পুরুষ তো কম ঘাটল না সে, সেই তেরো বছর বয়সের থেকে আজ পূর্ণ তেত্রিশ। ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুরুষের আদ্যোপান্ত ঠিকে নিয়েছে সে। তবু বুঝি কিছু বাকি ছিল। নইলে এই ছেলেটিকে দেখে তার মন মায়ার্দ্র হবে কেন।
পঞ্চাশ টাকায় রাজি হয়ে গেছে সে। ফুঃ। পঞ্চাশ টাকা। তার হাতের ময়লা এখন। চা বানাতে বানাতে সে ভাবে, টাকাটা যাবার সময় ফেরত দিয়ে দেবে।
বস্তুত, দরদস্তুরি করার সময় হাসিই পাচ্ছিল তার। সে হেঁকেছিল পাঁচশো। ছেলেটা ভয়েভয়ে থেমে থেমে বলেছিল পঞ্চাশ, শুধুমাত্র পঞ্চাশই সে দিতে পারে। এবং শরীর নয়, শরীরের কিছু চাহিদা নয়, সে শুধু চায় কথা বলতে। বেশিক্ষণ নেবে না সে। পঞ্চাশ টাকায় যতটা সময় পাওয়া যায়।
সে জানে ছেলেটা সত্যি বলছে। কোমরের ঘুনসিতে হাজার হাজার টাকা ঢুকিয়ে পকেটে রাখা তিনখানা ময়লা একশো টাকার পাত্তি ঠেকানোর মানুষ এ নয়। ছেলেটাকে ঘরে বসিয়ে রান্নাঘরে এসেছে সে। চায়ের জল ফুটছে। সে পাতা দিল। একটু বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চা করবে আজ। বেশি করে বিস্কুট দেবে। আহা রে! ছেলেটার মুখটা কেমন
শুকনো শুকনো। চোখ কেমন ভেবলু মেরে আছে। ইচ্ছে করে তার, আঁচল দিয়ে মুখ পুছিয়ে দেয়।
ফুটন্ত জল কীরকম ঘন খয়েরি হয়ে যাচ্ছে। যেন ঠাকুরমার পানের ডাবরে খয়েরগোলা। দুধ দিলেই কীরকম বুজরুড়ি কেটে উপচোবে সে দেখার মতো।
ছেলের কথা মনে পড়ে তার। বছর দুই বাদে গোঁফ-টোফ ভাল করে গজালে এরই মতো দেখতে হবে ছেলেকে। কেন-না এরই মতো ফিটফরসা ছেলে তার। এরই মতো উঁচা লম্বা। এই পরিবেশ থেকে দূরে রাখবে বলে একেবারে বাচ্চাবেলায় হস্টেলে দিয়ে দিয়েছে সে ছেলেকে। বলতে নেই, শুধু দেখনদারিতে নয়, ছেলে তার পড়াশোনায়ও ভাল। তার নিজের বিদ্যে ক্লাস এইট। পরে অবশ্য দায়ে মাথা ঠুকে বইপত্তর কিছু পড়েছে। সংগঠন করতে গেলে পড়তে হয়। দেশ-বিদেশের খবর না রাখলে চলবে কেন!
মাঝে মাঝে হস্টেলে গিয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলে যখন, টের পায়, ছেলে অনেক জানে। খবর রাখে অনেক বেশি। সারা দিন পড়ে কত। সেই ফাস্টসকালে ইস্কুল। খুব মন পড়ায়। কে জানে, কোন বীজ এসে গর্ভে ঢুকেছে। গায়ে-গতরে চেনাই ছিল তখন, এমন মুটিয়ে যায়নি, এক বাবু তো আদর করে নামই দিয়ে ফেলল কৃষ্ণকলি। প্রায়ই আসত আর আদর করে ডাক দিত কৃষ্ণকলি! সে-ও দিব্যি উ, যাই, আসি বলে জবাব দিত। কী গেছে সেই সব দিন। খুব কামিয়েছে। দিনে পাঁচজন খদ্দের পাওয়া ব্যাপারই ছিল না। তারই মধ্যে কারও একটা লেগে গিয়েছিল।
প্লেটে বিস্কুট সাজায় সে। চায়ের কাপের চিনি গোলে। একবার উঁকি মেরে দেখেও নেয় ছেলেটাকে। কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে। আর কোনও দিকে নজর নেই। উশখুশ করা নেই। মজিনিসের দোকান থেকে একটু খাবার আনিয়ে দিলে হত।
দুর দুর! নিজেকেই সে শাসন করে। অন্ত আদিখ্যেতায় কাজ নেই। ভাল মানুষই লাগছে বটে কিন্তু একেবারেলে পড়ার কী দরকার। আরও তো দিচ্ছে না!
তবে এটাও ঠিক,চা নিয়ে যেতে যেতে সে ভাবে যে এটাও ঠিক, শয়ে শয়ে পুরুষমানুষ এসেছে, গেছে কিন্তু কেউ চাষ্ট্রি কথা বলার জন্য এমন কাতরায়নি।
ছেলেটার সামনে চায়ের কাপ ও বিস্কুটের প্লেট রাখে সে। তারও চা আছে কিনা, বিস্কুট আছে কিনা জানতে চায় ছেলেটা, সে তখন নিজের কাপ আনতে যায়। ট্রে আছে, তাতে চড়িয়ে একবারে নিয়ে গেলেই হত। কেতাকানুন সম্পূর্ণ রপ্ত করার খুব চেষ্টা করে সে। কিন্তু পেরে ওঠে না। ভুল হয়ে যায়।
চায়ের কাপ হাতে সে ছেলেটার মুখোমুখি এসে বসে। ছেলেটা তার দিকে চায়। আবার চায়ও না। সে বুঝতে পারে। তার দেহ এখানে আছে, মন নেই। এই ব্যাপারটা সে খুব ভাল বুঝতে পারে। কারণ তার কাছে, এই গোটা বেশ্যাপাড়ায় যারা আসে তারা কেউ মন আনে না। চৌকাঠে খুলে রাখা জুতোর মতো মন রেখে আসে বাইরে। শুধু শরীর আনে। তারাও মন-টনের ঝামেলা পোয়াতে চায় না। তারাও যে রাস্তার ধারে সেজে-গুজে বসে বসে থাকে, বুকের ড্যালা বের করে, ঠোঁটে রং মেখে—সেও তো শরীরটাই পসরা করে বলে।
শুন্য কাপ-প্লেট নিয়ে উঠে আসে সে। ধোয়, তার তাড়া নেই। ছেলেটা আড় হয়ে আছে, বরং একটু সময় দেওয়া যাক।
চিন্তার সূত্র ধরে সে। মন নিয়ে বেশ্যাবাড়ি ঢুকে পড়া কোনও দিনই হয়নি এমন নয়। হয়েছে কালে কালেই। এখনও হয়, লাইনের মেয়ে ক্লায়েন্টের প্রেমে হাবুডুবু খায়। ক্লায়েন্টও তখন জগৎ সংসার ভুলে সেই মেয়ের পিছন-পিছন ঘোরে। পয়সা থাকলে বাবু তখন মাসি রাখে। পয়সা
থাকলে ভেড়ুয়া বনে যায়। খানকি সারাদিন রোজগার করে যখন যেটুকু সময় দেয় তাই নিয়েই খুশি।
বিয়েও হয় মাঝে মাঝে খুব কম। বেশির ভাগই চিরন্সলের প্রতিশ্রুতি হয়ে থাকে। এবং, বিয়ে হলেই সে-বিয়ে টিকে যায় না। কদিন বাদেই দেখা যায় লাইনের মেয়ে লাইনে ফিরে আসে।
আবার রেন্ডির মনে প্রেমের ভাব জমলে খুব রেগে যায় ঢেমনা খচ্চর মালকিনগুলো। তাদের তখন হেভি লস। মেয়েটা সারাদিন নাগরের সঙ্গে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করবে। আর কোনও বাবু বসাতে চাইবে না। হঠাৎ সিঁদুর-মিদুর পরা শুরু করে বিধবার গোবরজল হয়ে থাকবে। শাসালো ক্লায়েন্ট এলেও ঢঙ করে বলবে সে লাইন ছেড়ে দিয়েছে। হুঁ। লাইন ছাড়া যেন শায়া খোলার মতো। অত সোজা! একবার খাতায় নাম উঠলে আর মোছে নাকি! যতই চঁাচানো হোক, যতই অধিকার করে দেশেবিদেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো যাক, কিছু সুবিধা আদায় হয় ঠিকই, কিন্তু শালার বেশ্যা বেশ্যাই থাকে। মানুষ হয় না। নারী হয় না। মহিলা হয় না। এমনকী মেয়েছেলেও হয় না। পুরুষ বেবুশ্যেগুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ।
কেউ প্রেমে পড়লে কুটনি মাসিগুলোর খুব রাগ। কামাই হয় না যে। অনর্গল রাঢ়ে ছেলেটার গুষ্টির তুষ্টি করে। সারাজীবন মাগি গতর খাটায়, তারপর বুড়ি হলেই ঘরটর কিনে মালকিন সেজে বসে। আদরের মাসি। কুটনি মাগি।
তার জীবনে অবশ্য আসেনি এসব কিছু। এই প্রেম-ভালবাসা। এই মাগি রাখা বাবু। তার জীবনে সব এসেছে আর গেছে। যত দিন সুন্দর ছিল, মুটিয়ে যায়নি, তখন লোকে ঘুরে-ফিরে আসত। ব্যস ওইটুকুই।
অবশ্য বাধা বাবু পেলে সে নিত কিনা সন্দেহ। কারণ বউ নয় কিন্তু বউয়ের মতো দাসীবাদি হয়ে থাকা তার পোষাবে না। বাবু এসে যখন খুশি মারবে, রাজি নেই অরাজি নেই, গায়ে-গতরের অসুখ-বিসুখ ভাল-মন্দ নেই, জানালা দিয়ে তাকাতে অব্দি পারবে না, ইচ্ছে হলেও অন্য বাবু ডাকতে পারবে না, বেগড়াই বেশি করলে বাবু এমনকী লাঠিপেটাও করতে পারেন। পোষাবে না। পোষাবে না তার। পুরুষমানুষ মানেই তাড়। যত ভালমানুষই হোক না কেন, ধন থাকলেই তঁাদড়ামি থাকে। কোনও পুরুষের সঙ্গেই সে পাকাপাকি থাকতে পারবেনা। এমনকী নিজের ছেলের সঙ্গেও না।
রেন্ডিগুলো বউ সেজে যে কী আনন্দ পায় কে জানে। সে এসবের থই পায় না। কী-ই বা তফাত গৃহবধুর সঙ্গে বারবধুর? ওরা দেয় শরীর আর মন, বিনিময়ে পালন-পোষণ পায়। তারা দেয় শুধু শরীর। বিনিময় প্রায় একই। পালন-পোষণ কিংবা অর্থ। মনই বা কটা বউ সত্যিকারের দেয় তার স্বামীকে? দিতে পারে ক’টা বউ! দেয় না। দিতে পারে না। দেওয়ার ভান করে মাত্র। অতএব এই দুনিয়া জুড়ে শুধুই শরীর-শরীর খেলা। আরে কে বেশ্যা, কে বধু ঠিক করে দিল কারা? সমাজের গোটা ক’জন ধরে-বেঁধে বলে দিল এই মেয়েটা এই ছোলসঙ্গে শোবে। ব্যস হয়ে গেল বর বউ। আর বহু পুরুষ চড়ালেই সব বেশ্যা। সব বেশ্যা। আক্ থুঃ। সমাজের চাদমুখে সে মুতে দেয়। এবং যত বার সমাজ’ শব্দটা সে ভাবে, তত বার, সে জানে না কেন, তার চোখে ভাসে অসংখ্য পুরুষের শক্ত, রাগত, নির্মম মুখ।
ছেলেটির মুখোমুখি এসে সে বসে আবার। দু’হাত মাথার পেছনে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে। ভাল-জৌড়-ডিমের। ছেলেটা লাগাতে আসেনি। কথা বলতে এসেছে। এসে মুখে কুলুপ এঁটেছে। আশ্চর্য। ছেলেটাকে ধ্বজভঙ্গ বলেও তো মনে হচ্ছে না। ধ্বজভঙ্গদের অবশ্য বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। কত রকমই না জুটেছে তার। একবার এক ধ্বজভঙ্গের কী কান্না! পারবে না বলে কী আফসোেস। ওফ! শেষে সারাক্ষণ আঙলি করে গেল। কী অস্বস্তি। পরে ওই লোক চাইলেও সে আর নেয়নি। খেয়ালি আর বদমেজাজি রেন্ডি বলে এ পাড়ায় বদনাম আছে তার।
পাক বদনাম। সে জানে তার সংকল্পগুলো ভাল। যত দিল গতর দেয়, কামিয়ে নেবে। তারপর ঘরবাড়ি কিনবে। কিনে মাসিও হবে না। এই এলাকা থেকে চলেও যাবে না। খানকির ছেলেগুলো পেট থেকে পড়েই রাস্তায় ঘোঘারাঘুরি করে। এই সব বন্ধ করবে সে। বেশ্যার ছেলেকে দালাল, হতে দেবে না আর। খানকির মেয়েকে নতুন করে রেন্ডি বানাবে না। সে একটা ইস্কুল করবে। অনাথদের জন্য হোম। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জানা আছে তার। কথাও বলেছে সে কয়েকটির সঙ্গে। টাকারঅভাব হবে। শুধু মনের জোর চাই। আর ইচ্ছা। তার কাজে উৎসাহ দেবার জন্য অনেক লোক থাকবে। বাধা দেবার লোকও কম পড়বে না।