১৬. মধ্য জীবনের দোলাচল
সেলিমের কথা
সেদিনের পর থেকে সেলিমের শুধু মরে যেতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীর কোনও কিছুতেই তার আকর্ষণ লাগছে না। রুচিও নেই। কি নিরন্তর লেগে থাকা কষ্ট তার বুকের গভীরে। দুই পাজরের তলে। কষ্টের অতল সাগর। মন নেই অগাধ বিত্তে। কি রিক্ত মনে হয় নিজেকে তার! অথচ কি নেই! তার যা আছে অনেকেরই নেই। তবু মরে যেতে ইচ্ছে লেগে থাকছে সারাক্ষণ। এত বিত্ত মনে হয় রক্তহীন পানসে জামরুল। এই দালান ধূসর বালি! কি নিঃস্ব পৃথিবী তার যেখানে এত আলোর জগতে তার হৃদয় জুড়ে বসে থাকছে বাদুড়ের ডানায় লেগে থাকা কালো কালো অন্ধকার।
বাঁচা কী শুধুই, বেঁচে থাকা? শরীরটাকে ঘুম থেকে ওঠানো, ঘুমোতে যাওয়া! জীবন মানে কি শুধু ঘৃণা আর অবিশ্বাসের অভিজ্ঞতার পুঁজি করা! এই যে আরেকটি দিন গড়িয়ে যায় জীবন থেকে শুষ্ক, প্রেমহীন! দাম্পত্যের চিহ্ন নেই। দু’জনের দু’বিছানা।
দোলা, থেকেও সে নেই। এই যে সে আছে শুয়ে-বসে একই ঘরে, এক ছাদের তলে, কিন্তু নেই। থেকেও নেই। সে মিশে আছে অন্যে। তার অনুভূতি জুড়ে অন্য পুরুষে। সেলিমের কষ্ট হয়। সেদিন নিজ চোখে সে যা দেখেছে তারপর দোলার ছায়াও ওকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। আত্মপীড়নে, পেষে। তাপিত বুক, আরও জ্বলে ওঠে। মরতে ইচ্ছে করে। ওদের প্রেমের বিয়ে। মধ্য বয়সের অতৃপ্ত শরীর তারুণ্যের সুখের সময়গুলোকে নিষ্ঠুরভাবে ছাড়িয়ে যায়।
বিয়ের পর থেকে দোলাকে সেলিম ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছে বারোটি শীত বসন্ত। সেলিম দোলা ছাড়া কাউকে জানতে চায় না। দোলা জানে অন্যকে। এবং সেই জানা না জানার সঙ্গে বাঁচার কারণ দোলার বাড়লেও, সেলিমের দিন দিন কমতে থাকে।
আজকাল দোলাকে সেলিম এড়িয়ে যায়। কেন যাবে না? এই দোলা যে অন্য দোলা! প্রেমহীন। ভালোবাসাহীন। তার সব প্রেম অন্য পুরুষে। তার হৃদয়ে লেগেছে নববসন্তের ছোঁয়া। অনভ্যস্ত শরীরের স্বাদ। নতুন শয্যা।
কিন্তু সেলিম এত অবিশ্বাস আর ঘৃণার পরেও আজও দোলা ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারছে না। এবং সমস্যা এখানেই। যদি সেও ভালোবাসতে পারতো, তবে সেও জুড়োতে পারতো। এবং জুড়োতে পারলে ভুলেও যেত। দোলা ছাড়া পৃথিবীতে, তার নিঃস্ব হয়ে যায় সবকিছু। স্বর্গসমেত সম্পূর্ণ অতীত বৈভব। দাম্পত্য অবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা পেলে, তা শত্রুতায় রূপান্তর হয়। তখন তার বাতাসটুকুকে বিষ। দোলার বাতাসও সেলিমের কাছে বিষ লাগছে। কারণ সে বাতাসটুকুতে মিহিরের ঘ্রাণ থাকে। তার স্পর্শ থাকে। না চাইলেও সে ঘ্রাণ পায়। মিহিরের ছোঁয়া পায়। দোলা যেখানে দাঁড়ায়, বসে, শোয়, সেলিম মিহিরের স্পর্শ পায়। কতবার সে চেষ্টা করে এই গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে, কিন্তু দোলা আর সেলিমের সম্পর্ক দাম্পত্যের বারো বছর শেষে, ঘুণপোকা। এবং দু’জন পরস্পর পরস্পরের থেকে যতদিন যায় দূরে সরে যেতে থাকছে। এই দূর ক্রমশ দীর্ঘতর হয়। এরপর একদিন স্বচক্ষে সেই ঘটনা। যার পর সেলিম প্রস্তুত হয়, বিবাহ বিচ্ছেদের।
