বেটার মরার কথা ইশারায় জানিয়ে দিয়ে পাকা দেড়টি মাস পর কাফনের কাপড় পাল্টে খয়েরি-নীল চেক-কাটা লুঙ্গি পরে এই ভর দুপুরবেলা ওই মানুষটা এসেছে ওই ছেলেরই চল্লিশার ভাত খেতে। তাও একবার খেয়ে তার আশ মেটে নি, বেহায়ার মতো ফের বসেছে কলাপাতা পেতে। হামিদা মানুষটাকে দেখে, ভালো করে দেখে; তার নজর লেগেই কি-না কে জানে, লোকটার কাঁচাপাকা দাড়িগুলো দেখতে দেখতে পেকে ওঠে। এবং তার গলায় গজিয়ে ওঠে শেকলের মালা। এইসব কাণ্ডে হামিদার নজর দেওয়ার শক্তি লোপ পায় এবং তার চোখজোড়াও বুজে আসে। তবে তার শরীরের কাঁপুনি কমে।, ওই কাঁপুনির ধাক্কায় তার মায়ের শরীর কাঁপে দ্বিগুণ বেগে। তবে মেয়ের মতো তার জবান বন্ধ হয় নি। হামিদার মায়ের বিলাপে ভেতর-উঠান থেকে অনেকেই এই ঘরে আসে এবং তাদের অনেকেই হামিদার বিচলিত হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে তার ওপর বিরক্ত হয়। তবে সহানুভূতিও কারো কারো ছিলো বৈ কি? তারা জিভ দিয়ে চ চ। এবং গলায় নানারকম ভিজে আওয়াজ করে। তবে তাদের কিছুই করবার নাই এবং বৌয়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের অধিকার তাদের এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাদের। সমবেদনা প্রকাশ অন্যদের বিরক্তিকে আরো বাড়ায়। রীতিমতো রাগ করে হামিদার শাশুড়ি, শরাফতের বড়োবিবি। বৌয়ের ওপর রাগের চোটে নাতির শোক তার স্থগিত থাকে এবং অনেকদিন পর হুমায়ুনের জন্যে উদ্বেগ ও কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ক্রোধের হাওয়ায় তার নিজের রেওয়াজ বাতিল হয়ে যায়। পুবদুয়ারি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।
বারবার ডাক পেয়ে আবদুল আজিজ একবার আসে। হামিদার এইসব ব্যাপারে সে বেশ ব্ৰিত, বিচলিতও বটে। শাশুড়ির সামনে বৌয়ের সঙ্গে রাগারাগি করার ঝুঁকিও নিতে। পারে না, তাই হামিদাকে সে ধমকায় একটু আদুরে গলায়, বাবরের মা, তুমি একটু শক্ত না হলে চলে? মনটা শক্ত কর। আল্লার মাল আল্লার পছন্দ হছে, নিয়া গেছে।
আজিজ ঘরে ঢুকতে তার শাশুড়ি সরে গিয়েছিলো দরজার আড়ালে। টাউনের শাশুড়ি, লজ্জাশরম কম, তাই ওখান থেকেই জামাইকে সরাসরি বলতে পারলো, হামিদা টাসকা ল্যাগ্যা গেছে বাবা, একটা বড়ো ব্যারাম হতে কততক্ষণ? কাল না হয় হামি অক সাথে করা লিয়া যাই।
শুনে সবাই ঠোট বাঁকায়, বেটা যেন কারো আর মরে না! বেটার শোকে মায়ের কঠিন ব্যারাম হবে কেন? এটা আবার কোন দেশী কথা গো? টাউনের বুড়িগুলোর আক্কেল জ্ঞান কম।
এদিকে বৌয়ের রোগশোক নিয়ে পড়ে থাকলে আবদুল আজিজের চলে না। উঠানে সারি সারি বসা মেয়েদের পেছন দিয়ে সে চলে যায় বাইরে মজলিশের মাঝখানে। বৌ-সোহাগের সময় কোথায় তার? মানুষ এতো এসেছে, এরকম জেয়াফত তাদের বাড়িতে এই প্রথম। বংশে মানুষ কি আর মরে নি? তার দাদার চল্লিশায় ফকির খাওয়ানো হয়েছিলো, জনা পঁচিশেক মানুষ ছিলো কিনা সন্দেহ। আর আজ তার নিজের ছেলের মৃত্যুতে এতো বড়ো আয়োজন। আজিজের চোখ ছলছল করে, হুমায়ুন মরে গিয়ে বাড়িতে এতো মানুষের জমায়েতের পথ করে দিয়ে গেলো। অথচ আজিজের নিজের অফিসের একটি মানুষও এলো না। কেরানির চাকরি করে, তাকে পোছে কে? কিন্তু চাকরি সে যতো ছোটোই করুক, তার বাড়িতে কত মানুষের উৎসব হতে পারে সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবকে একবার দেখাতে পারলে লোকটা কথায় কথায় তার ইংরেজি ভুল ধরার বাতিকটা কাটিয়ে উঠতো। লোকটা নিজে না আসুক, অফিসের একটা চাপরাশি এসেও যদি এই বাড়ির আজকের হালটা দেখে যেতো তো জয়পুর ফিরে গিয়ে অফিসের আর সবাইকে অন্তত ওয়াকিবহাল তো করতে পারতো!
বয়স কম হলে কী হয়, কাদেরটা এদিক থেকে অনেক চালাক। টাউনে সব ব্যবস্থা করে এসেছিলো, সবাই একসঙ্গে হয়ে ১৫/২০ জন মানুষ টমটমে করে এসেছে হৈ চৈ করতে করতে। গাড়ি থেকে নেমেই তারা মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, লড়কে লেঙে, পাকিস্তান, নাড়া দিয়ে গ্রাম কাঁপিয়ে তুললো। জেলার নেতাগোছের মানুষও এসেছিলো তিন জন। কাদেরের এই মেহমানদের যেভাবে আজ খাওয়ানো হলো তাতে টাউনে কাদেরের পজিশন কতো বাড়বে!
সেখানে আবদুল আজিজের হালটা কী?-শোক, আক্ষেপ ও চিনচিনে হিংসা থেকে আজিজকে উদ্ধার করে গোলাবাড়ি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার আলিমুদ্দিন। লোকটা হাজির হলো একেবারে বিকালবেলা। এক স্কুল ছাড়া মানুষটা সব জায়গাতেই লেট। মানুষ পেলেই দাঁড়ায়, আর চাষাভুষাদের সাথে তার জমে বেশি। বাড়ি অনেক দূরে, পশ্চিমে শান্তাহার কি আদমদিঘির ওদিকে, এখানে থাকে গোলাবাড়ির উত্তরে এক চাষার বাড়িতে। তার চাষবাসের কাজেও হাত লাগায়, নইলে চাষা তাকে থাকতে দেবে কেন? চাষাদের সঙ্গে তার মেলামেশা দেখে কাদের তার সঙ্গে লীগের ব্যাপার আলাপও করেছে, তেমন আমল বোধহয় পায় নি। আজ তাকে দেখে আবদুল আজিজ তার স্বভাবের অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়ে আলাপ করে এবং খানকাঘরে নিয়ে তাকে বসায় মেহমানদের সঙ্গে। খাওয়া দাওয়া তখন তাদের শেষ। তবে কাদেরের লীগের কর্মীদের কেউ কেউ তখনো খায় নি। আলিম মাস্টারকে আজিজ তাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলো।
নামীদামি মেহমানরা কাঁচা রাস্তায় টমটমে ফিরে যাবে, তারা একটু তাড়াহুড়া করে গাড়িতে ওঠে। শিমুলতলার ছোটোমিয়ার ফিটনগাড়িতে জোড়া ঘোড়া জুতে সহিস অপেক্ষা করছে। ছোটোমিয়া হাতের ছড়ি একটু একটু নাড়াচ্ছে আর মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলছে। আবদুল আজিজ হোটোমিয়ার কাছছাড়া হয় না, শেষ সময়ের কথাটাই মানুষের মনে থাকে।–সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবের সঙ্গে দেখা হলেই ছোটোমিয়া যেন আজিজের প্রসঙ্গ তোলে।
আবদুল কাদেরের মেহমানদের মধ্যে কমী গোছের রয়ে গেলো পাঁচজন। আজ রাতে তারা মানুষের ঘরে ঘরে যাবে। দলের পোস্টার আর হ্যান্ডবিল আনতে কাদের গোলাবাড়ি লোক পাঠিয়েছে।
বিকাল শেষ হতে না হতে বেশ ঠাণ্ডা পড়লো। খানকাঘরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরাফত মণ্ডল দেখে শুকনা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোয়াচ্ছে তার বাড়ির কামলাপাট, সঙ্গে আরো কিছু মানুষ জুটেছে। লোকগুলো জেয়াফত খেয়ে এখনো বাড়ি ফিরে যায় নি। এরা এতোক্ষণ করে কী? আহা থাক, শীতে কষ্ট পাচ্ছে, এখানে একটু গা গরম করে যাক! শরাফত ছলছল চোখে তাদের দেখে। তার ছোট্টো দাদাভাইকে আল্লা বেহেশত নসিব করবে, মাসুম বাচ্চাটার জন্যে এই লোকগুলোর দোয়া আল্লার আরসে পৌঁছুবে সবার আগে। গরিব মানুষকে আলাদা করে দোয়া পড়তে হয় না, ভুখা মানুষের তৃপ্তিই আল্লাকে সন্তুষ্ট করে, গরিব বান্দার ভরা পেটের চেয়ে সুখ আল্লার কাছে আর কী আছে? এই এলাকায় এতগুলো গরিব মানুষ ভুখা নাঙা মানুষ আছে বলেই তো তাদের খাইয়ে তৃপ্তি দেওয়ার সুযোগ আজ শরাফত মণ্ডলের হলো। আহা এরা থাক। নাঙা মানুষের গায়ে আগুনের ওম লাগলে সেই আরামে তার নাতির রুহের মাগফেরাত হবে।
শিমুলগাছের সাদা বকের ঝক নিচের আগুনের তাপে ওম নিতে নিতে তাদের পাখাগুলো আস্তে আস্তে মেলে, কিন্তু গুটিয়ে নেয় ঝপ করে। কয়েকটা বক শান্ত ও অলস উড়ালে চলে যায় বিলের ওপরকার পাতলা কুয়াশার ভেতর, তারপর ছোটো ছোটো ঝকে ভাগ হয়ে ডানায় কুয়াশার হিম মাখতে মাখতে বিলের ওপর ঘিরে ঘিরে ওড়ে।
গোলাবাড়ির রাস্তায় এখনো যারা হাঁটছে তারা সবাই ফিরে যাচ্ছে এই বাড়ি থেকেই। পাতলা কুয়াশায় তাদের গতি বোঝা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। বিলের ওপারে শরাফত মণ্ডলের নিজের জমি এবং তার আকাঙ্ক্ষিত জমির ওপর কুয়াশা একটু ঘন। ধান কাটা হয়ে-যাওয়া জমির উদাম বুক ধানগাছের স্মৃতিতে কুয়াশার ভেতরে একটু কঁপে কাৎলাহার বিলের ওপরকার কুয়াশা আঁশটে পানির গন্ধে পুরুষ্ট হচ্ছে। ওদিকে তাকিয়ে শরাফতের বুক পেট মাথা ভরে যায় কানায় কানায়।
শীতের সন্ধ্যা নামে ঝপ করে, কুয়াশার কোলে-পিঠে অন্ধকার ক্রমে ঘন হয়। বিলের হাওয়া এসে লাগে শরাফতের কিস্তি টুপি-পরা মাথায়। ঘরের ভেতরে গিয়ে পশমি-টুপি মাথায় দিয়ে, গলায় মাফলার ও গায়ে খয়েরি শাল জড়িয়ে সে নামে বারান্দার নিচে। নিচে নামলে বিল চলে যায় চোখের আড়ালে। তখন আবছা আবছা শোনা যায় নামীদামি মানুষের কথাবার্তা। চোখের সামনে দোলে ছোটোমিয়ার হাতের ছড়ি। এই ছোট্টো দাদাভাইটা মরে গিয়ে শরাফতকে আজ কী ইজ্জতটাই না দিয়ে গেলো! আর সেই মাসুম বাচ্চাটাই পড়ে থাকে মাটির নিচে একা একা। সবই আল্লার ইচ্ছা!—শরাফতের দুই চোখ বেয়ে নামে পানির ধারা। সে তখন আস্তে আস্তে হাঁটে পশ্চিমের দিকে, বাড়ির পেছনে পালানে জোড়াপুকুরের ওপারে বেগুনখেত পেরিয়ে মস্ত বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের গা ঘেঁষে হুমায়ুনের কবর।
চল্লিশ দিনে হুমায়ুনের কবরে ঘাস গজিয়েছে, চারপাশে শীতের দাপটে ঘাসগুলো একটু রক্তশূন্য। এর ওপর টাঙানো কুয়াশার মশারি, সামনে গেলে মশারি পাতলা হয়ে আসে। শরাফতের বাবা, মা, সৎ, বড়োভাই, ভাবী ও ছোটেভাইয়ের কবর। সবই এলোমেলো। এই কবরগুলো এখানে তবু চেনা যায়। এছাড়া এই বড়ো জমিটা জুড়ে শুধু কবর আর কবর। সে গুলোকে আলাদা করে চেনা কঠিন। বড়ো বড়ো ঘাস আর গাছড়ার নিচে কোনোমতে মুখ গুঁজে থাকে। শুধু এই জমির শেষ মাথায়, একেবারে উত্তর পশ্চিম কোণে কালাম মাঝি মাঝে মাঝে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে যায়, সেটা নাকি ওর বাপের কবর। কবরে মোমবাতি দেওয়া বেদাত কাম, মোহাম্মদি জামাতের মানুষ হয়ে শরাফত এটা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কালাম মাঝি বড়ো ঘাড়ত্যাড়া মানুষ, তাকে দুই একবার বলে লাভ হয় নি, সে জবাব দেয়, হামাগোরে আলাদা জামাত, হানাফির গোরস্থান, হামার দাদা পরদাদা তার পরদাদা সোগলি এটি আছে। মোমবাতি হামার দেওয়াই লাগবি। জায়গাটা অবশ্য আগে থেকেই গোরস্থান ছিলো, এখানে মাঝিদের কাছ থেকে জমি কেনার সময় শরাফতের বাপ দলিলে পুরো জমিটাই নিজের নামে লিখে নেয়। তবে শরাফতের বাপের আমলেও মাঝিদের লাশ কিন্তু দাফন হতো এখানেই। শরাফতের জমি বাড়তে লাগলো পশ্চিমে ও উত্তরে, এমন কি কালাম মাঝির এক ভাগীদারের কাছ থেকে গোরস্তানের দক্ষিণের মজা ডোবাটাও মণ্ডল কিনে নিয়েছে আকালের বছর। গোরস্তানের চারো দিকের জমি শরাফতের দখলে আসার পর সে এমন চাষবাস শুরু করে দিলো যে, মাঝিপাড়ার মানুষ এখানে গোর দেওয়ার রেওয়াজ চালু রাখতে আর সাহস পায় না। কাৎলাহার বিলের উত্তর পুবের একটা পতিত জমি শরাফত তাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বেটারা সেখানেই মড়া পেতে আজকাল। এই কালাম মাঝির মতো রগত্যাড়া মানুষ মাঝে মাঝে এটা সেটা কয়। বাপের কবরে মোমবাতি দেওয়ার নাম করে মরা মাঝিদের অছিলায় এখানে জ্যান্ত মাঝিদের দখল কায়েম করার ফন্দি করে। বুলু মাঝি মরলে তাকে এখানে গোর দেওয়ার কথা উঠিয়েছিলো এই কালাম মাঝিই। তা কী করতে পারলো? বুলুর দাফনে শরাফত খরচা করলো কতো। কালাম মাঝির এতো বড়ো দোকান থেকে একটা পয়সা তো বেরুলো না। এরপর বুলু মাঝির দাফন কোথায় হবে সে নিয়ে মাঝির বেটারা আর কথা বলতে পারে? শরাফত মণ্ডল বিল। ইজারা নেওয়ার পর থেকেই কালাম হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। আরে বাবা, জমিদার তার এলাকার ভেতর কাকে কী দেবে সে জানে কেবল জমিদারই। হিংসা করে কালাম মাঝি কী করতে পারে? মাঝিপাড়ার সবাইকে জমি বর্গা দিয়ে শরাফত তাদের বিলের কথা ভুলিয়ে ছাড়বে। আজ জেয়াফতে মাঝিপাড়ার একটি প্রাণী বাদ পড়ে নি। কালাম মাঝি প্রথমদিকে এলো না দেখে কাদের তমিজকে পাঠাতে চেয়েছিলো। মণ্ডল বললো, আসবি বাবা। দোকানপাট করে, কতো কাম তার। দেরি হবার পারে। তা সে ঠিকই এসেছিলো। কালাম মাঝির ছেলে তহসেন বর্ধমান জেলায় কোথায় পুলিসের চাকরি পেয়েছে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। শরাফত সেদিন নিজে তাকে বলে এসেছিলো। সে তো এসে খানকাঘরে ভদ্রলোকদের মধ্যে দিব্যি খেয়ে গেলো। বিকালের দিকে কালাম কখন এসে গোয়ালঘরের পেছনে আর দশজন মাঝির কাতারে বসেছিলো, শরাফত সব খবরই রাখে। কালাম মাঝির জারি-জুরি আর কতোদিন? গোরস্থান দখল করার ফন্দি ওর আজই মিটে যাবে।
হুমায়ুনকে কবর দেওয়ার পর জায়গাটিকে মণ্ডলদের পারিবারিক গোরস্তানে পরিণত করার ব্যবস্থা এখন পোক্ত করা যায়। ছেলের কবরটা বাধাবার জন্যে আবদুল আজিজ কয়েক দিন ঘ্যানঘ্যান করলো। বড়োবেটাটা তার বড়ো বৌচাটা, বৌ ফোৎ ফোৎ করলেই তার মাথা খারাপ, বৌ যা বলে তাই করার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে। শরাফত বলেই দিয়েছে তাদের আহলে হাদিস জামাতে কবর সাজানো শেরেকি কাজ।
তবে এখন হুমায়ুনের কবরের পাশে দাড়িয়ে তার চোখ জুড়ে শুয়ে থাকে। শিমুলতলার মিয়াদের বাড়ির গোরস্তানের সার সার কবর। মিয়াদের কোনো কোনো কবর কী সুন্দর করে বাঁধানো। কোনো কবরের শিওরে সিমেন্টের ওপর চাঁদ তারা, কোনো কবরে পাথরে খোদাই-করা আল্লার কালামের নিচে মরহুমের নাম, বাপের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। সেখানে গেলে সেই সব মরহুমের অছিলায় তাদের ছেলেমেয়ে নাতি পুতিদের জন্যেও ভক্তিতে বুকটা ভরে ওঠে। শিমুলতলার মিয়াদের খানদানি বোঝার জন্যে জ্যান্ত মানুষকে না দেখলেও চলে, ওইসব বাঁধানো কবরই হলো খানদানের নীরব নকিব।
তা হুমায়ুনের কবর বাধালে ক্ষতি কী? ছেলেটা তাদের কতো ইজ্জত এনে দিলো, মরার পর তার কি এটুকুও প্রাপ্য নয়?
ইট সিমেন্ট কবর বাঁধালে নায়েববাবু কি আপত্তি করতে পারে? কয়েক বছর আগে বিলের উত্তরে কাশবন কেটে চাষবাস করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হলে টাউনের উকিল রমেশ বাগচি ওখানে ইটের ভাটা করার কথা ভাবছিলো। উকিলবাবুর ভাগ্নে টুনুবাবু পয়সাকড়ি নিয়ে বোম্বাই না মাদ্রাজ ভাগলে এসব ভাবনা তারা ঝেড়ে ফেললো। তারপর কাদের একবার বাই তুললো ইটের ভাটা করবে। ওদিকে তো জঙ্গুলে জায়গা, কাঠের খরচ নাই। সস্তায় হঁট করে প্রথমে না হয় নিজেদের বাড়িটাই পাকা করে ফেলবে। তা। কাদেরের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা কী করে লাঠিডাঙা কাচারিতে পৌঁছুলে নায়েববাবুই
একদিন মণ্ডলকে ডেকে পাঠিয়ে বলে, মণ্ডল, কর্তা আমাদের মাটির মানুষ। তার সহ্যশক্তিও অনেক। ভগবান একেকজন মানুষকে সৃষ্টিই করেন ওইভাবে। কিন্তু চাষাভুষা প্রজাপিট সবাই যদি দরদালানে থাকতে শুরু করে তখন তার সম্মানটা থাকে কোথায় বলো তো? ইঙ্গিত ধরতে পেরে শরাফত বলে, সোগলি দালানেত থাকলে দালানের ইজ্জত থাকে ক্যাংকা করা? কথা ঠিকই কছেন বাবু। ধরেন, হামার কথাই ধরেন। বাপের ছনের ঘর আছিলো, হামি করলাম টিনের ঘর। আশীর্বাদ করেন বাবু, নায়েবের আশীর্বাদ নিতে শরাফত অন্তত পাঁচ হাত দূরে মাটি ছুঁয়ে ফের উঠে দাঁড়ায়, আশীর্বাদ করেন, ওই টিনের ঘরত যেন মরবার পারি। ওই ঘরত যানি হামার মরণ হয়। তখন কাচারিতে সে নিয়মিত ভেট দিয়ে যাচ্ছিলো, শরাফতের এক কথাতেই নায়েব গুজবটা বাতিল করে দেয়।
তবে কবর বাঁধালে নায়েববাবু আপত্তি করবে কেন? বাড়ি আর কবর কি আর এক হলো?
কিন্তু অসুবিধা আর একটা আছে। সেটা অন্যরকম। কী—এখানে তো শরাফতের মুরুব্বিরাও আছে। বাপজান আছে, মা আছে, মিয়াভাই আছে, এদের কবর পাকা না করে হুমায়ুনের কবরে সে ইঁট বসায় কী করে?
তাহলে হুমায়ুনের জন্যে, তার লাশ হেফাজতের জন্যে শরাফত কি কিছুই করতে পারে না? এটা কি তার সঙ্গে নিমকহারামি করা হচ্ছে না? এই ভাবনা ও উদ্বেগে তার জিয়ারতের দোয়া বারবার এলোমেলো হয়ে যায়। নতুন করে সমস্ত মনোযোগ সে নিয়োগ করে দোয়ার দিকে। আসসালামু আলাকুম ইয়া আহলাল কুবরে, মিনাল মুসলিমিনা, ওয়াল মুমিনিনা, আন্তম লানা পর্যন্ত বলেছে, তখন তার পাশে এসে দাঁড়ালো আবদুল আজিজ। জিয়ারতে সে শরিক হয়, কিন্তু মোমবাতি ও আগরবাতি জড়ানো কাগজের মোড়কে তার একটা হাত বন্ধ, মোনাজাতের জন্যে হাত ভোলা তার পক্ষে বেশ মুশকিল। দোয়া শেষ হলে হাতের প্যাকেটার জন্যে আবদুল আজিজ বাপের দিকে তাকায় অপরাধী চোখে। তাদের জামাতে গোরে বাতি দেওয়া একেবারেই নিষেধ। মিনমিন করে সে কৈফিয়ৎ দেয়, বাবরের মাও খালি কান্দিচ্ছে, বাপের সঙ্গে দূরত্ব না রাখার জন্যে কিংবা শোকেও হতে পারে, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ছোটোবেলার বুলি, খালি কান্দে আর কয়, বেটাটা হামার ঘুটঘুটা আন্ধারের মধ্যে একলা পড়া থাকে। তাই হামি–
শরাফত চুপচাপ ছেলের হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে হুমায়ুনের শিওরে সাজায়, তারপর আজিজের কাছ থেকে দেশলাই নিয়ে মোমবাতি ও আগরবাতি সব এক এক করে ধরিয়ে কবরের চারদিকে মাটিতে পুঁজে খুঁজে দেয়। এই করতে করতে, হয়তো মোমবাতির আলো ও আগরবাতির সুবাসেই হবে, শরাফতের মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে, তার বাপ-মা কি মিয়াভাই তো নিজেদের কবর বাঁধাবার জন্য কোনো অসিয়ত করে যায় নি। তারা পাকা আহলে হাদিস। মিয়াভায়ের নাম শেতল মণ্ডল পাল্টে শমশের আলি মণ্ডল হলো তো মওলানা আবদুল্লাহেল বাকির কথায়। না, তাদের কবর পাকা করলে তাদের রুহ কষ্ট পাবে। কিন্তু হুমায়ুন এক মাসুম বাচ্চা, নাবালক। তার কবর কী হবে না। হবে সেটা ঠিক করবে তার মুরুব্বিরা। তার কবরে কোনো শেরেকি কাজ তারা করবে না, শুধু পাকা দেওয়ালে ঘিরে দেবে যাতে ভবিষ্যৎ বংশধররা শিশুটিকে চিনতে পারে, শিশুটি তাদের পরিবারে অনেক মর্যাদা দিয়েছে।
সিদ্ধান্তটি শরাফত ঠিক তক্ষুনি আজিজের কাছে প্রকাশ করে না। কিন্তু হুমায়ুনের। প্রতি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে ভেবে তার মাথার জট খুলে যায় বলে হুমায়ুনের জন্যে শোকের প্রতি মনপ্রাণ নিবেদন করতে পারে। এর মধ্যে আবদুল আজিজ কবরের ওপর গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়েছে এবং আগরবাতি ও গোলাপজলের খুসবু মোমবাতির কচি আলোর আভায় ছড়িয়ে পড়ে তামাম গোরস্তান জুড়ে। এইভাবে অনেক অনেক আগে দাফন-হওয়া মাঝিদের কবরগুলোও চলে আসে হুমায়ুনের কবরের আওতার ভেতরে। চল্লিশার অনুষ্ঠানের এমন নিটোল উপসংহারে শরীফত মণ্ডলের মাথা খুব হালকা হয়ে যায়, তার চোখ থেকে প্রবাহিত নোনা পানি আগরবাতির মিষ্টি গন্ধ ও মোমবাতির কচি আলো কবুল করে নিয়ে হয়ে ওঠে মিষ্টি ও স্বচ্ছ।
অন্ধকার গাঢ় হয়। বাপেবেটায় এবার বাড়ি ফেরার জন্যে পা ফেলে পুব দিকে। কিন্তু পাশের বাঁশঝাড়ে কিসের শব্দ পেয়ে দুজনেই থমকে দাড়ায়। শরাফত মণ্ডল কপাল কোঁচকায় : মাঝিদের পুরনো কোনো লাশ কি মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছে গোরস্তানে টহল দেওয়ার জন্যে? আর আবদুল আজিজের ভাবনা কি ভয় পাবার শক্তির সবটাই ঢুকে পড়েছে সেই টহল-দেওয়া লাশের শূন্য কবরের ভেতর, সে কেবল প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোমতে নিজের পা দুটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে। এতো বড়ো বাঁশঝাড়টা এখন এরা পেরোবে কী করে? দুই জনের একটি পা-ও এক পা নড়তে পারে না।
কিন্তু কয়েক মুহর্তেই শরাফত স্বস্তি ও ক্রোধের নিশ্বাস ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ! সেরকম কিছু নয়। বাঁশঝাড়ে বসে পায়খানা করছে কোনো শালা ছোটোলোকের বাচ্চা। আজ জেয়াফতে গোগ্রাসে গেলা এবং হজম-বদহজম-হওয়া খানা সে খালাস করছে মিহি ও মোটা নানারকম ধ্বনি তুলতে তুলতে। ভূতপেত্নী আর যাই হোক হাগামাতা করে না, এই ভরসায় শরাফত তেজি গলায় হাঁক ছাড়ে, কেটা রে? কেটা হাগে? এটি হাগে কোন হারামজাদা?
বাঁশঝাড় থেকে মলত্যাগকারীর গলার আওয়াজও পাওয়া যায় এখন। কোৎ দেওয়ার ও পায়খানা করার আওয়াজ বাজে যুগলবন্দি হয়ে, লোকটা তাড়াতাড়ি কাজ সম্পন্ন করার জন্যে মরিয়া হয়ে লেগেছে। শরাফত মণ্ডল দ্বিতীয়বার হুংকার ছাড়ার পরেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় দুজনকে। তারপর বাঁশঝাড় থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে তমিজের বাপ। তার শরীরে উল্কট দুর্গন্ধ। গন্ধ ধাঁ করে ঢুকে পড়ে আজিজের গলায়, সেখান থেকে পেটেও চলে যেতে পারে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বমি করে ফেলে। তার বমির তরল ছিটায় হুমায়ুনের কবরের শিওরে একটি মোমবাতির শিখা একটু কেঁপে দপ করে নিভে যায়।
শরাফত মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তমিজের বাপ অপরাধী গলায় বলে, বাড়িত যাচ্ছিলাম। ঘাটাত বাহ্যি চাপলো, আর পারলাম না। হামাগোরে গোরস্তানের এটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে
তমিজের বাপের গুয়ের গন্ধ এখন দখল করে নিয়েছে গোটা গোরস্তান। এখানে ফেরেশতা আসবে কীভাবে? শরাফত ও আজিজের পক্ষেই তো টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
ঘরে যেতে যেতে শরাফতের ভুরু কুঁচকে আসে, তমিজের বাপ এই পথে বাড়ি ফেরে কেন? মাঝিপাড়ার মানুষের জন্যে এই পথে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। এই গোরস্তান কি এখনো শালাদের হামাগোরে গোরস্তান? এতো সাহস ও পায় কোত্থেকে? কালাম মাঝি আবার লেলিয়ে দেয় নি তো? আর আবদুল আজিজের করোটিতে বেঁধে একটির পর একটি কাঁটা, কিংবা একটি কাটারই শাখাকাটা উপকাটা : এই লোকটাই না? দুপুরবেলা এই লোকটাকে দেখেই তো হামিদা অমন ভয় পেয়ে গেলো? আজিজ এখন বোঝে, এই তমিজের বাপই সেই রাত্রে কাফনের কাপড় পরে ওই রাতে এসেছিলো হুমায়ুনকে নিয়ে যেতে। ছেলেটা মরার পরেও সে তার পিছু ছাড়ছে না। সন্ধ্যার পর পায়খানা করার জন্যে সে কি হুমায়ুনের কবরের পাশে ছাড়া আর জায়গা পেলো না? লোকটা আসলে কী? তমিজের বাপ কি আসলেই তমিজের বাপ? লোকটা কে?-ভয়ে আবদুল আজিজ থরথর করে কাঁপে। কাঁপুনির বেগে সে ঘরে পৌঁছে যায় শরাফতের অনেক আগে। তমিজের বাপের আচরণ শরাফতকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, ভাবনায় তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেশ ভারী। তার গতি একটু মন্থর।
অসাধারণ