বেজির নাম রিক্কি
রিক্কি টিক্কি হলো একটা বেজি। অনেকটা ছোট বেড়ালের মতো দেখতে। চোখ ও নাকের ডগা আবছা লাল। লেজটাকে এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে ফোলাতে পারে। ঘন ঘাসঝোপের মাঝ দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাবার সময় রিক্কি বেজি ঘাড় ফুলিয়ে ডাকে।
বেজিটা তার বাবা মার সাথে একটা গর্তের ভেতরে থাকত। একবার বানের পানিতে গর্তটা ভরে যায়। বেজিটা তখন পানির প্রচণ্ড স্রোতে ছিটকে ভেসে যেতে থাকে । রাস্তার পাশের নালার ভেতর দিয়ে জোরে ধাক্কা খেতে খেতে বেজিটি এগিয়ে যাচ্ছিল। একগোছা ঘাসকে ভেসে আসতে দেখে বেজিটা সেটাকে আঁকড়ে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে । ঘাসগোছাটা আঁকড়ে ধরে বেজিটা কোনোমতে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ একটা ধারাল পাথরের টুকরোর সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
বেজিটা একটা বড় বাংলোবাড়ির বাগানের পথের উপর এসে ছিটকে পড়ে। সোনালি রোদ পড়ে বেজিটার ভেজা শরীর চিকচিক করছিল। একটা ছোট ছেলে দেখতে পেল সবুজ ঘাসের মাঝে বেজিটা কীরকম নিথর হয়ে পড়ে আছে। ছেলেটির নাম টেডি ।
ছেলেটি চেঁচিয়ে বলে, এই তো এখানে একটা মরা বেজি। এটাকে পুড়িয়ে ফেললে কেমন হয়।
ছেলেটির মা বারান্দা থেকে বলল, আসলে এটা হয়তো এখনও মারা যায়নি। এই বেজিটাকে তুমি ভেতরে নিয়ে চলো। দেখছ না এটা পানিতে কেমন চুপসে গেছে। এখন এটাকে গরম করতে হবে। তাজা করে তুলতে হবে। আমার তো এটার জন্য মায়া লাগছে।
তখন মা আর ছেলে মিলে বেজিটাকে মাটি থেকে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।
ছেলেটির বাবা বেজিটাকে তুলে ধরে নেড়েচেড়ে বললেন, এটা কিন্তু এখনও মরেনি। এটাকে গরম করলে হয়তো বেঁচে উঠতে পারে।
এটার প্রাণ এখনও ধুকপুক করছে।
ওরা তখন বেজিটাকে মন দিয়ে যত্ন করতে শুরু করল। তুলো দিয়ে নেতাতো শরীরটাকে মুড়ে রাখল। কিছুক্ষণ পরে বেজিটা জুলজুল করে তাকায়। ছেলেটির বাবা বলল, একে তোমরা কিন্তু কেউ ভয় দেখাবে না। আগে দেখ, এটা কী সব করে।
টেডি বেজিটার গায়ে আদর করে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, এই বেজিটাকে আমরা কিন্তু এখন থেকে রিক্কি বলে ডাকব। এর নাম হলো রিক্কি। বুঝেছো রিক্কি।
বেজিটা টেবিলের চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল। একসময় লাফ দিয়ে ছেলেটির কাঁধে চড়ে বসে। বেজি খুব চঞ্চল একটি প্রাণি। এক জায়গাতে কখনও এরা স্থির হয়ে থাকতে পারে না।
ছেলেটির বাবা বলল, দেখেছ টেডি, এই বেজিটা তোমার সাথে কেমন ভাব করতে চাইছে। তোমাকে বোধ হয় সে নিরাপদ বলে মনে করছে।
টেডি ফিক করে হেসে বলল, বাবা, বেজিটা আমাকে কেমন সুড়সুড়ি দিচ্ছে দেখ। আমাকে একদম ভয় পাচ্ছে না।
বেজিটা টেডির কাঁধ থেকে চট করে নেমে কাঠের মেঝেতে বসে নিজের নাক ঘষতে থাকে। আলমারির ওপরে বসে থাকে বিড়ালটা ওকে দেখতে থাকে।
টেডির মা বলল, আসলে এটা কিন্তু একটা বুনো প্রাণি। এখন অবশ্য এটা বেশ নিরীহ ধরনের ভাব করছে। কারণ আমরা যে ওকে আদর করছি।
টেডির বাবা বলল, বেজিরা কিন্তু অনেকটা ও রকমই। টেডি যদি এটাকে খাঁচায় না পোরে তবে সারাদিন সে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে এভাবে ছুটোছুটি করবে। এবার এটাকে কিছু খেতে দাও। এর বেশ খিদে পেয়েছে।
টেডি বেজিটাকে তিতির পাখির এক টুকরো কাঁচা মাংস খেতে দিল। মাংস খেয়ে বেজিটা বারান্দায় গিয়ে রোদের মাঝে বসল। তাকে তখন বেশ নিশ্চিন্ত দেখাছে।
বেজিটা ভাবছে, এই বাড়িতে তার অনেক কিছু জানার আছে। আমি তাই এখানে থাকব। অনেক কিছু খুঁজে বের করব। এখানে আমাকে কেউ খোচায়নি। আমাকে আক্রমণ করেনি।
বাংলোবাড়িতে সারাদিন ধরে ছুটোছুটি করল রিক্কি। একবার তো টেবিলের কালির দোয়াতের ভেতরে নাক ডুবিয়ে দিল। দোয়াতটাকে উল্টে ফেলে কালি ছড়িয়ে দিল।