কারণটা খুব অস্বাভাবিক নয়। সঙ্গতও নয়। তবে মানবজীবনের কোনও এক সময়ে হঠাৎ ফের অনুভূতির বদল হলে, হতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, দোলা ভুল করেছে। তারপরেও সম্পর্কটা ধুকে ধুকে হলেও টিকে ছিল।
সেলিমের যে হঠাৎ মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তার কারণটা একটু বিশেষ। সেদিন রাতে সেলিম, দোলাকে দেখেছিল, মিহির নয়, শান্তনুর বিছানায়। মিহিরের পর শান্তনু! অবিশ্বাস্য! শান্তনু ওদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিহির, তারপর শান্তনু! দোলা কি সেফ পাগল হয়ে গেছে! বিকারগ্রস্ত! কিন্তু দেখে তো মনে হয় না। দোলা ঠিক আগের মতোই চঞ্চল ও ধীর একইসঙ্গে। কোমল ও কঠিন এক পলকে। বার্ধক্য আর কৈশোর এক মুহূর্তে। একি! সেলিম ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
ঠিক তার দু’মাস পর। সেলিম, ডিভোর্সের কাজ সম্পন্নশেষে বাড়ি ফিরে এলো। দোলা কিছুই জানে না। মধ্যরাত। খোলা জানালা দিয়ে উত্তরে বাতাস ঢুকছে। সেলিম চুপচাপ বসে উদাস চোখ মেলে আকাশে তাকিয়ে আছে। রাতটা বড় বেশি ঘন লাগছে ওর কাছে। অসংলগ্ন লাগছে। ভাবছে…। আকাশে তারা আর মেঘ এক সাথে। উড়ে যাচ্ছে তারা। মেঘ থাকছে। উড়ছে না।
সে ভাবছে। এরপর, দোলাকে সে ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। দোলার জন্য বুকে কষ্ট আগলে রাখা ভালোবাসা, সে ভুলে যাবে। শুধু দোলাকে ভালোবেসে বেঁচে থাকা ভুলে যাবে। যেতেই হয়। যেতে হয় কারণ আজ ডিভোর্সের কাগজে সই করে কোথায় যেন এক পুঞ্জীভূত রাগ আর ঘৃণা থেকে সে হঠাৎ মুক্ত হলো। চুলে তার একগুচ্ছ বাতাস লাগে। মুখেও লাগে। তারপর গায়ে। সে ভাবছে, এরপর হয়তো দোলার সাথে হঠাৎ দেখা হলে মনে হবে কৃষ্ণচূড়া। মনে পড়বে সময়। ভোরবেলাকার উথিত শক্ত পুরুষে দোলার দুষ্টুমি। পেটে ‘দ’ হয়ে থাকা। কিংবা দোলার চেঁচামেচি শীকার, সঙ্গমের সময় কি সব আবোল-তাবোল। সে অনর্গল বলে যেতো! ইস। সেলিমের হাসি পায়। মনে পড়ে হাসি হাততালি, দোলার গর্ভাবস্থায়, বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে নিজের পুরুষ পেষণ মৈথুন করে নিজেকে মুক্ত করা। ওতে দোলারই প্ররোচনা ছিল। তখন যে দোলার সব সব কথা শুনতো। ইস কি লজ্জা। দোলাকে আজ ওর লজ্জা লাগছে। ভারি লজ্জা লজ্জা। কেন? আগে লাগেনি তো! লজ্জা শুধু তাকেই হয় যে আপন নয়। আজ দোলা তার আপন নয়। বুকের মধ্যে সেই ভালোবাসা কোথাও আর অনুভব হয় না। কোথাও কিছু আর টানে না। সেই টান আর নেই। কোথায় যেন সব সব হারিয়ে গেল। স্মৃতি ছাড়া বাকি সব যা, মুছে গেল জলে ছাপা অক্ষরের মতো মুছে গেল।
আজ মনে হচ্ছে দোলা ওকে শিখিয়েছে। অনেক শিখিয়েছে। বিয়ে দাম্পত্য সংসার মানে একসঙ্গে আজীবন আবদ্ধ থাকা নয়। মনের পরিবর্তন হতেই পারে। তখন ছেড়ে দিতে হয়। কষ্ট না পেয়ে বরং সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুটো ব্যক্তিত্বকে এক করা অসম্ভব। দোলাই ঠিক। সেলিমের নিজের নির্বুদ্ধিতায় তার লজ্জা বোধ হয়। সে তাকায় আগামীর দিকে। উত্তরে হাওয়ায় সে আচ্ছন্ন হয় নতুন সম্ভাবনায়। পৃথিবীতে কোথাও কারও জন্যে কিছু আটকায় না। শরীরে তার নতুন পুলক হচ্ছে, বহুদিন পর তার পুরুষ উত্থিত হয়ে প্যান্টের বোতাম ছিঁড়ে ফুড়ে ওঠে এসে দাপিয়ে সে নীলিমাকে চায়! মনের কোণায় দেখা দেয় কোনও, নীলিমা। কে সেই নীলিমা! কোথায় সে! সেলিম জানালা খুলে বাইরে তাকায়। তারপর দোলার দিকে একবার তাকালো সে। কোথায় সেই অনুভূতি! সব মেকি। সব গুজব। মনে হয় সেলিমের। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন পৃথিবীতে কে কার। তাইতো! পৃথিবীতে কে কার?
দোলার কথা
আজ আমার স্বামী বুঝতে পেরে বিশাল এক সঙ্কীর্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন, যা মানবদর্শনের নিয়ত সত্য। আমি দোলা যে কথাটি আমার স্বামী সেলিমকে এতদিন ধরে বোঝাতে চেয়েছিলাম আজ তিনি স্বেচ্ছায় তা বুঝে নিলেন। বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজে আমার অজান্তেই সই করে এসে আজ প্রথম তিনি আমার সঙ্গে যে দূরত্ব অনুভব করেছেন, যে দূরত্ব থেকে তিনি আজ প্রথম আমায় স্পষ্ট করে দেখছেন–সেই দূরত্ব, জীবন সম্পর্কে তার পৌরাণিক দৃষ্টি আর বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে পাল্টে দিয়েছে। এখন থেকে তিনি একজন মুক্ত মনমানসিকতার মানুষ। বোধের অন্ধত্ব ছেড়ে মুক্ত স্নায়ুর মানুষ। মুক্ত জীবনদর্শনের প্রকৃত রূপ দেখতে পারার অপারগতা থেকে মুক্ত মানুষ। দূরত্ব, যা তাকে দিয়েছে দেখার ক্ষমতা দূর থেকে। আজ আমার জয় হলো। আজ আমারও জীবনদর্শনের জয় হলো যে আমরা বনের পশুপাখির চেয়েও মূর্খ। কারণ আমাদের দাম্পত্য জীবনে রয়েছে ১৪৪ ধারা।
আজ আমার স্বামী স্বীকার করলেন, ১৪৪ ধারা ভুল। দোলাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে করে শুধু কষ্ট পাওয়া। শুধুই কষ্ট পাওয়া। তিনি বুঝলেন, বিবাহ কখনো আমৃত্যু আজীবন হয় না। হতে পারে না। প্রেম ভালোবাসা অনুভূতি বিবাহের মাধ্যমে তাকে আমৃত্যু আবদ্ধ করা যাবে না। করা যায় না। সম্ভবও নয় তার প্রমাণ, বিবাহ ভাঙে। কলমে না ভাঙলেও এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে শুয়েও বিচ্ছেদ হয়। নীরবতার অন্ধকার। দূর দূর তফাত। পাশাপাশি শুয়েও মাঠ মাঠ দূরত্ব।
এই যে একটার পর একটা শয্যা পাল্টাচ্ছি, পুরুষ পাল্টাচ্ছি, এটা যেমন আমার একটা ফ্যান্টাসিতে রূপান্তর হয়েছে, তার চেয়েও এটা ছিল আমাকে ধরে রাখার ব্যাপারে তার অক্ষমতা। যা সৃষ্টি হয় দোহের মধ্যে ভিন্ন ব্যক্তিত্বের দুই মানুষের মধ্যে বিবিধ অসমতার কারণে। এবং যাকে উন্মোচন করতে পারে শুধু সময়। অক্ষমতা। যা নিশীথের আঁধারে রচিত হয় ঘরে ঘরে নারী আর পুরুষের মিলনে, যখন তারা দু’জন