১৬. বিবেকের সংকট
বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষ এখন এক দারুণ সংকট আর রুদ্ধবাক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ সংকট বাইরের বা রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক পরিবর্তনেই শুধু নয়, নৈতিক চেতনা আর বিবেকের সংকটটাই আজ সবচেয়ে বেশি করে দেখা দিয়েছে। আমরা সবাই এখন (যারা বিবেকের ধার ধারেন না তাঁরা ছাড়া) প্রতি মুহূর্তে বিবেকের দংশন অনুভব করছি। এ দুঃসহ অবস্থা ও আত্মিক যন্ত্রণাকে যদি মুক্তি তথা প্রকাশের সুযোগ দেওয়া না হয় তাহলে এমন দিন খুব দূরে নয়, যখন জাতি হিসেবে আমরা সম্পূর্ণ বিবেকহীন, হৃদয়হীন এক জড়বস্তুর শামিল হয়ে পড়বো। তখন চিরদাসত্ব হবে আমাদের ভাগ্যের লিখন। গোলাম হুকুমের তাঁবেদার মাত্র, তার কোনো বিবেক বা বিবেকের অভিব্যক্তি থাকে না, স্বাধীনতার অর্থ নিশ্চয়ই তা নয়।
এ অবস্থা থেকে আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে দেশকে দিতে হবে বাঁচার সুযোগ। আপাতত এ করার একমাত্র উপায় জাতির বিবেকের মুখপাত্র যারা–অর্থাৎ লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সবাইকে নির্ভয়ে কথা বলার, আলোচনা-সমালোচনা করার সুযোগ দেওয়া। রুদ্ধদ্বার বিবেকের দরজা-জানালা খুলে না দিলে তাতে বাইরের স্বাস্থ্যপ্রদ মুক্ত আলো-হাওয়া প্রবেশ করতে পারবে না। না পারলে তার হৃদয় আর বিবেকের অকালমৃত্যু অনিবার্য। জাতির মুখপাত্রদের এ দশাপ্রাপ্তি মানে সারা জাতির এ দশা ঘটা। গত তিন-চার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে আমরা জাতি হিসেবে দিন দিন হৃদয়হীন, বিবেকহীন হয়ে যাচ্ছি না? শত শত মানুষের সামনে যখন কোনো আদমসন্তানকে প্রকাশ্য রাজপথে যে কোনো অজুহাতে স্রেফ পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তখন অগণিত সক্ষম জনতা অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে সে বর্বর দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে। আমরা অনেকে তখন অসহায় দর্শক বনে যাই। পরদিন আমাদের সংবাদপত্রগুলোও এ বর্বরতাকে ফলাও করে প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। উচ্চারিত হয় না কোনো মহল থেকে কোনো নিন্দা বা প্রতিবাদ। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী শক্তিরও যেন এ ধরনের ব্যাপারে কিছুমাত্র করণীয় নেই। এ রকম ঘটনা রাজধানীর বুকে এবং অন্যত্র একবার দু’বার নয়, বহুবার ঘটেছে। দেশের বিবেক একবারও সোচ্চার হয়নি এ ধরনের বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে।
তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কোথায় আইন, কোথায় শৃঙ্খলা, কোথায় সভ্য আচরণ; কোথায় ইনসাফ? যে ইনসাফ ইসলামের এবং যে কোনো সভ্যতার এক প্রধান স্তম্ভ। সব রকম মানবিক চেতনা এভাবে আমাদের জীবন থেকে যেন দিন দিন বিদায় নিচ্ছে। এর ফলে আমাদের ভাষায় ‘গণপিটুনি’ নামে এক বর্বর শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। এভাবে আইন বা ইনসাফ শুধু নয়, আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ আর মানবিক চেতনাও প্রতিদিন পদদলিত হচ্ছে। তাই ভাবি, জাতি হিসেবে আমরা কোথায় নেমে যাচ্ছি? আমরা কি এক বর্বর জাতিতে পরিণত হতে চলেছি? এমন জাতির মুখে রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদির বুলি স্রেফ প্রহসনের মতো শোনায় না কি?
আমাদের দেশ ও রাষ্ট্র আছে, আছে ধর্ম ও শাস্ত্র, আছে স্বাধীনতা–এমনকি আইন-আদালত, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টও রয়েছে, কিন্তু এসবের পেছনে যে মহৎ আদর্শ ও লক্ষ্য, তার চর্চা, অনুশীলন ও বাস্তবায়ন ছাড়া সামাজিক জীবনে এসবের কতটুকুই বা মূল্য। তাই এসব কথা আমাদের মুখে আজ স্রেফ ফাঁকা বুলিতে পরিণত। আমরা অহরহ ধর্মের নাম ইসলামের নাম আউড়ে থাকি। দোহাই দিয়ে থাকি আল্লাহ-রসুলের। দেশের বেতার-টেলিভিশনও অহরহ শোনায় ধর্মের বাণী। কিন্তু জীবনে ও কর্মে এসবের সঙ্গে যে আমাদের কিছুমাত্র সংযোগ নেই তা বোধকরি না বললেও চলে। ইসলাম তো বিমূর্ত শিল্প কিংবা অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু নয়। তার একটা বাস্তব বা চক্ষুগ্রাহ্য রূপ আছে। মোটামুটিভাবে শরিয়তের হুকুম-আহকাম পালনের ভিতর দিয়ে তা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। শরিয়তকে বাদ দিলে ইসলাম স্রেফ বায়বীয় হয়ে দাঁড়ায়। আমার বিশ্বাস ইসলাম বায়বীয় বা অশরীরী কোনো কবি-কল্পনা নয়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার আশি ভাগেরও বেশি মুসলমান। ব্যক্তিগত জীবনে সবাই হয়তো শরিয়তের সব হুকুম-আহকাম পালন করে না কিন্তু সামাজিক আর জাতীয় ক্ষেত্রে তা নগ্নভাবে অবহেলিত হতে দেখলে সবাই অল্পবিস্তর মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে থাকে বই কি। প্রকাশ্যে কেউই ধর্মের কিংবা শরিয়তের অবমাননা দেখতে চায় না। তা পালিত হলে অধার্মিকজনও মনে মনে খুশি হয়, স্বস্তিবোধ করে। সামাজিক রেওয়াজ বা কনভেনশনকেও একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই কট্টর অর্ধামিকেরও মৃত্যুর পর জানাজা পড়া না হলে তার আত্মীয়স্বজন তো বটে এমনকি তার দুশমনেরাও নাখোশ হন এবং আপত্তি জানান।
আমাদের স্বাধীনতার আয়ু খুব দীর্ঘ নয়। সুদীর্ঘকাল আমরা ইংরেজদের অধীন ছিলাম। তারপর সিকি শতাব্দী ধরে তাঁবেদার ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের। একাত্তরের মোলই ডিসেম্বরের পর থেকে আমাদের স্বাধীনতার শুরু। তখন থেকে বাংলাদেশ পুরোপুরি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ স্বাধীনতার জন্য আমরা শেখ মুজিবের কাছে ঋণী। তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নাম জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে এবং অনুপস্থিতিতে যে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। তাতেও তাঁকেই করা হয়েছিল সে সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করেছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে, সে সরকারের বাস্তব বা কাল্পনিক রাজধানীর নাম ‘মুজিবনগর হয়েছিল। অন্য নাম কারো মাথায় আসেনি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলা যাবে না। তিনি বাংলাদেশের গত পঁচিশ বছরের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর মৃত্যুর পর আমি যার যা প্রাপ্য এই নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। আজ শেখ মুজিবুর রহমান নেই, তার সম্বন্ধেও জাতিকে আমি ওই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই–অর্থাৎ যার যা প্রাপ্য। জাতির কাছে শেখ মুজিবের কি কোনো প্রাপ্য নেই? এ নশ্বর পৃথিবী থেকে তাঁকে কি আমরা একদম খালি হাতেই বিদায় দেবো? বাংলাদেশে ছটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, হাজার হাজার স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা আছে-অতএব বাংলাদেশ যে কিছুটা সভ্য দেশ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার জিজ্ঞাসা–তার মতো একজন জননেতার প্রতি আমরা সভ্য মানুষের মতো ব্যবহার করেছি কিনা? বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর পর? বাংলাদেশের মুসলমান মোটামুটি ধর্মপ্রাণ। অন্য সময় না হলেও জন্ম আর মৃত্যুতে এদেশের মুসলমানরা শরিয়তের নিয়মাবলি পালন করে থাকে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তা পালিত হয়েছে কিনা অর্থাৎ শরিয়ত মোতাবেক তাঁর দাফন-কাফন-জানাজা ইত্যাদি হয়েছে কিনা? বলা হয়েছে “প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।” জানাজা এ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত কিনা? সেদিন আর যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদেরও কোনো জানাজা হয়েছে কিনা? সংক্ষিপ্ত সরকারি বিবৃতিতে জানাজার উল্লেখ নেই। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির যথাবিধি জানাজা আদায় হয়েছে এ খবর জানতে পারলে আমাদের মতো সাধারণ মুসলমানের অশান্ত বিবেক কিছুটা হয়তো শান্তি লাভ করতো। অধিকন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি (খোন্দকার মোশতাক) আর তাঁর সহকর্মীরা যখন প্রায় সবাই শেখসাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘকালের সঙ্গী-সাথী এবং স্নেহপুষ্ট ছিলেন, নিহত শেখসাহেবের রূহ নিশ্চয়ই এ দাবিটুকু তাঁদের কাছে করতে পারে।
শেখসাহেবের এক নিকট-প্রতিবেশী এ বলে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন-প্রতিবেশীর প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্য তা আমি পালন করতে পারিনি। সে কর্তব্য অতি সামান্য। প্রতিবেশীর মৃত্যু হলে তার দাফন-কাফনে সহায়তা করা, জানাজায় শরিক হওয়া। সেটুকুও আমি করতে পারি নি। এ বেদনা আমাকে সারা জীবন বইতে হবে।
শেখ নিজে মানুষটাও ছিলেন ওই রকম। সহকর্মী কারো মৃত্যুসংবাদ শুনলে সে যশোর, খুলনা, চাটগাঁ, নোয়াখালী, সিলেট যেখানেই হোক ছুটে যেতেন। জানাজায় শরিক হতেন। জানাজায় শরিক হতে না পারলে পরে সুযোগমতো গিয়ে কবরের পাশে দাঁড়াতেন, জেয়ারত করতেন। ঢাকায় হলে তো কথাই নেই। তিনি নিহত হবার পর তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীরা তার জানাজায় শরিক হয়েছেন, তেমন কথা শোনা যায়নি। বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান আর তারা মন্ত্রীদের কাছে তাঁর এ দাবিটুকু অনায়াসে করতে পারতেন।
রাষ্ট্রপ্রধান বা জননেতা হিসেবে না হোক, একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবে তাঁর মরদেহের প্রতি এ প্রাথমিক দায়িত্বটুকু যদি পালন করা না হয়ে থাকে তার চেয়ে বেদনার বিষয় আর কী হতে পারে? এ বেদনা বাংলাদেশের বুকের ওপর চিরকাল একটা ভার হয়ে থাকবে।
শেখ মুজিবের জন্ম মুসলমানের ঘরে। শুনেছি তার পিতা-মাতা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর যে দু’চারবার দেখা আর আলাপ-আলোচনা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছে ধর্মের ওপর তারও প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হয়ে যাই তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো মসজিদ ছিল না, আমি একটা মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছি শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে নিজের খাস তহবিল থেকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলেন, আগামী অর্থবছরে তিনি আরো বেশি করে টাকা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো যখন চট্টগ্রামে আসেন, জনসভায় ভাষণ দিতে উঠে সর্বাগ্রে শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনা আর দোয়া-দরুদ পড়ে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেছিলেন। উক্ত জনসভায় আমি সভাপতি ছিলাম বলে এ দৃশ্য আমার চাক্ষুষ দেখা।
যারা মনে করেন তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তাঁরা তো এ সময়টুকু বাদ দিয়ে তার আগের জীবন ১৯৭২-এর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য যা করেছেন তার বিচার করে তার মূল্যায়ন করতে পারেন। আমার বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে না হোক দেশের সর্বপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নেতা হিসেবে আর দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে তার যে বিরাট অবদান রয়েছে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ তাকে কখনো ভুলতে পারবে না। তাদের মানসপটে তাঁর স্মৃতি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেল-জুলুম-বন্দুক-রাইফেল মানুষের স্মৃতিকে কখনো মুছে ফেলতে পারবে না।
দেশ এইসব ভুলে যাবে কী করে? তাঁর রাজনৈতিক জীবন কিছুমাত্র অগৌরবের কিংবা ছিল না অশ্রদ্ধেয়। যুদ্ধ পরবর্তী বিশৃঙ্খল দেশ শাসনে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকলে জন্য বড় বেশি মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। এ মূল্য দেওয়া-নেওয়াটা সব রকম সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমরা দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত বোধ না করে পারছি না। এ লেখার প্রেরণাও সে আতঙ্ক থেকে।
মৃতজনের প্রতি বৈরীভাব রাখতে নেই, ইসলামের শিক্ষাও তাই। আবারও পুনরাবৃত্তি করছি—’যার যা প্রাপ্য’ তাকে তা দেয়া উচিত।
ইংরেজিতে যে একটা কথা আছে, ‘শয়তানকেও তার প্রাপ্য দিয়ে দাও’-এ ঠাট্টা-বিদ্রূপ কিংবা অর্থহীন হেয় উক্তি নয়। এতে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিচয় রয়েছে। যার যা প্রাপ্য কথাটার মধ্যেও রয়েছে সে মূল্যবোধের স্বীকৃতি।
জাতির কাছে শেখ মুজিবের যেটুকু স্বীকৃতি আর সম্মান প্রাপ্য তা দেওয়া হলে, আমার বিশ্বাস, জাতির বিবেক কিছুটা অন্তত শান্তি ও স্বস্তি পাবে।
[রচনাকাল : ২৭ আগস্ট, ১৯৭৫]