বিকেলবেলায় মিস্টার মাওজীর সঙ্গে সোমনাথের দেখা করার কথা আছে। মাওজীরা নানারকম কেমিক্যালের ব্যবসা করেন। আদকবাবুই এদের খবর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভীষণ ভদ্রলোক, বোম্বাই মুসলমান এরা। আপনার ব্রীজবার মতো শুধু নিজের আত্মীয়কুটুম্ব এবং গাঁয়ের লোকদের কোলে ঝোল টানেন না। মুখজ্যে, চাটুজ্যে, হাজরা, দাস, বোসদের সঙ্গেও এরা সম্পর্ক রাখেন-লাভের সবটাই দেশে পাঠাবার জন্যে এরা উঁচিয়ে বসে নেই।”
মাওজীদের সঙ্গে এরমধ্যে কয়েকবার দেখা করে এসেছে সোমনাথ। ওরা একেবারে বিদায় দেননি। সোমনাথকে একটু বাজিয়ে দেখেছেন। দু-একটা অফিস থেকে খবরাখবর আনতে বলেছেন। সোমনাথ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। দু-একটা ভালো খবরও এনেছে।
মিস্টার মাওজী আজ জিজ্ঞেস করলেন, “কাজকর্ম কেমন হচ্ছে, মিস্টার বনাজি?”
এ-পাড়ার অভিজ্ঞতা থেকে সোমনাথ জেনেছে, কখনও বলতে নেই যে কিছুই হচ্ছে না। তাতে পার্টির ভরসা কমে যায়, ভাবে লোকটার দ্বারা কিছু হবে না। তাই ব্যবসায়িক কায়দায় সোমনাথ বলে, “আপনাদের শুভেচ্ছায় চলে যাচ্ছে।”
মাওজী জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কোন লাইনে কাজ করছেন?”
কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না সোমনাথ। কোথায় সায়েব বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, এই খোঁজখবর করছে বললে মিস্টার মাওজী নিশ্চয় ইমপ্রেসড হবেন না। হঠাৎ খাম এবং কাগজের কথা মনে পড়ে গেলো। বললো, “পেপার, স্টেশনারি এই সব অফিস সালাইয়ের দিকে জোর দিচ্ছি।”
মাওজী বললেন, “ওসব লাইনে তো বেজায় ভিড়। ওখানে খুব সুবিধে হবে কী “
“অফিস-টফিসে হায়ার লেভেলে কিছু জানাশোনা আছে, কোনোরকমে চালিয়ে দিচ্ছি।’ সোমনাথ বেশ সুন্দর অভিনয় করলো। মাওজী যদি জানতে পারেন—গত ক’মাসে সে সব সমেত তিরিশ এবং দেড়শ’ টাকা রোজগার করেছে।
“কাজ বাড়িয়ে যান, মিস্টার মাওজী বললেন। “বিজনেস এমন জিনিস যে দাঁড়িয়ে থাকাটাই মত্যু। সব সময় এগিয়ে যেতে হবে।”
কী ধরনের উত্তর দেওয়া উচিত সোমনাথ বুঝতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বললো, “বুঝতেই পারছেন—ক্যাপিটালের অভাব। টাকা না হলে ব্যবসা হয় না। সরকারী ব্যাঙ্কগুলো বলছে পয়সা আমরা দেবো। কিন্তু কেবল নামকাওয়াস্তে। ওদের কাছে টাকা নিয়ে তো ক্যাপিটেল বাড়ানো যায় না।”
এমন সময় মাওজীদের আর এক ভাই ঘরে ঢুকলেন। সিনিয়র মিস্টার মাওজী এবার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জনির মাওজী সোমনাথের মখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে তো দেখেছি মনে হচ্ছে।”
“কোথায় বলুন তো?” স্ট্র্যান্ড রোডের রেস্তরাঁয় লোকটা এতোক্ষণ বসেছিল না তো? সোমনাথের একটু চিন্তা হলো।
মাওজী বললেন, “এবার মনে পড়েছে। লেকের ধারে। একটা অ্যামবাসাড়ার গাড়ি চালাচ্ছিলেন আপনি। সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা ছিলেন। আপনারা কোকাকোলা খেলেন। আমরাও ওই দোকানে কোক খাচ্ছিলাম।”
সিনিয়র মাওজী ধরে নিলেন সোমনাথের গাড়ি আছে। তিনি বললেন, “যা বলছিলাম, মিস্টার বনাজি। নজরটা উঁচু করুন। আপনার গাড়ি রয়েছে, জানাশোনা কোম্পানি রয়েছে অনেক—আপনি বড়-বড় কাজ ধরবার চেষ্টা করুন। টাকার জন্যে ভাববেন না। টাকার কোনো দরকার নেই। আপনি শুধু অর্ডার বুক করবেন। কোম্পানি সোজা মাল পাঠিয়ে দেবে আপনি কমিশন পেয়ে যাবেন।”
মিস্টার মাওজী যে কী বলছেন সোমনাথ বুঝতে পারছে না।
মাওজী বললেন, “আমাদের কয়েকজন আত্মীয় বোম্বাইতে একটা কেমিক্যাল ফ্যাকটরি খুলেছে। কয়েকটা প্রোডাক্ট আমরা নিজেরাই বাজারে চালাচ্ছি। আপনি একটু বসুন—আমার কাজিন বোম্বাই থেকে এসেছে, এখনই দেখা হয়ে যাবে।”
মিস্টার মাওজীর কাজিন একটু পরেই এলেন। সব শুনে বললেন, “আপনাকে একটা সুযোগ দিতে পারি আমি। আমাদের নতুন মালি কয়েকটা জায়গায় চালু করবার চেষ্টা করে দেখুন। আপনার কোনো আর্থিক দায়িত্ব নেই। সোজা এখানে অর্ডার পাঠিয়ে দেবেন। তারপর যদি ভালো কাজ দেখাতে পারেন আপনার ফিউচার ব্রাইট। আমরা আপনাকে এজেন্সি দিয়ে দেবো। কমিশন পাবেন।”
বেশ উত্তেজনা বোধ করছে সোমনাথ। আদকবাবু বললেন, “দেখুন যদি আপনার কিছু, হয়। ও-ঘরে মিস্টার সিংঘী তো বোম্বাই-এর ভালো একটা কোম্পানির এজেন্সি রেখেছেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাসে বারোশ’ টাকা রোজগার করছেন।
সুতরাং বলা যায় না—হয়তো এবার সত্যিই সোমনাথ ব্যানার্জির ভাগ্য খুলবে।
বউদি এদিকে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বলছেন, “বাবাকে আর চেপে রেখে লাভ কী?”
সোমনাথ বললো, “দাঁড়ান, আগে একটু আশার আলো দেখি। এখনও পর্যন্ত তো আপনার দেওয়া পয়সাতেই টিফিন সারছি।”
সোমনাথ ঠিক করেছিল কাউকে বলবে না। কিন্তু বউদির কাছে চাপতে পারলো না সোমনাথ। “বউদি, যা দেখছি, বড় জায়গায় বড় টোপ ফেলতে হয়। নোংরা জামা-কাপড় পরে বাসে-ট্রামে ঝলে পারচেজ অফিসারদের কাছে গেলে কাজ হয় না। দু-একদিন যদি গাড়িটা বার করবার দরকার হয়?”
“এতো বলবার কী আছে?” বউদি ভেবে পান না। “তা ছাড়া তোমার দাদা এখানে নেই। মাঝে মাঝে গাড়িটা বার করলে বরং ভালোই হবে। তুমি আমার কাছে পেট্রলের দাম নিয়ে নেবে।”
তেলের দাম দরকার হবে না। এখনও নগদ দেড়শ’ টাকা পকেটে রয়েছে। মাছের তেলেই মাছ ভাজবে সোমনাথ।