স্নায়ুযুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়। এবং সত্যকে লুকিয়ে যাচ্ছে বেমালুম আর নিয়ত দোষ দিয়ে যায় তাদের ভাগ্য, বয়স আর পরিস্থিতিকে। তারা অনুভব করছে তবে স্বীকার করছে না। তারা অতৃপ্ততায় মারা যাচ্ছে তবু মুখ ফুটে বলছে না। তবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যখন তারা সত্যিই বুঝলো তাদের মধ্যে নেই ভালোবাসা, নেই প্রেম, ইটস টু লেইট। আজ সেকথাই সেলিম ধুকে ধুকে অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে নিশীথের অন্ধকারে এই যে আমাদের অতৃপ্ততার অভিনয় আসলেই তা বানানো, সাজানো। আমাদের ছিল গভীর সমস্যা দূরের ও কাছের। আর অবশেষে সে আমার অসুবিধের চিহ্ন চিনেছে। সেজন্য বিচ্ছেদের পরেও আজ সে ধীর। ধীর স্থির শান্ত। এবং আমি এজন্যেও সুখী যে এখন তার ভাবনাকে আন্দোলিত করবে অন্য নারীর অস্তিত্ব। যে হবে তার সমমনা। এই ভাবনা ভালো। নতুন অলঙ্করণ। নতুন উজ্জীবন। এবং আমি তাতে সুখী। ঈর্ষা নয়, শাসন নয়, শাস্তি নয়, দাম্পত্যে গোপন ও করুণ তবে নিষ্ঠুর সত্য গ্রহণ করার মধ্যে যে শান্তি আছে সেই ত্যাগ সেটাই খুঁজে নেয়া আমাদের কাম্য। বিবাহ মানেই কি আমৃত্যু? সম্ভব কী? প্রতিটি নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধন সত্ত্বেও যে যে যার যার মতো আলাদা। এবং চলার পথে এমন কিছু পরিবর্তন তার মধ্যে ঘটতে পারে যখন একটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ যে বিবাহ সূত্রে এক যুগ ধরে এক, হঠাৎ সে নিজেকে খুঁজে পায় আবার আলাদা করে। যখন বিবাহ বন্ধন তাকে আর বাঁধে না। তার রোচে না। কুলোয় না। নাগরিক রুচি ও অভ্যেস। যখন দাম্পত্য তাকে আর টানে না। যখন তার মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন সবকিছু ধুলো নস্যাৎ করে দেয়। চিড়ে চ্যাপটা। যখন দাম্পত্য হয় ঝড়ের সম্মুখীন। যখন বিবাহ ভাঙে। যখন মানুষ না পেরে আত্মহত্যা করে এবং নিরুপায় সে পাল্টায়। শয্যার পর শয্যা। দাম্পত্যে এমন ঝড় স্বাভাবিক। ফুসলে ওঠা না ওঠা নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।
আমি আর সেলিম সত্যেরই জ্বলন্ত প্রমাণ। আমাদের জীবনের শুরুতে ওর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম দারুণ কৌতূহল। তারুণ্য। সব-সবই যখন ভালো। সুন্দর সেক্সি। কোথাও কোনও একটু অপূর্ণতা আমাদের ছিল না। সময় যেতে থাকে। হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় একদিন প্রথম যৌবনের নিমগ্নতা ধরা পড়লো, দুর্বলতায়।
এত বছর ধরে আমি অভিনয় করে চলেছি, বিছানায়। সেলিমের হাতের বলে নিজেকে ঠিক ফুটিয়ে তোলা বা অলঙ্করণের অভিনয়। আমি যে নিজের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছিলাম, জানতাম। তবে জেনেশুনে এই ভালোমানুষটিকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। তাই কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কষ্ট পার হতাম। কল্পনার সুখে ভাসলাম বহু বছর সমমনা পুরুষের সঙ্গে যেখানে আমার শয্যা রচিত হয়, মনে, শরীরে। গীতিময় রেণু রেণু সুখে, সুখ সঞ্চারিত হয় স্বর্গে। কিন্তু বাস্তব তো, বাস্তব। কল্পনার সুখ শেষে দুস্থতা আবার গ্রাস করে আমার শূন্য পৃথিবী। আমি কাঁদি। নিতান্ত প্রয়োজনে সেলিমের সঙ্গে ফের শরীর হয়। এবং আমি ওর থেকে অপেক্ষা করতে থাকি আরও অন্য কিছুর। এই করে করে মনের বিনিময়বিহীন অতৃপ্ত শরীর এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। সেলিমের অতৃপ্তি আসে না কারণ সে বিনিময় জানে না। কারণ সে, সে-গভীরের মানুষ নয়। ক্রমশ আমার ক্লান্তি বাড়ে। আর আমি অধিক আশ্রয় নেই কল্পনায়। ধীরে ধীরে সেলিমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়ে ওঠে মেকি। স্রেফ উগরে ফেলা। আর বন্ধনটি আলগা হতে থাকে। তবুও সেলিম আমাকে দেখে বুঝতে পারে না। আমি নিরন্তর অভিনয় করে চলি। অতৃপ্ত থেকেও তৃপ্ততার অভিনয়। এবং যা পেরে তাই শুরু হলো বিকল্প এবং অন্যান্য সম্ভাবনা…।
আমার গোপন জীবনের ঘটনার শুরুতে। সেবার একটা কনফারেন্সে যেতে হয়। সেলিমকে যেতে বললাম। কিন্তু সে যাবে না। মিহির আমাদের বন্ধু। সেও যাচ্ছে। আমি মিহিরের সঙ্গেই গেলাম। কনফারেন্সটা হচ্ছিল আপস্টেইট নিউইয়র্কে। জায়গাটা সবুজে ঘেরা জল-কাদায় প্রকৃতির অকৃপণ শোভা। আমার সমস্যা আমি একা একা থাকতে পারি না। আমার মধ্যে একটা দারুণ অনিশ্চয়তা কাজ করে। একা ঘরে আমার ঘুম হয় না। তাই দু’জন মিলে এক হোটেলে এক ঘরে উঠলাম। বন্ধু মানুষ। যথারীতি মধ্যরাতে দু’জন দু’বিছানায়। স্তব্ধ রাত। বাইরে অন্ধকার। ঘরে রোমাঞ্চময় নীরবতা। শুধু শোনা যায় দুই নারী ও পুরুষের শ্বাসের গন্ধ। দুই অতৃপ্ত। এবং আমি কি কৌতূহলে যেন পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে মিহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘ-দীর্ঘ রাত। কি সুন্দর সে! কি আকর্ষণ! দেখতে দেখতে নামলো আবছা ভোর। হঠাৎ কি যেন হলো! এই প্রথম আমার অনুভব হলো, পরপুরুষ! হ্যাঁ, আমার মিহিরকে চাই। অতৃপ্ত শরীর কাঁদলো। হু-হুঁ করে কাঁদতে শুরু করলো। রোমাঞ্চ। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মিহিরও নেমে এলো আমার দিকে। এক অলৌকিক আহ্বান। অসম্ভব টান। ওর চেহারায়, রিক্ততা। ওর শরীরও কাঁপছিল। আমি নিরুপায়, তবে উচ্ছ্বসিত। কাঁধে, ঠোঁটে দু’হাত নামিয়ে দিলাম, রাতের মতো, নীরবে। আমি, মুহূর্তেই শুষে নিলাম কল্পনা।
সেই রাতে। সেই গভীর রাতে। কেউ জানলো না শুধু দুটো তৃষ্ণার্ত–আর্ত মানুষ ছাড়া। যাদের মানসিক সমতা ছিল। যাদের চোখে বিনিময় ছিল। প্রতিটা মুহূর্ত যেখানে প্রেমের আবিরে আবিরে লাল হয়ে যেতে থাকে অশান্ত দুটি শরীরে, কেউ জানলো না কি সুখ রচিত হয়েছিল সেই শয্যায়। এবং সেই প্রথম আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হলাম নিজের অনুভূতির দায় থেকে অন্য কারো হাতের তলায়, আবিরে বসন্তে, যেখানে ফুল ফুটলো তার সবগুলো পাপড়ি মেলে বসন্ত শরীরের সম্ভার। মিহির আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিল নারী। ওর শয্যাতেই প্রথম নিজেকে এমন করে উন্মোচিত হতে দেখলাম। সেও। নব আবিষ্কারে আমি অভিভূত।
কনফারেন্স থেকে ফিরে আমরা আরও গম্ভীর হতে থাকি। মনের বিশাল এক সমতা আমাদের তীব্র টানে। টেনে আরও নিয়ে আসে কাছে। না হলে, না দেখলে, পাগল পাগল লাগে। পাশাপাশি সেলিমকে এত দেখি তবুও দেখি না। মিহিরের স্ত্রী মালা কাজে গেলে আমি লুকিয়ে চলে যাই ওর বাড়িতে। সেখানে ওর সঙ্গে ধুম আড্ডা হয়। হাতে হাত রেখে ভাব বিনিময় হয়। একটু ছুঁয়ে থাকা কোথাও কখনও। এই করে করে ও আমাকে শেখায়–শরীরবিহীন প্রেম। যৌনতা ছাড়া দাম্পত্য। আমি ও মিহির যে দাম্পত্যে পুরোনো হয়েছি, ক্ষয়েও গেছি। এবং সেজন্যেই কোনও অপরাধ বোধ হয়নি আমাদের।
তার একবছর পর। একদিন হঠাৎই মিহির এলো অসময়ে। এমন চেহারা নিয়ে আমার অফিসে এলো যেন ওর কেউ মারা গেছে। একেবারে ঝুলে পড়া, চোখ গাল ঠোঁট। বললো, বিদেশে ওর পোস্টিং হয়েছে। যেতেই হবে। উপায় নেই। আমি একেবারে নিরুপায়। কি বলবো! যেও না? তাতো সম্ভব নয়! এবং সে যথারীতি চলে গেল।
এরপর। আবার শুরু হলো শূন্যতার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ তার কল্পনার স্বর্গসন্ধান। কষ্ট পেরুবার স্বর্গপথের কল্পনা। মিহিরের সঙ্গে মানসিক বন্ধন আমার এমন গম্ভীর হয়েছিল যে ওর চলে যাওয়ায় রিক্ত আমার বিভ্রান্তি আরও বাড়লো। কি করি নিজেকে নিয়ে, কিছু ভালো লাগে না। শূন্যতা সৃষ্টি করে গভীর কুয়ো। সেলিম ততদিনে একটি জীবন্ত মূর্তি। ওকে দেখলে মায়া হয় তবে কোনও রকম ইচ্ছে জাগে না। আমি ওকে এড়াতে অভ্যস্ত হই। তবুও না পেরে ওর শরীর নিই। আমি অনিচ্ছায় দাঁতে দাঁত আটকে রাখি।
পা একবার ঘরের বাইরে গেছে। শরীর একবার প্রেম জেনেছে। এবং মিহিরের পর এই সুবিধে-অসুবিধেগুলো নিয়ে সেলিমের সংসারে এরপরের কাহিনী দ্রুত এবং সংক্ষেপ। এরপর এলো শান্তনু। তার…। সব কারণ ফুরিয়ে গেলে, একমাত্র যাওয়া ব্যতীত, গন্তব্য নেই। আমি তা সমূহ অস্তিত্ব দিয়ে বুঝলাম। সমমনা না হলে অতৃপ্ততা কখনো যাওয়ার নয়। এবং এই অতৃপ্ততা মোটেও শারীরিক নয়। এবং এসব সমূহ কারণেই হয় দাম্পত্য ভাঙে, নয়, মানুষ অসুস্থ হয়। কেউ বিকার, কেউ কেউ পরকীয়া আবার কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন। আর আমি যাচ্ছিলাম মানসিক ভারসাম্যতার দিকে।
যে কারণে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুমা ভোররাতে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে কারণটা কেউ খুঁজে দেখেনি। সবাই জানলো রুমা হেলালের শয্যায় গিয়েছিল। হেলালের সঙ্গে তার পরকীয়া ছিল। সে দুই সন্তানের জননী। কি করে করলো! কি করে করলো অমন কাজ! মাসি একেবারে ছেনাল অমন স্বামী থাকতেও, মাসি ছেনাল। অমন কলঙ্কের চল্লিশায় যাওয়া যাবে না। গেলে গুনাহ্ হবে। না-না-না। মারা যাওয়ার একবছর পরেও কেউ বুঝতে চাইলো না অমন সোনার স্বামী ফেলে মাসিটা কেন হেলালের কাছে গেল!
রুমার জীবনের প্রকৃত ঘটনা, জানতো একমাত্র ওর মা। মাকে রুমা সব বলেছিল। বলেছিল শরীফের নিষ্ঠুরতার কথা। বিয়ের তিন বছর পর থেকে একযুগ সময়, এই এক যুগ সময়, শরীফ ওকে আর ভালোবাসলো না। এক বিছানায় ওরা যেন অতিথি। এবং মাঝে মাঝে শরীফ যখন শুধু ওর শরীরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে মধ্যরাতে এগিয়ে আসতো, রুমা ভুল বুঝতো। আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নময় জগতে যা হয়। ভাবতো এই বুঝি ঠিক হয়ে যাবে। যাচ্ছে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। রুমাকে সে উতলা করে ফালাফালা করে নিংড়ে নিতো শরীর। এবং পরমুহূর্তেই সে ফের অচেনা এবং এই বিড়ম্বনা চলে বছর তিনেক।
রুমা কাদলো মায়ের আশ্রয় চেয়ে। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি নয়! রুমা চেয়েছিল বিবাহ বিচ্ছেদ। আমাদের সমাজ যেখানে মা-মাসিরা পুরানো মনের মানুষ। মা রুমাকে বাধা দিয়ে বললো, ভালো না বাসলে কি দুটো সন্তান হয়! যদি তুই ডিভোর্স করিস তবে তোর দুটো মেয়েরই বিয়ে হবে না। হবেই না। মা বলেন, রুমা ভয়ে পিছিয়ে যায়। তাই তো!
নববিবাহের শরীর মিটে গেলে, দু’জনের মানসিক দূরত্ব দাম্পত্যে ফাটল জোগায়। আর রুমা সেই ফাটলে আটকে যায়। আর এমনি করে একযুগ সময় নিষ্ঠুরতায় কেটে যায় পাশাপাশি শুয়ে যখন দুটো মানুষ যারা স্বামী-স্ত্রী যারা সমস্ত রাত নীরব থাকে। আর সেই বিছানায় তোশকের আশপাশ থেকে পুরোনো দীর্ঘ-দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে এক অতন্দ্র নারীর বুকের তলা থেকে কি গভীর বেদনায়! আর গভীর বেদনা থেকে সৃষ্টি হতাশায় একদিন সে আলিঙ্গন করে নেয় যাকে সমাজের তথাকথিত সতী-সাধ্বীরা, নিজেরাও যারা গোপনে মেলে শরীর, পরকীয়া।
অবৈধ প্রণয়। রুমা সুস্থ হতে থাকে হেলালকে ঘিরে। নতুন স্বপ্ন নতুন আগামীর কুঁড়ি বাঁধে ওর মনে। শিশুসমেত হাসি উঠে আসে তার ঠোঁটে। জাগে, বেঁচে থাকার নতুন তীব্রতা। দাম্পত্যে, স্নেহ প্রেম ভালোবাসাবিহীন রুমা নতুন অভিজ্ঞতায় উজ্জীবিত হতে থাকে যেখানে সে স্পষ্ট দেখতে পায় শরীফ আর ওর কেউ না। শূন্য সাদা খাতা। এক ঘর এক বিছানা দুটো সন্তান সত্ত্বেও ওরা মাঠ মাঠ দূর। এদিকে ছিছিক্কার পড়ে যায় পাড়ায়। পাড়া ছাড়িয়ে শহরে। মানুষ হাতের কাজ ফেলে উৎসুক হয়ে যায়। এক মুখ থেকে অন্যমুখ। এক ঘর ছেড়ে অন্য ঘর। কাজ ফেলে যেচে জানিয়ে যায় হায় খোদা! একি! দু’সন্তানের মা! একি? কি করে পারলো! কি নির্লজ্জ! হায় খোদা কি বেহায়া কেমন বেহায়া! ঘরে অমন সুন্দর স্বামী রেখে অন্য পুরুষে যার চোখ, সে নির্ঘাত নরকে যাবে। দোযখে যাবে। যা-বেই। মুখে মুখে রটে যায় রুমার নষ্টামো যা, ছেনাল।
রুমা পারলো না এই সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। শরীফ ওকে গরু পেটা করে। প্রতিবেশীরা জানালা খোলে, সামান্য দেখে পাপ হবে তাই বন্ধ করে, আবার খোলে। মা এসে তিরস্কারশেষে নির্লজ্জ মেয়ের ঘরের মাটিতে নিতান্ত লজ্জায় আর দাঁড়াতে না পেরে মুখে কাপড় ঢেকে চলে যায়। মেয়ে দুটো মুখে কাপড় খুঁজে ছেনাল মায়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে চোখে চোখে কাঁদে।
গরু পেটা রুমা, ছুটে গেল মায়ের কাছে। একমাত্র মা-ই তাকে আশ্রয় দিতে পারে এই দুঃসময়ে। কিন্তু মা সব জেনেশুনে নির্লজ্জ মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় স্বামীর হাত-পা ধরে সব পাপের ক্ষমা চেয়ে নিতে। রুমা সেসব কিছুই করে না। সে সহজ পথ বেছে নিতে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যায়।
জীবনপ্রবাহে এ ধরনের বিচ্যুতি সত্য। সত্য যা সত্য। এবং সত্য যে দাম্পত্য। নিতান্তই মনের ব্যাপার, যা কখনো সামাজিক নয়, তবে নিশ্চিত মানবিক। যা মানুষের মনের আবহাওয়াসাপেক্ষে।
আমাদের বিচ্ছেদের সেই রাতে। আমি সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ কার হাত অনুভব করলাম আমার মাথায়। ভারি কোমল। স্পর্শটা অচেনা ছিল না। তবে তার গভীরতা ছিল বিশাল। আমি মুখ তুলে আর্ত তাকালাম তার দিকে। অশ্রুসিক্ত দুটি চোখ দিয়ে সে আমায় স্নেহ দিল। প্রগাঢ় মায়া দিয়ে বললো, দোলা তুমি আমায় অনেক শিখিয়েছে। আজ আর আমার মধ্যে ক্রোধ-ক্ষোভ নেই। তোমার এই পরিবর্তন আমি গ্রহণ করে, তোমায় মুক্ত করে দিয়ে এলাম আজ। আর নয় এই অস্থিরতা। নয় লুকোচুরি। আমরা শত্রু নয়, বন্ধু। আমরা ভুলে যাবো না। সেই দিন। আমরা অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। যেদিন আমার জীবনটা সহজ করে দিয়েছিল। মনে হলো সেলিমের মতো সবাই যদি বুঝতো! কেন বোঝে না? বুঝলে দাম্পত্যে এত ক্রটি। থাকতো না। রুমা, কলি, অর্চনা, নদী ওরা জীবন রেখে মৃত্যু নিতো না। আজ আমি সুখী পৃথিবীর সব সেলিমদের জন্যে। আর দুঃখী, সব রুমাদের জন্যে।
বিবাহ বড় কঠিন। দুটো মানুষ সম্পূর্ণ দু’রকমের ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও সব বিষয়ে তাদেরকে এক হয়ে দেখতে হয়। দাম্পত্যের কাছে এটা বড় বেশি প্রত্যাশা, যা নিষ্ঠুর। দুরূহ এবং অবাস্তব। দাম্পত্য একটি মঞ্চ, বিবাহ একটি বিষয়। দুটো মানুষ, প্রধান চরিত্রের দুই অভিনেতা, অভিনেত্রী প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ছাপিয়ে লুকিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ করে যায় সুখের। না পেরে, ভাঙে অঙ্কের পর অঙ্ক, শুধুই ফুরিয়ে যাওয়ার তাগিদে নাটক ফুরোয়।
প্রতিটি হাততালির শেষে –নীরবতা।
প্রতিটি মিলন দৃশ্য–বিষাদের সূচনা।
প্রতিটি সুখ–অসুখের প্রসূতি রচনা হয়।
একদিন –কোনও একদিন এই নাটকের একটি কথাও কেউ আর মনে রাখবে না। কিন্তু নাটকের পর নাটক রচনা হয়। হতেই হয়। এটাই নিয়ম। এবং এজন্যেই আমরা তথাকথিত সামাজিক জীব।