১৬. বিনোদিনী

১৬. বিনোদিনী

ঠাকুরবাড়ির বাঁধাধরা গণ্ডিতে জ্ঞানদা ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। ছেলেমেয়েকে নিয়ে কিছুদিন তিনি সিমলা পাহাড়ে বাসা বাঁধলেন। তার। ধারণা হয়েছে, কলকাতার বিশেষত জোড়াসাঁকো বাড়ি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। সিমলার স্কুলেই ভরতি হল বিবি ও সুরেন কিন্তু তাদের আসল শিক্ষা ঘরের মধ্যে, মায়ের কাছে।

জ্ঞানদা নিজের প্রিয় কাব্যসাহিত্য পড়ে শোনান ছেলেমেয়েকে। তার পছন্দ শেলির সেনসিটিভ পয়েন্ট আর দি ক্লাউড, টেনিসনের মে কুইন আর দি ব্রুক। আবার ভারতী পত্রিকা থেকেও পড়ে পড়ে শোনান নতুন লেখা। সুরেন বিবির প্রতিদিনের আর-একটি কাজ হল সমবয়সি ভাইবোনদের আঁকাবাঁকা অক্ষরে চিঠি লেখা। এভাবেই ব্যাকরণের গতেবাধা নিয়ম এড়িয়ে তাদের শিক্ষা শুরু হয় প্রাণের স্পর্শে, সাহিত্যের উত্তেজনায়।

জ্ঞানদার আর-একটি প্রিয় কবিতা টমাস মুরের লাল্লারুখ। মুরের কবিতা ঠাকুরবাড়িতে খুব চর্চা হত, আইরিশ মেলোডির কারণেই। সত্যেন পাঠিয়ে দিয়েছেন হান্স আন্ডারসন আর গ্রিমভাইদের রূপকথা, সুরেন বিবি রাতদিন কাড়াকাড়ি করে বইদুটি নিয়ে। বড়দের পছন্দের সব উত্তরাধিকার ছড়িয়ে পড়তে লাগল সুদূর সিমলায় বসে থাকা ছোট ছোট দুটি বালক-বালিকার তন্ত্রীতে।

কিছুদিন পর ছেলেমেয়ে নিয়ে একা একা পাহাড়ে থাকার চেয়ে কলকাতায় নেমে আসাই সুবিধেজনক মনে হল জ্ঞানদার। অবশ্য ঠাকুরবাড়িতে নয়, আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ওঁরা উঠে এলেন ভবানীপুরের বির্জিতলাও পাড়ায়। মস্ত দোতলা বাড়ি, বিলিতি স্টাইলে মাঝখানে বড় হলঘর, তার চারপাশে চারটে ঘর, গাড়ি-বারান্দার ওপরে আরও একখানা। এখন এরকম বাড়িতে থাকতেই আরাম পান জ্ঞানদা।

ইংল্যান্ডে বাস করার ফলে তার অভ্যেসগুলি পালটে গেছে। সুরেন বিবিরা ম্যাট-ন্যাপকিন সাজানো ডাইনিং টেবিলে না বসলে খেতে পারে না। ঠাকুরবাড়ির সনাতন পরিবেশে তাদের অসুবিধে হচ্ছিল। তা ছাড়া কূটকচালি-ভরা মেয়েমহলের দমবন্ধ করা পরিবেশ এখন আর জ্ঞানদার সহ্য হয় না। ছেলেমেয়েরা ওখানে বেড়ে উঠুক সেটা তিনি কখনওই চান না।

জ্ঞানদার বাড়িই হয়ে উঠল রবি-জ্যোতির ঘরোয়া আড্ডার নতুন ঠিকানা। ভারতীর মিটিং থেকে পিয়ানো বাজিয়ে গান রচনার আসর– সবকিছুই এখন এই বাড়িতে। এখানেই জড়ো হন অক্ষয়, প্রিয়নাথ, বিহারীলালের মতো বন্ধুজন। এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য স্বর্ণকুমারী ও জানকীনাথ। স্বর্ণকুমারীকে ঠাকুরবাড়িতে রেখে জানকীনাথ বিলেত গিয়েছিলেন পড়তে, কিন্তু ঊর্মিলার মৃত্যুর খবরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কখনও কখনও সৌদামিনী বা বর্ণকুমারীও এসে হাজির হন। বাদ শুধু একজন, সদর স্ট্রিটের বাড়ির নতুনবউ। জ্ঞানদার বাড়িতে তার আমন্ত্রণ থাকে না। জ্ঞানদা নিজেই এ-সব গানবাজনা কবিতার আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকতে ভালবাসেন, সেখানে কোনও প্রতিদ্বন্দিনীকে তিনি ডেকে আনতে চান না। তিনি সবাইকে উৎসাহ দেবেন, তার প্রেরণায় সবাই নাটক বা গীতিনাট্যে মেতে উঠবে, তার সঙ্গেই রবি-জ্যোতিরা সাহিত্য আলোচনা করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এইজন্য তিল তিল করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন জ্ঞানদা।

স্বর্ণ যে দাদাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সভায় গিয়ে কবিতা পড়ছে বা কাদম্বরী যে ডিঙিনৌকোয় চড়ে জ্যোতির বন্ধুদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করছে, এসবের সুযোগ কে করে দিয়েছে? চোদ্দো-পনেরো বছর আগের সেই সময়ে তিনি জোর করে অন্ধকারের চৌকাঠ ভেঙে না বেরলে এতদিনেও ওরা আলোর মুখ দেখত না। জোড়াসাঁকোর চারদেওয়ালে বন্দি হয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া নিয়েই জীবন কাটাতে হত।

তা ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে একমাত্র এই কাদম্বরীর কাছেই তাকে কয়েকবার হার মানতে হয়েছে। তার সামনেই নতুনবউকে নিয়ে ছাদের আসরে জ্যোতি, রবি, অক্ষয়, বিহারীলালদের আদিখ্যেতা তিনি ভুলে যাননি।

এখন জ্যোতির যে ঘরে মন টেকে না, তাতে তিনি আশ্চর্য নন মোটেই। জ্যোতির মতো সৃষ্টিশীল প্রতিভা চিরদিন ওই বউকে নিয়ে মেতে থাকতে পারবে না, এ বিশ্বাস তার ছিলই। তার ওপর এখন কাদম্বরী যেরকম ঘ্যানঘ্যানে হয়ে গেছে, জ্যোতি আর কত সইবে?

গানবাজনার শেষে জ্যোতির মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, মেজোবউঠানের কাছে রাতে থেকে যান। জ্ঞানদাও তাকে নিজের কাছে টেনে নেন স্নেহে, শুশ্রূষায়, ভালবাসায়। এই দেবরটির প্রতি তার অদ্ভুত টান এখনও অটুট।

সদর স্ট্রিটের বাড়িটা দামি দামি ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে তুলেছেন জ্যোতি, তাতে আবার লেগেছে কাদম্বরীর রুচির ছোঁয়া। তবু সেই বাড়িটাকে মাঝে মাঝে একঘেয়ে মনে হয় জ্যোতির। গান কবিতা সাজসজ্জার আড়ম্বরের মধ্যেও পুরনো দাম্পত্য যেন হাঁপিয়ে ওঠে নতুন প্রাণের অভাবে।

জ্ঞানদার বাড়ির উদার স্নেহময় বাতাসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। শুধু মেজোবউঠান নন, তার ছেলেমেয়েরাও জ্যোতিকে স্নেহের বন্ধনে আটকে রাখে। আহা কাদম্বরীর কোলে যদি একটি কচি উপহার দিতে পারতেন। জ্যোতি নিজেকেই দোষ দেন। হতাশায় বাড়ি ফেরেন না, রবি সতর্ক করেন, জ্যোতিদাদা, নতুনবউঠান কিন্তু রাগ করবেন, সে আমি সামলাতে পারব না।

জ্যোতি রবিকে বলেন, সে আমি কাল গিয়ে সামলে নেব। তুই সদর স্ট্রিটে ফিরে আজ রাতে বউঠানকে পাহারা দে রবি।

কেন একদিন একা থাকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে তার? জ্ঞানদা ডাইনিং টেবল সাজাতে সাজাতে বলেন, আমি গাড়োয়ানকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, রবি তুমিও আজ থেকে যাও।

বিবি এসে রবির হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে, যেয়ো না রবিকা, আজ আমরা সেই বিলেতের মতো গান করব সবাই মিলে।

বালিকা বিবির স্নেহকাঙাল মুখের দিকে তাকিয়ে টানাপোড়েনে পড়ে যান রবি, তবু সেই নিঃসঙ্গ অভিমানিনী নতুনবউঠানের মুখ মনে করে শেষে সদর স্ট্রিটের দিকেই পা বাড়ালেন।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জ্যোতির মনে পড়ল বিনোদিনীর মুখ। এই সকালে তার মানসীপ্রতিমার ধ্যানে কাদম্বরী ঢুকে পড়তে পারছেন না বলেই জ্যোতির ঘুম পাড়িয়ে রাখা প্রেম চনমন করে উঠল। তিনি ঠিক করে ফেললেন, অনেকদিন যাওয়া হয়নি, আজ বিনোদিনীর খোঁজ নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবেন।

বিলিতি কায়দায় জ্ঞানদার ব্রেকফাস্ট ঘন্টি বেজে উঠল, অর্থাৎ টেবলে খাবার রেডি। এমনিতে বিলেতের সব চালচলন মানতে পারেন না জ্ঞানদা, কিন্তু যেগুলি ভাল তা তিনি গ্রহণ করেছেন। ওদের গুছিয়ে সংসার করার কায়দাকানুনগুলি বেশ ভাল, এই যেমন টেবিলে বসে একসঙ্গে খানাপিনার ব্যাপারটা। বাঙালি বাড়িতে কর্তার খাবার আগে সাজিয়ে দিতে হবে তাঁর সময়মতো, ছেলেপুলেরা আলাদা আলাদা সময়ে খাবে, গিন্নিরা খাবেন সবার হয়ে গেলে তারপর। এতে সময় অনেক নষ্ট হয় আর গৃহিণীর পরিশ্রমও বেশি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার পাট চুকে গেলে টেবিল পরিষ্কার করে গিন্নিরাও পড়াশোনা বা পছন্দসই অন্য কাজে মন দিতে পারেন।

সবচেয়ে বড় কথা, সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। নিজেদের কথাবার্তা হাসিঠাট্টার মধ্যে যে খোলামেলা মেলামেশা হয়, সেটাই পারিবারিক সম্পর্কের আসল অমৃতধারা।

জ্যোতি টেবিলে পৌঁছে দেখলেন, বিবি সুরেন জ্ঞানদারা সবাই আগেই এসে গেছেন। কিন্তু কেউ খাওয়া শুরু করেনি, তার জন্য অপেক্ষা করছে। জলখাবারের মেনু অবশ্য বিশুদ্ধ মতে, গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত মাছের কচুরি দেখে জ্যোতি বুঝতে পারেন জমিয়ে খিদে পেয়েছে। সেই সঙ্গে আবার হাতছানি দিচ্ছে বরফকুচি দেওয়া ফলের রস আর চিনেমাটির বাটিতে সাজানো কাজু-কিশমিশ দেওয়া মোহনভোগ।

জ্ঞানদা জানতে চান, এখনি বাড়ি ফিরবে নাকি জ্যোতি? এসেছ, দু তিনদিন থেকে একটু জিরিয়ে যাও না।

জ্যোতি হেসে উড়িয়ে দেন, কী যে বলো মেজোবউঠান, আমি তো প্রায় রোজই আসি। দিনের বেলা কি আমার কোনও কাজকর্ম নেই?

তা হলে কাজ সেরে ফিরে এসো, দুপুরে ইলিশ রান্না হবে। জ্ঞানদা যেন বালক দেওরকে লোভ দেখান।

জ্যোতি হেসে বলেন, আর আমার বউ যে গোঁসাঘরে খিল দেবে, তোমার তাতে খুব মজা হবে, না? কেন যে তোমার এখনও এত রাগ সে বেচারার ওপর!

আমার রাগ করতে বয়ে গেছে, জ্ঞানদা ফোঁস করে ওঠেন, সে কি আমার ঘরের লোক যে রাগ করব?

আর আমি? জ্যোতি জানতে চান, আমাকে যে আটকে রাখতে চাও তোমার কারাগারে, সে কোন অপরাধে দেবী?

আহা, জ্ঞানদা অভিমানী গলায় বলেন, জানো না যেন, তোমাকে ভালবাসি বলেই ধরে রাখতে চাই। তোমার মেজদাদা কোন সুদূরে পড়ে থাকেন, আমার কি ভাল লাগে একা একা শুধু বিবি-সুরেনকে নিয়ে সংসার সামলাতে! তুমি থাকলে আমাদের বাড়িতে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। বিবি সুরেনরাও কত খুশি হয়, তুমি বোঝো না!

কালপরশুই আবার আসব বউঠান, জ্যোতি জ্ঞানদার হাতের ওপরে হাত রেখে মিনতি করেন, আজ ছুটি দাও।

কোন রাজ্যজয় করতে যাবে শুনি? জ্ঞানদা কৌতূহলী হন, এখনি বাড়ি যাবে না নিশ্চয়ই!

বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করতে হবে একটু, জ্যোতি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলেন, আমার পরের নাটকে ওকে নায়িকা করতে চাই।

জ্ঞানদা তীক্ষ্মচোখে জ্যোতিকে দেখেন, চিবুক ধরে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলেন, একটা সত্যি কথা বলবে নতুনঠাকুরপো, কাদম্বরীর সন্দেহ কি সত্যি? তুমি কি সত্যি বিনোদিনীর প্রেমে পড়েছ?

জ্যোতি জ্ঞানদার সামনে থেকে সরে যান জানলার কাছে, কী করে বোঝাব মেজোবউঠান, কখনও কখনও নাট্যকারের কাছে নায়িকা তার লেখার প্রেরণা হয়ে ওঠে তুমি কি জান না তা? প্রেরণাকে প্রেম নাম দিলে বড্ড স্কুল শোনায়, জিনিসটাকে এত নীচে নামিয়ে এনো না, দোহাই তোমাদের।

জ্ঞানদার ভয় হয় জ্যোতি বোধহয় ভাবছেন তিনিও কাদম্বরীর মতো মোটাদাগের চিন্তায় নামিয়ে আনছেন বিনোদিনীকে। কিন্তু তিনি তো কাদম্বরী নন, তাড়াতাড়ি বলেন, না নতুনঠাকুরপো, সে ভয় কোরো না, বিনোদিনী যদি তোমার প্রেরণা হয়, আমি কখনও তাকে মোটা দাগে বিচার করব না। আটকেও রাখব না। যাও তুমি তোমার মিউজের কাছে।

বিনোদিনীর বাড়ি পৌঁছে জ্যোতি দেখলেন পরিবেশ থমথমে। বিনোদিনীর মুখে সংকটের ছায়া। গিরিশ মাথার চুল ছিঁড়ছেন। অমৃতলাল চুপচাপ বসে আছেন।

বিনোদিনীর এক ধনী প্রেমিক ছিল, সম্প্রতি সে লুকিয়ে বিয়ে করেছে। সেজন্য বিনোদিনীর খুবই মন খারাপ, জ্যোতি জানেন। কিন্তু সেজন্য সবাই এত গম্ভীর থাকবেন তা তো সম্ভব নয়। তবে কী হল?

জ্যোতি সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, কী হয়েছে বিনোদিনী? কারও অসুখ করেছে?

না জ্যোতিবাবু, ভেজা গলায় বিনোদিনী বলেন, আমার স্বপ্ন বুঝি অধরা থেকে গেল। আমি ন্যাশনাল থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছি। গিরিশবাবু এখন একটি নতুন থিয়েটার তৈরি করতে চান, কিন্তু টাকার অভাবে সে-চেষ্টা থমকে যাচ্ছে।

গিরিশবাবু ন্যাশনাল ছেড়ে নতুন থিয়েটার করবেন, জ্যোতি উল্লসিত হন, এ তো দারুণ খবর।

গিরিশ বলেন, ওহে ঠাকুরবাবু, ন্যাশনাল থিয়েটারে তো আর ভদ্রলোকে থাকতে পারছে না। মালিক কথায় কথায় সবাইকে অপমান করছেন। বিনোদিনী পনেরো দিন বেনারস বেড়াতে গেছিল বলে ওর টাকা কেটেছে। বিনোদ তাই রাগ করে ন্যাশনাল ছেড়ে দিল। আমিও বেরিয়ে এসে নাটক করছি। এখন নতুন থিয়েটার তৈরি করতে চাই। আপনার তো অনেক টাকাপয়সা, প্রতিপত্তি। দেখুন না কিছু করতে পারেন কি না।

জ্যোতি উদগ্রীব হয়ে জানতে চান, কী করতে হবে বলুন। বিনোদিনীর চোখের জল মোছর জন্য তিনি সবকিছুই করতে পারেন।

টাকা চাই, অনেক টাকা, গিরিশ বলেন, পারবেন কিছু করতে? আমার তো শখের থিয়েটার না, এ থেকেই রুটিরুজি চালাতে হবে।

জ্যোতি নিজেকে ধিক্কার দেন মনে মনে। অনেক টাকা তিনি কোথা থেকে দেবেন, কিছু জোগাড় করা যেতে পারে মাত্র। বাবামশায় তো কখনওই থিয়েটারের পেছনে এত টাকা ওড়াতে দেবেন না, তার নিজের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। তবু বিনোদিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে বলে ফেলেন, কিছু তো দিতেই পারি, আরও কিছু জোগাড় করা যায়। হাল ছেড়ে বসে থাকলে তো হবে না।

বিনোদিনী এগিয়ে এসে জ্যোতির হাত ধরে বলেন, সত্যি কিছু করা যাবে? আমাদের নতুন থিয়েটার গড়ে দিলে আমি চিরদিন আপনার কেনা হয়ে থাকব জ্যোতিঠাকুর।

জ্যোতির গা ভাললাগায় শিরশির করে ওঠে। এতদিন ওই প্রেমিকের জন্য বিনোদিনী তাকে কাছে ঘেঁসতে দেয়নি, আজ এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তটা যদি চিরস্থায়ী করে রাখা যেত!

কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢোকেন এক অল্পবয়সি যুবক, দামি বিলিতি মদের গন্ধে তাঁর গা ভুরভুর করছে, অঙ্গে মহামূল্য আঙরাখা, গলায় লম্বা সোনার চেন, পাঁচ আঙুলে হিরে-পান্নার আংটি। ঢুকতে ঢুকতেই আগের কথার রেশ টেনে বলেন, কী বিনোদিনী, আমাকে ফেলে অন্য কোনও মহাপুরুষের কেনা হয়ে থাকবে তুমি?

বিনোদিনী তাঁকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যান, তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে বলেন, গুরমুখবাবু আপনি বসুন, ওরকম টালমাটাল করবেন না।

গিরিশ গুরমুখকে আপ্যায়ন করতে চান, বড়লোকের ছেলে, সাহায্যে লাগতে পারে। বলেন, আহা বিনোদ, ওঁকে ওরকম করে বোলো না, উনি থিয়েটার ভালবাসেন, ওঁকে একটু আদরযত্ন করো।

গিরিশ নিজেও আর ন্যাশনালে থাকতে চান না। মালিক প্রতাপাদ এতদিন শিল্পীদের অবহেলা করলেও তার কথা শুনতেন। ক্ষুব্ধ শিল্পীরা গিরিশের কথায় মালিকের অন্যায় মেনে নিয়েও কাজ করছিল। কিন্তু ইদানীং প্রতাপ যেন গিরিশকেও গুরুত্ব দিতে চান না, ন্যাশনালের বাণিজ্যিক রমরমা যে গিরিশ আর বিনোদিনীর জন্যেই, তা আর মানতে চাইছেন না তিনি। এই অবস্থায় গিরিশ চাইছেন নতুন করে শুরু করতে। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল ছেড়ে ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি নামে একটা নাট্যদল গড়েছেন তিনি। অমৃতলাল মিত্র, নীলমাধব চক্রবর্তী, অঘোরনাথ পাঠক, বিনোদিনী, ক্ষেত্ৰমণি, কাদম্বিনী, গঙ্গামণিরাও যোগ দিয়েছেন নতুন এই দলে। পুরনো সীতাহরণ নাটকটি নতুন দলের ব্যানারে অভিনয় শুরু হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট কোনও স্টেজ না থাকায় আজ এখানে কাল ওখানে হচ্ছে। এভাবে বেশিদিন চলবে না, তাই গিরিশ মরিয়া হয়ে উঠেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ থিয়েটার মঞ্চ গড়তে, আর তার জন্য বড়লোক বাবু ধরা দরকার। বিনোদিনীকে সুকৌশলে টোপ হিসেবে এগিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

বিনোদিনী কাছে গেলে গুরমুখ বলেন, না না, গিরিশবাবু, একটু ভুল বললেন, আমি থিয়েটার ফিয়েটার ভালবাসি না, ভালবাসি শুধু বিনোদিনীকে। তার হাত ধরে টেনে ডাকেন, এসো বিনোদ, আমার বুকে এসো।

বিরক্ত বিনোদিনী হাত ছাড়িয়ে নেন, থিয়েটার ফিয়েটার কথাটা শুনে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিছুদিন ধরেই সদ্য গোঁফ গজানো এই যুবকটি তাকে টানাটানি করছে, কিন্তু বিনোদের মনে আগের প্রেমিকের প্রতি ভালবাসা ছিল, তাই পাত্তা দেননি।

গিরিশও বিরক্ত হন, তা হলে তুমি এখন এসো গুরমুখ, আমরা থিয়েটার নিয়ে একটু সিরিয়াস আলোচনা করছি।

জ্যোতি আর সহ্য করতে পারেন না, আঠারো-উনিশ বছরের ছেলের মাতাল হয়ে এ কী বেহায়াপনা! উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি নিজে থেকে যাবেন না গলা ধাক্কা দেব?

আরে, এ যে দেখি ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্র। অন্ধকারে চাঁদের উদয়! গুরমুখ জ্বালা ধরানো হাসি হাসেন, এনার কাছেই কি নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছিলে বিনোদ? এই তোমাদের সিরিয়াস আলোচনা?

বিনোদিনী নিজেকে স্পষ্ট করতে চান, গুরুমুখবাবু শুনুন, আপনি ভুল বুঝছেন। আমরা ন্যাশনাল ছেড়ে দিয়েছি। নতুন থিয়েটার গড়ব, তার জন্য টাকা চাই। কী করে টাকা জোগাড় হবে, আমরা তা নিয়েই মিটিং করছি। আমি জ্যোতিঠাকুরকে বলছিলাম, উনি যদি থিয়েটার গড়ে দিতে পারেন, আমি ওঁর কেনা হয়ে থাকব।

কত টাকা চাই বলো? গুরমুখের এবার বীরত্ব জেগে ওঠে, টাকা দিয়ে পৃথিবীতে যা-কিছু কেনা যায়, সবই তিনি কিনতে পারেন। উল্লসিত মুখে বলেন, বিনোদিনী, যত টাকা তোমাদের থিয়েটার তৈরি করতে লাগবে, আমি পুরো টাকাই ফেলে দেব।

জ্যোতির হৃদয়ে যেন শেল বেঁধে, অথচ তিনি অসহায়, গুরমুখের মতো করে বলার ক্ষমতা তার নেই।

দেবে তুমি? বিনোদিনীর গলায় এবার মধু ঝরে পড়ে, কিন্তু গুরমুখবাবু তুমি তো জানও না কত টাকা? আমাদের কিন্তু অনেক অনেক টাকা লাগবে।

তোমার জন্য যা লাগে তাই ঢালব সুন্দরী, গুরমুখ দম্ভভরে বলেন, আমি থিয়েটার ফিয়েটার জানি না, আমি তোমার শখের জন্য টাকা দেব।

এবার গিরিশ আসরে নামেন। গুরমুখ তুমি এমনি এমনি এত টাকা দেবে? থিয়েটারের শেয়ার চাও না? অবশ্য তুমি না চাইলেও আমরা দেব। একাজ যদি করতে পার, বাংলার থিয়েটারের ইতিহাসে তোমার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে।

হাঃ, দুদিনের জীবন, কীসের শেয়ার! কে চায় অমরত্ব! গুরমুখ হা হা করে হেসে ওঠেন। আমি শুধু বিনোদিনীকে চাই।

জ্যোতি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? এ কি মেছোবাজারের দরদাম চলছে? আপনি টাকা দিয়ে থিয়েটারকে বাঁচাচ্ছেন না বিনোদিনীকে কিনতে চাইছেন?

এতক্ষণে আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছেন ঠাকুরবাবু, গুরমুখ লাফিয়ে ওঠেন, আমার কাছে রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই এক। এ হল রূপের হাটের বিকিকিনি।

ছিঃ বিনোদিনী, এ-সব তোমরা সহ্য করছ কী করে? লোকটাকে এখনও গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছ না কেন? জ্যোতি ধিক্কার দিয়ে ওঠেন।

গিরিশ তাকে বাধা দেন, আঃ জ্যোতিবাবু, ও যদি সত্যিই টাকা দেয় আর তাতে নতুন থিয়েটার তৈরি হয়, আমরা যে-কোনও শর্তে রাজি হব। আমাদের কথাবার্তা বলতে দাও, আগে উত্তেজনা ছড়িয়ো না।

কিন্তু এই লোকটা তো বিনোদিনীকে অপমান করছে, জ্যোতি তবুও ফুঁসে ওঠেন।

অপমান কীসের, গুরমুখ অবাক হয়ে বলেন, আমি তো বিনোদিনীর জন্যেই সবকিছু করব, আমি ওর নামেই থিয়েটারের নাম দেব। কী বিনোদ, আমাকে একটু ভালবাসবে তো?

বিনোদিনীর অনেক জ্বালাযন্ত্রণার ওপর এই কথায় যেন মলম পড়ে, তিনি মধুর হেসে গুরমুখের দিকে এগিয়ে বলেন, সত্যি বলছ, আমার নামে থিয়েটার হবে? এ-কথা তো আগে কেউ আমাকে বলেনি!

জ্যোতিকে শান্ত করতে তার হাতে হাত রাখেন, দেখুন জ্যোতিঠাকুর, উনি এত ভাল একটা প্রস্তাব দিচ্ছেন, আপনি আর রাগ করবেন না, আমার এত সহজে অপমান গায়ে লাগে না।

গিরিশ অবশ্য এই প্রস্তাবে খুশি হতে পারলেন না, তার সাধের থিয়েটার হবে কিনা শেষে বিনোদিনীর নামে! লোকে যে ছ্যা ছ্যা করবে। বারাঙ্গনাকে দিয়ে নাটকে পার্ট করানো যায়, তাই বলে তার নামে থিয়েটার!

তিনি কায়দা করে বললেন, থিয়েটারের নাম নিয়ে পরে ভাবা যাবে, আগে হোক তো। গুরমুখবাবু যদি এই থিয়েটারে টাকা দেন, বিনোদিনীর জন্যই দেবেন, কিন্তু যে-কোনও বিনোদিনীর চেয়ে থিয়েটার যে অনেক বড়, এটা কোনও দিন ভুলিস না বিনোদ।

না, না, গিরিশবাবু, আমি বিনোদিনীর নামেই থিয়েটার করব, ওর নামে শেয়ার লিখে দেবেন, গুরমুখ বলে ওঠেন, আমি নিজে শেয়ার চাই না, শুধু বিনোদিনীকে নিজের করে পেতে চাই।

অমৃতলাল বলেন, আপনার প্রস্তাব তো ভালই, কিন্তু জীবিত নট-নটীদের নামে তো থিয়েটার হয় না, তা ছাড়া বিনোদের নামে নাম দিলে লোকে আসবে না, সমাজের মাথারা বয়কট করবেন। কাজ কী অত ঝামেলায়, আমরা তো জানলাম আপনি বিনোদিনীকে দিলেন।

গুরমুখ বিনোদিনীর মতামত চান, কী গো সুন্দরী, আমি তো পঞ্চাশ হাজার টাকা এখনি তোমাকে ঢেলে দিতে পারি, তুমি ঠিক করো টাকা নিজে নেবে না এদের কথা শুনে সবটা থিয়েটারে ঢালবে?

না, না, গুরমুখবাবু, বিনোদিনী বললেন, আমার টাকার লোেভ নেই। আপনি থিয়েটারের জন্যই টাকা দিন, গিরিশবাবু আমার নামে থিয়েটারের অংশীদারিত্ব লিখে দিলেই আমি খুশি হব।

বাবা, এ মেয়ে যে চমকে দিল, গুরমুখ হেসে ওঠেন, টাকাপয়সা চায় না, শুধু থিয়েটার করতে চায়, তার জন্য এত স্যাক্রিফাইস? কী জ্যোতিঠাকুর, এমন নটী আর দেখেছেন?

ক্ষুব্ধ বিরক্ত হতাশ জ্যোতি বিনোদিনীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে পিছু ডেকেও ফেরাতে পারেন না বিনোদিনী।

.

টাকা দিয়ে বিনোদিনীকে কিনে নিলেন গুরমুখ। তার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নেন গিরিশ। কিন্তু বিনোদিনী তখনও খুঁতখুঁত করছেন। গুরমুখের শর্তটা মানতে পারছেন না। মাঝে মাঝে সঙ্গ দেওয়া এককথা, কিন্তু একেবারে রক্ষিতা হয়ে থাকতে তার মন চায় না। একদিকে তার সামনে রঙ্গালয়ের তারাভরা আকাশ, আর তিনি সেই আকাশের পরি; অন্যদিকে কালিমাখা জীবনযাপনের জন্য রঙ্গকর্মীদের জোরাজুরি। রূপোপজীবিনীর অতীতকে পেছনে ফেলে যত তিনি উত্তরণ চান, তত যেন সবাই মিলে তাকে সেই পাঁকে ডোবাতে চাইছে।

ক্যালকাটা স্টার কোম্পানির দলবল মিলে তাকে কাতর অনুরোধ করে। শেষে গিরিশ তাকে ডেকে বললেন, আর কোনও উপায় নেই রে বিনোদ, তুই থিয়েটার ভালবাসিস, থিয়েটারের জন্যে আজ তোর নিজেকে বলি দিতে হবে।

গিরিশের সকাতর অনুরোধ মানে বিনোদিনীর কাছে আদেশ। তা ছাড়া, থিয়েটার যখন তার নামেই হচ্ছে, বিনোদিনী গুরমুখের বাসনায় নিজে বলিপ্রদত্ত হলেন। বিডন স্ট্রিটে জমি কেনা হল, আর কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করে রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল। নাম নিয়ে দরকষাকষি চলছিলই, শেষ পর্যন্ত। বিনোদিনীর আশা ছিল বিনোদিনী থিয়েটার না হোক, বি-থিয়েটার নাম হবে, গুরমুখ তাকে আদর করে সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন।

কিন্তু গিরিশ, অমৃতলালেরা কিছুতেই তাতে রাজি হলেন না। বিনোদিনীর কাছে খবর পৌঁছল নাম রেজিষ্ট্রি হয়েছে স্টার থিয়েটার। যে জন্য তিনি নিজেকে বিকিয়ে দিলেন সেই থিয়েটারে তার নামের চিহ্নটুকু রাখা হল না, বিনোদিনী এত বড় প্রবঞ্চনায় ভেঙে পড়লেন। রিহার্সালেও তার প্রতি সকলের ব্যবহার যেন পালটে গেছে, কেউ তাকে আগের মতো খাতির করছে না। অপরাধবোধ ঢাকার জন্য গিরিশও যেন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিনোদিনীর চোখ ফেটে জল আসে। তিনি রিহার্সালে আসা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন।

গুরমুখ হতাশ হয়ে পড়েন, এত টাকা ঢেলে কি এক শোকার্ত রমণীর সেবা করবেন? কোথায় গেল বিনোদিনীর হাসিমুখ, চমক ধমক! গিরিশের কাছে গিয়ে খুব রাগারাগি করলেন একদিন।

গিরিশও বুঝতে পারছিলেন, বিনোদিনীর সঙ্গে খুবই অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে। থিয়েটারের শেয়ার দেওয়ার ব্যাপারটাও কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনই বিনোদকে বাদ দিলে চলবে না, কারণ গুরমুখ রেগে যাচ্ছে আর দর্শকেরা আজও তার জন্য পাগল।

গিরিশ বিনোদিনীকে একটু সাধাসাধি করে ফিরিয়ে আনলেন। বিনোদের অবস্থা তো একবার সাধিলেই খাইব গোছের। রিহার্সালে না গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সব বঞ্চনা তিনি মানিয়ে নিলেন। বাড়ি ফিরে নিজের খাতায় লিখে রাখলেন, থিয়েটার ভালবাসিতাম তাই কার্য করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই।

১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই স্টার থিয়েটারের উদবোধন হল গিরিশের লেখা দক্ষযজ্ঞ নাটক দিয়ে, সতীর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় যেন আগের সব রোলকে ছাপিয়ে গেল। জনতার চাপে সেদিন থিয়েটারের গেট বন্ধ করা যায়নি, কত লোককে যে ফিরে যেতে হল তার ঠিক নেই।

গুরমুখের সঙ্গে ভালবাসার খেলায় মেতেছেন বিনোদিনী। সে-ই এখন তার সুখদুঃখের সঙ্গী। এর মধ্যে একদিন বিনোদিনীর দখল নিতে উদয় হল তার পুরনো প্রেমিক।

সে বললে, ওই গুরমুখ হারামজাদার কাছে তুমি কেন গেলে? যদি টাকার জন্য হয় তো ও তোমাকে যা দিচ্ছে আমি তার চেয়ে আরও দশহাজার টাকা বেশি দেব।

শুনে বিনোদিনী জ্বলে উঠলেন, যখন আমাকে ছেড়ে গেলে তখন মনে ছিল না? রাখো তোমার টাকা। আমি অনেক টাকা রোজগার করেছি কিন্তু টাকা কোনও দিন আমাকে কিনতে পারে না। ওরকম দশ-বিশ হাজার আমার কত আসবে।

বিনোদিনীর কথায় রেগে উঠে সেই পুরনো প্রেমিকটি তলোয়ার খুলে তেড়ে এল তার দিকে। ঘরে লণ্ডভণ্ড বেঁধে গেল। তার প্রতি বিনোদিনীর যেটুকু প্রেম অবশিষ্ট ছিল, এই ঘটনায় তা প্রায় উবে গেল। তার হাত থেকে রক্ষা করতে বিনোদিনীকে নিয়ে কিছুদিন কলকাতার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালেন গুরমুখ। শহরে শুরু হল তাদের নিয়ে কেচ্ছার ফুলঝুরি।

.

কলকাতা ফেরার পর একদিন গুরমুখ বললেন, বিনোদ, বাড়ির লোকেদের চাপে আমার তো জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। এবার বোধহয় আর উপায় নেই, তোমাকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে আমার মন চায় না, কী যে করি?

বিনোদিনীর চোখ ছলছল করে। ভেজা গলায় অতলজলের মতো চোখদুটি তুলে তিনি বললেন, তোমার আবদারে আমি সব ছাড়লাম। প্রেমিক ছাড়লাম, জ্যোতিঠাকুরের মতো অমন মানীজনকে ফেরালাম, আর এখন তুমি আমাকে ভাসিয়ে চলে যাবে?

উনিশের গুরমুখের মুখে বাসনা ও বেদনার টানাপোড়েন যেন মেঘ ও রৌদ্রের মতো ছায়া ফেলে। মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের অত্যন্ত ধনী সন্তান, কিছুদিন যথেচ্ছাচার করার পরেই আত্মীয়রা পেছন থেকে রাশ টেনে ধরেছে। তাতেও তাকে বিনোদিনীর কক্ষচ্যুত করা যাচ্ছিল না, কিন্তু শেষমেষ মায়ের আত্মহত্যার হুমকিতে নড়ে গেছেন গুরমুখ।

যেতে চাই না কিন্তু মায়ের জন্য ফিরে যেতে হবেই বিনোদ। গুরমুখ তার কোলে মাথা গুঁজে বলেন, কিন্তু ভাসিয়ে যাব না, যাওয়ার আগে তোমার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।

তুমি যদি চলেই গেলে, কোন ব্যবস্থা নিয়ে আমি সুখে থাকব? তা ছাড়া, বিনোদিনী উদবিগ্ন হন, তোমার সঙ্গে থাকার আগে একরকম ছিল, এখন যে দলের লোকেদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পালটে গেছে। আমার জন্য তুমি দল গড়ে দিলে আর সেটার মালিক হল পাঁচভূতে। আমি এখন ফেলনা।

তা হতে দেব না বিনোদ, গুরমুখ দৃঢ়স্বরে বলেন, তুমি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছ আর স্টারের পেছনে তোমার ভূমিকা কতটা তাও আমি জানি। এবার আমার সব শেয়ার তোমার নামে ট্রান্সফার করে দেব। তুমি হবে স্টারের অংশীদার।

কিন্তু তা হল না। গিরিশরা হতে দিলেন না। একজন বারাঙ্গনার অধীনে কাজ করতে কেউই রাজি হলেন না। বিনোদিনীকে মানাতে না পেরে গিরিশ তার মায়ের কাছে গেলেন মধ্যস্থতার জন্য। বিনোদিনী গো না ছাড়লে সমূহ বিপদ। থিয়েটার লাটে উঠবে।

জলের দরে এগারো হাজার টাকায় স্টার কিনে নিলেন গিরিশের সহযোগী চার অংশীদার অমৃতলাল বসু, দাশুচরণ নিয়োগী, হরিপ্রসাদ বসু ও অমৃতলাল মিত্র। আবার বঞ্চিত হলেন বিনোদিনী।

পুরনো প্রেমিক চলে গেছে, গুরমুখ সরে গেল, গিরিশ ছলনা করলেন, নাটকের সহশিল্পীরাও দূরে সরে গেছে। রাশিরাশি ভক্ত দর্শকেরা আছে, কিন্তু রঙ্গপটের আলো নিভে গেলে তারাও মিলিয়ে যায়। নিজের মানুষ বলে কেউ নেই।

এই অবস্থায় মাত্র একজনের কাঁধেই মাথা রেখে কাঁদবার জায়গা খুঁজে পেলেন বিনোদিনী, তিনি জ্যোতিঠাকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *