১৬. পরিশিষ্ট

প্রথম পরিশিষ্ট অধ্যায়-১

সাত বছর পার হয়ে গেছে। ইওরোপিয় ইতিহাসের ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র তার তটপ্রান্তে স্তিমিত হয়ে এসেছে, মনে হয় বুঝি শান্তই হয়েছে। কিন্তু যেসব রহস্যময় শক্তি (তাদের কর্ম-পদ্ধতির বিধি-বিধান আমাদের কাছে অজ্ঞাত বলেই রহস্যময়) মানব-সমাজকে পরিচালিত করে তাদের কর্ম-ধারা অব্যাহতই রয়েছে।

ইতিহাস-সমুদ্রের উপরিভাগ শান্ত দেখালেও কালের অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখেই মানুষের অগ্রগতির ধারা অবিরাম বয়ে চলেছে। বিভিন্ন মানব-গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে আবার ভেঙে গেছে, নানা রাজ্যের ভাঙা-গড়া ও মানুষের স্থানচ্যুতির উদ্যোগ-আয়োজন চলেছে।

ইতিহাস-সমুদ্রের তরঙ্গাভিঘাত এখন আর আগের মতো এক সৈকত থেকে অপর সৈকতে আছড়ে পড়ছে না, গভীর তলদেশে টগবগ করে ফুটছে। ইতিহাসের বিখ্যাত প্রতিভূরা এখন আর ঢেউয়ের টানে এক তীর থেকে অপর তীরে চলে যাচ্ছে না। মনে হয় এখন তারা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেনাদলের প্রধান হিসেবে ইতিহাসের যেসব নায়ক একদা যুদ্ধ, অভিযান ও লড়াইয়ে জনগণের গতিবিধিকে পরিচালিত করত তারাই এখন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংঘবদ্ধতা, বিধি-বিধান ও সন্ধির সাহায্যে জনগণের অশান্ত গতিকে নিয়ন্ত্রিত করছে।

ইতিহাসের পর্যালোচনাকালে তারা ইতিহাসের নায়কদের তীব্র সমালোচনা করে থাকে, তাদের মতে তারা প্রতিক্রিয়াপন্থী। আলেক্সান্দার ও নেপোলিয়ন থেকে আরম্ভ করে মাদাম দ্য স্তায়েল, ফোটিয়াস, শেলিং, ফিকটে, চাম্ৰায়া ও অন্য যারাই তাদের সমালোচনার শিকার হয়েছে, তাদের কঠোর বিচারে তারাই হয় প্রগতিবাদী হিসেবে মুক্তি পেয়েছে, আর না হয় তো প্রতিক্রিয়াপন্থীরূপে দণ্ডিত হয়েছে।

তাদের বিবরণ অনুসারে সেই সময়ে রাশিয়াতেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছেন, তার প্রধান অপরাধী ছিল প্রথম আলেক্সান্দার, অথচ সেই লোকই তাদের মতেই তার রাজত্বকালের শুরুতে ছিল রাশিয়ার রক্ষাকর্তা এবং উদারনৈতিক আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা।

আজকের রুশ সাহিত্যে স্কুলের ছাত্র থেকে আরম্ভ করে পণ্ডিত ইতিহাসকারদের মধ্যে এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না যে নিজ রাজত্বকালে আলেক্সান্দার যেসব ভুল করেছিল তার জন্য তাকে লক্ষ্য করে একটা ছোট পাথরও ছুঁড়ে মারে না।

তার উচিত ছিল এইভাবে এবং ওভাবে কাজ করা। এক্ষেত্রে তিনি ঠিক কাজই করেছেন, কিন্তু ওক্ষেত্রে করেছেন ভুল। রাজত্বের গোড়ার দিকে এবং ১৮১২ সালে তিনি আশ্চর্য রকমের ভালো কাজ করেছেন, কিন্তু পোল্যান্ডকে নতুন শাসনতন্ত্র দিয়ে, পবিত্র মৈত্রীচুক্তি স্থাপন করে আরাকচিভের হাতে ক্ষমতা দিয়ে, গোলিৎসিনকে ও মরমীয়াবাদকে সমর্থন করে এবং পরবর্তীকালে শিশকভ ও ফোটিয়াসকে অনুগ্রহ দেখিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছেন। সক্রিয় সেনাদলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে এবং সেমেনভ রেজিমেন্টকে ভেঙে দিয়েও তিনি ভুল করেছেন।

মানবজাতির কিসে কল্যাণ হয় সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ভিত্তিতে ইতিহাসকাররা তার উদ্দেশ্যে যত নিন্দা বাক্য উচ্চারণ করেছে তা লিপিবদ্ধ করতে হলে ডজনখানেক পৃষ্ঠার দরকার হবে।

এইসব নিন্দা-তিরস্কারের অর্থ কি?

প্রথম আলেক্সান্দারের রাজত্বের গোড়ার দিকে তার উদারনৈতিক প্রয়াস, নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ, ১৮১২ সালে ও ১৮১৩ সালের অভিযানে তার দৃঢ়তা প্রভৃতি তার যেসব কাজের জন্য ইতিহাসকাররা তার প্রশংসা করে থাকে সেসবই কি ঐ একই উৎস থেকে প্রবাহিত নয় : তার জন্ম, শিক্ষা-দীক্ষা ও জীবনযাত্রার যে পরিবেশে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল এবং যা থেকে সেইসব কাজগুলিও উৎসারিত হয়েছিল যার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে (যেমন পবিত্র মৈত্রীচুক্তি, পোল্যান্ড প্রতার্পণ, ১৮২০ ও তার পরবর্তীকালের প্রতিক্রিয়া)-সে সবকিছুরই উৎস কি এক নয়?

ঐ সব নিন্দা-তিরস্কারের মূল ভিত্তিটা কি?

মূল ভিত্তি হল : প্রথম আলেক্সান্দারের মতো ইতিহাসের একটি মুখ্য চরিত্র যে মানব-ক্ষমতার একেবারে শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত ছিল, ক্ষমতার সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত ষড়যন্ত্র, খোসামোদ ও আত্ম-প্রবঞ্চনার মতো প্রচণ্ড শক্তিগুলি যার উপর অবিরাম প্রভাব বিস্তার করতে সক্রিয় ছিল, ইওরোপে সংঘটিত সমস্ত ঘটনার দায়িত্ব যাকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বহন করতে হত, কোনো কাল্পনিক চরিত্র না হয়ে যে ছিল একটি জীবন্ত চরিত্র, প্রতিটি জীবন্ত মানুষের মতোই সত্য, শিব ও সুন্দরের প্রতি যার ছিল ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুরাগ-পঞ্চাশ বছর আগে (যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসখানি সমাপ্ত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে) মানব-কল্যাণের সেই ধারণা ও তাৎপর্য-বোধ নিশ্চয় তার ছিল না, বর্তমান কালের একজন অধ্যাপক যৌবনকাল থেকে অধ্যয়নকার্যে ব্যাপৃত থেকে-নানা পুঁথি ও বক্তৃতা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যে ধারণা ও তাৎপর্যবোধ গড়ে তুলতে পারে।

কিন্তু একথা যদি ধরেই নেওয়া যায় যে পঞ্চাশ বছর আগে মানব-কল্যাণ সম্পর্কে প্রথম আলেক্সান্দারের ধারাণাটা ভুল ছিল, তাহলে তো অনিবার্যভাবেই এটাও আমাদের ধরে নিতেই হয় যে আজ যে ইতিহাসকার আলেক্সান্দারের বিচার করছে, কালের যাত্রাপথে একদিন তার ধারণাও ভ্রান্ত বলে পরিগণিত হবে। এই অনুমান, আরো স্বাভাবিক ও অনিবার্য এই কারণে যে ইতিহাসের পথ-পরিক্রমার পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাবের সঙ্গে মানব-কল্যাণের ধারণাও প্রতি বছরই পরিবর্তিত হয়, ফলে আজ যা ভালো দশ বছর পরে তাই মন্দ বলে পরিগণিত হয়, এবং এর বিপরীতক্রমও সমান সত্য। আরো বড় কথা, ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় কি ভালো আর কি মন্দ তা নিয়ে সমকালীন ইতিহাসকারদের মধ্যেও মতবিরোধের অন্ত নেই, পোল্যান্ডকে নতুন শাসন-অধিকার দান এবং পবিত্র মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের জন্য কেউ বা আলেক্সান্দারকে প্রশংসা করে, আবার কেউ বা নিন্দা করে।

আলেক্সান্দার বা নেপোলিয়নের কার্যাবলিকে দরকারি বা ক্ষতিকর কোনোটাই বলা যায় না, কারণ সেগুলি কেন দরকারি বা ক্ষতিকর সেটা বলাই তো অসম্ভব। সেসব কার্যাবলি যদি কারো অসন্তোষের কারণ হয় তাহলে তো তার একমাত্র কারণ যে কল্যাণ সম্পর্কে তার সীমিত জ্ঞানের সঙ্গে সেগুলো মেলে না। মস্কোতে আমার পৈত্রিক ভবনকে রক্ষা করা, অথবা রুশ বাহিনীর গৌরব, অথবা পিটার্সবুর্গ ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধি, অথবা পোল্যান্ডের মুক্তি, অথবা রাশিয়ার মহত্ত্ব, অথবা ইওরোপের শক্তি-সাম্য অথবা প্রগতি নামধারী ইওরোপিয় কিছু সংস্কৃতি-আমার কাছে ভালো বা খারাপ যাই মনে হোক, একথা তো স্বীকার করতেই হবে যে প্রতিটি ঐতিহাসিক চরিত্রের এসব ছাড়াও এমন কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে যা আমার কাছে অনধিগম্য।

কিন্তু ধরে নেওয়া যাক যে বিজ্ঞান নামক শক্তিটি সব বিরোধের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করে ভালো-মন্দের এমন একটা শাশ্বত মাপকাঠি আমাদের হাতে তুলে দিতে পারে যা দিয়ে ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলির বিচার করা যেতে পারে : বলা যাক যে আলেক্সান্দার সবকিছুই অন্যভাবে করতে পারত, বলা যাক–আজকের নিন্দুকরা জাতীয়তা, স্বাধীনতা, সাম্য ও প্রগতির যে কর্মসূচি তাকে দিত সেই অনুসারেই সেসব কাজ করতেও পারত। ধরা যাক, এই কর্মসূচি প্রণয়ন তখন সম্ভব ছিল, এবং আলেক্সান্দার তদনুসারেই সব কাজ করর। কিন্তু তকালীন সরকারি রীতিনীতির যারা বিরোধিতা করেছিল, ইতিহাসকারদের মতে যাদের কাজকর্ম ছিল ভালো ও কল্যাণকর, সেক্ষেত্রে তাদের কি হত? তাদের কাজকর্মের তো কোনো অস্তিত্ব থাকত না : থাকত না জীবনের লক্ষণ, থাকত না কিছুই।

একথা যদি আমরা স্বীকার করি যে মানুষের জীবন বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত, তাহলে তো জীবনের সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করা হয়।

.

অধ্যায়-২

যদি ইতিহাসকারদের মতোই ধরে নেওয়া হয় যে মহাপুরুষরাই মানব সমাজকে বিশেষ বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়–যেমন রাশিয়া অথবা ফ্রান্সের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা, ইওরোপের সাম্য শক্তি-প্রতিষ্ঠা, বিপ্লবের ভাবধারার প্রচার, সাধারণ অগ্রগতি, বা অণ্য কিছু–তাহলে তা আকস্মিকতা প্রতিভার তত্ত্ব ছাড়া ইতিহাসের ঘটনাবলিকে ব্যাখা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ঊনিবংশ শতাব্দীর গোড়াতে যেসব ইওরোপিয় যুদ্ধ হয়েছিল তার লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে রাশিয়ার

উচ্চাকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা, তাহলে তো পূর্ববর্তী সব যুদ্ধ ও এই অভিযান ছাড়াই সে লক্ষ্যসাধন করা যেত। আবার ফ্রান্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই যদি তার লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলেও তো বিপ্লব ও সাম্রাজ্য ছাড়াই তা পূর্ণ করা যেত। নব ভাবধারার প্রচারই যদি লক্ষ্য হত তাহলে তো যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিবর্তে মুদ্রণ-যন্ত্রই সে কাজ আরো ভালোভাবে করতে পারত। সভ্যতার অগ্রগতি যদি লক্ষ্য হত তাহলে তো সহজেই বোঝা যায় যে সম্পত্তি ও মানব জীবনের ধ্বংস সাধন ছাড়াই সভ্যতা বিস্তারের আরো অনেক ভালো পথ আছে।

তাহলে ঘটনাগুলি অন্যভাবে না ঘটে এভাবে ঘটল কেন?

কারণ এটাই প্রকৃত ঘটনা! ইতিহাস বলে, আকস্মিকতা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, আর প্রতিভা সেটাকে কাজে লাগিয়েছিল।

কিন্তু আকস্মিকতা কি? প্রতিভাই বা কি?

আকস্মিকতা এবং প্রতিভা কোনো সত্যিকারের বস্তুকে বোঝায় না, কাজেই তাদের সংজ্ঞাও দেওয়া যায় না। এই কথা দুটি ঘটনাকে বোঝার একটা স্তরের দ্যোতকমাত্র। একটা বিশেষ ঘটনা কেন ঘটে তা আমি জানি না, আমি মনে করি সেটা জানা যায় না, আর তাই আমি সেটা জানতে চেষ্টাও করি না, আকস্মিকতার দোহাই পাড়ি। আমি দেখি, এমন একটা শক্তি কতকগুলি ফল

ফলায় যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে, এটা কেন ঘটে তা আমি জানি না, তাই প্রতিভার কথা বলি।

মেষপালক একদল ভেড়ার মধ্যে যে ভেড়াটাকে রোজ একটা বিশেষ খোঁয়াড়ে নিয়ে গিয়ে দানা-পানি দেয়, সেটাই অন্যগুলির চাইতে দ্বিগুন মোটা হয়, এবং প্রতিভাধর হয়ে ওঠে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সেই চর্বিওয়ালা মোটা ভেড়াটাকেই মাংসের প্রয়োজনে জবাই করা হয়।

কিন্তু একটু চিন্তা করলেই ভেড়ার দল বুঝতে পারে যে তাদের ভাগ্যে যা কিছু ঘটে তা তাদের ভেড়ার উপযুক্ত লক্ষ্য সাধনের জন্যই ঘটে, তাদেরও এ সত্য স্বীকার করতেই হবে তাদের ভাগ্যে যা ঘটেছে তার উপর তাদের কোনো হাত ছিল না, তাহলেই পুরুষ্ট ভেড়াটার ভাগ্যের পরিণতিটা তারা সহজেই বুঝতে পারবে। কেন তাদের পুরুষ্ট করা হয় সেটা যদি বুঝতে নাও পারে, অন্তত এটুকু তারা বুঝতে পারবে যে ঐ ভেড়াটার কপালে যা ঘটেছে তা আকস্মিকভাবে ঘটেনি, তাহলেই তাদের আর আকস্মিকতা অথবা প্রতিভার তত্ত্বের কোনো দরকার হবে না।

আমাদের কেবল এটুকু স্বীকার করতেই হবে যে ইওরোপের সেই প্রচণ্ড আলোড়নের উদ্দেশ্য কি ছিল তা আমরা জানি না, আমরা জানি শুধু যা ঘটেছে তাকে–অর্থাৎ নরহত্যা–প্রথমে ফ্রান্সে, তারপর ইতালিতে, আফ্রিকায়, প্রশিয়ায়, অস্ট্রিয়ায়, স্পেনে, ও রাশিয়ায়, আরো। জানি, পশ্চিম থেকে পূর্বে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে মানুষের চলাচল ও গতিবিধিই এইসব ঘটনার মূল কথা ও উদ্দেশ্য, তার জন্য নেপোলিয়ন ও আলেক্সান্দারের মধ্যে কোনো বিরল ক্ষমতা ও প্রতিভার খোঁজ করার কোনো দরকার হয় না, তাদের সাধারণ মানুষের চাইতে অন্য কিছু বলে মনে করা আর তখন সম্ভবই হবে না, যেসব ছোটখাট ঘটনা এই লোকগুলিকে এত বড় করে তুলেছে তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো আকস্মিকতার আশ্রয়ও আমাদের নিতে হবে না, বরং এই সত্যই আমরা

স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে পারব যে ওইসব ছোটখাট ঘটনাগুলি একান্তই অনিবার্য ছিল।

 চরম উদ্দেশ্যকে জানার দাবিকে অস্বীকার করলেই আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারব যে কোনো একটি গাছে ফুল ফোটে বা ফল ফলে তার চাইতে ভালো ফুল ফোঁটা বা ফল ফলার কথা যেমন কেউ কল্পনা করতে পারে না, তেমনই নেপোলিয়ন ও আলেক্সান্দার যে লক্ষ্য সাধন করেছিল, অন্য কোনো দুটি মানুষ যে তাদের চাইতে ভালোভাবে সে লক্ষ্য সাধন করতে পারত সে কল্পনা করাও অসম্ভব।

.

অধ্যায়-৩

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইওরোপে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মূলগত প্রধান তাৎপর্যই হচ্ছে ইওরোপের। অধিকংশ মানুষের স্থান-পরিবর্তন-প্রথমে পশ্চিম থেকে পূর্বে, এবং পরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। শুরুতে ছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়া। পশ্চিমের মানুষরা যাতে মস্কোতে একটা যুদ্ধকালীন অভিযান চালাতে পারে তার জন্য প্রয়োজন ছিল—

 ১. পূর্বের রণকুশল সামরিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে এর্টে উঠাবার মতে যথেষ্ট সংখ্যক একটি সামরিক গোষ্ঠীরূপে নিজেদের গড়ে তোলা,

 ২. প্রতিষ্ঠিত সবরকম ঐতিহ্য ও রীতিনীতিকে বিসর্জন দেওয়া এবং

৩. সামরিক অভিযানের সময় নেতৃপদে এমন একজন লোককে রাখা যে অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম প্রতারণা, দস্যুবৃত্তি ও নরহত্যাকে সমর্থন করতে পারবে।

ফরাসি বিপ্লবের শুরু থেকেই অনুপযুক্ত পুরোনো বড় দলটাকে এবং সেইসঙ্গে পুরোনো সব অভ্যাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হতে লাগল, এবং ধাপে ধাপে তার চাইতেও বড় এমন একটা দলকে গড়া হতে লাগল যাদের রীতিনীতি নতুন আর ঐতিহ্যও নতুন, এবং এমন একজনকে মাথার উপরে বসানো হল যে যা কিছু করা । হোক না কেন সে সব কিছুর দায়-দায়িত্ব গ্রহন করবে।

বিচিত্র এক যোগাযোগের ফলে বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান ফরাসি উপদলের ভিতর থেকে এমন একটি লোকের আর্বিভাব ঘটল যার কোনো পূর্ব ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই, নাম নেই, এমন কি যে নিজে ফরাসিও নয়। কোনো দলে যোগ না দিলেও তাকেই ঠেলে দেওয়া হল সকলের সম্মুখে।

সহকর্মীদের অজ্ঞতা, বিরোধী শক্তিগুলির দুর্বলতা ও গুরুত্বহীনতা, খোলাখুলি নিজের মিথ্যাকে স্বীকার করতে পারা, আর সর্বপরি একটা চোখ-ধাঁধানো ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সীমাবদ্ধতাই সেই লোকটিকে সামরিক নেতৃপদে উন্নীত করে দিল। যে বাহিনীটিকে ইতালিতে পাঠানো হল তার সৈনিকদের ক্ষুরধার রণকুশলতা, প্রতিপক্ষগুলির যুদ্ধে অনীহা, এবং নিজের শিশুসুলভ ঔদ্ধত্য ও আত্ম-বিশ্বাসই তাকে এনে দিল সামরিক খ্যাতি। সে যেখানে যায় সেখানেই অসংখ্য তথাকথিত সুযোগ যায় তার সঙ্গে। ফ্রান্সের শাসক দলের বিরাগভাজন হওয়াটাও তার ভাগ্যে অনুকূল হয়েই দেখা দেয়। পূর্বনির্দিষ্ট পথগুলি এড়িয়ে চলার চেষ্টাও সফল হল না, রাশিয়ার চাকরিতে তাকে নেওয়া হল না, তুরস্কে চাকরির চেষ্টা ব্যর্থ হল। ইতালির যুদ্ধে বারবার ধ্বংসের একেবারে মুখোমুখি হয়েও প্রতিবারই একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে সে রক্ষা পেল। যেসব রুশ বাহিনীর হাতে তার সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট হতে পারত তারাও নানারকম কূটনৈতিক কারণে তখন মঞ্চে অবতীর্ণ হতে পারল না।

ইতালি থেকে ফিরে গিয়ে সে দেখতে পেল, প্যারিসের শাসন-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মুখে, শাসন-ক্ষমতায় যারা অধিষ্টিত ছিল সেই ভাঙ্গনের মুখে তারা অনিবার্যভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর ঘটনাক্রমেই এই বিপদ থেকে উদ্ধারের একটা এল আফ্রিকায় একটি উদ্দেশ্যহীন ও অর্থহীন অভিযানের রূপে। আবার সেই তথাকথিত, আকস্মিক সুযোগ হল তার সঙ্গী। একটা গুলিও ছেঁড়া হল না, অথচ দুর্ভেদ্য মাল্টা আত্মসমর্পণ করল, তার অত্যন্ত বেপরোয়া পরিকল্পনাগুলিও সাফল্যমণ্ডিত হল। শত্রুপক্ষের যে নৈবহরের চোখ এড়িয়ে পরবর্তীকালে একটি নাৈকাও পার পায়নি তার চোখে ধুলো দিয়ে তার গোটা বাহিনী নির্বিঘ্নে সরে পড়ল। আফ্রিকায় প্রায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হল। আর যারা এইসব অপরাধ করল তারা, বিশেষ করে তাদের নেতা, নিজেদের নিশ্চিত করে বোঝাল যে একাজ তো প্রশংসাৰ্হ, গাৈরবজনক–সিজার ও মহান আলেক্সান্দারও তো এই কাজই করেছে, আর তাই এ কাজ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।

গৌরব ও আভিজাত্যের এই আদর্শই এই লোক ও তার সঙ্গী সাথীদের আফ্রিকায় নিয়ে গেল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে। সে যা কিছু করে তাতেই আসে সাফল্য। মহামারী তাকে স্পর্শ করে না। বন্দিকে হত্যার নিষ্ঠুরতাও তার বেলায় অপরাধ বলে গন্য হয় না। সঙ্গী সাথীদের বিপদের মুখে ফেলে রেখে সে যখন নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো অকারণে অত্যন্ত হীনভাবে আফ্রিকা থেকে চলে গেল তখন তাকে সেজন্য তাকে প্রশংসাই করা হল, এবং পুনরায় শত্রুপক্ষের নৌবহর দু-দুবার তাকে পালাতে দিল। সফলতার সঙ্গে এইসব অপরাধ করার উল্লাসে মত্ত হয়ে সে যখন প্যারিসে পৌঁছল তখন দেখা গেল, যে প্রজাতন্ত্রী সরকার এক বছর আগে তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারত তার নাভিশ্বাস উঠেছে। সেইমুহূর্তে সবরকম দলগত রেষারেষি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত একজন নবাগত হিসেবে তার উপস্থিতি স্বভাবতই তাকে তুলে ধরল উচ্চ পদে-আর নিজের সে রকম কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও সেই নতুন ভূমিকার জন্য সে তখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, সবকিছুতেই তার ভয়, তবু সব দলই তাকে আঁকড়ে ধরল, তার সহযোগিতা দাবি করল।

ইতালি ও মিশরে অর্জিত গৌরব ও সুনাম তখন তার করায়ত্ত, তার উপর আছে তার উম্মদোচিত আত্ম প্রশান্তি, যে কোনো অন্যায় কাজ করার উপযুক্ত সাহসিকতা এবং খোলাখুলি মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কাজেই আসন্ন কর্তব্য সাধনের সেই তো একমাত্র যোগ্য লোক।

আসনটি তো তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল, কাজেই নিজের ইচ্ছা ছাড়াই এবং নিজের অস্থিরচিত্ততা, পরিকল্পনার অভাব, এবং সব ভূলভ্রান্তি সত্ত্বেও ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ল। সে ষড়যন্ত্র সফল হল।

আইন-পরিষদের একটা সভায় তাকে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ভয়ে তার দিশেহারা অবস্থা, কোনোরকমে পালাতে পারলে বাঁচে। মূৰ্ছা যাবার ভান করে সে এমন সব অর্থহীন উক্তি করে বসল যাতে তার বারটা বেজে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের একদা গর্বিত ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি শাসকরা তখন বুঝতে পেরেছে যে তাদের খেলা সাঙ্গ হয়েছে, তারা তখন সেই লোকটির চাইতেও বিমূঢ়, যেসব কথা বললে সেইমুহূর্তেই তাকে ধ্বংস করা যেত তা তারা মুখেই আনল না।

আকস্মিক সুযোগ, লক্ষ লক্ষ আকস্মিক সুযোগ তার হাতে তুলে দিল ক্ষমতা, আর সকলেই যেন চুক্তি করে সে ক্ষমতাকে সমর্থন জানাল। ফ্রান্সের যে শাসকরা তার কাছে নতি স্বীকার করল তারাও আকস্মিকতার ফসল, সেই আকস্মিকতার প্রভাবেই রাশিয়ার প্রথম পল তার রাজত্বকে স্বীকৃতি দিল, ঘটনাচক্রেই তার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হল তা যে ব্যর্থ হল তাই শুধু নয়, তার ফলে তার শক্তি আরো বৃদ্ধি পেল। আকস্মিক ঘটনার ফলেই দুক দ্য এনি তার হাতে পড়ে, অপ্রত্যাশিতভাবে তার হাতেই নিহত হয়–ফলে জনতার মনে এই ধারণাই দৃঢ়তর হয় যে একাজ করার অধিকার তার আছে, কারণ সে শক্তি আছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটা অভিযানের উদ্যোগ-আয়োজন করেও (করলে হয় তো তার ধ্বংসই ছিল অনিবার্য) আকস্মিক ঘটনাচক্রেই সে বাসনা পরিত্যাগ করে অপ্রত্যাশিতভাবে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যাক ও অস্ট্রিয়ানদের উপরে, আর বিনা যুদ্ধে তারা আত্ম সমর্পণ করল। আকস্মিক ঘটনাচক্র আর প্রতিভাই তাকে বিজয়-গৌরব এনে দিল অস্তারলিজে, আর আকস্মিকভাবেই সব মানুষ, কেবল ফ্রান্সের নয়, সারা ইওরোপের মানুষ-একমাত্র ইংল্যান্ড বাদে-স্বীকার করে নিল তার কর্তৃত্ব, তার নতুন পদ-মর্যাদা, তার গৌরব ও জাকজমকের আর্দশ।

