মেমোরিয়াল লাউঞ্জে তুমুল উত্তেজনা।
অসহায় সামুদ্রিক তিমি মাছের কল্যাণে টাকা তোলা হচ্ছে। চারদিকে বড়ো বড়ো পোস্টার-তিমি মাছদের বাঁচার অধিকার আছে। নোংরা রাশিয়ান, তিমি শিকার বন্ধ কর। পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে কত তিমি মারা পড়ছে, তার পরিসংখ্যানও ঝলছে জায়গায়—জায়গায়।
মেমোরিয়াল লাউঞ্জে দুটি মেয়ে সেজেগুজে চুমু খাওয়ার স্টল (কিসিং, বুথ) খুলে বসেছে। এদের চুমু খেলে দু ডলার করে দিতে হবে। সেই ডলারটি চলে যাবে তিমি রক্ষার ফাণ্ডে। প্রচুর ডলার উঠছে। মেয়ে দুটি চুমু খেয়ে কুল পাচ্ছে না। আনিস অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুমু খাওয়া দেখল। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকেও কিছু কিছু জিনিসে এখনো সে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে নি। কিসিং বুথ তার একটি।
হ্যালো আনিস।
আনিস তাকিয়ে দেখল, ড. বায়ার। হাতে সাবমেরিন স্যাণ্ডউইচ। গালভর্তি হাসি।
তিমি ফাণ্ডে কিছু দিয়েছ?
এখনো না।
একটা এডভাইস দিচ্ছি, ঐ নীল-স্কার্ট-পরা মেয়েটিকে চুমু খেতে যেও না। সে নিশ্চয়ই দাঁত ব্ৰাশ করে না। ড. বায়ার ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন।
আনিস, তুমি কি লাঞ্চ খেতে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমি জয়েন করতে পারি তোমার সঙ্গে?
তা পার।
আনিস তার প্রিয় জায়গাটিতেই গিয়ে বসল। ভিড় নেই, সবাই জড়ো হয়েছে তিমি মাছদের সাহায্যের ব্যাপার দেখতে। ড. বায়ার অনবরত কথা বলে যেতে লাগলেন, আমেরিকানদের কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু ওদের না হলেও আবার কারের চলে না।
আমেরিকানরা যদি এক বৎসর কোনো ফসল না করে, তাহলে থার্ড ওয়ার্লডের চার ভাগের এক ভাগ লোক মরে ভূত হয়ে যাবে।
মুখে সবাই বলে আগলি আমেরিকান, কিন্তু হাত পাততে হয় আগলি আমেরিকানদের কাছেই, হা হা হা।
রাশিয়ানরা এ বৎসর কত লক্ষ মেটিক টন গম কিনছে জান? জান না? আন্দাজ কর তো।
আনিস হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছিল। ড. বায়ার তাতেই খুশি। একটির পর একটি প্রসঙ্গ টেনে আনতে লাগলেন। এক সময় আনিস বলল, আমাকে এখন উঠতে হয়।
ক্লাস আছে কোনো?
না। লাইব্রেরিতে যাব।
পাঁচ মিনিট বাস। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
আনিস তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
ড. বায়ার বললেন, শুনলাম তুমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যানের কাছে এই রকম একটা চিঠি দিয়েছ।
হ্যাঁ।
অবশ্যই এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবু–কারণ জানতে পারি কি? তুমি এক জন ভালো টীচার। এবং হাইলি কোয়ালিফাইড। খুব শিগগিরই ট্যেনিউর পাবে। তারপর গ্রীন কার্ডের জন্যে দরখাস্ত করতে পারবে।
ড. বায়ার, এখানে আমার ভালো লাগছে না।
তোমাকে দোষ দেয়া যাচ্ছে না, এ জায়গার ওয়েদার অত্যন্ত খারাপ। তুমি বরং কালিফোর্নিয়ার দিকে চলে যাও।
ড. বায়ার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন, দেশটাই তোমার ভালো লাগছে না?
না।
এখানে যে-ফ্রীডম আছে, সে-ফ্ৰীডম তোমার নিজের দেশে আছে?
না।
এখানকার মতো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তোমার দেশে আছে?
না, তাও নেই।
দেখ আনিস, আমি অনেক বিদেশীকে দেখেছি, পড়াশোনা শেষ করে দেশে চলে যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। চলেও যায়, কিন্তু মাস ছয়েক পর আবার ছুটে আসে। স্বপ্নভঙ্গ বলতে পার।
আনিস কিছু বলল না। ড. বায়ার কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, তোমরা বিদেশীরা থাক শামুকের মতো। বাইরের কারো সঙ্গে মিশতে পার না। এটা ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক হতে চেষ্টা করা উচিত। পৃথিবীটাই হচ্ছে তোমার দেশ। এভাবে ভাবলে আর খারাপ লাগবে না।
আনিস কোনো উত্তর দিল না। ড. বায়ার হড়বড় করে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই কিসিং বুথের মেয়ে দুটিকে চুমু খাও নি। খেয়েছ?
না।
এস আমার সঙ্গে, চুমু খাবে। আমাদের কালচারকে দূরে ঠেলে রাখলে তো চলবে না। এস তো দেখি। তবে নীল-স্কার্ট-পরা মেয়েটির থেকে দূরে থাকবে। আমি ঠিক করেছি, ঐ মেয়েটিকে একটি জাম্বো সাইজের এ্যাকোয়াফ্রেশ টুথপেস্ট উপহার দেব, হা হা হা।
আনিসকে ড. বায়ারের সঙ্গে দোতলায় উঠে আসতে হল। কিসিং বুথের নীলস্কার্ট-পরা মেয়েটি নেই। অন্য মেয়েটির গলায় উজ্জ্বল রঙের একটি রুমাল। শঙ্খের মতো সাদা মুখ। শান্ত নীল চোখ। আনিসের মনে হল যেন মালিশা দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দিন মালিশাকে দেখা হয় না। কিসিং বুথের মেয়েটি আনিসের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসিটি পর্যন্ত মালিশার মতো। ড. বায়ার বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন, এগিয়ে যাও।
আনিস মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোল। কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারল মেয়েটিকে। তার ছাত্রী। কোর্স নাম্বার পাঁচ শ দুই-তে আছে। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে রিণরিণে কণ্ঠে বলল, হ্যালো ডক।
আনিস ঠিক করে ফেলল, একগাদা ফুল নিয়ে আজ সন্ধ্যাতেই আবার যাবে মালিশার খোঁজে। কী ফুল নেওয়া যায়? ডাউনটাউনে ফুলের দোকান কটা পর্যন্ত খোলা থাকে?