড্রাইভার না থাকলে মণিদীপা অনেক খোলামেলা হবে না কি? মুখ-ফাঁকা দু’-একটা কথা ঠিক বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর-একটু ভেবে মণিদীপা বলে, না, থাক। আমি যে আপনার সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছি না ড্রাইভারটা তার সাক্ষী থাকবে।
ভীষণ লাল হয়ে গেল দীপ। বলল, কী যে বলেন।
রতনপুর কোন দিকে এবং কত দূর তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না দীপের। খুব দূর যে নয় তার একটা ধারণা হয়েছিল মাত্র।
কিন্তু লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে গিয়ে সে নিজেও অবাক। মণিদীপা মেজদার বাড়িতে কে কে আছে এবং তারা কেমন লোক তা জানতে চেয়েছিল। সেই সব। প্রশ্নের জবাবও ভাল করে দেওয়া হল না।
ফটকের কাছে গাড়ি থেকে মণিদীপাকে সঙ্গে নিয়ে নামবার সময় দীপনাথ একটু লজ্জা বোধ করছিল। এই পোশাকে একজন সধবাকে দেখে মেজো বউদি আবার কী ভাববে!
ঢুকতেই ডান ধারে শ্রীনাথের বাগান।
মণিদীপা দাঁড়ায় এবং বাগান থেকে মাটিমাখা হাত-পায়ে উঠে আসে শ্রীনাথ।
কাকে চাইছেন?
দীপনাথ হাতের ইশারা করে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে মেজদাকে। তার পর এগিয়ে গিয়ে বলে, মজদা, ইনি মিসেস বোস। আমার বসের স্ত্রী।
শ্রীনাথ একটু অবাক। বলে, ও, তুই! আসুন! আসুন!
শ্রীনাথ আর তাদের মধ্যে বেড়ার বাধা। শ্রীনাথ বেড়া বরাবর এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ওই সামনের ঘর। আসুন।
বোঝাই যাচ্ছিল, মেজদা একটু ঘাবড়ে গেছে। তটস্থ হয়ে পড়েছে। হবেই। কী একখানা মেয়ে। সঙ্গে নিয়ে বেরোলে বাজারে প্রেস্টিজ বেড়ে যায়।
মণিদীপা মুখ ফিরিয়ে দীপনাথকে বলে, ঘর নয়। আমি বাগানটা দেখব। দারুণ সুন্দর বাগান।
শ্রীনাথ কথাটা শুনে মুখ ফিরিয়ে বলে, বাগান দেখবেন? খুব খুশি হলাম। তা হলে ওই সামনের ফটক ঠেলে চলে আসুন।
বাস্তবিকই দেখার মতো বাগান করেছে শ্রীনাথ। সাজানো গোছানো নয়। বরং জংলা, এলোপাথাড়ি সব গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু তার বিচিত্র রকমফের মানুষকে হতভম্ব করে দেয়। প্রাইজ জেতার মতো বড় বড় আকারের মরশুমি ফুল থেকে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনের ভাষায় রাক্ষুসে ফুলকপি পর্যন্ত সবই ফলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাগানের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালে নিবিড় গাছপালার আবডালে বাইরের পৃথিবী একদম আড়াল পড়ে যায়।
আপনি বাগান করতে খুব ভালবাসেন, না?–মণিদীপা শ্রীনাথকে জিজ্ঞেস করে।
শ্রীনাথ একটা চার-রঙা তারাফুল তুলে মণিদীপার হাতে দিয়ে বলে, আচার্য জগদীশ বোস গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, জানেন তো! আমি নতুন করে সেই প্রাণটার সন্ধান করছি।
রোদচশমার ওপর দিয়ে মণিদীপার ভ্রু-তে একটু কুঞ্চন দেখা দেয়। সে বলে, অনেক বাঙালি এ কথাটা বলে বেড়ায়। কিন্তু আচার্য জগদীশ গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, এ কথাটা মোটেই ঠিক নয়।
শ্রীনাথ একটু যেন ভয় খেয়ে তাকায়। বলে, তা হলে?
মণিদীপা এবার সুন্দর করে হাসে। বলে, গাছের প্রাণের কথা লোকে তো বহু দিন ধরে জানে। জগদীশ বোস বোধ হয় গাছের সেনসিটিভিটি প্রমাণ করেছিলেন। ডিটেলস জানি না। তবে ওইরকমই কিছু।
শ্রীনাথ একটু নিভে গিয়ে বলে, তাই হবে।
মণিদীপা খুব সমবেদনার সঙ্গে বলে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। গাছের প্রাণ আপনিই আবিষ্কার করেছেন। এত বড় আর লাইভলি ফুল আমি আগে দেখিনি। প্রত্যেকটা গাছই এত হেলদি!
আপনি গাছ ভালবাসেন?
কে না বাসে?
শ্রীনাথের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে যায়। সে বলে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিচি দেখে গাছ চিনতে পারে না। লেখাপড়া শিখে তা হলে কী লাভ?
ঠিকই তো!
বলতে বলতেই গাছপালা এবং বাগানের ওপর মণিদীপার কৌতূহল শেষ হয়ে যায় এবং দীপনাথ সেটা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে।
দীপ বলে, চলুন, আমার বউদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
মণিদীপার চোখ চারদিকটা গিলে খাচ্ছে। বলল, বাঃ, বেশ তো জায়গা। এ রকম একটা জায়গায় থাকতে পারলে কলকাতার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে আমি এক্ষুনি রাজি।
ভাবন-ঘর থেকে ভিতরবাড়ি যাওয়ার পথেই খবর রটে গিয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের ধারে। তৃষা এগিয়ে এসে মণিদীপার হাত ধরে বলল, আসুন। আপনার জন্যই বোধ হয় আমার একজন হারানো দেওরেরও খোঁজ পাওয়া গেল।
বাকি সময়টুকু দীপনাথ আর মণিদীপার নাগালও পেল না। মেয়েমহলে গিয়ে ঘুরঘুর করা তার স্বভাব নয়। মণিদীপাকে এগিয়ে দিয়ে সে ফিরে এল ভাবন-ঘরে।
শ্রীনাথ হাত-মুখ ধুয়ে এসে বলল, কোথায় এসেছিলি?
মিঠাপুকুর। তোমার আস্তানাটা যে এত কাছে কে জানত?
শ্রীনাথকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বলল, আমি ভাবলাম বুঝি সোমনাথ তোকে খবর দিয়ে আনিয়েছে।
না তো! সোমনাথ আনাবে কেন?
আজ বাবাকে নিয়ে ওরও এখানে আসার কথা।
দীপনাথ ভারী লজ্জিত হয়। বাবা যে সোমনাথের কাছে সেটা সে মাঝে মাঝে ভুলেই যায়। বাবাকে দেখেওনি বহুদিন।
সে বলল, বাবা আসছে কখন?
কে জানে?
দীপনাথ ঘড়ি দেখে বলে, বেলা বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারি। তারপর লাঞ্চে যেতে হবে। এর মধ্যে যদি বাবা এসে যায় তবে দেখাটা হতে পারে।
এখানে দুপুরে খাবি না?
উপায় নেই। একা হলে কথা ছিল। বসের বউ সঙ্গে রয়েছে।
মেয়েটা একটু খ্যাপা নাকি?
কেন?
কেমন যেন অন্যরকম।
দীপনাথ হাসে। বলে, খ্যাপা নয়। আজকালকার মেয়েরা এরকমই। সজলকে ডাকো তো। বহুকাল ওকে দেখি না।
শ্রীনাথ বারান্দায় বেরিয়ে খ্যাপা নিতাইকে ডেকে সজলকে পাঠিয়ে দিতে বলে।