মোরান্ডা।
২৪শে ডিসেম্বর। বুধবার। সকাল ৯টা।
জেনারেল ডোফা গার্ড রেজিমেন্ট পরিদর্শনে এসেছেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা এর কারণ বুঝতে পারছিল না। তারা শঙ্কিত বোধ করছিল।
জেনারেল ডোফা পরিদর্শনের কাজ সারলেন। প্রথাগত বক্তৃতা দিলেন-সৈন্যদের কাজ হচ্ছে দেশের আদর্শকে সামনে রাখা। দেশের প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিদর্শনের শেষে চা-চক্রের ব্যবস্থা ছিল। ডোফা চা-চক্রে রাজি হলেন না। আগের চেয়েও গম্ভীর মুখে প্রেসিডেন্ট হাউসের দিকে রওনা হলেন।
আজ ক্রিসমাস ইভ। ক্রিসমাস ইভের প্রাক্কালে তিনি সবসময়ই একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণ প্রচার হয় বেতার ও টিভিতে। আজকের ভাষণটি তৈরি হয়েছে এবং তাঁর কাছে কপি এসেছে। ভাষণ তাঁর পছন্দ হয় নি। বক্তৃতা-লেখককে কিছু কড়া-কড়া কথা শুনিয়েছিলেন। নতুন একটি ভাষণ তৈরি করে আনার কথা।
নতুন ভাষণটি আগেরটির চেয়েও বাজে হয়েছে। ডোফা ধমকে উঠলেন, এক জিনিসই তো আপনি লিখে এনেছেন। দু-একটা শব্দ এদিক-ওদিক হয়েছে। এর বেশি কিছুই তো করা হয় নি। নতুন কিছু লিখুন।
বক্তৃতা-লেখক বিনীতভাবে বললেন, কি লিখব, যদি একটু বলে দেন।
জুলিয়াস নিশোর কথা তো বক্তৃতায় কিছুই নেই। তাঁর কথা থাকা উচিত। তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে কি কি করা হবে তা বলা দরকার।
কি কি করবেন, স্যার?
সংগ্রহশালা করা যায়। এই জাতীয় কিছু লিখে আনুন, সব কি আমিই বলে দেব নাকি? মাউ উপজাতিদের সম্বন্ধেও কিছু লেখা উচিত। যান, নতুন করে লিখুন। আমার প্রতিটি বক্তৃতায় একই জিনিস থাকে।
বিকেলে তিনি গেলেন প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্ট পরিদর্শনে। এটা তাঁর হঠাৎ পরিদর্শন। আগে কিছুই ঠিক করা ছিল না। তাঁর মুখ আগের মতোই গম্ভীর। প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্টের জেনারেল র্যাবি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। কোথাও কোনো ঝামেলা হয়েছে কি? হবার তো কথা নয়। সবকিছু বেশ স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট কি মাউ উপজাতিদের নিয়ে চিন্তিতঃ চিন্তিত হবার মতো তেমন কোনো কারণ কি সত্যি-সত্যি আছে?
মাউদের কোনো অস্ত্ৰবল নেই। বর্শা এবং তীর-ধনুকের কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সাহসের এ-যুগে আর দাম নেই। পরিদর্শনপর্ব ভালোভাবেই শেষ হল। জেনারেল ডোফা সৈন্যদের আনুগত্য ও দেশপ্রেমের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের রেজিমেন্ট যে পৃথিবীর যে-কোনোে সৈন্যবাহিনীর আদর্শস্থানীয় হতে পারে, সে-কথাও বললেন।
পরিদর্শনশেষে জেনারেল র্যাবির সঙ্গে তাঁর একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসল। সেখানেও তিনি গম্ভীর হয়ে রইলেন। সাধারণত এ-জাতীয় বৈঠকগুলিতে তিনি মজার মজার কথা বলে আবহাওয়া হালকা করে রাখেন। আজ সেরকম হচ্ছে না। র্যাবি বললেন, স্যার, আপনার শরীর কি ভালো আছে?
শরীর ভালই।
আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
না, চিন্তিত নই। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। সেজন্যেই আমার আসা।
স্যার, বলুন। ফোর্টনকে এক শ জন কমান্ডার একটি দল পাঠাতে হবে।
কখন?
আজই।
জেনারেল রাবি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। ডোফা বললেন, তুমি কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?
না স্যার, কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই না। এক ঘন্টার মধ্যে হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো পাঠানো হবে। ওদের ওপর কি কোন নির্দেশ থাকবে?
না, কোনো নির্দেশ নয়।
আপনি যদি চান আমি ওদের সঙ্গে থাকতে পারি।
না, তুমি রাজধানীতেই থাক।
জেনারেল র্যাবি ইতস্তত করে বললেন, ঠিক কি কারণে আপনি এটা চাচ্ছেন তা জানতে পারলে আমি সেভাবে ওদের নির্দেশ দিয়ে দিতাম।
ডোফা দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বললেন, তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। আমি খারাপ ধরনের স্বপ্ন দেখেছি।
কি দেখেছেন স্বপ্নে?