নিজেদের শক্তির পরিমাপ করতে এবং আসন্ন অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতেই পশ্চিমদেশীয় শক্তিগুলি বারবার পুবের দিকে পা বাড়াল-১৮০৫, ১৮০৬, ১৮০৭, ও ১৮০৯-এ আরো উত্তরোত্তর তাদের শক্তি বাড়তে লাগল। ১৮১১-তে যে জনগোষ্ঠীটি গড়ে উঠেছিল ফ্রান্সে, তার সঙ্গে এককাট্টা হয়ে যোগ দিল মধ্য ইওরোপের একটা বড় জনগোষ্ঠী। দল যত বড় হতে লাগল দলপতির শক্তি ততই বাড়তে লাগল। দশ বছরব্যাপী প্রস্তুতির কালে এই লোকটি ইওরোপের সব রাজা-রাজড়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলল। একের পর এক তারা ছুটে এল তার কাছে নতি স্বীকার করতে। এই মহামানবটির করুণা লাভের আশায় প্রাশিয়ার রাজা পাঠাল নিজের স্ত্রীকে, এই লোকটি যদি সিজার-বংশের একটি কন্যাকে তার শয্যাসঙ্গিনী করে তাহলে অস্ট্রিয়ার সম্রাট নিজেকে অনুগৃহীদ মনে করবে, সব জাতির কাছে যা কিছু পবিত্র তার প্রতিভূস্বরূপ পোপ এই মহামানবটিকে তুষ্ট করতে ধর্মের আশ্রয় গ্রহন করল। যেন স্বীয় ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য নেপোলিয়ন নিজেকে তৈরি করছে না, যারা রয়েছে তার চারপাশে তারাই তাকে তৈরি করে তুলছে আসন্ন ঘটনাবলীর দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে। এমন কোনো কাজ, এমন কোনো পাপ, কোনো ছোটখাট জালিয়াতি সে করেনি যা তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখে মহৎ কীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়নি। জার্মানরা তো তার সম্মানে জেনা ও অরস্তাদ-এ একটা ভোজসভার আয়োজন করেছিল। এই লোকটি শুধু নিজেই মহান নয়, মহান তার পূর্বপুরুষরা, তার ভ্রাতাগন, তার বি-পুত্ৰগন, ও শ্যালকগনও। যেটুকু বুদ্ধি-বিবেচনা তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল সেটুকু নিঃশেষ করে একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালনের জন্য তাকে প্রস্তুত করে তুলতে সব কিছুই করা হল। এইভাবে সে নিজে যখন প্রস্তুত হল, তখনকার সৈন্যরাও প্রস্তুত।

অভিযান পূর্বদিকে অগ্রসর হল–পৌঁছল চরম লক্ষ্য মস্কোতে। নগর অধিকৃত হল, অস্তারলিজ থেকে ওয়াগ্রাম পর্যন্ত আগেকার সব যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যত ক্ষতি হয়েছিল এবার তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হল রুশ বাহিনীর। কিন্তু এবার চাকা ঘুরল। যে আকস্মিকতা ও প্রতিভা এতদিন সাফল্যের পর সাফল্যের এক নির্বিঘ্ন স্রোতের মুখে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথে, হঠাৎ এবার তার পরিবর্তে দেখা দিল অসংখ্য আকস্মিক ঘটনার এক উল্টো স্রোতবরদিনোতে তার মাথায় সর্দি বসে যাওয়া থেকে মস্কোর অগ্নিকাণ্ডের স্ফুলিঙ্গ ও বরফপাত পর্যন্ত আর প্রতিভার পরিবর্তে এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল নির্বুদ্ধিতা ও অপরিমেয় নিচতা।

আক্রমণকারীরা পালাচ্ছে, ফিরে দাঁড়াচ্ছে, আবার পালাচ্ছে, এবার কিন্তু আকস্মিকতার স্রোত বইতে লাগল নেপোলিয়নের স্বপক্ষে না হয়ে তার বিরুদ্ধে।

আগেকার পশ্চিম-পূর্ব অভিযানের মতোই একটা বড় রকমের পূর্ব-পশ্চিম পাল্টা অভিযান গড়ে উঠল। ১৮০৫, ১৮০৭ ও ১৮০৯-এর অভিযানের মতোই একটা পূর্ব-পশ্চিম অভিযান শুরু হল, সেই একইভাবে দলের পর দল এসে যোগ দিতে লাগল, যোগ দিল মধ্য ইওরোপের মানুষরা, মাঝপথে সেই একই ইতস্তত ভাব, এবং লক্ষ্যে পৌঁছাবার পথে সেই একই ক্রমবর্ধমান দ্রুতগতি।

শেষ লক্ষ্য প্যারিসে পৌঁছনো হল। নেপোরিয়নের রাজত্ব ও বাহিনী ধ্বংস হল। নেপোলিয়নের কিছুই আর করার নেই, এখন তার সব কাজই সকরুণ ও নিচ। কিন্তু আবার ঘটল সেই দুর্বোধ্য আকস্মিক ঘটনা। মিত্রশক্তিরা নেপোলিয়নকে ঘৃণা করে, তাকেই মনে করে তাদের সব দুঃখ-দুর্দশার কারণ। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে, সব পাপকর্ম ও চালকি ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে, সকলের চোখেই তার সমাজচুত্য দুষ্কৃতকারীর সেই মূর্তিই ফুটে উঠা উচিত ছিল যা সে ছিল দশ বছর আগে এবং পরের এক বছর। কিন্তু কোনো বিচিত্র আকস্মিক ঘটনার ফলে সে মূর্তি কারো চোখে ধরা পড়ল না। তার অভিনয় এখনো শেষ হয়নি। যে মানুষটি দশ বছর আগে এবং পরের এক বছর ছিল একটি সমাজচুত্য দুষ্কৃতকারী তাকে পাঠানো হল জাহাজে ফ্রান্স থেকে দুদিনের পথ একটা দ্বীপে, যে কারণেই হোক সেই দ্বীপটিকে তার রাজ্য হিসেবেই উপহার দেওয়া হল, তার জন্য রক্ষীর ব্যবস্থা করা হল, লক্ষ লক্ষ টাকা তাকে দেওয়া হল।

.

অধ্যায়-৪

জাতিসমূহের বন্যাস্রোতে স্বাভাবিকখাতেই ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। প্রবল আন্দোলনের তরঙ্গ স্তিমিত হয়ে এলেও তার শান্ত বুকে গড়ে উঠল অনেক ঘূর্ণাবর্ত, আর তাতে ভেসে বেড়াতে লাগল সেইসব কূটনীতিকের দল যাদের ধারণা তারাই বন্যাস্রোতকে স্তিমিত করেছে।

কিন্তু সমুদ্রের শান্ত বুক আবার সহসা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল, কূটনীতিকরা মনে করল, তাদের মতবিরোধিতাই প্রাকৃতিক শক্তির এই নতুন চাপের কারণ, তাদের ধারণা হল রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে আবার যুদ্ধ বাধবে, সে সংকটের কোনো সমাধান নেই। কিন্তু সে ক্রমবর্ধমান তরঙ্গভিঘাত তাদের প্রত্যাশিত অঞ্চল থেকে এল না। এল আগের মতো সেই একই কেন্দ্র থেকে–এল প্যারিস থেকে। পশ্চিম থেকে দেখা দিল শেষ উল্টো টান : যে কূটনৈতিক সমস্যা ছিল আপাতবিচারে অনতিক্রমনীয় সেই উল্টো টানেই তার সমাধান হয়ে গেল, ইতিহাসের সেই অধ্যায়ের সামরিক অবিযানের অবসান ঘটল।

যে মানুষটি ফ্রান্সকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল সে ফ্রান্সে ফিরে এল একেবারে একা-কোনো ষড়যন্ত্র করে নয়, কোনো সৈন্য সঙ্গে নিয়ে নয়। তখন যে কোনো রক্ষী তাকে বন্দি করতে পারত, কিন্তু কি এক বিচিত্র কারণে কেউ তা করল না, আগের দিন পর্যন্ত যে মানুষটিকে সকলে অভিশাপ দিয়েছে এবং একমাস পরে আবার অভিশাপ দেবে, তাকেই সকলে মহা উৎসাহে স্বাগত জানাল।

একটা সম্মলিত পদক্ষেপের জন্য সে মানুষটিকে আজও প্রয়োজন।

 সে কাজ সম্পন্ন হল।

শেষ ভূমিকার অভিনয় শেষ হল। অভিনেতাকে বলা হল : এবার রাজবেশ খুলে ফেল, মুখের পাউডার ও রং ধুয়ে ফেল। তাকে আর দরকার হবে না।

কয়েক বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে নিজের দ্বীপে একান্ত নির্জনে একটি করুণ হাসির নাটকে সে অভিনয় করে চলেছে, নিজের অতীত কর্মধারার কোনো সমর্থনের আর কোনো প্রয়োজন না থাকলেও ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা ভাষণের দ্বারা তাকেই সমর্থন করে চলেছে। সারা জগতের কাছে এতদিনে এই সত্যই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যতদিন পর্যন্ত একটি অদৃশ্য হাত তাকে পরিচালিত করেছে ততদিন মানুষ যাকে ক্ষমতা বলে ভুল করেছিল আসলে সেটা কি ছিল।

এবার নাটকের যবনিকা ফেলে দিয়ে এবং অভিনেতার সব সাজ-পোশাক খুলে ফেলে ম্যানেজার তাকে আমাদের সামনে এনে হাজির করল।

দেখুন, কাকে আপনারা বিশ্বাস করেছিলেন। এই তো সেই লোক! এখন কি বুঝতে পেরেছেন যে আপনাদের মুগ্ধ করেছিল সে ওই লোক নয়, সে আমি?

কিন্তু ঘটনার তীব্রতায় হতচকিত হওয়ায় এ সত্যি উপলব্ধি করতে মানুষের আরো দেরি হয়ে গেল।

এর চাইতেও অধিকতর সামঞ্জস্য ও অনিবার্যতা চোখে পড়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাল্টা আক্রমণের নায়ক প্রথম আলেক্সান্দারের জীবনে।

দরকার ছিল ন্যায়বোধ ও ইওরোপিয় ঘটনাবলির প্রতি সহানুভূতির, কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা আচ্ছন্ন গতানুগতিক সহানুভূতি নয়, তকালের যেসব রাষ্ট্রপ্রধান তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল তাদের অপেক্ষা উন্নত নৈতিক চরিত্র, একটি শান্ত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, আর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ক্ষোভ। প্রথম আলেক্সান্দারের চরিত্রে এ সবই ছিল, অসংখ্য তথকথিত আকস্মিক যোগাযোগ তার জীবনে এসবই গড়ে দিয়েছিল : তার শিক্ষা, প্রথম জীবনের উদারনৈতিক মতবাদ, চারদিকের পরামর্শদাতার দল, আর অস্তালিজ, তিলজিট ও এরফুর্ট।

জাতীয় যুদ্ধের সময়ে নিষ্ক্রিয় ছিল, কারণ তখন তাকে প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যে মুহূর্তে একটি ব্যাপক ইওরোপিয় যুদ্ধে অনিবার্য হয়ে উঠল, সেইমুহূর্তেই সে স্বস্থানে আর্বিভূত হয়ে ইওরোপের দেশগুলিকে সংঘবদ্ধ করে লক্ষ্যপথে এগিয়ে নিয়ে এল।

লক্ষ্যে পৌঁছনো হল। ১৮১৫-র চূড়ান্ত যুদ্ধের পরে সবরকম সম্ভবপর ক্ষমতা আলেক্সান্দার করায়ত্ত হল। কিন্তু সে ক্ষমতাকে সে কীভাবে ব্যবহার করল? প্রথম আলেক্সান্দার ইওরোপে শান্তির প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম জীবন থেকেই নিজের দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট, পিতৃভূমিতে নব নব উদারনৈতিক চিন্তাধারার প্রবর্তক। তার হাতে এখন সর্বাধিক ক্ষমতা। দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনের এই তো উপযুক্ত সময়। সুদূর দ্বীপে বসে নির্বাসিত নেপোলিয়ন ছেলেমানুষের মতো মিথ্যা স্বপ্ন দেখছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে কেমন করে সে মানবজাতিকে সুখের পথ দেখাতে পারত। প্রথম আলেক্সান্দারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, ঈশ্বরের হাত নেমেছে তার মাথায়, অথচ সহসা তার মনে হল, এ ক্ষমতা অতি তুচ্ছ, তাই দূরে সরে গিয়ে সব ক্ষমতা তুলে দিল সেই সব নগণ্য মানুষদের হাতে যাদের সে এতকাল ঘৃণা করে এসেছে। মুখে একমাত্র কথা, আমাদের জন্য নয়, আমাদের জন্য নয়, সবকিছু উৎসর্গিত হোক তোমারই নামে!…তোমাদের সকলের মতোই আমিও তো মানুষ। মানুষের মতোই আমাকে বাচঁতে দাও, আত্মা ও ঈশ্বরের কথা চিন্তা করতে দাও।

সূর্য ও প্রতিটি পরমাণু যেমন একাধারে একটি সম্পূর্ণ জগত আবার একটা সমগ্র সত্তার অংশমাত্র, তেমনই প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব আর্দশ ও লক্ষ্যের বাহক। একটি মৌমাছি ফুলের উপর বসতে গিয়ে একটি শিশুর শরীরে হুল ফুটিয়ে দিল। সেই থেকে শিশুটি মৌমাছিকে ভয় পায়, বলে যে মানুষের শরীরে হুল ফোঁটাতেই মানুষের জন্ম। মৌমাছিকে ফুলের পাপড়ি থেকে মধু সগ্রহ করতে দেখে কবি তার প্রশংসা করে, আবার একথাও বলে যে ফুলের গন্ধ লুটতেই মৌমাছির জন্ম। ফুল থেকে পরাগ সংগ্রহ করে মৌমাছি যখন তাকে মৌচাকে বয়ে নিয়ে যায় তখন একজন মৌমাছি-পালক বলে যে মধুসগ্রহ করাই মৌমাছির কাজ। আবার অন্য একজন মৌমাছি-পালক যে মৌমাছির জীবনযাত্রা ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে সে বলে, মৌমাছি পরাগরেণু সগ্রহ করে বাচ্চা মৌমাছিকে খাওয়াতে ও মক্ষীরানীকে বাঁচিয়ে রাখতে, বংশবৃদ্ধির জন্যই তার জন্ম। একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী দেখে, একটি মৌমাছি পুং-পুষ্প থেকে পরাগ সগ্রহ করে উড়ে গিয়ে তাকে গর্ভকেশরে স্থাপন করে, তার কাছে এটাই মৌমাছির জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। অপর একজন উদ্ভিদের স্থানান্তরে গমনের ঘটনায় মৌমাছির ঘটনাকে লক্ষ্য করে বলে যে সেটাই মৌমাছির জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়–মানুষের বুদ্ধিগত কোনো কর্মধারাই মৌমাছির জীবনের চরম লক্ষ্য হতে পারে না। এইসব উদ্দেশ্যের সন্ধানে মানুষের বুদ্ধি যত উপরে উঠতে থাকে ততই একটি সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চরম লক্ষ্য আমাদের বুদ্ধির অতীত।

মৌমাছির জীবনের সঙ্গে জীবনের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমগুলির সম্পর্কটাই একমাত্র জিনিস মানুষের বুদ্ধি যাকে ধরতে পারে। ঐতিহাসিক চরিত্র ও জাতিসমূহের উদ্দেশ্যের বেলায়ও একথা সমান সত্য।

.

অধ্যায়-৫

১৮১৩ সালে বেজুখভের সঙ্গে নাতাশার বিয়েই প্রাচীন রস্তভ-পরিবারের শেষ সুখের ঘটনা। কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ সেই বছরই মারা গেল, আর সর্বত্র যে রকম ঘটে থাকে, পিতার মৃত্যুর পরেই পারিবারিক বন্ধনও ভেঙ্গে পড়ল।

আগের বছরের নানা ঘটনা : মস্কোর অগ্নিকাণ্ড ও সেখান থেকে পলায়ন, প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যু, নাতাশার হতাশা, পেতয়ার মৃত্যু ও বৃদ্ধা কাউন্টেসের শোক–আঘাতের পর আঘাত হানল বুড়ো কাউন্টারে মাথায়। এসব ঘটনার কোনো তাৎপর্যই সে বুঝতে পারল না, আধ্যাত্মিক প্রশান্তির সঙ্গে সে পক্ককেশ মাথাটাকে নোয়াল, যেন প্রার্থনা করল আরো আঘাত এসে তাকে শেষ করে দিক। তাকে কখনো মনে হত ভয়াত ও হতবুদ্ধি, আবার কখনো মনে হত অসম্ভব রকমের জীবন্ত উদ্যমশীল।

নাতাশার বিয়ের ব্যবস্থাদি নিয়ে বেশ কিছুদিন ব্যস্ত থাকল। ডিনার ও সাপারের আয়োজন করল, সবসমই চেষ্টা করত হাসি-খুশি থাকতে, কিন্তু যারা তাকে জানত, তাকে ভালোবাসত তারা সবই বুঝত, বৃদ্ধকে করুণার চোখে দেখত।

পিয়ের ও তার স্ত্রী চলে গেল সে খুবই চুপচাপ হয়ে গেল, সবসময়ই বলতে লাগল, কিছুই তার ভালো লাগে না। কয়েকদিন পরেই সে অসুস্থ হয়ে বিছানা নিল। ডাক্তার যতই আশা দিক, প্রথম থেকেই সে জানত যে আর কোনোদিনই সে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। কাউন্টেস পোশাক না ছেড়েই তার বালিশের পাশে একটা হাতল-চেয়ারে বসে পক্ষকাল কাটিয়ে দিল। যতবার কাউন্টাকে ওষুধ খাওয়ায় ততবারই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে নিঃশব্দে তার হাতে চুমো খেত। শেষ দিনেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তাদের সম্পত্তি নষ্ট করার জন্য কাউন্টেসের কাছে, তাদের অনুপস্থিত ছেলের কাছে ক্ষমা চাইত–তার ধারণা তাদের কাছে সেটাই তার প্রধান অপরাধ। অনুষ্ঠানাদির পরে সে শান্তভাবে মারা গেল, পরদিন দলে দলে পরিচিত লোকজন এসে মৃতের প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গেল। জীবিতকালে তারাই কাউন্টকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলেও এখন সকলেই বলল : যাই বল না কেন কাউন্ট খুবই যোগ্য লোক ছিলেন। আজকাল এরকম লোক চোখে পড়ে না।…নিজ নিজ দুর্বলতা আমাদের কার না আছে?

বাবার মৃত্যু-সংবাদ যখন নিকলাসের কাছে পৌঁছল তখন সে রুশ বাহিনীর সঙ্গে প্যারিসে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কমিশন থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত হবার জন্য অপেক্ষা না করেই সে ছুটি নিয়ে মস্কো চলে গেল। কাউন্টে মৃত্যুর একমাস পরেই তার আর্থিক অবস্থা পরিষ্কার বোঝা গেল। তার যেসব ছোটখাট ধার-দেনার কথা কেউ সন্দেহই করেনি তাই যখন সর্বসাকুল্যে একটা মোটা অংক দেখা দিল, তখন সকলেই বিস্মিত হল। ঋণের পরিমাণ সম্পত্তির মূল্যের দ্বিগুণ।

বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়রা নিকলাসকে উত্তরাধিকার অস্বীকার করার পরামর্শ দিল। কিন্তু এই অস্বীকৃতি তার পিতার পবিত্র স্মৃতিকে কলংকিত করবে এ-কথা ভেবে সেসব পরামর্শ বাতিল করে দিয়ে সে উত্তরাধিকার এবং সেই সঙ্গে ঋণ-পরিশোধের দায়কে স্বীকার করে নিল।

যেসব পাওনাদার এতকাল চুপ করে ছিল এবার তারা সদলে এসে যার যার পাওনা-গণ্ডা দাবি করতে লাগল। এসব এক্ষেত্রে সাধারণত যা ঘটে থাকে, কার আগে কে পাওনা বুঝে পাবে তা নিয়ে পাওনাদারদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। নিকালসকে কেউ এতটুকু রেহাই দিল না, শান্তি দিল না, এতকাল যারা বুড়ো মানুষটিকে করুণা করে এসেছে তারাই উত্তরাধিকারী যুবকটিকে নির্মমভাবে হেঁকে ধরল।

নিকলাসের কোনো পরিকল্পনাই সফল হল না। নিলামে সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল অর্ধেক মূল্যে, অর্ধেক ঋণ তখনো বাকি রয়ে গেল। ভগ্নিপতি বেজুখভ যে ত্রিশ হাজার রুবল দিল নিকলস সেটা হাত পেতে নিল। অবশিষ্ট ঋণের দায়ে পাছে জেল খাটতে হয় তাই সে নতুন করে সরকারি চাকরি গ্রহণ করল।

পরবর্তী শূন্য পদেই তাকে কর্নেল করা হবে জেনেও সে সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে পারল না, কারণ জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে মা তাকে সম্পূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরল, কাজেই পরিচিত লোকজনের মাঝখানে মস্কোতে বাস করতে যত অনিচ্ছাই থাকুক, সিভিল সার্ভিসের চাকরিকে যতই ঘৃণা করুক, তবু মস্কোতে সেই চাকরিতেই সে ঢুকল, অতি প্রিয় সামরিক পরিচ্ছদ খুলে ফেলে মাকে ও সোনিয়াকে নিয়ে মস্কোর দরিদ্র পল্লী সিভৎসেভ ভ্রাঝেকের একটা ছোট বাড়িতে গিয়ে উঠল।

সেসময় নাতাশা ও পিয়ের পিটার্সবুর্গে বাস করেছিল, নিকলাসের অবস্থায় কোনো স্পষ্ট ধারণা তাদের ছিল না। ভগ্নিপতির কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার জন্য নিজের শোচনীয় অবস্থাটা তার কাছ থেকে গোপন রাখতেই সে চেষ্টা করেছিল। তার অবস্থা আরো সংকটজনক হয়ে উঠল কারণ বারোশো রুবল মাস-মাইনেতে তাকে যে মার, সোনিয়ার ও নিজের খরচ চালাতে হচ্ছে তাই শুধু নয়, তাদের দারিদ্রের খবরটা মার কাছ থেকে লুকিয়েও রাখতে হচ্ছে। যে বিলাস ও প্রাচুর্যের মধ্যে কাউন্টেস শৈশব থেকে লালিত-পালিত হয়েছে তাকে বাদ দিয়ে জীবন ধারণ করার কথা সে ভাবতেই পারে না, কাজেই ছেলের পক্ষে কতটা কষ্টকর হাত পারে সেটা না বুঝেই কাউন্টেস কোনো বান্ধবীকে বাড়িতে ডেকে আনতে গাড়ি পাঠাতে বলে (এখন তাদের নিজেদের গাড়ি নেই), কখনো বা নিজের জন্য আদেশ করে দামি খাবারের, ছেলের জন্য মদের, অথবা হয় নাতাশার জন্য, নয় তো সোনিয়ার জন্য, না হয় নিকলাসের জন্যই কোনো দামি উপহারের দরুন টাকার জন্য চাপ দেয়। সোনিয়া সংসার চালায়, খালার সেবা করে, তাকে পড়ে শোনায়, তার খেয়াল ও বদমেজাজ সহ্য করে, এবং কাউন্টেসের কাছ থেকে সংসারের দারিদ্রকে ঢেকে রাখতে নিকলাসকে সাহায্য করে। তার মার জন্য সোনিয়া যা করছে সেজন্য নিকলাস তার প্রতি অপরিশোধ্য ঋণ অনুভব করে, তার ধৈর্য ও সেবার প্রশংসা করে, কিন্তু সব সময় তার কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। নিকলাসের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হতে লাগল। মাস-মাইনে থেকে কিছু উদ্বৃত্ত রাখা স্বপ্নবৎ অলীক। কিছু জমাতে তো পারেই না, বরং মার দাবি-দাওয়া মেটাতে তাকে কিছু কিছু ধার-দেনাও করতে হয়। কিছু কিছু আত্মীয়ার পরামর্শমতো কোনো ধনবতী নারীকে বিয়ে করার কথা সে ভাবতেই পারে না। মুক্তির আর একটা পথ-মায়ের মৃত্যুর কথা কখনো তার মাথায়ই আসেনি। তার কোনো কামনা নেই, কোনো কিছুই সে আশা করে না। নিজের অবস্থাকে সহ্য করতে পারার মধ্যেই সে মনে মনে একটা কঠোর সন্তুষ্টি অনুভব করে। পুরোনো পরিচিতি জন, তাদের সহনুভূতি ও সাহায্যের প্রস্তাব–সবকিছুকেই সে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। এড়িয়ে চলে সবরকম আমোদ-প্রমোদ ও সাধ-আহ্লাদ। এমন কি বাড়িতেও মার সঙ্গে তাস খেলা, ঘরময় পায়চারি করা, এবং একটার পর একটা পাইপ ধরানো ছাড়া কিছুই করে না। মনের মধ্যে সেই বিষণ্ণতাকেই সযত্নে লালন করেই একমাত্র যার সাহায্যে এই দুরবস্থাকে সে সহ্য করতে পারে।

.

অধ্যায়-৬

 শীতের গোড়াতেই প্রিন্সেস মারি মস্কোতে এল। শহরে প্রচলিত আলোচনা থেকেই সে রস্তভদের অবস্থা জানতে পারল, জানতে পারল মায়ের জন্য ছেলের আত্মত্যাগের কথা।

নিকলাসের প্রতি গভীর প্রীতিবশত মারি নিজের মনেই বলল, তোমার কাছ থেকে এছাড়া অন্য কিছু আমি কখনো আশা করেনি। নিজেকে সে রস্তভ পরিবারেরই একজন বলে মনে করে। তাদের সঙ্গে বন্ধুতের কথা স্মরণ করে সে ভাবল, এ অবস্থায় তাদের সঙ্গে একবার দেখা করা তাদের কর্তব্য। কিন্তু ভরোনেঝে নিকলাসের সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্মরণ করে সেকাজ করার সাহস তার হচ্ছিল না। তবুও মস্কোতে আসার কয়েক সপ্তাহ পরে অনেক চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

নিকলাসের ঘরের ভিতর দিয়েই কাউন্টেসের ঘরে যাবার কথা, নিকলাসের সঙ্গেই তার প্রথম দেখা হল। প্রিন্সেস মারি আশা করেছিল নিকলাস তাকে সাদরেই গ্রহণ করবে, কিন্তু তার পরিবর্তে প্রথম দৃষ্টিতেই তার চোখে এমন একটা নিরাসক্ত, কঠিন ও গর্বিত ভাব দেখতে পেল যা আগে কখনো দেখেনি। নিকলাস তার স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাইল, মার ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে পাচঁ মিনেট বসেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

প্রিন্সেস কাইন্টেসের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলে নিকলাস আবার তার সঙ্গে দেখা করল, গম্ভীর, কঠিন মুখে তাকে নিয়ে বাইরের ঘরে গেল। মার স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাবই দিল না। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হল যেন বলতে চায় : তাতে তোমার কি দরকার? আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।

প্রিন্সেসের গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পরে সোনিয়াকে সামনে পেয়ে নিকলাস সোচ্চার বলে উঠল, কেন সে এখানে ঘুর ঘুর করতে আসে? কি চায় সে? এই সব মহিলা ও তাদের ভদ্রতাকে আমি সইতে পারি না।

নিজের খুশিকে চেপে রাখতে না পেরে সোনিয়া বলে উঠল, আঃ নিকলাস, এসব কথা তুমি বলতে পাররে কেমন করে? ও এত ভালো, আর মামণি ওকে এত ভালোবাসে!

নিকলাস জবাব দিল না, যেন প্রিন্সেসের কথা মুখেই আনতে চায় না। বুড়ি কাউন্টেস কিন্তু সেই থেকে প্রতিদিনই বেশ কয়েকবার প্রিন্সেস মারির কথা বলে।

কাউন্টেস তার গুনকীর্তন করে, ছেলেকে তার সঙ্গে দেখা করতে পীড়াপীড়ি করে, নিজে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু নিকলাস সারাক্ষণ চুপ করেই থাকে। তাতে কাউন্টেস আরো বিরক্ত হয়ে ওঠে।

বলে, মেয়েটি বড় ভালো, খাসা মেয়ে। তার কাছে গিয়ে তোমার দেখা করা উচিত। তাছাড়া, সদাসর্বদা শুধু আমাদের মুখ দেখতে তো তোমার ভালো না লাগারই কথা।

কিন্তু মামাণি, সেখানে যাবার ইচ্ছা আমার মোটেই নেই।

একসময় তুমি সেখানে যেতে চাইতে, আর এখন চাও না। সত্যে বলছি, তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি । এই তোমার মন খারাপ হয়, এই তুমি কারো সঙ্গে দেখা করতে চাও না।

মন খারাপের কথা তো আমি কখনো বলিনি।

সে কি, এই তো নিজের মুখেই বললে তার সঙ্গে দেখা করতেও চাও না। ও তো খুব ভালো মেয়ে, তুমি তো সবসমই ওকে পছন্দ করতে, কিন্তু এখন যে হঠাৎ তোমার মাথায় কি ঢুকেছে তা তুমিই জান। আমার কাছে তুমি সব কথা লুকিয়ে চল।

মোটেই তা নয় মামণি।

তবুও যদি তোমাকে কোনো খারাপ কাজ করতে বলতাম-তোমাকে তো বলছি ভদ্রতার খাতিরে তার সঙ্গে একবার দেখা করতে। সৌজন্যের খাতিরেই তো সেটা করা দরকার…। ঠিক আছে, আমার বলা আমি বললাম, এরপরও যদি মার কাছ থেকে লুকোবার মতো কোনো গোপন কথা তোমার থাকে তা আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না।

বেশ তো, তুমি যদি চাও তো আমি যাব।

এটা তো তোমার কোনো ব্যাপার নয়। তোমার জন্যই কথাটা বলছি।

নিকলাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল, গোঁফ কামড়াল, তারপর মার মনটাকে অন্য দিকে ঘোরতে তাস নিয়ে পেশেন্সের ছক বিছিয়ে দিল।

পরদিন সেই একই সংলাপের পুনরাবৃত্তি ঘটল, তার পরের দিন, এবং তারও পরের দিন।

রস্তভ পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিকলাসের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত রকমের শীতল অভ্যর্থনার পরে প্রিন্সেস মারিও নিজের কাছে স্বীকার করল যে প্রথম দেখা করতে না যাওয়াটাই তার উচিত ছিল।

আত্ম-গর্বে সে নিজেকে বোঝাল, এছাড়া আর কিছু তো আমি আশা করিনি। তার কাছে তো আর কোনো দরকার ছিল না। আমি গিয়েছিলাম বৃদ্ধা মহিলাটির সঙ্গে দেখা করতে, তিনি আমাকে চিরদিনই ভালোবাসেন, তার কাছে আমি অনেক দিক থেকে দায়বদ্ধ।

মধ্যশীতের একটা দিন। পড়ার ঘরে বসে সে ভাই-পোকে পড়াচ্ছিল, এমন সময় খবর এল রস্তভ এসেছে দেখা করতে। মনে মনে সংকল্প করল, কিছুতেই ধরা দেবে না, মনের উত্তেজনা কিছুতেই প্রকাশ করবে না। মাদময়জেল বুরিয়েকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানায় গেল।

নিকলাসের মুখের দিকে প্রথম দৃষ্টিপাতেই প্রিন্সেস মারি বুঝতে পারল শুধুমাত্র সৌজন্যের খাতিরেই সে এসেছে, তাই নিজের সুর সে মোটেই পাল্টালো না।

দুজনের মধ্যে কথা হল কাউন্টেসের কথা নিয়ে, বন্ধুদের নিয়ে, যুদ্ধের সর্বশেষ সংবাদ নিয়ে। তারপর দশ মিনিট পরে ভদ্রতার পাট চুকে যেতেই নিকলাস বিদায় নিতে উঠে দাঁড়াল।

মাদময়জেল বুরিয়ের সহায়তায় প্রিন্সেস বেশ ভালোভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে গেল, কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে নিকলাস যখন উঠে দাঁড়াল তখন যেন অসম্ভব একটা ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরল, মনে প্রশ্ন জাগল কেন সে জীবনে সুখের মুখ দেখতে পাবে না, অন্যমনস্কভাবে সে চুপ করে বসে রইল, উজ্জ্বল চোখ দুইটি সামনের দিকে নিবদ্ধ, নিকলাস যে উঠে দাঁড়িয়েছে সেটাও সে লক্ষ্য করেনি।

নিকলাস তার দিকে তাকাল, হঠাৎ প্রিন্সেসের জন্য তার নিজেরই দুঃখ হল, মনে হল প্রিন্সেসের এই দুঃখের জন্য হয়তো সে নিজেই দায়ী। ইচ্ছা হল প্রিন্সেসকে একটু সাহায্য করে, কিন্তু বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না।

বলল, বিদায় প্রিন্সেস!

প্রিন্সেস চমকে উঠল, তার মুখ লাল হয়ে উঠল, গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এল।

যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে বলল, মাফ করবেন, আপনি কি সত্যি চলে যাচ্ছেন কাউন্ট? বেশ তাহলে বিদায়! আরে, কাউন্টেসের জন্য যে একটা কুশন দরকার!

একটু অপেক্ষা কর, আমি এনে দিচ্ছি, বলে মাদময়জেল বুরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দুজনেই চুপ। মাঝে মাঝে একে অন্যকে দেখছে।

অবশেষে নিকলাস বিষণ্ণ হেসে বলল, হ্যাঁ প্রিন্সেস। বগুচারেভোতে আমাদের শেষ সাক্ষাতের পরে খুব বেশি দিন পার হয়নি, হয়ত এরই মধ্যে কত জলই না গড়িয়ে গেছে। তখন আমরা সকলে কি দুঃখেই না পড়েছিলাম, অথচ সেই দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনতে অনেক কিছু দিতেই আমি প্রস্তুত।…কিন্তু সেদিন আর ফিরবে না।

প্রিন্সেস মারি উজ্জ্বল দুটি চোখ তুলে একদৃষ্টিতে নিকলাসের দিকে তাকাল। যেন তার কথাগুলির গোপন তাৎপর্যকে বুঝতেই চেষ্টা সে করছে। বলল, ঠিক, ঠিক, কিন্তু অতীতের জন্য অনুশোচনা করার কোনো কারণ তো আপনার নেই। আপনার বর্তমান জীবনযাত্রা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয় খুশির সঙ্গেই আপনি সে দিনকে স্মরণ করবেন, কারণ যে আত্মত্যাগের দ্বারা সে জীবন পরিপূর্ণ…

নিকলাসের মুখে পুনরায় আগেকার মতোই কাঠিন্য ও শীতলতা ফুটে উঠল। কিন্তু যে মানুষটিকে প্রিন্সেস জানত ও ভালোবাসত তার দেখা সে এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তাকে উদ্দেশ্য করেই সে বলতে লাগল : ভেবেছিলাম একথা বলার অনুমতি আপনি আমাকে দেবেন। আপনার…এবং আপনার পরিবারের অন্য সকলের এত কাছে আমি এসেছিলাম যে ভেবেছিলাম আমার সহানুভূতিকে আপনি ভুল বুঝবেন না, কিন্তু আমারই ভুল হয়েছিল। হঠাৎ তার গলা কাঁপতে লাগল। কেন জানি না আপনি যেন বদলে গেছেন, আর…

 এ কেনর হাজার কারণ আছে,–নিকলাস কেন কথাটার উপর বিশেষ জোর দিয়ে বলল। ধন্যবাদ প্রিন্সেস, অনেক সময়ই এটা কষ্টের।

তাহলেই এটাই কারণ! এটাই কারণ! প্রিন্সেস মারির বুকের মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে বলল। না, শুধু এই সদয়, হাসিখুশি, খোলামেলা দৃষ্টিকে, শুধু এই সুন্দর বহিরাবরণকে তো আমি ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি তার মহৎ, স্থিতপ্রজ্ঞ, আত্মত্যাগী মনকেও। ঠিক, সে এখন গরিব আর আমি ধনী…হাঁ, সেটাই একমাত্র কারণ…হ্যাঁ, তা যদি না হত… নিকলাসের আগেকার মমতা স্মরণ করে এবং এখনকার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা তার শীতল ব্যবহারের কারণটা সে বুঝতে পারল।

নিজের অজ্ঞাতসারেই নিকলাসের আরো কাছে সরে গিয়ে প্রিন্সেস মারি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, কিন্তু কেন, কাউন্ট কেন? আমাকে বলুন। আপনাকে বলতেই হবে।

নিকলাস নীরব। প্রিন্সেস বলতে লাগল, আপনার কেনগুলি আমি বুঝতে পারছি না কাউন্ট, কিন্তু স্বীকার করছি…আমি বড় কষ্ট পাচ্ছি। যে কারণেই হোক আপনার সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্ব ছিল তা থেকে আমায় বঞ্চিত করতে চাইছেন। আর সেখানেই আমার দুঃখ। তার কণ্ঠ অশ্রুসিক্ত, দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ। জীবনে সুখের মুখ এত অল্প দেখেছি যে যা কিছু হারাই তাই আমার কাছে সহ্যের অতীত। ক্ষমা করবেন, বিদায়! সহসা কেঁদে উঠে সে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তাকে থামানোর চেষ্টায় নিকলাস ডাকল, প্রিন্সেস, ঈশ্বরের দোহাই! প্রিন্সেস! প্রিন্সেস ঘুরে দাঁড়াল কয়েক সেকেন্ডের জন্য দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল–আর যা মনে হয়েছিল সম্ভব ও অনেক দূরে তাই সহসা হয়ে উঠল সম্ভব, অনিবার্য, অনেক কাছে।

.

অধ্যায়-৭

১৮১৩ সালের শীতকালে নিকলাস প্রিন্সেস মারিকে বিয়ে করে স্ত্রী, মা ও সোনিয়াকে নিয়ে বল্ড হিলসে চলে গেল।

স্ত্রীর সম্পত্তির এতটুকু বিক্রি না করে চার বছরের মধ্যে বাকি ঋণ শোধ করে দিল এবং একজন জ্ঞাতির মৃত্যুতে উত্তরাধিকারসূত্রে একটা সম্পত্তি পেয়ে পিয়রের ঋণটাও শোধ করে দিল।

আরো তিন বছরে ১৮২০ সালের মধ্যেই সবকিছু এমনভাবে ব্যবস্থা করল যাতে বোল্ড হিলস সংলগ্ন একটা ছোট সম্পত্তিই সে কিনে ফেলল, এবং জীবনের একমাত্র প্রিয় স্বপ্ন অত্রাদকে আবার কিনে নেয়ার জন্য আলোচনা শুরু করে দিল।

প্রয়োজনের তাগিদে খামারের কাজে হাত দিয়ে সে কাজটা কার এত ভালো লেগে গেল যে এখন সেটাই তার প্রিয় এবং প্রায় একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে। নিকলাস খুব সাধাসিধেভাবে খামার চালায় : বর্তমানে প্রচলিত নতুন নতুন বিলাতি চাষ-ব্যবস্থা সে পছন্দ করে না। নিজের ক্ষেতে ফসল বোনা ও খড় কাটার মতো যত্ন নিয়েই সে অন্য চাষীদের ক্ষেতে ফসল বোনা ও খড় কাটার ব্যবস্থা করে দিত। ফলে চাষীদের সহযোগীতায় নিকলাসের ফসল বোনা ও ফসল কাটা ভালোভাবে এবং এত আগে আগে হয়ে যেত যা অন্য কোনো জমির মালিকের বেলাই সম্ভব হত না।

পারিবারিক ভূমিদাসদের-তাদের সে বলত দ্রোনকাজে লাগানো সে পছন্দ করত না। সকলেই বলত, লাই দিয়ে-দিয়ে সে তাদের মাথাটি খেয়েছে। কখনো কোনো ভূমিদাসকে শাস্তি দেবার দরকার হলে সে যে কি করবে তাই বুঝে উঠত না, আর বাড়ির সকলের সঙ্গেই তা নিয়ে পরামর্শ করত। অবশ্য চাষীদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত সে কখনো ইতস্তত বোধ করত না। সে জানত সে যাই করুক সব চাষীরাই সেটা মাথা পেতে নেবে। চারদিকে নিকলাসের জয়-জয়কার পড়ে গেল। তার লোকবল দ্রুত বাড়তে লাগল, পার্শ্ববর্তী সব জমিদারি থেকে ভূমিদাসরা এসে তার কাছে ধর্না দিত বিক্রি হবার জন্য। তার মৃত্যুর অনেকদিন পরেও তার সুশানের স্মৃতি ভূমিদাসরা সসম্মানে নিজ নিজ অন্তরে রক্ষা করে চলত। তিনি তো কর্তার মতো কর্তা… প্রথমে চাষীদের কাজ, তারপর নিজের। অবশ্য কোনো কিছুকেই তিনি অকহেলা করতেন না–এককথায় তিনিই তো ছিলেন সত্যিকারের কর্তা!

.

অধ্যায়-৮

পরিচালনা সংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে নিকলাস মাঝে মাঝে চিন্তিত বোধ করত–সেটা বদমেজাজ আর ঘুষি চালানোর অনেক দিকের হুজারি অভ্যাস। প্রথম প্রথম সে এতে দোষের কিছু পেত না, কিন্তু বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই এধরনের দণ্ডবিধানের ব্যাপারে হঠাৎ তার মতটা বদলে গেল।

একবার গ্রীষ্মকালে সে বগুচারেভোর গ্রাম-প্রধানকে ডেকে পাঠাল। তার বিরুদ্ধে ছিল আচরণ ও নানারকম বিধিবহির্ভূত কাজের অভিযোগ। নিকলাস বাইরে গেল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। গ্রাম-প্রধান কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবার পরেই চেঁচামেচী ও ঘুষির শব্দ শোনা গেল। প্রাতরাশে যোগ দিতে এসে নিকলাস স্ত্রীর কাছে গেল। স্ত্রী, তখন সেলাইয়ের ফ্রেমটার উপরে ঝুঁকে বসে ছিল। সকালে সে কী কী করেছে তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে নিকলাস বগুচারেভোর গ্রাম-প্রধানের কথাও বলল। কাউরন্স মারির মুখ প্রথমে রক্তবর্ণ ও পরে বিবর্ণ হয়ে গেল মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে সে বসে রইল। স্বামীর কোনো কথার জবাব দিল না।

গ্রাম-প্রধানের কথা মনে হতেই রেগে টং হয়ে নিকলাস চেঁচিয়ে বলল, লোকটা এত বেহায়া আর পাজী। যদি আমাকে বলত যে মদ খেয়েছিল বলে সে কিছু দেখাশোনা করতে পারেনি…আরে, তোমার কি হয়েছে মারি? হঠাৎ নিকলাস প্রশ্ন করল। কাউন্টেস মারি মাথা তুলে কি যেন বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু তখনই আবার মুখ নামিয়ে নিল, ঠোঁট দুটি বেঁকে যেতে লাগল।

আরে, কি হয়েছে বল না লক্ষ্মীটি?

চোখে পানি এলে কাউন্টেস মারিকে বড় সুন্দর দেখায়। সে তো বেদনায় বা বিরক্তিতে কখনো কাঁদে না, কাঁদে দুঃখে ও করুণায়, আর তখনই তার দুটি উজ্জ্বল চোখে ফুটে ওঠে এক দুর্বার মোহ।

নিকলাস তার হাতটা ধরতেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, কাঁদতে শুরু করল।

নিকলাস, আমি সব দেখেছি…সে দোষ করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তুমি কেন নিকলাস! কাউন্টেস মারি দুই হাতে মুখ ঢাকল।

নিকলাস কিছুই বলল না। মুখ লাল করে স্ত্রীর কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। স্ত্রী কেন কাঁদছে তা সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু অন্তরের দিক থেকে তার সঙ্গে একমত হয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে শিশুকাল থেকে যাকে সে প্রাত্যাহিক ঘটনা বলে জেনে এসেছে সেটা অন্যায় কাজ। সে নিজেকেই শুধাল : এটা কি নেহাই মেয়েলিপনা, না কি তার বিচারই ঠিক? এ সমস্যার সমাধানের আগেই সে আর একবার স্ত্রী ভালোবাসা ও বেদনায় ভরা মুখখানির দিকে তাকাল, আর তখনই সহসা বুঝতে পারল যে তার স্ত্রীর কথাই ঠিক, এতকাল ধরে সে নিজেই ভুল পথে চলে এসেছে।

স্ত্রীর কাছে গিয়ে ধীর গলায় বলল, মারি, এ জিনিস আর কখনো ঘটবে না, আমি তোমাকে কথা দিলাম।

 ক্ষমাপ্রার্থী বালকের মতো সে আর একবার বলল, কখনো না।

 কাউন্টেসের দুই চোখে আরো বেশি করে জলের ধারা নামতে লাগল। স্বামীর হাতখানা নিয়ে তাতে চুমো খেল।

নিকলাসের আঙুলে পরা ছিল লাওকুনের মাথা খোদাই-করা পাথর বসানো একটা আংটি। সেটার দিকে তাকিয়ে কাউন্টেস মারি শুধাল, তোমার আঙ্গুলের পাথরটা কখন ভেঙে ফেললে?

আজই-ওই একই ব্যাপার। ও মারি, সেকথা আর আমাকে মনে করিয়ে দিও না! নিকলাসের মুখটা আবার রাঙা হয়ে উঠল। তোমাকে কথা দিচ্ছি, এ ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে না। ভাঙা আংটিটা দেখিয়ে বলল, আর এটাই হবে আমার প্রতিশ্রুতির স্মারক।

তারপর থেকে গ্রাম-প্রধান অথবা নায়েবদের সঙ্গে আলোচনাপ্রসঙ্গে যখনই নিকলাসের মুখে রক্ত উঠে আসে, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হতে শুরু করে, তখনই সে আঙুলের ভাঙা আংটিটা তুলে ধরে, আর যার উপরে সে রাগ করছিল তার সামনেই নিজের চোখ দুটো নামিয়ে আনে। কিন্তু পুরো বারোটি মাসের মধ্যে দু একবার সে প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও গেছে, তখনই সে স্ত্রীর কাছে গিয়ে সে ভুল স্বীকার করেছে এবং পুনরায় কথা দিয়েছে যে সেটাই শেষবার।

স্ত্রীকে বলত, মারি, তুমি আমাকে ঘৃণা কর। সেটাই আমার প্রাপ্য।

স্বামীকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টায় স্ত্রী বিষণ্ণ গলায় বলত, নিজেকে সংযত করবার মতো যথেষ্ট মনের জোর যদি তোমার না থাকে, তাহলে চলে যাও, এখনই চলে যাও।

এ তল্লাটের ভদ্রসমাজ নিকলাসকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু পছন্দ করত না। স্বীয় সমাজের স্বার্থ নিয়ে সে মাথা ঘামাত না, ফলে কেউ তাকে ভাবত অহংকারী, আবার কেউ ভাবত বোকা। সারা গ্রীষ্মকালটা সে খামারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। হেমন্তকালে চলে যেত শিকারে-একমাস, এমন কি দুমাসও বাড়ি ছেড়ে থাকত। শীতকালে অন্যগ্রামগুলি দেখতে যেত, আর পড়াশুনা করে সময় কাটাত। বেশির ভাগ পড়ত ইতিহাসের বই, আর সেজন্য প্রতি বছরই বেশ কিছু টাকা ব্যয় করত। এইভাবে একটা ভালো গ্রন্থাগার সে গড়ে তুলেছে, নিয়ম করে নিয়েছে, যত বই কেনা সব সে পড়বে। ক্রমে পড়াটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল, পড়তে বসলেই সে একটা ভীষণ ধরনের আনন্দ পায়। শীতকালটা বিশেষ কোনো কাজে বাইরে না গেলে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গেই কাটায়। এইভাবে স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ক্রমেই ঘনিষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল : প্রতিদিন স্ত্রীর মধ্যে আবিষ্কার করতে লাগল নব নব আত্মিক সম্পদ।

বিয়ের পর থেকে সোনিয়া নিকলাসের বাড়িতেই থাকে। বিয়ের আগে নিকলাস স্ত্রীকে সোনিয়া সম্পর্কে সব কথাই বলেছে, সব দোষ নিজের ঘাড়ি নিয়ে সোনিয়ার প্রশংসা করেছে। প্রিন্সেস মারিকে বলেছে, এই বোনটির প্রতি সে যেন সদয় ব্যবহার করে। কাউন্টেস মারি ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে নিকলাস সোনিয়ার প্রতি অবিচার করেছে, তার মনে হয়েছে, তার সম্পত্তির জন্যই নিকলাস তাকে পছন্দ করেছে। সোনিয়ার কোনো দোষ সে দেখতে পায়নি। তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতেই চেষ্টা করেছে, তবু অনেক সময় তার প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করেছে।

একসময় বন্ধু নাতাশার সঙ্গে সোনিয়ার বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে নিজের অবিচারের কথাই তাকে বলল।

নাতাশা বলল, কি জান, তুমি তো সুভাষিতাবলি অনেক বেশি পড়ছে–তাতে একটা অনুচ্ছেদ আছে যেটা সোনিয়ার বেলায় খুব খাটে।

কোনটা বল তো? কাউন্টেস মারি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল।

যার আছে তাকে আরো দেওয়া হবে, আর যার কিছু নেই, তার কাছ থেকে সব নেওয়া হবে। মনে পড়ে? সোনিয়া সেই মানুষ যার কিছুই নেই, কেন নেই তা আমি জানি না। হয়তো আত্মসর্বস্বতার অভাব, আমি জানি না, কিন্তু তার কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছে, সবকিছু নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তার জন্য আমার খুব দুঃখ হয়। আগে আমি খুব চাইতাম যে নিকলাস তাকে বিয়ে করুক, কিন্তু সব সময়ই আমার মনে কেমন যেন একটা ধারণা ছিল যে সেটা ঘটবে না। সে এক ফলহীন ফুল, কি জান এক ধরনের স্ট্রবেরি ফুলের মতো। অনেক সময় তার জন্য আমার দুঃখ হয়, আবার অনেক সময় ভাবি, সে দুঃখকে সে তোমার-আমার মতো করে অনুভব করে না।

কাউন্টেস মারির মনে হল, সত্যি সত্যি সোনিয়া নিজের অবস্থাকে কষ্টকর বলে বলে মনে করে না, ফলহীন ফুলের ভাগ্যকেই সে মেনে নিয়েছে। সে কোনো ব্যক্তিকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে গোটা পরিবারকে। বিড়ালের মতোই তার অনুরাগ মানুষের প্রতি নয়, বাড়ির প্রতি। সে বুড়ি কাউন্টেসের সেবা করে, ছোটদের আদার দিয়ে নষ্ট করে, ছোটখাট সেবার জন্য সদাই প্রস্তুত থাকে, আর সকলেই বিনা কৃতজ্ঞতায়ই সে সেবা গ্রহণ করে।

বল্ড হিলসে পল্লী ভবনটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে, অবশ্য বুড়ো প্রিন্সের আমলের মতো ততটা বড় মাপে নয়। আর্থিক অসুবিধার মধ্যে অত্যন্ত সাদামাঠাভাবেই বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে। পুরোনো পাথরের ভিতের উপর প্রকাণ্ড বাড়িটা বানানো হয়েছে কাঠ দিয়ে, তার পলস্তরা করা হয়েছে কেবল ভিতরের দিকটা। নিজস্ব ভূমিদাস ছুতোর মিস্ত্রিরাই নিজেদের বার্চ কাঠ দিয়ে বানিয়েছে খুব সাধারণ শক্ত সোফা, হাতল-চেয়ার, টেবিল ও চেয়ার। বাড়িটা বেশ বড়, তাতে পারিবারিক ভূমিদাসদের জন্য ঘর আছে, আছে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। রস্তভদের গোটা পরিবার এবং বলকনস্কিদের আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বল্ড হিলসে আসে ষোলোটা ঘোড়া ও ডজনখানেক চাকর-বাকর নিয়ে, থাকে মাসের পর মাস। তাছাড়া, বছরে চারবার করে নামকরণ-দিবস ও জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে শ খানেক অতিথি এসে দু একটা দিন কাটিয়ে যায়। বছরের বাকি সময়টা দৈনন্দিন জীবনের বাঁধা পথ ধরেই চলে, প্রাতরাশ, লাঞ্চ, ডিনার ও সাপারের ব্যবস্থা সম্পত্তির আয় থেকেই চলে যায়।

.

অধ্যায়-৯

 ১৮২০ সালের পাঁচই ডিসেম্বর, সেন্ট নিকলাস দিবসের সন্ধ্যা। হেমন্তের শুরু থেকেই নাতাশা স্বামী-পুত্র নিয়ে দাদার বাড়িতেই আছে। পিয়ের গেছে পিটার্সবুর্গে নিজের কাজে, বলে গেছে সেখানে তিনি সপ্তাহ থাকবে, কিন্তু প্রায় সাত সপ্তাহ কেটে গেছে, যে কোনো সময় তার ফেরার কথা।

বেজুখভ পরিবার ছাড়াও নিকলাসের প্রবীণ-বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ভাসিলি দিমিত্রিচ দেনিসভা ৫ ডিসেম্বর উপলক্ষ্যে রস্তভদের বাড়িতেই আছে।

৬ তারিখে তার নামকরণ-উৎসব। বাড়িতে তখন অনেক অতিথির সমাগম হবে। নিকলাস জানে সেদিন তাকে নতুন পোশাক পরতে হবে, যে গির্জাটি সে নিজে তৈরি করেছে সেখানে যেতে হবে, যেসব অতিথিরা তাবে অভিনন্দন জানাতে সেখানে সমবেত হবে তাদের অভ্যর্থনা করতে হবে, তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করতে হবে জ্বজনদের নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা বলতে হবে। সেদিনের সন্ধ্যাটা সে কিন্তু স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়েই কাটাতে ইচ্ছুক। করলও তাই। ডিনারের সময় সে বাড়ি ফিরে এল, স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময় না থাকায় সোজ গিয়ে বসল বিশ জনের জন্য আয়োজিত লম্বা খাবারের টেবিলে। বাড়ির সকলেই তখন সেখানে হাজির টেবিলে বসেছে তার মা, মার বান্ধবী বেলোভা, তার স্ত্রী, গভর্নেস ও শিক্ষিকাসহ তাদের তিনটি সন্তান, সোনিয়া, দেনিসভ নাতাশা ও তার তিন সন্তান, তাদের গভর্নেস, এবং স্বর্গত প্রিন্সের স্থপতি বুড়ো মাইকেল আইভানভিচ, অবস নিয়ে সে বল্ড হিলসে বাস করছে।

কাউন্টেস মারি বসেছে টেবিলের অপর প্রান্তে। স্বামীর হাবভাব দেখেই মনে হল তার মন-মেজাজ ভালে নেই। এভাবে তাকে অকারণে ক্ষুব্ধ হতে দেখে কাউন্টেস মারি মনে আঘাত পেল, দুঃখিত হল। স্বামী কোথায় গিয়েছিল সেটা জানতে চাইল। নিকলাস জবাব দিল। স্ত্রী আবার জানতে চাইল, খামারে সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে কি না। স্ত্রীর অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বিরক্ত হয়ে সেও ভুরু কুঁকে তাড়াতাড়ি একটা জবাব দিল ।

কাউন্টেস মারি ভাবল, তাহলে আমি ভুল করিনি। কিন্তু সে আমার উপর বিরক্ত হল কেন?

দেনিসভকে ধন্যবাদ, সে আলোচনার মোড় ঘুড়িয়ে দিল, সকলে ভোলা মনে কথা বলতে শুরু করল। স্বামী স্ত্রী মধ্যে আর কোনো কথা হল না। টেবিল ছেড়ে যাবার আগে তারা যথারীতি বুড়ি কাউন্টেসকে ধন্যবাদ জানাল তারপর কাউন্টেস মারি হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাতে চুমো খেল, জানতে চাইল, সে রাগ করেছে কেন।

নিকলাস জবাবে বলল, কী সব অদ্ভুত ধারণা যে তোমার মাথায় আসে। রাগ করার কথাই তো আমার মনে আসেনি।

নিকলাস ও তার স্ত্রীর দিনগুলি সুখেই কাটছে। তাদের সুখ দেখে মাঝে মাঝে সোনিয়া ও বুড়ি কাউন্টেসের ঈর্ষা হয়। তবু তার মধ্যেই দুজনের খিটিমিটিও বাধে। কাউন্টেস মারির গর্ভাবস্থার পর থেকেই সেটা মাঝে মাঝেই ঘটছে। খুশি মনে বেশ শুনিয়ে শুনিয়েই নিকলাস বলল, দেখুন মাননীয়া ভদ্রমহোদয়া, সকাল ছয়টা থেকে ঠায় দুপায়েই তো চলছি। কাল আবার অনেক কষ্ট আছে কপালে। সুতরাং এবার একটু বিশ্রাম চাই।

স্ত্রীকে আর একটি কথাও না বলে সে ছোট বৈঠকখানায় গিয়ে সোফা শুয়ে পড়ল।

কাউন্টেস মারি ভাবল, সর্বদা এই তো চলেছে। আমার সঙ্গে ছাড়া আর সকলের সঙ্গেই ও কথা বলে বুঝেছি…বুঝেছি, ওর কাছে আমি বিরক্তিকর হয়ে উঠেছি, বিশেষ করে আমার এই অবস্থায়। সে একবার তাকাল নিজের স্ফীত উদরের দিকে, আবার আয়নায় তাকাল নিজের ফ্যকাসে, শুকনো মুখের দিকে, চোখ দুটো আগে চাইতে অনেক বড় দেখাচ্ছে।

তার কাছে সবকিছুই বিরক্তিকর বোধ হচ্ছে-দেনিসভের চিৎকার ও উচ্চহাসি, নাতাশার কথা, বিশেষ করে সোনিয়ার বাকা চাউনি।

কিছুক্ষণ অতিথিদের সঙ্গে বসে থেকে কাউন্টেস মারি নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে নার্সারিতে গেল।

ছেলেমেয়েরা চেয়ার দিয়ে গাড়ি বানিয়ে মস্কো যাওয়া খেলছে, মাকেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে ডাকল কিছুক্ষণ বসে তাদের সঙ্গে খেলা করল, কিন্তু স্বামীর কথা, তার অকারণ রাগের কথা মনে করে চিন্তিত হল উঠে দাঁড়িয়ে পা টিপে টিপে ছোট বৈঠকখানার দিকে গেল। নিজেকে বলল, হয়তো সে ঘুমোয়নি, তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। বড় ছেলে ছোট্ট আন্দ্রু মাকে নকল করে পা টিপে তাকে অনুসরণ করল। খেয়ালই করল না। বড় বৈঠকখানায় তার সঙ্গে দেখা হতেই সোনিয়া বলল, সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মারি–তাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আন্দ্রু হয়তো তাকে জাগিয়ে তুলবে।

কাউন্টেস মারি মুখ ঘুরিয়ে তাকাল, দেখল ছোট্ট আন্দ্রু পিছন পিছন আসছে, বুঝল যে সোনিয়া ঠিক বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে তা মুখ লাল হয়ে উঠল, কিন্তু কোনো কড়া কথা উচ্চারণ করল না। সোনিয়াকে কিছু। বলে ইশারায় আন্দ্রুকে চুপি-চুপি আসতে বলে সে দরজার কাছে গেল। সোনিয়া অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিকলাস যে ঘরে ঘুমিয়েছিল সে ঘর থেকে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আসছে। সে শব্দ স্ত্রীর কাছে খুবই পরিচিত শুনতে শুনতেই সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল স্বামীর মসৃণ, সুন্দর কপাল, তার গোঁফ, তার সমস্ত মুখে ঘুমের মধ্যে রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে সেসব সে অনেকবার দেখেছে। হঠাৎ নিকলাস নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দিল আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট আ দরজার বাইরে থেকে বলে উঠল, বাপি! মামণি এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টেস মারি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ছেলেকে ইশারা করল। সে চুপ করে গেল। মুহূর্তের নীরবতা। সে নীরবতা কাউন্টেস মারির কাছে ভয়ঙ্কর। সে জানে, ঘুম ভাঙানোটা নিকলাস খুব অপছন্দ করে। আবার নিকলাসের গলা পরিষ্কার করার ও নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল। সে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, একমুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারি না। মারি, তুমি কি ওখানে? কেন ওকে এখানে এনেছ?

আমি শুধু তোমাকে দেখতে এসেছিলাম, খেয়াল করিনি…তুমি আমাকে ক্ষমা কর…।

নিকলাস কাশল। আর কিছু বলল না। কাউন্টেস মারি দরজা থেকে সরে এসে ছেলেকে নিয়ে নার্সারিতে ফিরে গেল। পাঁচ মিনিট পরে বাবার আদরের মেয়ে তিন বছরের কৃষ্ণাঙ্গী নাতাশা যখন দাদার কাছে শুনল যে বাপি ঘুমচ্ছে আর মা আছে বৈঠকখানায় তখন সে মার অলক্ষ্যে একদৌড়ে বাবার কাছে চলে গেল। কালো চোখের ছোট মেয়েটি সাহস করে দরজাটা সশব্দে খুলে ফেলল, ছোট ঘোট পা ফেলে সোফার কাছে এগিয়ে গেল, বাবা তার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়েছিল, নাতাশা পা টিপে এগিয়ে গিয়ে বাবার মাথার নিচেকার হাতে চুমো খেল। মৃদু হেসে নিকলাস মুখ ফেরাল।

দরজায় শোনা গেল কাউন্টেস মারির ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠস্বর, নাতাশা! নাতাশা! বাপি এখন ঘুমবে।

ছোট্ট নাতাশা জোর দিয়ে বলল, না মামণি, বাপি এখন ঘুমবে না। সে তো হাসছে।

নিকলাস উঠে বসল, মেয়েকে কোলে তুলে নিল। স্ত্রীকে বলল, ভিতরে এস মারি।

ভিতরে ঢুকে সে স্বামীর পাশে বসল। সভয়ে বলল, আমি বুঝতে পারিনি, যে ছেলেটা আমার পিছু পিছু আসছিল। তোমার ঘরে একটু উঁকি দিয়েছিলাম মাত্র।

ছোট মেয়েটিকে এক হাতে ধরে নিকলাস আর এক হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তার চুলে চুমো খেল।

নাতাশাকে বলল, মামণিকে একটা চুমো খাই?

 নাতাশা লজ্জায় হেসে ফেলল।

 নিকলাস যে জায়গাটায় চুমো খেয়েছিল সেটা ইশারায় দেখিয়ে সে ধমক দিয়ে বলল, আবার!

স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে পেরে নিকলাস বলল, আমি তো বুঝতে পারি না কিসে তুমি জানলে যে আমি রাগ করেছি।

তুমি ওরকম ভাব দেখালে আমি যে কত দুঃখ পাই, কত একলা বোধ করি সে ধারণা তোমার নেই। আমার সব সময়ই মনে হয়…

নিকলাস হেসে বলল, বাজে কথা বলো না মারি। তোমার এজন্য লজ্জা হওয়া উচিত!

মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভালোবাসতে পার না, আমি এত সাদাসিধে… চিরকালই তাই… আর এখন… এই অবস্থায়…

আঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না! রূপের জন্যতো ভালোবাসা নয়, ভালোবাসাই মানুষকে সুন্দর করে। মালভিনা এবং ওই ধরনের নারীদেরই মানুষ রূপের জন্য ভালোবাসে। কিন্তু আমার স্ত্রীকে কি আমি ভালোবাসি না? যদি ভালো না বাসি, কিন্তু… কীভাবে যে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না…

আমি জানি। তাহলে আমার উপর তুমি রাগ করোনি তো?

ভীষণ রাগ করেছি! সোফা থেকে উঠে নিকলাস হাসতে হাসতে বলল–আমি এতক্ষণ কী ভাবছিলাম জান মারি? ভাবছিলাম… পিয়েরকে বসন্তকাল পর্যন্ত থেকে যেতে বলব।

হলঘরে কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল।

 কেউ এসেছে।

নিশ্চয় পিয়ের। আমি দেখছি, বলে কাউন্টেস মারি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিকলাস ছোট মেয়েটিকে নিয়ে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল। একসময় হাঁপিয়ে উঠে মেয়েকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। অকারণেই তার মনে হল, একদিন এই মেয়ে বড় হবে, সে বুড়ো বয়সে তাকে সমাজে নিয়ে যাবে, আর তার বাবা যেভাবে মেয়ের সঙ্গে দানিয়েল কুপার নাচত, সেও সেইভাবে এই মেয়ের সঙ্গে মাজুকা নাচবে।

কয়েক মিনিট পরেই কাউন্টেস মারি ঘরে ঢুকে বলল, সে এসেছে। আহা, আমাদের নাতাশার জীবনে যেন জোয়ার এসেছে। এখন যদি তাকে দেখ! চল, চল, তাড়াতাড়ি চল। মেয়েটি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে বলল, অনেক হয়েছে, এবার ওকে ছেড়ে দাও তো!

মেয়ের হাত ধরে নিকলাস বেরিয়ে গেল।

কাউন্টেস মারি নিজের মনেই বলে উঠল, মানুষ যে এত সুখী হতে পারে তা আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না। মৃদু হাসিতে তার মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, আবার সেই সঙ্গে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলল, দুটি গভীর চোখে ফুটে উঠল শান্ত বিষণ্ণতা, যেন সুখের ভিতর দিয়েই সে অনুভব করল যে এমন আর একরকমের সুখ আছে যা এই জীবনে পাওয়া যায় না, অথচ এই মুহূর্তে আপনা থেকেই সে সুখের চিন্তা তার মনে জাগল।

.

অধ্যায়-১০

নাতাশার বিয়ে হয়েছিল ১৮১৩-র বসন্তকালের গোড়ার দিকে, ১৮২০-তেই তার তিনটি মেয়ে হয়েছে, তাছাড়া আছে অনেক আশার ধন কোলের ছেলেটি। নাতাশা আরো শক্তসমর্থ হয়েছে, মোটা হয়েছে, আজকের স্বাস্থ্যবতী জননী নাতাশার মধ্যে সেদিনের সেই তম্বী তরুণী নাতাশাকে চেনাই শক্ত। দেহ-রেখা আগের চাইতে স্পষ্টতর হয়েছে, মুখে দেখা দিয়েছে একটা প্রশান্ত, গম্ভীর ভাব। মুখের সেই উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, রমণীয় ভাবটা আর নেই। তার দেহ ও মুখ এখন নেহাই গতানুগতিক, আত্মার সাক্ষাৎ সেখানে কদাচিৎ মেলে। চোখে পড়ে শুধু একটি স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী, উর্বরা নারীমূর্তি। মুখে সেদিনের সেই কনক-দীপ্তি কৃচিৎ কখনো জ্বলে ওঠে, আর তখন সে যেন আগেকার চাইতেও মনোরমা হয়ে ওঠে।

বিয়ের পর থেকে নাতাশা ও তার স্বামী মস্কোতে, পিটার্সবুর্গে, মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে, অথবা নাতাশার মার কাছে অর্থাৎ নিকলাসের বাড়িতেই থেকেছে। তরুণী কাউন্টেস বেজুখভা সমাজে বড় একটা যাতায়াত করে না, আর গেলেও সেখানকার লোকজন তাকে নিয়ে খুশি নয়, তাদের চোখে সে মনোরমাও নয়, সৌজন্যপূর্ণও নয়। নাতাশা যে একলা থাকাই পছন্দ করে তা কিন্তু নয়, কিন্তু গর্ভিনী অবস্থা, সন্তানের জন্ম, তাদরে লালন-পালন ও স্বামীকে সঙ্গ দানে তার এত বেশি সময় কেটে যায় যে সমাজে যাবার সময়ই হয় না। বিয়ের আগে যারা নাতাশাকে চিনত তারা তো তার এই পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে যেত। একমাত্র বুড়ি কাউন্টেস মায়ের মন দিয়ে বুঝতে পারত যে নাতাশার যত কিছু হৈচৈ সবই ছিল স্বামী ও সন্তানের প্রয়োজনে, সে বলত, নাতাশা যে একদিন আদর্শ স্ত্রী ও জননী হবে তা সে আগেই জানত।

কাউন্টেস বলে, শুধু তার স্বামী-সন্তানের প্রতি ভালোবাসা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটাই যা সমস্যা।

কিন্তু সাধারণভাবে সমাজের ধার না ধরলেও নাতাশার কাছে তার আত্মীয়-স্বজনের সমাজ খুবই মূল্যবান-কাউন্টেস মারি ও তার দাদা, তার মা ও সোনিয়ার সঙ্গ সে খুবই পছন্দ করে। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে নাতাশা এত বেশি বিব্রত থাকে যে তার পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল বাঁধার ধরন, অপরকে ঈর্ষার চোখে দেখা–এসব কিছু নিয়েই সকলের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা পর্যন্ত চলত। সাধারণভাবে সকলেই মনে করে যে পিয়ের তো স্ত্রীর একেবারে হাতের মুঠোয়। কথাটা সত্যি। বিয়ের প্রথম দিনই নাতাশা তার দাবিগুলি জানিয়ে দিয়েছিল। সে বলেছিল, পিয়েরের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মালিক সে ও তার পরিবার। এই সম্পূর্ণ নতুন কথা শুনে পিয়ের তো অবাক। সে যেমন বিস্মিত হল, তেমনই আত্মতুষ্টিও বোধ করল, স্ত্রীর দাবিকে মেনেও নিল।

বাড়ির বাইরে পিয়ের স্ত্রীর নির্দেশ এত বেশি মেনে চলে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করা তো দূরের কথা, হেসে কথা বলতে পর্যন্ত সাহস করে না, সখ করে কখনো ক্লাবে যেতে পারে না, খুশি মতো টাকা খরচ করতে পারে না, এবং বিশেষ কাজ ছাড়া বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে কাটাতে সাহস করে না। অবশ্য এর ক্ষতিপূরণস্বরূপ বাড়ির ভিতরে নিজের জীবন এবং পরিবারের সকলকে চালাবার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব পিয়ের নিজের হাতে পেয়েছে। বাড়িতে নাতাশা চলে স্বামীর ক্রীতদাসীর মতো, সে যখন লেখাপড়া কের গোটা বাড়িটা তখন পা টিপে টিপে চলে। মুখ খুলতে না খুলতেই তার আদেশ পালিত হয়। মনের বাসনা প্রকাশ করামাত্রই নাতাশা এক লাফে ছুটে গিয়ে তা পূর্ণ করে দেয়।

এইভাবে বিবাহিত জীবনের সাতটা বছর কাটাবার পরে পিয়েরের মনে এই সানন্দ অনুভূতি হল যে সে নিজে লোক খারাপ নয়, আর এই অনুভূতির কারণ স্ত্রীর মধ্যে সে নিজেকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছে। মনে হল, তার মধ্যে ভালো-মন্দ দুইই ওতঃপ্রোতভাবে মিশে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে যা কিছু ভালো তার প্রতিবিম্ব পড়েছে স্ত্রীর মধ্যে, আর যা কিছু ঠিক ভালো নয় তাই খারিজ হয়ে গেছে। আর এটা কোনো বিচার-বিবেচনার ফল নয়, একটা প্রত্যক্ষ ও রহস্যময় প্রতিফলন।

.

অধ্যায়-১১

 রস্তভদের বাড়িতে থাকার সময় দুমাস আগে পিয়ের একটা চিঠি পেল প্রিন্স থিয়োডোরের কাছ থেকে, পিয়ের যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তেমন একটা সমিতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যোগ দিতে তাকে পিটার্সবুর্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

চিঠিখানা পড়ে (নাতাশা সব সময়ই স্বামীর চিঠি পড়ে থাকে) নাতাশা বলল, স্বামীর অনুপস্থিতি তার পক্ষে কষ্টদায়ক হলেও তার পিটার্সবুর্গে যাওয়া উচিত। পিয়েরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে নাতাশা তাকে যেতেই বলল, কিন্তু সেইসঙ্গে তার ফিরে আসার একটা নির্দিষ্ট তারিখও ঠিক করে দিল। তাকে চার সপ্তাহের ছুটি দেওয়া হল।

একপক্ষকালের বেশি হয়ে গেল সে ছুটি ফুরিয়েছে। ফলে নাতাশ সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে, কেমন যেন মন-মরা, বিরক্ত ভাব।

সেই পক্ষকালের মধ্যেই এসে হাজির হল দেনিসভ। সে এখন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, বর্তমান বিধিব্যবস্থায় খুবই অসন্তুষ্ঠ। নাতাশাকে দেখে তার মনে যুগপৎ দেখা দিল দুঃখ ও বিস্ময়। ক্লান্ত বিষণ্ণ দৃষ্টি, কাদাচিৎ কথার জবাব দেয়, সবসময়ই নার্সারির কথা বলে। একদিন যে তার মনকে ভুলিয়েছিল আজ এই তার স্বরূপ!

নাতাশা সারাক্ষণ মন-মরা ও খিটখিটে হয়ে থাকে, বিশেষ করে যখন মা, দাদা, সোনিয়া, অথবা কাউন্টেস মারি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে পিয়েরের কাজকে সমর্থন করে, তার ফিরতে বিলম্ব হবার কৈফিয়ৎ দেয়।

যে কাজকে সে কিছুদিন আগেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত তার সম্পর্কেই এখন বলে, যত সব বাজে, অর্থহীন কাজ–এসব আলোচনার কোনো শেষ নেই–যত সব বাজে সমিতি!

একমাত্র ছেলে পেতয়াকে আদর করতে সে নার্সারিতে চলে যায়। আর কেউই এই তিন বছরের প্রাণীটির মতো করে তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারে না-যুক্তিপূর্ণ কথাও বলতে পারে না। সেই প্রাণীটি যেন বলে, তুমি রাগ করেছ, তোমার মনে ঈর্ষা জেগেছে, তুমি ভয় পেয়েছ-কিন্তু আমি তো আছি! আর আমিই সেই…।

একথার কোনো জবাব নেই। এ তো সত্যের চাইতেও সত্য।

এই দুশ্চিন্তা-ভরা একটা পক্ষকাল নাতাশা ছোট্ট প্রাণীটিকে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করল যে তার ফলে তাকে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়াল, সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছেলের অসুখ দেখে সে ভীষণ ভয় পেল, অথচ, এটাই তার দরকার ছিল। তাকে সেবাযত্ন করতে পেয়ে স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা সহ্য করা তার পক্ষে সহজতর হল।

বাচ্চাটার সেবাযত্ন করতে করতেই সামনের ফটকে সে পিয়েরের স্লেজের শব্দ শুনতে পেল। বুড়ি নার্স সুখবরটি নিয়ে হাসিমুখে দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকল।

পাছে ছেলের ঘুম ভেঙে যায় তাই কোনোরকম নড়াচড়া না করে নাতাশা ফিসফিস করে শুধাল, সে কি এসেছে?

নার্সও ফিসফিস করে জবাব দিল, তিনি এসেছেন মাম। নাতাশার মুখে রক্ত উঠে এল, আপনা থেকেই চলতে চাইল পা, কিন্তু সে লাফিয়ে ছুটে যেতে পারল না। বাচ্চাটি আবার চোখ মেলে তার দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, তুমি এখানে? তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট চাটতে লাগল।

সাবধানে মাই টেনে নিয়ে নাতাশা তাকে একটু দোলা দিল, তারপর তাকে নার্সের হাতে তুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ছেলেকে ছেড়ে আসায় বিবেকের তাড়নায়ই যেন দরজায় থেমে পিছন ফিরে তাকাল। নার্স ছেলেকে খাটের রেলিংয়ের উপরে তুলে ধরেছে।

হেসে নিচু গলায় বলল, আপনি যান মাম! কোনো চিন্তা করবেন না, যান!

নাতাশা হাল্কা পা ফেলে ছুটে গেল বাইরের ঘরের দিকে।

পাইপ মুখে দিয়ে দেনিসভ পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল নাচ-ঘরে, আর তখনই প্রথম বারের মতো চিনতে পারল পুরোনো দিনের নাতাশাকে। তার পরিবর্তিত মুখ থেকে উৎসারিত হচ্ছে উজ্জ্বল সানন্দ আলোর বন্যা।

পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে নাতাশা বলছে, সে এসেছে, পিয়ের ফিরে এসেছে বুঝতে পেরে দেনিসভও খুশি হয়ে উঠল। ঝুল-বারান্দায় পৌঁছে নাতাশা দেখল, লোমের কোট গায়ে একটি দীর্ঘদেহী পুরুষ গলার স্কার্ফটা খুলছে। ওই তো সে! সত্যি সে! সে এসেছে! বলতে বলতে নাতাশা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল, তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে তার রক্তিম খুশি-খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, সত্যি সে, যেমন সুখী তেমনই সন্তুষ্ট…

তখনই সহসা তার মনে পড়ে গেল গত একপক্ষকালের উদ্বেগ ও যন্ত্রণার কথা, মুখ থেকে নিভে গেল খুশির আললা, চোখ কুঁচকে উঠল, ক্রুদ্ধ তিরস্কার বর্ষণ করে পিয়েরকে বিব্রত করে তুলল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো কাজ করেছ। তোমার তো মজা, সুখে দিন কাটিয়েছ.. কিন্তু আমার কি হাল? অন্তত ছেলেমেয়েদের কথাও তো ভাবা উচিত ছিল। আমার এই অবস্থা, বুকের দুধ নষ্ট হয়ে গেছে,…পেতয়া মরতে বসেছিল। আর তুমি সেখানে ফুর্তি করছিলে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফুর্তি…

পিয়ের জানে তার কোনো দোষ নেই, আরো আগে আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, সে জানে এই বকবকানি আরো দু এক মিনিট চলবে, আরো জানে যে সে নিজে বেশ খুশিই আছে। হাসতে চাইল, কিন্তু সাহসে কুলোল না। করুণ-করুণ মুখ করে ঝুঁকে দাঁড়াল।

সত্যি বলছি, এর আগে আসার উপায় ছিল না। কিন্তু পেতয়া কেমন আছে?

 এখন ভালো আছে। এস! তোমার লজ্জা হচ্ছে না দেখে আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি! তোমাকে ছাড়া আমি যে কেমন হয়ে গিয়েছিলাম, কত কষ্ট পেয়েছি, তা যদি নিজের চোখে দেখতে!

এখন ভালো আছ তো?

 পিয়েরের হাত ধরে টেনে নাতাশা বলল, চল, চল। তারা নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

নিকলাস ও তার স্ত্রী যখন পিয়েরকে দেখতে এল সে তখন নার্সারিতে ছোট ছেলেকে হাতে নিয়ে নাচাচ্ছে। ছেলেটির ফোকলা মুখে স্বর্গীয় হাসির ছটা। ঝড় অনেকক্ষণ থেমে গেছে, নাতাশার মুখে তখন খুশির উজ্জ্বল আলোর ঝিকিমিকি, মমতাভরা চোখে সে স্বামী ও পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

শুধাল, প্রিন্স থিয়োডোরের সঙ্গে সব কথা আলোচনা করেছ তো?

হ্যাঁ, চমৎকার আলোচনা হয়েছে।

আচ্ছা, প্রিন্সেসের সঙ্গে দেখা হয়েছে? একথা কি সত্যি যে সে ভালোবেসেছে…

সত্যি, কিন্তু ভাব তো…।

সেইমুহূর্তে নিকলাস ও কাউন্টেস মারি ঘরে ঢুকল। ছেলেকে হাতের উপর রেখেই পিয়ের ঝুঁকে পড়ে তাদের চুমো খেল, সব জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতে লাগল। কিন্তু তার মন তখনো পড়ে আছে ছোট ছেলের দিকে।

কাউন্টেস মারি বলল, কী মিষ্টি দেখতে! আচ্ছা নিকলাস, এমন মিষ্টি মধুর মুখ কি তোমাকে টানে না? আমি তো অবাক হয়ে যাই।

ঠাণ্ডা চোখে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে নিকলাস বলল, ওসব আমার আসে না, আমি পারি না। একদলা মাংসপিণ্ড!

স্বামীকে সমর্থন করে কাউন্টেস মারি বলল, অথচ ও কিন্তু খুব স্নেহশীল পিতা, অবশ্য বাচ্চারা এক বছরের মতো বড় হলে তবে…,

নাতাশা বলল, পিয়ের কিন্তু ওদের খুব আদর-যত্ন করে। সে তো বলে তার হাতটা না কি বাচ্চাদের আসনের মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। দেখই না।

শুধু সেজন্যই নয়… পিয়ের হঠাৎ হেসে উঠল। ছেলেকে তুলে দিল নার্সের হাতে।

.

অধ্যায়-১২

অন্য সব বড় সংসারের মতোই বল্ড হিলসেও অনেকগুলি ছোট ছোট স্বতন্ত্র জগৎ মিলেমিশে একটা বড় জগৎ গড়ে উঠেছে, যদিও প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে চলে এবং অন্যের বৈশিষ্ট্যকেও মেনে নেয়। সুখ দুঃখের যে ঘটনাই সে বাড়িতে ঘটুক সেটা সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়, যদিও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশের যার যার নিজস্ব বিশেষ কতকগুলি কারণ অবশ্যই থাকে।

যেমন ধরা যাক, পিয়েরের প্রত্যাবর্তন একটা আনন্দময় বড় রকমের ঘটনা, আর সকলেই সেটাকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছে।

পিয়ের ফিরে আসায় চাকর-মহল খুশি হয়েছে কারণ তারা জানে যে সে উপস্থিত থাকলে নিকলাস প্রত্যহ জমিদারি দেখতে যাবে না, তার মন-মেজাজও ভালো থাকবে, তাছাড়া, উৎসব উপলক্ষে তারা ভালো ভালো উপহারও পাবে।

পিয়ের ফিরে আসায় ছোটরা ও তাদের গভর্নের্সরা খুশি হয়েছে কারণ অন্য কেউ তার মতো করে তাদের সবাইকে সামাজিক জীবনযাত্রার মধ্যে টেনে আনে না। একমাত্র সেই ক্ল্যাভিকর্ডে সেরকম একোসাসের সুর বাজাতে পারে যার সঙ্গে সবরকম নাচই নাচা যায়, তাছাড়া, তারা জানে তাদের সকলের জন্যই সে নানা উপহার এনেছে।

ছোট্ট নিকলাস এখন পনেরো বছরের সুঠাম তরুণ, যেমন দেখতে সুন্দর তেমনই বুদ্ধিমান, হালকা বাদামি রঙের কোঁকড়ানো চুল, আর সুন্দর দুটি চোখ। সে খুশি হয়েছে কারণ পিয়ের কাকাকে সে খুব ভালোবাস। পিয়েরের সঙ্গে তার দেখা হয় কালে-ভদ্রে : কেউ তাকে পিয়েরকে ভালোবাসতে শেখায়ওনি। কাউন্টেস মারি তাকে বড় করে তুলেছে, সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে নিকলাস যাতে তার স্বামীকে তার মতোই ভালোবাসে, ছোট নিকলাসও তাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে ভালোবাসার সঙ্গে যেন একটু ঘৃণার ছোঁয়া থাকে। কিন্তু পিয়েরকে সে যেন পুজো করে। নিকলাসের মতো একজন হুজার বা নাইট হতে সে চায় না, সে চায় পিয়েরের মতো জ্ঞানী, গুণী ও দয়ালু হতে। পিয়ের কাছে এলেই তার মুখটা খুশিতে জ্বল জ্বল করে, পিয়ের তাকে কিছু বললেই তার মুখ লাল হয়ে ওঠে, দম আটকে আসে। তার সব কথা সে কান পেতে শোনে এবং পরেও তা নিয়ে অনেক ভাবে। পিয়েরের অতীত জীবন, ১৮১২-র আগেকার দুঃখের কথা (চুপি চুপি শোনা কিছু কথা থেকেই একটা অস্পষ্ট ছবি সে নিজের মনেই একে নিয়েছে), মস্কোর কাণ্ডকারখানা, বন্দি জীবন, প্লাতন কারাতায়েভ (পিয়েরের মুখ থেকে শোনা), নাতাশার প্রতি ভালোবাসা, এবং যে বাবার কথা সে মনেই করতে পারে না তার সঙ্গে পিয়েরের বন্ধুত্ব–সবকিছু মিলিয়ে তার চোখে। পিয়ের হয়ে উঠেছে একটি নায়ক ও মহাপুরুষ।

অতিথিরা পিয়েরকে স্বাগত জানিয়েছে কারণ সে সর্বদাই যে কোনো মজলিসকে প্রাণবন্ত ও সংঘবদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করে।

স্ত্রী ছাড়াও পরিবারের অন্য সব বড়রাও এমন একজন বন্ধুকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়েছে যে কাছে থাকলে জীবনযাত্রা আরো স্বচ্ছন্দ ও শান্তিময় হয়ে ওঠে।

বাড়ির বুড়িরা উপহার পেয়েই খুশি, বিশেষত এবার নাতাশা আবার আগেকার মতো হয়ে উঠবে।

এইসব আলাদা জগতের আলাদা মনোভাব পিয়ের ভালোই বাসে, সেইভাবেই সে তাদের সকলেরই বাসনা পূর্ণ করেছে। পূর্বেকার ব্যয়বহুল ব্যবস্থা মতোই পারিবারিক জীবন শুরু করার সময় থেকেই পিয়ের সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে যে আগেকার তুলনায় এখন তার ব্যয় হয় অর্ধেক, অথচ প্রধানত প্রথমা স্ত্রীর ঋণের দরুন সংসারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তারও অনেক উন্নতি দেখা দিয়েছে।

জীবনযাত্রা সীমিত বলেই তার ব্যয়ও এখন আগের তুলনায় কম : সেই ব্যয়বহুল বিলাসিতা, সে ধরনের জীবনযাত্রা তো যে কোনো মুহূর্তে বদলানো যায়, এখন আর সেভাবে সে জীবন চালায় না, চালাতে চায় না। সে বোঝে, বর্তমান জীবনযাত্রা মৃত্যুর দিন অবধি পাকাপাকিভাবে স্থির হয়ে গেছে, তার কোনো পরিবর্তন করা তার সাধ্যায়ত্ত নয়, এই জীবনযাত্রাই অল্প ব্যয়সাধ্য।

হাসিমুখে পিয়ের জিনিসপত্রগুলি সাজিয়ে রাখছিল।

দোকানির মতো করে একটা কাপড়েরর বাজ খুলতে খুলতে বলল, এটা কেমন হয়েছে বল তো?

বড় মেয়েটিকে কোলে নিয়ে নাতাশা সামনেই বসেছিল, স্বামীর উপর থেকে কাপড়টার দিকে চোখ ফিরিয়ে। বলল, বেলোভার জন্য তো? চমৎকার! হাত দিয়ে কাপড়টা দেখল।

নিশ্চয় এক আর্শিন-এর দাম এক রুবল হবে?

পিয়ের দামটা বলল।

এত সস্তা! নাতাশা মন্তব্য করল। মেয়েরা কী খুশিই না হবে! আর মাও! শুধু আমার জন্য এটা আনলেও পারতে। মুক্তোবসানো সোনার চিরুনিটার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল।

পিয়ের জবাব দিল, এডেলই তো লোভ দেখাল: সেই তো বারবার এটা কিনতে বলল।

সেটাকে চুলে গুঁজে দিয়ে নাতাশা বলল, কখন পরব এটা? ছোট্ট মাশাকে নিয়ে যখন সমাজে যাব তখন? হয় তো তখন আবার এটাই ফ্যাশন হয়ে উঠবে। আচ্ছা, এবার চল।

উপহারের জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে তারা প্রথমে নার্সারিতে ও পরে বুড়ি কাউন্টেসের ঘরে গেল।

কাউন্টেস সঙ্গী বেলোভাকে নিয়ে যথারীতি গ্র্যান্ড পেশেন্স খেলতে বসেছে। বগলে পার্শেলগুলো নিয়ে পিয়ের ও নাতাশা ঘরে ঢুকল। কাউন্টেসের বয়স তখন ষাটের উপর, সব চুল পাকা, মাথার কুঁচিবসানো টুপিতে মুখটাই প্রায় ঢেকে গেছে। মুখে ভাঁজ পড়েছে, উপরের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে।

পর পর ছেলে ও স্বামীর মৃত্যুতে তার মনে হয়েছিল আকস্মিকভাবেই এ জগৎ তাকে ভুলে গেছে, বেঁচে থাকার সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই গেছে হারিয়ে। সে খায়, পান করে, ঘুমোয়, জেগে থাকে, কিন্তু ঠিক বেঁচে থাকে না। জীবনে কোনো নতুন ছাপ আঁকা পড়ে না। জীবনের কাছে সে শান্তি ছাড়া আর কিছু চায় না, একমাত্র মৃত্যু দিতে পারে সে শান্তি। কিন্তু মৃত্যু যতদিন না আসে ততদিন তো তাকে বেঁচে থাকতেই হবে, অথবা সব জৈব শক্তিকেই ব্যবহার করতে হবে। শরীরের বিভিন্ন যন্ত্রকে কাজ করানো ছাড়া তার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাকে খেতে হয়, ঘুমতে হয়, চিন্তা করতে হয়, কথা বলতে হয়, কাঁদতে হয়, কাজ করতে হয়, রাগ দেখাতে হয়, আরও অনেক কিছু করতে হয় শুধু এই কারণে যে-তার পাকস্থলী আছে, মস্তিষ্ক আছে, স্নায়ুতন্তু আছে, একটি যকৃৎ আছে। সে কথা বলে যেহেতু তার জিভ ও ফুসফুসের অনুশীলন করা দরকার। ছোট শিশুর মতোই সে কাঁদে যেহেতু তার নাকটা পরিষ্কার হওয়া দরকার, ইত্যাদি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছে যে কাজ উদ্দেশ্যপূর্ণ, তার কাছে সেটা একটা অছিলামাত্র।

যেমন, আগের দিন যদি একটু ভারি খাওয়া হয়ে যায় তো সকালে তার রাগ করা দরকার হয়ে পড়ে, আর সেজন্য অছিলা হিসেবে সে বেছে নেয় বেলোভার বধিরতাকে।

ঘরের এক কোণ থেকে নিচু গলায় তাকে কিছু বলতে শুরু করে।

হয়তো বলে, আজ দিনটা একটু গরম মনে হচ্ছে সোনা।

বেলোভা জবাব দিল, ঠিক, ঠিক, তারা এসেছে। কাউন্টেসও রেগে বলল, হায় প্রভু! মেয়েটা কি বোবা আর কালা!

আর একটা অছিলা তার নস্য-সেটা হয় বেশি শুকনো, নয় তো বেশি ভেজা, আর নয় তো ভালো গুড়ো হয় না। এইসব বিরক্তি প্রকাশের পরে তার মুখটা হলদে হয়ে যায়। বেলোভা আবার কখন কালা হবে, নস্য ভেজা হবে, আর কাউন্টেসের মুখ হলদে হবে, দাসীরা সেটা অভ্রান্তভাবেই বুঝতে পারে।

বৃদ্ধার এই অবস্থা সংসারের সকলেই বোঝে, কিন্তু মুখে কেউ বলে না, সাধ্যমতো তার সব প্রয়োজন মেটাতে চেষ্টা করে। শুধু নিকলাস, পিয়ের, নাতাশা ও কাউন্টেস মারির মধ্যে বিষণ্ণ হাসির সঙ্গে দুএকবার দৃষ্টি বিনিময়ের ভিতর দিয়েই প্রকাশ পায় যে তারা বৃদ্ধার অবস্থাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

কিন্তু সে দৃষ্টি আরো অনেক কিছুই প্রকাশ করে : বুঝি বলে, তার জীবনে যা করণীয় ছিল তা সে করেছে, আজ তাকে যা দেখছি সেটাই তার সমগ্র রূপ নয়, একদিন আমরা সকলেই তার মতো হব, তাই তার সব খেয়াল হাসিমুখে মেনে নিয়েছি, একদিন যে ছিল পরম মূল্যবান, তাদের মতোই জীবন-শক্তিতে পরিপূর্ণ আর তাই করুণার যোগ্য তার জন্য নিজেদের সংযত করেছি। সে দৃষ্টি যেন বলে, একদিন তো আমরা সকলেই মরব।

শুধু এ সংসারে যারা সত্যি হৃদয়হীন, যারা নির্বোধ, আর যারা একেবারেই শিশু, তারাই একথাটা বুঝতে পারে না, আর তাই তাকে এড়িয়ে চলে।

.

অধ্যায়-১৩

পিয়ের ও তার স্ত্রী যখন বৈঠকখানায় ঢুকল কাউন্টেস তখন মানসিক অনুশীলনের প্রয়োজনে যথারীতি পেশেন্স খেলায় ব্যস্ত ছিল। স্বভাবসিদ্ধভাবেই সে তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, অনেকদিন পরে সোনা, অনেকদিন পরে! তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! উপহারগুলি পেয়ে আবার সেই একই পুরোনো মন্তব্য করল, উপহারটার তো দাম নয়, আসলে দামি হল তুমি যে আমার কাছে ফিরে এসেছ সেটাই, আমি তো বুড়ো হয়েছি…। মুখে কথাগুলি বললেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে সেইমুহূর্তে পিয়েরকে দেখে কাউন্টেস খুশি হয়নি, কারণ তার ফলে অসমাপ্ত খেলায় বাধা পড়েছে।

পেশেন্স খেলা শেষ করে তবে সে উপহারগুলি ভালো করে দেখতে লাগল। খুব ভালো জাতের এক বাক্স তাস, উজ্জ্বল নীল রংয়ের একটা সেভ্রে চায়ের কাপ–তার উপর মেষপালিকার ছবি আঁকা ও একটা ঢাকনা দেওয়া–আর একটা নস্যের কৌটো, তার উপর ভালো কারিগর দিয়ে কউন্টেসের ছবি খোদাই করে আঁকা। এরকম একটা কৌটো কাউন্টেসের অনেকদিনের ইচ্ছা, কিন্তু এখন সেকথা জানাতে তার ইচ্ছা হল না, সে তাসের বাক্সের দিকেই নজর দিল।

অন্য সবসময়ের মতোই বলল, ধন্যবাদ সোনা, তুমি আমাকে খুব খুশি করেছ। কিন্তু তুমি যে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছ সেটাই সবচাইতে বড় কথা–কিন্তু তোমার বৌকে আচ্ছা করে বকে দিও তো, এরকমটা আমি কখনো দেখিনি। ওকে নিয়ে কি করি বল তো? তুমি চলে গেলে ও যেন পাগলের মত হয়ে যায়। কোনোদিকে নজর থাকে না, কোনো কথা মনে থাকে না…তারপর সঙ্গিনীর দিকে ফিরে বলল, দেখ আন্না তিমোফিভনা, ছেলে আমার জন্য কী সুন্দর একবাক্স তাস এনেছে।

বেলোভো উপহারগুলির প্রশংসা করল, তার পোশাকের কাপড় পেয়েও খুশি হল।

তারপর সকলে মিলে সামোভারকে ঘিরে চায়ের টেবিলে বসল। পিয়ের একে একে কাউন্টেসের সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল–প্রিন্স ভাসিলি বুড়ো হয়ে গেছে কি না, কাউন্টেস মারি আলেক্সিনা তাকে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে কি না, তাছাড়া আরো এমন সব প্রশ্ন করতে লাগল যাতে কারো কোনো আগ্রহ নেই, এমন কি এসব প্রশ্নের কথা সে নিজেও আর ভাবে না।

কথায় কথায় দেনিসভের আগ্রহে যুদ্ধের কথা, রাজনীতির কথা উঠল। বুড়ি কাউন্টেস সেসব আলোচনার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে গেল। ওদিকে পাশের ঘরে ছেলেমেয়েদের ও নাতাশার হৈ-হল্লা শুনে তাদের তদারকি করতে পিয়েরও চলে গেল।

.

অধ্যায়-১৪

কিছুক্ষণ পরে ছেলেমেয়েরা ঘরে ঢুকল শুভরাত্রি জানাতে। তারা সকলকে চুমো খেল, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গভর্নের্সরা অভিবাদন করল, তারপর চলে গেল। শুধু থেকে গেল ছোট্ট নিকলাস ও তার শিক্ষক। দেসালেস চুপি চুপি নিকলাসকে নিচে নেমে যেতে বলল।

নিকলাস বলকনস্কিও মৃদু স্বরে বলল, না সঁসিয়ে দেসালেস, আমি কাকিমাকে বলছি আমাকে এখানে তাকার অনুমতি দিতে।

কাকিমার কাছে গিয়ে বলল, মা তাঁতে, দয়া করে আমাকে এখানে থাকতে দাও।

তার মুখে ফুটে উঠল। অনুরোধ, উত্তেজনা ও উস। তার দিকে একবার তাকিযে কাউন্টেস মারি পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

বলল, তুমি যতক্ষণ আছ ততক্ষণ ও এখান থেকে নড়বে না।

সুইস শিক্ষিকাটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পিয়ের বলল, একটু পরেই ওকে আপনার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি মঁসিয়ে দেসালেস। শুভরাত্রি! তারপর নিকলাসের দিকে ফিরে বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে তো এখনো ভালো করে দেখা সাক্ষাই হয়নি। দেখ মারি, ও কত বড় হয়ে গেছে!

আমার বাবার মতো? উজ্জ্বল উচ্ছ্বসিত চোখ মেলে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে রক্তিম মুখে ছেলেটি শুধাল।

পিয়ের মাথা নাড়ল। তারপর আবার শুরু হল পিয়ের ও দেনিসভের আলোচনা। মারি উল বুনতে বসে গেল, নাতাশার চোখ সারাক্ষণ স্বামীর উপর। নিকলাস ও দেনিসভা উঠে পাইপ নিয়ে ধূমপান করল, সোনিয়ার কাছে থেকে আরো চা আনল। কোঁকড়া-চুল ছেলেটি সকলের অলক্ষ্যে ঘরের এককোণে বসে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।

কিছুক্ষণ পরে সকলে যখন নৈশ ভোজনের জন্য উঠে পড়ল তখন ছোট্ট নিকলাস বলকনস্কি পিয়েরের কাছে গিয়ে বলল, পিয়ের কাকা, তুমি…না…আচ্ছা, বাপি বেঁচে থাকলে…সে কি তোমার সঙ্গে একমত হত?

হঠাৎ পিয়ের বুঝতে পারল, ছোট ছেলেটির উপস্থিতিতে এসব আলোচনা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু একটা জবাব তো দিতেই হবে।

হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথাটা বলে সে বেরিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-১৫

ড্রেসিং-গাউন পরে নিকলাস যখন শোবার ঘরে ঢুকল, কাউন্টেস মারি তখন টেবিলে বসে কি যেন লিখছে।

কি লিখছ মারি? নিকলাস শুধাল।

কাউন্টেস মারির মুখ রাঙা হয়ে উঠল। একটা দিনপঞ্জী লিখছি নিকলাস, বলে নীল রংয়ের খাতাটি তার হাতে তুলে দিল।

দিনপঞ্জী? বল কী? একটু ঠাট্টার হাসি হেসে সে খাতাটা খুলে পাতা ওল্টাল। সত্যি, ফরাসিতে লেখা একটা দিনপঞ্জী। কাউন্টেস মারি ও ছেলেদের দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি কথা লিখে রাখা হয়েছে। খানিকটা দেখে খাতাটা টেবিলে রেখে দিল।

কাউন্টেস মারি বলল, দেখ, ছোট্ট নিকলাসকে নিয়ে মাঝে-মাঝেই আমার বড় চিন্তা হয়। এরকম ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। আমার ভয় হয়, নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে গিয়ে আমি হয় তো ওকে অবহেলা করছি। আমাদের তো সন্তান আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে, কিন্তু ওর তো কেউ নেই। সব সময় নিজের চিন্তায়ই ডুবে থাকে।

দেখ, আমার তো মনে হয় না তার জন্য তুমি নিজেকে দোষী করতে পার। স্নেহময়ী মা তার জন্য যা কিছু করতে পারত সেসবই তো তুমি করেছে, এখনো করছ, আর সেজন্য আমিও খুব খুশি। সত্যি ছেলেটি ভালো, খুব ভালো। আজ সন্ধ্যায় তো মন্ত্রমুদ্ধের মতো পিয়েরের কথাগুলি শুনছিল। ভালো ছেলে, বড় ভালো ছেলে।

কাউন্টেস মারি বলল, তবু আমি তো তার নিজের মা নই। সেটা আমি বুঝি আর তাই তো ভয় পাই। চমৎকার ছেলে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার ভয়ও খুব। কিছু সঙ্গীসাথী থাকলে তার পক্ষে ভালো হত।

নিকলাস বলল, সে ব্যবস্থাও শিগগিরই হবে। পরের গ্রীষ্মকালেই আমি তাকে পিটার্সবুর্গ নিয়ে যাব।

কাউন্টেস মারি মুখে কিছু বলল না। স্বামীর হাতটা হাতে নিয়ে চুমো খেল।

ছোট্ট ভাই-পোটির কথাই ভাবতে লাগল। পিয়েরের কথাগুলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে শুনেছে-স্বামীর এই কথাটা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। ছেলেটির স্পর্শকাতর চরিত্রের আরো অনেক বৈশিষ্ট্যই তার মনে পড়ে গেল। তার কথা ভাবতে গিয়ে সে নিজের ছেলেমেয়েদের কথাও ভাবল। তাদের মধ্যে কোনো তুলনা সে করল না, কিন্তু তাদের প্রতি নিজের মনোভাবের সঙ্গে ছোট্ট নিকলাসের প্রতি নিজের মনোভাবকে সে তুলনা না করে পাল না, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সে বুঝল যে ছোট্ট নিকলাসের প্রতি তার মনোভাবে কোথায় যেন কিছু ত্রুটি আছে।

অনেক সময় সে মনে করে, তাদের বয়সের জন্যই তার মনোভাবের এই পার্থক্য ঘটে, কিন্তু তবু নিজের মনে সে বোঝে যে সে অপরাধী, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, তার প্রতি সে আরো ভালো ব্যবহার করবে, অসাধ্য সাধন করবে-খৃস্ট যেভাবে মানুষকে ভালোবাসত। সেইভাবেই এ জীবনে সে ভালোবাসবে স্বামীকে, সন্তানকে, ছোট্ট নিকলাসকে, সব প্রতিবেশীকে। কাউন্টেস মারির মন সর্বদাই উড়ে চলে অনন্ত এ শাশ্বতের পানে, আর তাই কখনো শান্তি পায় না। তার মুখে ফুটে উঠল উন্নত মনের কঠিন ভাব, দেহবন্ধনে আবদ্ধ আত্মার গোপন যন্ত্রণা। নিকলাস একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। হে ঈশ্বর! সে মরে গেলে আমাদের কি হবে? তার এই মুখ দেখলেই যে সেই ভয়ই আমাকে পেয়ে বসে। এই কতা ভাবতে ভাবতে দেবমূর্তির সামনে বসে সে সান্ধ্য প্রার্থনা শুরু করল।

.

অধ্যায়-১৬

নাতাশা ও পিয়ের নিজেদের মধ্যে যেভাবে কথা বলতে শুরু করল তা একমাত্র স্বামী-স্ত্রীই বলতে পারে। বড় বড় চোখ তুলে নাতাশা স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল, তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে উঠল : এখন তুমি সম্পূর্ণ আমার, আমার! তোমাকে আর পালাতে দেব না!–আর সেইমুহূর্ত থেকে যে সংলাপ শুরু হল তা কোনো যুক্তি মানে না, বুঝি বা নিজেকেও মানে না, আপন বেগে আপনি উৎসারিত হয়ে চলে, পরস্পর পরস্পরকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।

নাতাশা পিয়েরকে বলল তার দাদার জীবন ও কাজকর্মের কথা, তার অনুপস্থিতিতে সে যে কত কষ্ট পেয়েছে, সে যে মারিকে কত ভালোবাসে, মারি যে তার তুলনায় অনেক ভালো–এমনি সব কথা। নাতাশা যে তার চাইতে অনেক বড় সেকথা আন্তরিকভাবেই স্বীকার করলেও সে কিন্তু পিয়েরের কাছে এ দাবিও সেইসঙ্গে রাখল যে পিয়েরকে কিন্তু মারি এবং অন্য সব মেয়ের চাইতে তাকেই বেশি ভালোবাসতে হবে, বিশেষ করে এখন পিটার্সবুর্গে অনেক নারী দেখে আসার পর সেকথা তাকে অতি অবশ্য নতুন করে ঘোষণা করতে হবে।

নাতাশার কথার জবাবে পিয়ের বলল, এবার পিটার্সবুর্গে গিয়ে ডিনারে ও বলনাচের আসরে মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করাটা তার কাছে বড়ই অসহ্য লেগেছে। 

বলল, মেয়েদের কথা বলার কায়দাই ভুলে গেছি। সব কেমন একঘেয়ে লাগত। তাছাড়া, আমি খুব ব্যস্তও ছিলাম।

নাতাশা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল : মারি চমৎকার মেয়ে! ছেলেমেয়েদের কথা খুব ভালো বুঝতে পারে। মনে হয় সে যেন তাদের মনের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পায়। ধর না গতকাল মিতা দুষ্টুমি করছিল…

পিয়ের বাধা দিয়ে বলল, ঠিক তার বাবার মতো।

নাতাশা হঠাৎ চুপ করে গেল। একটু পরে বলল, আমি এতক্ষণ কি ভাবছিলাম জান? প্লাতন কারায়েভের কথা।

পিয়ের উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ওঃ, প্লাতন কারাতায়েভ? আমাদের পারিবারিক জীবনটা দেখলে সে খুব খুশি হতে। সবকিছুর মধ্যেই সে দেখতে চায় মিল, সুখ, তাকে এনে আমাদের জীবনটা দেখাতে পারলে আমি গর্ববোধ করতাম। ভালো কথা–তুমি তো কেবলই আমার অনুপস্থিতির কথা বলছ, কিন্তু তুমি কি বিশ্বাস করবে এই বিরহের পরে তোমাকে এখন কত বেশি ভালো লাগছে…

হ্যাঁ, আমার ভাবা উচিত… নাতাশা বলতে শুরু করল।

 না, সেকথা নয়। তোমাকে না ভালোবেসে আমি পারি না। আমার মতো এমন ভালোবাসতেও কেউ পারে, কিন্তু এটা একটা বিশেষ ব্যাপার…সত্যি বলছি, অবশ্য-পিয়ের কথাটা শেষ করল না। কারণ চার চোখের মিলনেই বাকিটা বলা হয়ে গেল।

নাতাশা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, এই যেসব মধুচন্দ্রিকা নিয়ে এত হৈ-চৈ, প্রথমেই নাকি জীবনের যত মধুমাস,–এসবের কোনো মানে হয়! বরং এখনই তো সবচেয়ে সেরা সময়। শুধু তুমি দূরে চলে না যাও! তোমার মনে পড়ে, আমরা কত ঝগড়া করতাম? আর সব সময়ই দোষ ছিল আমার। সবসময়। আর কি নিয়ে যে ঝগড়া করতাম-তাও ছাই মনে পড়ে না!

পিয়ের হেসে বলল, কারণ তো একটাই…ঈর্ষা…

ওকথা বল না! আমি সইতে পারি না। তার চোখে আগুনের ঝিলিক। একটু থেমে বলল, তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

না। আর হলেও আমি তাকেই চিনতেই পারতাম না।

কিছুক্ষণ দুজনই চুপ।

যে মেঘ জমেছিল তাদের মনে সেটাকে উড়িয়ে দিতে নাতাশা বলতে আরম্ভ করল, আরে জান? তুমি যখন পড়ার ঘরে কথা বলছিলে তখন আমি তোমাকেই দেখছিলাম। তোমরা যেন এক বোটায় দুটো ফল–তুমি আর তোমার ছেলে।… ও হো, এবার আমাকে যেতে হবে। ওটাকে দুধ খাওয়াতে হবে।…তোমাকে ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।

কয়েক সেকেন্ড দুজন আবার চুপ। তারপর একই সঙ্গে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একই সময় দুজন কথা বলতে শুরু করল। পিয়েরের মুখে তৃপ্তির হাসি, নাতাশার মুখে খুশির শান্ত হাসি।

না, তুমি কি যেন বলছিলে? বলে যাও

না, তুমি বল, আমার যত সব বাজে কথা, নাতাশা বলল।

পিয়ের যেকথা বলতে শুরু করেছিল শেষ করল। পিটাসবুর্গে নিজের সাফল্যের কথাই বলল।

আমি শুধু বলতে চেয়েছি, যেসব চিন্তা-ভাবনা থেকে মহৎ ফসল ফলে আসলে সেগুলো খুব সরল, সহজ। আমার বক্তব্যের সার কথাই হল, পাপীরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তাহলে সৎ লোকদেরও তাই করতে হবে। এটা তো খুব সোজা কথা।

ঠিক।

আর তুমি কি বলছিলে?

আমি? যত বাজে কথা।

তবু?

আরো উজ্জ্বল হাসি হেসে নাতাশা বলল, আহা, অতিতুচ্ছ কথা। আমি বলতে চেয়েছি পেতয়ার কথা: আজ যখন নার্স তাকে আমার কাছ থেকে নিতে এল, তখন সে হেসে চোখ বুজল, আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি জানি, সে লুকোতে চাইছিল। কী মিষ্টি! ওই যে, আবার কাঁদছে। আচ্ছা, চলি। নাতাশা বেরিয়ে গেল।

এদিকে একতলায় ছোট্ট নিকলাস বলকনস্কির শোবার ঘরে একটা ছোট বাতি যথারীতি জ্বলছে। (ছেলেটি অন্ধকারকে ভয় পায়, সে ভয় কিছুতেই যাচ্ছে না।) দেসালেস ঘুমোয় চারটি বালিশে ভর দিয়ে, তার রোমক নাক থেকে সুরেলা শব্দ বের হতে থাকে। ছোট নিকলাস ঘামে ভিজে সবে ঘুম থেকে উঠেছে। বিছানায় বসে হাঁ করে সামনে তাকিয়ে আছে। ঘুম ভেঙেছে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখেছে, সে আর পিয়ের কাকা পুতার্কের বর্ণনামতো শিরস্ত্রাণ পরে একটা মস্ত বড় সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করছে। হেমন্তের বাতাসে যেসব মাকড়শার জাল ভেসে বেড়ায় তারই মতো কাৎ হয়ে চলেছে সেনাদল। সম্মুখে গৌরব, সেটা মাকড়শার জালের মতো হলেও আরো বেশি ঘন। সে ও পিয়ের ধীরে ধীরে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ জালের সুতোগুলো জড়িয়ে গেল, এগিয়ে চলা হল শক্ত। নিকলাস খুড়ো কঠিন, ভয়ঙ্কর মূর্তিতে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কিছু ভাঙা মোম ও কলম দেখিয়ে পিয়ের বলে উঠল, এ কাজ তোমরা করেছ? আমি তোমাদের ভালোবাসতাম, কিন্তু আরাকচিভ আদেশ পাঠিয়েছেন, যারা এগিয়ে আসবে তাদের প্রথম জনকে আমি হত্যা কর। ছোট্ট নিকলাস পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু পিয়ের সেখানে নেই। তার জায়গায় এসেছে তার বাবা-প্রিন্স আন্দ্রু-বাবার কোনো আকার নেই, গঠন নেই, তবু সে আছে, সেটা বুঝতে পেরে নিকলাস ভালোবাসায় দুর্বল হয়ে পড়ল :মনে হল সে নিজেও শক্তিহীন, পঙ্গু, নিরাকার। বাবা তাকে আদর করল, করুণা করল। কিন্তু নিকলাস কাকা ক্রমেই তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নিকলাস ভয় পেল। তার ঘুম ভেঙে গেল।

আমার বাবা! নিকলাস ভাবল। (বাড়িতে প্রিন্স আন্দ্রুর দুখানা প্রতিকৃতি থাকলেও নিকলাস কখনো তাকে মানুষের রূপে কল্পনা করেনি।) বাবা আমার কাছে এসেছে, আমাকে আদর করেছে। আমার ও পিয়ের কাকার কাজকে সমর্থন করেছে। সে আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব। মিউসিয়াস স্কাভোলা তার হাতটা পুড়িয়েছিল। আমার বেলায়ও কেন সেই একই ঘটনা ঘটবে না? আমি জানি তারা চায় আমি লেখাপড়া শিখি। শিখবই তো। কিন্তু একদিন তো লেখাপড়া শেষ হবে, আর তখন তো আমাকে কিছু না কিছু করতেই হবে। ঈশ্বরের কাছে আমার কেবল একটি প্রার্থনা, পুতার্কের চরিত্রগুলোর মতো আমার বেলায়ও কিছু ঘটুক, তাহলে আমিও তাদের মতোই কাজ করতে পারব। আরো ভালো কাজ করব। সকলেই আমাকে চিনবে, ভালোবাসবে, আমাকে দেখে আনন্দ পাবে। আর তখনই তার বুকটা দুলে উঠল, সে কাঁদতে লাগল।

তোমার কি অসুখ করেছে? তার কানে এল দেসালেসের গলা।

না, বলে নিকলাস আবার বালিশে মাথা রাখল। দেসালেস সম্পর্কে ভাবল, তিনি খুব ভালো, দয়ালু, আমিও তাকে ভালোবাসি! কিন্তু পিয়ের কাকা! আঃ, কী এক আশ্চর্য মানুষ! আর আমার বাবা? আহা, বাবা, আমার বাবা! হ্যাঁ, আমি এমন কিছু করব যাতে বাবাও খুশি হবে…

.

.

দ্বিতীয় পরিশিষ্ট

অধ্যায়-১

 ইতিহাস নানা জাতি ও মানবতার জীবনস্বরূপ। মানবতার জীবন, এমন কি একটিমাত্র জাতির জীবনকে আয়ত্তে এনে তাকে ভাষা দেওয়া, তাকে বর্ণনা করা স্বভাবতই অসম্ভব কাজ।

জনগণের যে জীবন স্পষ্টতই মরীচিকাসম তাকে করায়ত্ত করে বর্ণনা করার একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে সব প্রাচীন ইতিহাসকাররা। তারা বর্ণনা করেছে জনগণের শাসক ব্যক্তিবিশেষের কর্মধারাকে, আর সেই সব মানুষের কাজকেই তারা সমগ্র জাতির কাজ বলে ধরে নিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল : সেইসব ব্যক্তি নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে এক একটা জাতিকে প্ররোচিত করেছে কীভাবে, আর এইসব ব্যক্তির ইচ্ছাই বা পরিচালিত হয়েছিল কিসের দ্বারা? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রাচীনকালের মানুষরা ঐশ্বরিক শক্তির অবতারণা করেছে : সেই শক্তিই একদিকে একটা জাতিকে করেছে একজন নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছার বশীভূত, আবার অন্যদিকে সেই নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছাকে এমনভাবে পরিচালিত করেছে যাতে কোনো পূর্বনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে।

মানবিক ব্যাপারে দেবতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দ্বারাই প্রাচীনরা এইসব প্রশ্নের মীমাংসা করেছে। আধুনিক ইতিহাস নীতিগতভাবে এই দুই মতবাদকেই বাতিল করে দিয়েছে। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মানুষের উপর দেবতার কর্তৃত্ব এবং বিভিন্ন জাতির কোনো পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হওয়া প্রাচীন মানুষদের এই উভয়বিধ বিশ্বাসকে বাতিল করার পরে আধুনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করবে শক্তির বহিঃপ্রকাশকে নয়, তার কারণকে। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস তা করেনি। নীতির দিক থেকে প্রাচীনদের মতকে বাতিল করলেও কার্যত তাকেই তারা অনুসরণ করে চলেছে। ঐশ্বরিক কর্তৃত্বসম্পন্ন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত মানুষের পরিবর্তে আধুনিক ইতিহাস আমাদের দিয়েছে হয় অসাধারণ, অতিমানিবিক ক্ষমতার অধিকারী নায়কদের, আর না হয়তো নরপতি থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত এমন সব সাধারণ মানুষদের যারা জনতাকে পরিচালিত করে। আগেকার দিনের ইহুদি, গ্রিক, বা রোমক জাতির যেসব ঈশ্বরনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে প্রাচীন ইতিহাসকাররা মানবজাতির প্রতীক বলে মনে করত, তার পরিবর্তে আধুনিক ইতিহাস তুলে ধরেছে তার নিজস্ব উদ্দেশ্যকে–সে উদ্দেশ্য ফরাসি, জার্মান, অথবা ইংরেজ জাতির কল্যাণ, অথবা সর্বোচ্চক্ষেত্রে মানবজাতির কল্যাণ ও সভ্যতা, অবশ্য সে মানবজাতি বলতে সাধারণত বোঝায় একটি বৃহৎ মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের একটি ক্ষুদ্র অংশের দখলদার মানুষের কল্যাণ ও সভ্যতাকে। আধুনিক ইতিহাস প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাসকে বাতিল করেছে, কিন্তু তার জায়গায় কোনো নতুন ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা করেনি, এবং তার ফলে নতুন ইতিহাসকাররা অন্য পথে সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছে, অর্থাৎ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে (১) ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা পরিচালিত জাতি এবং (২) এমন একটি পূর্বজ্ঞাত উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব যার দিকে এগিয়ে চলেছে এইসব জাতি ও মানব সমাজ।

গিবন থেকে বাকল পর্যন্ত আধুনিক ইতিহাসকারদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যতই অমিল থাকুক, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যতই নতুনত্ব থাকু, তাদের সকলের লেখার ভিত্তি হিসেবে রয়েছে ওই দুটি প্রাচীন ও অনিবার্য ধারণা।

১৭৮৯-তে প্যারিসে একটা উত্তেজনা দেখা দিল : সেটা বেড়ে চলল, ছড়িয়ে পড়ল, এবং মানুষের পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে এগিয়ে চলার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। কয়েকবার সে গতি হল পূর্বমুখী, পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী একটা পাল্টা অগ্রগতির সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধল, ১৮১২-তে সেটা পৌঁছল চূড়ান্ত লক্ষ্য মস্কোতে, তারপর একটা অদ্ভুত মিল রেখে শুরু হল প্রত্যাঘাত, আর আগের মতোই মধ্য ইওরোপের জাতিগুলি তাতে যোগ দিল। প্রতি আন্দোলন প্রথম আন্দোলনের যাত্ৰাস্থল প্যারিসে পৌঁছে মিলিয়ে গেল। সেই বিশ বছরকালের মধ্যে অগণিত শস্যক্ষেত্রে চাষ-আবাদ হল না, অসংখ্য ঘর-বাড়ি পুড়ল, বাণিজ্যের গতি পরিবর্তিত হল, লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছাড়ল, কেউ নিঃস্ব হল, প্রেমধর্মে বিশ্বাসী লক্ষ লক্ষ খৃস্টান পরস্পরকে হত্যা করল।

এসবের অর্থ কি? এসব কেন ঘটল? কিসের জন্য মানুষ ঘর পোড়াল, মানুষকে খুন করল? এসব ঘটনার কারণ কি? কোন শক্তি তাদের দিয়ে এসব করাল? সেই সময়কার স্মৃতিস্তম্ভ ও ঐতিহ্যর মুখোমুখি হয়ে মনে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে এই সব ন্যায্য প্রশ্নই তো উচ্চারিত হয়। এইসব প্রশ্নের জবাবের আশায় মানুষের সাধারণ বুদ্ধি তো ইতিহাসবিজ্ঞানের দিকেই চোখ ফেরায়, কারণ জাতি ও মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখানোই তো ইতিহাসের লক্ষ্য।

ইতিহাস যদি প্রাচীনদের ধ্যান-ধারণাকে অক্ষুণ্ণ রাখত তাহলে সে বলত মানুষদের পুরস্কার বা শাস্তি দিতে ঈশ্বরই নেপোলিয়ানকে শক্তি দিয়েছেন, দৈব উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করতে তার ইচ্ছাকে পরিচালিত করেছেন, সেক্ষেত্রে এই উত্তরই হত স্পষ্ট ও পূর্ণ। লোকে নেপোলিয়াসের দৈব তাৎপর্যে বিশ্বাস করতে পারে, নাও করতে পারে, কিন্তু যে বিশ্বাস করে তার কাছে তকালীন ইতিহাসের কোনো কিছুই দুর্বোধ্য ঠেকবে না, বা কোনো স্ব-বিরোধিতাও তার চোখে পড়বে না। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস তো জবাব দিতে পারে না। মানুষের ব্যাপারে দেবতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের প্রাচীন ধারণাকে বিজ্ঞান স্বীকার করতে পারে না, আর তাই ইতিহাসকে অন্য জবাব দিতে হয়।

এইসব প্রশ্নের জবাবে আধুনিক ইতিহাস বলে : তুমি জানতে চাও এই আন্দোলনের অর্থ কি, তার কারণ কি, আর কোন শক্তি এইসব ঘটনা ঘটিয়েছে। শোনো : ষোড়শো লুই ছিল অত্যন্ত অহংকারী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ, তার এই-এই রক্ষিতা ছিল, এই-এই মন্ত্রী ছিল, আর ফ্রান্স সে খুব খারাপভাবে শাসন করছিল। তার বংশধররাও ছিল দুর্বল মানুষ, আর খারাপ শাসনকর্তা। তাদেরও ছিল এই-এই প্রিয়পাত্র, আর এই-এই রক্ষিতা। তাছাড়া, কিছু লোক সেইসময় কিছু বই ও লিখেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্যারিসের প্রায় ডজন দুই লোক বলতে শুরু করল যে সব মানুষই স্বাধীন ও সমান। তার ফলেই সারা ফ্রান্স জুড়ে মানুষ একে অন্যকে হত্যা করল। সেই সময়ে ফ্রান্স জুড়ে মানুষ একে অন্যকে আঘাত করতে লাগল, ডুবিয়ে মারতে লাগল। তারা রাজাকে হত্যা করল, আরো অনেককে হত্যা করল। সেই সময়ে ফ্রান্সে একজন প্রতিভাধর মানুষ ছিল-নেপোলিয়ান। সে সর্বত্র সকলকে জয় করল–অর্থাৎ সে অনেক মানুষ মারল, কারণ সে ছিল একটি মহৎ প্রতিভা। যে কারণেই হোক সে গেল আফ্রিকাবাসীদের মারতে, আর এত ভালোভাবে, এত সুকৌশল ও সুচিন্তিতভাবে তাদের মারল যে ফ্রান্সে ফিরে এসে সে যখন আদেশ জারি করল যে সকলকেই তাকে মানতে হবে, তখনই সকলেই তার বশ্যতা স্বীকার করল। সম্রাট হবার পরে সে আবার গেল ইতালি, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সে সেখারকার মানুষদের মারতে। সেখানে সে অনেককে মেরে ফেলল। রাশিয়াতে আলেক্সান্দার নামে একজন সম্রাট ছিল, ইওরোপে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এই মনস্থ করে সে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল। ১৮০৭-এ সে হঠাৎ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করল, কিন্তু ১৮১১-তে তাদের মধ্যে আবার বিবাদ বাধল, আবার তারা অনেক লোক মারতে শুরু করল। নেপোলিয়ান ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করল, মস্কো দখল করল, তারপর হঠাৎ সে মস্কো থেকে পালিয়ে গেল, আর সম্রাট আলেক্সান্দার স্তিন ও অন্যান্যদের পরামর্শে ইওরোপের এই শান্তি বিঘ্নকারীরা বিরুদ্ধে গোটা ইওরোপকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলল। নেপোলিয়ানের মিত্রপক্ষের লোকেরা হঠাৎ তার শত্রু হয়ে গেল, তাদের সেনাবাহিনীও তার বিরুদ্ধে এগিয়ে এল। মিত্রশক্তি নেপোলিয়ানকে পরাজিত করল, প্যারিসে প্রবেশ করল, নেপোলিয়ানকে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য করল, এবং তাকে এলবা দ্বীপে পাঠিয়ে দিল। অবশ্য তার সম্রাট উপাধিটা কেড়ে নিল না, তাকে সর্বপ্রকার সম্মানও দেখাল, যদিও পাঁচ বছর আগে এবং এক বছর পরে সকলেই তাকে দেখত একজন সমাজচ্যুত দস্যুর মতো। তারপর যে ষোড়শ লুই ছিল এতদিন ফরাসি ও মিত্রশক্তির পরিহাসের পাত্র সেই আবার শাসন-কর্ততে ফিরে এল। আর নেপোলিয়ন তারই ওল্ড গার্ডদের সামনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সিংহাসন পরিত্যাগ করে নির্বাসনে চলে গেল। তার পর সুকৌশলী রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবদরা (বিশেষ করে তালেবাদ) ভিয়েনাতে আলোচনায় বসল, এবং তাদের আলোচনার দ্বারা কোনো জাতিকে সুখী, কোনো জাতিকে দুঃখী করে দিল। হঠাৎ কূটনীতিবিদ ও রাজাদের মধ্যে লড়াই বাধার উপক্রম দেখা দিল, উভয় পক্ষের সেনাদলকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয় আর কি, এমন সময় এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ান এনে হাজির হল ফ্রান্সে, আর যে ফরাসিরা তাকে ঘৃণা করত তারাই সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে আত্মসমর্পন করল। মিত্রপক্ষের নরপতিরা ক্ষেপে গিয়ে আবার ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিল। প্রতিভাধর নেপোলিয়ানকে পরাজিত করল, আর তখনই হঠাৎ তাকে একটা দস্য বলে চিনতে পেরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে পাঠিয়ে দিল। আর সেই নির্বাসিত লোকটি তার বড় আদরের প্রিয় ফ্রান্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে সেই পাহাড়ের বুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল, আর তার মহৎ কার্যাবলিকে রেখে গেল অনাগত মানুষের জন্য। কিন্তু ইওরোপে আবার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, নরপতিগণ আর একবার প্রজাদের উপর উৎপীড়ন চালাতে লাগল।

এটাকে ঐতিহাসিক বিবরণের প্রতি বিদ্রূপ–তার একটা হাস্যকর চিত্র বলে মনে করলে ভুল করা হবে। পরন্তু সেই যুগের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্মৃতিকথার সংকলক ও ইতিহাসের লেখক থেকে আরম্ভ করে সাধারণ ইতিহাসের লেখক ও সংস্কৃতির নব ইতিহাসের লেখক পর্যন্ত এসব প্রশ্নের যেসব পরস্পরবিরোধী উত্তর দিয়েছে অথচ প্রশ্নের মীমাংশা করতে পারেনি তারই একটা অত্যন্ত বিবরণ এখানে দেয়া হল। এসব উত্তর এত অদ্ভুত ও অবাস্তব মনে হবার আসল কারণ, আধুনিক ইতিহাস বধির লোকের মতো এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে যা কেউ জিজ্ঞাসা করেনি।

মানবতার ও জনগনের অগ্রগতির বিবরণ দেওয়াই যদি ইতিহাসের উদ্দেশ্য হয় তাহলে তো প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে কোন সে শক্তি যা জনগণকে পরিচালিত করে? এই প্রশ্নের উত্তরে আধুনিক ইতিহাস যত্ন সহকারে হয় বলেছে যে নেপোলিয়ন ছিল মস্ত প্রতিভা, অথবা যোড়শ লুই ছিল অহংকারী, অথবা কিছু লেখক কিছু বই লেখেছে।

এই সব সত্য হতে পারে, মানুষ সেটা মেনে নিতেও প্রস্তত, কিন্তু প্রশ্ন তো সেটা নয়। এইসব উল্লেখযোগ্য হত যদি আমরা এমন একটি স্বয়ম্ভু ঐশ্বরিক শক্তিকে স্বীকার করতাম যিনি নেপোলিয়ন, লুই ও লেখকদের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহকে পরিচালিত করেন, কিন্তু আমরা তা স্বীকার করি না, আর তাই নেপোলিয়ন, লুই অথবা লেখকদের কথা বলার আগেই এসব লোকের সঙ্গে রাষ্ট্রসমূহের অগ্রগতি ও আন্দোলনের সম্পর্কটা আমাদের বুঝিয়ে দেয়া দরকার। ঐশ্বরিক শক্তির পরিবর্তে অন্য কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, সে শক্তি কী দিয়ে গঠিত তা আমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে, কারণ ইতিহাসের সমস্ত আকর্ষণই সেই শক্তিতে নিহিত। ইতিহাস যেন ধরেই নিয়েছে যে এই শক্তি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু এটাকে জানা বলে মনে করবার একান্ত ইচ্ছা স্বত্ত্বেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠের পরে এ সন্দেহ না জন্মাতে পারে না যে সত্যি সত্যি এটা সকলের জানা কি না।

.

অধ্যায়-২

কোন শক্তি জাতিসমূহকে পরিচালিত করে? জীবনীমূলক ইতিহাসকার এবং বিভিন্ন জাতির ইতিহাসকার এই শক্তিকে নায়ক ও শাসকদের জন্মগত শক্তি বলে মনে করে। তাদের বিবরণ অনুযায়ী সব ঘটনাই ঘটে নেপোলিয়ন, আলেক্সান্দার, বা অন্য কোনো ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে। তাদের এ ধারণা সন্তোষজনক হতে পারত যদি প্রতিটি ঘটানার মাত্র একজন করে ইতিহাসকার থাকত। কিন্তু যে মুহূর্তে বিভিন্ন জাতি ও ভাবধারার ইতিহাসকার একই ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করে, তখনই তারা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ এই শক্তিকে যে তারা শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বোঝে তা নয়, অনেক সময়ই বোঝে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধীভাবে। এক ইতিহাসকার বলে ঘটনাটি ঘটিয়েছে নেপোলিয়নের শক্তি, আবার অন্যজন বলে ঘটিয়েছে আলেক্সান্দারের শক্তি, অন্য কেউ কোনো তৃতীয় ব্যক্তির নাম করে। তাছাড়া, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন শক্তির কথাও তাঁরা বলে। যেমন বোনাপার্তপন্থী থিয়ের্স বলে, নেপোলিয়নের গুণাবলি ও প্রতিভার ওপরেই তার শক্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রজাতন্ত্রপন্থী লাফ্রে বলে, সে শক্তির ভিত্তি চালাকি ও জনগণকে প্রবঞ্চনা। সার্বিক ইতিহাসের সে সব লেখকের কারবার সব জাতিকে নিয়ে তারা তো বিশেষজ্ঞ ইতিহাসকারদের মতকে ভ্রান্ত বলেই মনে করে। তারা নায়ক বা শাসকদের কোনো জন্মগত শক্তিকে স্বীকারই করে না, তারা মনে করে, বিভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত বহু শক্তির ফলই সেই শক্তি যা ঘটনাকে ঘটায়। একটি যুদ্ধ অথবা একটি জাতির অধীনতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাধারণ ইতিহাসকার তার কারণের অনুসন্ধান করে সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে, কোনো একটি মানুষের শক্তির মধ্যে নয়। ১৮১৩-র অভিযান অথবা বুরবন-বংশের পুনঃ প্রতিষ্ঠার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ইতিহাসকাররা স্পষ্টই বলে যে আলেক্সান্দারের ইচ্ছাই এইসব ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সার্বিক ইতিহাসকার জার্ভিনাস প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে যে ওই দুটি ঘটনার পিছনে রয়েছে আলেক্সান্দারের ইচ্ছা ছাড়াও আরো অনেক কিছুযেমন স্তিন, ম্যাটার্নিক, মাদাম দ্য স্তায়েল, তালেরাদ, ফিকটে, চাতুব্রিয়াদ, ও অন্যদের কাজকর্ম। এইভাবে তাদের মধ্যে বিরোধিতা একান্তই স্পষ্ট। আর একটি তৃতীয় শ্রেণীর ইতিহাসকার আছে–তথাকথিত সংস্কৃতির ইতিহাসকার-যারা এই শক্তিকে একটা স্বতন্ত্র কিছু বলে মনে করে। এই শক্তির মধ্যে তারা আবিষ্কার করে সংস্কৃতিকে-মানসিক ক্রিয়াকলাপকে। তাদের মতে, কতগুলি ব্যক্তির আচরণের দ্বারা যদি ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, তাহলে অমুক-অমুক মানুষ অমুক-অমুক বই লিখেছে এই তথ্যের দ্বারা কেন তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না? তাদের মতে, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পিছনেই তো কাজ করে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার ফসল। কিন্ত মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাকে সংযুক্ত করার যত চেষ্টাই তারা করুক, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা খুব সহজসাধ্য নয়। ফরাসি বিপ্লবের নির্মম হত্যাকাণ্ড কি মানব-সাম্যের ফল হতে পারে? অথবা নিষ্ঠুর যুদ্ধ ও নরহত্যা মানুষকে ভালোবাসার ফল?

কিন্তু এইসব ইতিহাসকারের সুকৌশল যুক্তিকে মেনে নিলেও-ভাবধারা নামক কোনো অস্পষ্ট শক্তি জাতিকে পরিচালিত করে একথা মেনে নিলেও-ইতিহাসের মৌলিক প্রশ্নেও উত্তরটা তবু বাকি থেকেই যায়। পূর্বেকার দুটি শক্তি-নরপতিগণের ক্ষমতা এবং উপদেষ্টাও অন্য লোকের ক্ষমতার সঙ্গে আর একটা নতুন শক্তি-ভাবধারার শক্তি-যুক্ত হল মাত্র। নেপোলিয়নের ক্ষমতা ছিল, তাই ঘটনা ঘটেছিল, এটা বোঝা হয়তো সম্ভব, কিন্তু চেষ্টা করলে এটাও হয়তো বোঝা যায় যে নেপোলিয়ন ও অন্য কিছু শক্তি একত্র হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, কিন্ত Le Contract Social নামক একখানি বইয়ের প্রভাবে ফরাসিরা পরস্পরকে ডুবিয়ে মারতে শুরু করে দিল, বিনা ব্যাখ্যায় এটা বোঝা যায় না। কিন্তু এ ধরনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুণগুণ যাই হোক না কেন, আর একদিক থেকে সে ইতিহাস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে নানা ধর্মীয়, দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদের চুল-চেরা বিচারের পরে যে মুহূর্তে তারা কোনো সত্যিকারের ঐতিহাসিক ঘটনা-যেমন ১৮১২ সালের অভিযানের বর্ণনা দিতে বসে তখনই তারা সেটা কোনো শক্তি প্রয়োগের ফল বলে বর্ণনা করে–পরিষ্কার বলে যে সে অভিযানটি নেপোলিয়নের ইচ্ছার ফলে ঘটেছে। আর সে কথা বলে সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা অজান্তে নিজেদের মতেরই বিরোধিতা করে বসে, তারাই দেখিয়ে দেয়, যে নতুন শক্তি তারা উদ্ভাবন করেছে তা ইতিহাসের ঘটানাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, ইতিহাসের ব্যাখ্যা একমাত্র সেই শক্তি দিয়েই করা যেতে পারে যাকে তারা স্বীকার করে না।

.

অধ্যায়-৩

একটা ট্রেন চলেছে। একজন প্রশ্ন করল : এটাকে কে চালাচ্ছে? চাষী বলল, শয়তান চালাচ্ছে। আর একজন বলল, চাকাগুলো ঘুরছে বলেই গাড়িটা চলছে। তৃতীয় একজন বলল, বাতাসে যে ধোঁয়া উড়ছে সেটাই গাড়ির চলার কারণ। চাষীর কথা অকাট্য। তার ব্যাখ্যা পুর্ণাঙ্গ। তাকে খণ্ডন করতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে শয়তান বলে কিছু নেই, অথবা অন্য চাষীকে বলতে হবে যে শয়তান নয় একজন জার্মান গাড়িটা চালাচ্ছে। একমাত্র তখনই স্ব-বিরোধিতার ফলে তারা বুঝতে পারবে যে তাদের দুজনেরই ভুল হয়েছে। একমাত্র সে ধারণার দ্বারা গাড়ির গতিকে ব্যাখ্যা করা যায় তা হচ্ছে গতির উপযুক্ত একটি শক্তির ধারণা।

একমাত্র জনগণের অভিযানের উপযুক্ত একটি শক্তির ধারণার দ্বারাই সে ঘটনার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

অথচ সেই ধারণাটাকে তুলে ধরতে গিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসকার এমন বিভিন্ন ধরণের শক্তির উল্লেখ করেছে যা অভিযারে পক্ষে উপযোগী নয়। কেউ সেটাকে দেখে নায়কের সহজাত শক্তির মধ্যে, ঠিক যেভাবে গাড়ির বেলায় চাষী দেখে শয়তানকে, কেউ বা সেটাকে দেখে নানা শক্তির সম্মিলনের মধ্যে, চাকর ঘূর্ণনের মতো, অন্যরা তাকে দেখে বুদ্ধিগত প্রভাবের মধ্যে, বায়ুতাড়িত ধোয়ার মতো। যতদিন পর্যন্ত লেখা হবে আলাদা আলাদা ইতিহাস, সিজার, আলেক্সান্দার, লুথার অথবা ভলতেয়ার, যারই হোক না কেন, যতদিন কোনো ঘটনার অংশগ্রহণকারী সব, সব মানুষের ইতিহাস লেখা হবে, ততদিন একটা শক্তিকে মেনে না নিলে মানুষের অগ্রগতির বর্ণনা করা অসম্ভব। আর ইতিহাসকারদের জানা একমাত্র ধারণাই তো সেই শক্তির ধারণা।

মানুষ সম্পর্কে বিচার করতে বসে এখনো পর্যন্ত ইতিহাসবিজ্ঞানের অবস্থা বাজার প্রচলিত অর্থ-নোট ও মুদ্রার মতো। জীবনীগ্রন্থ এবং বিশেষ জাতীয় ইতিহাস হচ্ছে নোটের মতো। যতদিন পর্যন্ত কেউ সে নোটের নিরাপত্তার প্রশ্ন না তুলছে ততদিন পর্যন্ত তাদের ব্যবহার করে চলে, কারো কোনো ক্ষতি না করে তাদের উদ্দেশ্যও সার্বিকভাবে সাধিত হতে পারে। নায়কদের ইচ্ছা কেমন করে ঘটায় সে প্রশ্ন যদি ভুলে যাওয়া যায় তাহলে থিয়ের্স লিখিত ইতিহাসের অনুরূপ সব ইতিহাসই হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষণীয় হতে পারে, এমন কি কিছুটা কাব্যের ছোঁয়াও তাতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নোট যখন অধিক সংখ্যায় ছাপা হয়, অথবা মানুষ যখন তার বিনিময়ে সোনা কিনতে চেষ্টা করে, তখনই যেমন নোটের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে তখনই সন্দেহ দেখা দেয় যখন অনেক বেশি ইতিহাসের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে তখনই সন্দেহ দেখা দেয়, তেমনই ওইসব ইতিহাসের বই লেখা হয়, অথবা সরল মনে যখন কেউ প্রশ্ন করে বসে; কোন শক্তি বলে নেপোলিয়ন একাজ করেছিল?–অর্থাৎ প্রচলিত নোটের বিনিময়ে কেউ যখন বোধ্যতার প্রকৃত সোনা অর্জন করতে চায়।

সার্বিক ইতিহাস ও সাস্কৃতিক ইতিহাসের লেখকরা হচ্ছে সেই সব লোকের মতো যারা নোটের ত্রুটিগুলো বুঝতে পেরে তার জায়গায় এমন ধাতু দিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে চায় যাতে সোনার আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুপস্থিত। তাতে মুদ্রার ঠুনঠুন আওয়াজ হতে পারে, কিন্তু তার বেশি কিছু কাজে আসবে না। নোট হয়তো নির্বোধ লোকদের ঠকাতে পারে, কিন্তু খারাপ ধাতুর যে মুদ্রার ঠুনঠুন শব্দ ছাড়া কোনো মূল্য নেই তা দিয়ে কাউকেই ঠকানো যায় না। সোনা যেমন একমাত্র তখনই সোনা যখন শুধু বিনিময়ের ক্ষেত্রে নয়, সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য, তেমনই সার্বিক ইতিহাসকাররা একমাত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠবে যখন তার ক্ষমতা কি?-ইতিহাসের এই মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। সার্বিক ইতিহাসকাররা দেয় সে প্রশ্নের পরস্পরবিরোধী জবাব, আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে জবাব দেয় অন্য কোনো প্রশ্নের। আর নকল সোনার বলে মেনে নেয় অথবা সোনা চেনেই না, তেমনই সার্বিক ইতিহাসকাররা, এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা,মানুষের মৌলিক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য, এবং যে সাধারণ পাঠকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠে রুচি আছে তাদের মধ্যে কারেন্সি নোটের মতোই কাজ করে।

.

অধ্যায়-৪

 একটি জাতির ইচ্ছাকে একজন নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছাধীন করা এবং সেই মানুষটির ইচ্ছাকে দেবতার অধীন করার যে দৈব ব্যবস্থা প্রাচীনরা বিশ্বাস করত তাকে পরিত্যাগ করার ফলে স্ববিরোধিতাকে এড়িয়ে ইতিহাসের পক্ষে একটা পাও চলা সম্ভব নয় হস্তক্ষেপের প্রাচীন বিশ্বাসে ফিরে যাওয়া, আর না হয় যে শক্তি ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ঘটায় এবং যাকে বলা হয় ক্ষমতা তার তাৎপর্যের একটা নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া।

প্রথমটাতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব, কারণ সে বিশ্বাসকে ধ্বংস করা হয়েছে, কাজেই ক্ষমতা বলতে কি বোঝায় সেটা ব্যাখ্যা করা একান্তভাবে প্রয়োজন।

নেপোলিয়ন আদেশ দিল, একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলে যুদ্ধে যাও। একাজে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ছলক্ষ মানুষ কেন নেপোলিয়নের কথামতো যুদ্ধে গেল সে প্রশ্ন করাটাও আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। তার হাতে ক্ষমতা ছিল, তাই সে যা আদেশ করেছে তাই করা হয়েছে। যদি আমারা বিশ্বাস করি যে ঈশ্বরই তাকে ক্ষমতা দিয়েছিল তাহলে ব্যাখ্যাটা খুবই সন্তোষজনক হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সেটা স্বীকার করা হল না তখনই একজস মানুষ অপরের উপর যে ক্ষমতা বিস্তার করে আসলে সেটা কি তা নির্ধারণ করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। এটা দুর্বলের উপর সবলের দৈহিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপার হতে পারে না-হারকিউলিসের মতো দৈহিক শক্তির উপরেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, কারণ নেপোলিয়নের মতো যে সব নায়কের নৈতিক গুনাগুন সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদের অবকাশ আছে তাদের কথা ছেড়ে দিলেও ইতিহাসই আমাদের জানিয়েছে, যে একাদশ লুই অথবা মেটারনিক লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর শাসন ক্ষমতা চালিয়েছে তাদের কারো কোনো বিশেষ নৈতিক গুণ ছিল না, বরং সাধারণভাবে বলা যায়, যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা শাসন করেছে তাদের যে কোনো একজনের তুলনায় তার ছিল নৈতিক দিক থেকে দুর্বলতর।

ক্ষমতার উৎস যদি দৈহিক অথবা নৈতিক গুণাবলির মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই অন্যত্র খুঁজতে হবে-খুঁজতে হবে ক্ষমতার অধিকারীর সঙ্গে জনগনের সম্পর্কের মধ্যে।

ক্ষমতা হচ্ছে জনগণের সেই সম্মিলিত ইচ্ছা যা ঘোষণার দ্বারা অথবা মৌন সম্মতির দ্বারা নির্বাচিত শাসকগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা যদি শাসককে হস্তান্তরিত জনগনের সম্মিলিত ইচ্ছাই হয়, তাহলে পুগাচেভ কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি ছিল? যদি তা না হয়, তাহলে প্রথম নেপোলিয়ন কেন তা হল? তৃতীয় নেপোলিয়ানকে যখন বোলনে বন্দী করা হল যাদের সে গ্রেপ্তার করেছিল?

যে রাজপ্রসাদের বিপ্লবে অনেক সময় মাত্র দুজন কি তিনজন লোক অংশ গ্রহন করে তার দ্বারাই কি একজন নতুন শাসকের হাতে জনগণের ইচ্ছকে হস্তান্তরিত করা হয়? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কি জনগণের ইচ্ছাকে বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয়? ১৮০৮ সালে কি রাইন রাষ্ট্রসংঘের ইচ্ছাকে হস্তান্তর করা হয়েছিল নেপোলিয়নকে। ১৮০৯ সালে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ-সাজসে আমাদের সেনাবাহিনী যখন অস্ট্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতি গিয়েছিল, তখন কি রীশ জনগণের ইচ্ছাকে সর্মপণ করা হয়েছিল নেপোলিয়নের হাতে?

এই সব প্রশ্নের তিনটি জবাব সম্ভব? হয় ধরে নিতে হয় (১) জনগণের ইচ্ছাকে সর্বদাই নিঃশর্তভাবে হস্তান্তর করা হয় পছন্দ-মতো শাসক বা শাসকদের হাত, সুতরাং প্রতিটি নতুন শক্তির আবির্ভাব, একদা ক্ষমতাসীন শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিটি সগ্রামই প্রকৃত ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ বলে পরিগণিত হওয়া উচিত, অথবা (২) জনগণের ইচ্ছাকে হস্তান্তর করা হয় কতকগুলি নির্দিষ্ট ও পূর্বজ্ঞাত শর্ত অনুসারে, আর তাতেই প্রমাণ হয় যে ক্ষমতাকে খর্ব করা, তার বিরুদ্ধাচরণ করা, এমন কি তাকে ধ্বংস করা শাসকগণ কর্তৃক তাদের উপর আরোপিত শর্তাবলীকে উপেক্ষা করারই ফল, অথবা (৩) জনগণের ইচ্ছাকে শর্তসাপেক্ষে শাসকদের হাতে তুলে দেয়া হয় কিন্তু সে শর্তগুলি থাকে অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট, আর শাসকগণ কর্তৃক সেইসব অজ্ঞাত শর্তাবলীকে কমবেশি পূরণ করার ফলেই আবির্ভূত হয় বিভিন্ন শক্তি, দেখা দেয় তাদের সংঘর্ষ ও পতন।

আর এই তিন পথেই ইতিহাসকাররা শাসকদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে থাকে। অবশ্য তাদের মধ্যেও মত পার্থক্যের অভাব নেই। একেক দল একেকভাবে সেই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে। সেই সবরকম ইতিহাসকে যদি একসূত্রে বাঁধা যায়, নতুনতম ইতিহাসকাররা তাই করে থাকে, তাহলে আমরা পাব রাজা-রাজড়া ও লেখকদের ইতিহাস, জনগণের জীবনের ইতিহাস নয়।

.

 অধ্যায়-৫

একটা জাতির জীবন অল্প কয়েকটি মানুষের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, কারণ ওইসব মানুষ ও জাতির মধ্যে যোগসূত্রটা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা কয়েকটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসক ব্যাক্তিত্বের হাতে হস্তান্তরই সেই যোগসূত্রের ভিত্তি-এ মতবাদ ইতিহাসের কষ্টিপাথিরে সমর্থিত হয়নি। অবশ্য এই মতবাদকে অখণ্ডনীয় মনে হয় কারণ জনগণের ইচ্ছায় হস্তান্তরের ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যায়নি, কারণ সেটা কখনো ঘটেনি। যাই ঘটুক না কেন এবং যে লোকই পুরোভাগে এসে দাঁড়াক না কেন, এই মতবাদ সবসময়ই বলতে পারে যে অমুক লোক নেতৃত্বে এসেছে কারণ সম্মিলিত ইচ্ছাকে তার হাতেই তুলে দেয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক প্রশ্নাবলির যে উত্তর এই মতবাদ দিয়ে থাকে সেটা সেই লোকের উত্তরেরই অনুরূপ যে গোচারণ ক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশের গুণাগুণ অথবা চালকের মনোগত ইচ্ছার দিকে নজর না দিয়ে একদল গরু-মোষের গতি-পথ লক্ষ করেই বলে দেয় যে-জন্তুটি সকলের পুরোভাগে আছে সে যেদিকে যাব পুরো দলই যাবে সেদিকে।

পুনরাবর্তী জন্তুটি যেপথে চলে গোটা দল সেই পথেই যায়, অন্য জন্তুগুলির সম্মিলিত ইচ্ছা দলনেতার উপরেই অর্পিত হয়। এই হল এক শ্রেণীর ইতিহাসকারের অভিমত। আসলে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের হাতে জনগণের ইচ্ছাকে সমর্পণের মতটা কথার মারপ্যাঁচ মাত্র- প্রশ্নটাকেই অন্য কথায় ঘুরিয়ে বলা হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে কে ঘটায়? ক্ষমতা। ক্ষমতা কাকে বলে? একজনের হাতে ন্যস্ত জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাই ক্ষমতা। কোন শর্তে জনগণের ইচ্ছাকে একজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়? একমাত্র শর্ত হল, সেই মানুষটি জনগণের ইচ্ছাকে প্রকাশ করবে। অর্থাৎ, ক্ষমতা মানেই ক্ষমতা : অন্য কথায়, ক্ষমতা এমন একটা শব্দ যায় অর্থ আমরা বুঝি না।

মানুষের ব্যাপারে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ স্বীকার না করে ক্ষমতাকে ঘটনার কারণ হিসেবে গণ্য করতে পারি না।

অভিজ্ঞতার দিকে থেকে দেখলে ক্ষমতা কোনো একজনের মনোবাসনার প্রকাশ এবং অন্যের দ্বারা সে বাসনা পূর্ণ করার মধ্যেকার সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।

সে সম্পর্কের শর্তাবলিকে বোঝাতে হলে মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে–দেবতার নয়–সেই বাসনা প্রকাশের ধারণাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

দেবতা যদি কোনো আদেশ ঘোষণা করে প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনামতো তার ইচ্ছাকে প্রকাশ করে, তাহলে সে ইচ্ছার প্রকাশ হবে কালনিরপেক্ষ, কোনো কারণের দ্বারা সেটা ঘটবে না, কারণ দেবতাকে ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। কিন্তু যে আদেশ মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ, যা কালের অধীন এবং পরস্পর সম্পর্কিত-সেক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে সেই আদেশের যোগসূত্রকে বোঝাতে হলে আমাদের নতুন করে জানতে হবে : (১) যা কিছু ঘটে তার শর্ত : ঘটনা এবং ঘোষণা প্রচারকারী উভয়কেই কালের অধীন হয়ে চলতে হয়, এবং (২) যে মানুষ আদেশ করে এবং যারা সে আদেশ তামিল করে তাদের যোগসূত্রের অনিবার্যতা।

.

অধ্যায়-৬

সময়ের অধীন নয় বলে একমাত্র দেবতার ইচ্ছার প্রকাশই বহু বর্ষ বা শতাব্দীব্যাপী ঘটনা-শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, একমাত্র দেবতাই পারে তার ইচ্ছার দ্বারা মানুষের অগ্রগতির দিক-নির্দেশ করতে, কিন্তু মানুষ কালের অধীন, আর যা-কিছু ঘটে তাতে সে নিজেই অংশগ্রহণ করে।

প্রথম শর্ত অর্থাৎ কালের কথা বলতে গিয়ে আমরা দেখি, কিছু পূর্বঘোষিত আদেশ ছাড়া কোনো আদেশই কার্যকর করা যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা যখন বলি যে নেপোলিয়ন তার সৈন্যদের যুদ্ধে যাবার আদেশ দিয়েছিল, তখন সেই একটি হুকুমের মধ্যে পর পর অনেকগুলি আদেশকে একত্রিত করে থাকি। নেপোলিয়ন একদিনেই রাশিয়া অভিযানের আদেশ দেয়া না, তা দিতে পারে না। আজ হয়তে আদেশ করেছে ভিয়েনা, বার্লিন ও পিটার্সবুর্গে অমুক-অমুক চিঠি লেখা হোক, কাল অমুক-অমুক হুঁকাম ও নির্দেশ জারি করেছে স্থলবাহিনীকে, নৌবহরকে, কমিসারিয়েটকে, ইত্যাদি ইত্যাদি–লক্ষ লক্ষ হুকুমের এক আনুপূর্বিক শৃঙ্খলের ফলে ফরাসি বাহিনী রাশিয়াতে ঢুকেছে।

নেপোলিয়ন তার সমগ্র রাজত্বকালে ইংলেন্ড অভিযানে এত সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় করল না, অথচ পুরো রাজত্বকালে সে পরিকল্পনাকে কখনো কার্যকর না করে বাস্তব ক্ষেত্রে রাশিয়াতে অভিযান শুরু করল-তার কারণ প্রথম ক্ষেত্রে তার আদেশগুলি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিলল না, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মিলে গেল।

কোনো আদেশকে নিশ্চিতরূপে কার্যকর করতে হলে সেটা এমন হওয়া চাই যাকে কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু কোনটাকে কার্যকর করা যাবে আর কোনটাবে যাবে না সেটা জানা তো অসম্ভব, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে নেপোলিয়সের রামিয়া অভিযানের ক্ষেত্রেই যে একথা সত্য শুধু তাই নয়, সরলতম ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই, কারণ উভয়ক্ষেত্রেই লক্ষ লক্ষ বাধা এসে তাকে কার্যকর করার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটি কার্যকর আদেশ অকার্যকর অনেক হুকুমের মধ্যে একটিমাত্র। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সব অসম্ভব আদেশই অকার্যকর থেকে যায়। মাত্র স্বল্পসংখ্যক সম্ভবপর আদেশই কার্যে রূপায়িত হয়।

বস্তৃত, যারা আদেশ করে যারা আদেশ তামিল করে তাদের সম্পর্কটাই ক্ষমতা নামক ধারণার মূল কথা।

আমরা দেখেছি, কোনো আদেশ একমাত্র তখনই কার্যকর হয় যখন একটি ঘটনা-শৃঙ্খলের সঙ্গে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই মূল যোগসূত্র থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে যারা আদেশ করে আসল কাজে তারাই অংশ নেয় সব চাইতে কম, তাদের কর্মপ্রচেষ্টা কেবলমাত্র আদেশ করার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে।

.

অধ্যায়-৭

যখন কোনো ঘটনা ঘটতে থাকে তখন সে সম্পর্কে মানুষ তাদের মতামত ও মনোভাব ব্যাক্ত করে থাকে, আর যেহেতু অনেক মানুষের সম্মিলিত কাজের ফলেই ঘটণাগুলি ঘটে, কোনো না কোনো মত বা মনোভাব আংশিকভাবে হলেও পূর্ণ হয়েই থাকে। যখন ঘোষিত কোনো একটি অভিমত পূর্ণ হয় তখন সেটাকেই ঘটনার পূর্ববর্তী আদেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক লোক একটা কাঠের গুঁড়িকে টানছে। কীভাবে কোথায় সেটাকে টেনে নেওয়া হবে সে সম্পর্কে নানা জনে নানা কথা বলছে। কাঠটাকে টেনে নেওয়া হয়ে গেলে যে কোনো একজনের কথামতোই সেকাজটা হয়েছে। তাহলে তার আদেশমতোই কাজটা সম্পন্ন হল। এখানেই আমরা পাই আদেশ ও ক্ষমতার প্রাথমিক রূপ।

একটা বৃহত্তর জনসমাবেশ যখন একই লক্ষ্যে একটা কাজ করে তখন তাদের মধ্যে এই মতভেদ আরো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। জ্ঞাত বা অজ্ঞাত যে কারণেই হোক ফরাসিরা নিজেদের ডোবাতে ও খুন করতে শুরু করে দিল। সেই সঙ্গে লোকে এও বিশ্বাস করল যে ফ্রান্সের গৌরব ও ইংল্যান্ডের নিচতার অনেক বড় বড় বুলি আওড়াতে লাগল। ইতিহাস আমাদের বুঝিয়েছে যে এসব কথাই অর্থহীন ও পরস্পরবিরোধী, যেমন বিরোধ থাকে নিজের অদিকার রক্ষা ও মানুষকে হত্যার মধ্যে, এবং ইংল্যান্ডকে ছোট করা ও রাশিয়াতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার মধ্যে।

প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়ালে একটি সহজ প্রশ্নই দেখা দেয় : এটা কেমন করে সম্ভব যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ সম্মিলিতভাবে অপরাধ করে–যুদ্ধ করে, নরহত্যা করে, ইত্যাদি?

ইওরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বর্তমান জটিল ব্যবস্থার মধ্যে রাজা, মন্ত্রী, পার্লামেন্ট, অথবা সংবাদপত্রের বিধান, নির্দেশ, অথবা আদেশ ছাড়া কোনো ঘটনার কথা কি কল্পনা করা যায়? রাজনৈতিক ঐক্য, দেশাত্মবোধ, শক্তি-সাম্য, অথবা সভ্যতার দ্বারা সমর্থিত নয় এমন কোনো সম্মিলিত কর্ম-প্ৰয়াস কি থাকতে পারে? কাজেই প্রতিটি ঘটনা অনিবার্যভাবেই কোনো ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়, একজন বা বহুজনের ইচ্ছার ফলরূপে প্রতিভাত হয়। জাহাজ যেদিকেই চলুক না কেন যে ঢেউ ভেঙে সেটা অগ্রসর হয় তাকে তো সবসময় জাহাজের সামনেই দেখা যাবে। জাহাজের যাত্রীদের কাছে সেই ঢেউই তো একমাত্র প্রত্যক্ষ গতি। জাহাজ যখন একদিকে চলে তখন একই ঢেউ থাকে তার সামনে, আবার জাহাজের গতি যখন মাঝেমাঝেই পাল্টে যায় তখন সামনের ঢেউয়ের গতিও যায় পাল্টে।

যখনই যে ঘটনা ঘটে তখনই মনে হয় যে ঠিক ঐ ঘটনাটিই ছিল পূর্বদৃষ্ট ও আদেশমাফিক। জাহাজ যে দিকেই যাক জলস্রোত সফেন তরঙ্গে একদিকেই চলতে থাকে, দূর থেকে মনে হয় জলস্রোত যে নিজের বেগে চলছে তাই নয়, জাহাজের গতিও নির্ধারণ করছে।

ঐতিহাসিক ব্যাক্তিদের যে সব ইচ্ছার প্রকাশ ঘটনাবলীর সঙ্গে আদেশরূপে সম্পর্কিত সেগুলিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ইতিহাসকাররা ধরে নিয়েছে যে ঘটনাগুলি ঐসব হুকুমের উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু ঘটনাবলী এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচার করে আমরা দেখেছি যে সেই সব ব্যক্তি ও তাদের আদেশই ঘটনার উপর নির্ভরশীল।

এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আমরা ইতিহাসের দুটি মূল প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে পারি :

(১) ক্ষমতা কি? (২) কোন শক্তি জাতিসমূহকে পরিচালিত করে?

(১) ক্ষমতা হচ্ছে কোনো বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের এমন একটা সম্পর্ক যার ফলে সেই লোক কোনো সম্মিলিত কাজের ক্ষেত্রে যত বেশি মতাতম, ভবিষ্যদ্বাণী ও সমর্থন প্রকাশ করে সেই অনুপাতে কম অংশ নেয় সেই কাজে।

(২) জাতিসমূহ পরিচালিত হয় ক্ষমতার দ্বারা নয়, বুদ্ধিহত কাজের দ্বারা নয়, বা দুইয়ের যোগফলের দ্বারাও নয় (যদিও ইতিহাসকাররা তাই মনে করে), তাদের পরিচালিত করে সেই সমগ্র জনগণের কর্মধারা যারা এমনভাবে একত্র হয় যে যারা সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে সবচাইতে বেশি অংশ নেয় তারাই নিজেদের মাথায় বহন করে সবচাইতে কম দায়িত্ব এবং বিপরীতক্রম।

নীতিগতভাবে ঘটনাকে ঘটায় তারা যাদের করায়ত্ত ক্ষমতা : কিন্তু যেহেতু দৈহিক শক্তির দিক থেকে ঘটায় তার যারা সেই ক্ষমতাকে মেনে চলে। কিন্তু যেহেতু দৈহিক কর্ম ছাড়া নৈতিক কর্ম অচিন্ত্যনীয়, তাই কোনো ঘটনার কারণ এ দুইয়ের কোনোরটাই নয়, প্রকৃত কারণ এই দুই শক্তির মিলন। অথবা অন্য কথায়, যে ঘটনার বিচার আমরা করছি তার ক্ষেত্রে কারণের ধারণাটাই প্রযোজ্য নয়। শেষপর্যন্ত আমরা একটা অন্তহীন চক্রে পৌঁছে। যাই। বিদ্যুৎ তাপ সৃষ্টি করে, আকার তাপ বিদ্যুৎ সৃষ্টি করে। পরমাণু পরস্পরকে আকর্ষণ করে, আর বিকর্ষণও করে। তাপ ও বিদ্যুতের এবং পরমাণুর পারম্পরিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে আমরা বলতে পারি না এটা কেন ঘটে, আমরা বলি যে এই ঘটে কারণ অন্যকিছু ভাবাই যায় না, কারণ এটাই হতে বাধ্য, আর এটাই নিয়ম। ঐতিহাসিক ঘটনার বেলায়ও এই কথাই প্রযোজ্য। যুদ্ধ এবং বিপ্লব কেন ঘটে আমরা জানি না। শুধু জানি, যে কোনো একটা কাজ করতে হলে মানুষ এমনভাবে নিজেদের গড়ে তোলে যেখানে সকলেই অংশ নিতে পারে, আর আমরা বলি, এটা এইরকমই হয়, কারণ অন্য কিছু ভাবাই যায় না, অথবা অন্য কথায়, এটাই নিয়ম।

.

অধ্যায়-৮

 যদি বাইরের ঘটনা নিয়ে ইতিহাসের কারবার হত তাহলে এই সরল ও সহজ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই যতেষ্ট হত, এবং আমাদের যুক্তিতর্কেরও অবসান ঘটত। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম মানুষকে নিয়ে। একটি পরমাণু বলতে পারে না যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের নিয়মকে সে অনুভব করে না, আর তাই সে নিয়মটা অসত্যম, কিন্তু ইতিহাসের বিষয় যে মানুষ পরিষ্কার বলে দেয় : আমি মুক্ত, স্বাধীন, কাজেই কোনো নিয়মের অধীন নই।

অঘোষিত হলেও মানুষের ইচ্ছাশক্তির এই সমস্যা ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অনুভূত হয়।

সব চিন্তাশীল ইতিহাসকারই নিজের অজ্ঞাতে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ইতিহাসের সব স্ব-বিরোধিতা ও অস্পষ্টতা, ইতিহাস-বিজ্ঞানের সব ভ্রান্ত পদক্ষেপের মূলেই রয়েছে এই সমস্যা সমাধানের অভাব।

প্রতিটি মানুষের যদি ইচ্ছার স্বাধীনতা, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ যদি নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারত, তাহলে তো সব ইতিহাসই হয়ে যেত অসংলগ্ন আকস্মিক ঘটনার একটি শ্রেণীমাত্র।

হাজার বছরের মধ্যে যদি দশ লক্ষের মধ্যে একটি মানুষও স্বাধীনভাবে অর্থাৎ নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারত, তাহলে তো মানবজাতির কাজকর্ম সংক্রান্ত নিয়মকে লঙ্ঘন করে সেই মানুষের একটি মাত্র কাজই সমগ্র মানবজাতির উপর প্রযোজ্য সেই নিয়মের অস্তিত্বকেই অসম্ভব করে তুলত।

মানুষের সব কর্মের বিধায়ক হিসেবে যদি একটিমাত্র নিয়ম থাকে তাহলে তো স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছুই থাকতেই পারে না, কারণ মানুষের ইচ্ছার বহু প্রাচীন সমস্যটির মূলেই আছে এই স্ব-বিরোধিতা।

সমস্যাটা হচ্ছে : ধার্মিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক বা দার্শনিক–যে দৃষ্টিকোণ থেকেই মানুষকে দেখি না কেন, সর্বত্রই দেখতে পাই এমন একটি বাধ্যতামূলক নিয়ম–অন্য সবকিছুর মতোই মানুষও যার অধীন, কিন্তু অন্তরের ভিতর থেকে যখন তাকে দেখি তখনই বুঝি যে আমরা মুক্ত, স্বাধীন। এই বোধ থেকেই নিজেকে জানার সূত্রপাত, সে জানা বুদ্ধিবহির্ভূত, এমনকি বুদ্ধি নিরপেক্ষ। বুদ্ধি দিয়ে মানুষ নিজেকে দেখে, আর বোধি দিয়ে মানুষ নিজেকে জানে। এই আত-জ্ঞান ছাড়া কোনো দেখা বা বুদ্ধির প্রয়োগের কথা চিন্তা করাই যায় না। কোনো কিছু বুঝতে হলে, দেখতে হলে, তা থেকে সিদ্ধান্ত টানতে হলে প্রথমেই মানুষকে জীবিত প্রাণী হিসেবে নিজেকে বুঝতে হবে। সে যে ইচ্ছা করতে পারে, নিজের ইচ্ছা-শক্তি সম্পর্কে সে যে সচেতন, একমাত্র এই বোধ দ্বারাই সে নিজেকে জীবিত প্রাণীরূপে জানতে পারে। যে ইচ্ছা তার জীবনের মূলকথা তাকে মানুষ স্বাধীন বলেই জানে। তুমি বলতে পার : আমি স্বাধীন নই। কিন্তু এই তো আমি আমার হাতটা তুললাম, আবার নামিয়ে নিলাম। সকলেই বোঝে যে এই যুক্তিবিহীন জবাব ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে একটি অখণ্ডনীয় প্রমাণ।

আমাদের চৈতন্যের এই জবাব বুদ্ধির অধিন নয়। স্বাধীনতার এই অভ্রান্ত ও অখণ্ডনীয় চেতনা পরীক্ষা ও যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, ব্যতিক্রমবিহীনভাব সব চিন্তাশীল লোকই এটাকে স্বীকার করে, সব মানুষই অনুভব করে, এই চেতনা ছাড়া মানুষের কোনো ধারণাই সম্ভব নয়। মানুষ এক সর্বশক্তিমান, সর্বকল্যাণময় ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের স্বাধীনতার চেতনা থেকে অদ্ভুত যে পাপের ধারণা সেটা কী? এটাই ধর্মশাস্ত্রের প্রশ্ন।

সেই একই উৎস থেকে উদ্ভূত আর একটি প্রশ্ন, সমাজে মানুষের দায়িত্ব কী? এটা আইনের প্রশ্ন।

সহজাত চরিত্র এবং উদ্দেশ্যের প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষ কাজ করে। স্বাধীনতার চেতনা থেকে উদ্ভূত ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান কী, বিবেক কী? এটা নীতিশাস্ত্রের প্রশ্ন।

জাতি হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে তার অতীত জীবনকে কীভাবে দেখা হবে-স্বাধীন সত্তা হিসেবে, না পূর্বনির্ধারিত কর্মের অধিকারী রূপে? এটা ইতিহাসের প্রশ্ন।

.

অধ্যায়-৯

ইচ্ছার স্বাধীনতা অথবা অনিবার্যতার সমাধানের ব্যাপারে জ্ঞানের অন্য সব শাখার তুলনায় ইতিহাসের কিছুটা সুবিধা রয়েছে : ইতিহাসের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার মূল কথার পরিবর্তে অতীতে তার প্রকাশকে নিয়েই আলোচনা করা হয়।

এ ব্যাপারে বিমূর্ত বিজ্ঞানের তুলনায় পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের যে ভুমিকা, অন্যসব বিজ্ঞানের তুলনায় ইতিহাসেরও সেই ভূমিকা।

ফলে ইচ্ছার স্বাধীনতা ও অনিবার্যতার মধ্যে বিরোধ ধর্মশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র এবং দর্শনশাস্ত্রের বেলায় যে সমাধানের অতীত রহস্য হয়ে দেখা দেয়, ইতিহাসের বেলায় তা হয় না। ইতিহাস পর্যালোচনা করে মানুষের সেই জীবনকে যেখানে এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা আগে থেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। যদিও জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনা অংশত স্বাধীন এবং অংশত বাধ্যতামূলক হয়ে দেখা দেয়, তবু প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা, মানুষের প্রতিটি কাজকেই সেই বিরোধিতা ছাড়াই স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায়। স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা মিলিত হতে পারে, এ দুটি ধারণার মূল কথাই বা কী, সে সমস্যার সমাধান করতে হলে ইতিহাস বিজ্ঞানকে অন্য সব বিজ্ঞানের চাইতে একটা আলাদা পথ ধরতে হবে। অনেক মানুষের অথবা মানুষ বিশেষের কোনো কাজের বিচার যখন করতে বসি তখন আমরা সব সময়ই সেটাকে দেখি অংশত মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং অংশত অনিবার্যতা নিয়মের ফলরূপে। মানুষের দেশান্তরে গমন এবং মানুষের আক্রমণ, অথবা তৃতীয় নেপোলিয়নের নানা বিধান, অথবা একঘণ্টা আগে বেড়াতে বেরিয়ে একজন লোকের কোনো একটা পথকে বেছে নেয়ার কথাই বলি না কেন কোথাও কোনো স্ববিরোধিতার কথা আমাদের মনে আসে না। এসব কাজের মধ্যে কতটা স্বাধীনতা থাকে, আর কতটা থাকে অনিবার্যতা তা আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার। যে দৃষ্টিকোণ থেকে একটা কাজকে বিচার করা হয় তদনুসারেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা আনুপাতিক হারের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে, তবে সেটা সবসময়ই ঘটে বিপরীতক্রম অনুসারে।

ধর্ম, মানুষের সাধারণ জ্ঞান, আইনশাস্ত্র, এবং ইতিহাস–সকলেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতার এই সম্পর্ককে একভাবেই বোঝে। সকলক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ও অনিকবার্যতার এই হ্রাস-বৃদ্ধি তিনটি শর্তের উপর নির্ভর করে :

১. কাজটি যে করে বাইরের জগতের সঙ্গে সেই মানুষটির সম্পর্ক।
 ২. কালের সঙ্গে তার সম্পর্ক।
৩. সেই কাজের কারণের সঙ্গে তার সম্পর্ক।

১. মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের তুলনায় যে মানুষটি জলে ডুবে যাচ্ছে তার ক্ষেত্রে অবশ্যই কাজের স্বাধীনতার তুলনায় অনিকবার্যতার পরিমাণ অনেক বেশি। অনুরূপভাবেই যে মানুষ নির্জনে একাকী বাস করে তার তুলনায় যারা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বাস করে, অথবা যারা পারিবারিক, কর্মস্থলঘটিত, বা ব্যবসাঘটিত দায়িত্ব দ্বারা আবদ্ধ, তাদের কাজে অবশ্যই স্বাধীনতা কম, অনিকবার্যতাই বেশি।

 ২. দ্বিতীয় বিবেচনার বিষয় সময়ের পরিবেশ। এই বিচারেই আজকের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ মানুষের তুলনায় প্রথম আদিম মানুষের পতনের ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা ছিল অনেক কম। সেই একই কারণে যেসব মানুষ কয়েক শতাব্দী আগে বাস করত তাদের জীবনযাত্রায় ও কাজে তারা ছিল সাম্প্রতিককালের মানুষের জীবনযাত্রার তুলনায় অনেক কম স্বাধীন।

৩. বিবেচনার তৃতীয় বিষয়টি হলে : কার্য-কারণের যে সীমাহীন শৃঙ্খলের মধ্যে প্রতিটি ঘটনা বিধৃত তার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত। সেই কার্যকারণ শৃঙ্খলার নিয়মে মানুষের প্রতিটি কাজ পূর্ববর্তী ঘটনার ফলস্বরূপ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী ঘটনার কারণস্বরূপ।

শারীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিধানগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় যত বেশি হবে, আলোচ্য কাজটি যত সরল হবে, এবং কর্তার চরিত্র ও মানসিক গঠনের জটিলতা যত কম হবে, তত আমাদের কাজের এবং অন্য সকলের কাজের অনিবার্যতা বৃদ্ধি পাবে আর স্বাধীনতা হ্রাস পাবে।

এই তিনটি শর্তের উপরই মানুষের অপরাধের দায়িত্ব এবং ক্ষমার প্রশাসন নির্ভর করে। যে লোকের কাজের বিচার করা হয় তার পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের হ্রাস-বৃদ্ধি, কাজটি করা এবং সে বিষয়ে তদন্তের মধ্যে সময়ের হ্রাস-বৃদ্ধি, এবং সেই কাজের কারণ-শৃঙ্খলার জ্ঞানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

.

অধ্যায়-১০

সুতরাং বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের হ্রাসবৃদ্ধি, এবং কার্যকারণ শৃখলের উপর নির্ভরতার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে থাকে। ফলে এমন কোনো মানুষকে নিয়ে যদি আমরা আলোচনা করি যার সঙ্গে বহির্জগতের যোগাযোগটা আমাদের ভালোভাবে জানা, যার কাজ ও তার বিচারের মধ্যেকার সময়ের ব্যবধানটা অনেক বেশি এবং যেখানে কাজটার কারণ সম্পর্কে আমরা খুবই অবহিত, সে-ক্ষেত্রে আমরা পাই সর্বোচ্চ অনিবার্যতা ও নিম্ন স্বাধীনতার ধারণা। বাইরের পরিবেশের উপর যে মানুষের নির্ভরতা খুবই কম, যার কাজ সংঘটিত হয়েছে খুবই সম্প্রতিকালে, এবং যার কাজের কারণ জানাটা আমাদের সাধ্যের অতীত, সেক্ষেত্রে আমরা পাই সর্বনিম্ন অনিবার্যতা ও সর্বোচ্চ স্বাধীনতার ধারণা।

অবশ্য এ দুয়ের কোনোক্ষেত্রেই পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পূর্ণ অনিবার্যতার ধারণা আমরা পাই না।

অনিবার্যতা নিয়মের সম্পূর্ণ অধীন এবং কোনোরকম স্বাধীনতাবিহীন একটি মানুয়ের কাজের কথা কল্পনা করতে হলে আমাদের অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে অসীমসংখ্যক স্থানসম্পর্কে, অসীম দীর্ঘকাল এবং অসীম কার্যশৃঙ্খলের জ্ঞান আমাদের আছে।

আবার সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং অনিবার্যতা নিয়মের অধীন নয় এরকম একটি মানুষকে কল্পনা করতে হলে আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে সে সম্পূর্ণ একা এবং কার্যের উপর নির্ভরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা আমাদের জানা তাকে বলি অনিবার্যতা নিয়ম, আর যেটা আমাদের কাছে অজ্ঞাত তাকে বলি জীবনশক্তি। জীবনের মূল কথা যতটা জানি তার বাইরে অজ্ঞাত অবশিষ্টাংশ যা থাকে তাকেই ভাষায় বলা হয় জীবনশক্তি। সে-রকম ইতিহাসের ক্ষেত্রেও যা আমাদের জানা তাকে বলি অনিবার্যতা নিয়ম, যেটা অজ্ঞাত তাকে বলি স্বাধীন ইচ্ছা। মানবজীবনের নিয়ম সম্পর্কে যতটা আমাদের জানা তার বাইরে অজ্ঞাত অবশিষ্টাংশ যা থাকে ইতিহাসের দিক থেকে তাকে ভাষায় বলা হয় স্বাধীন ইচ্ছা।

.

অধ্যায়-১১

কালানুগ বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং কারণের উপর নির্ভরশীল মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশকেই ইতিহাস পরীক্ষা করে দেখে, অর্থাৎ বুদ্ধির বিধানের দ্বারা ইতিহাস এই স্বাধীন ইচ্ছার সংজ্ঞা নিরূপণ করে, আর সেই কারণেই ইতিহাস একটি বিজ্ঞান। একটি স্বাধীন শক্তি সৌরজাগতিক বস্তুসমূহকে পরিচালিত করে–একথা স্বীকার করা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পক্ষে যতটা প্রয়োজন, মানুয়ের স্বাধীন ইচ্ছা ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রভাবিত করে এ-কথা স্বীকার করাও ইতিহাসের দিক থেকে ততটাই প্রয়োজন। আবার এটাকে সত্য বলে ধরে নিলে বিধানের অস্তিত্ব অর্থাৎ যে-কোনো বিজ্ঞানের সম্ভবনাকেই তো অস্বীকার করতে হয়। একটি মাত্র বস্তুও যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে তাহলে তো কেপলার ও নিউটনের বিধানসমূহকেই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি মাত্র কার্যও যদি স্বাধীন ইচ্ছায় পরিচালিত হয় তাহলে তো কোনো ঐতিহাসিক বিধানেরই অস্তিত্ব থাকে না, সজ্ঞস হয় না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তোলা।

ইতিহাসের বিচারে মানুষের ইচ্ছা চলে একটি রেখা ধরে–সে রেখার একপ্রান্ত থাকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢাকা, আর অন্যপ্রান্তে মানুষের ইচ্ছার একটা চেতনা স্থান, কাল ও কার্য-কারণের শৃঙ্খলের মধ্যে কাজ করে চলে। এই কর্মক্ষেত্রটি যত বেশি আমাদের চোখের সামনে প্রসারিত হয়, ততই তার বিধানাবলি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এ-সব বিধানকে আবিষ্কার করা ও তাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করাই ইতিহাসের সমস্যা। এই বিধানের সন্ধান দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এ কাজে ইতিহাসের পুরোনো পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে চলেছে তারই পাশাপাশি চলেছে তার নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলার কাজ।

সব মানবিক বিজ্ঞান এই পথেই এগিয়ে চলেছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পৌঁছে গণিতশাস্ত্র বিশ্লেষণের পথকে পরিহার করে অতি সূক্ষ্ম, অজ্ঞাত বস্তুর সমন্বয়ের পথে পা রেখেছে। কার্য-কারণের তত্ত্বকে পরিহার করে গণিতশাস্ত্র বিধানের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছে। অন্যভাবে হলেও চিন্তার এই একই পথ ধরে এগিয়ে চলেছে অন্য সব বিজ্ঞান। নিউটন যখন মাধ্যাকর্ষণ বিধানের সংজ্ঞা দিল তখন সে একথা বলল না যে সূর্য বা পৃথিবীর আকর্ষণের শক্তি আছে, সে বলল, বৃহত্তম থেকে ক্ষুদ্রতম প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করে।

প্রকৃতিবিজ্ঞানসমূহও সেই একই কাজ করে : কারণের প্রশ্নকে পরিহার করে তারা সকলেই বিধানের সন্ধানে ফেরে। ইতিহাসও সেই একই পথের পথিক। ব্যক্তিবিশেষের জীবনের ঘটনার বিবরণ না হয়ে ইতিহাসের বিষয়বস্তু যদি হয় জাতিসমূহ ও মানুষের গতিকে জানা, তাহলে কার্য-কারণের তত্ত্বক একপাশে সরিয়ে রেখে ইতিহাসকেও খুঁজে ফিরতে হবে স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশসমূহকে নিয়ন্ত্রণকারী বিধানকে।

.

অধ্যায়-১২

কোপারনিকাসের বিধান আবিষ্কৃত ও প্রমাণিত হবার পর থেকে সূর্যের বদলে পৃথিবীটা ঘোরে এই সত্যের স্বীকৃতিই প্রাচীন মানুষের বিশ্বতত্ত্বকে ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সে বিধানকে অপ্রমাণ করতে পারলে হয় তো গ্রহ উপগ্রহের গতির পুরোনো ধারণাকে অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হত, কিন্তু সেটাকে অপ্রমাণ না করে টোলোমির বিশ্বতত্ত্বে বিশ্বাস রাখা ছিল একান্তই অসম্ভব। তবু কোপার্নিকাসের বিধান আবিষ্কৃত হবার পরেও অনেককাল পর্যন্ত টোলোমিয় বিশ্বতত্ত্বের পঠন পাঠন চলেছিল। যেসময় একটিমাত্র মানুষ প্রমাণ করে দিল যে জন্ম ও অপরাধের সংখ্যা গাণিতিক বিধানের অধীন, এবং রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ধারিত হয় কতকগুলি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা, এবং জমির সঙ্গে মানুষের কতকগুলি সম্পর্কের ফলেই মানুষ এক দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি জমায়, তখন থেকেই সে-সব তত্ত্বের উপর গড়ে তোলা ইতিহাসের মূল ভিত্তিই ধ্বংস হয়ে গেল।

এই নববিধানগুলিকে খণ্ডন করে ইতিহাসের পূর্বতন ধারণাকে হয়তো রক্ষা করা যেত, কিন্তু সেটাকে খণ্ডন করে না ইতিহাসের ঘটনাবলিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ফলরূপে দেখা একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হল। কারণ কতকগুলি বিশেষ গৌগোলিক, জাতিতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কারণের ফলেই যদি কোনো বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং কোনো বিশেষ জাতির স্থানান্তর গমন ঘটে, তাহলে কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীন ইচ্ছাকে ওই দুইয়ের কোনো ঘটনার কাণে বলেই ধরা যায় না। অথচ সংখ্যাতত্ত্ব, ভূগোল, রাজনীতিভিত্তিক অর্থনীতি, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও ভূতত্ত্বের বিধানগুলি যখন পূর্ববর্তী ইতিহাসের মূল ধারণাগুলিরই সরাসরি বিরোধিতা করে, তখনো ইতিহাসের নতুন ধারার পাশাপাশি পুরোনো ধারার অনুসরণও সমানভাবেই চলতে থাকে।

প্রাকৃতিক দর্শনে প্রাচীন ধারা ও নব্যধারার এই সংঘর্ষ দীর্ঘদিন ধরে বেশ জোরালোভাবেই চলতে লাগল। প্রাচীন ধারার পক্ষ সমর্থন করে ধর্মতত্ত্ব নব্যধারাকে আঘাত করল। কিন্তু সত্যই যখন জয়লাভ করল তখন ধর্মতত্ত্ব নতুন ভিত্তিভূমির উপরেই আসর জাঁকিয়ে বসল।

ইতিহাসের প্রাচীন ও নব্যধারার মধ্যেও সেই একই তীব্র, দীর্ঘ সংঘর্ষ আজো চলেছে, আজো ধর্মতত্ত্ব প্রাচীন ধারাকে সমর্থন করে নব্যধারাকে আঘাত করছে।

উভয়ক্ষেত্রেই ঘটছে চরম উত্তেজনা ও সত্যের অপমৃত্যু। একদিকে আছে ভীতি ও যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা হর্মরাজিকে হারাবার আশঙ্কা, আর অন্যদিকে আছে ধ্বংসের নেশা। প্রাকৃতিক দর্শনের ক্রমবর্ধমান সত্যের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছে তারা ভেসেছে, সে সত্যকে স্বীকার করার অর্থই ঈশ্বরে বিশ্বাস, সৌরজগতের সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস, এবং সন্ন্যাসিনীর পুত্র জোসুয়ার অলৌকিক ঘটনাবলিতে বিশ্বাসের ধ্বংস। কোপার্নিকাস ও নিউটনের বিধানের সমর্থকদের, যেমন ভলতেয়ারের মনে হয়েছিল সে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিধানাবলি ধর্মকে ধ্বংস করেছে। তাই মাধ্যাকর্ষণ বিধানকে ধর্মবিরোধী অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা হয়েছিল।

ঠিক অনুরূপভাবেই এখন মনে করা হচ্ছে যে আত্মা ও সৎ অসতের তত্ত্ব এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সব রাষ্ট্র ও গির্জার ধারণাকে নষ্ট করবার, একমাত্র পথই হলে অনিবার্যতার বিধানকে মেনে নেয়া। ভলতেয়ারের মতোই আজকের দিনের অনিবার্যতা বিধানের অবাঞ্ছিত সমর্থকরা সেই বিধানকেই ধর্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছে, যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাধ্যাকর্ষণ বিধানের মতোই ইতিহাসের ক্ষেত্রে অনিবার্যতা বিধানও সেই সব ভিত্তিভূমিকে ধ্বংস করার পরিবর্তে আরো শক্তিশালীই করে তুলেছে যার উপর গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র ও গির্জার শাসনব্যবস্থা। সেদিন যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, আজো তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে, পরিদৃশ্যমান ঘটনাসমূহের মাপকাঠি হিসেবে একটি নিঃশর্ত কিছুকে স্বীকার করা বা না করারই গোটা মতো-পার্থক্যের ভিত্তিস্বরূপ। জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেটা ছিল পৃথিবীর স্থাবরত্ব, আর ইতিহাসে সেটা হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা-স্বাধীন ইচ্ছ।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর জঙ্গমত্বকে স্বীকার করায় বিপদ ছিল তার ফলে পৃথিবীর স্থাবরত্ব ও গ্রহ নক্ষত্রের জঙ্গমত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে অস্বীকার করতে হত, তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বকে স্থান, কাল ও কার্যকারণের অধীন করায় বিপদ হয়েছে, স্বীয় ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ অনুভূতির অস্বীকৃতি। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন নব্যধারায় বলা হয়েছিল, একথা সত্য যে পৃথিবীর জঙ্গমতাকে আমরা অনুভব করি না, কিন্তু তার স্থাবরতাকে স্বীকার করলে আমরা পৌঁছে যাই একটা স্ববিরোধিতায়, আর তার জঙ্গমত্বকে স্বীকার করলে আমরা পাই বিধান, তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে নব্যধারায় বলা হয়, এ কথা সত্য যে আমাদের পরনির্ভরতা সম্পর্কে আমরা সচেতন নই, কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করলে আমরা পৌঁছে যাই একটা স্ববিরোধিতায়, আর বহির্জগতের উপর, স্থান, কাল ও কার্য কারণের উপর নির্ভরতাকে স্বীকার করলে আমরা পাই বিধান।

প্রথম ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়েছিল একটি অবাস্তব স্থাবরতাকে পরিহার করে একটি অননুভূত জঙ্গমতাকে স্বীকার করা, বর্তমান ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে প্রয়োজন হয়েছে এমন একটি স্বাধীনতাকে পরিহার করা যার কোনো অস্তিত্ব নেই, আর এমন একটি পরনির্ভরতাকে স্বীকার করা যার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই।

[সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *