১৬. বেলজোনি

বেলজোনি

‘১৮০৩ সালের লন্ডন শহরের ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজের কাছে সার্কাস বসেছে। কাপড় দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় থিকথিক করছে লোক। মাঝের ফাঁকা গোল অংশে খেলা দেখানো চলছে। তবে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে শেষ খেলাটার জন্য। এইজন্যই এত ভিড়। খেলাটার নাম ‘হিউম্যান পিরামিড’! সাত ফুট লম্বা একজন মানুষ স্টেজের মাঝে এগিয়ে আসে। চওড়া কাঁধ, লম্বা চুল, নীল চোখের মণি। হারকিউলিসের মতো চেহারা। সেই লোকটার দু-দিকে ছড়িয়ে রাখা হাতের ওপর ভর দিয়ে একে একে কাঁধে উঠে পড়ে বারোজন মানুষ!’

‘অ্যাঁ! বারোজন!’

মুখের কাছে আইসক্রিমটা চামচে করে এনে হাঁ হয়ে রইল পিজি।

‘হ্যাঁ, বারোজন। কীরকম শক্তিশালী মানুষ খালি ভাবো। ওই পিরামিডের চুড়ো তৈরি করত একটা সুন্দরী মেয়ে। সে নাকি আবার এই দৈত্যের স্ত্রী। সার্কাসের রিং-এ এই লোকটার গালভরা নাম ‘‘প্যাটাগোনিয়ান স্যামসন’’। তবে মিশরের আর্কিয়োলজির ইতিহাসে ও অমর হয়ে আছে ওর আসল নামে। জিওভান্নি বাতিস্তা বেলজোনি।’

‘জিওভান্নি? নামটা শুনে ইতালিয়ান মনে হচ্ছে তো।’

‘ইতালিয়ানই তো। ১৭৭৮-এ ইতালির পাদুয়া নামের একটা ছোট্ট শহরে জন্ম হয়েছিল বেলজোনির। বাবা ছিল গরিব নাপিত। খুব ছোটো বয়স থেকেই ও বাবার দোকানে কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু ওই কাজ ওর কোনোদিনই ভালো লাগত না। তাই ষোলো বছর বয়সে দাদা ফ্রাঞ্চেস্কোর সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল রোমে। ১৭৯৭তে রোম দখল করল ফ্রেঞ্চরা। জোয়ানদের তখন ফ্রেঞ্চ আর্মিতে নাম লেখাতেই হবে। জিওভান্নি তাই পালিয়ে গেল হল্যান্ডে। সেখানে হাইড্রোলিক মেশিনের কাজ শিখল বেশ কয়েক বছর। তার পরে গন্তব্য লন্ডন। আশা ছিল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ পাবে। কিন্তু কেউ ওকে কাজ দিতে রাজি হল না। অতঃপর জিওভানি বেলজোনির জায়গা হল লন্ডনের সার্কাস।’

‘কিন্তু একজন সার্কাসে খেলা দেখানো লোক আর্কিয়োলজিস্ট হয়ে গেল কী করে?!’

image128.jpg

বেলজোনি

‘ডেস্টিনি স্পন্দন ভাই, ডেস্টিনি। সার্কাসে খেলা দেখিয়ে রোজগার মন্দ হত না। কিন্তু তাতে তো সম্মান ছিল না। ন-বছর বিলেতে কাটাবার পরে তাই একদিন বেলজোনি সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিজের ভাগ্য বদলাবার জন্য। সঙ্গে ওর স্ত্রী সারা আর খাস চাকর জেমস কার্টিন। অন্যদিকে মিশরে তখন একটা অদ্ভুত অবস্থায় পড়েছেন তখনকার শাসক পাশা মহম্মদ আলি। লজ্জায় প্রায় নাক কাটা যাবার উপক্রম বলতে পারো।’

পিজি বলল, ‘কী কেস?’

‘কেস খুব জন্ডিস তখন, বুঝলে। মামলুক লিডারদের সরিয়ে আলি পাশা মিশরের মসনদে বসার পরে ঠিক করেন দেশটাকে ভালো করে সাজাতে হবে। সেইমতো নতুন নতুন প্রাসাদ গড়ে উঠতে লেগেছিল কায়রো আর তার চারপাশের শহরগুলোতে। তবে শুধু শহর গড়লেই তো আর হবে না। দেশে জলের অভাব বরাবরই ছিল। চাষবাসের জন্য বা শহরের রোজকারের কাজে লাগাবার জন্য নীল নদ থেকে জল তুলে আনতে হবে। তার জন্য চাই ভালো কোয়ালিটির পাম্প। এদিকে সেই পাম্প বানানোর মতো ইঞ্জিনিয়ার গোটা দেশে নেই। যেটুকু জল ওঠে সেটা ষাঁড়ে-টানা সাক্কিয়া নামের একরকমের প্রাগৈতিহাসিক নকশার দুর্বল পাম্পে। ভালো পাম্প কেনার জন্য তাই পাশাকে তাকাতে হল ইউরোপের দিকে। প্রথম সুযোগেই ব্রিটিশরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরা বলল আমরা একটা দারুণ পাম্প আপনাকে দিতে পারি, যার কারিগরি সবচেয়ে আধুনিক। পাশা রাজি হয়ে গেলেন। একটা পাম্প কিনতে আলি পাশার খরচা হল তখনকার দিনের মুদ্রায় ১০,০০০ পাউন্ড। মানে, প্রায় নব্বই হাজার টাকা। এখনকার হিসেবে সেটা প্রায় তিরিশ চল্লিশ লাখ টাকা হবে।’

image129.jpg

ষাঁড়ে টানা সাক্কিয়া

‘বলেন কী! অত টাকা দিয়ে একটা পাম্প! ব্রিটিশরা বেশ ভালো লেভেলে বোকা বানিয়েছিল তো দেখছি পাশাকে।’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও, শুধু এখানেই বোকা বানানোর শেষ নেই। ব্রিটিশ পাম্প তো এসে পৌঁছোল পাশার কাছে। কিন্তু সেই পাম্প চালানো শেখাবার জন্য কেউ এল না ইংল্যান্ড থেকে। একটা আদ্দামড়া মেশিন নিয়ে পাশা বোকার মতো বসে রইলেন।’

‘এ বাবা। একদম যা তা লেভেলে ঠকেছিলেন দেখছি আলি পাশা।’

‘তা আর বলতে? পাশা সেইজন্য নিজের খুব কাছের একজনকে পাঠিয়েছিলেন ইউরোপে। তাঁরর নাম ইসমায়েল জিব্রালটার। জিব্রালটারের কাজ ছিল একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ধরে পাশার কাছে নিয়ে আসা। এই জিব্রালটার যখন ইউরোপের উত্তর দিকের একটা ছোট্ট দ্বীপ মালটাতে ঘুরছেন তখন ওঁর সঙ্গে আলাপ হল একজন ইতালীয়র। কে বলো তো লোকটা?’

আমি আর পিজি দু-জনেই ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলাম।

‘আচ্ছা, কয়েকটা হিন্ট দিচ্ছি। ইতালীয় হলেও সে থাকত ইংল্যান্ডে। লম্বা-চওড়া চেহারা, গালে দাড়ি। চোখের মণি নীল। ইসমায়েলের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিল হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সার্কাসে খেলা দেখানোর কথা থোড়াই কেউ নিজের সিভিতে রাখে !’

‘বেলজোনি!’

‘একদম ঠিক ধরেছ । ইংল্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে এসে পোর্তুগাল, স্পেন, সিসিলি হয়ে বেলজোনি এসে পৌঁছোয় মালটাতে। ইসমায়েল পাম্প চালাবার ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছে জানতে পেরে নিজেই আলাপ জমায়। এদিকে ইসমায়েলও বেলজোনিকে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ১৮১৫ সালের ১৯ মে জিওভান্নি বাতিস্তা বেলজোনি ওর স্ত্রী আর চাকরকে নিয়ে এসে পৌঁছোল মিশরে। তখনও বেলজোনির কোনো ধারণাই ছিল না যে ওর গোটা জীবনটাই বদলে যেতে চলেছে।

‘বেলজোনি পাশার সঙ্গে দেখা করেই জানিয়ে দিল যে ব্রিটিশ কোম্পানির দেওয়া পাম্প সে চালাতে জানে না। কিন্তু অনেক কম খরচে এমন একটা পাম্প ও বানিয়ে দিতে পারবে যেটা সাক্কিয়া পাম্পের থেকে ঢের ভালো কাজ করবে। এক বছর ধরে বেলজোনি সেই মেশিন বানাল। গোল ড্রামের মতো দেখতে একটা অংশকে একটা ষাঁড় ঘোরাবে। আর তার থেকে তৈরি হওয়া এনার্জিতেই জল উঠবে। ডেমনস্ট্রেশনের দিন সেই পাম্প বেশ ভালোই কাজ করল। ছ-টা সাক্কিয়া পাম্প যে পরিমাণ জল তোলে তার সমান জল তুলে দেখাল বেলজোনির মেশিন। পাশা তো খুব খুশি। কিন্তু বেলজোনির এই সাফল্য পাশার দরবারের অনেকের সহ্য হল না। আগে থেকেই তারা একটা প্ল্যান বানিয়ে রেখেছিল। তাদের মধ্যে একজন পাশাকে বলল, আচ্ছা, ষাঁড়ের বদলে যদি মানুষই ড্রামটাকে ঘোরায় তাহলে কী হবে। মজা দেখার আশায় পাশা রাজিও হলে গেল। ষঁাড়টাকে সরিয়ে পনেরো জন মানুষকে দাঁড় করানো হল সেই জায়গায়। তাদের মধ্যে বেলজোনির চাকর জেমসও ছিল। ড্রাম আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। হঠাৎই জেমসকে ছেড়ে দিয়ে বাকি চোদ্দোজন সরে দাঁড়াল। বিশাল বড়ো আর ভারী ড্রামটা ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ল জেমসের ওপরে। ওটা জেমসকে পিষেই ফেলত, যদি না বেলজোনি নিজের অতিমানবিক শক্তি দিয়ে ড্রামটাকে সামলে রাখত। কিন্তু ততক্ষণে বেচারা জেমসের থাইয়ের হাড় হয়ে গেছে দু-টুকরো। প্রথম কাজ করার দিনেই এই মেশিনে একজন আহত হল। অতএব এই মেশিন অপয়া। আলি পাশা এমনটাই মনে করলেন। বাতিল হয়ে গেল বেলজোনির মেশিন। এক বছরের পরিশ্রম জলে গেল। তার সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল রোজগারের পথও।’

পিজি এতক্ষণ ধরে মন দিয়ে গল্প শুনতে শুনতে খেয়াল করেনি যে ওর ভাগের সানডিটা গলে জল হয়ে গেছে। মুখ ব্যাজার করে একটা চুমুকে সেটা সাবাড় করল প্রথমে। তারপরে ভবেশদাকে বলল,

‘দেখলেন তো, আপনার গল্প শোনার চক্করে আমার আইসক্রিমটাই গলে গেল। এদিকে আপনার বেলজোনির এখনও আর্কিয়োলজিস্ট হয়ে ওঠা হল না।’

বাইরে তখন সন্ধে হচ্ছে। আমরা স্কুপের দোতলায় বিশাল বড়ো কাচের জানলাটার পাশের টেবিলে বসেছিলাম। সেকেন্ড ব্রিজের জ্বলে-ওঠা আলোতে নদীটাকে দেখতে দারুণ সুন্দর লাগছিল। মন চাইছিল না উঠতে ওখান থেকে। এদের ওয়েটারগুলোও ভালো। একদম তাড়া লাগায় না। আমি পিজিকে বললাম,

‘তোর টুটিফ্রুটি নিয়ে দুঃখ তো? ওকে আমি খাওয়া…’

‘আরে, তুমি কেন? আমিই খাওয়াচ্ছি। আজকে প্রদীপ্তর জন্য এত বড়ো একটা কাজ হল আমার। আর একটা আইসক্রিম খাওয়াতে পারব না? চলো, আরেক রাউন্ড করে হয়ে যাক।’

পিজি আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে আসার পরে ভবেশদা আবার গল্প বলা শুরু করলেন,

‘মিশরে থাকতে থাকতেই বেলজোনির আলাপ হয়েছিল একজন সুইস আর্কিয়োলজিস্টের সঙ্গে। নাম জোহান লাডউইগ বুৰ্কাৰ্ড। বুর্কার্ডই সম্ভবত প্রথম ইউরোপিয়ান, যিনি ইজিপ্ট দেশটার এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেলেছিলেন। এই বুর্কার্ডই আবু সিম্বেলের মন্দির খুঁজে বের করেছিলেন। সেই গল্পটাও দারুণ। তবে সেটা অন্য আরেকদিন হবে ’খন। আজকে বেলজোনির কথাই বলি। বুর্কার্ডের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বেলজোনিকে খুব টানত। সেইসময় আবার বুর্কার্ড প্ল্যান করছেন একটা ক্যারাভ্যানে করে সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে টিমবাকটু যাওয়ার। সেই অভিযানে তিনি একাই যাবেন, আর কাউকে নেওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে বুর্কার্ড বেলজোনিকে একটা অন্য ঐশ্বর্যের খবর দিলেন। 

‘নীল নদের পশ্চিম পাড়ের কাছে থাকা একটা জায়গার নাম গুর্না। লাক্সর শহরের কাছেই। গুর্নাতে নাকি একটা ভাঙা মন্দির আছে। পরিত্যক্ত জায়গা, কেউ যায় না সেখানে। কিন্তু সেখানেই বেলজোনি একটা দারুণ জিনিসের খোঁজ পেয়েছেন। মসৃণ গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি একটা বিশাল বড়ো ফারাওয়ের মূর্তি। ন-ফুট লম্বা, ওজন প্রায় সাত টন। মানে, প্রায় ৬,৫০০ কিলো! মাথাটা অক্ষত থাকলেও বুকের নীচের অংশ থেকে ভেঙে গেছে। সেইসময় ইজিপ্টের এদিকে-ওদিকে ফ্রেঞ্চ আর ব্রিটিশরা টুকটাক যা পাচ্ছে তুলে নিয়ে দেশে যাচ্ছে। এই মূর্তিটার কথাটাও অনেকেই জানত। কিন্তু এত বড়ো একটা কিছুকে হস্তগত করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। মূর্তিটাকে টেনে নীল নদের পাড়ে নিয়ে আসাটাই তো প্রায় অসম্ভব। সেইসময় তো ফারাওয়ের নাম কেউ বুঝতে পারেনি। ইউরোপিয়ান এক্সপ্লোরাররা এর নাম দিয়েছিল কম বয়সের মেমনন। মেমনন ছিল ইলিয়াডের একটা চরিত্রের নাম। তবে তার আগেও গ্রিকরা এঁকে অন্য নামে ডাকত। অজিমেন্দিয়াস।

‘বেলজোনির মনে হল ওঁর জন্যই যেন পাথরের টুকরোটা অপেক্ষা করে আছে। তাই আরেকবার বেলজোনি আলি পাশার দরবারে হাজির হল। এবারে ইচ্ছাটা অন্যকম, মূর্তিটাকে ও তুলে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চায়।’

‘কিন্তু, ওই সাড়ে ছ-হাজার কিলোর পাথর টানা তো অসম্ভব ছিল বললেন।’

‘হুঁ, আলি পাশাও সেরকমই ভেবেছিল। বেলজোনির কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ ভেবে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ব্যস, ১৮১৭ সালের জুলাই মাসে বেলজোনিকে দেখা গেল নীল নদের পশ্চিম তীরে, গুৰ্নাতে।

‘পাথরের মূর্তিটার বেশ খানিকটা মাটির নীচে গেঁথে ছিল। নেপোলিয়নের সৈন্যরা এর আগে চেষ্টা করেছিল একে তুলে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার। ওরা ভেবেছিল গানপাউডার দিয়ে মূর্তিটার কাঁধ থেকে মাথাটাকে আলাদা করে দেওয়া যাবে। তাহলে শুধু মুন্ডুটাকে বয়ে নিয়ে গেলেই হল। সেইজন্য ডান কাঁধে ড্রিল করে গর্তও বানিয়েছিল। কিন্তু সেই গানপাউডারের ব্লাস্টের চোটে মূর্তির মুখেও ক্ষতি হতে পারে, তখন অতটা বিষ্ফোরকের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। এই ভেবে রণেভঙ্গ দেয় ওরা। 

‘ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল হেনরি সল্টকে খুব বুদ্ধি করে রাজি করায় বেলজোনি। সল্টের ওপরেই তখন দায়িত্ব ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ইজিপ্টের প্রত্নতত্ত্বগুলোকে নিয়ে যাওয়ার। সল্ট দেখল বেশ ভালো সুযোগ, ওকে খাটতেও হবে না। খাটবে এই দানবের মতো চেহারার লোকটা। এদিকে মূর্তিটাকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর জন্য ওর বেশ নামও হয়ে যাবে। তাই সল্টও এককথায় রাজি হয়ে গেল। সল্টের কাজ মূর্তিটাকে আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দর থেকে ইংল্যান্ডে পাঠানো। আর বেলজোনির কাজ ওটাকে লাক্সর থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে আসা। 

‘বেলজোনির সামনে দুটো চ্যালেঞ্জ ছিল। তার প্রথমটা অবশ্যই মূর্তিটাকে টেনে নীল নদের পাড়ে নিয়ে আসা। আর পরেরটা হল মরসুম। সামনেই আসছে বর্ষাকাল। নীল নদে বন্যা আসবে। দুই পাড়ই ভেসে যাবে। মূর্তিটা চলে যাবে জলের তলায়। জল নামলেও কাদামাটির মধ্যে থেকে মূর্তিটাকে তোলা অসম্ভব একটা কাজ হয়ে যাবে। অতএব হাতে সময় কম।

image130.jpg

আশি জন মানুষ মূির্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে

‘কাঠের লিভার বানিয়ে মূর্তিটাকে মাটি থেকে তোলা গেল। তারপরে ওটাকে বসানো হল একটা বেশ বড়ো কাঠের পাটাতনে। সেই পাটাতনের নীচে লাগানো হল চারটে মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি। এবারে কাঠের পাটাতনটা চাকা লাগানো স্লেজগাড়ির মতো দেখতে হল বেশ। এই স্লেজকে টানতে লাগল আশিজন মানুষ। বেলজোনি নিজেও হাত লাগাল। টানা ষোলো দিন ধরে অমানুষিক পরিশ্রমের পরে যুবক মেমনন পৌঁছোল নীল নদের তীরে। তারপরে মাসকয়েকের মধ্যেই সেটা পৌঁছোল লন্ডনে। যেদিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মূর্তিটাকে বসানো হল সেদিন গোটা লন্ডন শহর ভেঙে পড়ল দূর দেশ থেকে আনা সেই আশ্চর্যকে দেখার জন্য। সেই ভিড়ের মধ্যে ছিলেন একজন কবিও, নাম পার্সি শেলি। নাম শুনেছ?’

‘মেরি শেলির নাম শুনেছি, ‘‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’’ যার লেখা।’

‘হ্যাঁ, পার্সি শেলি ওঁর স্বামী ছিলেন, সেইসময়কার বেশ নামকরা কবি, কিন্তু স্ত্রী-র খ্যাতির কাছে ওঁর নাম চাপা পড়ে যায়। এই শেলি সেই মূর্তিটাকে দেখে একটা কবিতা লেখেন। ইংরেজি সাহিত্যে সেই কবিতা বেশ বিখ্যাত। এর নাম ‘‘অজিমেন্দিয়াস’’।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই নামের একটা কবিতার কথা শুনেছিলাম বটে। তবে এইটাই যে তার পিছনের গল্প, সেটা জানতাম না।’

গলার স্বরটা ভারী করে বলল পিজি। আমি ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই বলল,

‘কী হয়েছে? আমি এটা জানতে পারি না? আমার মাসতুতো দিদি ইংরেজিতে এম এ করছে। ও বলেছিল।’

‘তোর আবার মাসি আছে নাকি? আমি তো জানতাম শুধু এক মামা, যে চুঁচড়োতে…’

image131.jpg

দ্বিতীয় রােমসিসের মূির্ত

‘তোকে কি সব বলতে যাব নাকি? এই মাসি মায়ের জ্যাঠতুতো বোন। এবারে হয়েছে? দেখুন ভবেশদা, ভালো আলোচনাটার কেমন তাল কাটছে স্পন্দন। ওকে এবার থেকে আর এসব গল্পের মধ্যে ডাকবেন না।’

ভবেশদা মুখে কিছু না বলে পিজির দিকে তাকিয়ে শুধু বাঁকা হাসলেন। কিন্তু ছেলেটা সেটাকে অগ্রাহ্য করে ভবেশদাকে এবারে বলল,

‘আচ্ছা, তাহলে অজিমেন্দিয়াস আর যুবক মেমনন একই মূর্তির দুটো নাম, এটা বুঝলাম। কিন্তু ফারাওয়ের আসল নামটা তো বললেন না। এতদিনে নিশ্চয়ই জানা গেছে।’

‘সে তো গেছেই। এই একমাত্র ফারাও যে নব্বই বছর বেঁচেছিল। গোটা ইজিপ্ট জুড়ে বানিয়েছিল নিজের মন্দির। ইজিপ্টোলজিস্টরা একে বলে ‘‘দ্য ফারাও অফ প্রোপাগান্ডা’’। এই সেই দ্বিতীয় রামেসিস! যার আবু সিম্বেলের মন্দির আবিষ্কার করেছিল জোহান বুর্কার্ড।’

‘আরিব্বাস! রামেসিসের গল্পটাও বলবেন তো!!’

‘বলতেই পারি, যদি তোমাদের এনার্জি থাকে তো। বেলজোনির গল্পও তো অনেক বাকি এখনও।’

দুটো করে আইসক্রিম সাঁটিয়ে আমাদের এনার্জি তুঙ্গে ছিল। আর ভবেশদার মুখে এইসব গল্পগুলো ছাড়া যায় নাকি!

image132.jpg

দ্বিতীয় রােমসিসের মমি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *