১৬.ভক্তি – ভগবদ্গীতা-সন্ন্যাস

ষোড়শ অধ্যায়-ভক্তি
ভগবদ্গীতা-সন্ন্যাস

গুরু। তার পর, আর একটা কথা শোন। হিন্দুশাস্ত্রানুসারে যৌবনে জ্ঞানার্জ্জন করিতে হয়, মধ্য বয়সে গৃহস্থ হইয়া কর্ম্ম করিতে হয়। গীতোক্ত ধর্ম্মে ঠিক তাহা বলা হয় নাই; বরং কর্ম্মের দ্বারা জ্ঞান উপার্জ্জন করিবে, এমন কথা বলা হইয়াছে। ইহা সত্য কথা; কেন না অধ্যয়নও কর্ম্মের মধ্যে, এবং কেবল অধ্যয়নে জ্ঞান জন্মিতে পারে না। সে যাই হৌক, মনুষ্যের এমন এক দিন উপস্থিত হয় যে, কর্ম্ম করিবার সময়ও নহে, জ্ঞানোপার্জ্জনের সময়ও নহে। তখন জ্ঞান উপার্জ্জিত হইয়াছে, কর্ম্মেরও শক্তি বা প্রয়োজন আর নাই। হিন্দুশাস্ত্রে এই অবস্থায় তৃতীয় ও চতুর্থাশ্রম অবলম্বন করিবার বিধি আছে। তাহাকে সচরাচর সন্ন্যাস বলে। সন্ন্যাসের স্থূল মর্ম্ম কর্ম্মত্যাগ। ইহাও মুক্তির উপায় বলিয়া ভগবৎকর্তৃক স্বীকৃত হইয়াছে। বরং তিনি এমনও বলিয়াছেন যে, যদিও জ্ঞানযোগে, আরোহণ করিবার যে ইচ্ছা করে, কর্ম্মই তাহার সহায়, কিন্তু যে জ্ঞানযোগ আরোহণ করিয়াছে, কর্ম্মত্যাগ তাহার সহায়।
আরুরুক্ষোর্ম্মুনের্যোং কর্ম্ম কারণমুচ্যতে।
যোগারূঢ়স্য তসৈব শমঃ কারণমুচ্যতে || ৬।৩
শিষ্য। কিন্তু কর্ম্মত্যাগ ও সংসারত্যাগ একই কথা। তবে কি সংসারত্যাগ একটা ধর্ম্ম? জ্ঞানীর পক্ষে ঠিক কি তাই বিহিত?
গুরু। পূর্ব্বগামী হিন্দুধর্ম্মশাস্ত্রের তাহাই মত বটে। জ্ঞানীর পক্ষে কর্ম্মত্যাগ যে তাহার সাধনের সাহায্য করে, তাহাও সত্য। এ বিষয়ে ভগবদ্বাক্যই প্রমাণ। তথাপি কৃষ্ণোক্ত এই পুণ্যময় ধর্ম্মের এমন শিক্ষা নহে যে, কেহ কর্ম্মত্যাগ বা কেহ সংসারত্যাগ করিবে। ভগবান্ বলেন যে, কর্ম্মযোগ ও কর্ম্মত্যাগ উভয়ই মুক্তির কারণ, কিন্তু তন্মধ্যে কর্ম্মযোগই শ্রেষ্ঠ।
সন্ন্যাসঃ কর্ম্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ। তয়োস্তু কর্ম্মসংন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে || ৫।২
শিষ্য। তাহা কখনই হইতে পারে না।জ্বরত্যাগটা যদি ভালো হয়, তবে জ্বর কখন ভালো নহে। কর্ম্মত্যাগ যদি ভালো হয়, তবে কর্ম্ম ভালো হইতে পারে না। জ্বরত্যাগের চেয়ে কি জ্বর ভাল?
গুরু। কিন্তু এমন যদি হয় যে, কর্ম্ম রাখিয়াও কর্ম্মত্যাগের ফল পাওয়া যায়?
শিষ্য। তাহা হইলে কর্ম্মই শ্রেষ্ঠ। কেন না, তাহা হইলে কর্ম্ম ও কর্ম্মত্যাগ, উভয়েরই ফল পাওয়া গেল।
গুরু। ঠিক তাই। পূর্ব্বগামী হিন্দুধর্ম্মের উপদেশ-কর্ম্মত্যাগপূর্ব্বক সন্ন্যাসগ্রহণ। গীতার উপদেশ-কর্ম্ম এমন চিত্তে কর যে, তাহাতেই সন্ন্যাসের ফল প্রাপ্ত হইবে। নিষ্কাম কর্ম্মই সন্ন্যাস-সন্ন্যাসে আবার বেশী কি আছে? বেশীর মধ্যে কেবল আছে, নিষ্প্রয়োজনীয় দুঃখ।
জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাং প্রমুচ্যতে ||
সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডতাঃ।
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ||
যৎ সাংখৈ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্‌‌যৌগেরপি গম্যতে।
একং সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ||
সংন্যসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ।
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি || ৫।৩-৬

“যাঁহার দ্বেষ নাই ও আকাঙ্ক্ষা নাই, তাঁহাকেই নিত্যসন্ন্যাসী বলিয়া জানিও। হে মহাবাহো! তাদৃশ নির্দ্বন্দ্ব পুরুষেরাই সুখে বন্ধনমুক্ত হইতে পারে। (সাংখ্য) সন্ন্যাস ও (কর্ম্ম) যোগ্য যে পৃথক্, ইহা বালকেই বলে, পণ্ডিতে নহে। একের আশ্রয়, একত্রে উভয়েরই ফল লাভ করা যায়। সাংখ্যে (সন্ন্যাস)* যাহা পাওয়া যায়, (কর্ম্ম) যোগেও তাই পাওয়া যায়। যিনি উভয়কে একই দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী। হে মহাবাহো! কর্ম্মযোগ বিনা সন্ন্যাস দুঃখের কারণ। যোগযুক্ত মুনি অচিরে ব্রহ্ম পায়েন। স্থূল কথা এই যে, যিনি অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম সকলই করিয়া থাকেন, অথচ চিত্তে সকল কর্ম্মসম্বন্ধেই সন্ন্যাসী তিনিই ধার্ম্মিক।
শিষ্য। এই পরম বৈষ্ণবধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া এখন বৈরাগীরা ডোর কৌপীন পরিয়া সং সাজিয়া বেড়ায় কেন, বুঝিতে পারি না। ইংরেজেরা যাহাকে Asceticism বলেন, বৈরাগ্য শব্দে তাহা বুঝায় না, এখন দেখিতেছি। এই পরম পবিত্র ধর্ম্মে সেই পাপের মূলোচ্ছেদ হইতেছে। অথচ এমন পবিত্র সর্ব্বব্যাপী, উন্নতিশীল বৈরাগ্য আর কোথাও নাই। ইহাতে সর্ব্বত্র সেই পবিত্র বৈরাগ্য, সকর্ম্ম বৈরাগ্য; Asceticism কোথাও নাই। আপনি যথার্থই বলিয়াছেন, এমন আশ্চর্য্য ধর্ম্ম এমন সত্যময় উন্নতিকর ধর্ম্ম, জগতে আর কখন প্রচারিত হয় নাই। গীতা থাকিতে, লোকে বেদ, স্মৃতি, বাইবেল বা কোরাণে ধর্ম্ম খুঁজিতে যায়, ইহা আশ্চর্য্য বোধ হয়। এই ধর্ম্মের প্রথম প্রচারকের কাছে কেহই ধর্ম্মবেত্তা বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। এ অতিমানুষ ধর্ম্মপ্রণেতা কে?
গুরু। শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জ্জুনের রথে চড়িয়া, কুরুক্ষেত্রে, যুদ্ধে অব্যবহিত পূর্ব্বে এই সকল কথাগুলি বলিয়াছিলেন, তাহা আমি বিশ্বাস করি না। না বিশ্বাস করিবার অনেক কারণ আছে। গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, এ কথা বলা যাইতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণ যে গীতোক্ত ধর্ম্মের সৃষ্টিকর্ত্তা, তাহা আমি বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করিবার কারণ আছে। ফলে তুমি দেখিতে পাইতেছ যে, এক নিষ্কামবাদের দ্বারা সমুদায় মনুষ্যজীবন শাসিত, এবং নীতি ও ধর্ম্মের সকল উচ্চ তত্ত্ব একতা প্রাপ্ত হইয়া পবিত্র হইতেছে। কাম্য কর্ম্মের ত্যাগই সন্ন্যাস, নিষ্কাম কর্ম্মই সন্ন্যাস, নিষ্কাম কর্ম্মত্যাগ সন্ন্যাস নহে।
কাম্যান্যাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ।
সর্ব্বকর্ম্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ || ১৮।২
যে দিন ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও শিল্প, এবং ভারতবর্ষের এই নিষ্কাম ধর্ম্ম একত্রিত হইবে, সেই দিন মনুষ্য দেবতা হইবে। তখন ঐ বিজ্ঞান ও শিল্পের নিষ্কাম প্রয়োগ ভিন্ন সকাম প্রয়োগ হইবে না।
শিষ্য। মানুষের অদৃষ্টে কি এমন দিন ঘটিবে?
গুরু। তোমরা ভারতবাসী, তোমরা করিলেই হইবে। দুই-ই তোমাদের হাতে। এখন ইচ্ছা করিলেই তোমরাই পৃথিবীর কর্ত্তা ও নেতা হইতে পার। সে আশা যদি তোমাদের না থাকে, তবে বৃথায় আমি বকিয়া মরিতেছি। সে যাহা হউক, এক্ষণে এই গীতোক্ত সন্ন্যাসবাদের প্রকৃত তাৎপর্য্য কি? প্রকৃত তাৎপর্য্য এই যে, কর্ম্মহীন সন্ন্যাস নিকৃষ্ট সন্ন্যাস। কর্ম্ম, বুঝাইয়াছি-ভক্ত্যাত্মক। অতএব এই গীতোক্ত সন্ন্যাসবাদের তাৎপর্য্য এই যে, ভক্ত্যাত্মক কর্ম্মযুক্ত সন্ন্যাসই যথার্থ সন্ন্যাস।

————–
* “সাংখ্য” কথাটির অর্থ লইয়া আপাতত: গোলযোগ বোধ হইতে পারে। যাঁহাদিগের এমত সন্দেহ হইবে, তাঁহারা শাঙ্কর ভাষ্য দেখিবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *