১৬
বিষ্ণুপদর পেটটা একটু নেমেছে। সকাল থেকে বার চারেক দাস্ত, পেটটা ভার। একটা বিশেষ বয়সের পর শাস্ত্রে আছে মলভাণ্ডং ন চালয়েৎ। চালাতে হয়নি, ইদানীং খাওয়া-দাওয়াটা একটু বেহিসেবী মতো হওয়ায় সামাল দিতে পারা যায়নি। রামজীবন খাওয়াচ্ছে খুব। পরশু কোথা থেকে ক্ষীর নিয়ে এল এক ভাঁড়। থকথকে ক্ষীর, সরে ননীতে একেবারে মাখামাখি, ভাঁড়টা একবার তাকে শুঁকিয়ে নিয়েছিল রামজীবন। আহা, কী মিঠে গন্ধ! প্রাণ জুড়িয়ে জিব রসস্থ হয়ে পড়ল। ইদানীং নোলাটা যে বেড়েছে তা বিষ্ণুপদ নিজেই টের পায়। কাল যখন ডাকে, তখন এরকমই হয়। নোলা বাড়ে।
ক্ষীর দেখে নয়নতারা চেঁচামেচি শুরু করল, ওই বুড়ো মানুষটাকে এই বিষ গেলাবি নাকি রে বাবা? এ কি ওর পেটে সইবে!
রামজীবন উদার গলায় বলে, আহা, খাক না মা। সাধ মিটিয়ে খাক। ভালমন্দ অত হিসেব করার কি বয়স এটা? এখন প্রাণ খুলে সাধ মিটিয়ে যা খুশি খেয়ে হরি বলে চলে যাওয়া।
নয়নতারা রাগ করে বলল, আমি বাপু তোদের মতো করে বুঝি না। আমি বুঝি যতদিন রাখা যায় ধরে বেঁধে ততদিনই রাখলাম। ওই ঘন পাকের জিনিস হজম হবে না বাবা। তোরা বরং ভাগজোগ করে খেয়ে নে। আমি একটা ফোঁটা বুঝেসুঝে দেবোখন তোর বাপকে।
রামজীবন জিব কেটে বলে, তা কি হয়! বাবার নাম করে এনেছি, বাবাই খাবে। ওতে ভাগজোগ চলবে না।
বিষ্ণুপদ বারান্দায় বসে শুনছিল। শুনে মনে মনে খুব বাহবা দিল রামজীবনকে। এ তার বিদ্বান ছেলে নয়, দোষঘাটওলা মুখ্যু ছেলে, কিন্তু বাপ-মায়ে ভক্তি এর কাছ থেকে লোকে শিখতে পারে। আর নয়নতারার তারিফও না করে পারে না বিষ্ণুপদ। ওই একটা মানুষই তার ভালমন্দর কথা ভাবে।
নাড়ে পরশু রাত্তিরে একটু ক্ষীর পড়ল। রামজীবন একেবারে সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে দেখল, কম দেওয়া হচ্ছে কিনা। সাদা বাতাসা গুঁড়িয়ে দিল রাঙা, সঙ্গে পাকা একখানা মর্তমান কলা। নয়নতারা একটু আবডাল থেকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল, বুঝেসুঝে খেও গো। মরা পেট, ওসব খাওয়ার অব্যেস নেই তো। পেটে ঢুকে কী হুলুস্থূল বাঁধায় কে জানে বাবা!
রামজীবন একটু অসন্তোষের গলায় বলল, খাওয়ার সময় অমন টিকটিক কোরো না তো মা!
সাধে কি বলি বাবা, ভুগতে তো হবে আমাকেই।
ক্ষীরটা আজও যেন জিবে লেগে আছে। যেমন স্বাদ, তেমনই গন্ধ। দু’হাতার একটু বেশীই খেয়ে ফেলল বিষ্ণুপদ। ঢেঁকুরখানায় অবধি ক্ষীরের গন্ধ আসছিল।
ভুটভাট শুরু হল শেষ রাতে। কাল সারাদিন থম ধরে রইল পেট। খিদেই হল না। আজ সকাল থেকে নেমেছে। বর্ষা ঋতুটা এমনিতেই ভাল নয়। রোগ সহজে ছাড়তে চায় না। ছাতা মাথায় দিয়ে বার বার ঘটি নিয়ে দৌড়োতে হচ্ছে পুকুরধারে। এ তো আর কৃষ্ণজীবনের সাততলার ফ্ল্যাটবাড়ির পাকা ঝা চকচকে পায়খানা নয়! নিতান্তই চট দিয়ে ঘেরা কাঁচা ব্যাপার। ওপরে কোনও ছাউনিও নেই। তবে রামজীবনের পাকা ঘরখানা হলে তাতে সব বন্দোবস্ত থাকবে। লাগোয়া না হলেও, কাছেই বারান্দার শেষ দিকটায় স্যানিটারি হচ্ছে। বাবা-মায়ের জন্য জান-কবুল করে লেগেছে ছেলেটা।
চারবার হয়ে গেল। লক্ষণ ভাল বুঝছে না বিষ্ণুপদ। শরীরটা কাহিল লাগছে, সিঁটিয়ে যাচ্ছে যেন। জিবটা খসখসে, বিস্বাদ।
নয়নতারা এসে বলল, ক’বার হল।
চারবার।
আরও হবে?
বলি কি করে?
বুঝছো কেমন?
ভয় খাওয়ার মতো কিছু নয়।
থানকুনি আর গ্যাঁদাল রস করে রেখেছি। খাও। বমির ভাব নেই তো!
না।
নয়নতারা গেলাসে রসটা নিয়ে এল। বিষ্ণুপদ ঢক করে রসটা খেয়ে বলল, সব ভাল যার শেষ ভাল।
দাসীর কথা বাসি হলে তবে কানে যায়। পিচকিরি যে ছুটবে সে তো তখনই বুঝতে পেরেছিলাম।
বিষ্ণুপদ কাহিল হাসি হেসে বলল, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু লোভের ক্ষমতা কি কিছু কম? শয়তানের গায়ে মেলা জোর। তার সঙ্গে আমরা পেরে উঠব কেন? তবে যদি এখন কলেরা হয়ে মরি তবে দুঃখ থাকবে না। একখানা জম্পেশ জিনিস খাওয়াল বটে রামজীবন। তুমিও একটু চেখে দেখেছো তো!
সে খোঁজ আর নিলে কোথায়?
খোঁজ নিইনি বটে। দোষই হয়েছে। তবে মনে হয় তুমিও একটু জিবে ঠেকিয়েছো, তাই না?
কী পুরুষের সঙ্গেই জীবনটা কাটল! বলি, দুধ সর ক্ষীর কবে মুখে তুলতে দেখেছো আমায়? আমার হল সাদা-পাতা খাওয়া পচা মুখ, ওসব ভাল ভাল জিনিস কি সয় আমার?
তাও বটে। তুমি তো সত্যি দুধটুধ খাও না। তবে এটা একটু খেয়ে দেখলে পারতে। বড় খাঁটি জিনিস।
ধোঁয়াটে গন্ধ পাওনি?
না তো! ছিল নাকি?
আমি তো ভাঁড় শুঁকেই পেয়েছি। মোষের দুধের ক্ষীর।
মোষের দুধে কি ধোঁয়াটে গন্ধ হয়?
তাই তো জানি।
বিষ্ণুপদ একটু হাসল, আমাদের আর গরু মোষের তফাত করে লাভ কি?
মোষের দুধ তেজী জিনিস। গুরুপাক। পেট ডাকল নাকি? শব্দ পেলাম যেন!
ডাকছে।
তাহলে আবার হবে। টোটকাতে আর ভরসা পাচ্ছি না। ডাক্তার ডাকি।
ব্যস্ত হয়ো না। ধরেও যেতে পারে। আজকালকার অ্যালোপ্যাথি মানেই তো বিষ। বিষে বিষ ক্ষয়। আজকের দিনটা উপোস দিলেই হবে।
আজ খুব সকালে রামজীবন বেরিয়ে গেছে। শুনছি আজ নাও ফিরতে পারে। বামাচরণ তো সম্পর্ক রাখছে না। এখন বিপদ হলে কাকে ডাকি?
বিষ্ণুপদ হাসে, কাউকে ডাকতে হবে না। বিষ্টুপুরে এতকাল আছি। পাড়া-প্রতিবেশীরা কি আর আসবে না ডাকলে! কিন্তু অত কিছু করতে হবে না।
এ বয়সে পেট-ছাড়া কি ভাল? কথায় বলে, ছেলে হাগে বাড়তে, বুড়ো হাগে মরতে।
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তাই খারাপ কি? সময় হলে চলে যাওয়াই তো ভাল।
এ কি হাসিঠাট্টার কথা!
আহা, রাগ করো কেন? পানের বাটাখান নিয়ে এখানেই বোসো। পাহারা দাও। যমদূত এলে তাড়িয়ে দিও।
বিষ্ণুপদ আর একবার গেল। ঘুরে যখন এল তখন আর হাসিখুশি ভাবখানা নেই।
বুঝলে, একটু শোবো।
নয়নতারা উঠে পড়ল। বলল, আগেই ভেবে রেখেছি। বিছানা করাই আছে। শুয়ে পড়বে চলো। রক্তটক্ত যাচ্ছে না তো!
না। এখনও ততটা খারাপ নয়।
ঘরে অন্ধকার ঘনিয়ে আছে। বাইরে মেঘলা। বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালে খই-ভাজার শব্দ তুলে।
নয়নতারা দাওয়ায় বেরিয়ে পটলকে ডাকল। এইবেলা যা দাদা, পুলিনবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়। পেট খারাপের কথা বলিস, ওষুধ যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
পটল ছাতা আর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার সেই ঝাঁ-কুরকুর সাইকেল। এই নাতিটিকে বড় ভালবাসে নয়নতারা। বড় হলে কেমন হবে কে জানে! কিন্তু এখন অবধি ভারি বাধ্যের, এ বয়সেই বুদ্ধি বিবেচনা খুব হয়েছে, বোবা ভাইটাকে বুকে বুকে আগলে রাখে।
দুই বউ আজকাল আলাদা রাঁধছে। রান্নাঘরটা রাঙার দখলে। শ্যামলী নিজের ঘরে স্টোভ জ্বেলে বা তোলা উনুনে রেঁধে নিচ্ছে। সেই ঝগড়ার পর থেকেই এই ব্যবস্থা। ভিতরে ভিতরে ভাইয়ে ভাইয়ে জায়ে জায়ে ভাগ হয়েই ছিল। মনের মধ্যেকার ভাগটাই এখন বেরিয়ে পড়েছে। যতদিন যাচ্ছে তত ভাগাভাগিটা যেন বাড়ছে চারদিকে।
নয়নতারা ঘরে এসে দেখতে পায়, চোখ চেয়ে নিঝুম শুয়ে আছে বিষ্ণুপদ। যেন ভাবন-জগতে।
কী হচ্ছে পেটের মধ্যে!
বিষ্ণুপদ বলে, পেটের মধ্যে নয়, মনের মধ্যে। সেখানে অনেক কিছু হচ্ছে।
তোমার তো মন নিয়েই যত জ্বালা। কী যে সারাদিন ভাবো বসে বসে!
তোমার ভাবনাচিন্তা আসে না, না?
তা আসবে না কেন? মেয়েমানুষের মাথায় তেল-নুন, রোগ-ভোগ, সংসারে পাঁচটা ভালমন্দ এইসব ছাড়া আর কী আসবে বলো! এই যে রোগ বাঁধালে এখন এইটেই মাথা জুড়ে থাকবে।
এইমাত্র কী ভাবছিলাম জানো?
কী ভাবছিলে?
ভাবছিলাম কলকাতায় থাকলে এখন বেশ হত। না, কৃষ্ণজীবনের বাড়িতে নয়। সে বড় সাহেবী জায়গা। কলকাতার বড় রাস্তার একটি ধারে যদি বসে থাকতে পারতাম সারা দিনমান তাহলে বেশ হত।
রাস্তায় বসে থাকলে আবার ভালটা কী হবে?
এই গাঁয়ে গঞ্জে যেমন সব কিছু থেমে থাকে, নড়াচড়া নেই, কলকাতায় তেমনি আবার সবসময়ে সব কিছু কেবল চলছে। ধুন্ধুমার করে চলছে। কী শব্দ! কী হই-চই!
যাই বলো বাপু, ও আমার সয় না। ক’বার তো গেলুম। কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়, একবার চিড়িয়াখানা। আমার মনে হয়, বেড়াতে খারাপ নয়, কিন্তু সারাক্ষণ থাকলে মাথা ধরে যাবে।
আমারও কি আর ভাল লাগবে! আমরা হলুম মাটি-ঘেঁষা মানুষ। সে কথা বলছি না। কিন্তু মাঝে মাঝে ইচ্ছে যায়, ওরকম ধুন্ধুমার কাণ্ডখানা কিছুক্ষণ বসে দেখি। চারদিকটা যেন বড় জীয়ন্ত মনে হয় কলকাতায়। আর এই বিষ্টুপুরের বাড়ির দাওয়ায় বসে থেকে থেকে কী মনে হয় জানো? এত নিস্তেজ, এত মরা চারধার যে, হঠাৎ চমকে উঠে ভাবি, ওরে বাবা, আমি মরে যাইনি তো!
পেট ভাঙল বুঝি! শব্দ পেলাম যেন!
অত ভাবছো কেন? বদহজম হলে ওরকম একটু হয়। কলেরা-টলেরা নয়। ভয় নেই। বরং পানের বাটাখানা নিয়ে এইখানে বোসো। একখানা পান সেজে খাও। দেখি।
পান খাওয়ার আর দেখার কী আছে?
আছে। সবকিছুর মধ্যেই দেখার জিনিস আছে। তুমি যখন পান সাজো তখন ভারি আদর করে, যত্ন করে সাজো। দেখতে বেশ লাগে। ইস্কুলে যখন পড়াতুম তখন একখানা বাংলা গল্প পড়াতে হত। তাতে ছিল, জাপানীরা যখন চা তৈরি করে তখন এত যত্ন নিয়ে করে, এত সুন্দর ভঙ্গিতে যে, সেটাও নাকি চেয়ে দেখার মতো ব্যাপার। তোমার পান সাজার মধ্যেও খানিকটা ওরকম কিছু আছে।
কী যে মাথামুণ্ডু বলো তার ঠিক নেই! সাদা পাতা দিয়ে একটু চুন জেবড়ে মুখে ফেলে দিই। দেখার যে কী আছে বুঝি না!
নয়নতারা পানের বাটা আনতে গেল। কিন্তু সহজে এল না। সংসারী মানুষ, একটা কাজ করতে গেলে সেটার সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে পড়ে।
দুর্বল শরীরে একটু ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল বিষ্ণুপদর। পেটে হাঁড়িকলসি ভাঙছে, জিব তেতো। শরীরটা জুত-এর নেই মোটেই। চোখ জুড়িয়ে যখন এল তখনই হঠাৎ মনে হল, ঘুমও কি ছোট করে মরণ? ঘুমোলে তো শরীরের বোধ মুছে যায়, সমাজ সংসার, আত্মীয়স্বজন সব মুছে যায়। মরণও তাই। তবে কি নিত্যি দিন ঘুমের মধ্যে আমরা একটু একটু করে মরি! মরণের পর কি সব ফক্কিকারি! মাথায় আজকাল কত কথাই আসে। উদ্ভুটে সব কথা। বিষ্ণুপদ বৈতরণীর কথা ভাবে, যমরাজার কথা ভাবে, স্বর্গ বা নরকের কথাও ভাবে। ওসব কি আছে বটে? বিষ্ণুপদর তেমন বিশ্বাস হতে চায় না। তবে আছেটা কি? মানুষ জন্মায়, বাঁচে, তারপর মরে হারিয়ে যায়? তাহলে তো এর কোনও মানেই হচ্ছে না। বিষ্ণুপদর শাস্ত্রটাস্ত্র পড়া নেই, তবে আজকাল মনে হয়, এই জীবনটার একখানা মানে-বই থাকলে বড় ভাল হত। সহজ করে সব বোঝানো থাকত তাতে।
জানালাব সরু সরু শিকের ওপাশের বর্ষার জল পেয়ে সতেজ পেয়ারা গাছটার ডালপালা আর পাতা উঁকি দিতে থাকে। গাছ যেন হাসছে। খুব হাসছে। গাছখানার স্বর্গ-নরক নেই, কর্মফল নেই। এক ঠাঁই দিব্যি একটা গোটা জীবন কাটিয়ে যায়।
চটকাটা ভাঙল পুলিন ডাক্তারের ডাকে।
আবার কী বাধালে হে?
এসো ভায়া, বোসো। তোমাকে আবার এই বাদলায় ছেঁচড়ে আনল কেন?
বাদলা বলে কি আর হাত পা গুটিয়ে বসে আছি নাকি ঘরে? চাষবাস দেখতে হচ্ছে। তা খুব নাকি ক্ষীর খেয়েছো?
খুব রটেছে দেখছি। বলে উঠে বসে বিষ্ণুপদ। মাথাটা একখানা চক্কর মারল।
তা রটেছে। তোমার নাতি গিয়ে বলল, ক্ষীর খেয়ে পেট ছেড়েছে। জরুরি তলব।
বিষ্ণুপদ হেসে বলে, ছেলে শেষ খাওয়া খাওয়াচ্ছে হে। ত’ আমারই বা আপত্তিটা কিসের? দিলুম ঠেসে। মরণ-বাঁচন ভগবানের হাত।
সবটাই ভগবানের ওপর ছেড়ে দিও না! মরণ-বাঁচনে তোমার আমারও একটু হাত আছে। ক’বার হয়েছে?
বার পাঁচেক হবে বোধহয়। বমিটমি নেই।
খিদে আছে?
শোনো পাগল ডাক্তারের কথা! খিদে থাকবে না কেন? এ কি বড়লোকের পেট? গরিবের পেটে সবসময়ে খিদে।
হরি বলো মন! তুমিই যদি গরিব তবে আমরা যাই কোথা! অত বড় বিলেত-ফেরত তালেবর ছেলে থাকতে তুমি গরিব কপচাচ্ছো? এও কি ধর্মে সয়?
বিষ্ণুপদ এক গাল হাসল। পুত্রগর্ব বলে একটা ব্যাপারও তো আছে! বলল, ছেলে তালেবর সে তার নিজের গুণে। আমার কোন গুণটা আছে বলো!
পুলিন প্রায় ঘরের লোক। সব খবরই জানে। তাছাড়া বিষ্টুপুরে সবাই সবাকার সব জানে। তালেবর ছেলে যে বাপ-মায়ের থেকে তফাত হয়েছে, তা কি আর গুহ্য কথা কোনও। পুলিন তার পেট টিপে দেখতে দেখতে বলল, টাকাপয়সা না হয় না-ই দিল, চোখের দেখা না হয় নাই দেখল, তবু তো ছেলে বটে হে! গত বিশ বছরে এ গাঁয়ে ওরকম ছেলে আর একটাও বেরিয়েছে? টাকাপয়সায় নও হে বাপু, তুমি অন্য দিকে বড়লোক।
একথাটা বিষ্ণুপদর খুব পছন্দ হল। মাথা নেড়ে বলল, সে খুব ঠিক কথা।
পুলিন পেটে আঙুলের খোঁচা দিচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা অভ্যাসবশে। আসলে ডাক্তারি পরীক্ষা করছে না কিছুই। তাকে আজ কিছু কথায় পেয়েছে। বলতে লাগল, আমার দশাই কি কিছু ভাল? আগে তবু রুগী-পত্তর আসত, আজকাল ভোঁ ভাঁ। বটতলায় এক হাতুড়ে চেম্বার খুলেছে, হপ্তায় দুদিন বসছে এসে। শুধু এম বি বি এস ডিগ্রিটা ছিল বলে সেখানে পাকা কাঁঠালে মাছির মতো ভিড়, নাড়ীজ্ঞান নেই, মোট তেরোখানা ওষুধের নাম জানে, লক্ষণ দেখে রোগ চিনতে পারে না, কিন্তু গাঁয়ের পয়সা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। দু-দুটো ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবো বলে ঠিক করে রেখেছিলুম, তা দুটো ষাঁড় ইস্কুল ডিঙোতেই হিমসিম খেয়ে গেল। কপাল! বুঝলে? কপাল! নাও, শুয়ে পড়ো দেখি।
বিষ্ণুপদ শুয়ে পড়ল।
পুলিন পেটে টোকা মেরে দেখল, বুকে পিঠে স্টেথোসকোপ দিল, নাড়ীও পরীক্ষা করল।
বিষ্ণুপদর খিদে পেয়ে রয়েছে। বলল, ওষুধের কথা থাক, পথ্যিটা কী হবে বলে তো! একটু ঝোলভাত খাবো নাকি?
তা খেতে পারো। পাঁচবার তো। ও কিছু নয়। বেশী করে জলটা খেও। ফুটিয়ে খেলেই ভাল। বর্ষাটা পেটের পক্ষে একেবারে যম। ওষুধটাও খেও। কয়েকটা ট্যাবলট দিয়ে যাচ্ছি।
নয়নতারার এতক্ষণে সময় হল আসবার। ঘরে ঢুকেই বলল, কেমন দেখলেন মানুষটাকে?
কিছু নয় তেমন। ক্ষীরের দেনা শোধ হচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালই, কোষ্ঠটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
বড্ড নোলা হয়েছে ইদানীং। বারণ করলুম, তবু জোর করে ক্ষীর খেল।
আর বিশেষ খেও না হে বিষ্ণুপদ। কথা কি জানো! বুড়োরা যখন একে একে কেটে পড়তে থাকে তখন বেঁচে-থাকা বুড়োদের বড্ড একা লাগে। ভয়-ভয়ও করে। বুঝলে কথাটা?
বুঝেছি।
তুমি যদি এখন টিকিট কাটো, তাহলে আমার দশাটা কেমন হবে জানো? মনে হবে, এই রে, এবার আমার পালা বুঝি!
বিষ্ণুপদ খুব হাসল। বলল, এমনিতে যাবে না। পোক্ত শরীর। তবে কিনা ডাক এলে তো যেতেই হবে।
সেই কালঘড়ি না কোন গুষ্টির পিণ্ডি দেখেছিলেন, সেই থেকেই মাথা বিগড়েছে!
রামজীবন ফিরল সন্ধেবেলা। বাপের খবর শুনেই চলে এল বিষ্ণুপদর কাছে, বাবা! শেষে কি পিতৃঘাতক হলাম?
মুখ থেকে ভকভক করে কাঁচা মদের গন্ধ আসছে। বড্ড খারাপ গন্ধ। গা গুলোয়। বিষ্ণুপদ বলল, ওরে না! সে ব্যাপার নয়।
রামজীবন দুখানা পা সাপটে ধরল বিষ্ণুপদর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি কুলাঙ্গার! নেমকহারাম! একটু কষ্ট করে উঠে আমাকে জুতোপেটা করুন বাবা। দু গালে থাবড়া দিন।
মাতালের মনস্তাপও বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস! সহজে শেষ হতে চায় না। বিষ্ণুপদ দুখানা পা ছাড়ানোর একটা ক্ষীণ চেষ্টা করতে করতে বলল, আমার তেমন কিছু হয়নি। সকালে দুপুরে মিলিয়ে বার ছ-সাত হয়েছে। তাতে ভালই হয়েছে বাবা। পেটের গাদ নেমে গেছে। এ বেলা শরীর বেশ ঝরঝরে।
কিন্তু এত কথার পরও রামজীবনের কান্না থামে না, আমার মত পাপী কি আর আছে? শালার এই ভাঙা ঘরে আপনাকে ফেলে রেখেছি! পাকা ঘর তুলে তাতে রাখব বলে কতকাল ধরে চেষ্টা করছি। আপনি মরে গেলে পাকা ঘর দিয়ে আমার কী হবে!
মরার এখনই কি! পুলিন ডাক্তারও দেখে গেছে, বলেছে কিছুই হয়নি। অত ভাবছিস কেন?
কিন্তু রাঙা যে বলল, ক্ষীর খেয়েই নাকি আপনার ভেদবমি শুরু হয়েছে।
ওরে না। ক্ষীর বলে কথা নয়। বর্ষাকালটা এরকমই হয়। নতুন জল তো!
আজ যে আমি জ্যান্ত শোল মাছ এনেছি। সেটা খাবে কে?
শোল মাছের কথায় বিষ্ণুপদ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তার অতি প্রিয় মাছ। তেজী গলায় বলল, এনেছিস? খুব ভাল করেছিস। আজ তো পেটটা ধরেই গেছে। সাঁতলে রাখুক, কাল খাবোখন।
নয়নতারা ঘরে ছিল না। কিন্তু শুনেছে ঠিক। বাইরে থেকেই উঁচু গলায় বলল, শোল মাছ খাবে! মাথাটা কি একেবারেই গেছে নাকি? তোমার ওই পেটে শোল মাছ সাক্ষাৎ বিষ।
রামজীবন হাহাকার করে উঠল, ও কথা বোলো না মা। শোল মাছ আমি বাবার নাম করে কিনে এনেছি।
তার চেয়ে বাপকে একটু সেঁকো বিষ এনে দে। ল্যাঠা চুকে যায়।
বিষ্ণুপদ গলাটা নামিয়ে রামজীবনকে বলল, অত সোরগোলের দরকার নেই। বউমাকে বলিস, তেলঝাল দিয়ে রেঁধে রাখতে। এক ফাঁকে কাল ঠিক খেয়ে নেবো। মুলো দিয়ে শোল অমৃত। তা এ তো মুলোর সময় নয়।
মুলো দিয়ে খাবেন বাবা! আজকাল সব সময়ে সব কিছু পাওয়া যায়। কাল ভোরে গিয়ে জাগুলিয়া থেকে নিয়ে আসব।
আধ ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট—কতক্ষণ কে জানে—বিষ্ণুপদর আজকাল আর সময়ের হিসেব থাকে না—রামজীবন পা দুখানা বুকে চেপে ধরে রইল। তারপর নয়নতারা আর পটল মিলে প্রায় জোর করে তুলে নিয়ে গেল রামজীবনকে। তারপরও বিষ্ণুপদ শুনতে পেল, নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে রামজীবন মেলা কান্নাকাটি করছে। নানা দুঃখ উথলে উঠছে এখন তার। হঠাৎ বৃষ্টি নেমে সব শব্দ ডুবিয়ে লি।
সারা রাত ধরে তুমুল বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল বিষ্ণুপদ। আজকাল মাঝে মাঝে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে, মাঝে মাঝে বায়ু চড়া হয়ে সময়েও ঘুম আসতে চায় না। আজ রাতে বায়ু চড়েছে।
খুব ভোরে, ভাল করে আলো ফোটবার আগেই বিষ্ণুপদ দাওয়ায় এসে বসল। একটু ধরেছে বৃষ্টিটা। তবে আকাশ মুখিয়ে রয়েছে এখনও। উঠোনে হাঁটুজল দাঁড়িয়ে গেছে। ঘরে জল, দাওয়ায় জল। এত জল বহুকাল হয়নি। আগে এই জলে গাঁ ভেসে যেত। আজকাল একটা নিকাশী খালের দরুন ততটা হচ্ছে না। কিন্তু তেমন ভারী জল হলে বিপদ।
রামজীবনের পাকা ঘরের অবস্থাও বড় করুণ। ইরফান সাতদিন ধরে কাজ বন্ধ রেখেছে। এই বাদলায় গাঁথনি থাকছে না, মশলা ধুয়ে যাচ্ছে। ঘরে কয়েক বস্তা সিমেন্ট পড়ে আছে। ভিজে ভিজে জমে না পাথর হয়ে যায়!
রোজকার মত আজও আধখ্যাঁচড়া ভূতুড়ে বাড়িটা বিষ্ণুপদকে মুখ ভ্যাঙচায় যেন, কী বুড়ো, থাকবি পাকা ঘরে? আয় থাকাচ্ছি! কালঘড়ি তো আয়ু খেয়ে ফেলল তোর। এরপর যখন ফুরুত হয়ে যাবি তখন ঘর কোথা পাবি বুড়ো? খুব ক্ষীর সাঁটাচ্ছিস, শোল গিলছিস, শরীরে আহূতি দিচ্ছিস, ক’দিন পর তো শরীরখানা পুড়িয়ে ছাই করে সেই ছাই জলে ভাসিয়ে দেবে? কে খাবে বাবা শোলমুলো, কে থাকবে বাবা পাকা ঘরে?
ঘরখানার সঙ্গে বিষ্ণুপদর একটা আড়াআড়ি আছে। তাকে সইতে পারে না ঘরটা। সেই জন্যই কি কাজ আটকে থাকে? এ বড় অলক্ষুণে ব্যাপার হল।
বর্ষাটা ছাড়লে বাড়ি ভাগ হবে। আমিন আসবে। মাপজোখ হবে। ছেলেমেয়েরা আসবে। গাঁয়ের মাতব্বররা সব সাক্ষী হবে। ছেলে কৃষ্ণজীবন আর দুই মেয়েকে চিঠি দিয়েছে বিষ্ণুপদ। কঠিন হল শিবচরণ। আজ বছর সাত-আট হল সে বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে! তার কথা আজকাল আর মনেই পড়ে না বিশেষ। বরাবর কিছু ডাকাবুকো ছিল, লেখাপড়ায় মাথা ছিল না। কিন্তু বড় হওয়ার শখ ছিল খুব। গাঁয়ে থেকে কিছু হচ্ছে না, প্রায়ই বলত। তারপর একদিন নিজের জিনিসপত্র নিয়ে, বাড়ির কিছু পুরনো কাঁসার বাসন, নয়নতারার দুটি সোনার দুল, ঘটে জমানো পয়সা, রাঙার বিয়েতে পাওয়া রূপোর চুটকি, রামজীবনের ঘড়ি এইসব জিনিস চুরি করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল। খোঁজখবর করা হয়েছে, লাভ হয়নি।
এলেম থাকলে পালিয়ে গিয়ে কেউ কেউ ভাগ্য ফিরিয়ে আসতে পারে। শিবচরণ পারবে কিনা কে জানে! কিন্তু যদি হেরো হয়ে একদিন ফিরে আসে তবে এ বাড়িতে তিষ্ঠোনো মুশকিল হবে।
শিবচরণ সম্পর্কে আর একটা ভাবনাও আছে। মরে-টরে যায়নি তো! যদি গিয়ে থাকে তবে খবরটা জীবৎকালে পেতে চায় না বিষ্ণুপদ। নিরুদ্দেশ থাকাই ভাল। খারাপ খবর-টবর না এলে ধরে নেওয়া যাবে, ভালই আছে। হয়তো করে-কর্মে খাচ্ছে। কে জানে, হয়তো বিয়েও করেছে, ছেলেপুলে হয়েছে!
নয়নতারা আগে খুব কাঁদত শিবচরণের জন্য। আজকাল বোধহয় ভাটা পড়েছে একটু।
আজ বেহানবেলায় হারানো ছেলের কথা মনে হতে বিষ্ণুপদ ভাবল, এ বাড়িতে তো শিবচরণেরও ভাগ আছে। কথাটা মনে রাখতে হবে।