মুবাশ্বেরা, বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে, বাড়ির মানুষদের তাজ্জব করে দিয়ে মরে গেল, বৃহষ্পতিবার রাতে। মুবাশ্বেরাকে আমি দেখেছি আমাদের বাড়ি ও বেড়াতে এলে অথবা পীর বাড়িতে আমি গেলে। ওর সঙ্গে মিছিমিছির চুলোপাতিও আমার খেলা হয়েছে আমাদের উঠোনে, ছাদে। আর ওর বাড়িতে চুলোপাতি খেলার নিয়ম যেহেতু নেই, ও খেলেছে কারবালা যুদ্ধ, মুবাশ্বেরা হাসান, মহাম্মদ হোসেন। এয়াজিদ আর মাবিয়াকে ওরা ঘুসি ছুঁড়ত, লাথি মারত, শূন্যে। কারণ কেউই এয়াজিদ বা মাবিয়া হতে চাইত না। আমি ছিলাম ওদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার একমাত্র দর্শক।
ফজলিখালার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার সখ্য হয়নি কোনওদিন, খুব দূরের মনে হত ওদের। ওরা, আমরা যে স্বরে ও সুরে কথা বলি, বলে না, বলে অবাঙালির মত, উর্দু টানে। ওরা, পাঁচ বছর বয়সেই নামাজ রোজা শুরু করে, ন বা দশে পৌঁছে বোরখা পরে। ওরা ইস্কুলে যায় না, মাঠে দৌড়োয় না, বাড়ির বাইরে বেরোয় না একা, কারণ ওদের মুরব্বিরা বলে দিয়েছ ওসব করলে আল্লাহ নারাজ হবেন।
মুবাশ্বেরার যখন পনেরোর মত বয়স, আবু বকরের ইস্পাতের কারখানাটি তখন পীর বাড়ির সম্পত্তি। আবু বকর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কারখানাটি লিখে দিয়েছেন পীর আমিরুল্লাহর নামে। পিঁপড়ের মত লোক ভিড় করে পীরের মজলিশে, পীর নিজে পছন্দ করে, খাঁটি আল্লাহভক্ত লোক বেছে কারখানার চাকরিতে ঢোকান। টুটু আর শরাফমামা তখন লেখাপড়া আস্তাকুড়ে থুয়ে পীরবাড়িতে ঢুকেছেন। ফজলিখালা নিজের ভাইদের দুনিয়াদারি ছাড়িয়ে আল্লাহর পথে আনতে পেরে খুশিতে আটখানা। প্যান্ট শার্ট ছেড়ে টুটু আর শরাফ মামা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন, মাথায় গোল টুপি পরেন, দাড়িমোচ চাছেন না। দুনিয়াদারির ছিঁটেফোঁটা শেকড় যা আছে উপড়ে ফেলতে ছোট ছোট ঘরগুলোয় বসে হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা ওঁদের নছিহত করে। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। হঠাৎ একটি নছিহতের ঘরে ঢুকে আমাকে টুটু মামার ধমক খেয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। টুটু মামা শুয়েছিলেন, আর হুমায়রা পাশে বসে তাঁর বুকে হাত বুলিয়ে নছিহত করছিলেন। নছিহত করতে হয় অমন একলা ঘরে, বুকে হাত বুলিয়ে, ঘর অন্ধকার করে। মা অমনই বলেছিলেন। শরাফ মামাকে নছিহতের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মুবাশ্বেরা। এ তো আর পর পুরুষকে নছিহত করা নয়, নিজের মামাকে করা। ওই নছিহত করার কালেই মুবাশ্বেরাকে জিনে ধরল। এই জিন আবার অন্যরকম, গাছের তলায় বসে একা একা কাঁদে। কেন কাঁদে, কাউকে বলে না কিছু। খেতে রুচি নেই, বমি বমি লাগে, নামাজ রোজায় রুচি নেই, কেবল গাছের তল খোঁজে। নছিহতে ভাঁটা পড়ে। সেই খলবলে মেয়ে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মেয়ে মুবাশ্বেরা বিছানা নিল। জিন তাড়ানোর ব্যবস্থা করার আগেই তার গা পুড়ে যাওয়া জ্বর। পানি পড়া খাওয়ানো হয়, নানা রকম সুরা পড়ে ফুঁ দেওয়া হয় গায়ে, জ্বর তবু সারে না। ফজলিখালা মুবাশ্বেরার মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকেন। কপালে জলপট্টি দেন, জলপট্টি থেকে ধোঁয়া বেরোতে থাকে গায়ের আগুনের। মুবাশ্বেরার শ্বাস কষ্ট হতে শুরু হয়।
ফজলিখালা বলেন–আর পারি না । এবার ডাক্তার ডাক।
— ডাক্তার!
— পানিপড়ায় জ্বর সারছে না, ডাক্তারের ওষুধে সারবে? মূসা, ফজলিখালার মেদেনিপুরি স্বামী বলেন।
— না সারুক, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! আল্লাহুসশাফি, ভাল করার মালিক আল্লাহ, ওষুধ উছিলা মাত্র।
ডাক পড়লে ডাক্তার রজব আলী তাঁর ডাক্তারি ব্যাগখানা হাতে নিয়ে রোগীর রোগ ভাল করতে যান পীরবাড়িতে, রাত তখন সাড়ে বারো।
রোগী শুয়ে আছে শাদা বিছানায়। সাত দিনের জ্বরে ভোগা শীর্ণ রোগী। জিভ শাদা, চোখ শাদা, নখ শাদা। ফ্যাকাসে। বিবর্ণ।
ডাক্তার নাড়ি টেপেন, রক্তচাপ মাপেন, হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনেন। ডাক্তার ঘর খালি করতে বলেন দশ মিনিটের জন্য, দশ মিনিট পর ফিরে আসতে বলেন ঘরের লোকদের, ঘরে। ডাক্তার ইনজেকশন দেন রোগীকে। ডাক্তারের কপালে বাড়তে থাকে ভাঁজ। ভাঁজ নিয়েই ডাক্তার বলেন–দেখ, কি হয়।
ডাক্তার কোনও পারিশ্রমিক নেন না, তিনি আত্মীয়ের বাড়ির রোগী দেখলে রোগী মাগনাই দেখেন।
মুবাশ্বেরা সকালে ঠান্ডা হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়, মরে। ফজলিখালা ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কেউ মরলে এ বাড়িতে চিৎকার করে কাঁদতে নেই। কারণ মরণ লেখা ছিল কপালে, মরেছে। আর মরে যাওয়া মানে আল্লাহর কাছে ফেরত যাওয়া। আল্লাহর কাছে যে গেছে, তার জন্য হাহাকার করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। বরং তাকে হাসি মুখে বিদায় দাও। ফজলিখালা চিৎকার করে কাঁদতে যখনই শুরু করেছেন, জোহরা, হুজুরের বড় মেয়ে, লাফিয়ে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরলেন — ছি ছি এইসব কি কর, তোমার মেয়ে আল্লাহর কাছে গেছে। তার জন্য দোয়া কর, ভাবী। দেখ, দেখ ওর মুখখানায় কী নূর, ও বেহেসতে যাবে। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন। কাঁদলে গুনাহ হবে। চোখের পানি যদি ফেলতে চাও, ফেল, কোনও শব্দ যেন বের না হয়।
কেউ মারা গেলে হাহাকার করা কবিরা গুনাহর সামিল। ফজলিখালাকে নিয়ম মেনে নিতে হয়। তিনি মুখে ওড়না ঠেলে শব্দের টুঁটি টিপে ধরেন।
মা বিকেলে বাড়ি ফিরে চোখের পানি ফেলছিলেন মুবাশ্বেরার জন্য। বাবা বাড়ি ফিরলে বললেন — মুবাশ্বেরা মারা গেছে।
— আরও আগে চিকিৎসা করলে বাঁচতে পারত। আমি যখন দেখলাম, তখন আর সময় নাই। বাবা বলেন।
মা বাঁ হাতে চোখের পানি নাকের পানি মুছে নিয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন — হায়াত না থাকলে বাঁচবে কেমনে? আল্লায় এর বেশি হায়াত দেন নাই। ও নিশ্চই বেহেসতে যাইব। মরার আগে ও আল্লাহ আল্লাহ বইলা ককাইতাছিল।
বাবা জুতো খুলে খাটের নিচে রাখেন। মুজো খুলে জুতোর পেটের মধ্যে। কপালে ভাঁজ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে — ওর ত বাচ্চা পেটে আছিল।
— কার পেটে?
বাঁ পাশের ঘরের দিকে আমার পাতা কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।
— কার পেটে আবার, তুমার বইনের মেয়ে, কী নাম ওর, মুবা, মুবাশ্বেরার!
বাবা ঘামে ভেজা শার্টটি হ্যাঙারে ঝুলোতে ঝুলোতে বলেন।
— ওর বিয়া হয় নাই, বাচ্চা পেটে থাকব কেন? এই পবিত্র মেয়েটা সম্পর্কে এই বাজেকথাগুলা কিভাবে মুখে আনো? জিব্বা তুমার খইসা পড়ব কইলাম। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
প্যান্টের ওপরে লুঙ্গি পরে লুঙ্গির একটি কোণা দাঁতে কামড়ে, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লুঙ্গির তল থেকে প্যান্ট খুলে আলনায় মেলে, দাঁত থেকে কোণা ছাড়িয়ে পেটের ওপর লুঙ্গির গিঁট দেন।
মা হাঁটেন সামনে পাঁচ পা, ঘুরে আবার পাঁচ পা। দরজার ফাঁক দিয়ে পা গুলো দেখতে পাচ্ছি দুজনের। মা সামনে পেছনে করে করে বাবার খালি পায়ের দিকে এগোলেন। মা’রও খালি পা, কালো পা, কোমল, বুড়ো আঙুলে অসুখ হয়ে নখ ওঠা, বাবার পা ফর্সা, মোজায় ঢাকা থেকে ফ্যাকাসে। চার পা কাছাকাছি। বাবার পায়ের আঙুলগুলো জোট বাঁধা, পা দুটো ঝুলে থাকে খাটের কিনারে, নখ ওঠা টলমল পা যায় জোট বাঁধা আঙুলের পা দুটোর পেছনে। ফিরে আসে আবার।
— বাচ্চা নষ্ট করছিল বোধয় শিকড় টিকড় দিয়া। ইনফেকশন হইয়া গেছিল, সেপটিসেমিয়া। বাবার ঠান্ডা গলার স্বর শুনি।
— না, মিছা কথা। জিভ খইসা পড়ব তুমার। আল্লায় বিচার করব এইসব বদনামের। মা’র গলায় আগুন। ধরাস করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়।
ও ঘর থেকে শব্দগুলো শিলপাটায় গুঁড়ো হয়ে এ ঘরে আসে, আমি গুঁড়ো জোড়া দিয়ে পারি না একটি অক্ষরও দাঁড় করতে।
মরে যাওয়াটা আমার মনে হতে থাকে খুব সহজ একটি ঘটনা। এই আজ শ্বাস নিচ্ছি ফেলছি, কাল হয়ত ঠান্ডা হয়ে পড়ে থাকব শাদা বিছানায়। আজ হাত পা নড়ছে, কাল নড়বে না। আজ স্বপ্ন দেখছি, কাল দেখব না। মরে গেলেই সব ফুরুৎ। মা বলেন রুহু উড়ে যায় আল্লাহর কাছে, দেহটা পড়ে থাকে দুনিয়ায়। রুহুটাই সব। রুহু কি করে ওড়ে, শাদা কবুতরের মত? মা বলেছেন রুহু অদৃশ্য, দেখা যায় না। অদৃশ্য কত কি যে আছে দুনিয়ায়।
মুবাশ্বেরা মরে যাওয়ার পর শরাফ মামা আল্লাহর পথ থেকে সরে এলেন, তাঁকে নছিহতের কেউ নেই বলে আর। তিনি আবার প্যান্ট শার্ট পরে দুনিয়াদারিতে নামলেন। ঘরের ট্রাংকে তিনি কিছুদিন স্মৃতি তুলে রেখেছিলেন রক্তের দাগ পড়া ত্যানাতুনোর।