১৬. পালাচ্ছে রবিন
ভাগ্যিশ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল, ফিনসবারি ময়দান ছেড়ে ওরা যখন মাইল চারেক গেছে, ঠিক তখনই ভিড় ঠেলে এসে হাজির হলো রাজার ছয়জন দেহরক্ষী রবিন ও তার বন্ধুদের বন্দী করতে। হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপের প্ররোচনায় শপথ ভঙ্গ করে দস্যু রবিনকে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন রাজা হেনরী, কাজটা উচিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, ভালমত না বুঝেই।
প্রতিযোগিতা শেষ হতেই ময়দান ছেড়ে নিজের ক্যাবিনেটে ফিরে এসেছেন রাজা। তাঁর সাথে সাথে এসেছেন হেরিফোর্ডের বিশপ আর স্যার রবার্ট লী। কিন্তু কারও সাথে একটি কথাও না বলে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভুরু কুঁচকে কি যেন চিন্তা করছেন রাজা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অন্তরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তাঁর আজকের এই ঘটনায়। কিছুতেই হজম করতে পারছেন না তিনি বাজিতে হেরে যাওয়ার অপমান।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় কথা শুরু করলেন বিশপ, সত্যিই, বড়ই পরিতাপের বিষয়, ইয়োর ম্যাজেস্টি, হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরা যাচ্ছে না বদমাশটাকে! একবার নিরাপদে শেরউড জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতে পারলে কিন্তু বগল বাজাবে লোকটা, গলা উঁচু করে বলবে সবাইকে, কলা দেখিয়ে এসেছি মহামান্য রাজা হেনরীকে।
চোখ গরম করে বিশপের দিকে চাইলেন রাজা। ‘তাই বলবে বুঝি?’
‘তা তো বলবেই,’ বললেন বিশপ। ‘কোন সন্দেহ নেই তাতে। আর একবার শেরউডে পৌঁছে গেলে ফের ওর নাগাল পাওয়া সম্ভব হবে না।’
‘তাই মনে হচ্ছে আপনার,’ রললেন রাজা। কিন্তু এ ভুলটা ভেঙে যাবে আপনার শীঘ্রিই। চল্লিশটা দিন পার হতে দিন, তারপর দেখাবো আমি কাকে বলে তেলেসমাতি। দরকার হলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব গোটা শেরউড জঙ্গল। রাজার ক্ষমতা কতখানি সেটা কল্পনাও করতে পারছে না ও। কতদিন পারবে সে টিকতে?-বাহিনীর পর বাহিনী পাঠাবো, যেমন করে হোক ধরে আনবো ওকে জীবিত বা মৃত।’
নরম মসৃণ কণ্ঠে বললেন বিশপ, ‘ক্ষমা করবেন, ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার সাথে আমি ঠিক একমত হতে পারছি না। দয়া করে একে ঔদ্ধত্য মনে করবেন না। আসলে ইংল্যাণ্ড ও তার রাজার মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই বলছি কথাটা-গোটা শেরউড মাটিতে মিশিয়ে দিলেই কি ধরা পড়ে যারে বদমাশটা? আর জঙ্গল নেই? শেরউডের কাছেই রয়েছে ক্যানক চেজ, সেখানে গিয়ে ডেরা বাঁধতে অসুবিধে কোথায় তার? জঙ্গলের তো কোন অভাব নেই; নটিংহাম, ডার্বি, লিংকন, ইয়র্ক….আর কত নাম করবো, সব অঞ্চলেই রয়েছে বিশাল সব জঙ্গল-লুকানোর জায়গার অভাব পড়বে না তার; খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সূচের মত গায়েব হয়ে যাবে ও। না, ইয়োর ম্যাজেস্টি, একবার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে চিরকালের মত হারাতে হবে আপনার তাকে।’
বিরক্ত ভঙ্গিতে টেবিলের ওপর দু’আঙুলের মাথা দিয়ে টপাটপ তবলা বাজালেন রাজা। তাহলে কি করতে বলেন আপনি আমাকে, বিশপ?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন তিনি। ‘রানীকে কি কথা দিয়েছি শোনেননি আপনি? পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া কয়লায় অযথা ফুঁ দিয়ে লাভ আছে কিছু?’
‘না, মাইগ্রেশাস লর্ড, চাতুর্যের আশ্রয় নিলেন এবার বিশপ, আপনার মত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজাকে কোন পরামর্শ দেয়ার মত ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে জিজ্ঞেস করছেন বলেই বলছি, আমি যদি ইংল্যাণ্ডের রাজা হতাম, ব্যাপারটাকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখতাম। আমি চিন্তা করতাম, লোকগুলোর পরিচয় প্রকাশ না করে রানী আমার কাছ থেকে ঝটপট্ করে ভাবনা-চিন্তার সুযোগ না দিয়েই একটা শপথ আদায় করে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যখনই জানতে পারলাম লোকগুলো রাষ্ট্রদ্রোহী ভয়ঙ্কর দস্যু, তাদের হাতের মুঠোয় পেয়েও কি ছেড়ে দেয়া উচিত হবে আমার? গোটা দেশের স্বার্থ জড়িত রয়েছে এর সাথে। ধরুন, রানীকে কোন দুর্বল মুহূর্তে বললাম- তুমি যা বলবে তাই করবো, রানী যদি বলেন-আত্মহত্যা করো, ব্যাস, ঘ্যাচ করে বুকে ছোরা বসিয়ে দেয়া কি উচিত হবে আমার? হাজার হোক, মহামান্যা রানী একজন স্ত্রীলোক বই তো নয়, রাষ্ট্রীয় কঠিন সব ব্যাপার বোঝা তাঁর কর্ম নয়, এই বিশেষ দস্যুর কিছু কিছু কীর্তিকলাপ শুনে হয়তো মুগ্ধ হয়েছেন তিনি সাময়িকভাবে, কোন সন্দেহ নেই দু’দিন বাদেই এর ব্যাপারে সমস্ত আগ্রহ হারাবেন তিনি। আমার কি উচিত হবে এই মুহূর্তে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পর তাকে বনে-বাদাড়ে তাড়া করে বিফল হয়ে সবার কাছে হাস্যাস্পদ হওয়া?’ এইভাবে একের পর এক দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সুচতুর ভাবে বাক্য সাজিয়ে চললেন বিশপ। শুনতে শুনতে মত পরিবর্তন করে ফেললেন রাজা। হঠাৎ আদেশ দিলেন স্যার রবার্ট লী-কে, যেন এক্ষুণি রক্ষী পাঠিয়ে ধরে নিয়ে আসেন রবিন হুড আর তার তিন সঙ্গীকে।
অত্যন্ত ভদ্র এবং মহৎ হৃদয়ের অধিকারী বলে খ্যাত স্যার রবার্ট লীর খুবই খারাপ লাগলো রাজার কথার এরকম বরখেলাপ হতে দেখে, কিন্তু মুখে তিনি কিছুই বললেন না। সাথে সাথেই রক্ষী-দল না পাঠিয়ে প্রথমে সোজা গিয়ে দেখা করলেন তিনি রানীর সাথে। রবিন হুডের প্রতি কোন রকম দুর্বলতার জন্যে নয়, রাজার সম্মান রক্ষার জন্যেই তিনি আগে-ভাগে খবরটা জানিয়ে রবিন হুডকে সতর্ক করে দেয়ার পরামর্শ দিলেন রানীকে, গ্রেফতারের জন্যে যখন লোক পাঠালেন, তখন বেশ কয়েক মাইল দূরে সরে গেছে রবিন ও তার সঙ্গীরা। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাজাকে গিয়ে খবর দিলেন, ফিনসবারি ময়দানে পাওয়া গেল না ওদের।
রবিন হুড, লিটল জন, উইল ও অ্যালান যখন রওনা হয় তখনই দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। হলুদ তেরছা রোদের মধ্যে দিয়ে খুশি মনে লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলেছে ওরা। লালচে হয়ে এলো রোদটা, পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে এখন সূর্য, ছায়াগুলো দীর্ঘ হতে হতে দৈত্য হয়ে উঠেছে। তারপর একসময় মিলিয়ে গেল সব ছায়া স্নান গোধূলির সাথে। কালচে হয়ে গেল ধূলি-মলিন সাদা রাস্তার দু’পাশে ঝোপঝাড়গুলো। হাঁটছে ওরা, যেন চারটে ছায়া। ধীরে ধীরে প্রকাণ্ড চাঁদ উঠলো পুবের আকাশে। মনে হচ্ছে, দম আটকে রেখে ঝুলছে গোল চাঁদটা। দূরে টিপ টিপ করছে বার্নেট শহরের বাতিগুলো। লণ্ডন থেকে বারো মাইল সরে এসেছে ওরা।
বার্নেট শহরের পাথুরে রাস্তা ধরে চলতে চলতে ছোট্ট একটা সরাইখানা দেখে থেমে দাঁড়ালো রবিন। ‘এখানেই রাতটা কাটিয়ে দিই, কি বলো তোমরা? অনেক দূর তো সরে এসেছি লণ্ডন থেকে।
‘ঠিক,’ বললো লিটল জন। ‘তোমার কথা আর আমার কাজ-এক্কেবারে খাপে খাপে মিলে যায়, ওস্তাদ। এখানেই ঢুকে পড়া যাক।’
‘কিন্তু, মামা,’ আপত্তি জানালো উইল স্কারলেট। আরো খানিক দূর এগিয়ে গেলে বোধহয় ভাল হতো। যথেষ্ট দূরে সরে এসেছি বলে মনে হচ্ছে না আমার। যাই হোক, তুমি যখন বলছো…’
ঢুকে পড়লো ওরা সরাইখানায়। সেরা খাবার আর মদের অর্ডার দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল সবাই। সুন্দরী এক তরুণী খাবার সাজিয়ে দিল টেবিলে। তার প্রতি লিটল জনের একটু অতি-আগ্রহ দেখে তাই নিয়ে রসিকতা করলো রবিন। হাসি-গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তৃপ্তির সঙ্গে পেট পুরে খেয়ে নিয়ে হাতে তুললো মদের গ্লাস। পরস্পরের গ্লাসের সাথে ঠোকাঠুকি করে নিয়ে একটা চুমুক দিতেই সরাইখানার মালিক এসে হাজির হলো, খবর দিল, রিচার্ড পার্টিংটন নামে মহামান্যা রানীর একজন সুদর্শন পরিচারক দেখা করতে চায় নীল পোশাক পরা যুবকের সাথে। গ্লাস নামিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো রবিন, সরাইখানার মালিককে সাথে আসতে বারণ করে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে বাকি সবাই।
চাঁদের আলোয় দুধ-সাদা ঘোড়ায় চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিচার্ড পার্টিংটন, হাসিমুখে রবিন বললো, ‘কি খবর, পরিচারক মশায়? আবার কোন খারাপ সংবাদ নেই তো?’
‘আছে, জবাব দিল পার্টিংটন। ‘খুবই খারাপ সংবাদ বয়ে এনেছি আমি। হেরিফোর্ডের বিশপের প্ররোচনায় ভয়ঙ্কর খেপে গেছেন রাজা। আপনাদের গ্রেফতার করার জন্যে লোক পাঠানো হয়েছিল ফিনসবারি ময়দানে। সেখানে না পেয়ে সেনাবাহিনী তলব করেছেন তিনি। এক হাজারেরও বেশি সৈন্য পাঠানো হচ্ছে এই রাস্তা ধরে শেরউডের দিকে, পথে পেলে পথেই গ্রেফতার করবে আপনাকে, না পেলে সোজা এগিয়ে গিয়ে আপনার শেরউডে ঢোকার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেবে। বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হেরিফোর্ডের বিশপকে। ওই লোকটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনাকে নতুন কিছু জানাবার দরকার নেই-হাতে পেলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে সে আপনাকে। ইতিমধ্যেই ঘোড়সওয়ারের দুটো দল রওনা হয়ে গেছে, এখানে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগবে না ওদের। আমাকে রানী এলেনর পাঠিয়েছেন আপনাকে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে। আর এক মুহূর্ত এখানে দেরি করা উচিত হবে না আপনার।’
‘ধন্যবাদ,’ আন্তরিক কণ্ঠে বললো রবিন। ‘বুঝতে পারছি, আমার জীবনের এক চরম মুহূর্ত এসে হাজির হয়েছে। এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে অস্ত্র বা গায়ের জোরে চলবে না, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা হবে আমার হাতিয়ার। ঠিক আছে, আমার সমস্ত ক্ষমতার পরিপূর্ণ প্রয়োগ প্রয়োজন পড়বে এবার, তাই করবো। রানীকে গিয়ে বলবেন, তিনি আমার জন্যে যেটুকু করেছেন তাতেই আমি ধন্য হয়ে গিয়েছি, আমি জানি অবস্থার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই—যদি ধরা পড়ে মারা যাই, তাঁকে কোন রকমে দায়ী মনে করবো না। বিদায়।’
‘বিদায়। প্রার্থনা করি, যেন নিরাপদে পৌঁছতে পারেন শেরউডে।’
করমর্দন করে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লণ্ডনের দিকে রওনা হয়ে গেল রিচার্ড পার্টিংটন, সরাইখানায় গিয়ে ঢুকলো রবিন হুড।
উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছে ওর সঙ্গীরা। সরাইখানার মালিকও অপেক্ষা করছে ওদের সঙ্গে, ব্যাপার কি জানার জন্যে; রিচার্ড পার্টিংটনের এই আকস্মিক আগমনে দারুণ কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে তার মনে। উঠে পড়ো সবাই,’ বললো রবিন, পিছু ধাওয়া করেছে ওরা আমাদের, ধরা পড়ে গেলে রক্ষে নেই। আবার রওনা দিতে হবে আমাদের এক্ষুণি, সারা রাত হেঁটে এক্কেবারে সেই সেন্ট অ্যালবাসে পৌছে তারপর বিশ্রাম।’ সরাইখানার বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা ব্যস্ত পদক্ষেপে।
রাজপথ ধরে এগিয়ে শহরের বাইরে এসেই দাঁড়িয়ে পড়লো রবিন, সমস্ত ঘটনা খুলে বললো আর সবাইকে। তারপর বললো, এখান থেকেই দুটো দলে ভাগ হয়ে যাবে ওরা; লিটল জন, উইল স্কারলেট আর অ্যালান-এ ডেল ধরবে পুবের পথ, ও একা চলে যাবে পশ্চিম দিকে; রাজপথ পরিহার করে ঘুরপথে নানান অলিগলি ধরে পৌছবার চেষ্টা করবে শেরউডে। ‘প্রথম দু’দিন উত্তরের রাস্তায় যাবে না, বহুদূর পুবে সরে গিয়ে তারপর উত্তরের পথ ধরতে পারো, কিন্তু রাজপথ যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। তোমাদের তিনজনের নেতৃত্ব দিচ্ছি আমি উইল স্কারলেটের ওপর। উইল, বুদ্ধি খাটিয়ে দায়িত্ব পালন করবে, সবাইকে জীবিত অবস্থায় দেখতে চাই আমি শেরউডে।
অবাক হয়ে লিটল জন জিজ্ঞেস করলো, তবে যে বললে সেন্ট অ্যালবান্সের পথে সারা রাত ধরে…
‘সরাইখানার মালিকের মুখে এই কথা শুনে সেনা বাহিনী ভুল পথে আমাদের পিছু ধাওয়া করুক, তাই চেয়েছিলাম। রওনা হয়ে যাও তাহলে তোমরা। বিদায়!’ সবার গালে চুমো খেলো রবিন, ওরাও চুমো খেল রবিনের গালে। দুই ভাগ হয়ে দুই পথে রওনা হয়ে গেল ওরা।
এই ঘটনার পর বেশিক্ষণ যায়নি, সেনা বাহিনীর বিশ-পঁচিশজন ঘোড়সওয়ার এসে ঘিরে ফেললো বার্নেট শহরের সেই সরাইখানাটা। জনা চারেক লোক সাথে নিয়ে দলনেতা ঢুকলো ভেতরে, কিন্তু গিয়ে দেখলো খাঁচা শূন্য, উড়ে গেছে পাখি।
‘ওরা লোক যে ভাল নয়, এ আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম,’ কাকে খোঁজা হচ্ছে জানতে পেরে বললো সরাইখানার মালিক। রওনা হবার আগে নীল পোশাক পরা লোকটাকে বলতে শুনেছি, সোজা সেন্ট অ্যালবান্সের পথে হাঁটবে আজ সারারাত। এখুনি ছুটলে পথেই পেয়ে যাবে ওদের।’ মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে সাথে সাথেই বাইরে বেরিয়ে ঘোড়ায় চাপলো ওরা, কাল বিলম্ব না করে ছুটলো রাজপথ ধরে।
এদিকে অবিশ্রাম হেঁটে চলেছে উইল স্কারলেট, লিটল জন আর অ্যালান-এ-ডেল পুবের পথ ধরে; পরদিনও কোথাও থামলো না, যতক্ষণ পর্যন্ত পারা যায়, সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা, হাঁটতেই থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে এসেক্সের চেমসফোর্ডে এসে পৌঁছলো। ওখান থেকে বিশ্রাম নিয়ে আবার উত্তর মুখো পথ ধরে কেমব্রিজ আর লিংকনশায়ারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌছলো গেইবারো শহরে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে কোনাকুনি এগিয়ে পৌছে গেল শেরউড জঙ্গলের উত্তর সীমান্তে। পুরো আটদিন ধরে হেঁটেছে, কিন্তু পথে একটি সৈনিকের সাথেও দেখা হয়নি ওদের। নিরাপদে শেরউডে পৌঁছতে পেরে স্বস্তির বিরাট এক হাঁফ ছাড়লো ওরা, কিন্তু আস্তানায় পৌঁছেই মনটা কালো হয়ে গেল ওদের এখনও ফিরে আসেনি রবিন।
বার্নেট শহরের কাছে রাজপথ ছেড়ে পশ্চিম মুখো পথ ধরেছে রবিন, এইবারি ছাড়িয়ে অক্সফোর্ডশায়ারের উডস্টকে পৌঁছে আবার হাঁটতে শুরু করলো উত্তর দিকে। ওয়ারউইক শহর পেরিয়ে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ডাডলি শহরে পৌছতেই লেগে গেল ওর পুরো সাতদিন। যথেষ্ট উত্তরে আসা হয়েছে, আন্দাজ করে এবার পুবের পথ ধরলো সে। রাজপথের ধারে-কাছে ঘেঁষলো না, কখনো সরু রাস্তা, কখনো মেটো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে লিচফিল্ড আর অ্যাশবি ডি লা যুখের মধ্যে দিয়ে এগোলো শেরউডের দিকে। স্ট্যানটনে পৌঁছে খুশিতে নাচতে শুরু করলো ওর হৃদয়টা, হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে; ভাবছে, সব বিপদ কেটে গেছে, এই আর কিছুদূর এগোলেই জঙ্গলের গন্ধ আসবে নাকে। বেচারা জানেও না সামনে কতবড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে।
রাজার সেনা বাহিনীর প্রথম দলটা সেন্ট অ্যালবান্সে পৌঁছে বোকা বনে গেল। পথে পাওয়া যায়নি রবিন হুড বা তার সঙ্গীদের, শহরেও তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া গেল না ওদের। দফায় দফায় আসছে অশ্বারোহী সৈন্যের দল, ক্রমে গোটা শহরের চন্দ্রালোকিত রাস্তা বোঝাই হয়ে গেল; থতমত খেয়ে গেছে ওরা, কি করতে হবে বুঝতে পারছে না। ভোর-রাতের দিকে আরেক দল সৈন্য এলো, তাদের সঙ্গে এলেন হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ।
সব ঘটনা শুনে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না বিশপ, কাল বিলম্ব না করে সবাইকে নিয়ে ছুটলেন সোজা উত্তরে, একজনকে রেখে গেলেন সেন্ট অ্যালবান্সে আরও যে-সব সৈন্যদল আসছে তাদের তাঁকে অনুসরণ করতে বলার জন্যে। চতুর্থ দিনের সন্ধ্যায় পৌঁছলেন তিনি নটিংহাম শহরে, পৌঁছেই সেনা-বাহিনীকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করে চারপাশ থেকে শেরউড জঙ্গলে ঢোকার সমস্ত রাস্তা, গলি, উপগলি বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। নটিংহামের শেরিফ দেখলেন, এই সুযোগ, রবিন হুডকে ধ্বংস করার এমন মওকা আর পাওয়া যাবে না; কাজেই জঙ্গল-রক্ষী আর কনস্টেবলদের নিয়ে এক বিরাট বাহিনী তৈরি করে পাঠালেন রাজার সৈন্যদের সাহায্য করার জন্যে। এই কঠোর পাহারা অতিক্রম করে একটা কাকপক্ষিরও শেরউডে ঢোকার উপায় থাকলো না। প্রথমে বন্ধ করা হলো দক্ষিণের সমস্ত পথ, তারপর পুব ও পশ্চিমের সবগুলো রাস্তা, সবশেষে প্রহরার ব্যবস্থা হলো উত্তরে। উইল স্কারলেট, লিটল জন আর অ্যালান-এ-ডেল যেদিন উত্তর দিক থেকে জঙ্গলে ঢুকলো, তার পরদিনই বন্ধ হয়ে গেল সেদিকের সমস্ত পথঘাট; যদি একটা দিন দেরি করতো কোথাও, কোন সন্দেহ নেই, ধরা পড়তো ওরা হয় রাজা নয় শেরিফের লোকের হাতে।
