১৬
সাফিয়া বেগমের শরীরটা খারাপ ৷ শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ৷ রাত্রিবেলা কাশির গমকে ঘুম আসতে চায় না ৷ একটুক্ষণ চোখ জোড়া লাগতে না লাগতেই আবার কাশির চোটে তিনি জেগে ওঠেন ৷ বুকের মধ্যে টান পড়ে ৷ তাঁর পাঁজর হাপরের মতো ওঠানামা করে ৷ হা করে তিনি শ্বাস নেন, শ্বাস ছাড়েন গোঁয়ারের মতো ৷ চোখ পানিতে ভরে ওঠে ৷ বিছানায় বসে থাকেন ৷ তাঁর অসুখটা যে বেড়েছে, এই খবর তিনি আজাদকে জানাননি ৷ খবর পেলে ছেলে উতলা হয়ে পড়বে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছুটে আসবে মাকে দেখতে ৷ শরীর তো যন্ত্রেরই মতো, মাঝে মধ্যে একটু বিগড়াবেই ৷ তাই নিয়ে একেবারে ডাক্তার ডাকো রে, হাসপাতালে চলো রে, আত্মীয়স্বজনদের খবর দাও রে করে জগৎটাকে আছড়ে-পিছড়ে মারার তো দরকার নাই ৷ নীরবে সহ্য করতে পারলে আর কিছুই লাগে না ৷
কিন্তু এবার ব্যারামটা তাঁকে সাঁড়াশির মতো করে চেপে ধরেছে ৷ মনে হচ্ছে, এতটুকুন শরীর এতটা ধকল এ যাত্রা আর সইতে পারবে না ৷ ডালু ডাক্তার ডেকে এনেছিল ৷ ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন ৷ ভালো ভালো খেতে বলেছেন ৷ অসুখ বেশি হলে, বলেছেন, হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে ৷ কিন্তু সাফিয়া বেগম টাকা খরচ করতে চান না ৷ ব্যাঙ্কের ফোল্ডে তাঁর গয়না জমা আছে, এখন তাঁর চিকিৎসার জন্যে সেই গয়নার কিছুটা তুলে বেচতে তাঁর মন থেকে সাড়া আসে না ৷ ছেলের পড়ালেখার খরচের জন্যে টাকা খরচ করা যায়, গয়নাও বিক্রি করা যায়, কিন্তু নিজের চিকিৎসার জন্যে কি তা করা যায় ? গয়না কি তাঁর, নাকি তাঁর ছেলের বউয়ের ?
আজকের রাতটা মনে হয় আর পার হবে না-এতটাই কষ্ট হচ্ছে সাফিয়া বেগমের ৷ বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে জলকণা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, তাতেই তাঁর শ্বাসকষ্টটা গেছে বেড়ে ৷ একটা ওষুধ আছে, তার ভাপ মুখে টেনে নাকে নিতে হয়, দাম বেশি বলে তিনি সেটা সাধারণত ব্যবহার করেন না, সেটা এখন হাতের কাছে থাকলে ভালো হতো ৷
বিছানায় বসে থেকে অতিকষ্টে তিনি শ্বাস টানেন ৷ আজকের রাতটা কি আর পার হবে না ?
তখন তাঁর খুব আজাদকে দেখতে ইচ্ছা হয় ৷ শরীরটা তাঁর আর চলছে না, কী জানি যদি না টেকে, যদি আজ রাতেই তাঁর মৃত্যু লেখা থাকে, তাহলে তো আর আজাদের মুখটা তিনি মরার আগে দেখতে পাবেন না ৷ ছেলেকে খবর না দেওয়াটা মনে হয় ভুলই হলো!
শেষরাতে সাফিয়া বেগমের কাশির গমক খুব বেড়ে গেলে তার ভাগি্ন মহুয়ার ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে উঠে দেখে, আম্মার প্রাণ বুঝি যায় ৷ সে ডালুকে খবর দিলে ডালু এসে সাফিয়া বেগমকে ঘুমের ওষুধ ডাব্ল ডোজ খাইয়ে দেয় ৷ কাশি তাতেও কমে না, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে, এক সময় সাফিয়া বেগম ঘুমিয়ে পড়েন ৷ ঘুমের আগে তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু পড়ে নেন, তাঁর মনে হয়, এই ঘুমই তাঁর শেষ ঘুম, তিনি আর কোনো দিন জাগবেন না, ঘুমের আগে তিনি আজাদের মুখটা মনে করবার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার বড়বেলার চেহারাটা কিছুতেই তাঁর মনে আসে না, কেবল ছোটবেলায় যখন সে কেবল স্কুল যেতে শুরু করেছে, সেই সময়ের চেহারাটা মনে আসে, স্কুলের ব্যাগ কাঁধে, পায়ে কেডস, আজাদ ফিরছে…আজাদকে না দেখেই কি তাঁকে চলে যেতে হবে দুনিয়া ছেড়ে ৷ তাঁর দু চোখ গরম জলে ভেসে যেতে চায় ৷
ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখতে পান, তাঁর শিয়রের কাছে বসে আজাদ, তাঁর ধন্দ লাগে ৷ তিনি কি জেগে আছেন, নাকি স্বপ্ন দেখছেন ৷ নাকি এটা ঠিক মরজগৎ নয়, তিনি অন্য কোথাও ৷ শরীর খুবই দুর্বল, জোর পাওয়া যাচ্ছে না একটুও, কিন্তু ধীর গলায় কে যেন ডাকছে, এ যে ঠিক আজাদেরই গলা ৷ তিনি চোখ খোলেন ৷ দেখেন তাঁর মুখের ওপরে আজাদের মুখ ৷ তিনি বলেন, ‘আজাদ ? কখন এলে বাবা ?’
‘এই তো এখনই ৷ তুমি ঘুমাও ৷’
মার মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ৷ ঘুমটা চোখ থেকে পুরোপুরি উবে যায়, তিনি উঠে বসার চেষ্টা করেন ৷ স্বপ্নের মতোই মিষ্টি একটা ব্যাপার ঘটে গেল, তাঁর আজাদ এসে বসে আছে তাঁরই শিয়রের কাছে ৷ মায়ের মনের ডাক সে নিশ্চয় শুনতে পেয়েছে তার মনের গ্রাহকযন্ত্রে ৷ তিনি ওঠার জন্যে মাথাটা তোলেন, হাত দিয়ে বিছানা ধরেন ৷
আজাদ বলে, ‘না, তুমি শুয়ে থাকো ৷ তোমার শরীর এতটা খারাপ, তুমি আমাকে খবর দাওনি কেন ৷ কেন আমাকে লোকমুখে তোমার অসুখের খবর পেতে হলো ?
‘কী এমন অসুখ ৷ এমনি ভালো হয়ে যাব!’
‘এমনি এমনি অসুখ ভালো হয় ? তোমাকে হসপিটালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে ৷’
‘তুই এসেছিস ৷ আমি এখন এমনি ভালো হয়ে যাব ৷’
মা উঠে পড়েন ৷ বলেন, আজাদ এসেছে, আর আমি শুয়ে থাকব নাকি! সবাই তাঁকে নিষেধ করে রান্নাঘরে হেঁশেলের ধারে যেতে, চুলার গরমে তাঁর শরীর খারাপ করবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি সন্ধ্যার মধ্যেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন, ছেলের কিছু প্রিয় খাবার আছে, তিনি লেগে পড়েন তারই একটা দুটো পদ রান্নায় মহুয়াকে সাহায্য করতে ৷ ছেলের আকস্মিক আগমনের উৎসাহে শরীরটা তাঁর দাঁড়িয়ে যায়, রান্নাঘরের কাজটা ভালোই এগোয়; কিন্তু রাতের বেলা শরীর তার খাজনা আদায় করে নিতে থাকে, তিনি ভয়াবহ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷
মহুয়া, কচি কাঁদতে থাকে ৷ আজাদ ছুটে যায় রাস্তায় ৷ একটা ফোন করা দরকার ৷ দরকার একটা অ্যাম্বুলেন্স ৷ মাকে হাসপাতালে নিতে হবে ৷ এক্ষুনি ৷
অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না ৷ কিন্তু ফোন করে সে তার বন্ধু ফারুকের গাড়িটা পেয়ে যায় ড্রাইভার-সমেত ৷ মাকে নিয়ে সে সোজা চলে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৷ সারাটা রাস্তা সে শুধু আল্লাহর নাম জপতে থাকে ৷
কেবিন খালি পাওয়া যায় ৷ মাকে সে ভর্তি করিয়ে দেয় কেবিনে ৷ সারা রাত সে বসে থাকে মার শয্যাপাশে ৷ রাত বাড়ে ৷ চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসে ৷ ঘড়ির কাঁটার টিক টিক আর মায়ের শ্বাস নেওযার শব্দ শোনা যায় ৷
আজাদ আল্লাহকে বলে, ‘হে আল্লাহ, আমার মাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো ৷ আমার মা বড় দুঃখী ৷ তিনি আমার জন্যে অনেক দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন ৷ আমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন ৷ তাঁর কষ্টের পালা তিনি অতিবাহিত করেছেন ৷ এখন আমার পালা ৷ আমি করাচিতে ব্যবসা শুরু করেছি ৷ কিছু কিছু লাভও হচ্ছে ৷ ভবিষ্যতে এমএ শেষ করে পুরোপুরি আয় করতে লেগে যাব ৷ ভালো বাসা নেব ৷ মাকে সেই বাসায় তুলব ৷ মাকে আর কষ্ট করতে হবে না ৷ এই সময়টায় মাকে তুমি নিও না ৷ মাকে বাঁচিয়ে রাখো ৷ তাঁকে সুস্থ রাখো ৷ তাঁকে নীরোগ রাখো ৷ তাঁকে সুখে রাখো ৷ তাঁকে শান্তিতে রাখো ৷’
আজাদ বিড়বিড় করে এই প্রার্থনা করে আর তার দু চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে ৷ নাক দিয়েও জল ঝরতে থাকে টপ টপ করে ৷
দুদিন পর মা কিছুটা সুস্থ হলে সে মায়ের সামনে হাজির করে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা সোনার গয়না তোলার কাগজ, বলে, ‘সাইন করো ৷’
‘কেন, সাইন করব কেন ?’
‘গয়না তুলতে হবে ৷’
‘না ৷ আমি সাইন করব না ৷’
‘কেন, করবা না কেন ?’
‘এই গয়না আমার না ৷ আমি এটা আমার চিকিৎসার জন্যে খরচ করতে পারব না ৷’
‘এই গয়না তোমার না ? এগুলো না তুমি তোমার বিয়ের সময় পেয়েছিলে, তোমার বাপের বাড়ি থেকে ?
‘পেয়েছিলাম ৷ কিন্তু এগুলো আমার জন্য খরচের কোনো অধিকার আমার নাই ৷’
‘মানে ?’
‘এগুলো তোর বউয়ের হক ৷ আমি এগুলো তার জন্যে জমা করে রেখেছি ৷ এগুলো আমি তোর বউয়ের হাতে তুলে দিতে চাই ৷’
আজাদ কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারে না ৷ এই মহিলা তো আচ্ছা বাতিকঅলা ৷ কবে আজাদ বিয়ে করবে, কবে তার বউ হবে, তার জন্যে সে গয়না জমিয়ে রেখেছে, আর নিজে বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে ৷
‘দ্যাখো মা ৷ তুমি যদি এখন সাইন করলা তো করলা ৷ না করলে আমিও তোমারই ছেলে ৷ আমার কিন্তু তোমার মতোই জেদ ৷ সোজা দুই চোখ যেদিকে চায় চলে যাব ৷ আর কোনো দিন আসব না ৷ করো সাইন ৷ তোমার এত গয়না দিয়ে কী হবে ৷ দুই ভরি এখন বেচি ৷ বাকিগুলো তো থাকলই ৷’
মা কাগজে স্বাক্ষর করে দিলে ব্যাঙ্ক থেকে গয়না তুলে দুই ভরি সোনার জিনিস বিক্রি করে দিয়ে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করা যায় ৷ তা থেকে চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহ করে যা বাঁচে, তা আজাদ তুলে দেয় মহুয়ার হাতে ৷ মায়ের যখন যা লাগে, তা যেন এই টাকা দিয়ে সে কিনে দেয় ৷
আজাদ ঢাকায় ফিরে এসে যখন হাসপাতাল, ডাক্তার, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত, তখন পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠছে ৷ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছে, গ্রেপ্তারপর্ব শুরু হয়ে গেছে ৷ ৬ দফা দাবিও পূর্ববাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ৷ রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে জারি করা আদেশের প্রতিবাদে এ অঞ্চলের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নানা রকম প্রতিবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ৷ এমনকি ঢাকায় বসবাসকারী উর্দুভাষীদের পক্ষ থেকে নয়জন লেখক ও দুটি প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন ৷ যদিও অচিরেই সরকার তাদের রবীন্দ্রবিরোধী আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়, তবু সারা প্রদেশে সভা-সমাবেশ-মিছিল চলতেই থাকে ৷
এইসব ঘটনা নিয়ে আজাদের কোনো কোনো বন্ধু ব্যস্ত হয়ে পড়ে ৷ মেনন গ্রুপ, মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ ৷ আজাদ ব্যস্ত তার মাকে নিয়ে ৷ বন্ধুদের কেউ কেউ ব্যস্ত দেশমাতার জন্যে ৷
আজাদের আর করাচি ফিরে যাওয়া হয় না ৷ সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ঢাকাতেই থেকে যাবে ৷ ঢাকাতেই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে ৷ পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমএটা সম্পন্ন করবে ৷
মাকে সে জানায় তার সিদ্ধান্তের কথা ৷
মা বলেন, ‘না, কেন তুই যাবি না ৷ আমার জন্যে ? না, তা হবে না ? আমার জন্যে তোর লেখাপড়ায় ছেদ পড়বে, এটা আমি হতে দেব না ৷ তুই অবশ্যই করাচি যাবি ৷’
আজাদ বলে, ‘না তো, তোমার জন্যে না তো ৷ আমি যাচ্ছি না আমার নিজের জন্য ৷ করাচি আমার ভালো লাগে না ৷ পশ্চিম পাকিস্তান আমার ভালো লাগে না ৷ উর্দু বলতে আমার ভালো লাগে না ৷ রুটি-ছাতু খেতে আমার ভালো লাগে না ৷’
মা বলেন, ‘করাচিতে তোর বুঝি খুব কষ্ট হয় ?’
আজাদ বলে, ‘হয় ৷ কেমন কষ্ট, এটা ঠিক বোঝানো যাবে না ৷ ধরো আমাকে না দেখলে তোমার কষ্ট হয় না ? এই রকম কষ্ট ৷ নিজের দেশ হলো আমার নিজের দেশ ৷’
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের নিজের দেশ না ?’
‘না ৷ তুমি ওদেরকে আপন ভাবতে পারো, ওরা ভাবে না ৷’
‘তাহলে তুই কী করবি ? যাবি না আর ?’
‘না ৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব ‘খন ৷’
মা মনে মনে খুশি হন ৷ আজাদকে চোখের আড়াল করতে কি তাঁর ভালো লাগে ? তবে সেটা তো তাঁর নিজের স্বার্থ ৷ তাঁর নিজের স্বার্থে তিনি ছেলের পড়াশোনার পথে অন্তরায় হতে চান না ৷