রাতে টেডি যখন ঘুমুতে গেল তখন বেজিটাও লাফিয়ে টেডির বিছানায় উঠে পড়ল। বেজিটার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এবার সে একটা পছন্দ মতো আশ্রয় পেয়েছে। টেডির বাবা, মা টেডির ঘরে ঢুকে দেখে বেজিটা বিছানায়। টেডির মা বিরক্ত হয়ে বললেন, এ কী কাণ্ড! বেজিটা এখানে কেন? যদি আমার ছেলেটাকে কামড়ে দেয়।
টেডির বাবা বলল, ভয় নেই। সে রকম কোনো কিছু হবে না। এখন যদি একটা সাপ বাগানে ঢুকে পড়ে তাহলে বেজিটা অবশ্যই ঘটনা ঘটাবে। সাপের সাথে বেজির আবার রয়েছে চিরকালের শত্রুতা। সাপের সাথে বেজির লড়াই হবেই। একে অন্যের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ছিড়ে ফেলতে চাইবে।
সাপের কথা শুনে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন টেডির মা।।
কী যে সব অলক্ষুনে কথা তুমি আবার বলল না। শুনলে শরীরে কাঁটা দেয়।
সকালে টেডি বেজিটাকে কাঁধে নিয়ে বারান্দায় এল। টেডি বেজিটাকে ডিমসেদ্ধ আর কলা খেতে দেয়। বেজিটা খেল। এরপর বেজিটা গেল বাগানে। বেশ বড় আকারের বাগান। বাগানের অনেকটা অংশ ঝোপঝাড়, কাঁটালতায় ঢাকা। আগাছায় পূর্ণ। একটা কাঠবাদাম গাছে বসে থাকা কাঠবেড়ালিটা লেজ উঁচিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছিল। ডাল থেকে কাঠবাদাম পেড়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলছিল। খোসা ভেঙে বাদাম খাচ্ছিল। বাগানের এদিকে সেদিকে ছুটছে বেজিটা । একসময় একটা কাঁটাঝোপের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। ঝোপের ভেতর থেকে বাবুই টুনটুনি পাখির গলা শোনা যাচ্ছে। দরজি পাখি টুনটুনি সেখানে পাতা জোড়াকে সেলাই করে নিপুণভাবে বাসা তৈরি করেছে। দমকা বাতাসে সবুজ পাতার বাসাটি দুলছিল। মনের দুঃখে কাঁদছিল টুনটুনি বউ।
রিক্কি বেজি জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছে কেন?
টুনটুনি বলে, গতকাল আমাদের একটা ছানা বাসা থেকে টুপ করে নিচে পড়ে গিয়েছিল। তখন ঝোপের ভেতর থেকে সাপটা বেরিয়ে এসে ছানাটাকে খেয়ে ফেলেছে। আমার ছানাটাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সাপটা।
টুনটুনির এমন কথা শুনে ভীষণ দুঃখ পায় রিক্কি। সাপটার ওপর খুব রাগ হয়।
বুঝলে, আমি তো এখানটায় নতুন এসেছি। তা সাপটা কোথায় থাকে?
ঝোপের ভেতর থেকে তখন একটা চাপা হিসহিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। রিক্কি একটু পিছিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা কালো গোখরো সাপের মাথা। ফণা তুলে আছে। দুলছে সাপটা। বেজিটার দিকে সাপটা সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে।
গোখরোটা তার ফণাটাকে আরও কিছুটা বড় করে মেলে ধরল। এর আগে রিক্কি কখনও এভাবে জীবন্ত গোখরো সাপের মুখোমুখি হয়নি। তার মা তাকে অনেক সময় মৃত গোখরো সাপ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাইয়েছে। রিক্কি জানে তাদের জাতের প্রধান কাজই হচ্ছে সাপের সাথে লড়াই করা। সাপের সাথে তাদের রয়েছে চিরকালের শক্রতা। সাপকে দেখামাত্রই তাদের শরীরে কেমন যেন ভয়ানক জ্বলুনি শুরু হয়ে যায়। সাপকে আঘাত করার জন্য তখন তড়পাতে থাকে। ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপের ওপর। আঁচড়াতে থাকে। খামচাতে থাকে। রিক্কি ফুঁসে ওঠে, তুমি টুনটুনির ছানাকে খেয়েছ। এটা কিন্তু তোমার মোটেই উচিত হয়নি। তুমি সাজ্জাতিক রকমের অন্যায় করেছ।
গোখরোটা ভালো করেই জানে বাগানে যখন একবার বেজি ঢুকেছে তখন তাদের উপর ভয়ানক আক্রমণ হবে। এ থেকে কোনোভাবেই রেহাই নেই। সাপে বেজিতে লড়াই হবেই। কিন্তু সে চাইছে বেজিটার উপর আচমকা আক্রমণ চালাতে। গোখরোটা ভাবল তার আগে বেজিটার সাথে একটু আলাপ করে নেয়া যাক। সাপটা একপাশে মাথা নামিয়ে বলে, তুমি তো ডিম খাও। তাহলে আমি পাখি খেলে দোষ কী?
তখন গোখরো সাপের বউটা চুপিসারে রিক্কির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাস নড়ছে। সাপটা ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে।
এখনই সে সাঁত করে তীব্র ছোবল মারবে বেজিকে। টুনটুনিটা ওপর থেকে দেখতে পেয়েছে সাপিনিটাকে। সে চেঁচিয়ে রিক্কিকে সাবধান করে দেয়, পেছনে তাকাও।
রিক্কি চট করে সরে যায়। গোখরোটার ছোবল রিক্কির উপর এসে পড়ল না। সাপটা হিংস্র হয়ে হিসহিস করে শব্দ করছে। এভাবে প্রথম আঘাত থেকে বেজিটা বেঁচে যাওয়াতে সাপটা আরো বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। সাপটা চেয়েছিল প্রথমেই বেজিটাকে কাবু করে ফেলতে। যাতে সে মাথা তুলতে আর না পারে । রিক্কি এবার ঝাপিয়ে পড়ল সাপটার উপর। তারপর কামড় বসিয়ে দিল। সাপটার প্রচণ্ড জোরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য বেজিটা লাফিয়ে উঠে সরে গেল। আহত সাপটা শরীর পেঁচিয়ে গজরাচ্ছে। পুরুষ গোখরোটা রেগেমেগে লাল চোখে বলল, ওরে শয়তান পাখি। তোমাকে আমি এবার দেখে নেব। আমার সাথে কিনা চালাকি করছ। মজা টের পাবে।
টুনটুনি পাখির পাতার বাসাটি ছিল সাপের নাগালের বাইরে। দমকা বাতাসে বাসাটি এদিকে সেদিকে দুলতে থাকে। রিক্কি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। সাপ আর সাপিনি ততক্ষণে ঘাসঝোপের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। দাঁত কিড়মিড় করছে রিক্কির। সে অবশ্য সাপ দুটোকে তাড়া করল না। সে জানে একা সে দুটো সাপের সাথে কোনোমতেই লড়াই করতে পারবে না। বেজিটা তখন বাংলো বাড়ির দিকে চলল। তাকে এখন থেকে সাবধানে থাকতে হবে ।
টেডি তখন বাগানে ছুটে আসছিল। সে ব্যাকুল হয়ে রিক্কিকে খুঁজছে। বেজিটার প্রতি তার মায়া পড়ে গেছে। বেজিটাকে দেখে সে থামল। এমন সময় ধুলোর মধ্যে কি যেন একটা নড়ে উঠল। রিক্কি দেখল, ধুলোর মধ্যে একটা ছোট ধূসর লিকলিকে সাপ নড়ছে। এই সাপের কামড় হলো ভয়ঙ্কর অত্যন্ত । এটা হলো গিয়ে কারাইত সাপ।
বেজিটা নিপুণ ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কারাইতের উপর। ফেঁসফোঁস শব্দ হলো। সাপ আর বেজির মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হলো। দুজনেই পরস্পরকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করছে। কেউ আর কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না। | টেডি সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বলছে, আমাদের বেজি এখন ধীরে ধীরে একটা সাপকে মারছে। টেডির মা, বাবা সেই চিৎকার শুনে ছুটে এলেন। কারাইত সাপটা ততক্ষণে ছিটকে দূরে চলে গেছে। বেজিটা লাফ দিয়ে সাপের পিঠে চড়ে বসল। তারপর প্রচণ্ড এক কামড় বসিয়ে দিল। সে কামড়ে কারাইতটা এবার অবশ হয়ে যায়। নেতিয়ে পড়ে। কামড়ে কামড়ে কারাইতটাকে রক্তাক্ত করে ফেলল রিক্কি। টেডির বাবা তখন সেই মরা সাপটাকে লাঠি দিয়ে ক্রমাগতভাবে আঘাত করছেন।
রিক্কি ভাবল সে তো আগেই কারাইতটাকে শেষ করে দিয়েছে। টেডির মা ধুলোর ভেতর থেকে রিক্কিকে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন । তিনি কাঁদছেন। এই বেজি আজ তার ছেলেকে নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বিস্ময়করভাবে তার ছেলেটিকে রক্ষা করেছে। প্রচণ্ড সাহসের পরিচয় দিয়েছে বেজিটা। বেজিটার প্রতি তখন তার প্রবল মায়া জন্মাল। এই প্রাণিটাকে সেদিন পথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল তার ছেলে। কত আদর যত্ন করে বাঁচিয়েছে। সেই প্রাণিটা যেন এভাবে তার ঋণ শোধ করল।
রাতেরবেলায় রিক্কির সাথে বাংলোবাড়িতে দেখা হলো গন্ধগোকুল চুচুন্দ্রার । চুচুন্দ্রা তাকে ভীতকণ্ঠে বলল, আমাকে কিন্তু আবার মেরে ফেল না। তুমি আজ কারাইত সাপটাকে মেরেছ।
রিক্কি বলল, তুমি কোনো ভয় পেও না। তুমি কি ভাবছ যে সাপ মারে সে আবার গন্ধগোকুলকেও মারবে?
চুচুন্দ্রা করুণ কণ্ঠে বলে, যারা সাপ মারে তারা কিন্তু আবার সাপের হাতেই মরে। রাতের অন্ধকারে গোখরোটা হয়তো আমাকে তুমি বলে ভুল করতে পারে। আমি তো এখন সে ভয়টাই পাচ্ছি। সেই ভয়ে আমি সিটিয়ে যাচ্ছি। যাকে বলে গোখরোর ছোবল। এক ছোবলেই সর্বনাশ। রিক্কি বলল, তোমার আবার কিসের ভয়? গোখরোটা থাকে বাগানে। যেখানে তুমি তো যাও না।
চুচুন্দ্রা বলল, ইদুর আমাকে বলেছে যে গোখরো সাপ সবখানেই থাকে। সবখানেই যায়। তুমি কী এখন কোনো ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
রিক্কি কান পাতল। বিশাল বাংলোবাড়িটা একেবারে নিঝুম হয়ে আছে। রিক্তির কানে এল কিচকিচ শব্দ। জানালার কাঁচের উপর বোলতার হেঁটে যাওয়ার মতো শব্দ। এটা হচ্ছে গোখরো সাপের চলার শব্দ। রিক্কি ভাবল, বাগান থেকে গোখরো সাপ তাহলে বাড়িতে উঠে এসেছে। রিক্কি আঁতিপাঁতি করে সাপকে খুঁজতে লাগল। একটা দেয়ালের ফোঁকরের কাছে এসে রিক্কি শুনতে পেল সাপ আর সাপিনি ফিসফিস করে কথা বলছে। সাপবউ বলছে, তুমি এবার ভেতরে যাও। যে বড় মানুষটা কারাইতকে মেরেছে তাকেই প্রথমে কামড়াবে। তারপর আমরা দু জনে মিলে ঐ বেজিটাকে খুঁজে বের করব । বেজিটার মাতব্বরি করা বের করছি। আমাদের সাথে লাগতে এসেছে।
গোখরো সাপ বলল, মানুষ মেরে আমাদের কী লাভ হবে?
সাপবউ বলে, মানুষই তো বেজিকে পুষছে। এই বাংলোবাড়িতে যখন কোনো মানুষ ছিল না তখন বাগানে আমরা কিন্তু কোনো বেজিকে কখনও দেখিনি। তখন পুরো বাগান ছিল আমাদের অধিকারে । আমরা মনের সুখে সবখানে ঘুরতাম। এ ছাড়া তরমুজ ক্ষেতে আমাদের ডিমগুলো ফুটে যখন ছানা হবে তখন তো তাদের জন্য ঘর লাগবে। তুমি এখন ভেতরে গিয়ে এ বাড়ির মানুষদের ছোবল দাও। জোরে তাদের আঘাত কর।
গোখরো সাপ বলল, আমি কিন্তু বড় মানুষ আর তার বউটাকে মারব। ছোট ছেলেটাকেও মারব। এতে বাংলোবাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে যাবে। বেজিটাও তাহলে আর এখানে থাকবে না।
সাপ দুটোর কথা শুনে প্রচণ্ড রাগে রিক্কির শরীর জ্বলতে থাকে। কতো ভয়ানক একটা পরিকল্পনা এঁটেছে তারা।
দেয়ালের ফোঁকর দিয়ে কুণ্ডলি পাকানো সাপটাকে দেখা যাচ্ছে। সাপটা মাথা তুলেছে। বেজিটা চকিতে সাপের চোখের ঝিলিক দেখতে পায়। রিক্কি ভাবল এখন যদি সে সাপটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে সাপটাকে মেরে ফেলে তবে সাপটা বেশি সুবিধে পাবে।
রিক্কি তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না যে সে কী করবে। রিক্কি শুনতে পেল সাপটা বলছে, সকালে বড় মানুষটা স্নানঘরে ঢোকা পর্যন্ত আমি এখানেই শীতল মেঝেতে আছি।
সাপটা চলে গেল। গোখরোটা কুণ্ডলি পাকিয়ে এক কোণায় রাখা বড় একটি পাত্রের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল।
বেজিটা অপেক্ষা করতে থাকে। সাপটা ঘুমিয়ে পড়েছে। রিক্কি লাফিয়ে পড়ল সাপের উপর। দু পাটি ধারাল দাঁত দিয়ে সাপের মাথায় প্রচণ্ড জোরে কামড় বসিয়ে দিল। লাল মাটির পাত্রে পিঠ ঠেকিয়ে বেজিটা ভয়ানক আক্রোশে চেপে ধরল সাপের মাথা। গোখরো সাপটা তখন তাকে এলোপাথারি আঁছড়াতে লাগল। এই প্রচণ্ড ঝাকাঝাকিতে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র একেবারে তছনছ হয়ে যায়। রিক্কি তার চোয়াল দুটো শক্ত করে সাপের মাথায় চেপে ধরে। সে বুঝতে পেরেছে। সাপটি তাকে এবার আঁছড়ে আঁছড়ে মেরে ফেলতে চাইছে।
বেজিটা এবার ঝিমুচ্ছে। তার শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। রিক্কির কাছে মনে হচ্ছিল তার শরীর বুঝি একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এমন সময় তার ঠিক পেছন দিকে একটা তীব্র আলোর ঝিলিক দেখল। একটা লাল আগুনের শিখা দপদপ করছে। গরম বাতাসের হলকাতে রিক্কি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। শব্দ শুনে টেডির ঘুম ভেঙে যায়। টেডি এসে বন্দুকের গুলি ছুঁড়ল সাপের ফণা লক্ষ্য করে। রিক্কি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে। টেডির মা আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে আসে। টেডির বাবা রিক্কিকে মেঝে থেকে তোলেন। আবার এই বেজিটাই আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছে। এটা আমাদের জন্য মঙ্গলকর।
সাপটি মেঝেতে মরে পড়ে আছে।
বাংলোবাড়িতে সেটি ছিল ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের এক রাত। একসময় রাত শেষ হয়ে ভোর হয়। বাগানে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। এভাবে গোখরো সাপটাকে মেরে ফেলার জন্য রিক্কি ভীষণ খুশি। এবার তার আসল লড়াই হবে সাপিনিটার সাথে । কবে যে সাপিনির ডিমগুলো ফুটে ছানা বের হবে । রিক্কি ছুটে যায়। তখন টুনটুনিটা গান গাইছিল । গেখরো সাপের মৃত্যুর খবর ততক্ষণে সারা বাগানে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির ঝাড়দার সাপের মৃতদেহটাকে নোংরা জঞ্জালের স্তুপে ফেলে দিয়ে গেছে। রিক্কি বলে, এখন কি তোমার গান গাইবার সময় হলো? আর তো তোমার ছানা হারানো চিন্তা নেই।
টুনটুনি তখন খুশিতে ডগোমগো হয়ে ডানা ঝাপটায়।
সাপটা মরেছে। সাপটা টুকরো টুকরো হয়ে এখন জঞ্জালের থিকথিকে কাদার ভেতরে পড়ে আছে। সে আর আমার ছানাদের কখনও খেতে পারবে না। সে আমাদের কতো যে ক্ষতি করেছে। ছানাদের গিলে ফেলেছে। তার ভয়ে আমরা সবসময় কুঁকড়ে থাকতাম। আতঙ্কে থাকতাম।
রিক্কি বলে, কিন্তু সাপবউটা এখন গেল কই?
টুনটুনি পাখা ঝাপটে উড়ে যায়। দেয়ালে ফোঁকরের কাছে গিয়ে সাপবউ ডাকছিল গোখরোটাকে। তখন দেখল তার স্বামী গোখরোটাকে একটা লাঠির মাথায় ঝুলিয়ে নিয়ে ঝাড়দার এগিয়ে আসছে। এই দৃশ্যটা দেখে সাউবউ আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায়। তার দুরন্ত স্বামীর একী দশা হয়েছে। থেঁতলানো, রক্তমাখা শরীর হয়ে ঝুলছে। কোথায় গেল তার সেই রুদ্র চেহারা।
সাপবউ শিউরে ওঠে। এমন করুণ একটা দৃশ্য যে তাকে দেখতে হবে তা সে ভাবেনি।
টুনটুনি বলল, তুমি তো একটা সাজ্জাতিক কাজ করেছ বেজিভাই। তোমাকে তাই অভিনন্দন জানাই।
রিক্কি গম্ভীর মুখে বলল, আমার কিন্তু এখন খুশিতে বাগবাগ হয়ে লাফালে চলবে না। কারণ আমার জন্য আরেকটা লড়াই যে অপেক্ষা করছে। এখন আমাকে বলল সেই সাপিনিটা কোথায়? আমাকে তার অবস্থান জানাও।
টুনটুনি জানায়, সাপিনিটা এখন জঞ্জালের স্তুপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। সেখানে গোখরোটার জন্য সে শোক প্রকাশ করে কাঁদছে।
রিক্কি বলে, তুমি কী জানো সাপিনিটা তার ডিমগুলোকে কোথায় রেখেছে?
টুনটুনি বলে, জানি, ডিমগুলো রয়েছে ওই তরমুজ ক্ষেতে। সেখানে সারাদিন ঝলমলে রোদ থাকে।
রিক্কি বলে, সেই তরমুজ ক্ষেতটা কোথায়?
টুনটুনি বলে, এই বাগানের প্রাচীরের একেবারে শেষ মাথায়। আস্তাবলের দিকে সোজা উত্তরে যাবে। রিকি বলে, তারপর এমন একটি ভান করবে যেন মনে হবে তোমার ডানা ভেঙে গেছে। তোমাকে তখন তাড়া করবে সাপিনিটা। তুমি কাঁটাঝোপে চলে যাবে। আমি তখন তরমুজ ক্ষেতে চলে যাব। এখন সেখানে গেলে যে আমাকে দেখে ফেলবে।
টুনটুনি জানে গোখরোর ডিম মানেই হলো ভবিষ্যতের বাচ্চা গোখরো। তাদের ভয়ানক শত্রু। সে তার বাসা থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল জঞ্জালের স্তুপের কাছে। আর চেঁচিয়ে বলতে লাগল, বাড়ির ছোট ছেলেটা ঢিল ছুঁড়ে আমার ডানা ভেঙে দিয়েছে।
সাপিনি হিসহিসিয়ে বলে, সেদিন আমি যখন বেজিটাকে ছোবল মারতে গিয়েছিলাম তখন তো তুই তাকে সাবধান করে দিয়েছিলি। এখন তুই আবার ঢং করে খোঁড়া সেজেছিস? তোর কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করি না।
টুনটুনি বলে, ছেলেটাই তো ঢিল ছুঁড়ে আমার ডানাটাকে ভেঙে ফেলেছে।
সাপিনি তখন গজরাচ্ছে। আমার স্বামীকে ওরা নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলেছে। আমার ভয়ানক সর্বনাশ করেছে। আমি এর শোধ তুলব। আজ রাত শেষ হবার আগেই এ বাড়ির ছোট ছেলেটাও মারা যাবে। আমি এখন তোকে ধরছি।
ভেবেছিস কি।
টুনটুনি পাখিটা মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়েই চলল। সাপিনিটাও ছুটতে লাগল আরও জোরে । রিক্কি তখন তরমুজ ক্ষেতের দিকে ছুটল। সেখানে সে পাতার আড়ালে বড় বড় পঁচিশটা সাপের ডিম দেখল। দেখতে মুরগির ডিমের মতো। সাপিনিটা এখানে তার ডিমগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিল।
বেজিটার কাছে তখন মনে হলো সে ঠিক সময়ে এসে পড়েছে। ডিমের ভেতরে গোখরোর ছানাগুলো নড়ছে। রিক্কি জানে ডিম ফুটে বেরিয়ে এসে এরা কোনো মানুষ বা বেজিকে মেরে ফেলতে পারে ।
রিক্কি তখন ডিমের মাথাগুলো কামড়ে ভেঙে ফেলতে লাগল। এমনভাবে কামড়াচ্ছিল যাতে ভেতরের গোখরোর ছানাগুলো দাঁতের চাপে মারা যাবে। এভাবে পরপর সে বাইশটা ডিম ভেঙে ফেলল। আর মাত্র তিনটে ডিম পড়ে আছে। তখন টুনটুনিটা সেখানে উড়ে আসে। রিক্কি শোনা, আমি সাপিনিটাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিয়ে এসেছি। সে বারান্দায় উঠে গেছে। সে এখন বাড়ির মানুষদের ছোবল মারার তালে আছে। তুমি তাড়াতাড়ি চল। সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সাপের বাকি দুটো ডিমও ভেঙে ফেলল রিক্কি। শেষ ডিমটাকে মুখে তুলে তরমুজ ক্ষেত থেকে দৌড়ে বাংলোবাড়ির বারান্দায় পৌছে গেল। টেডি তার বাবা মার সাথে তখন বারান্দায় প্রাতঃরাশের জন্য বসেছিল। রিক্কি দেখল টেডির বাবা মা কোনো কিছু খাচ্ছে না। তারা স্থির হয়ে বসে আছে। তাদের দুজনের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। টেডি বসে আছে চেয়ারে। আর টেডির চেয়ারের পাশে মাদুরের উপর কুণ্ডুলি পাকিয়ে সাপিনিটা ফণা তুলে আছে। সে তখন টেডিকে ছোবল মারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাপিনিটা হিসহিসিয়ে বলল, তোমরা আমার স্বামীকে মেরেছ। এখন আমি কিন্তু তোমাদের ছোবল মারব।
টেডি তাকিয়েছিল তার বাবার দিকে। টেডির বাবা বললেন, চুপচাপ বসে থাক টেডি । একটুও নড়াচড়া করবে না কিন্তু।
রিক্কি তখন সেখানে পৌঁছে গেছে। সে চিৎকার করে বলল, এবার তুমি ঘুরে দাঁড়াও সাপ। আমার সাথে তোমার এখন প্রচণ্ড লড়াই হবে । তোমাকে আমি আর ছাড়ছি না। আর এটাই হবে গিয়ে তোমার শেষ লড়াই।
সাপটা হিসহিসিয়ে বলল, তুমিও তাহলে ঠিক সময়ে এসেছ। তোমার সাথেও তাহলে আমার শেষ বোঝাপড়াটা এবার হয়ে যাক। তোমার মানুষ বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ তো। তারা কী রকম ঘাবড়ে গেছে। তুমি আর এক পা এগুলেই আমি কিন্তু তোমাকে ছোবল মারব। তোমাকেও ছাড়ব না।
রিক্কি বলল, তার আগে তরমুজ ক্ষেতে লুকিয়ে রাখা তোমার ডিমগুলোকে একবার দেখে এসো গিয়ে।
সাপটা দেখল বারান্দায় তার একটা ডিম পড়ে আছে। সাপ চিৎকার করে বলল, এই ডিমটা আমাকে দাও।
রিক্কি ডিমটাকে থাবা দিয়ে ঢেকে রাখল । তার চোখ দুটো তখন টকটকে লাল। রিক্কি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, একটা সাপের ডিমের কত দাম? একটা গোখরোর কত দাম? গোখরোর সব শেষ বাচ্চাটির কত দাম? তরমুজ ক্ষেতের ভেঁয়ো পিঁপড়েরা এখন তোমার বাকি ডিমগুলোকে খাচ্ছে। সব খেয়ে সাবাড় করবে।
সাপিনিটা তার শেষ ডিমটার জন্য তীব্রভাবে ঘুরে তাকাল ।
টেডির মা তখন টেডিকে টেনে সাপের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।
রিক্কি এবার সাপের সাথে লড়াই করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়।
বেজিটা চিৎকার করে, কাল রাতে আমি গোখরোর ফণাটাকে চেপে ধরেছিলাম। রিক্কি লাফঝাপ শুরু করে। সাপটা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারেনি। বন্দুকের গুলি ছোড়ার আগেই আমি তাকে মেরে ফেলেছিলাম। এবার তুমি আমার সাথে লড়তে আস সাপিনি।
সাপিনি বুঝল টেডি এখন তার ছোবলের বাইরে চলে গেছে। আর তার শেষ ডিমটাও বেজিটার থাবার মধ্যে রয়েছে।
সাপিনি ফণা নামিয়ে মিনতি করে বলে, আমার শেষ ডিমটাকে এবার আমাকে দিয়ে দাও। আমি এখান থেকে চলে যাই । আর কখনও ফিরব না।
রিক্কি শরীরের রোঁয়া ফুলিয়ে গরগর করে ওঠে, তোমাকে তো এখান থেকে চলে যেতেই হবে। তুমি তোমার স্বামীর মতো ঐ জঞ্জালের স্তুপেই শেষপর্যন্ত যাবে। ওটাই হবে গিয়ে তোমার পরিণতি। ভেবেছ কি। টেডির বাবা বন্দুক আনতে গেছে। এখন তুমি আমার সাথে লড়াই কর। দেখি তোমার কতো সাহস।
সাপের ছোবলের বাইরে থেকে বেজিটা তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।
রিক্কির চোখ দুটো তখন আগুনের মতো ধকধক করে জ্বলছে। সাপিনি ছোবল মারল। সাঁৎ করে একপাশে সরে যায় রিক্কি। প্রতিবারই সাপিনির মাথা বারান্দার মাদুরের উপর ঠুকে যাচ্ছে। রিক্কি চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। সে সাপটির পেছনে যেতে চাইছে। সাপিনিও তার মুখোমুখি হবার জন্যে ঘুরতে লাগল। মাদুরের উপর সাপটি জোরে জোরে লেজ আছড়াচ্ছে। সপাত সপাত করে শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ঝড়ের মধ্যে শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছে।
রিক্কি তখন ভুলে যায় ডিমের কথা। ডিমটা পড়েছিল বারান্দায়। সাপিনিটা ডিমটার কাছাকাছি চলে গেল। যেই না রিক্কি শ্বাস টানার জন্য একটু সরেছে অমনি সাপিনি ডিমটাকে মুখে তুলে নিয়ে তীরবেগে ছুটতে থাকে। বেজিটাও তখন তার পেছনে পেছনে ছুটল। প্রাণপনে ছুটছে সাপিনি। বেজিও সেই সাথে ছুটছে। যে ভাবেই হোক রিক্কি সাপটাকে জাপটে ধরে ফেলতে চায়। সাপিনি কাঁটাঝোপের পাশ দিয়ে দিঘল ঘাসের ভেতর দিয়ে ছুটছে। টুনটুনি তখনও তার বাসার ভেতরে বসে গান গাইছে। টুনটুনির বউটা বেশ চালাক চতুর।
সাপিনিটা যেইমাত্র কাছে এল অমনি পাখিটা সাপিনির মাথার উপর ডানা ঝাপটে উড়তে লাগল। চড়ুই পাখিটাকে এভাবে ফুড়ুত ফুড়ত করে উড়তে দেখেও সাপিনিটা কিন্তু ঘাবড়ে গেল না। সাপিনি ছুটল ফণা নামিয়ে। এই সুযোগে রিক্কি সাপিনিটাকে কামড়ে ধরে ফেলল। ইদুরের যে গর্তের ভেতর সে ও সাপ বাস করত চোখের পলকে সাপিনি সেই গর্তের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেজি তখন আর গোখরো সাপের গর্তে ঢুকতে সাহস পায় না। গর্তের ভেতরে থিকথিকে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে।
রিক্কি সাপিনিটাকে প্রচণ্ড গতিতে আঘাত করতে চাইছে। সে প্রাণপনে সাপিনির লেজটাকে কামড়ে ধরে রইল। কিছুক্ষণ পর গর্তের মুখের ঘাসগোছার দুলুনি থেমে যায়। বাবুই পাখি বলল, রিক্কি বেজি শেষ হয়ে গেছে। রিক্কি মারা গেছে। কারণ মাটির নিচে সাপিনি তাকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই মেরে ফেলেছে।
এই বলে বাবুই পাখিটা করুণ সুরে গান গাইতে লাগল। এই চরম দুঃখের মুহূর্তের কথা ভেবেই সে গানটি তৈরি করেছে। দুঃখে যেন তার বুকটি একেবারে ফেটে যেতে চাইছে।
গানের শেষ পর্যায়ে গর্তের মুখের ঘাসের গোছা দুলে উঠল । গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিজয়ী রিক্কি। তার পুরো শরীরটাই তখন ধুলায় ঢেকে ধূসর হয়ে গেছে। তাকে দেখে ভীষণ চমকে গেল বাবুই পাখি।
রিক্কি তার শরীরের ধুলো ঝাড়তে লাগল। তারপর শান্তভাবে বলল, সব শেষ হয়ে গেছে। সাপিনিটা আর এই গর্ত থেকে কখনও বেরিয়ে আসবে না ।
একঝাঁক লাল পিঁপড়ে তখন পিলপিল করে গর্তের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
রিক্কি এখন বেশ ক্লান্ত। সবুজ ঘাসের মাঝে পড়ে আছে। এতক্ষণ প্রচণ্ড ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। সাপিনিটা তাকে পরাস্ত করার জন্য আপ্রাণভাবে চেষ্টা করেছিল। ক্ষিপ্রগতির বেজির কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে গেল সাপিনিটা। রিক্কি তার ধারাল দাঁত দিয়ে চিরে ফেলেছিল সাপিনিটার শরীর। তার ছিল প্রচণ্ড সাহস। সে পণ করেছিল শত্রুর শেষ দেখে ছাড়বে। তাই সে করেছে। সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙার পর রিক্কি বলল, আমি এবার ঘরে ফিরে যাব।
বাবুই পাখি বাগানের সবাইকে জানিয়ে দিল যে সাপিনিটা এখন মৃত। সকল পাখিদের জানিয়ে দাও এ কথা।
বিজয়ী রিক্কি ফিরে এল বাংলোবাড়িতে। টেডি আর তার বাবা মা বেরিয়ে এসে রিক্কিকে নিয়ে হইচই শুরু করে দিল। রিক্কি টেডির কাঁধে চড়ে বসেছে।
টেডির মা টেডির বাবাকে বলল, এই বেজিটা আমাদের জীবন আর টেডির জীবনটাকে রক্ষা করেছে। সে আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছে। অদ্ভুত সাহস তার।
রিক্কি জানাতে চাইল, সব গোখরো সাপ মরে গেছে। তাকে এখন বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে। সে বাগানটাকে পাহারা দিচ্ছে। বাগানটি এখন নিরাপদ। আতঙ্কের অবসান ঘটেছে। রঙিন প্রজাপতিরা উড়ছে। ঘাসফড়িঙ উড়ছে। শান্ত পরিবেশ। তার রয়েছে ধারাল দাঁত। আর কোনোদিন কোনো গোখরো সাপ দেয়ালের ভেতরে মাথা ঢোকাতে সাহস পায়নি।