লখাই সেনেদের মনেরপাড় পুকুরের ধারে আসতেই বাসন মাজতে মাজতে অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে একটি ঝি বলে উঠল, কী গণ্ডগোল করেছ তুমি যে, কোম্পানি কত্তাদের চিঠি দিছে?
লখাই কোনও জবাব না দিয়ে অগ্রসর হল। বুঝল ব্যাপারটা রটে গেছে চারিদিকে। ঝি-চাকর পর্যন্ত জেনেছে। বাইরের কাছারিবাড়ির আমলারা সকলেই আজ নতুন করে তাকাল তার দিকে।
কেবল কোতলবাবু নিষ্ঠুরভাবে হেসে উঠে বললেন, কখনও সোনা, কখনও ধুলোকণা। এক দিন মোহর নিয়ে গিয়েছিলি, আজ কয়েকখানায় চল্।
লখাইয়ের আজ মনে একটা সাড়া পড়ে গেল। আমলা একজন ছুটে গেলেন কর্তাকে খবর দিতে।
লখাই যেন এক আদিম বন-মানুষের মতো সভ্য-জগতের দর্শকদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। খবর এল কর্তার খাস কামরায় যাওয়ার হুকুম আছে, আর কেউ যেন সঙ্গে না যায়।
খাইয়ের কানে এল অন্তঃপুরের মেয়েদের ফিস্ক্ষা, দু-একটি বিস্মিত মুখ উঁকি দিল তাকে দেখবার জন্য। তার ঘরের দরজায় এসে হঠাৎ লখাইয়ের পা দুখানি যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। জোর করে কোনওরকমে ঢুকে সে গড় করল। চকিতে কর্তার মুখোনি তার দৃষ্টিপথে পড়েছিল। সর্বনাশ! মানুষের মুখ নয়, যেন চাপা রাগে স্ফীত সিংহের গম্ভীর মুখ। দিবাবিশ্রাম-হীনতায় চোখ জোড়া ঈষৎ লাল মুখও তাই। কুঞ্চিত দৃষ্টি স্থির।
লখাই উঠল কিন্তু মাথা তুলল না।
কর্তার গম্ভীর গলা গমগম্ করে উঠল, মুরলীদাসের আখড়ার ঘটনা তুই তো আমাকে বলিসনি।
স্তিমিত গলায় জবাব দিল লখাই, ভরসা পাইনি হুজুর।
আজ তোর ভরসা কোথায়?
লখাই নিরুত্তর।
কত আবার বললেন, গোরাদের সঙ্গে বিবাদের দুঃসাহস তোর হল কোত্থেকে? সেদিন যদি গোরারা তোকে কিছু বলত তুই কী করতিস্? ওদের মারতিস?
লখাই সত্যি কথাই বলল, হুজুর, বোধ হয় তাই।
কর্তার ক্রোধের চেয়ে বিস্ময়ের মাত্রাই অপরিসীম হয়ে উঠল। একবার থেমে তিনি হঠাৎ বললেন, তোকে আমি কয়েদ করব হতভাগা, কোম্পানির ইংরেজদের গায়ে হাত তুলতে যাস্ তুই। জানিস, তোর কত কোম্পানির দেওয়া দৌলতেই তোকে পোষে।
লখাই নির্বাক। নত হয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে রইল শেষ হুকুমের প্রত্যাশায়।
কর্তা একখানি কাগজ নিয়ে কী এক রহস্যে যেন নরম গলায় বললেন, এতে কী লিখেছে আমাকে, জানিস? লিখেছে, তোমার ধর্মান্ধ দুঃসাহসী প্রহরী আমাদের এবম্বিধ বিধর্মীর আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে এসেছিল। আমাদের বলেছে, কামান থাকলে সে আমাদের মাথা উড়িয়ে দিত। আমরা জিজ্ঞেস করি তার মনিব শ্ৰীযুত সে মহাশয়ের গৃহে কখানি কামান আছে?
বলতে বলতে তার গলার স্বর চেপে এল। বললেন, এ অপমানের অর্থ তুই বুঝি? তারা জুতো পায় দিয়ে এসেছিল, মুরলীদাস তাদের বলতে পারে, তুই কেন খেপলি? তোর মনে ছিল না তুই সেনেদের হুকুমবরদার?
লখাই হঠাৎ সেনকর্তার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, আমার পান মানেনি, হুজুর!
কর্তার মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। কিন্তু সে লালমুখ জ্বলন্ত নয়, অস্তমিত সূর্যের পশ্চিম আকাশের মতো তা ম্লান। তাঁর ক্রোধ কোথায়? অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন লখাইয়ের বলিষ্ঠ শরীরটার দিকে। তার পর খানিকক্ষণ পায়চারি করে বললেন, আগের দিন হলে তোকে হয় তো কয়েদ করতুম, কিন্তু আজ আর সে ইচ্ছে নেই, সে দিনও নেই। আইনত, ইংরেজ আমাদের কয়েদখানার অধিকার নষ্ট করে দিয়েছে। দেওয়ানি ছেড়ে আমরা সব কোম্পানির চাকুরে হয়ে পড়েছি। আমাদের
বলতে বলতে তিনি হঠাৎ থামলেন। এ কী করছেন তিনি। ঘরোয়া কথা বলছেন তিনি তাঁর এক বন্দুকধারী প্রহরীর কাছে? নিজের প্রতি ধিক্কারে স্তব্ধ হলেন। কীসের এত দুর্বলতা তাঁর লখাইয়ের প্রতি? মনসার সন্তান বলে?
মনসার সন্তান! হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, মনসার ছেলে তুই? না, তোকে আমি আর কিছু করব না, খালি বরখাস্ত করলাম। চটকলের সাহেবরা আমাকে কোনও নির্দেশ না দিলেও তোকে আমি জবাব দিলাম। তবে সাহেবরা লিখেছে, তোর মত লোক যদি তাদের বিশ্বস্ত হয়ে কাজ করে, তবে তোকে চায়। তোর অতীতের ইতিহাস তারা চেয়েছে আমাদের কাছে। তুই যাবি সাহেবদের কাজে?
লখাই মাথা নিচু করে নিরুত্তর রইল। কর্তা কী ভেবে বললেন, আচ্ছা তুই যা, তোর উপর বাকি হুকুম তুই কাল সকালে কাছারিতে জেনে যাস্।
আবার রয়ে গেল বাকি হুকুমের ধুকপুকুনি।
পরদিন কাছারিতে একজন বৃদ্ধ কর্মচারী একটি কাগজে তার টিপসই নিয়ে চারটি টাকা নিয়ে বললেন, তোমার মাসিক বেতন। বলে আর একখানি কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলেন। পূর্ব প্রতিজ্ঞামতো আমি লক্ষীন্দর মৈত্রকে বসতবাটি স্থাপনের জন্য হালিশহর পরগনায় জগদ্দলের আগুঁড়িপাড়ার সন্নিকটে তিনবিঘা জমি দানপত্র লিখিয়া দিলাম। তার পর লখাইয়ের জীবনবৃত্তান্তটুকু পড়ে কর্মচারীটি শেষ কথাটি পড়লেন, প্রকৃতপক্ষে উক্ত লক্ষীন্দর আমার শক্রর কাজ করিয়া থাকিলেও আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ অনুচিত জ্ঞানেই এই দান দেওয়া হইল।
সেনবাড়ি থেকে ফেরবার পথে কোতলবাবু কুটিল হাসি হেসে বললেন, ব্যাটা, জাদুটা আমাদের একটু শিখিয়ে দিতে পারলিনে, তরে যেতাম! তবে খুব সাবধান, এখান থেকে পার পেলেও গোরারা তোকে ছাড়বে না।