এসব ব্যাপারের বিন্দু বিসর্গ জানে না রবিন, স্ট্যানটন ছাড়িয়ে মনের সুখে শিস দিতে দিতে চলেছে সে শেরউডের দিকে। পথের ধারে ছোট্ট একটা চঞ্চল ঝর্ণা দেখে তেষ্টা পেল ওর, নেমে গিয়ে দাঁড়ালো ঝর্ণার ধারে, আঁজলা ভরে পানি তুলে খাচ্ছে। পথের দু’পাশেই ছোট ছোট গাছ আর ঝোপ-ঝাড়ে ছাওয়া জঙ্গল, কিচির মিচির করছে পাখিগুলো, ওর মনে পড়ে যাচ্ছে শেরউডের কথা, পরিষ্কার বুঝতে পারছে কতটা ভালবাসে ও শেরউড জঙ্গলকে, মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে যেন শ্বাস নিতে পারেনি, জঙ্গলের বিচিত্র গন্ধ ভরা বাতাস বুক ভরে নিতে পারলে আসবে তৃপ্তি।
সামনে ঝুঁকে পানি খাচ্ছে রবিন, এমনি সময়ে সাঁ করে কানের পাশ দিয়ে চলে গেল কি যেন, ছপাৎ করে পড়লো পানিতে। তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রবিন, চোখের পলকে এক লাফে পেরিয়ে গেল ঝর্ণাটা, দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়লো ওপাশের ঝোপ- ঝাড়ের মধ্যে। একবারও পিছনে ফিরে চাইলো না সে, এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেই মৃত্যু ঘটবে এখন, কারণ কানের পাশ ঘেঁষে কি জিনিস গেছে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি তার—কোন সন্দেহ নেই, তীর মেরেছে কেউ। ঝোপের আড়ালে পৌঁছবার আগেই আরও ছয়টা তীর এসে বিঁধলো ওর আশেপাশে, একটা লাগলো ওর পাঁজরে-লোহার জাল দিয়ে তৈরি বর্ম পরা না থাকলে ওই এক তীরেই মারা পড়তো রবিন। ছুটে এসে রাস্তার ওপর থামলো কয়েকজন অশ্বারোহী সৈন্য, ঘোঁড়া থেকে লাফিয়ে নেমেই ধাওয়া করলো রবিনের পিছনে।
কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রবিনকে ধরা মুশকিল। কখনও কোমর বাঁকিয়ে নিচু হয়ে ঝুঁকে হাঁটছে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে, কখনও বা দৌড়ে পেরিয়ে যাচ্ছে ছোট ফাঁকা জায়গা—এইভাবে সৈন্যদেরকে বেশ অনেকটা পেছনে ফেলে পাঁচশো গজ দূরের আর একটা রাস্তায় উঠে পড়লো সে। কান পেতে শুনলো দূর থেকে ভেসে আসা সৈন্যদের হাঁকডাকের আওয়াজ, তারপর কোমরের বাঁধন এঁটে নিয়ে তীরবেগে ছুটলো নাক বরাবর পুব দিকে, শেরউডের উদ্দেশে।
আধ মাইলের মত দৌড়ে হঠাৎ একটা পাহাড়ের মাথায় থমকে দাঁড়ালো রবিন নিচে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় বসে রয়েছে আর একদল সৈন্য। যদিও ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তবু এখন যে পথে এসেছে সেই পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে। ভাগ্যিশ দেখতে পায়নি ওকে নিচের লোকগুলো! ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করলো রবিন। কপাল ভাল, ঝোপ-ঝাড় আর ছোট ছোট গাছের সেই জঙ্গলটা ছাড়িয়ে সিকি মাইল চলে যাওয়ার পর ওর পিছু ধাওয়া রত দলটা উঠে এলো রাস্তায়। ছুটন্ত অবস্থায় ওকে দেখতে পেয়ে যথেষ্ট শোরগোল তুললো, কিছুদূর পর্যন্ত তাড়াও করলো- কিন্তু পাখির মত ডানা গজিয়ে গেছে যেন রবিনের, প্রাণভয়ে উড়ে চলেছে সে রাস্তার ওপর দিয়ে, নাগাল পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে থেমে গেল দলটা। মাইলের পর মাইল দৌড়ে ডার্বি শহর সংলগ্ন ম্যাকওয়ার্থের কাছাকাছি এসে গতি কিছুটা কমালো রবিন। যখন মনে করলো এই মুহূর্তে বিপদের আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন দম নেবার জনে; বসলো এক ঝোপের ঠাণ্ডা ছায়ায়।
‘সেরেছিল!’ মনে মনে বললো রবিন, ‘আর একটু হলেই গেছিলাম আজ! ওই তীরের পালকগুলো, বাপ রে, কান ছুঁয়ে গেছে একেবারে! কিন্তু…খিদে আর তেষ্টার কি ব্যবস্থা করা যায়? এতটা দৌড়ে একেবারে খালি হয়ে গেছে পেটটা। সেইন্ট ডানস্ট্যান, জলদি কিছু মাংস আর বিয়ার পাঠাও, নইলে গেলাম!’
কাছাকাছি হয়তো ছিলেন, রবিনের কথাটা শুনে ফেললেন সেইন্ট, এবং সাথে সাথে মঞ্জুর করে দিলেন প্রার্থনা। ডার্বির এক মুচিকে দেখা গেল আসছে এদিকেই। কার্ক ল্যাংলির দিকে এক গেরস্তের জন্যে একজোড়া জুতো বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মুচি কুইন্স, ফিরে আসছে এখন। গেরস্ত ওকে তিন শিলিং ছয় পেনন্স আধ পেনি দিয়েছে চমৎকার জুতো জোড়ার জন্যে, তার ওপর খুশি হয়ে একটা সেদ্ধ খাসি-মোরগ দিয়েছে ওকে খাবার জন্যে, সেই সাথে দিয়েছে এক বোতল বিয়ার। অত্যন্ত সৎ লোক এই কুইন্স, কিন্তু বুদ্ধিটা বেজায় মোটা। ওর মাথার মধ্যে বার বার একটা কথাই ঘুরছে কাটা রেকর্ডের মত, ‘তিন শিলিং ছয় পেন্স আধ পেনি দিলাম, হে কুইন্স, সুন্দর জুতো জোড়া, তিন শিলিং ছয় পেন্স আধ পেনি দিলাম।’ এই পুনরাবৃত্তির ফাঁক গলে আর কোন চিন্তা পথ খুঁজে পাচ্ছে না ওর মাথায় ঢোকার।
‘এই যে, ভাই,’ ছায়ায় বসে হাঁক ছাড়লো রবিন, ‘কোথায় চলেছো এত খুশি মনে?’
ডাক শুনে থামলো কুইন্স। চমৎকার নীল পোশাক পরা এক সুন্দর যুবক তাকে ভাই বলে ডেকেছে বলে দারুণ খুশি হলো সে। বললো, ‘কার্ক ল্যাংলির দিক থেকে আসছি আমি, যাব ডার্বি শহরে। বুঝলেন, একজোড়া জুতো যা বানিয়েছিলাম না, সাংঘাতিক! পুরো তিন শিলিং ছয় পেন্স আধ পেনি দিয়েছে আমাকে গেরস্ত… খোদার কসম! সৎ ভাবে পরিশ্রম করেছি বলেই না পয়সাটা দিয়েছে, কি বলেন? সেইজন্যেই খুশি দেখতে পাচ্ছেন আমাকে, স্যার। কিন্তু কিছু যদি মনে না করেন… আপনি, মানে, এত সুন্দর পোশাক পরে ঝোপের নিচে বসে কি করছেন?’
আমি এখানে বসে বসে সোনার পাখির লেজের ওপর লবণ দিচ্ছি,’ বললো রবিন।
‘তাই নাকি!’ ছানা বড়া হয়ে গেল মুচির চোখ জোড়া। ‘সত্যিই? সোনার পাখি কোনদিন দেখিনি আমি। এই ঝোপের নিচে আসে বুঝি? ঠিক আছে, আমিও তাহলে একদিন আসবো। আমিও ধরবো সোনার পাখি। সত্যিই ওদের লেজের ওপর লবণ দিলে ধরা যায়?’
‘তা যায়, কিন্তু যা-তা লবণে আবার চলবে না,’ বললো রবিন। ‘এক গামলা চাঁদের আলো কাঠের পাত্রে নিয়ে জাল দিতে হবে, তাও পাবে মাত্র এক চিমটি। যাই হোক, তোমার ঝোলার ভেতর কি আছে বললে না?’
সোনার পাখির কথায় কাঁধে যে একটা ঝোলা আছে, তা-ই ভুলে গিয়েছিল কুইন্স। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো ওটার দিকে, অনেক কষ্টে মনে করতে পারলো কি আছে ওর ভেতর। অনিশ্চয়তার হাসি হেসে বললো, ‘বলিনি বুঝি? আসলে ভুলে গিয়েছিলাম বলতে। মোটা-তাজা একটা খাসি-মোরগ সেদ্ধ রয়েছে এর মধ্যে, আর আছে এক বোতল বিয়ার। ওফ, যা মজা করে খাবো না!’
‘বেচবে ওগুলো আমার কাছে?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন। শুনেই জিভে পানি এসে গেছে আমার। বিনিময়ে এই দামী নীল পোশাক তো দেবই, আরও দশ শিলিং দেব আমি তোমার জামা কাপড়, চামড়ার অ্যাপ্রন, বিয়ার আর মোরগের জন্যে। কি বলো, বেচবে?
‘আপনি ঠাট্টা করছেন, স্যার,’ বললো মুচি। ‘আমার এই নোংরা মোটা কাপড়ের বদলে আপনার ওই দামী…
‘জীবনে কখনো ঠাট্টা করিনি আমি কারো সাথে, কুইন্সকে বেশি ভাবনা চিন্তার সুযোগ না দিয়ে বললো রবিন। ‘এসো, এক্ষুণি বদল হয়ে যাক। তোমার পোশাক ভাল না বলছো, কিন্তু আমার কাছে তো চমৎকার লাগছে। কাপড় বদলে এসো, দু’জনে মিলে খেয়ে নিই একসাথে বসে।’ কথা বলতে বলতে নিজের পোশাক ছাড়তে শুরু করলো রবিন। তাই দেখে নিজের কাপড় খুলতে শুরু করলো কুইন্সও। পোশাক বিনিময় হয়ে যেতেই চকচকে দশটা শিলিং গুঁজে দিল রবিন মুচির হাতে। দু’জনে এবার বসে পড়লো মোরগ আর বিয়ার নিয়ে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে লম্বা করে পা ছড়িয়ে দিল রবিন। মনে মনে ধন্যবাদ দিল সেইন্ট ডানস্ট্যানকে।
এমনি সময়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে এসে হাজির হলো ছয়জন অশ্বারোহী সৈন্য, তড়াক করে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়লো নীল পোশাক পরা কুইন্সের ওপর, দু’জন দু’পাশ থেকে ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। হকচকিয়ে গেল কুইন্স।
‘ধরা পড়তেই হলো শেষ পর্যন্ত, কি বলো?’ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো সৈন্য দলের নেতা। ‘সেইন্ট হিউবার্টকে ধন্যবাদ, চার-কুড়ি পাউণ্ড উপরি রোজগার হয়ে গেল। বদমাশটাকে ধরে দিতে পারলে দলনেতাকে নিজের পকেট থেকে এই পুরস্কার দেবেন বলেছেন হেরিফোর্ডের বিশপ। খুব ভোগান ভুগিয়েছো, বাছা! আহা-হা! বদমাশের ধাড়িকে দেখো, চেহারাটা এমন করেছে, যেন কিছুই জানে না, নিতান্ত নির্দোষ গোবেচারা! ওসব চালাকি দিয়ে আমাকে ভোলাতে পারবে না, বাবা! চলো, অভিনয় করে লাভ নেই, ভাল করেই চিনি আমরা তোমাকে।’
জবান বন্ধ হয়ে গেছে কুইন্সের। বড় বড় নীল চোখ মেলে বোকার মত চারপাশে তাকাচ্ছে, আর ঢোক গিলছে। দেখে মনে হচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে বোধশক্তিও।
হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো রবিন ওদের দিকে, বার কয়েক মুখ খুললো এবং বন্ধ করলো, তারপর বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘কি বলছেন আপনারা? কি ঘটছে এসব? জেগে আছি, না স্বপ্নে? এমন মিষ্টভাষী, সৎ লোককে বদমাশের ধাড়ি বলছেন…নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে আপনাদের, ভুল করে অন্য লোক ভেবে…’
‘চোপ রাও!’ ধমক দিল দলপতি। ‘চেনো একে?’ বোকার মত রবিনকে মাথা নাড়তে দেখে বললো, ‘এ হচ্ছে ভয়ঙ্কর এক দস্যু, রবিন হুড!’
কথা শুনে ছানাবড়া হয়ে উঠলো কুইন্সের সরল দুই চোখ। মাথার মধ্যে সবকিছু জট পাকিয়ে গেছে বেচারার। একবার রবিন হুডের দিকে চাইলো, তারপর চাইলো নিজের পোশাকের দিকে। মনের মধ্যে সন্দেহের উদয় হলো, সত্যিই কি সে কুইন্স নামের এক মুচি, নাকি এরা যা বলছে-সেই বিখ্যাত দস্যু রবিন হুড? নিচু গলায় বিড়বিড় করতে শুরু করলো ও, আমিই কি সেই লোকটা?…কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে না, মুচি তো ওই লোকটা, আমি কুইন্স হই কি করে! উহুঁ, মনে হচ্ছে তাহলে সত্যিই আমি রবিন হুড।…কিন্তু…
‘হায়, হায়!’ দুঃখিত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লো রবিন। ‘দেখুন বেচারার অবস্থাটা! আপনার দাবড়ি খেয়ে এমনই ঘাবড়ে গেছে যে মাথার মধ্যে গোল পাকিয়ে ফেলেছে সব। কুইন্স তো আমি, ডার্বি শহরের মুচি।
‘তাই নাকি?’ এতক্ষণে পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা কুইন্সের কাছে, ‘তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই, সত্যিই আমি রবিন হুড। শোনো, ধরা পড়ে গেছি বটে, কিন্তু খেয়াল রেখো, আমি হচ্ছি শেরউড জঙ্গলের রাজা, আমার সমান দস্যু আর কোথাও পাবে না তোমরা খুঁজে।’
‘পাগলামির ভান হচ্ছে, অ্যাঁ?’ খেপে উঠলো দলপতি, ‘দাঁড়াও, তোমার পাগলামি বের করছি! বাঁধো দেখি পিছমোড়া করে হারামীর হাত দু’টো, বিশপের সামনে নিয়ে ঝেড়ে খানিক প্যাদানি দিলেই ছুটে যাবে পাগলামি। চল্ ব্যাটা, বেশি তেরিবেরি করলে খুন হয়ে যাবি আমার হাতে!’
হাত বেঁধে কুইন্সকে নিয়ে চলে গেল ওরা। দলটা চোখের আড়াল হতেই হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল রবিনের। মুচি বেচারার কোন ক্ষতি হবে না, ও জানে। কিন্তু বিশপের সামনে ওকে নিয়ে হাজির করলে বিশপের চেহারা কি রূপ ধারণ করবে, সেটা ভেবেই হাসি আর সামলাতে পারছে না সে। প্রাণ ভরে হেসে নিয়ে আবার পুব দিক লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলো রবিন, শেরউডের দিকে, সম্ভব হলে আজই মুচির ছদ্মবেশে রাজার সৈন্যদের ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়বে জঙ্গলে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। পা-জোড়া বেঁকে বসলো রবিনের। এই ক’দিনে একশো চল্লিশ মাইলেরও বেশি হেঁটেছে সে। শেরউডের পথে মাইল দশেক এগিয়েই হঠাৎ নিঃশেষ হয়ে গেল সব শক্তি, পায়ের ওপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকলো না, মনে হচ্ছে আর এক পা এগোলে হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে যাবে হুমড়ি খেয়ে। রাস্তার ধারে বসে খানিক বিশ্রাম নিল বটে, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারলো এই পা নিয়ে আজ আর শেরউডে পৌঁছানো সম্ভব হবে না তার পক্ষে। তবু আর একবার চেষ্টা করে দেখলো সে। এবার মাইল দুয়েক গিয়ে কাঁপতে শুরু করলো পা দু’টো। হাল ছেড়ে দিয়ে কাছেই একটা সরাইখানায় গিয়ে হাজির হলো রবিন, মালিককে ডেকে ভাড়া নিল একটা কামরা। মাত্র তিনটে ঘর রয়েছে সরাইখানায়, তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে খারাপ সেটাই মুচির জন্যে উপযুক্ত হবে বলে মনে করলো মালিক। কামরাটা খুবই অপছন্দ হলো রবিনের, কিন্তু কিছুই বললো না- এখন কোনরকম একটা বিছানা পেলেই হয়, ভাঙা ইঁট-পাথরের ওপর ঘুমাতেও আপত্তি নেই। জামা-কাপড় ছেড়ে উঠে পড়লো সে বিছানায়, বালিশে মাথা ছোঁয়াবার প্রায় সাথে সাথেই ঢলে পড়লো গভীর নিদ্রায়।
এদিকে রবিন ঘুমিয়ে পড়ার পর-পরই কালো মেঘ জমলো আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড় ডিঙিয়ে গোটা আকাশ ঢেকে দিতে দিতে এগিয়ে এলো মেঘটা, ঝিক ঝিক বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে—মনে হচ্ছে কে যেন হলুদ কালি দিয়ে দ্রুত হাতে সই করছে মেঘের গায়ে। একটু পরেই এলো বাতাসের ঝাপটা, সেই সাথে কড়-কড়াৎ বজ্রের নির্ঘোষ। এমনি সময়ে নটিংহাম শহরের জনা চারেক ধনী লোক এসে হাজির হলো ঘোড়ায় চেপে। ড্রনফিল্ড থেকে নটিংহামে ফিরছিল ওরা, ঝড়-বৃষ্টি এড়াবার জন্যে রাতটা এই সরাইখানায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘোড়াগুলো আস্তাবলে তুলে দিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিল ওরা, তারপর ঢুকলো গিয়ে শোবার ঘরে। ঘর দু’টো সুন্দর করে সাজানো বটে, কিন্তু এক বিছানায় দু’জন করে ঘুমাতে হবে দেখে গজ গজ করলো ওরা খানিকক্ষণ, তারপর জামা-কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লো। পরিশ্রান্ত ছিল, ঘুম আসতে দেরি হলো না বিশেষ।
হাওয়ার জোর বেড়েছে আরো, দড়াম দড়াম দরজা-জানালা আছড়াচ্ছে, ধুলোয় ধোঁয়াটে হয়ে গেছে চারদিক। খানিক পর এলো বৃষ্টির ভেজা গন্ধ। ঠিক সেই সময়ে তাড়াহুড়ো করে দরজা ঠেলে সরাইখানায় ঢুকলেন এমেট মঠের অত্যন্ত দামী কাপড়ের আলখেল্লা পরা এক উচ্চপদস্থ সন্ন্যাসী। তাঁর হাঁক-ডাকে তটস্থ হয়ে উঠলো সরাইখানার মালিক, সসম্মানে ভাল ভাল খাবার এনে হাজির করলো সামনে। খাবার দেখে খুশি হলেন সন্ন্যাসী, খেলেনও পেট পুরে, কিন্তু যখন শুনলেন ঘর খালি নেই, একটা মুচির সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে হবে তাঁকে, মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল তাঁর। উপায়ও নেই আর কোন। তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে, বাজ পড়ছে মুহূর্মুহূ; এর মধ্যে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোন সরাইখানার খোঁজ করবেন সেটা সম্ভব নয় কাজেই অগত্যা মোমবাতি হাতে ঢুকে পড়লেন তিনি সেই ঘরেই। মোমের আলোয় ঘুমন্ত রবিনকে আপাদমস্তক দেখে ঘৃণার ভাবটা অনেকখানি দূর হয়ে গেল তাঁর, তিনি আশা করেছিলেন কদাকার নোংরা এক মুচি বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে বুঝি শুয়ে থাকবে বিছানায়, তার বদলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রবিনকে দেখে হাঁপ ছাড়লেন স্বস্তির। পোশাক ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি বিছানায়, যদি জানতেন কার পাশে ঘুমাচ্ছেন, তাহলে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত ওঁর, জানেন না বলেই ঘুমিয়ে পড়লেন নিশ্চিন্তে
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো রবিনের। চোখ মেলেই চমকে উঠলো সে পাশেই এক মাথা কামানো সন্ন্যাসীকে শুয়ে থাকতে দেখে। এই লোক কখন এসে পাশে শুয়েছে টেরও পায়নি সে। আস্তে করে নামলো সে বিছানা থেকে। অঘোরে ঘুমাচ্ছেন সাধু বাবা। ঘরের কোণে সন্ন্যাসীর খুলে রাখা পোশাকের দিকে চাইলো একবার রবিন, তারপর চাইলো সন্ন্যাসীর মুখের দিকে। ধীরে ধীরে চোখ টিপলো সে ঘুমন্ত সাধুকে উদ্দেশ করে। মনে মনে বললো, ‘কিছু মনে করো না, হোলি ফাদার, তুমি যেমন আমাকে না বলে আমার বিছানাটা ব্যবহার করছো, আমিও তেমনি তোমাকে না বলে ধার নিচ্ছি তোমার পোশাকগুলো।’ এই বলে সন্ন্যাসীর জোব্বা গায়ে চাপিয়ে নিল রবিন, মুচির পোশাক ওখানেই ফেলে রেখে খুশি মনে বেরিয়ে গেল সরাইখানা থেকে।
ঘুম থেকে উঠে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন এমেট মঠের সন্ন্যাসী। পাশের লোকটা নেই, তাঁর দামী পোশাক উধাও, ঘরের কোণে পড়ে আছে শুধু মুচির জীর্ণ পোশাক। প্রচুর হাঁক-ডাক করলেন তিনি, গালিগালাচ করলেন অজস্র, কিন্তু কোন লাভ হলো না তাতে; কেউ জানে না কখন কোনদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে মুচিটা। অত্যন্ত জরুরী এক কাজে এক্ষুণি তাঁর রওনা হয়ে যাওয়া দরকার এমেট মঠের উদ্দেশে, দেরি করার কোন উপায় নেই। এখন হয় মুচির পোশাক পরে নিতে হয়, নয়তো উলঙ্গ অবস্থায় হাঁটতে হয় রাস্তা দিয়ে। ডার্বিশায়ারের সমস্ত মুচির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে মুচির পোশাক গায়ে চড়ালেন তিনি, তারপর বেরিয়ে পড়লেন সরাইখানা থেকে। কিন্তু বেচারার কপালটাই আজ খারাপ, কিছুদূর যেতে না যেতেই ধরা পড়লেন রাজার একদল সৈন্যের হাতে। কোন কথাই শুনলো না তারা, ঠেসে ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে চললো হেরিফোর্ডের বিশপের কাছে। হেসে খুন হয়ে গেল মুচির ছদ্মবেশ পরা রবিন হুডের মাথা কামিয়ে সন্ন্যাসী সাজার ব্যর্থ প্রয়াস দেখে। বললো, ‘বার বার আর ফাঁকি দিতে পারবে না, রবিন হুড! নীল পোশাক পরা মুচিটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে যথেষ্ট ধমক খেয়েছি বিশপের কাছে, খুব ভুগিয়েছো যাহোক!’
ওদিকে খুশি মনে হাঁটছে রবিন। দু’দুটো প্রহরারত সৈন্যদল ডিঙিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে সে শেরউডের দিকে। শেষ পর্যন্ত শেরউডে ফিরতে পারবে বুঝতে পেরে আনন্দে নাচছে হৃদয়টা। আর মাত্র কয়েকটা মাইল। এমেট মঠের সন্ন্যাসীর কপালে কি ঘটেছে জানতে পারলে এতটা নিশ্চিন্ত বোধ করতো না সে।
মুচির পোশাক পরা সাধুকে হেরিফোর্ডের বিশপের সামনে নিয়ে হাজির করতেই হায় হায় করে উঠলেন লর্ড বিশপ। পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, আবার ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে রবিন হুড; নিশ্চয়ই সাধুর পোশাক পরে নিরাপদে শেরউডের পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে বদমাশটা এতোক্ষণে। স্বল্প-বুদ্ধি সৈন্যদের ওপর আর ভরসা করা যায় না বুঝতে পেরে নিজেই ঘোড়ায় চেপে তীরবেগে ছুটলেন তিনি। পিছনে একদল সশস্ত্র সৈন্য। একবার জঙ্গলে ঢুকে গেলে কিছুতেই আর হাতের মুঠোয় পাওয়া যাবে না রবিন হুডকে, ধরতে হবে ওকে পথেই।
পিছনে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেয়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না রবিন, সন্ন্যাসী মানুষকে কিছুই বলবে না রাজার সৈন্যদল। কিন্তু কি মনে করে এবার পিছন ফিরে চাইতেই আঁৎকে উঠলো ওর কলজেটা। তুমুল বেগে ছুটে আসছে বারো-চোদ্দটা ঘোড়া, সবার আগে ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছেন হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ। সাধুর পোশাক পরা রবিনকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘ধরো! ধরো! ওই যে রবিন হুড!’
খিঁচে দৌড় দিল রবিন কাছাকাছি একটা জঙ্গল লক্ষ্য করে। ধরে ফেলার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে।
‘ঘিরে ফেলো!’ চেঁচিয়ে উঠলেন বিশপ, ‘বেশি বড় না জঙ্গলটা! ঘিরে ফেলো! তারপর চারদিক থেকে এগিয়ে গেলেই ধরা পড়বে বদমাশ!’
জঙ্গলটা ঘিরে ফেলতে ওদের কয়েক মিনিটের বেশি লাগলো না। মাঝখানে আটকা পড়েছে রবিন। ধীরে ধীরে সাবধানে এগোল ওরা সামনের দিকে, কারণ কে জানে এই জঙ্গলে রবিনের আরও লোকজন আছে কিনা, যদি হঠাৎ পাল্টা আক্রমণ করে বসে!
শেরউডের আধ মাইলের মধ্যে এসে এমন বিপদে পড়বে কল্পনাও করতে পারেনি রবিন। কিন্তু সাহস বা বুদ্ধি হারালো না সে, একদৌড়ে পৌঁছে গেল জঙ্গলের ঠিক মাঝখানটায়। ও জানে, ছোট্ট দু’কামরার একটা কুটির রয়েছে ওখানে, বিধবা এক বুড়ি থাকে, কায়-কষ্টে দিন কাটায়। প্রায়ই নানাভাবে সাহায্য করে রবিন ওকে। বুদ্ধিমতী ওই বুড়িকে এখন বাসায় পেলে হয়।
পাওয়া গেল। চরকা কাটছিল বুড়ি, অবাক হয়ে চাইল হাঁপাতে হাঁপাতে এক সাধুকে তার ঘরে ঢুকতে দেখে।
‘আমি রবিন, বুড়ি মা!’ বললো রবিন হুড, রাজার সৈন্য আর হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ তাড়া করেছে আমাকে, ধরতে পারলে ফাঁসীতে ঝোলাবে!’
‘কোনও চিন্তা নেই, বাবা,’ বললো বুড়ি। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হতে দেব না। তোমাকে ধরে ফাঁসী দেবে…উহুঁ, তাহলে আমার দুঃখের সময় সাহায্য করবে কে, ওই বিশপ? যাও, বাপ, পাশের ঘরে গিয়ে আমার ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরে নাও, টুপিটাও পরতে ভুলো না। নিজের কাপড়গুলো ওখানেই খুলে রেখে দিয়ো।’
মুহূর্তে বুড়ির প্ল্যানটা বুঝতে পেরে হাসি ফুটে উঠলো রবিনের মুখে, বুড়ির দুই গালে চুমো খেয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। দুই মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলো রবিন কুটির থেকে, লাঠিতে ভর দিয়ে পিঠ বাঁকিয়ে হাঁটছে, পরনে শতচ্ছিন্ন জীর্ণ পোশাক, মাথায় কানা ভাঙা তোবড়ানো মস্ত এক টুপি, হাতে চরকা আর কিছু সুতো- যেন বিশ্রামের জন্যে কোথাও বসতে হলেও হাতের কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়।
কিছুদূর এগিয়েই লোকজনের গলার আওয়াজ পেল রবিন, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আরো কুঁজো হয়ে থরথর করে লাঠি কাঁপিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলো রবিন। হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে।
‘কে যায়?’ হাঁক ছাড়লেন বিশপ, ও, বুড়ি একটা! ধরে নিয়ে এসো ওকে আমার সামনে।’
বিশপের সামনে নিয়ে আসা হলো বুড়িকে। কাঁপুনি বেড়ে গেছে বুড়ির।
‘কোথা থেকে আসছো তুমি, বুড়ি?’ জিজ্ঞেস করলেন বিশপ।
‘আমার কুঁ-উঁ-ড়ে ঘ-অ-র থেকে-এ, হুজু-উ-র, কাঁপা গলায় জবাব দিল বুড়ি, ‘জ- অ-ঙ্গলে-এ-র মদ্যিখা-আ-নে…’
আর শোনার ধৈর্য রইলো না বিশপের। মাথা নিচু করে রেখেছে বুড়ি, তাতে কোন সন্দেহের উদ্রেক হলো না তাঁর মনে, ভাবলেন তাঁকে সম্মান দেখাবার জন্যে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না বুড়িটা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এদিকে কোন লোককে দেখেছো?’
কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিল বুড়ি, ‘না, হুজুর, একজন সন্ন্যাসী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।’
‘কোথায়? কোনদিকে গেছে লোকটা?’
‘আমার ঘরে। বিশ্রাম নেবার জন্যে হোলি ফাদার…’
‘কচু ফাদার!’ কর্কশ কণ্ঠে বললেন বিশপ। হয়েছে, আর বক বক করার দরকার নেই তোমার। চলো হে, পেয়েছি ব্যাটাকে হাতের মুঠোয়! ছোটো সবাই, টেনে বের করে নিয়ে এসো ওকে বুড়ির কুঁড়েঘর থেকে।
ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ছুটলো ওরা কুটিরের দিকে। কুঁজো হয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে এগোলো বুড়ি নিজের পথে। কিন্তু ঝোপের আড়ালে গিয়েই আশ্চর্য পরিবর্তন এসে গেল বুড়ির চালচলনে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো বুড়ি, যেন চঞ্চলা হরিণী! জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রাণপণে ছোটে, ফাঁকা জায়গায় এসেই আবার কুঁজো হয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে এগোয়—এই ভাবে অল্পক্ষণের মধ্যেই শেরউডে প্রবেশ করলো রবিন হুড। একছুটে চলে এলো নিজের আস্তানার কাছে
কাছাকাছি আসতেই ওকে দেখে ফেললো লিটল জন। চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল ওর। ‘আরে! ব্যাপার কি! একেবারে উড়ে আসছে যেন বুড়িটা! নিশ্চয়ই ডাইনী!’ এই বলে চট্ করে একটা তীর জুড়ে ফেললো সে ধনুকে।
‘আরে, থামো, থামো!’ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন হুড। ‘আমি রবিন! রবিন হুড!’
‘তাই তো!’ রবিনের. গলা চিনতে পেরে তাজ্জব হয়ে গেল লিটল জন। ‘আরে, ওস্তাদ,এ কি হাল তোমার! বুড়ির পোশাক কেন তোমার গায়ে?’
‘বলবো, সব বলবো পরে,’ বললো রবিন। ‘জলদি শিঙাটায় ফুঁ দাও আগে। সব লোক দরকার আমার এই মুহূর্তে।’
শিঙায় তিনটে ফুঁ দিতেই চারপাশ থেকে হুড়মুড় করে এসে হাজির হলো অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সাত কুড়ি দুর্ধর্ষ যুবক। রবিনের পিছন পিছন ছুটলো সবাই বুড়ির সেই জঙ্গলের দিকে।
এদিকে কুটিরের সামনে পৌঁছে কয়েকজনকে বাইরে পাহারায় থাকতে বলে চারজন সৈন্যকে ভেতরে পাঠালেন বিশপ রবিন হুডকে ধরে আনার জন্যে। টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে এলো ওরা সন্ন্যাসীর পোশাক পরা বুড়িকে। মুখটা টুপিতে ঢাকা রয়েছে বলে চিনতে পারলেন না ওকে বিশপ, চেনার চেষ্টাও করলেন না, হুকুম দিলেন, ‘পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ওই সাদা ঘোড়াটায় তুলে দাও ওকে। এক্ষুণি রওনা হয়ে যাব আমরা নটিংহামের পথে। বদমাশটাকে জেলের খাঁচায় পুরতে না পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আগামীকালই লটকে দেব ফাঁসীতে
একটি কথাও উচ্চারণ করেনি বুড়ি, সবাই ভাবলো ধরা পড়ে বোকা বনে গেছে রবিন হুড। ওকে পরীক্ষা করে দেখার কথা মাথায় এলো না কারো, সবাই এখন ভালোয় ভালোয় জঙ্গল থেকে সরে পড়তে পারলে বাঁচে, কে জানে, যদি টের পেয়ে আক্রমণ করে বসে ওর লোকজন। রওনা হয়ে গেল ওরা তড়িঘড়ি।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন বিশপ, কিভাবে রবিন হুডকে পাকড়াও করলেন সেটা কেমন ভাবে সাজিয়ে গল্প করবেন সবার কাছে, তাই গোচ্ছাচ্ছেন মনে মনে। গর্বে ময়ূরের মত পেখম মেলে দিয়ে রঙ চড়াচ্ছেন নিজের বাহাদুরির ওপর। আর হাসছেন। হাসি এসে যাচ্ছে, থামাতে পারছেন না চেষ্টা করেও।
কিন্তু সামনের একটা বাঁক ঘুরেই মুহূর্তে মিলিয়ে গেল বিশপের মুখের হাসি। সাতকুড়ি সশস্ত্র লোক ধনুকে তাঁর গুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর। তাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই বুড়িটা।
‘আরে! কারা এরা?’ বলেই চিনে ফেললেন তিনি এদের। সবুজ পোশাক পরা তীরন্দাজ-দল যে কারা, ভাল করেই জানা আছে তাঁর। ঢ্যাঙা লিটল জনকেও দেখা যাচ্ছে ওদের মধ্যে। আর ওই সামনে দাঁড়ানো বুড়িটা…কে ও?’
পাশের ঘোড়ার ওপর থেকে বন্দী বললো, ‘আমার মনে হয় ওরই নাম রবিন হুড।’
‘রবিন হুড!’ কপালে উঠলো বিশপের চোখ। তাহলে…তাহলে তুমি কে?’
হি, হি হি! হো, হো, হো!’ হাসতে শুরু করলো বুড়ি, তারপর সরিয়ে দিল নিজের মাথার হুড। দেখা গেল লোলচর্ম এক বৃদ্ধা দন্তহীন মাড়ি বের করে হাসছে খিল খিল করে। ‘কেন, আমাকে চিনতে পারছো না? বন্দী করে তো নিয়ে চলেছিলে, এখন চিনতে পারছো না যে আমি দস্যু রবিন হুড? কেমন জব্দ?’ হেসে উঠলো বুড়ি প্রাণখোলা হাসি।
‘সেরেছে!’ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন বিশপ, ধরা পড়ে গেছেন তিনি রবিন হুডের হাতে। শায়েস্তা করতে এসে নিজেরই শায়েস্তা হয়ে যেতে হবে আজ। একঝাঁক তীর ছুটে এসে পড়লো পিছনে দাঁড়ানো অশ্বারোহী সেনাদলের ওপর। জান বাঁচানো ফরজ বুঝে বিশপকে ফেলে তীর বেগে পালালো সবাই। বিশপও চেষ্টা করলেন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ওদের অনুসরণ করতে, কিন্তু মাচ আর উইল স্কেদলক দৌড়ে গিয়ে টেনে ধরলো তাঁর ঘোড়ার রাশ। এগিয়ে এলো রবিন। ঘোড়াটাকে একটা গাছের সাথে বাঁধার নির্দেশ দিয়ে নামতে বললো বিশপকে। কাঁপতে কাঁপতে নেমে এলেন লর্ড বিশপ।
‘কি খবর, লর্ড বিশপ?’ বললো রবিন, ‘অনেক কিছুই তো করলেন আমার বিরুদ্ধে, এবার আমি শুধু একটা কিছু করি?’
দুই হাঁটু বাড়ি খাচ্ছে পরস্পরের সাথে, একটি কথাও বেরোলো না বিশপের মুখ থেকে, প্রাণভয়ে শুকিয়ে গেছে জিভ। হাসলো রবিন। বললো, ‘আপনার মত নীচ একজন লোকের গায়ে হাত তুলতেও ঘৃণা বোধ করছি আমি, তাই বেঁচে গেলেন এ- যাত্রা। কিন্তু মনে রাখবেন, আগামীতে যদি আবার আপনাকে এই ভূমিকায় দেখি, গলায় পা দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলবো জিভ। লিটল জন, দেখো এর থলিতে কি আছে।’
টাকা কড়ি যা ছিল সব বের করে নিল লিটল জন। রবিনের নির্দেশে অর্ধেক দিয়ে দিল বুড়িকে। রবিন বললো, ‘এবার যেতে দাও ওঁকে। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবো না আমরা। অন্ততঃ আজকে নয়।’
ছেড়ে দিল ঠিকই, তবে উল্টো করে ছেড়ে দিল লিটল জন লর্ড বিশপকে। লেজের দিকে মুখ করে উল্টো করে বসিয়ে হাত-পা বেঁধে দেয়া হলো বিশপের, তারপর কষে এক ঘা লাগিয়ে দেয়া হলো ঘোড়ার পিছন দিকে। টগবগিয়ে ছুটলো ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে উল্টো হয়ে চড়ে নটিংহাম শহরে ফিরে গেলেন হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ।