অষ্টাদশ অধ্যায় – বিশ্ববিদ্যালয়
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা চরিত্র-গঠনমূলক ও বুদ্ধিমূলক যে শিক্ষার আলোচনা করিয়াছি তাহা সমাজের সকল ছেলেমেয়ের জন্যই উন্মুক্ত থাকিবে; কোনো গুরুতর বিশেষ কারণ না থাকিলেই সে শিক্ষা দিতে হইবে। শিশুর প্রতিভা যদি বিদ্যালয়ের পড়ার দরুন ব্যাহত হয় এবং অন্য ব্যবস্থা করিলে বিকাশ লাভ করে, তবে তাহার জন্য পৃথক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা উচিত। (মোজার্টকে যদি জোর করিয়া বিদ্যালয়ে পাঠ্যবিষয়গুলি পড়িতে বাধ্য করা হইত তবে ইহা বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয় হইত; তাহার সঙ্গীত-প্রতিভা হয়তো সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হইতে পারিত না।) কিন্তু আদর্শ সমাজেও এমন অনেক লোক থাকে যাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করিবে না। এই বিষয়ে আমার কোনই সন্দেহ নাই যে, পুঁথিগত শিক্ষাকাল একুশ অথবা বাইশ বৎসর বয়স পর্যন্তবর্ধিত করিলে কেবলমাত্র অল্পসংখ্যক লোকই ইহাতে উপকৃত হইবে। যে সব অলস ধনীর দুলাল এখন পুরাতন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তাহারা কতকগুলি কায়দা-কানুন এবং বেহিসেবিরূপে খরচ করার অভ্যাস ছাড়া আর বিশেষ কিছুই শিক্ষালাভ করে না। সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিরূপ ছাত্র নির্বাচন করা উচিত তাহা বিশেষভাবে বিবেচ্য। বর্তমানে দেখা যায়, যাহার টাকা আছে সেই সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য পাঠায়। পরীক্ষার ফলাফল দেখিয়া স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় অবশ্য কতক ভাল ছাত্রও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র নির্বাচন আর্থিক যোগ্যতা দ্বারা হইয়া ছাত্রের মেধা ও বুদ্ধির যোগ্যতা দ্বারাই হওয়া উচিত। আঠারো বৎসরের বালক ও বালিকা যদি বিদ্যালয়ের মোটামুটি ভালো শিক্ষা পাইয়া থাকে তবে সমাজে অনেক কিছু উপকারী কাজ করিতে পারে। তাহাকে আরও তিন-চারি বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে বৃথা নিযুক্ত না রাখিলে এই সময় সে সমাজসেবার কাজে লাগাইতে পারে। কিরূপ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো উচিত তাহা নির্ধারণ করিবার পূর্বে আমাদের সমাজ-জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য কি তাহা জানা আবশ্যক।
ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি পর্যায়ের ভিতর দিয়া পার হইয়া আসিয়াছে, যদিও তৃতীয় পর্যায় এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়কে সম্পূর্ণরূপে স্থানচ্যুত করিতে পারে নাই। প্রথম অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ধর্মযাজকদের শিক্ষার কলেজ ছিল; মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষা কেবল ইহাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রেনেসাঁসের যুগে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীতে নূতন ভাবপ্রবণের যুগে প্রত্যেক অবস্থাপন্ন পুরুষের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এই ভাব ক্রমে প্রসার লাভকরে; পুরুষদের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের শিক্ষা কম হওয়াই উচিত তখন এই ধারণা প্রচলিত ছিল। সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও ঊনবিশ শতাব্দী ধরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভদ্রলোকের শিক্ষা চলিতে থাকে; অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এখনও তাহাই চলিতেছে। এই আদর্শ এক যুগে প্রয়োজনে মনে হইয়াছিল কিন্তু এখন ইহা বাতিল হইয়া গিয়াছে। কি কি কারণে এরূপ ঘটিয়াছে প্রথম অধ্যায়ে তাহার আলোচনা করা হইয়াছে। এই দ্রলোকের শিক্ষা আভিজাত্যের উপর নির্ভর করিত কিন্তু গণতন্ত্র অথবা শিল্পপ্রধান ধনতন্ত্রবাদের যুগে ইহা টিকিয়া থাকিতে পারে না। আভিজাত্য যদি থাকেই তবে বরং শিক্ষিত লোকের দ্বারা গঠিত হইয়াই থাকুক; তবে আভিজাত্য না থাকাই সর্বাপেক্ষা ভাল। এই সম্বন্ধে এখন আর আলোচনা করিয়া লাভ নাই। ইংল্যান্ডে সংস্কার আইন [Reform Bil] ও শস্য আইন [Corn Law] পাশ করার ফলে এবং আমেরিকায় স্বাধীনতার যুদ্ধ [War of Independence] দ্বারা এই সমস্যার সমাধান হইয়াছে। সত্য বটে এখনও ইল্যান্ডে আভিজাত্যের কাঠামো রহিয়াছে কিন্তু ইহার অন্তর্নিহিত মূল ভাব হইল ধনতন্ত্রবাদসঞ্জাত, যাহার সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো মিল নাই। ধনী ব্যবসায়ীরা তাহাদের পুত্রদিগকে ভদ্রলোক করিবার বাসনায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান; ধনীর দুলালরা তথায় ব্যবসায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব অর্জন করে; অর্থের অভাবে তাহাদের অবস্থা যখন খারাপের দিকে যায়, তখন আবার তাহারা অর্থোপার্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিতে থাকে। কাজেই দেখা যায়, সমাজ-জীবনের পক্ষে ভদ্রলোকের শিক্ষার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পরিকল্পনা করিবার সময় এইরূপ অকেজো শিক্ষা উপেক্ষা করা চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ক্রমে মধ্যযুগে যেমন ছিল তেমনই বিভিন্ন বৃত্তির ট্রেনিং স্কুলে পরিণত হইতেছে। ব্যারিস্টার, ধর্মযাজক এবং উপরের স্তরের সিভিল সার্ভিস কর্মচারিগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য ব্যবসায়ে টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মিগণের অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিতেছে। জগৎ যত জটিল এবং শিল্প যতই বিজ্ঞানের প্রভাবাধীন হইতেছে ততই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য দক্ষ লোকের প্রয়োজন হইতেছে। জটিল বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন লোক এখন বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই বাহির হইতেছে। প্রাচীনপন্থীরা দুঃখ করেন যে, বিশুদ্ধ জ্ঞানের মন্দির বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বড় টেকনিক্যাল স্কুলে পরিণত হইতে চলিয়াছে। কিন্তু ইহা প্রতিরোধ করার উপায় নাই কারণ ধনতন্ত্রবাদীরা ইহাই চায়। তাহাদের নিকট বিশুদ্ধ জ্ঞান বা কৃষ্টির কোনো মোহ নাই। শিল্পের জন্যই শিল্প-সাধনার মতো অকেজো শিক্ষা ও আভিজাত্যের আদর্শ, ধনতন্ত্রের কাম্য নয়। যথায় এখনও ইহার রেশ রহিয়াছে তথায় বুঝিতে হইবে। রেনেসাঁস যুগের ঐতিহ্য এখনও শেষ হইয়া যায় নাই। এই আদর্শের বিলোপ আমার নিকট শোচনীয় মনে হয়। বিশুদ্ধ জ্ঞান আভিজাত্যের অলংঙ্কারস্বরূপ ছিল কিন্তু আভিজাত্যের অন্যান্য দোষ এত বেশি ছিল যে তাহার তুলনায় গুণ হইয়াছিল অত্যন্ত হালকা। আমরা পছন্দ করি আর নাই করি শিল্পতন্ত্রের হাতে আভিজাত্যের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কাজেই আভিজাত্যের কোনও প্রশংসনীয় গুণ যদি রক্ষা করিতে চাহি তাহা হইলে শক্তিশালী কোনও নূতন ভাবধারার সঙ্গে তাহার সংযোগ সাধন করিতে হইবে। আভিজাত্যের ক্রমবিলীয়মান ঐতিহ্য আঁকড়াইয়া ধরিতে থাকিলে নূতন যুগের ধনতন্ত্রবাদের আক্রমণের হাত হইতে ইহাকে রক্ষা করা যাইবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ শিক্ষার দ্বারা যদি জিয়াইয়া রাখিতে হয় তবে অল্প কয়েকজন ভদ্রলোকের অবসর বিনোদনের আনন্দদায়ক উপাদান হিসাবে না রাখিয়া ইহাকে সাধারণ মানুষের সমাজ-জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করিতে হইবে। উদ্দেশ্য-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা আমাদের নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে হয়। শিক্ষার্থীর জীবনে ইহা হ্রাস না পাইয়া দিন দিন বেশি হউক ইহাই আমি দেখিতে চাই। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় এইরূপ শিক্ষা যে ক্রমশ বিলোপের দিকে যাইতেছে তাহার প্রধান কারণ অজ্ঞ ক্রোড়পতিদের নিকট হইতে শিক্ষার উন্নতির জন্য মোটা টাকা সাহায্য গ্রহণের অভিলাষ। এই ধনতান্ত্রিক শিল্পপতিগণ কৃষ্টিমূলক শিক্ষার প্রতি আগ্রহশীল নন; অর্থকরী এবং শিল্পের উন্নতিবিধায়ক শিক্ষার প্রতিই যে তাহাদের ঝোঁক থাকিবে তাহা স্বাভাবিক। এইরূপ অবস্থায় প্রতিকার সম্ভবপর। তবে এইজন্য শিক্ষিত গণতন্ত্র গড়িয়া তুলিতে হইবে, তখন শিল্পপতিগণ যে বিদ্যার কদর বুঝিতে পারে না, জনগণই তাহার জন্য অর্থব্যয় করিতে আগ্রহশীল হইবে। ইহা একেবারে অসম্ভব নয়, কিন্তু ইহা সাধন করিতে হইলে আগে সর্বসাধারণের শিক্ষার মান উন্নত হওয়া আবশ্যক। পূর্বে শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিগণ (জীবিকার জন্য) ধনবান পৃষ্ঠপোষকের সাহায্যের উপর নির্ভর করিতেন। আধুনিক যুগের বিদ্বজ্জন যদি সর্বদা অর্থশালী লোকদের কৃপাপ্রার্থী না হন তবে ভাল হয়। শিক্ষা এবং শিক্ষিত লোক এক বিষয় নয়, তবু শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তিকে একত্রে তালগোল পাকাইয়া ফেলা অসম্ভব নয়। একটি কাল্পনিক উদাহরণ মনে করা যাক একজন শিক্ষিত ব্যক্তি জৈব রসায়নবিদ্যা শিক্ষাদানের পরিবর্তে মদ তৈয়ার করা শিখাইয়া অর্থোপার্জন করিতে পারেন। তিনি অর্থ লাভ করিবেন কিন্তু শিক্ষার অবনতি ঘটিবে। শিক্ষিত ব্যক্তির যদি জ্ঞানের প্রতি প্রকৃত অনুরাগ থাকিত তবে মদ তৈয়ারি শিক্ষার জন্য যদি কেহ অর্থ দান করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করিতেন তিন তাহাতে যোগাদন করিতেন না। তিনি যদি গণতন্ত্রের পক্ষে থাকিতেন তবে গণতন্ত্রই তাহার বিদ্যার যথাযোগ্য সমাদর করিত। এইসব কারণে আমার মনে হয় শিক্ষাবিদগণ যদি ধনী লোকের নিকট অর্থের প্রত্যাশা না করিয়া জনসাধারণের অর্থের উপরই নির্ভরশীল হন তবেই প্রকৃত কল্যাণ হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ধনশালী ব্যক্তিদের নিকট হইতে আর্থিক সাহায্য গ্রহণের কুরীতি ইংল্যান্ড অপেক্ষা আমেরিকাতেই বেশি; তবে ইংল্যান্ডেও ইহা আছে এবং ক্রমশ বেশি হইতে পারে।
এইসব রাজনীতির প্রভাব ও কার্যপরম্পরার কথা বাদ দিয়া আমি ধরিয়া লইব যে, বিশ্ববিদ্যালয় দুইটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রহিয়াছে; প্রথম, কতকগুলি বৃত্তি বা পেশার জন্য পুরুষ ও নারীদিগকে শিক্ষা দিয়া প্রস্তুত করা; দ্বিতীয়, আশু কোনো কিছু লাভের সম্ভাবনা সম্মুখে না রাখিও উচ্চস্তরের জ্ঞান অর্জনের ও গবেষণার সুযোগ দান। কাজেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ছাত্রদিগকে দেখিতে চাহি যাহারা এইরূপ বৃত্তি বা পেশার জন্য উচ্চশিক্ষা চাহে এবং যাহাদের এমন বিশেষ যোগ্যতা আছে যাহা দ্বারা তাহারা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করিয়া সমাজকে মূল্যবান কিছু দান করিতে পারে। বিভিন্ন বৃত্তিশিক্ষার জন্য কিরূপ ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করা উচিত তাহা এই নীতির দ্বারা নির্ণয় করা গেল না।
বর্তমানে ধনীলোকের সন্তান না হইলে আইন বা চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করা ছাত্রদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন, কেননা এই শিক্ষা ব্যয়বহুল। তাহা ছাড়া শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পরই অর্থোপার্জন শুরু হয় না। কাজেই দেখা যায় এই ব্যক্তিগুলির জন্য নির্বাচন হয় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকের সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি দ্বারা, ছাত্রদের কাজের যোগ্যতা ও গুণপনার দ্বারা নয়। উদাহরণ স্বরূপ চিকিৎসাবিদ্যার শিখাইয়া সমাজসেবার কাজে নিয়োগ করিতে হয় তবে যাহাদের এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি আগ্রহ, আন্তরিকতা ও প্রবণতা আছে এমন ব্যক্তিদিগকে নির্বাচন করা উচিত। বর্তমানে যাহারা খরচ বহন করিতে সমর্থ কেবল এমন প্রার্থীদের মধ্য হইতেই লোক বাছাই করিতে হয় কিন্তু এমনও হইতে পারে যে, যাহারা চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বাপেক্ষা পারদর্শিতা দেখাইতে পারিত এমন লোক অর্থাভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করার সুযোগই পাইল না। ইহার ফলে প্রতিভার অপচয় ঘটে। অন্য রকম একটি উদাহরণ লওয়া যাক। ইংল্যান্ড অত্যন্ত জনবহুল দেশ; ইহার বেশিরভাগ খাদ্যই বিদেশ হইতে আমদানি করিতে হয়। কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করিতে বিশেষত যুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করিলে বোঝা যায়। এই দেশে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত আবশ্যক। এখানকার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম; তথাপি এইগুলি যথাসম্ভব উন্নত প্রণালীতে সুযোগ্যভাবে চাষ করার ব্যবস্থা হয় নাই। বংশানুক্রমিকভাবেই কৃষকগণ এই পেশা গ্রহণ করে; সাধারণত তাহারা কৃষকদেরই পুত্র। আর কতক কৃষিক্ষেত্র কিনিয়াছে; ইহার জন্য তাহারা টাকা খরচ করিয়াছে তাই বলিয়া কৃষিকার্যের যোগ্য নিপুণতা অর্জন করিয়াছে এমন কথা নাই। ডেনমার্কের কৃষকদের চাষের প্রণালী ইংল্যান্ডের চাষিদের তুলনায় বেশি ফলপ্রদ। কিন্তু ইংল্যান্ডের কৃষকদের তাহা শিকাইবার কোনো ব্যবস্থাই অবলম্বন করা হয় না। একজন মোটরচালককে যেমন লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র লইতে হয় তেমনই যে কৃষকই কিছু বেশি পরিমাণ জমি চাষ করিবে তাহাকেই বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চাষ সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করিতে বাধ্য করা উচিত। সরকারি কাজকর্মে বংশানুক্রমিক নিয়োগপ্রথা পরিত্যক্ত হইয়াছে কিন্তু জীবনের কোনও ক্ষেত্রে এখনও ইহা চলিতেছে। যথায় ইহা আছে তথায় অযোগ্যতা প্রবেশ করিয়াছে। দুইটি সংশোধন নিয়ম দ্বারা এই অযোগ্যতা দূর করা উচিত; প্রথমত, উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত কাহাকেও কোনো প্রয়োজনীয় কাজে নিযুক্ত হইতে দেওয়া উচিত নয়; দ্বিতীয়ত, যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের অভিবাবক অর্থশালী হউক বা না হউক অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার ব্যয় বহনে তাহাদের সামর্থ্য থাকুক আর নাই থাকুক তাহা বিবেচনা না করিয়া তাহাদের শক্তি ও প্রতিভা বিকাশের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। এই দুইটি নিয়ম পালন করিলে লোকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাইবে।
যাহাদের বিশেষ কোনো শক্তি বা গুণ আছে তাহা পরিপূর্ণমাত্রায় বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত। যাহাদের যোগ্যতা আছে কিন্তু শিক্ষার ব্যয়নির্বাহের যোগ্য অর্থ নাই, রাষ্ট্রকর্তৃক তাহাদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা উচিত। যোগ্যতার প্রমাণ দিতে না পারিলে কাহাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করা সমীচীন নয় এবং ভর্তি হওয়ার পরও কেহ যদি প্রমাণ দিতে না পারে যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করিতেছে তবে তাহাকেও থাকিতে দেওয়া উচিত নয়। পূর্বে ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ধনীর দুলালদের আরাম-নিকেতন, তাহারা তথায় তিন-চারি বৎসর আলস্যে ও বিলাসে কাটাইতে পারে, এই ধারণা এখন লোপ পাইতেছে।
যখন বলি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত যুবক-যুবতীদিগকে আলস্যে সময় কাটাইতে দেওয়া উচিত নয়। তখন ইহাও আমি বলিতে চাই যে, কতকগুলি বাঁধাধরা নিয়ম মানিয়া চলাই কাজের প্রকৃত প্রমাণ নয়। ইংল্যান্ডে নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অসংখ্য বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয় এবং তাহাদের ছাত্রদিগকে হাজিরা দেওয়ানোর জোঁক দেখা যায়। মন্তেসরি বিদ্যালয়ে শিশুদের ব্যক্তিগত কাজের স্বপক্ষে যে যুক্তি প্রয়োগ করা হয়, কুড়ি বৎসর বয়সের যুবকদের ক্ষেত্রে–বিশেষত যখন তাহাদের বুদ্ধি ও উদ্যম সাধারণ ছাত্রদের তুলনায় বেশি বলিয়া ধরিয়া লই, তাহাদিগকে ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করানোর যুক্তি আরও প্রবল। আমি যখন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছিলাম তখন আমার এবং আমার অধিকাংশ বন্ধুর ধারণা হইয়াছিল যেই বক্তৃতা দ্বারা কেবল সময়ের অপচয় করা হইত। আমাদের অবিমত অতিরঞ্জিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই কিন্তু খুব বেশি নয়। বক্তৃতার ব্যবস্থা করার আসল কারণ এই যে, দৃশ্যত ইহাকে কাজ বলিয়া মনে হয়, কাজেই ব্যবসায়িকগণ ইহার জন্য ব্যয় করিতে রাজি হইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যদি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করেন ব্যবসায়ীরা তাঁহাদিগকে অলস মনে করিবে এবং শিক্ষকের সংখ্যা কমাইয়া দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে থাকিবে। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাহাদের প্রতিপত্তির বলেই কিছু পরিমাণে উপযুক্ত প্রণালী অবলম্বন করিতে পারেন কিন্তু নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারেন না; আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থাও এইরূপ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের প্রকৃত প্রণালী এইরূপ হওয়া উচিত; শিক্ষা বৎসরের প্রারম্ভে শিক্ষক কতকগুলি বই-এর তালিকা দিবেন যেগুলি ছাত্রদিগকে যত্নের সঙ্গে অধ্যয়ন করিতে হইবে, আর কতকগুলি বইয়ের নাম দিবেন যেগুলি সকলে না পড়িলেও কতক ছাত্র পড়িতে পারে। তিনি এমন কতকগুলি প্রশ্ন জানাইয়া দিবেন যাহা ভালভাবে উত্তর করিতে হইলে বুদ্ধি খাটাইয়া উল্লিখিত বইগুলি হইতে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করিতে হইবে। ছাত্রগণ স্বচেষ্টায় অধ্যয়নের ফলে প্রশ্নের উত্তর তৈয়ার করিলে শিক্ষক একে একে প্রত্যেকের উত্তর দেখিবেন। যে সফল ছাত্র তাহার সঙ্গে পাঠ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে চাহে সপ্তাহে একদিন কিংবা একপক্ষকালে একদিন সন্ধ্যায় তিনি তাহাদিগকে আলোচনার সুযোগ দিবেন। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রায় এই ধরনের ব্যবস্থাই আছে। শিক্ষকের নির্দিষ্ট প্রশ্নের পরিবর্তে যদি কোনো ছাত্র নিজেই প্রশ্ন বাছিয়া লয় তাহাতে আপত্তি করিবার কোনো কারণ নাই। এই কাজে তাহার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে তবে দেখিতে হইবে তাহার স্বয়ং নির্বাচিত প্রশ্ন শিক্ষক নির্ধারিত প্রশ্নের সমান কঠিন হওয়া চাই। ছাত্রের লিখিত উত্তরপত্র পরীক্ষা করিলেই তাহার অধ্যবসায় কতখানি তাহা বোঝা যাইবে।
একটি বিষয়ের উপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে গবেষণাকার্যে নিযুক্ত থাকিতে হইবে। তাহার অধ্যাপনার বিষয়ে অন্যান্য সকল দেশে কি কি গবেষণা হইতেছে এবং কোথাও কোনো নূতন তথ্য বা জ্ঞাতব্য বিষয়ের উপর নূতন আলোকপাত হইতেছে কিনা তাহা অধ্যয়ন করিবার যথেষ্ট অবসর তাহার থাকা চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কৌশল একান্ত প্রয়োজনীয় নয়; যিনি যে বিষয় পড়ান সে সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা এবং তৎসংক্রান্ত আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। যিনি অত্যধিক কাজের চাপে পরিশ্রান্ত এইরূপ লোকের পক্ষে ইহা সম্ভবপর নহে। এইরূপ ক্ষেত্রে তাঁহার অধ্যাপনার বিষয় তাহার নিকট নীরস হইয়া দাঁড়ায় এবং যৌবনে তিনি যাহা শিখিয়াছিলেন তাহাই হয় তাহার শিক্ষাদান কার্যে একমাত্র মূলধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের পক্ষে প্রতি সাত বৎসরে এক বৎসরকাল সময় বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা অন্য কোনো দেশে জ্ঞানার্জনের জন্য কাটানো উচিত। আমেরিকায় এইরূপ ব্যবস্থা আছে কিন্তু ইউরোপীয় দেশসমূহের বিদ্যার অহমিকা এতই বেশি যে, এইরূপ প্রয়োজনীয় তাঁহারা স্বীকার করিতে চান না। এই বিষয়ে তাঁহারা ভ্রান্ত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যাহাদের নিকট গণিতশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলাম তাঁহারা ইউরোপের অন্যান্য দেশে পূর্ববর্তী কুড়ি হইতে ত্রিশ বৎসর গণিতবিদ্যায় যে অগ্রগতি হইয়াছিল সেই সম্বন্ধে কোনো খোঁজখবর রাখিতেন না–আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রাবস্থায় আমি ভিয়ারস্রাসের নাম কখনো শুনি নাই। পরে ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমি আধুনিক গণিতের সংস্পর্শে আসি। এইরূপ ঘটনা কেবল একক বা একান্ত বিরল ছিল না, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই প্রযোজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য আছে : একদল শিক্ষাদানের উপর জোর দেন, অন্য দল গবেষণা কার্যকেই প্রধান মনে করেন। ইহার প্রধান কারণ শিক্ষাদান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ছাত্রের প্রবেশ যাহাদের মানসিক ও বুদ্ধিগত শক্তি এবং অধ্যবসায়ের পরিমাণ উচ্চতর শিক্ষার উপযুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুলের মতো শিক্ষাদানের রীতি এখনও কিছুটা রহিয়াছে। ছাত্রদের নিকট বক্তৃতা করিয়া, স্কুলের ছাত্রদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকেও পাঠ অনুশীলনে বাধ্য করিয়া সুফল লাভের চেষ্টা করা হয়। ছাত্রদিগকে কাজের জন্য মৌখিক উপদেশ ও উৎসাহ দিয়া কোনো লাভ নাই; আলস্যবশত অথবা সামর্থ্যের অভাবে যে কোনো কারণেই হোক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নের যোগ্যতার পরিচয় দিতে না পারিলে তাহাকে সেখান হইতে বিদায় দিতে হইবে, কারণ এইরূপ ছাত্র অন্যত্র কোনো কাজে নিযুক্ত থাকিলে বরং সময়ের ও অর্থের বৃথা অপচয় হইবে না। শিক্ষকের বহু ঘণ্টা ধরিয়া অধ্যাপনা করিবার প্রয়োজন নাই; জ্ঞানার্জন সাধনায় তাহাকে অবসর সময়ে ব্যাপৃত থাকিতে হইবে।
মানব-জাতির জীবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কাজ তাহা বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে গবেষণা শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। নূতন জ্ঞান অবলম্বন করিয়াই ক্রমোন্নতির ধারা চলিয়াছে; ইহার অভাবে বিশ্বের (উন্নতির গতি) প্রগতি থামিয়া যাইবে। বর্তমান সময় পর্যন্ত যে জ্ঞান মানুষের অধিগত হইয়াছে তাহার প্রসার ও ব্যাপক প্রয়োগের ফলে আরও কিছুকাল উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকিবে কিন্তু ইহা খুব বেশিদিন চলিবে না। নিছক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য যে জ্ঞান তাহাও চিরদিন মানুষের মন অধিকার করিয়া রাখিতে পারে না। বিশ্ব-রহস্যকে ভালভাবে বুঝিবার জন্য যে নিঃস্বার্থ উদ্যম ও গবেষণায় মানুষ প্রবৃত্ত হয় তাহা হইতেই প্রয়োজনার্থ জ্ঞান উদ্ভূত হয়। প্রথমে মানুষ বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক [Theoretical] জ্ঞান অর্জন করে পরে তাহাই প্রয়োজনে খাটানো সম্ভবপর হয়, কেননা উচ্চস্তরের তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রয়োজনে লাগানো সম্ভবপর না হইলেও ইহার নিজস্ব মূল্য আছে কেননা বিশ্বের রহস্য সম্বন্ধে ও বৈজ্ঞানিক সংস্থা যদি মানুষের দেহের প্রয়োজন মিটাইতে এবং যুদ্ধ ও নিষ্ঠুরতা দূর করিতে পারে তবে জ্ঞান ও সৌন্দর্যের সাধনা আমাদের মনে সৃষ্টির প্রেরণা যোগাইতে থাকিবে। কবি, চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক অথবা গণিতবিদ নিজেদের সৃষ্টিকে কেবল মানুষের প্রয়োজনে লাগাইতে ব্যস্ত থাকুন ইহা আমার কাম্য নয়। ভাবজগতে বিচরণ করিতে স্রষ্টার মানস-গগনে যে নূতন জ্ঞানের প্রথম আলোর আভাস ক্ষীণ আভায় ফুটিয়া ওঠে তাহাকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করিতে এবং নবসৃষ্টিতে রূপায়িত করিতে তাহার যে আনন্দ তাহার সহিত তুলনায় জগতের সকল আনন্দ ম্লান হইয়া যায়। জগতে শিল্প ও বিজ্ঞানের যত কিছু উন্নতি, তাহার মূলে আছে দুর্লভকে লাভ করার অদম্য বাসনা। যাহা প্রথমে মনে হয় অবাস্তব কল্পনা তাহাই বৈজ্ঞানিক সাধনায় বাস্তবে পরিণত হয়; যেইরূপকল্পনা শিল্পীর ভাবনেত্রে প্রথমে অস্পষ্ট কমনীয় আভাস ফুটিয়া ওঠে তাহাই পরে রেখায়, রঙে, সাহিত্যে, শিল্পে মাধুর্যমণ্ডিত হইয়া উপভোগ্য হইয়া ওঠে। দুর্লভকে লাভ করার সাধনায় মানুষ অকুণ্ঠিতচিত্তে বিপদের মুখে আগাইয়া যায়, সকল রকম কৃচ্ছসাধন স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লয়। যে-সকল ব্যক্তির এইরূপ গভীর অনুরাগ ও মানসিক সামর্থ্য থাকে তাহাদিগকে প্রয়োজনার্থক কাজের শিকলে বাঁধিয়া রাখিয়া তাহাদের প্রতিভা স্ফুরণে বাধা দেওয়া উচিত নয়। কেননা যাহা কিছু মানুষকে মহান করিয়াছে তাহা সবই এই জাতীয় লোকের প্রচেষ্টা হইতে উদ্ভূত।