পথে, তবে মাঝে মাঝেই বিপথে
সুখে থাকতে ভূতে কিলায়– কথাটা অতি প্রাচীন বাংলা প্রবাদবাক্য। আমাদের সংস্কৃতির বহু যুগের সঞ্চিত জ্ঞান এই সব প্রবাদবাক্যে বিধৃত, ফলে তারা গভীর সত্যের আকর। কথাটা বহু দিনের অভিজ্ঞতার থেকেই বলছি। আবাল্য বেশ কিছু ভূত আমাকে কিলিয়ে বেড়াচ্ছে। যখনই একটু সুখের মুখ দেখি, তখনই পিঠে দমাদম ভূতের কিল পড়ে। মনে হয়, ভূতের জগতে আমি বেশ সম্মানিত ব্যক্তি। ওঁদের রাজা তাঁর কিছু পেয়াদাকে শুধু আমাকে কিলোবার কাজেই নিযুক্ত রেখেছেন। মানে এ দেশে ফ্যাক্স বা ই-মেলের জন্য যেমন ডেডিকেটেড লাইন থাকে, কতকটা সেইরকম আর কী! আমাকে কিলোবার কাজে নিযুক্ত ভূতেদের আর অন্য কোনও কাজ নেই।
অক্সফোর্ড বাস যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, ভারতীয় হাই কমিশন থেকে চিঠি এল–কবে নাগাদ দেশে ফিরতে চাও জানাও, আমরা তোমার জাহাজে বার্থের ব্যবস্থা করব। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই এক দফা ভূতের কিল শুরু হল। ভূতেরা আদেশ করল–জাহাজে যাওয়া তোমার চলবে না। তুমি যদি আর পাঁচ জন সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষের মতো জাহাজেই যাবে, তবে আমরা আছি কী করতে? হাই কমিশনকে জানালাম—প্রভুদের আপত্তি না থাকলে, যদি ভাড়া বাবদ বরাদ্দ টাকাটা আমাকে দেন, তবে অধম স্থলপথে দেশে ফেরার চেষ্টা করতে পারে। উত্তর যেটা পেলাম, সেটা নেতিবাচক না হলেও, বেশ বিরক্তিপূর্ণ। বক্তব্য—যেতে চাও তো যেতে পার। তবে পথে যদি মারা পড়ো অথবা ঠ্যাং ভাঙে, তবে হাসপাতাল বা দাহ খরচা আমরা দিতে পারব না, কারণ পাগল-ছাগল পোষা হাই কমিশনের কাজ না। আর একটি কথা ভুলো না। ভূলিলে বিপদ হবে (বিপদটা যে কতটা সাংঘাতিক, তা যথাকালে বুঝেছিলাম)। মনে রেখো, রঘুনাথ রাও-এর মতো তুমিও বাঁধা আছ ন্যায়ের বিধানসূত্রে। মানে, তুমি সরকারের পয়সায় এসেছ। তার শর্ত, জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ফিরবে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে-চাকরি দেবেন তাই নিতে হবে। মধ্য প্রাচ্যে কোনও বোম্বেটে তোমাকে ধরে দাস ব্যবসায়ে নিযুক্ত করেছিল, এই অজুহাতে ছ’ মাস পর দেশে ফিরলে সে সব আমরা মানব না। সবিনয়ে উত্তর দিলাম, হুজুরান, চিন্তা করবেন না। সব দায়িত্ব আমি নিলাম। পথে বেঘোরে মরলে দাহ খরচা নিজেই দেব, আর তেমন দরকার হলে ভূত হয়ে খেটে সরকারের ঋণ পরিশোধ করব। সরকারের জন্য যাঁরা খাটেন বা খাটেন না তাঁদের অনেকেরই জায়গায় ভূতেদের নিযুক্ত করলে জনসাধারণের কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা না। অবশ্যই এ সব কথা মনে এলেও কাগজে-কলমে লিখিনি। যা হোক, শেষ অবধি ছোটখাটো একটি চেক হাতে এল। আর একটি স্বীকারপত্রে সই করে পাঠাতে হল, যার মূল কথা, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। বুঝলাম, এই ধর্মহীন সরকার ভবিতব্যে বিশ্বাস করে না। সঙ্ঘ পরিবার কি সাধে সেকুলার সেকুলার বলে ক্ষেপে উঠেছিল? বিশ্বাসী হেঁদুর গায়ে এ সব অধর্মের কথা আর কত সহ্য হয়?
অক্সফোর্ড আসার সময় দেশ থেকে বেশ মোটা একটি কম্বল কাটিয়ে একটি ওভারকোট বানিয়ে এনেছিলাম। আর তা ছাড়া পাঁচটা ভদ্র বাঙালি শীত পড়লে লেকে বেড়াবার সময় যে-মাঙ্কি ক্যাপ পরেন, তাও একটা এনেছিলাম, যাতে ঠান্ডায় অপমৃত্যু না ঘটে। বন্ধুবর প্লাদিমির একবার ওই দুটি জিনিস পরিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। পথে যার সঙ্গে দেখা হয় তার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড, দা এবমিনেবল স্নোম্যান’ বলে। অক্সফোর্ড ছাড়বার আগে বন্ধুদের পরামর্শে ও দুটি অক্সফ্যামকে দান করতে গিয়েছিলাম। ওরা নিতে রাজি হল না। সবাই বলল, ওই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এরকম ঘটনা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। যাক, শেষাশেষি জিনিস দুটির মায়া ত্যাগ করে পাঁশগাদায় ফেলে দিলাম। পাঁশগাদা মানে স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি বা কাউন্সিলের সযত্নে রক্ষিত ধাপার মাঠ। তারপর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে প্যাডিংটন, সেখান থেকে ওয়াটার্ল স্টেশন, তারপর চ্যানেল পার হওয়ার জন্য ডোভার। ডোভার থেকে ফেরি জাহাজে বেলজিয়মের অন্তর্গত জেইব্রুখ।
ফেরি জাহাজে বিরহিণী যক্ষিণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তবে তখন আর সে যক্ষযযানিতে নেই, নিতান্তই মানবী। বয়স গোটা পঞ্চাশেক হবে। জাতে ফ্লেমিশ, মানে রুবেনসের স্বজাতি। আকারও উক্ত মহাত্মার আঁকা ছবির নায়িকাদের ছাঁচে। তবে গায়ে জামাকাপড় থাকায় ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ইংরেজরা সচরাচর অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে না। কিন্তু ইউরোপের আর পাঁচটা জাতের ও বালাই নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা বলায় দোষের কিছু নেই, এ কথাটা তারা সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। তাই বিনা দ্বিধায় মানবী প্রশ্ন করলেন, অস্তের্স? অর্থাৎ, প্রাচ্য দেশের লোক? এই জাতীয় মানুষ আমি খুব পছন্দ করি। যাকে প্রশ্ন করছ সে তোমার ভাষা জানে কি না, পরোয়া না করে নিজের ভাষায় আলাপ শুরু করে। লাগলে লাগল, না লাগলে পরোয়া নেই। এ ক্ষেত্রে লেগে গেল। কারণ ফ্লেমিশ আর ডাচ জেঠতুত-খুড়তুত ভাই, একটা জানলে অন্যটা বোঝা যায়। বললাম, অবশ্যই, আমি আধ্যাত্মিক চিন্তা তথা বিচিত্র পেজোমির জন্মভূমি ভারতবর্ষের সন্তান। শুনে আবেগে মহিলার চোখ বুজে এল। বললেন, “টাগোরে? গানডি?” শুনে বড় আত্মদ হল। শ্বেতদ্বীপে দু-চারজন গাঁধীজির নাম যদিবা শুনে থাকে, রবীন্দ্রনাথের কথা জানে এমন প্রাণী রীতিমতো দুর্লভ। সলঞ্জে জানালাম ওই দুই মহামানবকেই স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর পর মহিলা এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যেন স্বয়ং যিশুর শিষ্য কোনও প্রেরিত পুরুষ বা এপোসলকে প্রত্যক্ষ দর্শন করছেন। তারপর কিছু অন্তরঙ্গ কাহিনি শোনালেন। আর এক প্রাচ্যদেশীয় মানব ওঁর জীবনে আবির্ভূত হয়েছিল। সে ইরাকের মুসলমান। বহুঁকাল পরে হাসপাতালে রোগশয্যা থেকে সে তার পুরাতন বান্ধবীকে স্মরণ করেছে। “হেই দেনত আন মেই, দেনত আন মেই।” সে খালি আমার কথা ভাবে, খালিই আমার কথা ভাবে। কেন? কে জানে? মানব চরিত্রের রহস্য কে বুঝতে পারে? কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় ভালবাসা। অস্তের্স লিফদ-অ। সে এক অপূর্ব জিনিস। জো দিইপ, জো-ও জাকত। এত গভীর, এত নরম! সেই প্রেম স্মরণ করে ফ্লেমিশ রমণী দেখি বেপথুমতী। ততক্ষণে জাহাজ জেইখ পৌঁছে গেছে। প্রাচ্যদেশীয় প্রেমের ধ্যানে নিমগ্ন নারীর ধ্যান ভঙ্গ না করে নীরবে বিদায় নিলাম।
জেইব্রুখ থেকে এস্টোয়ার্প। বহুবার দেখা এই শহর। সেখানে পুরাতন বান্ধবী রিকা ওরফে ফ্রেডারিকা অপেক্ষা করছিল। হেগ অভিলেখাগারে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সে তখন এন্টোয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ছাত্রী। ডাচ ভাষায় যাকে বলে ব্লন্ডচ্যা, স্বর্ণকেশী বালিকা, চোখের মণিতে সবুজের আভা। তারপর ক’বার এন্টোয়ার্পের কাছে ওদের বাড়ি হোবোকেন গ্রামে গিয়েছি। একসঙ্গে বুখ খেন্ট বেড়িয়েছি। এবারও গেলাম। একবার ইচ্ছে হয়েছিল ব্রাউনিংয়ের লাস্ট রাইড টুগেদার ওকে শোনাই। কিন্তু কেমন যেন হাসি পেল। ব্রাউনিংয়ের বদলে অলডাস হাক্সলি থেকে দুটি লাইন ওর অটোগ্রাফের খাতায় লিখে দিলাম: “ট্র্যাজেডি ইজ দা ফার্স হুইচ ইনভলভস আওয়ার সিমপ্যাথি। ফার্স ইজ দা ট্র্যাজিডি হুইচ হ্যাপেনস টু আদার্স।” এন্টোয়ার্প স্টেশনে ডেন হাগের ট্রেনে উঠলাম। অনেক দূর অবধি দেখতে পেলাম—রিকা রুমাল নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। চিঠিপত্র মারফত যোগাযোগ রাখার চেষ্টাও কখনও করিনি। সত্যিই কি রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে? লাইনটা লিখে কবি নিজেই সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন। “সত্যি বললাম তো?”
ডেন হাগের স্টেশনে ইডো অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে আমালিয়া স্ট্রিটের সেই পুরনো অভিজাত ভবন। সেখানে আমাকে বিদায় জানাবার জন্য ছোটখাট এক উৎসবের আয়োজন হয়েছে। ওই সেই আফওয়াশ সাঙ্গেন, বাসন ধোয়ার গান। ইমপ্রেসারিও ইয়ানের বাগদত্তা এলি। তার কিঞ্চিৎ স্কুল দেহে সত্যিই লঘু মন। সে গান ধরল—দাআর খাত ইয়ানচ্যানার দা রিকসাম তু। সঙ্গে সবার উদ্দাম নৃত্য। ইয়ানচ্যা এলির ভবিষ্যৎ পতিদেবতা। সে অধঃপাতে গেলে এত উল্লাসের হেতু কী তা বোঝা কঠিন। যা হোক, উৎসব রীতিমতো জমে উঠল। ঘরের ভিতর আলো-আঁধারির খেলা। প্লেটে প্লেটে নানা টুকিটাকি খাবার সাজান রয়েছে। একটি বস্তু মুখে দিয়ে বেশ সুস্বাদু মনে হল। কিন্তু স্বাদটা অচেনা। পর মুহূর্তেই বুঝলাম বস্তুটি কী! অন্ধকারে না দেখে স্যান্ডউইচ টারটার—অর্থাৎ কাঁচা গোমাংসের স্যান্ডউইচ গলাধঃকরণ করেছি। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে এল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম। জানলাম সংস্কারমুক্ত হওয়া সোজা কাজ নয়।
ইতিমধ্যে ইডোর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ফ্রেড আর তস্য পত্নী লেনার আবির্ভাব। ফ্রেড ছিল যাকে বলে রগুড়ে মানুষ। নেচে কুঁদে হোহো-হিহি করে সবাইকে, বিশেষত নিজের বউকে, খুঁচিয়ে নরক গুলজার করার আর্ট তার সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল। ইউরোপের উচ্চ কোটির সংস্কৃতি তার চোখের বিষ। লেনা পেতিত্ অর্থাৎ ছোট সাইজের সুন্দরী মেয়ে। একটু বেশি সংস্কৃতিবান। সে এসেই প্রস্তাব করল—এই রান্নাঘর ছেড়ে ওপরের প্রশস্ত হল ঘরে চলো। এটা কোনও নাচগানের জায়গা? ও ভাল অর্কেস্ট্রার বাজানো ভিয়েনিজ ওয়ার্জ-এর রেকর্ড নিয়ে এসেছে। স্তিমিত আলোয় সেই রেকর্ডের সঙ্গে ধীবোদাত্ত ছন্দে ওয়াজ নৃত্য হবে—’তুন, ও তুর্ন মে পের্সনাজ’। ফ্রেড এক কথায় সে প্রস্তাব বাতিল করল—”রোমান্টিশ!” এর চেয়ে বেশি নিন্দনীয় কোনও শব্দ ওর ভাষায় ছিল না। লেনা মুখ ব্যাজার করে বসে রইল। মুখে বলল, “ফ্রেডটা একটা জন্তুবিশেষ।” কিন্তু ওই জন্তুর প্রেমে সে পাগল। কী করা যাবে। ফ্রেড শুধু এক রকম গানই ভালবাসে। তার উৎপত্তি বহু দূরদেশে, ইউরোপীয় সংস্কৃতির বাইরে। তার নাম ক্যালিপসো। এবং তার মধ্যে একটি গানই ফ্রেডের প্রিয়। সেই ভয়াবহ অপসাংস্কৃতিক সংগীত হাজার বার শুনেও ওর তৃপ্তি হয় না। কিন্তু ফ্রেড আর ওই মহাসংগীত পার্বতী-পরমেশ্বরের মতই পরম্পরসম্পৃক্ত। ও যেখানে উপস্থিত সেখানে ওই গান না শুনে নিষ্কৃতি নেই। ফলে রেকর্ড বাজতে শুরু করল, কাম মিসতার তালিমান, তালি মি বানানা। আর সেই কলা বেচার গানের সঙ্গে উন্মত্ত রক অ্যান্ড রোল। অহহ, কী যন্ত্রণা।
আওয়াজ আর নাচানাচি যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে, তখন আমি এক মোক্ষম দাওয়াই প্রয়োগ করলাম। নাচানাচির একটু বিরতি হতেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলাম, “এসো আমি তোমাদের হাত দেখব৷” ব্যস, ম্যাজিকের মতো কাজ হল। কে না জানে, ভারতীয় মাত্রেই সামুদ্রিক শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। তার উপর অক্সফোর্ডের পাশ দেওয়া ভারতীয় বলে কথা। দশখানা হাত যুগপৎ এগিয়ে এল, “আমি আগে, আমি আগে।” লেনা বেচারা এতক্ষণ মুখ ভার করে এক কোণে বসে ছিল। এখন সে রীতিমতো উদ্দীপিতা। ওর হাতটাই আগে নিলাম। তখন আমার পেটেও তিন চার বোতল আমস্টেল বিয়ার। কী মনে হল জানি না। বললাম, “লেনা, তুমি ভবিষ্যতে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হবে।” সবাই হো হো করে হেসে উঠল “আমরা অনেকদিন ধরেই জানি ফ্রেড কালে ব্যাঙ্ক ডাকাত হবে।” ফ্রেড তখনও পর্যন্ত ওই পেশাটা ধরেনি। আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডাকাতির মতো অত রোজগার হয় না। ফ্রেড ঘুষি উচিয়ে বলল, “দেখ, আমি যখন হেনরি ফোর্ড হব, তখন তোমাদের সব দারোয়ান রাখব।” তারপর কী হঠাৎ মাথায় এল জানি না। বললাম, “লেনা, তোমার হাতে সবই ভাল, শুধু দেখছি আয়ুষ্কাল নিয়ে কিছু একটা গোলমাল আছে। তবে এটা তোমার আয়ু না নিকটস্থ আর কারও, বুঝতে পারছি না।”
চিঠিপত্র লেখার আমার কোনও দিনই অভ্যেস নেই। ফলে দেশে ফেরার পর ইডোদের খোঁজখবর অনেকদিন নেওয়া হয়নি। ১৯৬০-এ আবার এক বছরের জন্য ইংল্যান্ড যাই। লন্ডন থেকে যখন ডেন হাগ গেলাম, তখন ইডোর কাছে এক মর্মান্তিক খবর পেলাম। ও বলল, আমার লেনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। লেনা এখন দশ লক্ষ ডলারের মালিক। কিন্তু এই সৌভাগ্য বিনামূল্যে হয়নি। সরকারের জন্য ফ্রেড একটা ব্রিজ তৈরি করছিল। সেই সময়ে জিপ অ্যাকসিডেন্টে ও মারা যায়। ক্ষতিপূরণ হিসাবে ডাচ সরকার লেনাকে এক মিলিয়ন ডলার খেসারত দিয়েছে। আমি আর কখনও কারও হাত দেখার প্রাণঘাতী খেলা খেলবার চেষ্টা করিনি।
আবার কখনও ইউরোপ ফিরব, তখন এমন ভরসা ছিল না। তাই বহু পরিচিত প্রিয় জায়গাগুলিতে একটা দিন ঘুরে ঘুরে কাটালাম। মাউরিটসহাউস, ঋেভেনিত্থেনের সমুদ্রতীর, অফিসপাড়ার সেই কাফে, লেলিভেল্টের মাঠ, মোলেনস্ট্রাটের সেই কাফেতে ডাচ চিতে পিঠা পফেরচা ভক্ষণ—সব চেনা অভিজ্ঞতাগুলিই আর একবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম। ভেরমিয়ারের আঁকা ডেলফটের দৃশ্যের একটি প্রতিলিপি আমার ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যয় করে কিনলাম। সেটি এখনও আমার বসার ঘরে দেওয়ালে ঝুলছে। তার সঙ্গে যৌবনের বহু আনন্দের স্মৃতি জড়িত।
হল্যান্ড থেকে কোপেনহেগেন, সেখান থেকে জার্মানির ডুসেলডর্ফ। শেষোক্ত জায়গায় অনন্তরমণ তখন গবেষণায় ব্যস্ত। দেখলাম, যে-ফেসিলিটি’র অভাবে বঞ্চিত নরনারী দুঃখভোগ করে বলে ওর দুশ্চিন্তা ছিল, সেই ফেসিলিটির সমস্যার ওর ব্যক্তিগত জীবনে একটা সমাধান হয়েছে। রমণ তার বাগদত্তা জার্মান মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ডুসেলডর্ফ থেকে কোপোন। সেখানকার জগদ্বিখ্যাত ক্যাথিড্রালে এক বিচিত্র নির্দেশনামা দেখে মুগ্ধ হলাম। গির্জার ভিতরে কী কী করা চলবে না তার একটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ফর্দ। প্রথম কথা, প্রেম অবশ্যই করা চলবে না। দ্বিতীয় কথা হাফ প্যান্ট নিষিদ্ধ। কিন্তু যে-নিষেধবাণী আমাকে বিস্ময়ে হতবাক করেছিল সেটি নিম্নরূপ : ‘গির্জার ভিতরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে চলা নিষিদ্ধ’। কিন্তু কেন? এর কোনও জবাব নেই। দেশটা জার্মানি। এখানে জনগণ সরকারের আদেশ মেনে চলতে অভ্যস্ত। এটা পেঁয়াজি করার জায়গা একেবারেই না। মানে মানে পকেট থেকে হাত বের করে নিলাম।
পয়সার অভাবে অনেক ট্যুরিস্টকৃত্যই এর আগে সম্ভব হয়নি। সেই সব সাধ এই যাত্রায় কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করলাম। কোলোন থেকে ডুসেলডর্ফ হয়ে রাইন-ডুসেলডর্ফার জাহাজ ফ্রাঙ্কফুর্ট যায়। বেড়ান বা ট্যুরিজম ছাড়া এই নদীবিহারের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ওখানে আহারবিহার সব কিছুই ট্যুরিজমের সুদৃশ্য মোড়কে প্যাক করা। দু-পাশে সবুজ পাহাড় আর সাজান সব শহর-গ্রাম। পাহাড়ের গায়ে আঙুরের লতা। মাঝে মাঝেই পাহাড়ের চূড়া ঘেঁষে মধ্যযুগীয় কেল্লা। বহু শত বৎসরের রক্তাক্ত অন্তর্দ্বন্দ্বের স্মৃতি তার সঙ্গে জড়ান। কিন্তু নয়নমুগ্ধকর সন্দেহ নেই। লোরেলেই পয়েন্ট পৌঁছতেই জার্মান রোমান্টিক ঐতিহ্যের অন্যতর ফল বহু জনপ্রিয় গানটি বেজে উঠল। নানা বয়সের এবং, বলাই বাহুল্য, নানা সাইজের জার্মান স্ত্রী-পুরুষ নাচতে শুরু করলেন। তাঁদের কেউ কেউ না নাচলেই ভাল ছিল। সেই অনন্তরমণের সাবধানবাণী মনে পড়ল। যা দেখলে অন্য মানুষের যন্ত্রণা বোধ হয় সেই আনন্দ কি সর্বজনসমক্ষে করা উচিত?
ট্যুরিজম মানুষ আর বাড়িঘরের ভিড় বাড়িয়ে পৃথিবীর সুন্দরতম জায়গাগুলিকে অসুন্দর করে তোলে ঠিকই। কিন্তু নদী-হ্রদ-পাহাড়-সমুদ্রের এক অজেয় রূপ আছে। তা ধ্বংস করা। লোভী নির্বোধ মানুষের পক্ষেও সহজ নয়। তবে অনেক বছর পরে ওই রাইন-ডুসেলডারে আর একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এবার দেখলাম সুন্দরকে কুৎসিত করার স্কুল প্রচেষ্টা শতকরা নব্বই ভাগ সফল হয়েছে। কারণ ট্যুরিজম না, শিল্পায়ন। ফ্যাক্টরির চিমনির কাছে মা ধরিত্রী শেষ অবধি মাথা নত করেছেন। ১৯৫৭ সালেও দেখেছিলাম—ডুসেলডর্ফ বা কোলোনেও বহু বাড়ি বোমায় বিধ্বস্ত। ভাঙা বাড়ির দু-একটি ঘরে আলো জ্বেলে বসে কেউ কাজ করছেন। কিন্তু প্রতিটি মানুষ দৈনিক কাজের সময় এক থেকে দু’ ঘণ্টা বাড়িয়ে নিয়ে জার্মানির আগের চেহারা শুধু ফিরিয়ে আনেনি, সম্পদ আগের তুলনায় বহু গুণ বাড়িয়েছে। একটি তথ্য জেনে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। বার্লিনবাসীরা বিধ্বস্ত শহরটি আবার গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে, জার্মানি যেদিন আত্মসমর্পণ করে তার পরদিন থেকে। কিন্তু সমৃদ্ধি ফিরে পাওয়ার জন্য যে দাম দিতে হয়েছে, রাইনতীরবর্তী অঞ্চলের কুৎসিত চেহারা তারই অংশ।
জার্মানির অক্সফোর্ড হাইডেলবার্গ। তার বহিৰ্দশ্য আমার চোখে অক্সফোর্ডের থেকেও ভাল লাগল, কারণ জায়গাটা পাহাড়ে আর শহরটির ভিতর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়টি বয়সে অক্সফোর্ডের চেয়ে খুব ছোট নয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় তফাত আছে। অক্সফোর্ড একদিকে মধ্যযুগের, অন্যদিকে বিশেষভাবে বিংশ শতকীয়–মরিস মোটর কোম্পানির কারখানা এই শহরের সমৃদ্ধির পেছনে। হাইডেলবার্গ সম্পূর্ণই মধ্যযুগের, তার উপরে আঠারো-উনিশ শতকের জার্মান রোমান্টিসিজমের প্রলেপ পড়ে মধ্যযুগীয় বীভৎসতা শিভালরি আর টুবাডুরদের গানের মোড়কে অদৃশ্য হয়েছে। ছাত্ররা তলোয়ার খেলা বা ফেন্সিং শেখে, আর মধ্যযুগীয় বীরত্বের আদর্শে ফিরে গিয়ে পরস্পরের গালে তলোয়ারের চিহ্ন এঁকে দেয়। না, সে-প্রথা বেশ কিছুকাল আগেই উঠে গেছে, কিন্তু কেন যেন মনে হয়েছিল, উনিশশো সাতান্ন সালেও তার প্রতি মোহময় ভক্তি তরুণ জার্মান হৃদয়ে সজীব রয়েছে। বসুন্ধরা, বিশেষত নারীর প্রেম, বীরভোগ্যা—এ বিশ্বস বহু সংস্কৃতিরই অঙ্গ। তবে আধুনিককালে সে বীরত্ব আর তলোয়ার খেলায় সীমাবদ্ধ নেই। জার্মান সংস্কৃতি কি এই নতুন আদর্শের ব্যতিক্রম? মাচিসমা বা আগ্রাসী পুরুষালির পূজা বোধ হয় এখন তুলনায় ল্যাতিন আমেরিকা আর ইতালিতেই বেশি চালু।
সংস্কৃতির কথা যখন তুলোম, তখন হাইডেলবার্গে ভারতীয় অপসংস্কৃতির সঙ্গে এক বেদনাদায়ক মোলাকাত হয়েছিল তার কথাটাও লিখি। একটা ছোট রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছি। দেখি আর একটা টেবিলে এক দল ভারতীয় ছেলে বেশ হই চই করছে। তখন বহু ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষার জন্য জার্মানি যেত। পশ্চিম জার্মান সরকার এ জন্য বেশ উদার হস্তে অনুদান করেছিলেন। ধরনধারণে বুঝলাম—ওই হইচইারীরা সেই দলের লোক। এরা বেশির ভাগই ম্যাট্রিক বা তুলনীয় কোনও পরীক্ষা পাশ করে বিদেশ যেত। কিন্তু শুনেছি কারিগরি কাজে দক্ষতার ব্যাপারে এরা কারও তুলনায়ই পিছিয়ে থাকত না। কিন্তু আচার ব্যবহারে অনেক সময়ই এরা একটু বেশি উগ্র, ইংরেজিতে যাকে বলে ব্রাশ। তার প্রমাণ হাতেনাতেই পেলাম। ওয়েটার যখন এসে জিগ্যেস করল, “তোমরা কী খাবে?” এক অতি স্মার্ট যুবক বলল, “অন্য কোনও ভাল রেস্তোরাঁর ঠিকানা দিতে পার? এখানকার খাবার শুনেছি মানুষে খেতে পারে না!” ওয়েটারটি ওদের একজনকে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে এক দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই রেস্তোরাঁটায় যেতে পারেন। শুনেছি রান্না ভাল। এই জায়গাটার আমিই মালিক, আমিই রাঁধুনি। আমি জানি আমার রান্না বিশেষ ভাল না।” এই উত্তর শুনে দলসুদ্ধ হেসে উঠল। তার সঙ্গে মন্তব্য, “তুমি যে রাঁধতে জানো না সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!” লোকটি চুপ করে শুনে গেল। এই জাতীয় স্মার্ট কথা দেশে, বিশেষত দিল্লি শহরে, বহুবার শুনেছি। ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্র বলে দেশের কোনও বিশেষ শহরকে চিহ্নিত করা যায় কি না জানি না, কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থ যে ভারতীয় অসভ্যতার রাজধানী, সে বিষয়ে আমার কোনও সংশয় নেই।
এই প্রসঙ্গে কিছুটা অবান্তর একটা কথা বলি। ভারতীয় সংস্কৃতি জিনিসটা কাল্পনিক ব্যাপার নয়, সাধারণ মানুষের চেতনা এবং ব্যবহারে তার শিকড় গভীরে চলে গেছে, আমার পরম সৌভাগ্য তার প্রত্যক্ষ প্রমাণও আমি অনেকবার পেয়েছি। এইখানে দুটি ঘটনার কথা বলব, যদিও তাদের সঙ্গে আমার স্থলপথে দেশে ফেরার কাহিনির কোনও যোগ নেই। ভারতীয় অসভ্যতার কথা বলেছি, তাই বিবৃতির ভারসাম্য রাখার জন্য ভারতীয় সভ্যতার কথা বলা প্রয়োজন মনে হল।
১৯৫৮ সালে কুলু-মানালি বেড়াতে গিয়েছিলাম। পাঠানকোট থেকে বাস ধরেছিলাম। পথে একটি জায়গা, এখন নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, সম্ভবত নূরপুর-তার কুলফি মালাইয়ের জন্য বিখ্যাত। ওখানে জিনিসটার নাম কুলফি না, বরফখায়েকুলফির টিনের ঘঁচে না, মাটির হাঁড়িতে জমানো, হাতা দিয়ে কেটে কেটে শুকনো পাতায় করে পরিবেশন করে। এমন অপূর্ব স্বাদ আইসক্রিমের লাইনে আর কিছুতে পাইনি। ফেরার পথে আবার ওখানে বাস থামল। বরফখোয়ে আর একবার খেলাম। কিন্তু এবার ঠিক আগের মতো ভাল লাগল না। কুলফিওয়ালাকে বললাম, তোমার মাল খুবই ভাল। কিন্তু ক’দিন আগে যে খেয়েছিলাম, সে যেন আরও ভাল ছিল। লোকটি বিনা দ্বিধায় উত্তর দিল, “তুমি নিশ্চয়ই রাম সিংহর বরফখোয়ে খেয়েছিলে। ওই সব চেয়ে ভাল কারিগর। ডেকে দেব রাম সিংহকে?” লজ্জায় কোন দিকে তাকাব ঠিক পেলাম না। বললাম, “না, না তোমারটাও খুব ভাল।” দ্বিতীয় ঘটনাটি কলকাতা [সুনীলরা যা-ই বলুন, আমি কোলকাতা লিখতে রাজি না। সাত পুরুষের কাঠ বাঙাল। কইলকাতা লিখছি না এই জন্যই সকলের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মোরগো ভাষা কি কারও চাইয়া খাড়ো? তয়?] শহরেই ঘটে। লেক মার্কেটের পাশের গলিতে যেখানে কিছু গ্রামের লোক বাড়ির বাগান থেকে ফল-তরকারি নিয়ে বসে, সেখানে একদিন একটি মাঝবয়সী স্ত্রীলোক দেখি কিছু কচুর শাক আর একটা মোচা নিয়ে বসে আছে। দাম জিগ্যেস করায় চোখ বড় বড় করে বলল, “দুটো মিলিয়ে পনেরো টাকা।” সে এক পয়সাও কমাতে পারবে না। হ্যাঁ! সেই দামে রাজি হয়ে যখন ওকে একটা বিশ টাকার নোট দিলাম, ও এক মুঠো টাকাপয়সা হাত মেলে আমার সামনে ধরল। বলল, “গুনে নেও!” “তুমি গুনে দেও না।” “আমি কি গুনতে জানি যে গুনব?” “বলো কী? তরকারি বেচতে এসেছ, গুনতে জানো না। তোমাকে যে ঠকিয়ে নেবে সবাই।” “যে ঠকাবে তারই অধম্মো হবে। আমার কী এল গেল?” এই কথোপকথন ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও হওয়া সম্ভব বলে মনে করি না। ঐতিহাসিক ব্যাশাম সাহেব বলতেন, যে-হিন্দি সিনেমা দেখে ভারতীয় ইনটেলেকচুয়ালরা নাক সিঁটকোয়, তার মূল কাঠামোও ধর্ম আর অধর্মের লড়াই। রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকে যে বিশ্বাস চলে আসছে, তা আজও জীবিত। বিশ্বায়নও তাকে ধ্বংস করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
আমার ভ্রমণকাহিনিতে ফিরে যাই। জার্মানি থেকে অষ্ট্রিয়া। প্রথমে সালজবুর্গ, তারপর ভিয়েনা। এর আগে এক কনফারেন্স উপলক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে ভিয়েনা গিয়েছিলাম। ওখানে দুটি পরিবারের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল। সেবারকার কনফারেন্সটা ছিল শরৎকালে, তখন সেই বছরের নতুন মদ সবে বাজারে উঠেছে। এই শিশু মদ্যের জার্মান-অস্ট্রীয় নাম হয়রিখেন, আর তার আস্বাদন হল হয়রিখেন-বেজুখ, মানে সেই নবাগতর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকার দলবদ্ধভাবে একটা দীর্ঘ সময় ধরেই হয়। ফলে মানুষে মানুষে অপরিচয়ের দেওয়াল সহজেই ভেঙে যায়। এই ভাবেই যথাক্রমে মার্কিন এবং অস্ট্রিয়ান দম্পতি দুটির সঙ্গে অল্প সময়েই বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল। এবার আমি অষ্ট্রিয় দম্পতিকে বাইরে বেশ দামি রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গেলাম। এই অসম্ভব ঘটনার কারণ দুটি। প্রথম, সে সময়ে ইউরোপে দু-তিনটে সস্তাগণ্ডার জায়গা ছিল। অস্ট্রিয়া এবং স্পেন সেই সস্তা জায়গার তালিকায় প্রথম সারিতে। তার উপর পাউন্ড তখন বেশ জোরদার। বিশেষ করে অস্ট্রিয়ান শিলিং-এর সঙ্গে বিনিময়ের হারে। সুতরাং অন্দরে ছুঁচোরা যতই কীর্তন গাক না কেন, ভিয়েনায় এক সন্ধ্যায় কোঁচার পত্তন দেখান আমার সাধ্যাতীত ছিল না। সেই সন্ধ্যাটা ভালই কাটল। কিন্তু পরদিন মার্কিন দম্পতির সঙ্গে পানভোজনের নেমন্তন্নটা ঠিক জমল না—সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। অষ্ট্রিয়া অক্ষশক্তির একটি। তার জন্য দেশটার যে খেসারত দিতে হয়েছিল তার অন্যতম শর্ত হিসেবে ভিয়েনাকে বেশ কিছুকাল ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স আর সোভিয়েত রাশিয়ার তবে থাকতে হয়। শহরটাকে চারটি জোন বা অংশে ভাগ করা হয় এবং এক একটি ভাগ এক একটি বিজয়ী রাষ্ট্রের তাবে থাকে। এই ব্যবস্থা ঠান্ডা লড়াই শুরু হওয়ার পর খুব ভাল চলছিল না। দখলকারী চার সংস্থার মধ্যে খটাখটি লেগেই থাকত। মার্কিন দম্পতির বাড়িতে খাওয়ার সময় কপালদোষে সেই প্রসঙ্গ উঠল। আমার বন্ধুটি রাজনীতির দিক থেকে রক্ষণশীল। তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রের নানা নিন্দাবান্দা করছিলেন। আমি নিজে স্টালিনের স্থাপিত রাষ্ট্রব্যবহার গুণমুগ্ধ স্তাবক কোনও দিনই ছিলাম না। কেসলারের ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’-এ বর্ণিত মস্কোর বিচারের প্রহসনের কথা যে অনেকাংশে সত্যি, তা আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু যুদ্ধ থামার পর পশ্চিমের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত শক্তির অবদান সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে শুরু করেছিলেন, সেটাও আমার যুক্তিযুক্ত মনে হত না। বন্ধুভবনে আপসে আলোচনা প্রসঙ্গে সেকথা আমি বললাম। ব্যস। বন্ধুটি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। “তোমাদের—তৃতীয় জগতের বুদ্ধিজীবীদের—এই নির্বোধ দুর্বলতা কিছুতেই যাবে না। তোমাদের আমরা সব দিচ্ছি, তবুও তোমরা রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা যদি সরে আসি আর রাশিয়ার তাঁবেদাররা তোমাদের কজা করে তবে তোমাদের শিক্ষা হয়”। আলোচনা এই পর্যায়ে পৌঁছলে তর্কে হারা-জেতার কোনও প্রশ্ন আর ওঠে না। তাই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখান থেকে বিদায় নিলাম। বুশ জুনিয়ারের রাজত্বে নিওকনদের যে দম্ভ আর আগ্রাসন সকলকে স্তম্ভিত করছে, তার বীজ অনেকদিন আগেই পোতা হয়েছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রথম পর্বেই। তার ভয়াবহ সব সম্ভাবনা হঠাৎ হঠাৎ নজরে পড়ত। বিদায় নেওয়ার সময় বন্ধুপত্নী বললেন—”ইউরোপে এলে আবার এসো কিন্তু।” সে কথার অসত্য জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলাম।
ভিয়েনা আমার অন্যতম প্রিয় শহর। অষ্ট্রিয় হাবসবুর্গ রাজবংশের ইউরোপ-জোড়া সাম্রাজ্যের রাজধানী এই শহরের ঐতিহ্যের এক করুশ দিক আছে। উনিশ শতকেই হাসবুর্গদের ক্ষমতা ক্ষীয়মাণ। কিন্তু আড়ম্বরের কিছু ত্রুটি তখনও হয়নি। শহরজোড়া বারোক স্থাপত্য সেই অন্তঃসারশূন্য আস্ফালনের স্মৃতি বহন করছে। বিরাট বিরাট গেট, যেখানে সেখানে ক্লাসিকাল আদর্শে তৈরি সব মূর্তি, কৃষ্টি, ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের গৌরব ঘোষণা করছে। সে গৌরব প্রথম মহাযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ অস্তমিত। ১৯৫৭ সালে ওইসব বারোক মূর্তি, গেট, বিরাট চওড়া রাস্তাঘাট ঠিক ভাবে দেখাশুনা করার মতো পয়সারও অভাব। অভিজাত ভবনগুলির বাইরে নেমপ্লেটে অমুক ফন তমুক ইত্যাদি পিলে চমকান নামের ছড়াছড়ি। কিন্তু অভিজাত পুষ্পবদের মাসখরচা চলে ঘর ভাড়া দিয়ে কিংবা পেয়িং গেস্ট নিয়ে। আমি সামান্য পয়সা দিয়ে যে বাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানে সকালের কফি নিয়ে আসতেন বাড়ির মালিক কাউন্টেস স্বয়ং। ঝি-চাকর রাখার রেস্ত অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ওখানে থাকার সময় বরিশালবাসের এক স্মৃতি খুব মনে পড়ত। চন্দ্রদ্বীপের ভূঁইয়া রাজার বংশধর মাধবপাশার রাজাদের বাড়ি গিয়েছিলাম একবার প্রাচীন নথিপত্রের সন্ধানে। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে সামনের দোকানে খবর নিলাম। উত্তর পেলাম, “থাকনের মধ্যে এখন তো আছে ক্যাবল গোপাল রাজা। সে গ্যাছে বাজারে।” ভিয়েনায় গোপাল রাজা ডজন ডজন। তারা শুধু বাজারে যায় না, ঘরও ঝাড় দেয়।
.
দেশভ্রমণ ব্যাপারটা অনেক সময়ই নৈরাশ্যজনক ব্যাপার। যে-দেশে যাচ্ছি তার সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে উপরি উপরি কিছু বাড়িঘর, পুরাকীর্তি তথা শিল্পকীর্তি দেখে খুব কিছু আনন্দ হয় না, যা দেখলাম তা বিশেষ মনেও থাকে না। প্রাকৃতিক দৃশ্যর কথা অবশ্যি আলাদা। খুব রসকষহীন মানুষও পাহাড় বা সমুদ্র দেখে দৈনন্দিনতা থেকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ পায়। তবে তার ব্যতিক্রমও আছে। আজকাল শিক্ষাজগতে আন্তর্জাতিক বিনিময়ের ফলে এবং ভারত সরকারের দাক্ষিণ্যে বহু লোক বিদেশে, বিশেষত ব্রিটেনে আসে, যারা না এলে তাদের বা অন্য কোনও মানুষের কোনও ক্ষতি হত না। এরকম দু একজন বন্ধুবান্ধবের চিঠি নিয়ে এসেছেন, যাঁদের কোনও কিছুতেই কোনও উৎসাহ নেই। এক ব্যক্তির অর্ধসুপ্ত মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম এখানকার মিউজিয়ামে যাবে? বিরস মুখে প্রতিশ্ন, “উহাঁ কেয়া হ্যায়?” বললাম–ছবি আছে, মূর্তি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনে আগন্তুক বললেন, “ছোড়িয়ে। ওহ ভি এক দেখ লিয়া।“ মরিয়া হয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। ভাবলাম শেষ চেষ্টা করি। কটসোলডের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষের সাক্ষাৎ আমি পাইনি। কিন্তু এই বীতরাগ ব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্বিকার। হঠাৎ দেখি তার চোখেমুখে উত্তেজনা তথা আনন্দের আভাস। প্রীত কণ্ঠে ভদ্রলোক বললেন, “ইহাকা গায়ে কাফি তনদুরস্ত হ্যায়।” বুঝলাম স্বজাতি সন্দর্শনে এবং তাদের শ্রীবৃদ্ধি দেখে প্রাণীটি প্রীত। তিনি নিজেও বেশ তনদুরস্ত, তাই ঈর্ষা বোধ না করে সহমর্মিতায়ই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
আধুনিকোত্তর চিন্তাবিদরা বারবারই রিয়াল রিডার বা সত্যিকার পাঠকের কথা বলেন। কথাটা মূল্যবান কারণ, একই শিল্পবস্তু বা সাহিত্যকীর্তি বিভিন্ন মানুষের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আবেদন বা অর্থ নিয়ে আসে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এই অন্তর্দৃষ্টি বিশেষ অর্থবহ। মানুষ যা দেখে অথবা তার যা অভিজ্ঞতা হয় তা সে নিজের রুচি বা বিশিষ্ট কৃষ্টির আলোতেই ব্যাখ্যা বা গ্রহণ করে। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখলে তার যে নির্যাসটুকু মনে থেকে যায়, তাও ব্যক্তিবিশেষের আগের অভিজ্ঞতা, শিক্ষাসংস্কৃতি এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আমি যেভাবে বোঁচকা কাঁধে ইউরোপে ঘুরেছিলাম তা কষ্টসাধ্য এবং সেই শারীরিক কষ্ট ভ্রমণের আনন্দ কিছুটা নষ্ট করেনি বললে মিথ্যা বলা হবে। যে জায়গায় একরাত বা দু’রাত থাকতাম, হোন্ড-অলটি হাতে নিয়ে সেখানে, বাসস্থানে গিয়ে উঠতাম। অনেক ক্ষেত্রেই জায়গাটা হত ইউথ হোস্টেল। একটা টানা, লম্বা ঘরে পাশাপাশি সব খাট ফেলা। সর্বসমক্ষে বিবস্ত্র হতে রাজি না থাকলে স্নান করার সুবিধে নেই। পাওয়া চলে যাওয়ার মতো, তবে বৈচিত্র্যহীন। তবে তারই মধ্যে মাঝে মাঝে অত্যন্ত সাধারণ জায়গায় অমৃতবৎ খাদ্যও জুটেছে। আর যদি রাত্রিবাসের ইচ্ছে না থাকে তো স্টেশনে মালটি রেখে টুরিস্ট অফিস থেকে ম্যাপ এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে বের হয়ে পড়া। সারাদিন ঘুরে পরবর্তী গন্তব্যস্থানের ট্রেন ধরা। বয়স কম হলেও আমি তখন ঠিক আর নবযুবক নই। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়েছে। সুতরাং কদিন পরপর রাতটা ট্রেনে কাটলে একটি পরিচ্ছন্ন নরম বিছানার জন্য চিত্ত কিছুটা আকুল হতই। মনে রাখবেন, বুদ্ধদেব বসু তার উত্তর তিরিশ প্রবন্ধে যৌবনকে বিদায়ই জানিয়েছেন। আমি ঠিক অতটা যেতে রাজি না থাকলেও স্থলপথে দেশে ফেরার চেষ্টাটা মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর হয়ে উঠত সন্দেহ নেই। কিন্তু তারই মধ্যে বহু উজ্জ্বল মুহূর্ত, অবিস্মরণীয় কিছু ছবি স্মৃতির ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে।
অস্ট্রিয়া থেকে সুইৎজারল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড থেকে ইতালি, ইতালির ব্রিলিসি বন্দর থেকে জাহাজে এথেন্স হয়ে ক্রিট, আবার ওই জাহাজেই এথেন্স ফিরে এসে ট্রেনে এথেন্স থেকে ইস্তাম্বুল, সেখান থেকে টরাস এক্সপ্রেসে বাগদাদ, বাগদাদ থেকে শাত-ইল-আরবের মুখে বসরা আর বসরায় গালফ বোটে ডেক প্যাসেঞ্জার হয়ে ওমান-মস্কট-দুবাই ছুঁয়ে ছুঁয়ে নদিন পর মুম্বই। এই ছিল আমার যাত্রাপথ।
জলের দেশের মানুষ, শৈশব কেটেছে খরস্রোতা নদীর পাড়ে। তাই জল আমাকে সব সময়ই আকর্ষণ করে। জল বর্ণহীন, এক বিশিষ্ট অর্থে আকারহীনও বলা চলে। কিন্তু স্থানভেদে পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তন হলে তার যে কত রূপ, কত বর্ণবৈচিত্র্য হয় ভাবলে অবাক লাগে। সুইৎজারল্যান্ডে তার এক অপরিচিত চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ইউরোপের সংস্কৃতিবান মানুষরা অনেকেই সুইৎজারল্যান্ডের নামে নাক সিটকান। হয় বলেন কুক আর চকোলেট ছাড়া ওদের আছেটা কী?নয় বলেন–স্যানাটোরিয়াম যদি তোমার ভাল লাগে তবে নিশ্চয়ই সুইৎজারল্যান্ড যেও। কিন্তু পার দেখা যায় না এমন সুবিস্তৃত জলরাশি, তার রঙ কখনও কালো, কখনও হালকা আকাশি, কখনও তাতে বরফে ঢাকা পাহাড়ের ছায়া পড়েছে, কখনও পাড়ঘেঁষা বনভূমির। রূপকথা থেকে উঠে আসা ছোট ছোট গ্রাম, ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, যা থেকে তুলে খাবার মুখে দিতেও দ্বিধা হয় না—মহৎ শিল্পসাহিত্য বা বিশ্বজয়ী দর্শনের জন্মভূমি নয় বলে সে-দেশ সভ্য মানুষের কাছে অপাঙক্তেয়—সভ্যতা নিয়ে এমন গৌরব বা শ্লাঘা আমার নেই। ইনটারলাকেন, টুন এমনকী আকারে কিছু বড় লুসার্ন শহর আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পাহাড়ে বাসের উপযোগী সুইস শালে সভ্য জীবনযাত্রার সুষ্ঠু পরিবেশ মনে হয়েছিল। আর অ্যারিখ হ্রদের পাড়ে ছোট্ট একটি গ্রাম—ভিৎসনাউ, আমার মন হরণ করে। সেখান থেকে ফিউনিকুলার ট্রেন স্কি-বিলাসী খেলুড়েদের প্রিয় পাহাড়ের চূড়া রিগি নিয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে সুযোগ পেলেই সেখানে ফিরে গেছি।
কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের দেখা ভিৎসনাউ হোটেল আজ অগুন্তি বাড়ির চাপে হারিয়ে গেছে। ওই সময়ে যেসব জায়গা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার সবগুলিরই প্রায় এক অবস্থা। বাউলরা গান করেন, “সাঁই, তোমার পথ ঢেকেছে মন্দিরে মসজিদে।” পৃথিবীর যত রম্য স্থান তারা আজ চাপা পড়েছে হোটেল আর ট্যুরিস্ট লজে। যারা রাজনৈতিক শুদ্ধতায় বিশ্বাসী, তারা এ জাতীয় কথা শুনলে ভুরু কুঁচকে বলেন, “এলিটিজম। সাধারণ মানুষ বেড়াবার আনন্দের স্বাদ পাচ্ছে, সম্পন্ন লোকেদের তা সহ্য হচ্ছে না।”অবশ্যি মুনাফাবাজরা এই নয়া হুজুগের সুযোগ নিয়ে পয়সা লুটছে, তার নিন্দা করলে প্রগতিশীলরা আপত্তি করেন না। এই তর্কের মধ্যে যেতে চাই না। শুধু বলি, ইউরোপের এক নয়নাভিরাম রূপ দেখেছিলাম। সে রূপ শুধু আমাদের মতো মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছে। আমরা ধনী নই, শুধু এই ধরিত্রীর সেই সব সন্তান, যারা শ্যামল মাটির হারিয়ে যাওয়া দক্ষিণ মুখটি খুঁজে ফেরে আর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে।
পৃথিবীতে কিছু অনিন্দ্যসুন্দর বস্তু আছে, তার কিছু মানুষের হাতে তৈরি, কিছু প্রকৃতির দান। শত শত বছর ধরে দেখে দেখে, বহু কোটি মানুষের অন্তহীন স্তব শুনে শুনে তাদের পুনর্বিচার করা আমরা প্রয়োজন মনে করি না। অতিবোদ্ধারা মাঝে মাঝে এই সব রম্য বস্তুর দিকে ক্ষণিক দৃকপাত করে বলেন ক্লিশে বা কিৎস। তাজমহল-পিরামিড—’কিৎস’, অভিভূত হওয়ার মতো কিছু না। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলি বা দেবতাত্মা হিমালয়ের মহীয়ান রূপ ‘ক্লিশে’। পাঁচশ হাজার বছর শুনে শুনে সবাই সকলের সুরে সুর মেলায়, বলে “আহা কী অপুর্ব!” এ ধরনের আঁতলামিতে সামিল হতে আমি নারাজ। বহু শত বছর ধরে যা মানুষের অঞ্জলি পেয়ে আসছে তা প্রায় সব ক্ষেত্রেই, সত্যিই রমণীয় বলে আমার বিশ্বাস। ব্যতিক্রম যদি থাকে তা আমার নজরে পড়েনি। সুইৎজারল্যান্ড থেকে আল্পসের ভিতর দিয়ে ইতালি প্রবেশ করার সময় আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম, কারও কথা শুনে নয়, প্রকৃতির এমন গরিমা এত কাছ থেকে দেখার এর আগে কখনও সৌভাগ্য হয়নি বলে। শুধু সিমপ্লন পাসের লম্বা লম্বা টানেল মাঝে মাঝেই রসভঙ্গ করছিল।
ইউরোপের মধ্যে দেখবার জন্য যদি একটি কোনও দেশ বেছে নিতে হয়, তো সে দেশ নিঃসন্দেহে ইতালি। এখানে ইউরোপীয় সভ্যতা আর কৃষ্টির সব কিছুই আছে। রোমানদের আবির্ভাবের অনেক আগে এর দক্ষিণ অঞ্চলে গ্রিকরা এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। উত্তরে এটুসকানদের রহস্যময় সভ্যতা, সেও রোমের অভ্যুত্থানের আগে। রোমের সাম্রাজ্য, পরে খ্রিস্টধর্মকে ভিত্তি করে মধ্যযুগের সভ্যতা, তার চেয়েও স্মরণীয় ইউরোপের রেনেসাঁস, এমনকী অত্যাধুনিক যুগের সিনেমা থেকে শুরু করে পোশাক-আশাকের ফ্যাশন-ইতালিতে সবই পাওয়া যাবে। আর রন্ধনশিল্প? এত সামান্য জিনিস দিয়ে যে এত অপূর্ব স্বাদ সৃষ্টি করা যায় এক বাঙালি আর ইতালিয়ানরা ছাড়া এই আশ্চর্য আবিষ্কার আর কেউ করতে পারেনি। আমাদের ভাতের মতো ওদেরও খাদ্যের প্রথম ভিত স্টার্চ—ময়দায় তৈরি পাস্তা আর চালেরই নানা রকমফের করে রিসোভা। সামান্য পয়সায় রাস্তার পাশের ত্রান্তোরিয়া পিৎসেরিয়ায় খেয়ে যে তৃপ্তি পেয়েছি তা লিখে বোঝান কঠিন। আহারের ব্যাপারে মূল্যহীনেরে সোনা করিবার পরশ পাথর ফরাসিদের হাতেও আছে, কিন্তু ওদের নজরটা আসলে একটু উঁচুর দিকে। ওয়াইন, ক্রিম, ট্রাফল, কাভিয়ার ইত্যাদি মহার্ঘ সব উপাদান, দামি মাংসের কাট—এ সব ছাড়া তেনাদের মন ভরে না। একটুকরো রুটি, একটু অলিভের তেল, আধখানা বিলিতি বেগুন আর এক মুঠো তুলসীর পাতা দিয়ে যে অমৃত সৃষ্টি করা যায়-এ হুনুরি ফরাসিদেরও নেই। ইতালির সর্বত্রই সভ্যতার স্মরণীয় সব সৃষ্টি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। সেই বিপুল ঐশ্বর্য অল্প কয়েক দিনে কিছুই দেখা হয় না। তিন সপ্তাহের মতো সৌন্দর্যের সেই বাঁশবনে আমি বাংলা প্রবাদবাক্যের দৃষ্টিহীন ডোমের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। মনে হয়েছিল—নেশার ঘোরে ঘুরছি। এত রূপ, এত রূপ—এর কি শেষ নেই?
ইতালি ভ্রমণকারীদের জন্য গাইড বুক লেখার উৎসাহ বা ক্ষমতা আমার নেই। বর্তমান রচনাটি নেহাতই একটা ব্যক্তিগত বিবৃতি। তাই অল্প ক’টি জিনিস, যা এখনও চোখ বন্ধ করলে মানসচোখে ভেসে ওঠে তার কথাই বলব। ইতালিতে সৌন্দর্যে আসাধারণ শহরের ছড়াছড়ি। যে-শহরটিকে কিছুতেই ভুলতে পারি না, সে হল ভেনিস। খালের পাড় ধরে মানুষের আবাসন তো আগেও দেখেছি। সুন্দর শহর হিসাবে ডেলফটের খ্যাতি কম নয়। কিন্তু ভেনিসের সঙ্গে তুলনীয় শহর পৃথিবীতে আর নেই বলেই আমার বিশ্বাস। আমস্টার্ডাম ধনী বুর্জোয়ার আবাসস্থল। ভেনিসে সেই বুর্জোয়া শ্রেণি মধ্যবিত্ততার সীমানা ছাড়িয়ে আভিজাত্য অর্জন করেছিল। ওই জীর্ণ প্রাসাদের সমারোহ আর কি কোথাও আছে? তারা যেন কালের আক্রমণ উপেক্ষা করে ঐশ্বর্য, সুরুচি আর আভিজাত্যের গর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সান মার্কোর পিয়াৎসা? দোজের প্রাসাদ আর সন্ত মার্কের নামে তৈরি বাইজেন্টাইন শৈলীর ক্যাথিড্রাল ঐশ্বর্য আর শিল্পদক্ষতার চরম নিদর্শন হয়ে বেঁচে আছে। মধ্যযুগের শেষ ভাগে ভেনিসের বন্দরে পূর্ব দেশের মহামূল্য বাণিজ্য সামগ্রী এসে জমা হত। রাষ্ট্রপ্রধান দোজে প্রতি বছর সমুদ্রে সোনার আংটি ফেলে দিয়ে ভেনিসের সঙ্গে সমুদ্রের বিবাহবন্ধন দৃঢ়তর করতেন। আর খালের উপরকার ছোট ঘোট পুলগুলি? তারাও সামান্য কারুকার্যে মনোরম। শুধু ভেনিসের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিল্পী টিশিয়ানের ছবি দেখে খুব আনন্দ পাইনি। বড় বিরাট, ছবির চরিত্রগুলি বড় বেশি পেশীবহুল। তবে এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, একথার শিল্পবিচার হিসাবে কোনও দাম নেই।
ভেনিস থেকে ট্রেনে ফ্লোরেন্স। ট্রেন লেক গাদার পাশ দিয়ে যায়। লোকে বলে এই অঞ্চলটা সুইৎজারল্যান্ডের মতো। আমার তা মনে হয়নি। এক কারণ এখানে সোজাসুজি উঁচু পাহাড় চোখে পড়ে না। প্রকৃতি যেন এখানে কিছুটা মৃদুভাষী। “অয়ম অহম ভো” বলে মানব সন্তানকে ধমক দিচ্ছে না।
যদি বলা হয় ইতালির সাংস্কৃতিক রাজধানী নোম নয়, ফ্লোরেন্স—তা হলে সম্ভবত ভুল হয় না। প্রাসাদে, গির্জায়, পিয়াসায়, ছবিতে, মূর্তিতে—মানুষের সৃষ্ট অন্তহীন সৌন্দর্যে রমণীয় এই শহর। স্মৃতির ভাণ্ডারে তার অল্প কিছুই অবিনশ্বর হয়ে আছে। নিখুঁত যৌবনের ছবি মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিড, ওঁরই অন্য সৃষ্টি দিন আর রাত্রির প্রতিমূর্তি, উফিৎসি সংগ্রহালয়ে বত্তিচেলির প্রিমাভেরা আর আর্নোর উপরে সেই বিখ্যাত ব্রিজ। যদি কেউ বলেন—এ আর তুমি নতুন কথা কী বললে? এ তো সবারই ভাল লাগে! তা হলে আমার উত্তর, “ঠিকই বলছেন। আমি সাধারণ মানুষ। যুগান্তকারী আবিষ্কার আমার সাধ্যের বাইরে। মানুষ আর প্রকৃতির সৃষ্ট কিছু বস্তু অপূর্ব সুন্দর। একথা শৈশব থেকে শুনে আসছি। তার কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম। শুধু আমার সেই সৌভাগ্যের কথা পাঠককে জানাচ্ছি”। কিছু জিনিস আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর সকারণ খ্যাতি সত্বেও মানুষের অনেক কীর্তি মনকে নাড়া দেয়নি। সেই সব স্মৃতিরই কিছু কিছু এখানে লিখলাম। ভাল-মন্দ বিচার পাঠকের হাতে।
উত্তর ইতালির ছোট ছোট শহরগুলির পথে পথে অনেক ঘুরলাম—পিসা, ভেরোনা, সিয়েনা। এরা সবই এখন ট্যুরিজম বলয়ের অন্তর্গত। তার ফল কী হয়েছে বলি। কয়েক বছর আগে একবার ফ্লোরেন্স গিয়েছিলাম। উফিৎসি গ্যালারি দেখতে গিয়েছি। দেখি লম্বা কিউ। অন্তত এক মাইল হবে। ঘণ্টাখানেক কিউতে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে চলে এলাম। এই সব উৎসাহের নিদর্শন কি সত্যি সংস্কৃতি-তৃষ্ণার প্রকাশ, না নিতান্তই গণহুজুগের ফল? এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। হয়তো শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে এই উৎসাহের সত্যিতেই কিছু সম্পর্ক আছে। আশাবাদী মানুষ হিসাবে সে কথা ভাবতেই আমার ভাল লাগে।
ইতালিতে সামান্য দামে যত্রতত্র ঘোরার একটি ট্রেন টিকিট পেয়েছিলাম। যেখানে ইচ্ছে হত নেমে পড়তাম। তারপর আবার রেলগাড়ি চড়ে চরৈবেতি চরৈবেতি। এইভাবে একদিন রোম পৌঁছলাম। বিরাট শহর, দ্রষ্টব্যর পরিমাণ বড় বেশি। ভ্যাটিকানের সংগ্রহালয়ে যেন শ্বাসরোধ হয়ে এল। বিখ্যাত সিসটিন চ্যাপেল দেখলাম। কিন্তু ততক্ষণে এত ক্লান্ত যে মাইকেল এঞ্জেলোর অসাধারণ কীর্তি চেতনায় কোনও দাগ রাখল না।
চরৈবেতি চরৈবেতি। ভূস্বর্গ যে নিছক কল্পনা নয়, নেপলস উপসাগরের তীরে সোরেনটো শহরে এসে সেই সত্য আবার উপলব্ধি হল। সমুদ্রের ওই নীল রঙের তুলনা আর কোথাও দেখিনি। মনে হয়, ওই জলে হাত দিলে হাতের রঙ নীল হয়ে যাবে। শুধু কি নীল? দিনের আলোর রঙ যত বদলাতে থাকে জলের রঙও তার সঙ্গে তাল রেখে বদলায়। কোথাও সবুজ, কখনও আসমানি রং, কখনও প্রায় গাঢ় বেগুনি। সোরেনটো থেকে বাসে চেপে সমুদ্রের পাড় ধরে আমালফি, পোসিটানো। পৃথিবীটা সত্যি এত সুন্দর? ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কেন জগৎস্ৰষ্টা কল্পনা করেন, কিছুটা যেন বুঝতে পারলাম। ইতালির চলতি প্রবাদ, “ভেদি নাপোলি এ পোই মোরি।” নেপলস দেখে তবেই মৃত্যুকে বরণ করো। অর্থাৎ নেপলস না দেখে মৃত্যু যেন না হয়। সে বক্তব্যর লক্ষ্য শুধু নেপলস শহর না, এই বহুবিস্তৃত অনিন্দ্যসুন্দর বেলাভূমি। আমালফির লোকেরা বলে—স্বর্গে গিয়ে খুব কিছু তফাৎ বুঝবে না। দেখবে এখানকারই মতন। যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে তা কি সত্যিই আমালফির সঙ্গে তুলনীয় হবে? সেই আমালফি সম্প্রতি আবার গিয়েছিলাম। হোটেলে আর ধনীভবনে সেই অপূর্ব সুন্দর সমুদ্রতীর প্রায় চাপা পড়েছে। কালো পন্টি কোন বাড়িটা সোফিয়া লোরেনকে যৌতুক দিয়েছিলেন, কোন বাড়িতে রজার মুর বাস করেন-ট্যুরিস্ট গাইড সে সব আঙুল দিয়ে দেখালেন। কিন্তু যে-আমালফি থেকে নন্দনভূমিতে গিয়ে কোনও তফাত চোখে পড়ত না, সেই আমালফি আর খুঁজে পেলাম না। তবু সমুদ্র সমুদ্রই আছে। এক সন্ধ্যায় দিগন্তে যে রঙের খেলা দেখলাম তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই। গভীর নীল আর গাঢ় গোলাপি মিলিয়ে দিবধুরা রং খেলছেন। সে খেলায় আকাশ আর সমুদ্র দুজনেই যোগ দিয়েছে। কোথায় আকাশ শেষ হয়ে সমুদ্র শুরু হয়েছে, তা আর বোঝার উপায় নেই। জীবন সার্থক হল। হে অদৃষ্টপুরুষ, আমার নেপলস দেখা হয়েছে। এখন যদি তুমি আমার প্রাণহরণ করো, আমার কোনও ক্ষোভ নেই।
নেপলস থেকে আবার ট্রেন ধরে ব্রিন্দিসি। সেখানে এথেন্স তথা ক্রিটের জাহাজ ধরলাম। এ জাহাজের একটু বৈশিষ্ট্য ছিল। এথেন্স পর্যন্ত এটি শখের যাত্রীদের জাহাজ। তার মধ্যে ট্যুরিস্ট ছিল, স্থানীয় মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত লোকও ছিল। টিকিটের দামের মধ্যে আহার্যের দামও ধরা। ডাইনিং রুমে তিনবেলা চর্বচূষ্য খাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু এথেন্সের পর এ জাহাজ আর টুরিস্ট জাহাজ থাকে না। লোকাল ট্রেনের মতো লোকাল জাহাজে পরিণত হয়। পথে ছোট-বড় নানা দ্বীপে থামতে থামতে টিমে তেতালা চালে এগোতে থাকে। দেখলাম ব্রিন্দিসি থেকে যে সব যাত্রীরা উঠেছিল, এক আমি ছাড়া আর সবাই এথেন্সে নেমে পড়ল। ওখান থেকে যারা উঠল, তারা সব জৈারবা দা গ্রিক নামক ছবির চরিত্র। পোশাক-আশাক বেশ ধূলিধূসর, দাড়ি বোধ হয় মাসে এক দিন কামায়, অনেকেরই সঙ্গে ছাগল-মুর্গি আর সবাই। আহার্য সঙ্গে করে এনেছে। বোঁচকা খুলে যথা সময়ে মোটামোটা রুটি আর কিছু শুকনো শুকনো মাংস বের করে গলাধঃকরণ করে। শুধু একজন যাত্রীর জন্য ডাইনিং রুম খোলা রাখার কোনও মানে হয় না। তাই কর্তৃপক্ষ বললেন আমার আপত্তি না থাকলে যেখানে সিট পেয়েছি খাবারটা সেখানেই এনে দেবেন। এতে আর আপত্তির কী থাকতে পারে?
গোলমালটা কোথায় একটু দেরিতে বুঝলাম। ওয়েটার লাঞ্চের সময় যথারীতি তিন পদ খাবার নিয়ে এল। অবশ্যই এক সঙ্গে না, যথাক্রমে। মুর্গি-ছাগলের মালিক সহযাত্রীরা বেশ দ্বিধাবর্জিত কৌতূহল নিয়েই ব্যাপারটা দেখতে লাগল। প্রথম পদ, দ্বিতীয় পদ পর্যন্ত এক রকম চলছিল। কিন্তু ওয়েটার তৃতীয় পদ নিয়ে ঢুকতেই যৌথ অট্টহাস্য। সে হাসি আর থামে না। একটা মানুষ পর পর তিন পদ খায়। এবং সে খাবার একাদিক্রমে ওয়েটার নিয়ে আসে, এইসব গ্রামবাসী মানুষ বোধ হয় এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি। লজ্জায় সত্যিই কুঁকড়ে গেলাম। ভাবলাম—পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে আমরা যারা শতকরা সত্তর-আশি জনের তুলনায় সৌভাগ্যবান, তাদের জীবনযাত্রা যে কত হাস্যকর, এ কথা আমাদের খেয়াল থাকে না। মনে মনে আমি আমার সহযাত্রীদের ধন্যবাদ জানালাম।
ক্রিটও এখন ট্যুরিস্টদের বিলাসভূমি হয়েছে। ১৯৫৭ সালে দ্বীপটির অন্য চেহারা যায়নি। মানে এখনকার মতো ওখানে গিয়ে ভিলা ভাড়া করে থাকবার সুব্যবস্থা তখন ছিল বলে জানি। আমি যে চব্বিশ ঘণ্টা ওখানে ছিলাম, জাহাজেই থাকতে হয়েছিল। তার একটা কারণ অবশ্যি অর্থাভাব। আমার ক্রিট যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই। সস-এ মিনোয়ান যুগের প্রত্নকীর্তি দেখা। মিনোয়ান কথাটা অবশ্য একেবারেই রূপকথা থেকে নেওয়া। তার কোনওই ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। গ্রিক উপকথায় এক কাহিনি আছে যে, মিনস নামে কোনও রাজা এক প্রাসাদ বানিয়েছিলেন যা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। সেই সুবাদে তার নাম ল্যাবিরিন্থ। আর সেই ল্যাবিরিন্থের অন্তস্থলে মিনোটর নামে এক প্রাণীর বাস। তার দেহটি ষাড়ের, কিন্তু উর্ধ্বাঙ্গ মানুষের। এই দানবকে রোজ খাদ্য জোগাতে হত—একটি তরুণ বা তরুণী। গ্রিক বীর থিসিউস রাজকন্যা মিডিয়ার সাহায্যে ল্যাবিরিন্থের ভিতরে ঢুকে মিনোটরকে সংহার করেন। ইংরাজ প্রত্নতাত্ত্বিক এভানস সসে খনন করে এক বিশাল প্রাসাদ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ অসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, প্রাসাদটির মালিক ছিলেন রাজা মিনস আর এই সেই উপকথার ল্যাবিরিন্থ। তাতেও তত ক্ষতি ছিল না। কিন্তু খোদার উপর খোদকারি করে খননের ফলে যে সব বাড়িঘর পাওয়া গিয়েছিল, তার কিছু কিছু সংস্কার করে মিনসের প্রাসাদ তিনি কিছুটা পুনর্নির্মাণ করেন। মিনোটরকে যে এভানস সাহেব পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করেননি, এ জন্য সকলে তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার সত্যিকার কীর্তি সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরানো ওই প্রাসাদ পুনরাবিষ্কার। সমস্ত ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এর তুলনীয় কিছু নেই। ক্রিটের এই প্রাচীন সভ্যতা এখনও রহস্যে ঢাকা। সেটা গ্রিস অঞ্চলের সভ্যতার পুর্বাভিযানের স্মারক, না মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতার পশ্চিমি প্রত্যন্তদেশ সে সমস্যার আজও সমাধান হয়নি। প্রত্নবস্তু যা পাওয়া গেছে তা থেকে প্রমাণ হয় যে, ক্রিটের সভ্যতা স্বকীয়তায় বিশিষ্ট। তার সঙ্গে হুবহু মেলে এমন অন্য কোনও সভ্যতা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সসের প্রাসাদ ক্রিটে পাওয়া প্রাসাদগুলির মধ্যে বৃহত্তম। ওটি দেখতেই আমার বোঁচকা কাঁধে ক্রিট অভিযান।
এভানস সাহেবের সংস্কারকার্য আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকের চোখে বর্বরতারই রকমফের। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ দর্শক তার জন্য কিছুটা কৃতজ্ঞ না হয়ে পারে না। অনেক হিসাব করে দেওয়ালে আঁকা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে ইনি প্রাসাদের কিছুটা পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এ রকম করা চলে না ঠিকই কিন্তু প্রাসাদের যে চেহারা উনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেটা ভ্রমাত্মক না। সেই বহুতল প্রাসাদ, অতি প্রশস্ত সিঁড়ি, দেওয়ালে আগাগোড়া নিপুণ হাতে আঁকা ছবি আর রঙের প্রলেপ, তার গায়ে সূক্ষ্ম কাজ করা সব সভ্যতার নানা উপাদান, অলিগলি চলিরাম করে ঘরের পর ঘর নিয়ে ল্যাবেরিন্থ—দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার জীবনযাত্রার চিহ্ন এখানে ধরা রয়েছে। মিশরের বাইরে এত প্রাচীন জীবনযাত্রার এত বিশদ স্মারক আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। আর মিশরেও সব কিছুই দেবতা বা মৃত মানুষের জন্য তৈরি। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রয়োজনে তৈরি কোনও প্রাসাদ দাঁড়িয়ে নেই। ফারাওরা মাটির বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু এই আশ্চর্য সভ্যতার স্রষ্টা কারা? তিনটি বিভিন্ন ধরণের ‘বর্ণমালা’ ক্রিটের সিলে আঁকা আছে। তার একটিরই (লিনিয়ার বি) শুধু পাঠোদ্ধার হয়েছে। তার ভাষা গ্রিক। তা থেকে প্রমাণ হয় না যে, মিনোয়ান সভ্যঅ গ্রিক সভ্যতারই অন্যতম আদি পুরুষ। আর এভানস সাহেব যে রানির ঘর, রাজার দরবারখানা ইত্যাদি বলে এক একটা ঘরকে নির্দিষ্ট করেছেন, তার কোনও ভিত্তিই নেই। ওখানে রাজতন্ত্র ছিল, না। পুরোহিততন্ত্র তাও জানা যায় না। দেখে দেখে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী মানুষ নাচে-গানে-খেলায়-রূপসজ্জায় সুখাদ্যে নানা ভাবে জীবনকে উপভোগ করতে জানে। তাদের এই রহস্যময় দ্বীপবাসী পিতৃপুরুষরাও জীবনরসের রসিক ছিলেন। এই ইতিবাচক বিবরণে শুধু একটা নেতিবাচক পাদটীকা দেওয়া দরকার। মিনোয়ানরা নরবলি দিতেন, তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ইউরোপীয় সভ্যতার জনক গ্রিকদের উপকথায় তো দেবতাদের তুষ্টির জন্য সন্তান বলিদানের উল্লেখ পাই। ওরিস্টিয়ান ট্রাজেডির সূচনা এগামেমননের কন্যাবলি দানে। সভ্যতা আর বর্বরতার মাঝখানকার সীমারেখা অনেক সময়ই অস্পষ্ট। গ্যয়টে-বাখের দেশেই নাৎসিবাদের জন্ম। মহাত্মা গাঁধী আর নরাধম মোদী একই সংস্কৃতির আওতায় মানুষ। সভ্যতা নিয়ে বেশি বড়াই না করাই ভাল। কোথায় কখন আমাদের রক্তকণায় হিংস্র শাপদ পিতৃপুরুষের জিন সজীব হয়ে উঠবে তার হিসাব তো কেউ রাখেনি।
ক্লসস দেখে জাহাজে ফিরে এলাম। শুনলাম ওই জাহাজে তখন একমাত্র যাত্রী আমি। এ বেশ নতুন অভিজ্ঞতা। পরদিন সকালে আবার যাত্রী নিয়ে অন্যান্য দ্বীপ আর এথেন্সের পথে জাহাজ রওনা হবে। মাঝরাতে প্রচণ্ড আলোড়ন আর তার চেয়েও প্রচণ্ড বিবমিষা নিয়ে ঘুম ভাঙল। বুঝলাম সমুদ্রে ঝড় উঠেছে। স্কুলপাঠ্য বাংলা সিলেকশনে ‘শ্রীকান্ত’ থেকে তোলা সমুদ্রে ঝড়ের বর্ণনা পড়েছিলাম। যে বয়সে বিমল কুমার-রামহরির সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার উচ্চাভিলাষ ছিল, সে বয়সেই সমুদ্রে ঝড় দেখারও ইচ্ছে হয়েছিল। আহা! এতদিনে সেই সাধ মিটল। মানে নভোতলবাসী কোনও বজ্জাত দেবতা ক্রুর হাসি হেসে (মনে রাখবেন ওইসব লোকের হাসি সব সময়েই কুর) বেশ ভাল করেই শখ মেটালেন। জাহাজ খোলা সমুদ্রে থাকলে হয়তো এতটা কষ্ট হত না। কিন্তু নোঙর ফেলা থাকায় সত্যিই মোচার খোলার মতো সামনে-পেছনে, ডাইনে বাঁয়ে অবিশ্বাস্য বেগে দুলতে লাগল। সে দুলুনির কোনও বর্ণনা সম্ভব না। মনে হল শুধু অন্নপ্রাশনের না, বেশ কয়েক পূর্বজন্মে যা কিছু খেয়েছি তা যেন স্মৃতির অতল থেকে উঠে এল। যখন পেটে কণামাত্র খাদ্যও অবশিষ্ট নেই, তখন পিত্ত এবং মনুষ্যশরীরে আর যা কিছু থাকে সবই যেন কণ্ঠনালী বেয়ে উঠতে লাগল। জীবনে নানারকম যন্ত্রণাদায়ক অসুখে ভুগেছি। কিন্তু ওই রাত্রির তুলনীয় শারীরিক যন্ত্রণা কখনও ভোগ করিনি। মাঝে এক সারেং এসে দেখে গেল—জাহাজের একমাত্র যাত্রীটি জীবিত, না মৃত। মৃত হলে তাকে জলে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “জাহাজ কি ডুবছে?” উত্তর, “তা নোঙর ফেলা থাকলে ডোবার সম্ভাবনা আছে। আর কিছুক্ষণ দেখে কাপ্তান সাহেব নোঙর তুলে মাঝসমুদ্রে পাড়ি দেবেন।” বড় নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। এই প্রলয়ঙ্কর তুফানে মাঝসমুদ্র ছাড়া মানুষের আর আশ্রয়স্থল কোথায়? যন্ত্রণা তখন এমন স্তরে পৌঁছেছে যে মরিয়া হয়ে ইসলামি মৃত্যুদূত মালেক-উমওতকে স্মরণ করলাম। বললাম, “বাবা আর জ্বালিও না। যেখানে নেবার এবার নিয়ে যাও। বেঁচে থাকতে নরক যন্ত্রণা সওয়াবে, এ আবার কোন আত্মদ?” আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এ যাত্রা যদি বাঁচি, আর কখনও কোনও জাহাজের ধারে কাছে যাব না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সমুদ্র শান্ত হল। শরীরের সব যন্ত্রণা যেন এক মুহূর্তে চলে গেল। হাসি মুখে ডেকে উঠে এসে কাপ্তান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “জাহাজ কখন ছাড়ছেন?” মনে ভাবলাম, আমি সত্যিই মিসেস দাস বর্ণিত সেই নির্লজ্জ বেহায়া।
ছোটবেলায় শোনা এক বরিশালি পঞ্চতন্ত্রের কাহিনি মনে পড়ল। এক কাক গাব খেয়ে গাবের আঁঠায় বদ্ধচক্ষু। মনে মনে বলছে, হে ঈশ্বর, এ যাত্রা রেহাই দাও। নাকে খত দিচ্ছি, এ যাত্রা রেহাই পেলে আর গাব খাব না, আর ওমুখী হব না। ঈশ্বর কৃপায় ঠোঁট খুলে গেল। তখন কাকের সনৃত্য সংগীত, “গাব খামু না খামু কী? গাবের তুল্য আছে কী?” এই কাহিনি ইতিহাস দর্শনের গোড়ার কথা। হেগেল লিখেছিলেন, “ইতিহাসের একমাত্র শিক্ষা একাই। সে শিক্ষা এই : মানুষ তার অতীত থেকে কোনও শিক্ষাই লাভ করে না।”
.
দেড় দিন পর এথেন্স পৌঁছলাম। এই স্থলযাত্রা কাহিনির বাঁধা দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে একটি অবশ্যকর্তব্য উল্লেখ করা হয়নি। আমার যাবতীয় টিকিট ইত্যাদি কেনা হয়েছে টমাস কুকের মারফত। সুতরাং আইনত ‘ঠাস কুক’ এখন আমার গার্জিয়ান হ্যায়। সেই গার্জিয়ানের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে কোনও চিঠিপত্র এলে তা তারা পোস্ট রেস্তাঁতে রেখে দেবে। সুতরাং দিনের মধ্যে কখনও সুবিধেমতো গিয়ে চিঠিপত্রের খোঁজ করে আসতে হত। এর মধ্যে দেশের খবর টুকরো-টাকরা “আমরা ভাল আছি, তুমি কেমন আছ জানিও” গোছের চিঠিতে পেয়েছি। মাবাবার চিঠিতে বুঝতে পারি তাঁরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। এখানেও সেই জীবনের চিরন্তন ট্র্যাজেডি। শাস্ত্রে বলে, স্নেহ নিম্নগামী। ওঁদের চিঠিতে যে ব্যগ্র উদ্বিগ্ন অপেক্ষার প্রকাশ, সাড়ে তিন বছর পর দেশে ফিরছি বলে আমি তো তার তুলনীয় কোনও উত্তেজনা অনুভব করছি না! পরিণত বয়সে নিজে যখন পিতৃত্বের আনন্দ এবং উদ্বেগে আকুল হয়েছি, তখন আমারও তো অনুরূপ অভিজ্ঞতাই হয়েছে। আবেগের বিনিময়ে প্রকৃতি কোনও ভারসাম্যর ব্যবস্থা রাখেনি। শুধু নরনারীর প্রেম সম্ভবত তার একমাত্র ব্যতিক্রম। তাও বোধহয় অল্প দিনের জন্য।
যখন দেশ ছেড়ে আসি তখন আমার চেয়ে বয়সে আঠারো বছরের ছোট ভাই অপু আকুল কান্না কাঁদছিল। সে দিন রাত্রে তাকে কিছুতেই কিছু খাওয়ানো যায়নি। এখন সে তেরো বছরের টিন এজার। নানা জিনিসের ফর্দ পাঠিয়েছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাইঝি বুবুর বয়স তখন ছিল কয়েক মাস। এখন সে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে। চিঠিতে খবর পাই সে বেশ গিন্নিবান্নি হয়েছে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছিল আমার বন্ধু শৈলেন সেনের সঙ্গে। আমি চলে আসার পর তার বড় মেয়ের জন্ম হয়েছে। তারও বয়স এখন প্রায় তিন। সাড়ে তিন বছর বিদেশবাস মানে দেশের চলমান জীবন থেকে কিছুটা দূরে সরে যাওয়া। ফিরে গিয়ে সেই পুরনো পরিবেশ কেমন লাগবে জানি না।
এথেন্স পৌঁছে মনে হল, সেই পরিবেশের বেশ কাছে এসে গিয়েছি। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে যাই হোক, আমার চোখে ১৯৫৭ সালের এথেন্স তৃতীয় জগতের অংশ বলেই মনে হয়েছিল। মুদির দোকানের সামনের রাস্তায় পেঁয়াজ আর আলুর ছালা দেখে সেই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল। শহরের কিছু উপরে পাহাড়ের গায়ে পার্থেনন আর আক্রোপোলিস দাঁড়িয়ে আছে। ভাঙাচোরা হলেও শিল্পরুচির চরম বিকাশে মহিমান্বিত। কিন্তু সক্রেটিসও কি পেঁয়াজের বস্তার পাশ কাটিয়ে আগোরায় গিয়ে জ্ঞানবিতরণ করতেন? ওঁর সময়ে কি রাস্তায় ধুলোবালি কিছু কম ছিল? প্রাচীন জগতের যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, এখনকার তুলনায় শহরের রাস্তাঘাট অনেক পরিষ্কার ছিল। গ্রিস হোক বা ভারত হোক–প্রায় সব দেশ সম্বন্ধেই বোধ হয় একথা সত্যি। তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল। হেরোডোটাস অবজ্ঞার সঙ্গে লিখেছেন, মিশরের লোকেরা সত্যিই বর্বর। প্রকৃতির সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য তাদের বসতবাড়ির ভিতরেই একটা ঘর আছে। ছ্যা ছ্যা ছ্যা। কী করবে? বর্বর জাতি বলে কথা। সভ্য গ্রিকদের মতো কাজটা রাজপথের পাশে সেরে নিতে জানে না।
এথেন্স থেকে ইস্তাম্বুলের ট্রেনে উঠলাম। তখন দক্ষিণ সাইপ্রাস কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নিয়ে গ্রিস এবং তুরস্কর মধ্যে জবর গোলমাল চলছে। এর আগে সাইপ্রাস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বের হয়ে গিয়ে গ্রিসের অন্তর্গত হতে চাওয়ায় সাহেবরা বিশেষ ব্যাজার হয়েছিলেন। এমন কথাও কেউ কখনও শুনেছে? ইংরেজ রাজত্বে কী সুখে আছিস তা তোদের কোনও ধারণা নেই। সত্যি বলতে কি যারা এই সুখে ছিল, তারা কেউই নিজেদের সুখটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সাইপ্রাসে কিছু ছেলে-ছোঁকরা ব্যাপারটা এতই কম বুঝেছিল যে তারা বোমাবাজি শুরু করে দেয়। অগত্যা তাদের কটাকে পটাপট গুলি করে মারতে হয়, কিছু লোককে ধরে জেলে ঢোকাতে হয়। ইংরেজরা স্বভাবত উদারপন্থী। এসব করতে কি তাদের ভাল লাগে? কী করবে? কঠোর কর্তব্যর খাতিরে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়। ইংরেজদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, যেখানে গেছে সেখানেই কিছু লোক মেরে ধরে জেলে পুরে লোকের উপকার করতে হয়েছে। যাকগে, সাইপ্রাসের সমস্যা যখন কিছুটা মিটে এসেছে তখন দক্ষিণ সাইপ্রাসের তুর্কি জাতীয় মানুষরা বললেন, আমরা কেরেশ্চানদের অধীনে থাকব না। আম্মো স্বাধীন হব। আবার বোমাবাজি রক্তারক্তি—সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। এ সব যখন চলছে, তখন একদিন আমি এথেন্স থেকে ইস্তাম্বুলের ট্রেনে উঠলাম।
ও ট্রেনে ওঠার লোক তখন বেশি নেই। কম্পার্টমেন্টটা প্রায় খালি দেখে মহানন্দে বেঞ্চিতে ঠ্যাং তুলে বসলাম। এমন রাজকীয় সুখ এই যাত্রা এর আগে হয়নি। কিন্তু অহো! পাঠিকা! পাঠক। জাগতিক সুখ সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী। গ্রিক, টিকিটবাবু একটু পরেই এসে রূঢ়ভাবে ইঙ্গিত করলেন, পা নামাও। তুমি কোন লাটের বাচ্চা হে! গাড়িতে অন্য নোক না থাকলে জুতো খুলে পা বেঞ্চিতে তুলে বসায় আন্তর্জাতিক আইনে কোনও নিষেধ আছে বলে আমার জানা ছিল না। কিন্তু রাস্তাঘাটে ঝামেলা করতে নেই। বিশেষ করে ভাষা না জানা থাকলে। তাই মানে মানে সুখশয্যা ছেড়ে খুদে নেপোলিয়নের আদেশমতো পা নামালাম। এরপর বুঝলাম, আসল গোলমালটা কোথায়। গ্রিক টিকিটবাবু ঘৃণায় নাসা কুঞ্চিত করে বললেন, ‘তুর্কেইয়া?’ আমি গ্রিক ভাষায় আমার জানা একটিমাত্র শব্দ সগর্বে নিক্ষেপ করলাম ‘ইন্দস’। সেই পুরনো কথাটা যা সেকেন্দর শা’রও আগে থেকে চলে আসছে, আর যার অপব্যাখ্যা করে সাম্প্রতিককালে কিছু বাঁদর আমাদের বড়ই জ্বালাচ্ছে। এই প্রাচীন শব্দটি উচ্চারণ করায় মন্ত্রের মতো কাজ হল। ইন্দস? ই-লস! আহা, ভাবের আবেগে টিকিটবাবু তখন বেপথুমান। মূকাভিনয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, “এত দিনে জানলেম যে কাঁদন কাঁদলেম সে কাহার জন্য।” তারপর আমাদের দুজনেরই সুবোধ্য একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষায় আলাপ শুরু করলেন। “রাজকাপুর, মধুবালা, অশোককুমার, সুচিত্রা সেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। আহা! সেই নাম-সংকীর্তন আর শেষ হয় না। মনেপ্রাণে আমাদের চিত্রতারকাদের ধন্যবাদ জানালাম। ওঁদের কৃপায় আমাদের মতো কত অজ্ঞাত-অপাত্র দেশওয়ালি লোক দুনিয়ার মানুষের আদর খেয়ে বেড়াচ্ছি। রাশিয়া থেকে তাহিতি, চিন থেকে দক্ষিণ আমেরিকা—সর্বত্রই ওঁদের পরিচয়েই আমাদের পরিচয়। ওঁরা কি হেলায়েন্দা করার মতো মানুষ! আমার এক পরিচিত বোম্বাইয়া (থুড়ি, মুম্বাইয়া হবে) চিত্রপরিচালকের ঘরে শুধু তিনটি ছবি ছিল—রাজেশ, গণেশ আর ধর্মেন্দ্র। মানে ওঁদের কৃপায়ই ওঁর যা কিছু সুখ সমৃদ্ধি। গণেশের ছবিটা অবশ্য এলেবেলে। দেবতাদের একেবারে কোল্ড দেওয়া ঠিক না, তাই রাখা। আমি সম্প্রতি ছোটবড় যাবতীয় চিত্রতারকাদের ছবির এক এক কপি করে অর্ডার দিয়েছি। তাড়কাদেরও বাদ দিইনি। কখন কী কাজে লেগে যায় কে বলতে পারে। দেখি, ওঁদের কৃপায় কপাল ফেরে কি না।
দিন দুই ট্রেনে সিটের উপর পা তুলে ঘুমিয়ে (টিকিটবাবু মাঝে মাঝেই এসে দেখে গ্যাছেন মধুবালার এই দেশবাসীর সুখ অব্যাহত আছে কি না) এক সকালে ইস্তাম্বুল পৌঁছলাম। নামে ইউরোপ হলে কী হবে ওটা আসলে প্রাচ্য দেশ। সেই জন্যই তো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানে ঢাকার ব্যাপারে বাকি ইউরোপিয়ানরা এত গোলমাল করছে। কবে তোরা মধ্য এশিয়া থেকে মারমার করে এসে আমাদের কিছু পবিত্রভূমি কেড়েকুড়ে নিলি—আর তাতেই তোরা ইউরোপিয়ান হয়ে গেলি? বললেই হল! আরে আমাদের গায়ে যে এশিয়ার বর্বর জাতিদের রক্ত, সে অনেক আগেকার কথা। ইউরোপের বর্বরদের রক্ত মিশে তা অনেকদিন আগেই শুদ্ধ হয়ে গেছে। ও সব কথা এখন তুলে কোনও সুবিধে হবে, ভেব না।
যাকগে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ঢিলেঢালা ধরনধারণ দেখে বড় আরাম পেলাম। আঃ! এ তো কলকাতা এসে গেছি মনে হচ্ছে। ইউথ হস্টেলে বোঁচকাটি রেখে বাজারের ভিতর এক চায়ের দোকানে গিয়ে জমিয়ে বসলাম। সে কী সুখ। কারও কোনও তাড়া নেই। গায়ের উপর দিয়ে তোক ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে। কারও কোনও তাপোত্তাপ নেই। আর সবাই গলা খুলে কথা বলছে। মানে মানুষের যেমন ভাবে বাঁচা উচিত, সেই ভাবে সবাই চলে বলে বেড়াচ্ছে। উহ, সাড়ে তিন বছর ইংরাজি সভ্যতার চাপে কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। ওই চাপাচাপা কথা, মৃদুমৃদু হাসি-কাঁহাতক সহ্য হয় মশাই! অনেকদিন পর হাত পা ছেড়ে বেশ গলা খাঁকারি দিয়ে চেয়ারে পা তুলে বাবু হয়ে বসলাম। কেউ ফিরেও তাকাল না। তামার থালায় করে ঘটির মতো চেহারার কাঁচের গ্লাসে দোকানির ছোঁকরা সাকরেদ চা নিয়ে আসছে। ভারতের বাইরে এত সুখের ব্যবস্থা কোথাও আছে তা কে জানত? চায়ে দুধ, চিনি দেওয়ায় এদের বিশ্বাস নেই। চায়ের রঙ রীতিমতো টকটকে লাল। মনে হল যেন অমৃত পান করছি।
ইউথ হস্টেলে ফিরে এক জোড়া খ্রিস্টীয় ধ্রুব-প্রহ্লাদের সঙ্গে পরিচয় হল। এই দুই সন্ত পুরুষ কেরালার সিরিয় খ্রিস্টান। পৃথিবী পরিভ্রমণ করছে, কিন্তু কোনও জাগতিক বাসনা এঁদের নেই। কেন বের হয়েছ? ‘টু ক্লাইম্ব দা হাইটস এন্ড প্লাহু দা ডেপথস অফ আওয়ার লর্ড, জিসাস ক্রাইস্ট।” ধ্রুব জানালেন। প্রহ্লাদ বললেন, “আলেলুইয়া।” তারপর ওঁরা আমার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েন। আমার খাটের দু-পাশেই ওঁদের খাট। রাত্রে ঘুম ভাঙলেই ওঁরা ঈশ্বরের মহিমা স্মরণ করেন এবং করে অভিভূত হন। কখনও প্রহ্লাদ বলেন, “দা গড হু মেড আস ইজ আ গ্রেশাস গড!” ধ্রুব উতোর দেন, “আলেলুইয়া!” আর যদি ধ্রুব চাপান দেন, “গ্লোরি বি টু গড অ্যান্ড হিজ ওনলি বিগটেন সান।” তো প্রহ্লাদের উতোর “আলেলুইয়া।” এইভাবে ঈশ্বরের মহিমা কীর্তনে রাতটা কেটে যায়। তাঁর কৃপায় ভক্তদের না ঘুমালে কোনও অসুবিধে হয় না। বুঝলাম, নাস্তিককে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই দুই ভক্তর তার দু’পাশে শোওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ঈশ্বরের মহিমায় আমারও একটু একটু ‘ফেত’ হতে শুরু করল। ভক্তযুগল আমারও অনুরক্ত ভক্ত হয়ে সারা দিনটাই সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। সুতরাং, আলেলুইয়া ধ্বনিতে আমার চেতনা আপ্লুত। তবে বাজারে দোনের কাবাব উওগোর্টলু কাবাব খেয়ে কষ্ট কিছুটা প্রশমিত হয়। এই সব জিনিস এখন ইউরোপের রাস্তাঘাটে বিক্রি হয়। কিন্তু দোনের কাবাবের মাহাত্ম্য বুঝতে হলে ইস্তাম্বুল যেতে হবে। প্রায় কোনও মশলা না দিয়ে মেষমাংস কী অপূর্ব সুখাদ্যে পরিণত করা যায় তুর্কিরা তা দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের মোগলাই কৃষ্টির অনেক কিছুই তুর্কি আর ইরানিদের কাছ থেকে নেওয়া। তবে ভারতীয়কৃষ্টির স্পর্শে তারা নব কলেবর ধারণ করেছে। মোগলাই খানা সম্পর্কে একথাটা বিশেষ করে সত্যি।
প্রাচ্য দেশে যে পৌঁছেছি তার নানা প্রমাণ পেলাম। ধ্রুব-প্রহ্লাদসহ একদিন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রলোকের হাতে ইংরিজি বই দেখে তাঁকে সুলতানদের প্রাচীন প্রাসাদ তোপকাপির পথ জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক একটুও দ্বিধা না করে বললেন, “সে হবে এখন। এখন চল, আমার সঙ্গে খাবে। আমার মা খুব ভাল রাঁধেন।” এ রকম ঘটনা ইংল্যান্ডে তো নয়ই, ইউরোপে কোথাও হওয়া সম্ভব বলে মনে করি না। আমাদের প্রাচ্য সভ্যতা জিন্দাবাদ। ভদ্রলোকের বাড়ি পৌঁছে দেখি যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। মানে ওঁর মা গজর গজর করতে লাগলেন। বুঝলাম অকৃতদার মানুষটির এ সব ব্যাপারে কাণ্ডজ্ঞান কম। কিন্তু উনি বললেন, “তোমরা যা ভাবছ তা না। মা চটেছেন, তোমরা এসেছ সে জন্য না। যথেষ্ট খাওয়ার ব্যবস্থা করিনি দেখে।” এরপর মা সোজাসুজি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। পুত্রর ভূমিকা শুধু অনুবাদকের। বক্তব্যটা খুবই সহজ। “আমার ছেলে একটি গর্দভ। লেখাপড়া শিখে ওর কোনওই উপকার হয়নি। অথচ আমার স্বামী একজন বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। লোককে খেতে বললে যে ভালমন্দ বাজার করতে হয় একথা কোনও দিনই বুঝল না। মানুষ ডেকে যা তা খাইয়ে বিদেয় করে। আসলে কিপটের জাশু। এমন বাপের এমন ছেলে কোত্থেকে যে হল!” খাওয়ার সময় ছেলের কার্পণ্যের প্রমাণ পেয়ে আমরা চমৎকৃত। অন্তত দু’পদ খেলাম। সত্যিই অনবদ্য রান্না। আর ভদ্রমহিলা আগাগোড়া ছেলের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করে গেলেন।
খাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাদের তোপকাপি পৌঁছে দিলেন। মণিমুক্তা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় এ অভিজ্ঞতা আমার এর আগে হয়নি। সত্যিই সেই আলিবাবার কাহিনির ডাকাতদের গুহার মতো থুপ থুপ করে হিরা-পান্না-চুনি সব রাখা। সুলতানরা দরবারে বসে হাতের কাছে কিছু দশাসই সাইজের চুনিপান্না রাখতেন। রাজকার্য করার সময় ক্লান্তি বোধ হলে ওগুলো হাতে নিয়ে মানসিক শান্তি পেতেন। পাবারই কথা। প্রাসাদটি আসলে সমুদ্রের উপরে। সুলতানদের হারেমে রমণীর সংখ্যা একটু বেশিই হত। মাঝে মাঝে সম্রাটের মুখ বদলাবার ইচ্ছে হলে পুরনো উপপত্নীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল বলে শোনা যায়। মানে রাজকীয় বাসনা মেটাতে রাজপ্রাসাদেও স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা হত। এই কাহিনি সম্পর্কে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু গাইড তোপকাপির মেঝেতে একটা বিশেষ জায়গা দেখিয়েছিলেন। মেঝের পাথর সরালেই নাকি নীচে সমুদ্র। আর বাতিল উপপত্নীদের শোনা যায় ওই পথেই সদগতি হত।
ইস্তাম্বুল শহর হিসাবে অদ্বিতীয়। এভাবে ইউরোপ আর এশিয়ার সন্নিবেশ আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য, তার পরেরকার বাইজেন্টাইন সভ্যতা, ওসমানলি তুর্কি রাজবংশের দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য, যা একসময় সমগ্র ইউরোপকে গ্রাস করতে গিয়েছিল, বিংশ শতাব্দীতে কামাল আতাতুর্কের তুর্কিদের পশ্চিমীকরণের প্রচেষ্টা সব কিছুই অপূর্ব সুন্দর শহরের গায়ে চিহ্ন রেখে গেছে। বিখ্যাত বাইজেন্টাইন গির্জা সান্তা সোফিয়া আয়া সোফিয়া নাম নিয়ে মসজিদে পরিণত হয়েছে পরে কামালের রাজত্বে মসজিদ থেকে জাদুঘর। তার জানালায় বিরাট অক্ষরে লেখা আল্লা মোহাম্মদ। শহরে স্ত্রী পুরুষ সবার অঙ্গেই পশ্চিমি পোশাক। কিন্তু ওখানে বারবারেই সেই ফিল্মি গানটি মনে পড়েছে–”মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, পাতলুন ইংলিশস্তানি। শরপে লাল টোপি রুশি। ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি”। আতাতুর্ক তুর্কিদের পোশাক বদলে দিয়েছেন, ইউরোপীয় ভাষা শিখিয়েছেন, কিন্তু ওদের প্রাচ্যদেশীয় দিলটি একই আছে।
প্রথমে ভেবেছিলাম ইরানের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানের পথে দেশে ফিরব। কিন্তু তখন তুর্কি-ইরান সীমান্তে কিছু গোলমাল চলছিল। তাই সে ইচ্ছে ত্যাগ করে বসরা থেকে জাহাজে ফেরা ঠিক করি। শুনলাম ধ্রুব-প্রহ্লাদও একই জাহাজে ফিরবেন। কিন্তু তাঁরা বাসে যাবেন বসরা অবধি। যিশুর উচ্চতা এবং গভীরতা মাপবার সুবিধে হবে বলেই নাকি ওঁরা ওই কষ্টকর পথ বেছে নিয়েছেন। এক বিরাট ট্রাঙ্ক টানতে টানতে ওঁরা একদিন বের হয়ে গেলেন। আর ওঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। আমার ধারণা, যিশু তাঁর ভক্তদ্বয়কে তুরস্ক সীমান্তে কোলে টেনে নিয়েছিলেন। ওখানে তখন রীতিমতো গোলাগুলি চলছিল।
তুরস্কবাসীরা যে প্রাচ্যের লোক, তার আর এক প্রমাণ পেলাম যেদিন তুরস্ক ছাড়ছি সেই দিন। ফেরি জাহাজে বসফরাস পার হয়ে ও পাড়ের হায়দারপাশা স্টেশন থেকে টরাস এক্সপ্রেস ধরব। সেই ট্রেন আমাকে ইস্তাম্বুল থেকে সোজা বাগদাদ নিয়ে যাবে। কিন্তু সব জায়গায়ই ভাষাসমস্যা। জাহাজের টিকিট কিনতে ঠিক জানালায় দাঁড়িয়েছি কি না বোঝবার উপায় নেই। আবারও চোখে পড়ল এক যুবকের হাতে ইংরিজি বই। সে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক জানালায় এসেছি তো, হায়দারপাশার টিকিট কাটার জন্য? সে বলল, “হ্যাঁ, কোথায় যাবে?” বললাম টরাস এক্সপ্রেস ধরব। দু মিনিট পর সে হায়দারপাশার টিকিট এনে আমাকে দিল। দাম দিতে গেছি। “আরে না না! ছি ছি!” অগত্যা অপরিচিতের সেই দান গ্রহণ করতে হল। জাহাজে সে এসে আমার কাছে বসল। বসফরাস পার হতে যতদূর মনে পড়ে ঘণ্টাখানেকের মতো লাগে! তার মধ্যে ছেলেটির সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনি শোনা হয়ে গেল। তার কেন্দ্রীয় সমস্যা এক প্রেমের কাহিনি। ও বয়সে অন্য আর কী হতে পারে? সেই প্রাচীনতম আন্তঃপ্রজন্ম সংঘাত। যাকে ও ভালবাসে ওর মা বাবা তাকে গ্রহণ করতে রাজি না। বুজরুগ আদমি দেখে সে আমার পরামর্শ চাইছে। বললাম, ভুল জায়গায় এসেছ। আমি অকৃতদার মানুষ। তবে মনে হয় আপাতত চুপচাপ থেকে পাশ করে চাকরিবাকরি নাও। আশা করি ততদিনে মা বাবার মন নরম হবে। সেই অতি সনাতন বাঙালি সমাধান। চাকরি-বাকরি পেলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। এর বেশি কী আর বলব? ছেলেটি আমাকে টরাস এক্সপ্রেসের রিজার্ভ করা সিটে তুলে দিল। তারপর হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখি গোটা দশেক অত্যন্ত দামি তুর্কি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে হাজির। বললাম, আমি তো সিগারেট খাই না। এ দিয়ে আমি কী করব? কিন্তু সে এসব কথা শোনার পাত্র না। বলল, কাউকে দিয়ে দিও। ট্রেন ছাড়া অবধি সে আমার সঙ্গে ছিল। পরে খেয়াল হল, ওর সঙ্গে তো আমার পরিচয় বিনিময়ও হয়নি। ভাবলাম, বোধহয় মানুষ মানুষের কাছে আসবার জন্য পরিচয় খুব প্রয়োজনীয় নয়। একই সুখ-দুঃখের বন্ধনে এই প্রজাতির শত কোটি জীব বাঁধা রয়েছে। সেই সুত্রে সবাই সবার পরিচিত, নিতান্ত কাছের লোক।
টরাস এক্সপ্রেসে কোনও ভিড় ছিল না। তবে মাঝে মাঝে কিছু যাত্রী উঠছে নামছে। নাম এক্সপ্রেস হলেও দামাস্কাস পর্যন্ত প্রায় লোকাল ট্রেনের মতোই চলে। ছোট ছোট সব স্টেশনে থামছে। দেখলাম গ্রামাঞ্চলের চেহারার সঙ্গে ইস্তাম্বুলের কিছু মিল নেই। যে-বোরখা শহরে একটিও দেখিনি, এ অঞ্চলে তা বেশ কিছু চোখে পড়ল। কিন্তু যে মহীয়সী মহিলা বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গাড়িতে উঠলেন, তাঁর অঙ্গে বোরখা ছিল না। চিত্তেও বোরখাসুলভ কোনও সঙ্কোচ বা লজ্জার চিহ্নমাত্র ছিল না। তিনি মাঝে মাঝে ভীমনির্ঘোষে বাচ্চাদের নানা আদেশ-উপদেশ দিচ্ছিলেন। তৎসহ দু-চারটে চড়চাপড়। সামান্য চা ভ্যা ধ্বনি। আর এক হায়দারি হাঁক। ব্যস, সব কিছু চুপচাপ। নট নড়ন নট কিচ্ছ। তারপর এক বিশাল বোঁচকা খুলে এক বিরাট কোনও পাখির শূল্যপক দেহ বের হল। তার জাতি নির্ধারণ করতে পারলাম না। সম্ভবত জটায়ুর কোনও বংশধর হবে। তার একটা বিশাল ঠ্যাং ছিঁড়ে নিয়ে মহিলা তাতে দাঁত বসালেন আর হাতে ছিঁড়ে চাঁই চাঁই মাংস শিশুদের দিলেন। কোলের শিশুটিও বঞ্চিত হল না। ঊর্ধ্বাঙ্গের জামাটি খুলে মা জননী তাকে স্তন্যপান করাতে শুরু করলেন। কিন্তু চরম বিস্ময়ের ব্যাপারটি শেষের জন্য তোলা ছিল। বাচ্চা স্তন্যপান বন্ধ রেখে হঠাৎ জটায়ুবংশজর দিকে দৃষ্টিপাত করল। জননী এক গাল হেসে উটপাখিটির (?) একটি ঠ্যাং ভেঙে বাচ্চার হাতে ধরিয়ে দিলেন। দন্তহীন শিশু অজ্ঞাত উপায়ে সানন্দে সেই পক্ষীমাংস খেতে লাগল। বুঝলাম চেঙ্গিজ খাঁ এই ভাবেই মানুষ হয়েছিলেন (জানি না কেন সাহেবরা ওঁকে গেঙ্গিজ বলতে শুরু করেছে)।
সসন্তান মা জননী নেমে যাওয়ার পর কামরা প্রায় খালি। আর একটি মাত্র যাত্রী, আমি ছাড়া। তিনি আরব না তুর্কি বুঝতে পারলাম না। কেউই কারও ভাষা জানি না। সেই পূর্বজন্মের প্রথম প্রিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের অবস্থা। একটা ভাষা সবাই বোঝে। সে ভাষাটা খিদের। ভদ্রলোক একটি বড়সড় এটাচি কেস খুলে কিছু খাবার বের করলেন। কাবাব আর রুটি। কাবাবে এক কামড় দিয়ে বাকিটা আমাকে দিতে চাইলেন। বুঝলাম, ও দেশে ওটাই রীতি। বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করছেন না সে কথাটা সপ্রমাণ বুঝিয়ে দেওয়া আর কি! ইঙ্গিতে জানালাম, ট্রেনে আমার খাবার অর্ডার দেওয়া আছে। কিন্তু এই অজুহাত বেশিক্ষণ চলল না। ইস্তাম্বুল বাগদাদ তিন দিনের রাস্তা। তার মধ্যে একটা বড় অংশে ট্রেনে ডাইনিং কার থাকে না। শুধু তাই নয়, পানীয় জলেরও কোনও ব্যবস্থা থাকে না। একথা যাত্রীদের আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়। আমি ধরে নিয়েছি যে ইস্টিশানে নিশ্চয়ই রুটি কাবাব পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই মরুযাত্রা যখন শুরু হল তখন দেখলাম স্টেশনের পর স্টেশন চলে যায়—জল ছাড়া আর কিছু কেউ বিক্রি করতে আসে না। সেই জল বাধ্য হয়ে শেষ অবধি কিনতে হল। খোলা বালতিতে করে জল বিক্রি হচ্ছে। কিনে দেখলাম তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পোকা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মরিয়া হয়ে পোকা বেছে জল খেলাম। কিন্তু পেটে যখন ছুঁচো ডন মারতে লাগল, তখন সত্যিই কাবু হলাম। আবারও ভদ্রলোক এক কামড় খেয়ে একটি শিক কাবাব জাতীয় বস্তু আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। এবার নিলাম। কিন্তু বাঙালি হিন্দু ঘরের ছেলে। উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ ব্যাপারটা একেবারেই সংস্কারের বাইরে। ইদিক উদিক তাকিয়ে কাবাবটিকে উল্টে নিলাম। তারপর অনুচ্ছিষ্ট দিকটায় কামড় বসালাম। আর মুখে পলাশের হাসি ফুটিয়ে শেষের অংশটা বাথরুমে গিয়ে ফেলে দিলাম।
বাগদাদ পৌঁছে বড়ই নিরাশ হতে হল। হারুন-অল-রশিদের শহর বলে কথা। কিন্তু এ তো দেখে মনে হল উত্তর ভারতের কোনও মফস্বল শহর। তাও লখনউ-ইলাহাবাদের সঙ্গে তুলনা হয় না। শুধু বাজারে গিয়ে এক অনাস্বাদিত বিলাসের সন্ধান পেলাম। চায়ের দোকানে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিতে, এক হুঁকোবরদার এসে হাতে এক গড়গড়া ধরিয়ে দিল। আর এক বালক এসে জুতো পালিশ করতে লাগল। ভাষা জানা নেই। সুতরাং তাদের বাধা দেওয়ারও উপায় নেই। ভাবলাম এরা আমাকে পথে বসিয়ে ছাড়বে। কিছুক্ষণ নবাবি করার পর ইঙ্গিত করলাম, এবার রেহাই দাও। বাড়ি ফিরব। বিল এল, ইংরেজিতেই লেখা। মনে মনে হিসাব করলাম, চা দু আনা, গড়গড়া এক আনা, জুতা পালিশ এক আনা-একুনে চার আনা। চার আনার নবাবির সুখ ভোগের সুযোগ আর কখনও পাইনি।
গাইড বই হাতে শহর প্রদক্ষিণে বের হলাম। দেখার মতো খুব কিছু নেই। বুঝলাম, হারুন-অল-রশিদের যুগ অনেক দিন গত। সত্যিতে আরব্য উপন্যাসের বাগদাদ নবম শতাব্দীর কায়রোর বর্ণনা। তখনই বাগদাদের গৌরব সূর্য যাকে বলে অস্তমিত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইংরাজদের বসানো এক রাজবংশ ইরাকে রাজত্ব করছে। তাঁদের হারুন-অল-রশিদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কাজের মধ্যে তাঁরা একটা জমকালো রাজপথ বানিয়েছেন। এছাড়া কোনও কীর্তি নজরে এল না। আমি যখন যাই তার অল্প পরেই বিপ্লব হয়ে ইংরাজদের বসানো রাজবংশ খতম হয়। এখন টেলিভিশনে দেখি বাগদাদে বড় বড় রাস্তাঘাট, সাদ্দামের তৈরি বিরাট বিরাট সব প্রাসাদ। আমার দেখা বাগদাদের সঙ্গে এই শহরের কোনও মিল নেই। শুনেছিলাম ব্যাবিলনের ধ্বংসস্তৃপও কাছেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম সেখানে কিছু দেখার কোনও সুব্যবস্থা নেই। পরে সাদ্দাম সাহেব এভান্সের আদর্শে উদ্দীপিত হয়ে নেবুকাডনেজারের আমলের অনেক কিছু পুনর্নির্মাণ করেছেন। গাইড বইয়ে দেখলাম, আব্বাসি খলিফাঁদের প্রাসাদ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার ঠিকানা দেওয়া নেই। শেষটায় অনেক খুঁজে পেতে স্থানীয় জাদুঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দরজার কাছে এক ছোঁকরা সিগারেট ফুকছিল। হাতে সেই ইংরিজি বই। জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বাসি বংশীয়দের প্রাসাদটা কোথায় জানো কি?” সোজা উত্তর, না। মিউজিয়ামে ঢুকেই দেখলাম ছোর্ট একটি প্লাকে লেখা আছে “এই ভবন এক সময়ে আব্বাসবংশীয় খলিফাঁদের প্রাসাদ ছিল!” কিন্তু ইট আর স্টাকোয় তৈরি এই প্রাসাদ দেখে একটু নিরাশ হলাম। মনে হল হারুন-অল রশিদের হয় পয়সা কড়ি বিশেষ ছিল না, নয় তো প্রাসাদ তৈরির ব্যাপারে ওঁর উৎসাহ কিছু কম ছিল। বড্ডই সাদামাটা।
হোটেলে ফিরে দেখি আমার ঘরে আর এক ব্যক্তি খালি গায়ে শুয়ে আছে। এইরকমই ব্যবস্থা ছিল। সস্তা করার জন্য শেয়ারের ঘর ভাড়া নিয়েছি। দুরাত ওখানে থেকে ট্রেনে বসরা যাব। সেখানে এক রাত থেকে জাহাজ ধরতে হবে। যখন হোটেলে ফিরেছি তখন দ্বিপ্রহরিক আহারের সময়। তারপর ওখানে সবাই ঘণ্টা দুই নিদ্রা দিয়ে আবার অফিস কাছারি করে। আমার সঙ্গে ঘরের ভাগীদারটির জন্য হোটেলের ছোঁকরা সেবক কিছু নান-এর মতো চেহারার রুটি নিয়ে এল। আবার সেই নাটক। এক কামড় খেয়ে আমাকে বাকিটা খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি। এবার আমি শক্ত হলাম। ‘শুক্রন’ শব্দটি উচ্চারণ করে প্রবল বেগে শিরঃকম্পন। এ ভাষা পৃথিবীর সবাই বোঝে। এক এস্কিমোদের কথা জানি না। যারা নাকে নাক ঘষে শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রেম ইত্যাদি সব আবেগ প্রকাশ করে তারা কীভাবে আপত্তি জানায় বলতে পারব না। যাক, ছোঁকরাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম, আমারও ওই রুটি কাবাব চাই। সেসব এল। বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খেলাম। বিকেলে বেড়াতে বের হয়ে দেখি ওই রুটিকাবাব ফুটপাথেই বিক্রি হচ্ছে। তবে আক্ষরিক অর্থেই ফুটপাথে। মানে একটা খবরের কাগজ বিছানোও কেউ প্রয়োজন মনে করেনি। পরদিন একটু খরচা করে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেলাম। ইঙ্গিতে বুঝলাম, সেদিন ওদের বিশেষ কোনও খাদ্য আছে। তাই আনতে বললাম। যা এল তা অখাদ্য, দুর্গন্ধ, অচৰ্য, খালি প্রচুর চর্বিতে ভরা। বস্তুটা কী জানতে চাইলাম। রেস্টুরেন্টের মালিক এক গাল হেসে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিলেন– উটের মাংস। ও জিনিস কেউ বিনা পয়সায় দিলেও খাবেন না।
রাতের ট্রেন ধরে সকাল বেলা বসরা পৌঁছলাম। সমরকন্দ বোখারার মতো বাগদাদ, দামাস্কাস, বসরা ছোট বেলা থেকে শোনা সব নাম। ইতিহাস আর আরব্য উপন্যাসের রোমান্সে রঙিন তাদের কল্পরূপ। কিন্তু এ কোন বসরায় এলাম? নোংরা ধুলোয় ভরা সব রাস্তা। বাড়িঘরে কোথাও কোনও সৌকর্য বা ঔজ্জ্বল্যের ছাপ নেই। থাকার মধ্যে শুধু আছে গলিতে গলিতে নাইট ক্লাব। তার বাইরে দেশি সিনেমার পোস্টারের স্টাইলে আঁকা নৃত্যশীলা স্কুল সব রমণীদের ছবি। বসরাই গোলাপের কথা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। কোথায় সেই গোলাপের বাগান? বুঝলাম তার নামও আজ বিস্মৃত। দুপুরের দিকে নদীর পাড়ের এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে আছি। এখানকার বিশেষত্ব জীবন্ত মাছ নদীতে জালের ভিতর রাখা থাকে। অর্ডার করলে তুলে এনে বেঁধে দেয়। হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে এক ব্যক্তি ভাঙা ইংরিজিতে কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন। তিনিই মাছটা অর্ডার দিলেন এবং দামও তিনিই দিলেন। বুঝলাম, আপত্তি করে কোনও লাভ হবে না। তারপর চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন, বসরা দেখেছি কি না। দেখার কি আছে জিজ্ঞেস করলাম। ফলে এক ট্যাক্সি ডাকলেন৷ তাতে চড়ে দু’জনে ওঁর মতে অসাধারণ দ্রষ্টব্য বসরার নতুন এয়ারপোর্ট দেখতে গেলাম। মানুষটার জন্য বড় করুণা বোধ হল। কিন্তু সেটা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ওর জীবনে তো কোনও অভাববোধ নেই। জুতোর দোকানের মালিক এই মানুষটি বেশ তৃপ্ত হাসিখুশি। তাঁর জন্মস্থান বসরা সম্পর্কে বিশেষ গর্বিত। তাকে করুণা করার আমি কে?
বসরার পোস্ট রেস্তাঁতে দুটি চিঠি অপেক্ষা করছিল। একটি পুনে শহরে গবেষণারত সিরিল লুইসের। জানিয়েছে, সে বোম্বাই এসে আমার জাহাজের অপেক্ষা করবে। আর একটি চিঠি ছিল, বাবার কাছ থেকে। জানিয়েছেন, যেন পথে আর দেরি না করি। কারণ দিল্লি থেকে চিঠি এসেছে আমাকে জাতীয় অভিলেখাগারের ডেপুটি ডিরেক্টরের পদের জন্য ইন্টারভিউতে উপস্থিত থাকার জন্য। এই চিঠিতে যে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের উত্থানপতনের বীজ নিহিত রয়েছে তা তখন জানা ছিল না।
বসরা থেকে আই. জি, এন, আর. এস. এন-এর জাহাজে বোম্বাই যাব। চেনা কোম্পানি কারণ কলকাতা বরিশালের স্টিমার এঁরাই চালাতেন। জাহাজে ওঠার পথে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। কাস্টমস শেডে সরকারি কর্মচারি আর যাত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড হাতাহাতি চলছে। হাতাহাতি না, আসলে মারামারিই। জাহাজে কী তোলা যাবে, বা যাবে না তাই নিয়ে বিতণ্ডা। শুনলাম কিছু যাত্রীরা যা তুলতে চাইছেন, তা আইনত তোলা নিষিদ্ধ। কিন্তু যাত্রীদের বক্তব্য, এটা ওঁদের বংশগত অধিকার। এই বিতর্ক মুষ্টিযুদ্ধ ছাড়া মেটাবার উপায় নেই। কে জয়ী হল তা দেখার অপেক্ষায় না থেকে মানে মানে জাহাজে উঠে পড়লাম। কুরুক্ষেত্রে দর্শকের কোনও ভূমিকা নেই। কাছাকাছি থাকলে ধর্মাধর্মের লড়াইয়ে সামিল হতে হয়। অধঃপতিত বাঙালি দেহে ওটা পোষাত না।
জাহাজে উঠে নদিনের বাসস্থান খুঁজতে লাগলাম। নামে আমরা ডেক প্যাসেঞ্জার। কিন্তু আসলে ডেকে কারও জন্যে নির্দিষ্ট কোনও জায়গা থাকে না। যতদূর বুঝলাম, ডেকে থাকা নিয়মসঙ্গতও নয়। কারণ, সমুদ্র উত্তাল হলে ডেক থেকে সমুদ্রে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। আমাদের নির্দিষ্ট ‘বার্থ’ জাহাজের গর্ভে–হোল্ডে, যার একদিকে মালপত্র থাকে। আমাদের ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে যেমন একটার উপর আরেকটা তিন প্রস্থ সাজিয়ে যাত্রীদের শোওয়ার ব্যবস্থা থাকে, কতকটা সেই রকম। তফাত শুধু এই যে, মার্চ মাসের ভ্যাপসা দম আটকানো গরমে সেখানে শয়ন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হাওয়া চলাচলের কোনও ব্যবস্থা নেই, কারণ জাহাজের হোন্ডে ও ব্যবস্থা থাকলে হাওয়ার সঙ্গে জলও ঢুকত। এই সব কারণে যাত্রীরা সবাই ডেকে উঠে নিজের নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। হোন্ডলের ভিতর আমার একটি দলা পাকানো স্লিপিং ব্যাগ ছিল। এবার সেটি কাজে লাগল। এক দল আফগানের পাশে আমি আমার জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করলাম। শুধু খাওয়ার সময় নিজের বার্থে ফিরতে হত। কারণ এনামেলের থালায় কারিভাত পরিবেশনের জন্য কোনও ডাইনিং রুমের ব্যবস্থা ছিল না।
এমন শান্ত সমুদ্র আমি আগে কখনও দেখিনি। বোম্বাই-এর কাছাকাছি পৌঁছবার আগে পর্যন্ত সমুদ্রে আছি, না কোনও শান্ত নদীপথে তা বুঝতে পারিনি। সত্যি পদ্ম আড়িয়াল খাঁয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি ঢেউ উঠতে দেখেছি। কিন্তু এই সমুদ্রযাত্রায় ফাউ হিসেবে পেলাম উড়ুক্কু মাছ। ওরা ঝাঁক বেঁধে ওড়ে আর কিছু মাছ পথভ্রষ্ট হয়ে জাহাজের নীচের তলার ডেকে এসে পড়ে। স্টিমারের অফিসার এবং সারেংরা তাদের সদ্ব্যবহার করেন। জাহাজের ডাক্তার এক বাঙালি ভদ্রলোক। তাঁর সুবাদে উড়ুক্কু মাছ বেশ কিছু পেটে গেল। রীতিমতো সুস্বাদু।
ডাক্তারবাবু দেশওয়ালি ভাই পেয়ে অনেক দুঃখের কথা শোনালেন। প্রথমত, বছরে বেশির ভাগ সময় পুত্রকন্যা থেকে দূরে থাকতে হয়। কোন ঘরমুখো বাঙালির এ ভাল লাগে? তবে এত মাইনে আর কোথায় পালে? অগত্যা! কিন্তু সত্যিকার সমস্যা জাহাজের যাত্রীদের নিয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা যে, ডাক্তারের উপর তাদের দাবির কোনও নির্দিষ্ট সীমা নেই। এবং ডাক্তারের কর্তব্য তাদের জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা। বেশির ভাগ মধ্য প্রাচ্যের যাত্রী একটি সমস্যা নিয়েই আসেন। তাঁদের সীমাহীন পৌরুষ আর একটু বাড়ানো যায় কিনা তার সন্ধানে। সাহেবরা এত কিছু করেছে আর এর জন্য কোনও ব্যবস্থা করেনি? এ কি বিশ্বাস করার মতো কথা! ওষুধ না বাতলালে তারা কাপ্তান সাহেবের কাছে নালিশ জানাবে। হ্যাঁ, কে তাদের বোঝায় যে তাদের পৌরুষ সম্ভাব্যতার চরম সীমায় পৌঁছেছে। আর বাড়ানো সম্ভব নয়, মানবজাতির পক্ষে মঙ্গলজনকও না। আর এক শ্রেণির ‘রোগী’ আসেন, যাঁদের ধারণা ডাক্তারবাবু তাঁদের চব্বিশ ঘণ্টার ক্রীতদাস। এক বিশালকায় কাবুলি ওঁকে রাত দুটোর সময় ঘুম থেকে তোলে। কী এমন সাঙ্ঘাতিক প্রাণঘাতী ব্যাপার ঘটেছে? না, মুহ মে থু আতা। থু ত মুহমেই আসে, অন্যত্র এলেই চিন্তার কারণ হত। ডাক্তারবাবুর জন্য সত্যই সহানুভূতিবোধ করলাম।
ডেকে থাকতে ভালই লাগত। অসুবিধার কারণ ঘটল নিতান্ত অপ্রত্যাশিত কারণে। সন্ধ্যে হলেই আফগানরা গান ধরতেন। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি সঙ্গীতের বিষয়বস্তু কী? জানলাম ইস্ক। তা হবে। আমি ভেবেছিলাম, রণসঙ্গীত, মানে যা যুদ্ধ জয়ের পরে গাওয়া হয়।
গালফের ধারে ধারে শেখদের রাজত্ব। এখন সে সব জায়গা ঐশ্বর্যে ফেটে পড়ছে। তখন তারা হতদরিদ্র। জাহাজ থামলেই ডিঙি নৌকা নিয়ে ছোট ছোট ছেলেদের ভিড়। সমুদ্রে আনি-দোআনি ফেলে দিলে তারা ডুব দিয়ে তুলে নিত। ওই খেলা দেখানোই তাদের জীবিকা উপার্জনের উপায়। আর কিছু মানুষ নৌকা করে শঙ্খ ইত্যাদি নানা সমুদ্রজ জিনিস বেচতে আসত। ওই অঞ্চলের যাত্রীরা অনেকেই কোথাও না কোথাও কুলির কাজে বহাল ছিল। নিজের দেশের কাছে এলে তারা প্রচণ্ড উৎসাহ আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠত। যখন দুবাই দেখা গেল তখন দুবাইবাসীরা হাততালি দিয়ে সমস্বরে গান ধরলেন “ওয়াহ ওয়াহ দুবাই”। এখন দুবাই দেখে আমারই ওই গান করার ইচ্ছে হয়।
পারস্য উপসাগর ছেড়ে আরব সমুদ্রে পড়তেই জাহাজ একটু একটু দুলতে শুরু করেছিল। বোম্বাই-এর কাছাকাছি এসে সে দুলুনি রীতিমতো ভয়াবহ হয়ে উঠল। আমি আমার ক্রিটের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে শয্যা নিলাম। উঠলাম বোম্বে পৌঁছবার পর।
জেটিতে কাস্টমস শেডে দেখি নরকের দৃশ্য। যাত্রীদের মালপত্র তছনছ করা হচ্ছে। কারণ শুনলাম এই জাহাজের খ্যাতি সোনা পাচার করার জন্য। আমার মাল সার্চ করার পালা যখন এল, অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন “কে হে তুমি বট? কী করা হয়?” বললাম, ছিলাম ছাত্র, আপাতত বেকার। পিঠ চাপড়ে লোকটি বলল, “আই শ্যাল ট্রিট ইউ লাইক এ ব্রাদার।” তারপর ঝোলাটি ঝেড়ে সব মালপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ফেলল। আর একটি ছুরি দিয়ে স্লিপিং ব্যাগটি দক্ষ হাতে ছিঁড়ে ফেলল। এই সব ভ্রাতৃজনোচিত কাজ শেষ হলে বলল, “সব ঠিক হ্যায়।” কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্য এই ভুল ধারণা নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, পেছন থেকে কে যেন শার্টের কলার টেনে ধরল। কী ব্যাপার? “সোনা চাঁদি যো কুছ হ্যায় নিকালো।” বললাম এই মাত্র আমার মাল সার্চ করা হয়েছে। সোনা চাঁদি কিছু পাওয়া যায়নি। লোকটি মুখ খিঁচিয়ে বলল, “আরে ও সব বহত শুনা। নিকালো তো।” বুঝিয়ে বললাম আমি নিতান্তই সম্বলহীন ছাত্র। ইংল্যান্ড থেকে ফিরছি। আমাদের মত মানুষের কাছে সোনা চাঁদি সাধারণত থাকে না। ইংল্যান্ড শুনে লোকটি একটু নরম হল। বলল, “আচ্ছা! মায়নে সোচা তুম বোরা মার্চেন্ট হ্যায়। গলত না মানো।” বুঝলাম মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছি। আমাকে দেখে কেউ অর্থবান বোরা ভাবতে পারে একথা জেনে পুলকিত হলাম। একটু এগিয়ে আর একটি বিয়োগান্তক নাটক দেখলাম। এক ব্যক্তিকে জাহাজে একটি ট্যাক্সিডার্মি করা সিংহের মাথা কোলবালিশ করে ঘুমাতে দেখেছিলাম। সে দেখি মাথায় হাত দিয়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কী ব্যাপার? সে আসছে উগান্ডা থেকে, সিংহমুণ্ডটিতে সোনা ভরা ছিল। কাস্টমসে কোনও অসুবিধে হয়নি। কর্তাদের অল্প কিছু দিতে হয়েছিল শুধু। কিন্তু মুটি বেজায় ভারি। বয়েস হয়ে গেছে। ওটা বইবার সামর্থ্য নেই। তাই কুলির মাথায় চাপিয়েছিল। এখন সেই সেয়ানা কুলি লাপাত্তা। পুলিশে যাবে সে উপায়ও নেই। কারণ তাহলে নিজেই বিপদে পড়বে। আবার বুঝলাম, দেশে ফিরেছি।
রাস্তায় বের হতেই সিরিলের সঙ্গে সাক্ষাৎ! আলিঙ্গন বিনিময়ের পর ও বলল, আজ আমার জন্য ও দারুণ এক ট্রিটের ব্যবস্থা করেছে। কী সেই অত্যাশ্চর্য আনন্দ? পকেট থেকে একটা সিনেমার টিকিট বের করে দেখাল। বিজয়ীর হাসি হেসে মুখে বলল, ‘ঝানক ঝ্যানক পায়েলি বাজে!’ ছবিটা ও পাঁচবার দেখেছে।
হ্যাঁ, একটা কথা লিখতে ভুলে গেছি। অক্সফোর্ড থেকে বোম্বাই এই পথ পার হতে লেগেছিল ঠিক নব্বই দিন। আর নিট খরচা হয়েছিল টিকিটের দাম ছাড়া একশো পাউন্ড। তখনকার টাকার হিসাবে তেরো শো’টাকা।