আমার মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে।
সে তো আমাদের সবার মধ্যেই আছে। আইনস্টাইনের মধ্যেও ছিল বলে শুনেছি।
ডোফা থেমে-থেমে বললেন, স্বপ্নটা দেখলাম ভোেররাত্রে। যেন ফোর্টনক থেকে জুলিয়াস নিশো বের হয়ে আসছেন। তাঁর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মাউ উপজাতীয়। তারা ছুটে আসছে রাজধানীর দিকে। ডোফা কপালের ঘাম মুছলেন।
জুলিয়াস নিশোকে নিয়ে আপনি চিন্তিত, সেকারণেই এ-রকম স্বপ্ন দেখেছেন। অন্য কোনো কারণ নেই। আমি কি স্যার আপনাকে একটি পরামর্শ দিতে পারি?
হ্যাঁ, পার।
নিশোর ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখবেন না, চুকিয়ে দিন। স্বপ্নের ব্যাপারটাও ভুলে যান।
এ-রকম বাস্তব স্বপ্ন আমি খুব কম দেখেছি। ভোররাত্রের স্বপ্ন, তা ছাড়া এটা আমার জন্মমাস।
আমি স্যার ঠিক এই মুহূর্তে ফোর্টনকে কমান্ডো পাঠানো সমর্থন করি না। কমান্ডো পাঠানো মানেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমাদের যা করতে হবে, তা হচ্ছে। কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না-করে কাজ সারা। তবে আপনি চাইলে এক ঘন্টার ভেতর আমি এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাঠাতে পারি। স্যার, পাঠাব?
ডোফা উঠে দাঁড়ালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, দরকার নেই।
সন্ধ্যায় তিনি একটি চমৎকার ভাষণ দিলেন জাতির উদ্দেশ্যে। সেই ভাষণে জুলিয়াস নিশোর কথা এল
আজ আমি গভীর দুঃখের সাথে স্মরণ করছি প্রয়াত নেতা জুলিয়াস নিশোকে, যাঁর চিন্তায় ও কর্মে জাতির আশা-আকাঙ্খ প্রতিফলিত হয়েছে। যাঁর রচনাবলী আমাকে দিয়েছে নতুন জীবনের সন্ধান। যে-জীবন সুখ ও সমৃদ্ধির, যেজীবন আশা ও আনন্দের।
আমি তাঁর স্মৃতিকে চির জাগরুক রাখার জন্যে জুলিয়াস নিশো সংগ্রহশালা স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছি। তাঁর রচনাবলী যাতে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছতে পারে, সেজন্যে সরকারী পর্যায়ে রচনাবলী প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের হাতে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং আমার বিশ্বাস তারা সুষ্ঠুভাবে সেদায়িত্ব পালন করবে।
রাতে গোয়েন্দা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ব্রিগেডিয়ার সালকের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ। সময় কাটালেন। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল—
ডোফা : মাউরা কি জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করেছে?
নুসালকে : করেছে স্যার। এরা সরল প্রকৃতির মানুষ, সবকিছুই বিশ্বাস করে।
ডোফা : বিশ্বাস যদি করে থাকে, তা হলে এরকম ভয়াবহ একটি গুজব ছড়াল কিভাবে? কেন তাদের ধারণা হল জুলিয়াস নিশো আবার ফিরে আসবেন?
নুসালকে: স্যার, মাউ হচ্ছে একটি কুসংস্কার-আচ্ছন্ন অন্ধকার উপজাতি।
ডোফা : অন্ধকার উপজাতি থোক আর যাই হোক, এরকম একটি গুজবের পেছনে কোনো একটা ভিত্তি তো থাকবে?
নুসালকে : আমি এ নিয়ে প্রচুর খোঁজখবর করেছি এবং এখনো করছি। গুজবের কোন ভিত্তি পাই নি। এটা মুখে-মুখে ছড়িয়েছে। প্রচারটা হয়েছে এভাবে-মাউ জাতির চরম দুর্দিনে জুলিয়াস নিশো ফিরে আসবেন এবং জাতিকে পথ দেখাবেন। সে দিনটি হবে মাউদের চরম সৌভাগ্যের দিন। অনেকটা পথপ্রদর্শকের মতো।
ডোফা : তাই দেখছি। এরা তা গভীরভাবে বিশ্বাস করে?
নুসালকে : জ্বি স্যার, করে।
ডোফা : এই বিশ্বাস ভাঙানোর জন্যে আমাদের কি করা উচিত?
নুসালকে : এই বিশ্বাস ভাঙানোর কোনো রকম চেষ্টা না-করাই উচিত।
ডোফা : কেন?
নুসালকে : যত দিন এই বিশ্বাস থাকবে তত দিন তারা চুপ করে থাকবে। তারা অপেক্ষা করবে জুলিয়াস নিশোর জন্যে।
ডোফা : ভালোই বলেছ। তোমার আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে।
রাত এগারটার দিকে তিনি ফোর্টনকের কারাধ্যক্ষ মাওয়ার সঙ্গে ওয়্যারলেসে কথা বললেন।
কেমন আছ, মাওয়া?
জ্বি স্যার, ভালো। আপনার শরীর কেমন?
আমি ভালেই আছি।
আপনার বক্তৃতা শুনলাম স্যার। চমৎকার।
ধন্যবাদ। তোমাদের ওখানকার সব ঠিক তো?
সব ঠিক আছে।
আমাদের বন্দির খবর কি?
খবর ভালো স্যার। একটু অসুস্থ, তবে তেমন কিছু না।
ডোফা ওয়্যারলেস সেট রেখে দিলেন। সেই রাতেও তাঁর ভালো ঘুম হল না।